Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » একুশে পা || Bani Basu » Page 4

একুশে পা || Bani Basu

‘গোধূলি! গোধূলি’…ওই ডাকটা…দুপুরটা..অ্যাসোসিয়েশনটা…

আকাশ কালো করে আসছে। গুম গুম মেঘের ডাক। এ বছর বৃষ্টি আর ফুরোতেই চায় না। গরমও তেমনি। কদিন অসহ্য গুমোট হচ্ছে। দু তিনদিন চলতে থাকছে একই রকম। তার পরেই গুম গুম গুড় গুড়, ঝমাঝ্ঝম। রাস্তার অবস্থা যা তাতে সর্বত্রই চোরা পুকুর। তাতে ভেসে রয়েছে ময়লা, গাড়ির তেলকালি। উজ্জয়িনী পেছন ফিরে বলল, ‘এই মিঠু, তুই কি বি. কে. সি-র ক্লাসটা করবি না কি? আমি বাবা বাড়ি চললাম। বৃষ্টি নাবলে আর ফিরতে হচ্ছে না।’ আজকে অনেকেই আসেনি। ছেলেগুলো তো মনে হয় মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। রোজ বইখাতা নিয়ে কলেজে বেরয়। অর্ধেক দিনই কলেজে ঢোকে না, কোথাও না কোথাও গিয়ে আড্ডা জমায়। কলেজে ঢুকলেও দেখো কমনরুমে, কী লাইব্রেরিতেও। ক্লাসে মুখ দেখায় কম। আজকাল পলিটিকসের ধার মরে গেছে। সে রকম জোর পলিটিকসের আলোচনাও শোনা যায় না। ইউনিয়ন যা করতে বলে সব্বাই মুখ বুজে মোটামুটি তাই করে যায়। কী যে এত আড্ডা মারে ছেলেগুলো। উজ্জয়িনীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। আড্ডার বিষয়বস্তু কি? মিঠু একটু পিছিয়ে ছিল, বলল, ‘বি কে সি কিন্তু আজ নতুন চ্যাপ্টার শুরু করবেন।’

‘কাকে নিয়ে শুরু করবেন? অর্ধেক তো আসেইনি! আমরা কিছু যদি কেটে যাই তো পরের দিন। চল এই বেলা পালাই। আজ গাড়ি আছে। আয় না।’ উজ্জয়িনী মিঠুর কনুই ধরে টান দিল।

ভিক্টোরিয়ার কাছাকাছি আসতে ওরা একটা অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য দেখল। জলভরা নীল রঙের মেঘের প্রেক্ষাপটে আরও সাদা হয়ে ভিক্টোরিয়ার গম্বুজটা ফুটে আছে। দু’পাশে একটু একটু আকাশ, আবার মেঘ। উজ্জয়িনী বলল, ‘মোহনদা, একটু থামাও তো! মিঠু ভিক্টোরিয়ায় যাবি?

‘যেতে তো খুব ইচ্ছে করছে, কিন্তু বৃষ্টি এলে?’

‘এলে ভিজব। চট করে বাড়ি পৌঁছে যাব তো! এ তো আর কলেজ স্ট্রিট নয় যে জ্যামে পড়ব, কি গাড়িতে জল ঢুকে যাবে!’

‘চল’— দুজনে নেমে দৌড়ল। গেটের কাছ থেকে ঝালমুড়ি কিনে নিয়ে ঢুকল।

মিঠু বলল, ‘ঝালমুড়িতে আজকাল নাকি ব্রাউন শুগার মিশিয়ে দিচ্ছে, জানিস?’

‘তাহলে আর এক টাকাতে ঠোঙা দিতে হত না!’

