একুশে পা (Ekushey Paa) : 08
‘আসল কথা না জেনেই এরকম করছিস…’
উজ্জয়িনী বাড়ি পৌঁছতে ওদের যে রান্না করে সেই যমুনাদি বলল, ‘জুনিদিদি মা তো আজও খেল না সকালে। কয়েক কাপ চা খেয়ে আছে খালি। এমনি করলে যে একটা অসুখ করে যাবে!’
মা-বাবাকে নিয়ে উজ্জয়িনী পড়েছে মহা মুশকিলে। দুজনের মধ্যে কথা-বার্তা নেই। প্রায় এক বছর হতে চলল। সে মাঝখানে সংযোগ রক্ষা করে চলেছে। বাবা ডক্টর রজত মিত্র, প্রচণ্ড রুক্ষ ভাষী, মেজাজী। বদরাগী। মা অমিতা মিত্র অনেকগুলো মেয়েদের সংস্থা চালান। কোথাও সেক্রেটারি, কোথাও প্রেসিডেন্ট। মার অভিমান, আত্মমর্যাদাজ্ঞান খুব বেশি। মা-বাবার মধ্যে শীতল যুদ্ধ চলছে অনেক দিন। যখন সে খুব ছোট ছিল, মনে পড়ে মা-বাবার হাত ধরে বেড়াতে যেত হংকং, সিঙ্গাপুর, ইয়োরোপ। সে-সব দিনগুলো কী সুন্দর ছিল। হাত ভরে যেত উপহারে। গাল ভরে যেত চুমোয়। মার কোলে, বাবার কোলে। সাত-আট বছর বয়স পর্যন্ত সে কোলে চড়েছে বাবার। এখনকার বাবাকে সে চিনতে পারে না।
সাড়ে ছটা প্রায়। সে মায়ের ঘরে ঢুকে ডাকল, ‘মা’।
মা বলল, ‘আজ এত দেরি করলি?’
‘ঋতুদের বাড়ি হয়ে এলাম, দরকার ছিল।’
‘কী খাবি?’
‘আমি খেয়ে এসেছি। এখন তুমি কী খাবে বলো?’
‘আমি আবার এখন…’
‘মা, এরকম যদি করো, আমি কিন্তু কোথাও চলে যাব।’
‘চলে যাবার ব্যবস্থাই তো হচ্ছে।’
‘মানে?’
‘তোমার বাবা তোমাকে স্টেটসে পড়তে পাঠাবেন।’
‘আমার তো এখনও পার্ট ওয়ানই হল না।’
‘তা জানি না, তুমি টোয়েফ্ল আর স্যাটে বসেছিলে, ভালো করেছ, কোন কোন য়ুনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করতে হবে, সেইসব বলছিলেন।’
‘তাই কি তুমি খাওনি?’ উজ্জয়িনী মৃদু স্বরে বলল, ‘মা, চলো না তুমি আমি দুজনেই চলে যাই। ওখানে আমরা বেশ থাকব দুজনে। কোনও ঝামেলা থাকবে না।’
তিক্ত হাসি হেসে অমিতা বললেন, ‘আমার কাছ থেকে দূরে রাখবার জন্যেই তো এত ব্যবস্থা! আমার যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।’
‘তোমার কাছ থেকে দূরে? আমি থাকতেই পারব না! আমি বাবাকে বলব মা? বলি, হ্যাঁ? যে আমরা দুজনে…’
‘খবর্দার জুনি। বলো না। হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। ওঁর ধারণা হয়েছে তোমার ওপর আমার প্রভাবটা বেশি হয়ে যাচ্ছে। সে জন্যেই এ ব্যবস্থা নিচ্ছেন। এখন যদি তুমি আমাকে পাঠাবার কথা বলো তো ওঁর আরও জেদ চেপে যাবে।’
উজ্জয়িনীর ঘরে একটা বেল বাজল। এখান থেকে শোনা যায়। এটা বাজছে বাবার চেম্বার থেকে। উন্নয়িনীর একদম যাবার ইচ্ছে নেই। সে বাবাকে, বাবার চেম্বারের ওই অংশটাকে একদম পছন্দ করে না। এই মাল্টি স্টোরিড বাড়িটাতে তাদের দুটো ফ্ল্যাট। আট তলায় একটা আর দোতলায় একটা। দোতলার ফ্ল্যাটটা বাবার চেম্বার, রোগীদের ওয়েটিং রুম, খাবার, রেস্ট রুম, কিচেন, টয়লেট সবই আছে। বেশির ভাগ সময়েই