Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » একুশে পা || Bani Basu » Page 7

একুশে পা || Bani Basu

‘এতক্ষণ আমাতে অমিতেতে আড্ডা মারছিলাম..

বাবা-মার ঘরটাতে ঢুকল ঋতু। দুদিকে দুটো খাট। মাঝখানে পর পর দুটো আলমারি। বারান্দার দিকের দরজার পাশে ড্রেসিং টেব্‌ল। এখন একদম ফাঁকা। বাবাদের যাওয়া পেছোতে পেছোতে জানুয়ারি হয়ে গেল। মিসেস মীনাক্ষী দাশ রকমারি প্রসাধন-দ্রব্য তাঁর কসমেটিক্‌স্‌ বক্সে পুরে নিয়ে গেছেন। প্যারিসের রাস্তায় রূপসী যুবতী সেজে বেড়াবেন। ঋতু নিজেই গুছিয়ে দিয়েছে সুটকেসটা। গাঢ় অরেঞ্জ, বেগনি সব শাড়িগুলো জোর করে দিয়ে দিয়েছে সে। মা খুব আপত্তি করছিল।

ঋতু বলেছিল, ‘এই লাস্ট চান্স মাম্মি পরে নাও।’ অরেঞ্জ শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং পলার সেট, বেগনি কাঞ্জিভরমের সঙ্গে আলেকজান্ডার স্টোন, সব মিলিয়ে মিলিয়ে দিয়েছে। খালি লালটা মা কিছুতেই নিতে রাজি হল না। বয়স্ক মহিলারা যখন চড়া রঙের শাড়ি পরে, রঙচঙ মেখে, রাজ্যের গয়নাগাঁটি পরে ঘোরে তখন ঋতুর ভীষণ হাসি পায়। অনেকে আবার ব্লাশার মাখে। আই শ্যাডো ব্যবহার করে দিনের বেলাতেও। ঋতুর মা মোটামুটি ভালোই দেখতে, খুব কিছু মোটা হয়ে যায়নি, চুলও আছে বেশ, সামান্যই। পেকেছে, অনেকেই বলে সোমার দিদির মতো লাগে দেখতে। এটা নিয়ে মার একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে বুঝতে পারে ঋতু। ভাগ্যিস ঋতুকে কেউ মায়ের বোন বলে না। তাহলে তার সঙ্গে তার এক হাত হয়ে যেত। মায়ের সাজ দেখতে হয় বাবার সঙ্গে কোথাও বেরোলে। সোমার সঙ্গে বেরোলে খুব হালকা সাজবে। সাদার ওপর বুটির টাঙ্গাইল পরবে, গাদোয়াল পরবে, সোমা যদি বলে, ‘মা পরো না পিঙ্ক শাড়িটা,’ মা বলবে, ‘দূর, তোর মা না!’ ঋতুর সঙ্গে বেরোলে আর একটু চড়ে মায়ের সাজ। কিন্তু বাবার সঙ্গে বেরোলে সাজের কী ধূম! অত রঙ লাগালে, কড়া লিপস্টিক মাখলে আরও বুড়োটে দেখায় মা জানে না। ঋতু এখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারাটা আপাদমস্তক দেখল। জিভ বার করে, ঘাড় ঘুরিয়ে, দাঁত বার করে হেসে, ভ্রূকুটি করে, নানা ভাবে। ঋতুর চেহারার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্য যে তাকে ভীষণ বাচ্চা-বাচ্চা দেখতে। একরাশ বাদামি চুল। সোজা কানের পাশ দিয়ে পিঠের ওপর, বুকের ওপর নেমে এসেছে। মসৃণ গমের মতো রঙ। বড় বড় বিস্ফারিত চোখ। ঠোঁট দুটো ফোলা-ফোলা, যে কোনও মুহূর্তেই আবদারে ফুলতে পারে। সোমা খুব লেডি-লাইক। তার পাশে ঋতু যেন খুকি। আয়নাটাকে জিভ ভেংচে, ঋতু বিছানার ওপর ধপাস করে বসে পড়ল।