‘কি জানি! বাড়িতে তো বাইরের এসব খেতে একদম বারণ করে, কাগজে নাকি বেরিয়েছিল।’

‘তো তুই খাস নি!’ এক ঝটকা দিল উজ্জয়িনী, ‘—ফ্যাল, ফ্যাল ঠোঙাটা’, মিঠুর হাত থেকে ঠোঙাটা কেড়ে নিয়ে সে অনেক দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল, একটা চিল সেটাতে ছোঁ মারল, যতই ওপরে যাচ্ছে ছড়িয়ে পড়ছে মুড়ি, ছোলা, বাদাম, পেঁয়াজ, ঝুরিভাজা, কাঁচালংকা।’

মিঠুর মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। উজ্জয়িনী আস্তে বলল, ‘সরি, এই মিঠু এক্সট্রীমলি সরি রে!’

মিঠু কেঁদে ফেলল। তার শামলা রঙের চিকণ গালের ওপর দিয়ে জলের ধারা নামছে। চোখদুটো ঈষৎ লাল। একগুচ্ছ চুল হাওয়ার বেগে খালি কপালের ওপর এসে লুটোপুটি খাচ্ছে। খয়েরি রং-এর স্কার্ট দুলছে সে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে লাগল।

উজ্জয়িনী বলল, ‘যাঃ, তুই কেঁদে ফেললি! আমি না আসলে মাথাটা না কি রকম গরম হয়ে গেল…আচ্ছা আমরা তো একটা ঠোঙা থেকেই খেতে পারি, পারি না?’

মিঠু ধরা-ধরা গলায় বলল, ‘তুই খা। আমার লাগবে না। ব্যাপারটা যে ঠিক খাওয়া না খাওয়ার নয়, সেটুকুও তুই বুঝতে পারিস নি।’

উজ্জয়িনী বলল, ‘এখানে বাঁদর থাকলে বেশ হত। এই ঠোঙাটাও সে ব্যাটাকে দিয়ে দিতাম। আয়, এই বেঞ্চটাতে বসি।’

মিঠু বলল, ‘না, জলের ধারে বসব, অবশ্য তুই যদি আমায় ঠেলে ফেলে না দিস।’

‘তার মানে?’ উজ্জয়িনী চোখ বড় বড় করে বলল, ‘তোর মনে হয় আমি তোকে ঠেলে ফেলে দিতে পারি?’

‘হ্যাঁ, তোর ধর হঠাৎ ইচ্ছে হল, তুই বোধ হয় নিজেই জানিস না কী পারিস আর কী না পারিস!’ জলের ধারের একটা বেঞ্চ দেখে মিঠু বসে পড়ল।

‘ওখানে বসলি যে? যদি তোকে ঠেলে ফেলে দিই?’

‘এখানে ঠেলা মারলে, মাটিতে পড়ব, জলে পড়ব না, পড়লেও সাঁতারটা তো জানি’ বলে মিঠু হেসে ফেলল।

উজ্জয়িনী পাশে বসে বলল, ‘না রে মিঠু, সত্যিই। হাসি নয়। তুই বোধ হয় না জেনেই আমার সম্পর্কে একটা সত্যি কথা বলেছিস। আমি নিজেই জানি না কী পারি আর কী না পারি। আমার ভেতরে একটা ভীষণ ক্রুয়েলটি আছে, আমি টের পাই…’

‘কী বাজে কথা বলছিস?’

‘বাজে কথা নয়। কারণ আছে, শুধু শুধু বলছি না বাবা। আসলে বাবার থেকে বোধ হয় এটা পেয়েছি আমি।’

‘মিঠু ভয়ের চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘য্যাঃ, বাবার সম্পর্কে ওভাবে ভাবতে আছে না কি?’

‘তুই আর কতদিন খুকী থাকবি মিঠু!’ উজ্জয়িনী বিরক্ত হয়ে বলল, ‘বাবা মা বলে কি সব সমালোচনার উর্ধ্বে? না স্বর্গের দেব-দেবী? আমি দেখছি, প্রতিদিন দেখছি মাই ফাদার ইজ আ ক্রুয়েল ম্যান, আর্ধেক দিন আমার মা রাতে ঘুমোয় না, খায় না ভালো করে, বাবার অপমানকর ব্যবহারের জন্যে, আর বলতে পাব না সেটা..!’