বাবা ওখানেই কাটান। দুপুরের খাবার ওখানে দিয়ে আসতে হয়। রাতটা ওপরে এসে খান। নিজের আলাদা ঘরে শোন। গত কয়েক মাস ধরে নিচেই শুচ্ছেন। সে অত্যন্ত অনিচ্ছুক পায়ে বেরিয়ে গেল, ইচ্ছে করে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল, যাতে দেরি হয়। পাশের দরজা দিয়ে, বাবার রেস্ট রুম দিয়ে সে চেম্বারে ঢুকল। পেছন থেকে দেখতে পেল বাবাকে। গাঢ় ব্রাউন রঙের সুট পরা। মাথার পেছন দিকটা পুরো টাক। টাকটার পর্যন্ত গোলাপি রং। ইস, সেই মহিলা ঘরে ঢুকছে। দেখে আপাদমস্তক জ্বলে গেল উজ্জয়িনীর। কী নির্লজ্জ, কী বেহায়া। এই বদমাস মহিলার জন্য তার মায়ের যত কষ্ট, যত অপমান! খুব নাকি সুদক্ষ ও. টি. নার্স। বাবার চেম্বারেও গত কয়েক বছর ধরে সন্ধে বেলায় ডিউটি দেয়। মানে চাকরি করে। একজন নাম্বার ওয়ান ও. টি. নার্স ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারে রোগী পরীক্ষায় সাহায্য করবার কাজ নিয়েছে! উজ্জয়িনীকে দেখে এক মুখ হেসে আবার বলছে, ‘কী জুনি! কেমন আছ!’ বিরস মুখে উজ্জয়িনী বলল, ‘ভালো।’ ফিরে ‘আপনি কেমন আছেন’টা সে বলল না। কেমন আছে দেখাই তো যাচ্ছে। গালে লালচে আভা। একটা দামী সিল্কের শাড়ি পরেছে। আজকে নার্সের পোশাকে নেই। কী মতলব, কে জানে!
বাবা চেয়ারটা ঘুরিয়ে উজ্জয়িনীর মুখোমুখি হল, বলল, ‘আমি কদিনের জন্যে শিলিগুড়ি যাচ্ছি। খুব জরুরি কেস আছে। কবে ফিরব বলতে পারছি না।’ বাবা পকেট থেকে একটা চেক-বই বার করে দুটো তিনটে ফাঁকা চেক খস খস করে সই করে দিল তলায়। বলল, ‘এটা রাখো।’ তারপর তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ফিরে আসি তোমার স্টেটস যাবার ব্যবস্থা সব পাকা করে ফেলব তারপর! এখানে কী হবে? কিস্যু হবে না।’ ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চলো শীলা, চলো।’ মসমস করে বেরিয়ে গেল বাবা, পেছন-পেছন সেই মহিলা—শীলা না অনুশীলা। হাতে আবার পাতলা একটা লাগেজ। উজ্জয়িনী তাড়াতাড়ি বারান্দায় ছুটে গেল। একটু পরেই সাদা অ্যামবাসাডর গাড়িটায় বাবা উঠল, পাশে উঠে বসল শীলা। মদন গাড়ির বুটে দুটো সুটকেস তুলে দিল। তারপর গাড়িটা দ্রুত বেরিয়ে গেল। যতক্ষণ দেখা গেল সাদা বিন্দুটার দিকে তাকিয়ে রইল উজ্জয়িনী। তারপর লিফটে চড়ে ওপরে চলে এলো।
সাড়ে আটটা নাগাদ উজ্জয়িনী বলল, ‘মা বড্ড খিদে পেয়েছে। দেবে?’ মা সেন্টারের কি সব মিলোনোর কাজ করছিল। বলল, ‘চল দিচ্ছি।’
‘দুজনে এক সঙ্গে বসব কিন্তু।’
‘ঠিক আছে।’
আস্তে আস্তে বসে বসে গল্প করতে করতে মাকে খাওয়ালো উজ্জয়িনী। সারা দিনের পর এই রাত সাড়ে আটটায় বোধ হয় কিছু পড়ল তাঁর পেটে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অমিতা বললেন, ‘যমুনা, সাহেবের খাবারটা রেডি করো, সময় হয়ে আসছে।’