‘বাসন্তী, বাসন্তী, শিগগিরই এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খাওয়াও।’

বাসন্তী ঋতুর ছোট্ট থেকে আছে। এক রকম মানুষই করেছে তাকে। কিন্তু ঋতু তাকে বাসন্তীই বলে। সে বাবা-মা ছাড়া আর সকলকেই প্রায় নাম ধরে ডাকে। দিদিকে সোমা, দিদির বরকে অমিত, বাবাকেও মাঝে মাঝে আদর করে নাম ধরে। সে বলে, ‘নামটাই তো পরিচয়। তা ছাড়া বাসন্তী ইজ দাসী। হাজার মাসি-পিসি ডাকলেও সে দাসীই থাকবে, ওসব ডাক এক ধরনের ভণ্ডামি।

বাসন্তী জল এনে দাঁড়াল। এক হাতে জল খেতে খেতে অন্য হাত তুলে বাসন্তীকে দাঁড়াতে বলল ঋতু। তারপর গ্লাসটা ড্রেসিং টেব্‌লের ওপর রেখে খাটের কোনায় হাত দিল। বলল, ‘হাত লাগাও তো, খাটদুটোকে জুড়তে হবে।’ মাঝখানের কার্পেটটাকে সে আগেই গুটিয়ে রেখেছে।

বাসন্তী বলল, ‘কেন?’

‘যা বলছি করো। কেন আবার কী? সোমারা আসবে না? এখানে থাকবে না?’

চটপট খাট জোড়া হয়ে গেল। আলমারি থেকে তোয়ালে, নতুন সাবান বার করে বাথরুমে রেখে আসা হল। বসবার ঘর থেকে বাবার ছোট্ট লেখার টেবিলটা আর দুটো চেয়ার সে শোবার ঘরের অন্য কোণে আলোর ঠিক তলায় রেখে দিল। এয়ারপোর্ট থেকে ফেরবার পথে অনেক ফল কিনে এনেছিল, সেগুলো ভালো করে মুছে ফ্রিজের মাথায় রেখে দিল। একগুচ্ছ লাল গোলাপ রাখল শোবার ঘরে টেবিলটার ওপর। এরপর একটু দূর থেকে সবটা দেখে বেশ পরিতুষ্ট মুখে নিজের ঘরে ঢুকে, দু ঘরের যোগাযোগের দরজাটা বন্ধ করে দিল।

সোমারা না এলেই সে খুশি হত। কিন্তু জানা কথাই, বাবা-মা তাকে এতদিন বাসন্তীর ভরসায় একা রাখবে না। যাই হোক, সোমারা থাকলেও, সে-ই বাড়ির কর্ত্রী। এই সব চাবি, বাসন্তীকে ফরমাশ করে সংসার চালাবার অধিকার তার। সে হাতে করে চাবির থলোটা পরীক্ষা করে দেখতে লাগল।

বাসন্তী ঘরে ঢুকে বলল, ‘ওরা কখন আসবে?’

‘অমিত য়্যুনিভার্সিটি থেকে সোজা আসবে। ওর জন্যে ভালো কিছু টিফিন করো। সোমার বোধ হয় আরো দেরি হবে। এয়ার-পোর্ট থেকে সোজা জোকায় চলে গেল। সেখান থেকে বাড়ি ফিরবে, গোছগাছ করবে, তারপর আসবে। কী বানাচ্ছ রাত্রের জন্য?’

‘মাটন রান্না করা আছে। রুটি হবে।’

‘মাটন আবার কী? মাটনের প্রিপারেশনটা কী বলো?’

‘মাটন মানে মাটন, যেভাবে রাঁধি রেঁধেছি। অতশত জানি না।’

‘জানো না বললেই পারতে, আমি বই দেখে দেখে বলে দিতাম। আর কিচ্ছু করো নি!’