‘আরে? তোমরা এখানে?’ ওরা পেছন ফিরে দেখল বিষ্ণুপ্রিয়া আর তন্ময়।

‘তোরা?’ বিষ্ণুপ্রিয়ার চোখে চোখ রেখে বলল উজ্জয়িনী।

তন্ময় পাতলা চেহারার, গম্ভীর, একটু ভাবুক ধরনের একটি ছেলে। খুব নিয়মিত ক্লাস করে। তন্ময় বিষ্ণুপ্রিয়া দুজনেই পলিটিক্যাল সায়েন্সে অনার্স। শোনা যাচ্ছে তন্ময় সায়েন্স স্ট্রিম থেকে এসেছে। ও নাকি খুবই ভালো ছেলে। ইকো, স্ট্যাট্‌স্ নিয়েছে পল সায়েন্সের সঙ্গে।

বিষ্ণুপ্রিয়া একটু বেঁটে। খুব কাটা কাটা চোখ মুখ। উজ্জ্বল রঙ। প্রচুর চুলে একটা বেণী বাঁধা। সে বলল, ‘আজ তো আমাদের ডিপার্টমেন্টে প্রায় সব প্রোফেসরই অ্যাবসেন্ট। কী নাকি সেমিনার আছে, সব ঝেঁটিয়ে গেছে। অনেকেই আগে জানত, আসেনি। আমি আর তন্ময় একা পড়ে গেলুম। তাই চলে এলুম। ও কী দারুণ নোটস রাখে! ওয়ার্ড ফর ওয়ার্ড। এই তন্ময়, খাতাটা দেখা না রে ওদের!’

তন্ময় বলল, ‘ডোন্ট বি সিলি। এই তোমরা ঘাসের ওপর এসে বসো না! বেঞ্চে চারজন কমফর্টেবলি বসতে পারবে না।’

‘যদি হয় সজ্জন!’ বলে উজ্জয়িনী সরে বসে। মিঠুকেও টেনে আনল। ওরা বসতে উজ্জয়িনী বলল, ‘তোমরা তো বেড়াচ্ছিলে! আমরা আবার তোমাদের ডিসটার্ব করলাম না তো!’

বিষ্ণুপ্রিয়ার গাল লাল হয়ে গেল। সে বলল, ‘দেখ, ইচ্ছে করলে অনায়াসে তোদের এড়িয়ে চলে যেতে পারতুম। দেখতেও পেতিস না। তন্ময়টা তলে তলে…জানিস ইকোতে সেভেনটি এইট পার্সেন্ট পেয়েছিল। ম্যাথসে লেটার।’

তন্ময় বলল, ‘কী হচ্ছে বিষ্ণুপ্রিয়া! বাজে বকলে আমি কিন্তু উঠে যাচ্ছি।’

‘আহা!’ বিষ্ণুপ্রিয়া দমবার পাত্রী নয় ‘জানিস, তন্ময় টি ভি-তে প্রোগ্রাম করে, ইয়ুথ টাইমে কুইজ কনডাক্ট করেছিল।’

‘দেখি দেখি’, মিঠু মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘তাই ওর মুখটা আমার কেমন চেনা চেনা লাগছিল। তুই বোধ হয় প্রায়ই করিস, না রে তন্ময়!’

তন্ময় বলল, ‘মাঝে মাঝে। আসলে রেডিওতে অনেক দিন আগে থেকেই করছি। “বিদ্যার্থীর জন্য”তে বিদ্যার্থী সেজে যে কতবার বসেছি! তোরা কেউ আবৃত্তিতে ইন্টরেস্টেড?’

মিঠু গীতিকবিতা খুব ভালো আবৃত্তি করে, ওর গলাটা মাইকে আসে মিষ্টি, রিনরিনে, অথচ স্পষ্ট, তীক্ষ্ণ নয়। সে বলল, ‘কেন রে?’