ন’টার সময়ে ডক্টর মিত্র খান দুখানা আটার রুটি, এক বাটি চিকেন স্টু, একটু স্যালাড। এক গ্লাস দুধ খাবেন আরও রাতে, শোবার সময়ে।
উজ্জয়িনী বলল, ‘মা, বাবা জরুরি কল-এ শিলিগুড়ি চলে গেল।’
‘কখন?’ অমিতা ভুরু কুঁচকে বললেন।
‘এই তো, যখন আমায় ডাকল।’
‘সে তো অনেকক্ষণ। এতক্ষণ বলিসনি!’ অমিতা ফেলে ছড়িয়ে খেতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর মায়ের খাওয়া মোটামুটি শেষ বুঝতে পেরে উজ্জয়িনী বলল, ‘ওই মহিলা সঙ্গে গেল, অপারেশন আছে বোধ হয়।’
সতর্ক হয়ে বসলেন অমিতা, ‘কে? শীলা ভার্গব? শিলিগুড়ি গেল?’
গ্লাসের জলটা শেষ করে, অমিতা উঠে পড়লেন। নিজের ঘরে গিয়ে একটা বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছেন। একটু পরেই আবার উঠে পড়লেন। উজ্জয়িনী নিজের ঘর থেকে মায়ের চলা-ফেরা দেখতে পাচ্ছে। মা পায়চারি করছে, হাত মুঠো করল, রাগে মুখ থমথম করছে, তার পরেই মুখ কালো হয়ে গেল, মা আলো নিবিয়ে দিল, চেয়ারে পিঠ হেলিয়ে দিয়েছে, চোখের ওপর হাত চাপা।
এই প্রথম উজ্জয়িনী এমনি সময়ে মার ঘরে ঢুকতে সাহস করল, ডাকল ‘মা।’ চমকে চোখের ওপর থেকে হাত সরালেন অমিতা।
‘দিনের পর দিন এভাবে…কী লাভ?’
‘তুই গান-টান শুনগে যা জুনি!’
‘গান-টান শুনিয়ে ভুলিয়ে রাখবার দিন আমার চলে গেছে মা!’ তার গলার স্বর রূঢ়।
অমিতা আবার চমকে উঠলেন, বললেন, ‘কী বলবি, বল?’
‘তুমি সহ্য করছ কেন এ সব? আজ শীলা, কাল শর্বরী। পরশু রোজি। তোমরা মনে করো খুব স্থূলভাবে কিছু চোখের ওপর না দেখলে আমি বুঝতে পারব না? আমি এখন বড় হয়েছি, বন্ধু-বান্ধবের একটা সার্কল আছে আমার। আমি আর কতদিন এভাবে মরমে মরে থাকব? তোমরা একটা কিছু স্থির করো! কিছু একটা করো মা! সক্কলে জানে। তুমি মনে করো কেউ কারো খবর রাখে না? আমার পরিচয় পেলেই লোকে দ্বিতীয়বার ফিরে তাকায় তা জানো? আমি আর সহ্য করব না। সহ্য করতে পারছি না।
‘তোর বাবা তো তোকে খুব ভালোবাসে জুনি!’ একটু পরে অমিতা বললেন।
‘ওকে ভালোবাসা বলে না, দিবারাত্র মেয়ের চোখের সামনে মাকে অপমান করে, “জুনি আমি তোমাকে স্টেটস পাঠাব।” ভেংচে উঠল উজ্জয়িনী। ‘নিজের ক্ষমতা দেখানো হচ্ছে? আমার চাই না ওই বাজে লোকটার ভালোবাসা, যে তোমাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে, তাকে আমি বাবা বলে মানতে পারব না। বলে দিলাম এই শেষ কথা।’
শিউরে উঠে অমিতা বললেন, ‘এদিকে আয় জুনি।’
মেঝেতে কার্পেটের ওপর বসে জুনি চেয়ারে বসা মায়ের কোলো মাথা রাখল। অমিতা তার চুলে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘যতই হোক। তোর বাবা। বাবার সম্পর্কে ওভাবে বলিস নি।’
‘তাহলে তুমি প্লিজ এবার ডক্টর মিত্রকে আলটিমেটাম দাও।’
‘কী হবে দিয়ে? উনি বলবেন, তোমার না পোষায় তুমি চলে যেতে পার।’
‘যাব। তাই যাব মা। তুমি আর আমি চলে যাব।’
‘ডিভোর্স করতে বলছিস?’
‘হ্যাঁ, তাই করবে দরকার হলে।’
‘অনেকবার ভেবেছি। তোর কথা মনে করে পারি না যে জুনি।’
‘আমার কথা? এই অশান্তির চেয়ে লজ্জার চেয়ে বরং আমি অন্য যে কোনও অবস্থায় থাকতে রাজি আছি। এই লজ্জা, এই ঘেন্না নিয়ে দিনের পর দিন…’
উজ্জয়িনীর চোখ দিয়ে গরম জল পড়তে লাগল।
অমিতা বললেন, ‘তুই চিরদিন খুব আদরে মানুষ জুনি। পারবি না। বলা সোজা, কিন্তু কষ্ট সহ্য করা ভীষণ শক্ত কাজ, পারবি না।’
‘কী বলছ মা! আমি এত মীন যে তোমার এত অপমানের পরও স্রেফ বিলাসের লোভে এই ঘৃণ্য বাড়িতে ওই ঘৃণ্য ভদ্রলোকের সঙ্গে থাকব? আমাকে তুমি এত ছোট মনে করো?’
‘তুই আমাকে খুব ভালোবাসিস না রে?’ অমিতা ভিজে-ভিজে গলায় বললেন।
উজ্জয়িনী জবাবে মায়ের হাঁটু দুটো আরো জোরে চেপে ধরল, সজল গলায় বলল, ‘তোমাকে ভালোবাসায় আমার তো কোনও বাহাদুরি নেই মা। মাকে সবাই ভালোবাসে। কিন্তু তুমি তো কবে থেকেই আমার মা-বাবা সবই। তোমাকে কেউ কষ্ট দিলে আমার মনে হয় তাকে…তাকে.. তা ছাড়া ওই ভদ্রলোককে আমার আজকাল বাবা বলে মনে হয় না।’
‘জুনি, তোর বাবাকে ডিভোর্স করা আমার পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়।’
‘কেন? ঠিক আছে এবার বাবা ফিরলে আমি, আমিই যা বলার বলব, আই’ল হ্যাভ এ শো-ডাউন উইথ হিম।’
‘না না’, ভীষণ ব্যস্ত হয়ে অমিতা বললেন, ‘অমন কাজও করিস নি, মাথা গরম করিস নি। সর্বনাশ হয়ে যাবে।’
‘কিসের সর্বনাশ! একজন চরিত্রহীন লোককে বাবা বলে পরিচয় দেবার চেয়েও সর্বনাশ! মা তোমাকে আমি এই কদিন ভাববার সময় দিলাম। এর মধ্যে তুমি যা হয় ঠিক করো।’
‘ওরে না না, এসব বলিস নি, জুনি এসব বলিস নি।’ অমিতা আকুলভাবে মাথা নাড়তে লাগলেন।
‘তাহলে, তুমি কি এখনও, এসব সত্ত্বেও বাবাকে ভালোবাসো? বলো! জবাব দাও!’
অমিতা মাথা নাড়তে থাকেন।
‘তাহলে এই সুখ, ঐশ্বর্য, বিলাস, স্ট্যাটাস এই সবের জন্যে ছাড়তে পারছ না? বুঝেছি।’
‘কিছুই বুঝিস নি। শোন জুনি, তোর একটা ভালো দেখে বিয়ে হয়ে যাক। তারপর, তার-পর আমি তোর বাবাকে ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে যাব। ডিভোর্স-টিভোর্স কিচ্ছু লাগবে না। স্রেফ এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। আমার যা গয়নায়গাঁটি আর নিজস্ব টাকা আছে তাতে আমার কোনক্রমে চলে যাবে। জুনি ভালো পাত্র দেখা আছে আমার, দেখলেই তোর পছন্দ হবে। তুই বাবাকে বলবি তোর পছন্দের কথা, উনি এটাতে আপত্তি করবেন না, তারপর…’
‘কী বাজে কথা বলছ? মোটেই আমি এখন বিয়ে করতে রাজি নই মা! তোমাদের দেখে দেখে বিয়েতেই আমার ঘেন্না ধরে গেছে।’
‘তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব ছেলেটির, শুভংকর, তোর বড় মেসোর বন্ধুর ছেলে, দেখেছিস না দেবারতির বিয়েতে!’
ভুরু কুচকে উজ্জয়িনী বলল, ‘তুমি কি ভাবছ, ডিভোর্স করলে বা ওই রকম কিছু করলে আমার বিয়ের অসুবিধে হবে? সে রকম ছেলেকে আমি বিয়েই করব না জেনে রাখো সেটা।’
‘আমার বড্ড মাথা ধরেছে জুনি, আমায় একটু চোখ বুজোতে দে এবার। সামনে ক্যাশ মিলিয়েছি আর ক্যাশমেমো কেটেছি সকাল থেকে। একটু বিশ্রাম দরকার।’
‘ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি এখন, কিন্তু এ প্রশ্নের জবাব না দিলে ভালো হবে না।’ উজ্জয়িনী চলে গেল নিজের ঘরে। সামনে একটা আমজাদ আলির ক্যাসেট পেলো, সেটাই চড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ পর একটা বিশ্রী আওয়াজ পেয়ে অমিতা মেয়ের ঘরে ছুটে এলেন। উজ্জয়িনী ক্যাসেটটাকে বার করে প্রচণ্ড জোরে ঘরের কোণে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। সে আরও ক্যাসেট বার করছে, সেগুলো দুমড়ে ভেতরে থেকে টেপগুলো বার করবার চেষ্টা করছে। তার মুখ-চোখ রাগে, চোখের জলে মাখামাখি। সে একটা বহু মূল্যবান পাথরের চতুর্ভুজ বিষ্ণুমূর্তি তুলে ধরতে যাচ্ছিল, অমিতা তাড়াতাড়ি এসে তার হাত ধরলেন, ‘ছাড় জুনি, ছাড় বলছি! উজ্জয়িনী হাত তুলে নিল মূর্তিটা থেকে, তারপর ক্ষিপ্ত গলায় বলল, ‘সব ভেঙে চুরে ফেলব, যা যা দিয়ে এতদিন এই নরকটা সাজিয়েছ, সব, স-ব চুরমার করে ফেলব, ফেলে যে দিকে দু চোখ যায় চলো যাব।’
অমিতার চোখদুটো ভয়ে বড় বড় হয়ে উঠেছে, তিনি বললেন, ‘আসল কথা না জেনেই এরকম করছিস? জানলে তাহলে কী করবি? ওঃ ভগবান, কী বিপদেই পড়লুম।’
হঠাৎ উজ্জয়িনী শান্ত হয়ে গেল। বলল, ‘কী আসল কথা মা? বলো না, আমি তো বড় হয়ে গেছি, এত বড় মেয়ের কাছ থেকে কিছু লুকোনো যায় না। আমি অন্যভাবে জেনে নেবই। তখন তোমার মুখ কোথায় থাকবে?’
অমিতা তার চোখের জলে ভেজা লালচে মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, ‘তুই যে আগে তোর বাবার মেয়ে। তোর বাবা দয়া করে আমার হাতে তুলে দিয়েছে তাই আমার হয়েছিস মা।’
অমিতার চোখ ছলছল করছে, ঘরে ঘড়ির বাজনা শুরু হল। সাড়ে ন’টা বাজছে। অমিতা বললেন, ‘তুই একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান নার্সের মেয়ে। তোর জন্মের সময়ে সে মেয়েটি মারা যায়। রাঁচির ভেতর দিকে একটা মিশনারি হাসপাতালে ডেলিভারি হয়েছিল। ওরাই তোকে রাখতে চেয়েছিল। আমি নিঃসন্তান। স্বামী থেকেও নেই। তোকে আমি চেয়ে নিই। সবাই জানে তুই আমারই মেয়ে, তোক নিয়ে পুরো এক বছর আমি ওই মিশনারি প্রতিষ্ঠানে কাটাই। আত্মীয়রা জানত আমি স্বামীর ওপর রাগ করে চলে গেছি, তারপর—বাচ্চা হবে বুঝতে পেরে আবার ফিরে এসেছি। তোর বাবা আর আমি ছাড়া এ কথা আর কেউ জানে না। রাগারাগি করে যদি আমরা পরস্পরকে ছাড়ি, তুই যদি আমার কাছে থাকতে চাস, তোর বাবা সেটা হতে দেবে না। তোর আসল জন্মবৃত্তান্ত প্রকাশ করে দেবে।’
পাথরের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল উজ্জয়িনী। তার দেহ কি রকম অসাড় হয়ে যাচ্ছে। চোখ ঝাপসা। পায়ের তলায় মাটি দুলছে। অমিতা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলেন। মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘তোর পাঁচ দিন বয়স থেকে তোকে বুকে করে বড় করেছি। আমি নিজেই ভুলে গেছি তুই আমার কোলে জন্মাসনি। আমিই তোর সত্যি মা। তুই ছাড়া পৃথিবীতে আমার কেউই নেই। চলছি যে এতদিন ধরে, কাজ করছি, সংসার করছি, সামাজিকতা করছি, সবই তোর জোরে। তুই না থাকলে আমিও নেই। আজ এইভাবে তোর বাবা এক দিক থেকে তুই আরেক দিক থেকে আমাকে বড্ড কোণঠাসা করলি, নইলে কোনও দরকার ছিল না তোর জানবার। তোর বার্থ সার্টিফিকেট পর্যন্ত আমার নামে। তোর বাবা নিজে ডেলিভারি করিয়েছে বাড়িতে এই মর্মে করিয়ে নিয়েছিল, সেটা তো তোর ফাইলে দেখেছিস…..’
উজ্জয়িনীর চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। এই মা সাদা খোলের টাঙাইল শাড়ি পরা মাথার খোঁপা ভেঙে পড়েছে, মার চুলগুলো ডান দিকের খানিকটা সাদা হয়ে গেছে। কপালে ছোট লাল টিপ। অনেক দূর থেকে এই মূর্তিটা দেখতে পাচ্ছে উজ্জয়িনী। মা বক্তৃতা করছে, মুখ দিয়ে অনর্গল শব্দ বেরিয়ে আসছে, উদ্দীপিত হচ্ছে কত সমাজসেবী, মহিলাদের উন্নয়নের জন্য মা ভীষণ পরিশ্রম করে, অনেক পদস্থ লোক খাতির করেন মাকে। যেমন রাজ্যপাল, মন্ত্রী, এম.পি, বড় বড় ব্যবসায়ী বাড়ি, বিশেষ সম্মান দিয়ে কথা বলেন মার সঙ্গে। এই মাতৃমূর্তি উজ্জয়িনীকে গর্বে, আনন্দে, আশায়, বিশ্বাসে ভরে দেয়। এই মা তার না!
ভালো করে মার দিকে চাইল উজ্জয়িনী, অমিতা বললেন, ‘এই নিয়ে তুই ব্রুড করলে আমিও আমার মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারব কি না বলতে পারছি না। সারা জীবনটা বড্ড ঝড় গেল রে জুনি, আর কি পারব…’
অমিতা কাঁদছেন না। তিনি খুব শক্ত মেয়ে। কিন্তু কান্নার জন্য শুধু চোখের জলই দরকার হয় না। উজ্জয়িনী দেখল তার মার দু চোখে অতল অন্ধকার, তিনি যেন কোথাও আর এতটুকু আলো দেখতে পাচ্ছেন না।
সে আস্তে আস্তে মার ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মা। আমি ব্রুড করব না। করব না কথা দিচ্ছি তোমায়। সার্টিফিকেটে তো তোমারই নাম আছে। তাহলে তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?’
‘আসলটা, রাঁচির সেই হসপিটালের ডিসচার্জ সার্টিফিকেটটা তোর বাবা নিজের কাছে রেখে দিয়েছে।’
মা এখন উজ্জয়িনীর খাটে তার পাশে শুয়ে পড়েছে। উজ্জয়িনী পাশ ফিরে ডান হাত দিয়ে তার মাকে জড়িয়ে আছে। এক বালিশে দু’জনের মাথা। মায়ের দু চোখ বোজা। উজ্জয়িনী লুকিয়ে লুকিয়ে মাকে দেখছে। কী ক্লান্ত! কী সর্বহারার মতো দেখাচ্ছে। কী দুঃখিনী এই মা তার! কত আশা নিয়ে হয়ত একদিন জীবন আরম্ভ করেছিলো, কানাঘুষায় শুনেছে বাবা মাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল, প্রচণ্ড আপত্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। সেই বিবাহের এই পরিণতি! ‘স্বামীর মিসট্রেস’ বাংলা প্রতিশব্দটা মনে মনেও উচ্চারণ করতে পারল না সে, স্বামীর ‘মিসট্রেস’-এর মেয়েকে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করেছেন, এখন তাকেও কেড়ে নেবার পরিকল্পনা হচ্ছে। উজ্জয়িনী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—সে কখনও কাউকে বিয়ে করবে না, কোনও পুরুষকে সে ভালোবাসবে না। বাবার যে প্রিয় ছাত্রটি গত জন্মদিনে তাকে এক বাক্স ফরাসী পারফুম দিয়েছে, সে বুঝতে পারে বাবার প্রশ্রয়ে সে একটু একটু করে তার দিকে এগোচ্ছে, তাকে তো না-ই, মায়ের নির্বাচিত ওই শুভঙ্করকেও কদাপি নয়। পুরুষ জাতির প্রতি নিবিড় নির্মম ঘৃণায় তার শরীর-মনের প্রতিটি রন্ধ্র পূর্ণ হয়ে গেল বুঝি বা। কেউ কেউ বলে তাকে বাবার মতো দেখতে। কিন্তু বেশির ভাগেরই মত সে নাকি বসানো অমিতা মিত্র। স্নেহ-ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে মায়ের আদলটুকুও কি অলৌকিকভাবে তার শরীরে বয়ে এসেছে? বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে ভাববার পর উজ্জয়িনী একেবারে স্থির নিশ্চিত হয়ে গেল অলৌকিক ব্যাপার পৃথিবীতে আছে। এবং সবার ওপরে ভাগ্য সত্য। অবিবাহিত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান নার্সের মেয়ে, রাঁচির মিশনে আর পাঁচজন অনাথ এবং আদিবাসীর সঙ্গে মানুষ হবার কথা তার। এখন হয়ত তার জন্মদাত্রী মায়ের মতো সে নার্সিংই শিখছে, কিংবা শর্ট-হ্যাণ্ড টাইপ-রাইটিং। এত জ্বলজ্বলে রঙ তার, সুন্দরী বলে সবাই। সে এতদিনে আবার কোনও নারীখাদকের গর্ভে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে, হত। এই অমিতা মিত্র যদি সমস্ত লজ্জা-ঘেন্না-কষ্ট চেপে তাকে বুকে করে না নিতেন। অতুল ঐশ্চর্য, বংশ পরিচয়, স্ট্যাটাস, নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা, সবার ওপরে এই মা, এই মহীয়সীকে মা বলে সে পেয়েছে। এত ভাগ্য কল্পনা করা যায়!
দুজনের কেউই ঘুমোচ্ছে না। দুজনে দুজনকে পৃথিবীর একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রিয়জন বলে অনুভব করছে। এভাবে থাকতে থাকতেই উজ্জয়িনী বুঝতে পারল—এই স্ট্যাটাস, এই নিজের হাতে গড়া সাজানো-গোছানো বাড়ি, ঘরসংসার, সামাজিক প্রতিষ্ঠা এই বয়সে ছাড়তে মায়ের কী অসহ্য কষ্ট, কী লজ্জা হবে। প্রধানত তার জন্য, তাঁর মেয়ের জন্যই তিনি তাঁর শূন্যগর্ভ ঘরের চারপাশ এমনিভাবে গড়ে তুলেছেন, তারপর এক সময়ে এটাই তাঁর অভ্যাস, তাঁর জীবন হয়ে গেছে। স্টেটস যাওয়াটা সে যেমন করে হোক ঠেকিয়ে রাখবে, যেভাবে হোক, খুব সাবধানে কূট বুদ্ধি করে চলতে হবে। বুঝতে দিলে চলবে না মাকে ফেলে যেতে হবে বলেই সে যেতে চায় না। কিন্তু কী উপায়ে মাকে এই প্রতিদিনের অপমান থেকে বাঁচানো যায়, কিভাবে?’
ভাবতে ভাবতে একটা দিবাস্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়ল উজ্জয়িনী। বাবা যেন ঘুমোচ্ছে। ওই তো ওদিকের ঘরে। রাত এগারোটা কি বারোটার সময়ে। এক গ্লাস দুধ নিয়ে যাচ্ছে সে বাবার জন্যে, বাবা ওপরে শুলে সে সব সময়েই এটা নিয়ে যায়। বাবা রাত-আলোটা জ্বেলেছে। পায়জামা পাঞ্জাবি পরেছে, রুক্ষ চোখে যতটা সম্ভব স্নেহ নিয়ে বাবা তাকাচ্ছে উজ্জয়িনীর দিকে। —‘কী রকম পড়াশোনা চলছে? জুনি, তোমাকে আমি স্টেটস পাঠিয়ে দেব। এখানে কী হবে? কিস্যু হবে না।’ দুধটা এগিয়ে দিচ্ছে উজ্জয়িনী, ড্রয়ার থেকে একগাদা ওষুধ বার করে খাচ্ছে বাবা, দুধের সঙ্গে, শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশের বালিশটা আস্তে আস্তে তুলে নিয়েছে সে, বাবার মুখের ওপর জোর করে চেপে ধরেছে। হাই ডোজে ঘুমের ওষুধ খায় বাবা। নেতিয়ে থাকে এখন। দুর্বলভাবে নড়াচড়া করছে। কিন্তু উজ্জয়িনীর গায়ে খুব জোর। সে প্রাণপণে বালিশটা চেপে উপুড় হয়ে আছে।
‘জুনিদিদি, চা এনেছি, মুখ ধুয়ে এসো’ —চমকে উঠে বসল উজ্জয়িনী। সে ঘামে ভিজে গেছে। সামনে যমুনাদি। মা ঘরে ঢুকছে। বোধ হয় মুখ-চোখে জল দিয়ে এলো। সেই কালচে ভাবটা এখনও মায়ের মুখ থেকে পুরোপুরি যায়নি। কিন্তু মুখ এখন শান্ত। কাল রাতে যে নিদারুণ মনঃকষ্ট, দ্বন্দ্ব আর দিশা হারানোর আঁচড় দেখেছিল, সেগুলো আর দেখা যাচ্ছে না। মা তুমিও কি দিবাস্বপ্নে কাউকে? …না মায়ের দিবাস্বপ্ন অন্য রকম হবে। মাকে দেখেই বুঝতে পারছে উজ্জয়িনী। পরে, অনেক পরে, যদি পরিবেশ অনুকূল বলে বুঝতে পারে, তা হলে মায়ের দিবাস্বপ্নের কথা সে জিজ্ঞেস করবে। আপাতত যে কটা দিন বাবা বাইরে থাকে, সে আর মা, তার মা, দুজনে মুক্ত।