‘সোমা আসুক, জিজ্ঞেস করে নেবো।’

‘কেন? সোমা কেন? আমি কি নেই? এটা এখন আমার বাড়ি। আমি যা বলব তাই করতে হবে। যাও বেগুন-ভাজা করো গিয়ে। পুডিং বানাও। কাশ্মিরী আলুর দম বানাও।’

‘কী মুশকিল, বেগুন না হয় খাবার সময়ে ভেজে দেব। আলু সোমা খেতে চায় না। পুডিং না হয় করছি। যদিও দুধ বেশি নেই, কনডেন্সড্ মিল্ক ঢালতে হবে, আগে থেকেই বলে দিচ্ছি।’

‘হোক। আর সোমা তো একা খাবে না। অমিত কাশ্মিরী আলুর দম খেতে ভালবাসে। আমিও বাসি। স্যালাড কেটেছ?’

‘ক-খন। ফ্রিজে ঢোকানো আছে।’

অমিত কিন্তু আগে এলো না। ওরা দুজনে একসঙ্গে পেল্লাই একটা সুটকেস নিয়ে নামল, রাত নটা। বাসন্তী খুলে দিল। তার মুখে খুশির হাসি।

‘ঋতু কোথায়? ঋতু?’ সোমা ঢুকেই জিজ্ঞেস করল।

‘মাথা ধরেছে। শুয়ে আছে।’

‘মাথা ধরেছে? কেন?’ সোমার ভুরু কুঁচকে উঠেছে।

‘তোমাদের জন্যে বাড়ি কত গুছোলো… রান্না-টান্না…’ বাসন্তী ঢোঁক গিলল।

‘ঋতু রান্না করেছে?’

‘তা নয়। বলল আমাকে কী কী করতে হবে, ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল।’

অমিত সুটকেসটা লিভিংরুমের একধারে রেখে ডাকতে লাগল, ‘ঋতু, ঋতু উঠে পড়ো।’ ডাকতে ডাকতে সে ঋতুর ঘরের সামনে চলে গেল, ‘আসব?’

‘এসো।’ ঋতুর ধরা-ধরা গলা শোনা গেল।

‘কী হল? উঠে পড়ো! খুব মনমেজাজ খারাপ নাকি মা-বাবার জন্য?’

অমিত ঋতুর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে। ঋতু আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়িয়ে একটা হাই তুলল মুখে হাত চাপা দিয়ে, ‘এক্সকিউজ মি।’ তারপর অমিতের শার্টের বোতামে হাত রেখে আদুরে গলায় বলল, ‘হোয়াই কুড নট্ ইউ কাম আর্লিয়ার অমিত?’

‘আরে বাড়ি ঠিকঠাক বন্ধ করতে হবে! নিচ্ছিদ্রভাবে তালা-ফালা দিতে হবে। এই ঢাউস সুটকেস তার পর, সোমা একা পারে না কি?’

‘ইউ প্রমিজ্‌ড্! আমি তোমার জন্যে চিকেন ওমলেট বানাতে বলে দিয়েছিলাম। তুমি ভালোবাসো বলে।’

‘তো কী আছে? আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না! প্রত্যেক সন্ধ্যায় আমি য়ুনিভার্সিটি থেকে প্রচণ্ড খিদে নিয়ে ফিরব, তখন দেখি তুমি কত খাওয়াতে পার। বোর হয়ে যাবে বলে দিলুম।’

সোমা ও-ঘর থেকে চেঁচিয়ে ডাকল, ‘অমিত চান করতে যাও। আমি গিজার চালিয়ে দিয়েছি ন’টা বেজে গেছে।’ তারপর তোয়ালে হাতে ঋতুর ঘরে এসে বলল, ‘ঋতু টেবিলটা ঘরে এনে খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছিস রে! গোলাপগুলো একেবারে টাটকা। অমিত, তুমি ও বাথরুমে যাও, আমি ঋতুরটাতে যাই বরং। বড্ড দেরি হয়ে গেছে।’

খাবার টেবিলে বসে সোমা বলল, ‘অ্যাত্তো কি সব রাঁধিয়েছিস রে?’