‘আমাদের একটা খুব ভালো আবৃত্তির ক্লাস হয়। ভয়েস থ্রো কনট্রোল, মডুলেশন, উচ্চারণ খুব ভালো শেখানো হচ্ছে। আমি তো জাস্ট তিন চারটে ক্লাস করার পরেই অনেকটা ইমপ্রুভ করে গেছি।’

‘কোথায়?’ মিঠু জিজ্ঞেস করল।

‘সল্ট লেক। করুণাময়ী।’

‘ও ব্বাবা!’

‘কেন? তুই থাকিস কোথায়?’

‘বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে।’

‘বাস রয়েছে। অসুবিধে কী?’

‘না বাবা। কলেজ করতেই প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। তারপর গানের ক্লাস।’

‘ওঃ হো, বলতে ভুলে গেছি, ফ্রেশার্স-এ বিউটিফুল গেয়েছিলি তুমি যে সুরের আগুন…’

‘থ্যাংকস—’ মিঠু বলল, ‘তা বিষ্ণুপ্রিয়াকে বল না তোদের ক্লাসে ভর্তি হতে, ও তো মানিকতলায় থাকে।’

‘বিষ্ণুপ্রিয়ার কোনও আগ্রহই নেই।’

উজ্জয়িনী বলল, ‘মিঠু দেখ, মেঘ কেটে গেছে। বৃষ্টিটা তার মানে হল না। ইস্ শুধু শুধু বি কে সি-র ক্লাসটা করা হল না।’

বিষ্ণুপ্রিয়া হেসে উঠল, ‘আরে বি কে সি তো সেমিনারে। ক্লাস হতই না, বললুম না!’

মিঠুর হাতে একটা চোরা টান দিয়ে উজ্জয়িনী উঠে পড়ল, বলল, আমরা চলি রে। এই মিঠু দেরি হয়ে যাবে কিন্তু, মোহনদাকে আবার ছাড়তে হবে।’ বলেই সে হনহন করে প্রায় ছুটতে লাগল। মিঠু অন্য দুজনের দিকে তাকিয়ে বিদায় জানিয়ে কয়েক পা দৌড়ে উজ্জয়িনীকে ধরে ফেলল। উজ্জয়িনী বাঁকা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে বলল, ‘টু ইজ কম্প্যানি, থ্রি ইজ…!’ মিঠু হাসতে হাসতে বলল, ‘য্যাঃ, আমরা এতদিন পর্যন্ত গার্লস স্কুলে পড়েছি বলেই আমাদের ওরকম মনে হয়। জাস্ট ফ্রেন্ডস ওরা।’

‘ওই আনন্দেই থাক। প্রিয়াটা কী রকম কনজারভেটিভ বাড়ির মেয়ে জানিস? এখনকার দিনেও ওদের মা-কাকিমারা ঘোমটা দিয়ে থাকে। আর কী বিরাট জয়েন্ট ফ্যামিলি। বাপরে। তোর দম বন্ধ হয়ে আসবে ওদের বাড়ি গেলে! এ ঘর থেকে একজন কাকা বেরোল তো ও ঘর থেকে একজন জেঠী! ঠাকুর্দা, ঠাকুমা! একেবারে সেভেনটিন্‌থ্ সেঞ্চুরি। প্রথম চান্স পেয়েই প্রিয়াটা…’ বলে উজ্জয়িনী হাসিতে ফাটতে ফাটতে ছুটতে লাগল। ওদের গাড়ি লোয়ার সার্কুলার রোডে ঢোকবার পর হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। উজ্জয়িনী বলল, ‘দুটোতে খুব ভিজবে এবার।’

‘এমা সত্যিই তো!’ মিঠু বলে উঠল, ‘বৃষ্টিটা কী অসভ্য।’

উজ্জয়িনী বলল, ‘ভিজুক না। না ভিজলে প্রেম হয়? জলে ভিজবে, রোদে পুড়বে, মাইলের পর মাইল হাঁটবে। ঝড়ো কাকের মতো চেহারা হবে, তবে না? ‘বলে সে ভীষণ হাসতে লাগল। মিঠু ড্রাইভারের দিকে ইশারা করে দেখাতে উজ্জয়িনী বলল, ‘এবারে নিজেকেই ড্রাইভ করতে হবে দেখছি। নইলে সব মজাই মাটি। কী বলো মোহনদা?’

মোহনলাল পাঁড়ে স্টীয়ারিং-এর দিকে চোখ রেখে বলল, ‘জী?’ আরেক দফা হাসি শুরু হল উজ্জয়িনীর।

দূর থেকেই কিন্তু বৃষ্টিটাকে আসতে দেখেছিল বিষ্ণুপ্রিয়া। উজ্জয়িনীরা বাঁ দিকের প্রধান গেট দিয়ে বেরিয়ে গেছে। বিষ্ণুপ্রিয়া তন্ময়কে বলল, ‘শিগগির চল, ভিক্টোরিয়ায় উঠতে হবে। বৃষ্টি আসছে।’ দৌড়চ্ছে দুজনেই। বৃষ্টিটা ওদের একটুর জন্যে ধরে ফেলল। চুন্নি দিয়ে মাথাটা আলতো করে মুছতে মুছতে বিষ্ণুপ্রিয়া খিলখিল করে হাসছিল। তন্ময়ও তার রুমাল দিয়ে মাথাটা মুছছে। চশমাটা খুলে নিয়ে মুছে নিল কাচগুলো। তারপর বলল, ‘আচ্ছা তোমরা মেয়েরা অকারণে এত হাসো কেন বলো তো?’

‘অকারণে? এতটা দৌড়লুম। বৃষ্টির সঙ্গে কমপিটিশনে নামলুম। একটুর জন্যে সেকন্ড এলুম। হাসব না? হোয়াট ফান!’

তন্ময় বলল, ‘কি জানি! আমার তো কই হাসি পাচ্ছে না! যাই বলো, তোমাদের সঙ্গে আমাদের কতকগুলো ফান্ডামেন্টাল ডিফরেন্স আছে।’

‘সবাই, আই মিন, সব মেয়েই কি হাসে আমার মতন?’

‘মোর অর লেস সব্‌বাই। মিঠু হাসে, উজ্জয়িনী হাসে…’

‘ইমন? ইমনকে আমি এভাবে হাসতে দেখিনি। অবশ্য এরকম পরিস্থিতিতেও পড়িনি কখনও ইমনের সঙ্গে।’ বিষ্ণুপ্রিয়া বলল।

‘ইমন স্পোর্টসওম্যান তো! একটু আলাদা, অত মেয়েলি নয়,’ তন্ময় মন্তব্য করল।

‘ঠিক আছে বাবা, আর হাসব না, গ্রাম্পি-ফেস হয়ে থাকব, মেয়েলি-টেয়েলি কত গালাগালি!’

‘গালাগালি? মেয়েকে মেয়েলি বললে গালাগালি হয়? আচ্ছা তো!’ তন্ময় বলল, ‘এবার বোধ হয় কাঁদবে।’

ঝাঁঝাল গলায় বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, ‘ভারি বয়ে গেছে কাঁদতে, অত সস্তা না।’

তন্ময় বলল, ‘কিন্তু সত্যি, খেয়াল করে দেখবে মেয়েরা অল্পে হাসে, অল্পে কাঁদে। ফলে ওরা কিন্তু ভেতরে কোন কিছুই জমিয়ে রাখতে পারে না। মেয়েদের হার্ট অ্যাটাক কম হয় ওই জন্যে। হাউ স্ট্রেঞ্জ আর নেচার্স ওয়েজ!’

বিষ্ণুপ্রিয়ার ক্রমশই রাগ বেড়ে যাচ্ছে। বলল, ‘মেয়েদের গভীরতা নেই, এই বলতে চাইছ তো? মেয়েরাই, কিন্তু জগতে বেশি ফেইথফুল, দায়িত্বশীল, নির্ভরযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।’

‘আমি কিন্তু বলতে কিছু চাইনি,’ ভাবুক মুখ করে তন্ময় বলল, ‘আই ওয়াজ জাস্ট কিউরিয়াস! বুঝতে চাইছিলাম। আর তুমি যে গুণগুলোর উল্লেখ করলে সেগুলোর জন্যেও বোধ হয় হাসিকান্নার সেফটি-ভালভের দরবার হয়। নার্ভ জিনিসটা মেয়েদের খুব স্ট্রং। দায়িত্বশীল, নির্ভরযোগ্য…এসব হতে গেলে নার্ভাস সিসটেমে একটা ব্যালান্স দরকার হয়।’

‘সব কিছুরই একটা করে ফিজিওলজিক্যাল এক্সপ্ল্যানেশন আছে বুঝি! মনটা কিছু না!’

‘ফিজিওলজিক্যাল এক্সপ্ল্যানেশন তো থাকবেই! তা নয়ত মেয়েরা অ্যাজ এ ক্লাস আলাদা কেন? ছেলে অ্যাজ এ ক্লাস আলাদা কেন? ব্যক্তির কথা হচ্ছে না। ক্লাসের কথা হচ্ছে। আর মন? মনটার তো আংশিকভাবে শরীরেরই সৃষ্টি। মেডিক্যাল সায়েন্স তো এদিকেই এগোচ্ছে!’

‘ওঃ, পারও তুমি!’

‘না, আমার খুব আশ্চর্য লাগে, শরীর আগে না মন আগে! বস্তুবাদ ক্রমেই শরীরকে পয়লা নম্বরে রাখছে। আরেকটা জিনিস দেখো। মেয়েরা এখন ক্লেম করছে তারা পুরুষের সব কাজ করতে পারে। করছেও। বাট আই হ্যাভ মাই ডাউটস!’

‘কী রকম? তুমি কি মেয়েদের রান্নাঘরে ফিরে যেতে বলছ?’

‘আরে দূর! তা নয়! কিন্তু কোথাও একটা সীমারেখা আছে। বেসিক্যালি দে আর ডিফরেন্ট। মেন্ট ফর ডিফরেন্ট কাইন্ডস অফ জবস্। ভেবে দেখো, আজকের দিনে অনেক ফ্যামিলিতেই ছেলে আর মেয়েকে বাবা-মা একইভাবে মানুষ করে। আমার বাড়িতেই ধরো না। ছোট থেকে আমি আর আমার বোন এক ধরনের খেলনা পেয়েছি। একসঙ্গে বাড়ির কাজ শিখেছি। ইন ফ্যাক্ট আমাদের পাঁচ জনের ফ্যামিলি। আমরা চার জন আর দিদা। মানে বাবার পিসিমা। তিনিও সব সময়ে থাকেন না। তুমি বোর হচ্ছ না তো!’ তন্ময় বিষ্ণুপ্রিয়ার দিকে তাকাল।

‘উঁহু, বলো না, ইনট্‌রেস্টিং, লাগছে।’

‘কী যেন বলছিলাম!’

‘তোমাদের বাড়ির কথা!’

‘ও হ্যাঁ, তো ছোট থেকেই আমি আর বোন ভাগাভাগি করে কাজ করি। আমাদের খুব ছোট্ট ফ্ল্যাট। কোনও কাজের লোক নেই। বাবা বাজার, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস এইসব বাইরের কাজ করে, দিদা রান্না করেন, জাস্ট রান্নাটুকু। মা দিদাকে সাহায্য করে। ঘর-টর পরিষ্কার করে। আমি বাসন মাজি। যে যার কাপড় কেচে নিই। আমার বোন ঘর মোছে। এই রকম ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে কাজের ভাগ তো! কিন্তু আমার বোন বাইরের কাজের চেয়ে রান্নাটাই প্রেফার করে। বাবার হয়ত অসুবিধে আছে ব্যাংকে যেতে পারবে না। বোন বলবে—তুই যা আমি তোর বাসন মেজে রাখছি। আমাকে রান্নার কাজ দিলে, ও বলবে, আমি রান্নাটা করি না মা, দাদা বাজার করবে।’

‘তুমি রান্না করো! তুমি?’

‘খাবে না কি এক দিন! ভাত, ডাল, মাছের ঝোল, সুকতো, মাংস, ফ্রায়েড রাইস, চচ্চড়ি—সব পারি। আনাজপাতি ছুরি দিয়ে, মাছ খুব ভালো ড্রেস করতে পারি।’

‘মা!’

‘মা? ওরে বাব্বা, মা একটা ভীষণ গোলমেলে কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। দশটা থেকে চারটে তো সেখানে এনগেজড্ বটেই, বাড়িতে এত ফাইল নিয়ে আসবে। অনবরত ফোন আসবে, এখান সেখান, রাইটার্স, সি এস সি দৌড়াদৌড়ি। এর ওপর বাড়ির কাজের চাপ পড়লে…সম্ভব নয়। বাবা বরং অনেক ফ্রি। অফিসের কাজ অফিসে সেরে বাড়ি চলে এলো। ব্যাস, নো মোর ঝঞ্ঝাট!’

বিষ্ণুপ্রিয়া চুন্নির প্রান্ত পাকাতে পাকাতে বলল, ‘আমাদের বাড়িতে এসব ভাবতেই পারবে না। আমার ছোটকাকিমাও তো ব্যাঙ্কে কাজ করে! সকালবেলায় ব্রেকফাস্ট তৈরি করবার ভার কাকিমার। সেসব করে তবে অফিস যায়। সন্ধেবেলায় কাকা-কাকিমা প্রায় একই সঙ্গে ফেরে কিন্তু চা-জলখাবার এসব দেয় কাকিমা। এ রকমই সিসটেম আমাদের। আমি আমার দাদার জুতো পালিশ করি, শার্ট-টার্ট ইস্ত্রি করে দিই। একবার বাড়িতে অনেকদিন কাজের লোক ছিল না, তো মা বলেছিল—খেয়ে দেয়ে যে যার বাসন তুলে দেবে। দাদা যেই তুলতে গেছে ঠাম্মা এসে বলল, ‘ব্যাটাছেলেকে দিয়ে আর এঁটো বাসনটা নাই তোলালে বউমা।’

বিষ্ণুপ্রিয়া এখন একটু গম্ভীর হয়ে গেছে। তন্ময় বলল, ‘চলো, দরকার হলে ঢোকা যাক।’

এখনও বৃষ্টি ভালোই পড়ছে। সমান ধারে। কারো কাছেই ছাতা নেই। তন্ময় ছাতা ব্যবহারই করে না। বিষ্ণুপ্রিয়ার ছাতা বাড়িতে পড়ে আছে। ছবি দেখতে দেখতে বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, ‘তন্ময় তোমার কোন পেপারটা সবচেয়ে ভালো লাগে?’

‘থিয়োরি, অফ কোর্স। ফোর্থ পেপারও ভালো লাগে।’

‘দূর, আমি থিয়োরি ভালো বুঝতে পারি না।’

‘বল, আর ল্যাসকিটা ভালো করে পড়, আর বি কে সি-র ক্লাসগুলো মন দিয়ে করো। ওতেই হবে।’

‘আচ্ছা তন্ময়, তোমার যা রেজাল্ট তাতে তো তুমি আরও নাম-করা কলেজে যেতে পারতে। আর্টসে। পেতে না?’

‘পেতাম। কিন্তু আমি চেষ্টা করিনি। আমার বাবা মা সব এই কলেজের। তা ছাড়াও সত্যিকার কারণটা শুনবে?’

‘এ ছাড়াও একটা সত্যিকার কারণ আছে? আলাদা? বলো বলো’, বিষ্ণুপ্রিয়া উৎসুক হয়ে বলল।

তখন দুপুরবেলা। এপ্রিল। এখানে সীট পড়েছিল। ফার্স্ট হাফটা দিয়ে উঠেছি, সেকেন্ড হাফে আমার কিছু নেই। বাইরে এসে, কৃষ্ণচূড়াটা দেখেছ তো? দেখি মাথাটা একেবারে হোরিখেলা হয়ে আছে। গেট দিয়ে বেরিয়ে হাঁটছি। ভীষণ চুপচাপ চারিদিক। হঠাৎ খুব দূর থেকে কে যেন ডাকল —গোধূলি! গোধূলি! ছেলে গলার ডাক। আমি ফিরে চাইলুম, কাউকে দেখতে পেলুম না। তারপর আরও দূর থেকে আরও ক্ষীণ হয়ে ডাকটা ভেসে এল —গোধূলি! গোধূলি! তখনই মনে মনে ঠিক করলুম আমি এখানেই পড়ব।’

বিষ্ণুপ্রিয়া আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘গোধূলির জন্যে গোধূলি নামের কোনও মেয়ের জন্যে? স্ট্রেঞ্জ! তুমি একদম খ্যাপা তন্ময়! তা পেলে খুঁজে তোমার গোধূলিকে?’

তন্ময় বলল, ‘খুঁজিনি তো!’

‘সে কি? খোঁজনি? গোধূলির জন্যে এলে। তাকেই খুঁজলে না!’

‘ঠিক গোধূলি নামের কোনও মেয়ের জন্যে এসেছি ভেবেছ নাকি? পা-গল! জাস্ট ওই ডাকটা, ওই দুপুরটা, অ্যাসোসিয়েশনটা, সব মিলিয়ে আমাকে চুম্বকের মতো টানল। আমি বুঝে গেলুম এটাই আমার জায়গা।’

‘স্ট্রেঞ্জ!’ বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, ‘তুমি কি কবি টবি নাকি?’

‘হতে পারি। তবে এখনও লিখিনি এক লাইনও। আবৃত্তি করি। বললুম না তোমায়, করুণাময়ীতে আমাদের একটা ক্লাস হয়। একটা শুনবে?’ তন্ময় একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ ভিন্ন স্বরগ্রামে ভিন্ন গলায় বলে উঠল—

“শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম, শুধু কবিতার

জন্য কিছু খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা

ভুবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য

অপলক মুখশ্রীর শান্তি একঝলক

শুধু কবিতার জন্য তুমি নারী, শুধু

কবিতার জন্য এত রক্তপাত, মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত

শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।

মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, শুধু কবিতার

জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।”

‘বাঃ খুব সুন্দর আবৃত্তি করো তো! গলাটাকে যেন গড়িয়ে দিলে, বেশ অল্প অল্প থেমে বাঁক নিতে নিতে এগিয়ে গেল!’

‘ভালো লাগল? ধন্যবাদ! ওই যে গলাটাকে গড়িয়ে দেওয়া বললে, একটা কনটিনিউয়িটির ব্যাপার, এটা এই কবিতাটার বৈশিষ্ট্য, যখন এটা পড়তে গিয়ে কেউ অযথা যতি চিহ্ন খরচ করে আমার খুব অসোয়াস্তি হয়। তুমি এটা বুঝতে পারো কিনা দেখবার জন্যে এই কবিতাটাই বললাম, খুব দমও লাগে।’

‘ও মা! তুমি খুব ডেঞ্জারাস তো! আরও অনেক পরীক্ষা করছ না কি আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে?’

‘তুমিও করো না। কে বারণ করেছে? নইলে কে কার বন্ধু হতে পারে কী করে বোঝা যাবে! তোমার নামটা কিন্তু বড্ড বড় আর ভারী।’ তন্ময়ের মুখে হাসির আভাস।

বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, ‘আমার বন্ধুরা তো সবাই ছোট করে ডাকে।’

চাপা হাসিতে মুখ ভাসিয়ে তন্ময় বলল, ‘আমার পক্ষে ওই শর্ট ফর্মে ডাকাটা খুব অকওয়ার্ড হবে না?’

এক মুহূর্ত থেমে দু জনেই দরবার ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠল। আরও যারা ঘুরে ঘুরে ছবি দেখছিল তারা আশপাশ থেকে, পেছন ফিরে, মুখ বাড়িয়ে ওদের দেখতে থাকল সকৌতূহলে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress