একুশে পা (Ekushey Paa) : 09
‘এনলাইট্ন্ড্ কো-অপারেশন… এই এখন একমাত্র পথ…
নির্বাচন নিয়ে উজ্জয়িনীর সঙ্গে মন কষাকষি হবার পর মিঠু যখন বাড়ি ফিরছিল তার মনটা কি রকম চুরমার হয়ে ভেঙে যাওয়া কাচের পেয়ালার মতো হয়ে গিয়েছিল। সে পা টেনে টেনে বাড়ি ফিরল। বুকের ভেতরের গুম গুম শব্দটা সে নিজেই শুনতে পাচ্ছে। অনেক কষ্টে অনেক দিন ধরে জোড়াতালি লাগিয়ে এই বন্ধুত্ব সে টিকিয়ে রেখেছিল। আর থাকবে না। উজ্জয়িনী চিরদিনের মতো তার থেকে দূরে অনেক দূরে চলে গেল। শুধুমাত্র ভুল বুঝে। বাড়ি ফেরার সময়ে সাধারণত বারান্দায় মা দাঁড়িয়ে থাকে। আজ বাবা-মা দুজনেই বসে আছে মনে হল। কিন্তু মিঠুর মনে হল কেউই নেই তার। সে দরজা খোলা পেয়ে ওপরে উঠল, মুখ-হাত ধুয়ে জামাকাপড় বদলে ঘরে আলো না জ্বালিয়ে পড়ার টেবিলে মাথা রেখে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর মায়ের গলা শোনা গেল বারান্দা থেকে, ‘কি রে মিঠু। খাবি না!’
‘না, ঋতুর বাড়ি অনেক খেয়েছি।’
বাবা চেঁচিয়ে ডাকল, ‘মিঠুমায়ি, এখানে এসে বসো।’
মিঠু ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল। বেশ প্রশস্ত ঝুল বারান্দা। মা বাবা দুটো বেতের চেয়ারে বসে আছে। বারান্দার কোণে একটা পেল্লাই টাইগার লিলি ফুটেছে। মিঠু একটা মোড়া নিয়ে গিয়ে বসেছে। মা বাবা গল্প করছে। হঠাৎ মিঠু মুখটা মায়ের কাঁধের কাছে গুঁজে দিল। মা কিছুই জিজ্ঞেস করছে না। বাবার কথা থেমে গেছে। মিঠু কাঁদছে বুঝতে পেরে অবশেষে বাবা বলল, ‘কি রে মিঠু?’
‘আমি খুব বাজে বাবা।’
‘কে বললে?’ বাবার গলায় হাসির আভাস। মা বলল ‘উজ্জয়িনীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বুঝি?’
‘কী করে বুঝলে?’ এবারে মিঠু মুখ তুলল।
‘সত্যি তো কী করে বুঝলে?’ —সাদেক বললেন।
অনুরাধা বললেন, ‘প্রত্যেকের জীবনে একটা করে সমস্যা থাকে, উজ্জয়িনীর সঙ্গে বন্ধুত্ব মিঠুর জীবনের সেই কেন্দ্রীয় সমস্যা।’ শুনে সাদেক গলা ছেড়ে হেসে উঠলেন।
‘বাবা তুমি চুপ করো তো, তুমি কিছু বোঝ না?’ মিঠু ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘ও মা! তুমি বাবাকে হাসতে বারণ করো না।’
‘কই, বাবা তো আর হাসছে না।’
‘বলো না ভোটের কী করব? উজ্জয়িনীকে তো আমায় দিতেই হবে।’
‘তো দিবি, সিক্রেট ব্যালট তো।’
‘না, বাবা, তুমি কিছু বোঝ না, বন্ধুদের মধ্যে ওরকম করলে ট্রেচারির মতো দেখাবে ব্যাপারটা। এমনিতেই তো উজ্জয়িনী আমায় সর্বক্ষণ ভুল বুঝছে। এর পর যদি রাজেশ্বরীও ভুল বুঝতে আরম্ভ করে…’
‘তো বল মা তারা দাঁড়াই কোথা? না কি রে মিঠু?’ বাবা হাসি হাসি মুখে বলল।
‘সোজাসুজি বলবি ওকে’, মা বলল।
‘আমিও তাই ভাবছিলাম। সোজাসুজি ওকে বলব, ওকেও আমি খুবই যোগ্য মনে করি, কিন্তু উজ্জয়িনীর সঙ্গে ছোট্ট থেকে বন্ধুত্ব, কাজেই উজ্জয়িনীকে আমায় দিতেই হবে।’
‘ঠিক।’ মা বলল!
‘সাদেক বললেন, ‘সবচেয়ে ঠিক, অর্থাৎ ঠিকেরও ঠিক ডিসিশন হল কাউকেই ভোট না দেওয়া।’
‘তা কি করে হবে বাবা। দুজনে দাঁড়িয়েছে যে।’
‘উদ্দেশ্যটা কী? ক্লাসের প্রতিনিধিত্ব? ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের অসুবিধে, ইত্যাদির কথা জানাতে যাচ্ছে, এই তো? ছাত্রদের হাতে কিছু ক্ষমতা আছে, কিছু বার্ষিক আয়-ব্যয় বরাদ্দ আছে, অ্যাকটিভিটিজ কিছু আছে সেইগুলো ঠিকঠাক চালাতে হবে, বুঝতে হবে, এই তো? তা এর মধ্যে ভোট-টোটের কী আছে? সবাই মিলে একজনকে মেনে নিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।’
‘ঠিক বলেছ বাবা, ঠিক। আমিও ঠিক এইভাবে ভাবি। সক্কলে বলে আমি কিছু বুঝি না। আকাশে পা দিয়ে হাঁটি। পার্টি নাকি থাকবেই।’
সাদেক বললেন, ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিসে ছুঁলে ছত্রিশ, আর পলিটিকসে ছুঁলে? রক্ষা নেই। ঘা গোনা যাবে না, এত।’
অনুরাধা বললেন, ‘এটা কি তুমি ঠিক বললে! অনেকগুলো মানুষ যেখানে জমেছে, সেখানে পছন্দ-অপছন্দের পার্থক্য তো হবেই।’
‘কথাটা তো পছন্দ-অপছন্দের নয়, রাধা, যোগ্যতার। যাকে যোগ্য মনে করছ তাকে পাঠিয়ে দিলেই তো হল। এই করে করে কমপিটিটিভ মনোভাবের বিষ ছোট ছোট ইউনিটে ঢুকে যাচ্ছে। সর্বত্র, সাবার মাথার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে এ ছাড়া পথ নেই, এটাই গণতন্ত্র। আসলে কিন্তু এসব গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে গোষ্ঠীতন্ত্র। গোষ্ঠীর স্বার্থতন্ত্র। একটা কলেজ। কতটুকু তার পরিধি? কাজ কী? না একটা পত্রিকা বার করা, একটা কি দুটো অ্যানুয়্যাল ফাংশন নাবানো, আজকাল ছাত্র প্রতিনিধি কলেজের গভর্নিং বডিতে থাকছে, নিজেদের অভাব-অভিযোগ সরাসরি জানাবার জন্য। এর জন্যে এত! মানুষে মানুষে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাচ্ছে যে। দেখো দেখি আমার ছোট্ট মেয়েটা মনে কত দুঃখ পেল? অথচ সবটাই শুধু শুধু। একেবারে অনর্থক। এনলাইট্ন্ড্ কো-অপারেশন, এই এখন একমাত্র পথ, মিঠু বুঝলি। সহযোগিতা আর সৌহার্দ্য এ ছাড়া বাঁচবার পথ নেই মা।’
মিঠুর মনে পড়ছিল গৌতমের সঙ্গে তার তুমুল তর্কের কথা। সে তা হলে তার সহজাত বোধ দিয়ে ঠিক জিনিসটাই বুঝেছে। তার মনটা আস্তে আস্তে হালকা হয়ে যাচ্ছে।
‘বাবা একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবে না?’ মিঠু আস্তে গলায় বলল।
‘মনে করব? হায় আল্লা, তাহলে বাবা হলাম কেন?’
মিঠু বলল, ‘বাবা আমার ধর্ম কী? আমি হিন্দু না মুসলিম?’
‘কোনটাই না হবার অতি দুর্লভ সৌভাগ্য তোর হয়েছে মিঠু। তুই পৃথিবীর সেই স্বল্পতম, একমুঠো মানুষের অন্যতম যাদের পেছনে ধর্মের ভূত ষাঁড়ের মতো তাড়া করছে না, যারা খোলা চোখে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি নিয়ে ধর্মের দিকে তাকাতে পারবে।’
‘কিন্তু বাবা, আমি যে লিখি আমি মুসলিম।’
‘কিন্তু তুমি জানো মিঠু, আচরণে তোমাকে আমরা হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান কিছু হতেই শেখাইনি। তোমার কোনও পূর্ব-সংস্কার থাকার কথা নয়।’
‘ধর্ম কি খারাপ?’
‘শোন মিঠু, চার ধরনের মানুষ ধর্ম তৈরি করেছে, তারাই ধর্ম ভোগ করে। এক নম্বর ভিতু, নার্ভের অসুখ এর, এই বিশাল জগৎ-ব্যাপারের সামনে, জীবনের জটিলতার সামনে এ ভয়ে জুজু হয়ে যায়। বোঝে না ভুবন বিশাল হলেও তার ওপর মোটেই ভুবনের ভার ন্যস্ত নয়। দু’নম্বর ক্ষমতালোভী, এ দেখে বেশ মজা তো, ধর্মের ভয় দেখিয়ে বা লোভ দেখিয়ে অনেক মানুষের ওপর দিব্যি ছড়ি ঘোরানো যায় তো! পাওয়াও যায় অনেক কিছু! এরা ভণ্ড, পাপিষ্ঠ, স্বার্থান্ধ, সব ধর্মের চার্চ এরা চালায়। তিন নম্বর কবি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কথা ভাবতে ভাবতে, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য এবং রহস্য অবলোকন করতে করতে এঁরা নানান অলঙ্কারের মধ্যে দিয়ে নিজেদের বিস্ময়, আকর্ষণ, ভক্তি প্রকাশ করেন, এঁরা কল্পনা করেন কোটি দেব-দেবী, তাঁদের নিয়ে বহু পুরাণ, এঁরা দেখেন পাখা-মেলে-উড়ে আসা দেবদূত, কণ্ঠ শোনেন জিব্রাইলের, এঁরা কল্পনা করেন এক জ্যোতির্ময় শিশু কোনও পিতার সাহায্য ছাড়াই ভূমিষ্ঠ হচ্ছে এবং বৃদ্ধ প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা তার পূজা করছেন। আর চার নম্বর হলেন দার্শনিক, আইডিয়া বা ভাবের জগতের লোক এঁরা, এঁরা কোনও না কোনও একটা তত্ত্ব দিয়ে বিশ্বরহস্যকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন, বিশ্বসংসারকেই নৈতিক পথে পরিচালিত করবার চেষ্টা করেন। এই চারটে শ্রেণীর মধ্যে একজনের ভেতর একাধিক প্রবৃত্তি থাকতে পারে। কিন্তু ধর্মের পেছনে যে উদ্দেশ্য-শক্তি কাজ করছে তাতে তুই এই চারটে ধারায় ভাগ করে ফেললে তোর বুঝতে সুবিধে হবে!
‘তাহলে কি বাবা, ঈশ্বর বলে কিছু নেই!’
‘এই রে! তা তো আমি বলিনি! কিছু একটা তো আছেই। কিন্তু তা এখনও পর্যন্ত আমাদের ধারণার বাইরেই আছে। ক্ষমতালোভীর দণ্ডচালনায় ভিতুর গলির মধ্যে ঢুকে সে বস্তুর খোঁজ পাওয়া যায় না!’
‘তাহলে কী বাবা, বিভিন্ন ধর্মে যে সব কথা পাওয়া যায় সেগুলো সব হয় চালাকি, নয় ভণ্ডামি, নয় কবিতা আর তা নয়ত হাইপথেসিস?’
‘কতকটা তাই। একটা জিনিস ভেবে দেখ—সব ধর্মগুলোই তো সৃষ্টি হয়েছে অনেক দিন আগে যখন বিজ্ঞানের চোখই ফোটেনি। বিশেষ করে প্রকৃতিবিজ্ঞান। এখন এইসব ধর্ম ইতিহাসের অন্তর্গত। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় এরা। গবেষকের চোখ দিয়ে দেখতে হবে এদের। খুঁজতে খুঁজতে তোর নিজের স্বভাবের সঙ্গে সামজ্ঞস্যপূর্ণ বলে কোনও তত্ত্ব তোর ভালো লেগে যেতে পারে, তখন তার থেকে আচার-আচরণ, মোল্লা-পুরোহিত এই সমস্ত খোসার মতো ছাড়িয়ে ফেলে তুই সে তত্ত্বের চর্চা করতে পারিস, সত্য কী জানি না, তবে সেই সত্যের কাছাকাছি পৌঁছনোর আনন্দটা পেতে পারিস!’
মিঠু বলল, ‘বাবা আমার ভাবতে ভালো লাগে একজন আছেন, তিনি আমায় রক্ষা করবেন, আমার ডাক শুনবেন। বাবা আমি কি ভিতুর দলে?’
‘নিঃসন্দেহে মা। তুই তো একা নয়। আমাদের বেশির ভাগের মধ্যেই এই ভিতু মানুষটা কম বেশি পরিমাণে থাকে।’
অনুরাধা বললেন, ‘না রে মিঠু, যদি কাউকে ডেকে ভরসা পাস নিশ্চয়ই ডাকবি, আস্তে আস্তে বুঝতে পারবি সে যে প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তায় সকল খানে!’
রাতের অন্ধকারে তিনজনে বসে রইলেন আধো-অন্ধকার বারান্দায়। অনুরাধা বললেন, ‘একটা গান ধর না মিঠু! তোরা বড্ড কথা বলিস। গান গা।’
‘কী গাইব বলো!’
অনুরাধা নিজেই ধরলেন, ‘কী আর চাহিব বলে, হে মোর প্রিয়…’। মিঠু ধরে নিল দ্বিতীয় পঙক্তি থেকে ‘তুমি যে শিব তাহা বুঝিতে দিও।’ মায়ের পরিণত গলা আর মেয়ের কাঁচা গলার ভক্তিরসে প্লাবিত হয়ে যেতে লাগল সদর্থে ধর্মহীন বাড়িটার সান্ধ্য বারান্দা।