‘তোমার পছন্দ না হয় খেও না।’

‘উঃ, আমি কি তাই বলেছি? আমার এমন রাক্ষসের মতো খিদে পায়! সমস্ত খাব। ··· ইস্‌স্ মাটনটা কী ভালো হয়েছে!’

অমিত বললে, ‘এ বাড়িতে এলে ঠিকঠাক জমিয়ে খাওয়া যায়। তোমার তো খালি বয়েল্‌ড আর স্টু।’

‘সেইজন্যেই অম্বলে না ভুগে সুস্থ শরীরে খাটতে পার। বুঝলে? একদিন দুদিন মুখ বদলাবার জন্যে এরকম ঠিক আছে। তাই বলে রোজ না। ঋতু তুই আজকাল রোজই এরকম খাস না কি রে?’

বাসন্তী বলল, ‘ওর তো খেয়ালের ওপর। খাওয়ার দশ মিনিট আগে হয়ত বলল—ঢাকাই পরোটা করে দাও।’

‘তাই দাও?’

‘না করে উপায়?’ বাসন্তী যেন এক দিনেই ঋতুর অভিভাবিকা হয়ে উঠেছে।

‘ঋতু অত ভাজাভুজি, মশলা খেও না সত্যি! অমিত বলল।

‘আমি তোমাদের মতো ডেস্‌ক্ ওয়ার্ক করি না বসে বসে। রীতিমতো লম্ফ-ঝপ করতে হয়, বুঝলে? ওসব ফ্যাট-ট্যাট, মশলা-টশলা সব কোথায় তলিয়ে যায়।’

সোমা বলল, ‘তা অবশ্য। নাচে প্রচণ্ড খাটুনি। কিন্তু একটু আলগা দিলেই মোটা হয়ে যাবি। ও কি হাত গুটিয়ে আছিস যে?’

‘খাওয়া হয়ে গেছে।’

‘হয়ে গেল? এরই মধ্যে? পুডিংটা খাবি না?’

‘নাঃ, আমি উঠছি, ডোন্ট মাইন্ড।’ ঋতু উঠে চলে গেল, ঘরের দরজা বন্ধ করবার শব্দ হল।

অমিত বলল, ‘কিছু হল যেন মনে হচ্ছে?’

‘রাগ হয়ে গেল বোধ হয়’, সোমা স্যালাড নিতে নিতে বলল।

‘রাগ? কেন?’

‘ঋতুর রাগ-অনুরাগের কোনও কেন নেই অমিত। ওর মন নামে জটিল যন্ত্রটির কোন কথায়, কখন তার ঢিলে হয়ে যায় আমরা কেউ জানি না।’

‘ডেকে আনব? কিছুই তো খেল না!’

‘খবর্দার, অমন কাজটিও করো না। ও তো তাই-ই চায়। দরজায় ঘা দেব। দুজনেই খাওয়া ফেলে ঋতু-ঋতু বলে ছোটাছুটি করব। অ্যান্ড শী’ল থ্রো ওয়ান অফ হার ফেমাস ট্যানট্রাম্‌স্!’

‘তাই বলে খাবে না?’

‘খেয়েছে তো! ও ওইরকমই খায়। বারে বারে খায়। রাত্তির তেরোটার সময়ে হয়ত ফ্রিজ থেকে পুডিং বার করে খেয়ে নেবে। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না তো!’

কিন্তু ঋতু বেশ ভালো হয়েই তো থাকছে। সকালে সর্বপ্রথম বেরোয় সোমা। অমিতের একটু বেলায় ক্লাস থাকে। ইউনিভার্সিটিও খুব কাছে! ঋতু প্রায়ই গোড়ার দিকের ক্লাসগুলোয় যায় না তাই এগারোটা, সাড়ে এগারোটা, কোন কোন দিন বারোটায় দুজনে খেতে বসে। অমিতের দুদিন যেতে হয় না। সে দুটো দিন, নিজের ব্যক্তিগত পড়াশোনা, পেপার টাইপ, লাইব্রেরি এ সব থাকে তার। ঋতুও প্রায়ই এই দিনগুলোতে গড়িমসি করে কলেজ যায় না। বলে, ‘ধুর। ভাল্লাগছে না, এই অমিত রাখো তো তোমার বালিশের মতো বইগুলো, এসো গল্প করি।’

কত যে গল্প ঋতুর! তার নাচ-ক্লাসের মাস্টার মশাইয়ের প্রতিভার গল্প। মেয়েদের মধ্যে, ছেলেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার পলিটিক্‌স্। অমিত যখন জার্মানিতে ছিল তখনকার গল্প। খালি সোমার সঙ্গে অমিতের প্রেমের গল্পটা সে কখনোই শুনতে চায় না।

উজ্জয়িনী আর মিঠু এলো একদিন।

‘কিরে ঋতু, কলেজ যাসনি কেন?’

‘এই তো পরশুই গেছি! আবার কী! ভারি তো কলেজ!’

‘তাই বলে দিনের পর দিন ফাঁকি দিবি? তারপর নন-কলেজিয়েট হয়ে গেলে?

‘আহা, ক জন প্রোফেসর রোলকল করতে পারেন রে! অনার্স ক্লাসেই তো সাতচল্লিশ জন স্টুডেন্ট। সব ফুটকি দেওয়া থাকে আমি দেখেছি। পরীক্ষার সময়ে একটা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দিয়ে দেব। বি কে সি-কে বলব, অনার্সের ‘পি’গুলো দিয়ে দিতে।’ গলা তুলে সে বাসন্তীকে ডাকতে লাগল, ‘বাসন্তী! বাসন্তী! আমার বন্ধুরা এসেছে কফি করো, কফি উইথ ক্রীম, এই চিকেন রোল খাবি?’

উজ্জয়িনী বলল, ‘তুই ব্যস্ত হোস না তো! এখন আর বাসন্তীদিকে কোথাও পাঠাতে হবে না।’

‘পাঠাব না তো! এভরিথিং ইজ রেডি। জাস্ট ভাজবে আর দেবে।’

‘তুই খুব গিন্নি হয়েছিস তো!’

‘হয়েছিই তো। জানিস না মা আর বাপী ফ্রান্স গেছে। আমিই তো এখন সব দেখছি।’

‘সে কি রে? তুই একা রয়েছিস?’

‘সোমা-অমিত আছে! এতক্ষণ আমাতে অমিতেতে আড্ডা মারছিলাম তো!’

‘অমিত কে রে? সোমাদির বর?’

‘আবার কে? এই অমিত এদিকে এসো শিগগির।’

বারান্দার দিকের দরজা দিয়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা অমিত ঢুকলো। ঋতু বলল, ‘ইজ্‌ন্‌ট্ হি হ্যান্ডসাম?’

মিঠু-উজ্জয়িনী জবাব না দিয়ে অমিতের দিকে তাকিয়ে নমস্কার করল। অমিত বলল ‘হাই!’

চিকেন রোল আর কফি খেতে খেতে শিগগিরই চারজনে খুব আড্ডা জমে গেল। মিঠু বলল, ‘আপনার রোজ রোজ বেরোতে হয় না, কী মজা, না অমিতদা?’

‘আরে! কে বললে যেতে হয় না। ক্লাস ছাড়াও অনেক কাজ থাকে। তো এই আহ্লাদি শ্যালিকাকে আগলাচ্ছি। মা বাবা নেই, মন-মেজাজ খারাপ। ঋতু তোমার বন্ধুরা এসে গেছে। আমি একটু বেরোচ্ছি।’

‘কেন?’

‘দরকার আছে।’

‘কী দরকার?’

‘আরে! আছে।’

‘দেরি করবে না, তাড়াতাড়ি ফিরবে।’ ঘড়ি দেখে বলল, ‘উইদিন হাফ অ্যান আওয়ার।’

‘অত তাড়াতাড়ি হবে না। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে ফিরব।’ অমিত চট করে পোশাক বদলে বেরিয়ে গেল।

উজ্জয়িনী বলল, ঋতু, কলেজ ইলেকশন-এ আমি এবার ক্লাস-রিপ্রেজেন্টেটিভ দাঁড়িয়েছি। আমাকে ভোটটা দিবি তো?’

‘তুই দাঁড়িয়েছিস? তুই? অফ কোর্স দেব। আর কেউ দাঁড়িয়েছে না কি রে?’

‘হ্যাঁ, দেখ না রাজেশ্বরীও দাঁড়িয়েছে।’

‘সে কী? তোদের দুজনের মধ্যে আবার ভোটাভুটি কী?’

মিঠু তাড়াতাড়ি বলল, ‘দেখ না, এটাই উজ্জয়িনীকে বোঝাতে পারছি না কিছুতেই। রাজেশ্বরীর নামটা আগে পড়েছে। ও দাঁড়িয়ে গেছে, উজ্জয়িনীর আবার দাঁড়াবার দরকার কি ছিল, বল তো!’

মাথায় একটা ঝটকা দিয়ে উজ্জয়িনী বলল, ‘তো দিস নি! বারবার এক কথা বলছিস কেন? দিস ইজ ইনসাল্টিং। আমাকে ডেকে দাঁড়াতে বলে ওরা হঠাৎ রাজেশ্বরীকে দাঁড় করালো কেন? আমার একটা প্রেসটিজ নেই? এটা আমার চ্যালেঞ্জ। রাজেশ্বরীকে আমি হারাব, এমন করে হারাব যে ওই সুকান্তদা, শৈলেশদা বুঝতে পারবে। এটা আমার চ্যালেঞ্জ জেনে রাখিস। আর তোরা তো রাজেশ্বরীকেও উইথড্র করতে বলতে পারতিস! আমার কাছেই খালি ঘ্যানঘ্যান করছিস কেন? বল ঋতু!’

ঋতু মজা পেয়ে বলল, ‘তোরা খুব একসাইটেড মনে হচ্ছে এই ব্যাপারটা নিয়ে। সত্যিই তো মিঠু তোরা রাজেশ্বরীকে বলছিস না কেন?’

মিঠু বলল, ‘আসলে রাজেশ্বরীর নামটাই তো প্রথমে পড়েছে। ওকে নাম উঠিয়ে নিতে বলার কোনও মর‍্যাল রাইট আমাদের নেই। তবে, উজ্জয়িনী যদি এত ইয়ে করে, তো রাজেশ্বরীকেও বলতে হবে।’

ঋতু বলল, ‘এখখুনি বল। দাঁড়া ফোনে ডাকি ওকে।’

মিঠু বলল, ‘অত তাড়া করছিস কেন? মুখোমুখি না হলে এ সব হয়?’

‘উঁহুঃ, ফোন ইজ বেস্ট।’ বলে ঋতু চট করে ডায়াল ঘোরালো।

‘রাজেশ্বরী আছে? হ্যাঁ আমি ঋতু বলছি রে। এই ফিরলি? হ্যাঁ? হ্যাঁ। আমার বাপী-মা নেই তো তাই!’ রিসিভারের ওপর হাত চাপা দিয়ে উত্তেজিতভাবে ফিস-ফিস করে ঋতু বলল, ‘আমার কাছে ভোট চাইছে! এই শোন রাজেশ্বরী, শুনলাম উজ্জয়িনীও দাঁড়িয়েছে! তুই উইথড্র করে নে নামটা। দুই বন্ধুতে…কী? না কেউ বলেনি বলতে। আমারই মনে হল। …বল!’ আবার রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে ঋতু বলল, ‘ও-ও একই কথা বলছে। বলছে ও আগে দাঁড়িয়েছে। উজ্জয়িনীকে নাম তুলে নিতে বল।’ রিসিভারের দিকে ফিরে ঋতু বলল, ‘কোত্থেকে জানলাম? যেটুকু গেছি তাইতেই কানে এসেছে। আচ্ছা রাখি! রাখছি রে!’ ফোন রেখে হাঁসিতে ফেটে পড়ল ঋতু।

ঋতু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোরা দুজনেই খুব ওয়ারিড না? এত গোঁ কেন রে তোদের? এক জন নামটা তুলে নিলেই তো ফুরিয়ে যায়।’

‘ঠিক আছে। দিস নি আমাকে ভোটটা। আমি চলি’, উজ্জয়িনী উঠে দাঁড়াল।

‘ইস? এত সহজে রেগে যাস কেন রে? ভোটটা তোকেই দোব। হল তো?’

‘ঠি-ক!’

‘ঠিক! কী আশ্চর্য তোর সঙ্গে কত দিনের বন্ধুত্ব!’

উজ্জয়িনী বলল, ‘থ্যাংকিউ।’ মিঠুও উঠে পড়ল। কিন্তু তার মুখে স্পষ্ট অশান্তির ছাপ। উজ্জয়িনী আড়চোখে সে দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মিঠু তুই রাজেশ্বরীকেই দিস। তোর থেকে আমি ভোট চাইছি না। তোকে আমার সঙ্গে আসতেও হবে না। কী জানি! তোকে যদি আবার ইনফ্লুয়েন্স করি! আমার কী মর‍্যাল রাইট আছে বল!’

মিঠু কাঁদো-কাঁদো মুখে বলল, ‘কী হচ্ছে উজ্জয়িনী! আমি একবারও বলেছি তোকে দেব না!’

উজ্জয়িনী ক্রুদ্ধ মুখে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই তো ঋতু কত সহজে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। মানছি তোদের পক্ষে অস্বস্তিকর হচ্ছে ব্যাপারটা। কিন্তু আমারও তো একটা প্রেসটিজ আছে। তা ছাড়া কোথায় আমি, কোথায় রাজেশ্বরী! রাজেশ্বরী তে এসেছে মোটে এইচ.এস-এ। আর আমার সঙ্গে পড়ছিস নার্সারি থেকে। তোদের মনে এত দ্বিধা আসে কোত্থেকে? আমি সব বুঝি মিঠু। তোর আমাকে ভালো লাগে না আর। আমি খেয়ালি, আমি তোকে ঠেলে দিতে পারি জলে। তো ঠিক আছে, রাজেশ্বরীকে ভালো লাগে। তাকে বেশি ডিপেন্ডেব্‌ল্ মনে হলে তার কাছে যা। আমি তো তোকে বেঁধে রাখি নি! যেখানে খুশি, যার কাছে খুশি যানা!’

মিঠুর চোখের কোল ভরে উঠছে। সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে উজ্জয়িনী বলল, ‘ক্রাই বেবি!’ সে বেরিয়ে গেল।

মিঠুকে ঋতু টেনে বসিয়ে রাখল। মিঠু রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে। ধরা গলায় বলল, ‘সত্যি রে ঋতু, আমি একটা অপদার্থ, চরিত্রের কোনও জোর নেই, কিছুই পারি না। কিচ্ছু না!’

ঋতু বলল, ‘দূর। ছাড় তো! উজ্জয়িনীটা চিরকাল একটা বুলি। সেলফিশ। নিজেরটা ছাড়া কারুরটা দেখতে পায় না। আমি ওকে কথা দিয়েছি যখন ওকেই দেব। তুই রাজেশ্বরীকে দে। ও তো তোকে অনুমতি দিয়েই দিয়েছে!’

‘তা হয় না ঋতু। উজ্জয়িনী দাঁড়ালে ওকে আমার দিতেই হবে। তাই বলে ওর ভুলটা অমি দেখিয়ে দেব না? আমি যাই রে!’

‘যাবি? যা তা হলে। শুধু শুধু মন-খারাপ করিস না।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress