একুশে পা (Ekushey Paa) : 03
‘আই হ্যাভ গন ক্রেজি—হি.হি.হি…’
দাশ সাহেবের আজকে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। কম্পুটার ওরিয়েন্টেশনের একটা প্রোগ্রাম নিয়েছে কোম্পানি। আয়োজনের সব দায়িত্ব তাঁর। উপস্থিতও থাকতে হবে। সপ্তাহে তিন দিন এই যন্ত্রণা। একসিকিউটিভদের তো ঘরসংসার নেই! তারা চব্বিশ ঘণ্টার বাঁধা চাকর! আজ দেরিটা বড্ডই বেশি হয়ে গেছে। নটা বেজে গেছে। দরজা খুলে দিল তাঁদের বহুদিনের কাজের লোক বাসন্তী।
‘বউদি কোথায়?’ সামনের ঘরগুলোর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মিঃ দাশ। বাড়ি ফিরে বাড়ি অন্ধকার দেখলে, মীনাক্ষীকে না দেখলে চোখে সত্যি-সত্যি অন্ধকার দেখেন তিনি। স্বামী অত্যন্ত ব্যস্ত এই অভিযোগে যখন বিয়ের অনেকদিন পর মীনাক্ষী একটা মারোয়াড়ি স্কুলে কাজ নিলেন, এবং স্কুলের পাহাড়প্রমাণ খাতা দেখায় নিমজ্জিত হয়ে গেলেন, তখন প্রথম দিকটা খুশিই হয়েছিলেন দাশসাহেব। মীনাক্ষীর ব্যস্ত হয়ে থাকাটা তাঁর পক্ষে ভালো। কিন্তু কমার্শিয়াল ফার্মের চাকরিতে কোনদিন নিশ্চিন্ততা আসেনা। তাঁরও আসে নি। ইতিমধ্যে হোমফ্রন্টে তাঁকে ঘিরে যে একটা ব্যস্ততা, আশা, আনন্দের বলয় তৈরি হত, মীনাক্ষী কাজে নেমে পড়ায় সেটা আর হচ্ছে না। সে-ও ব্যস্ত থাকে, সে-ও ক্লান্ত থাকে, তারও বেশ কিছু ‘শপ-টক’ তৈরি হয়েছে, যেগুলো দাশসাহেবের শুনতে একেবারে ভালো লাগে না। সবচেয়ে বড় কথা মীনাক্ষী যেন আর পুরোটা তাঁর আয়ত্তে নেই। সব সময়েই তাঁর আজকাল হারাই-হারাই ভাব। এমন নয় যে মীনাক্ষী এই বয়সে, বড় মেয়ের বিয়ে দেবার পর, ছোট মেয়ে কলেজে ঢোকার পর হঠাৎ দুম করে পরাসক্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু ও হয়ত স্কুলের পার্টির সঙ্গে পনেরো দিন এক্সকারশনে বেরিয়ে গেল। কিংবা রবিবার ওর কোনও সহকর্মিনীর বাড়ি নেমন্তন্ন। রবিবার। সপ্তাহের একমাত্র দিন, যে দিনটাতে অজিত দাশের মনে হয় তিনি একজন সংসারী মানুষ। স্ত্রী-কন্যা ইত্যাদি আছে। তাই রাত নটার পর ঘর অন্ধকার দেখলে ভয় করে, মীনাক্ষী আবার কোথাও গেল না তো! হয়ত ফোন করে জানাবে কিছুক্ষণ পর, আজ আর ফিরতে পারছে না। হ্যাঁ, সকালে বলতে ভুল হয়ে গিয়েছিল মিসেস ভিমানীর বাড়ি দাওয়াত, সেই ব্যারাকপুর। এত রাতে কি আর ফেরা সম্ভব, আনতির বাড়ি…ওই তো বাঙ্গুরে..ওইখানে থেকে যাচ্ছে।
বাসন্তী বলল, ‘বউদির মাথা ধরেছে। এতক্ষণ ছটফট করছিলেন। এখন বোধ হয় ঘুমিয়েছেন।’
‘ঋতু!’
ঘরে। ওরাও বোধ হয় মাথা ধরেছে।’
মা মেয়ে দুজনেরই মাথা ধরেছে? ধরতে যে পারে না তা নয়। কিন্তু একই সঙ্গে দু’জনেরই ধরল? এ তো ফুড পয়জনিং নয় যে বাড়িসুদ্ধ সবার একসঙ্গে হবে, কাজেই দাশসাহেবের অস্বস্তি লাগতে থাকে। মাথা ধরা একটা এমন রোগ, যেটা সত্যিই হতে পারে, আবার মিথ্যে হতেও কোনও বাধা নেই। রাগ-অভিমান-ক্ষোভ-অসন্তোষ এসব জানাবার জন্যে মাথা ধরা আখছার ব্যবহৃত হয়। সত্যিকারের মাথা ধরা হলে তার বিহিত আছে। চটজলদি ওষুধ। মাথা টেপা। এসবে উপকার হয়। কিন্তু মিথ্যেকারের মাথা ধরার প্রতিকার করা খুব শক্ত। মিঃ দাশ সেটা তাঁর দীর্ঘদিনের গার্হস্থ্য জীবনে হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন।
মেয়েকে তিনি বুঝতে পারেন না, তাই ভয়ও করেন বেশি। অতএব আগে ঢুকলেন স্ত্রীর ঘরে। সোজা বলগুলো তো আগে খেলে নেওয়া যাক। মীনাক্ষী মিডিয়াম-পেস, ভালো সুইং করতে পারে না। বেশি রাগ হলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে বল দেবে। তিনি চট করে মাথা নিচু করে সেগুলোকে উইকেটের অনেক ওপর দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেবেন।
‘মীনাক্ষী!’ আলতো করে ডেকে, বিছানার ওপর ঝুঁকে তিনি দেখলেন মীনাক্ষী এত টান-টান হয়ে শুয়ে আছে, চোখ দুটো এমন শক্ত করে বন্ধ যে এটা আসল ঘুম হতেই পারে না। অর্থাৎ মীনাক্ষী ইচ্ছে না করলে সাড়া পাওয়া যাবে না।
‘ওহ, আজ যা গরম! অফিস থেকে বেরিয়ে পর্যন্ত সেদ্ধ হচ্ছি। চানটা সেরে আসি। বুঝলে? তারপর…’ তারপর কী, দাশসাহেব জানেন না। কিছু না-কিছু একটা ঘটবেই। নিয়ত পরিবর্তনশীল এ জগতে কোনও কিছুই থেমে থাকতে পারে না। মাথা ধরা অবস্থাটাও কেটে যেতে বাধ্য। চানটা বড় আরামের। দুশ্চিন্তা যত বেশি থাকে চানের সময়টাও ততই বেশি হয়ে যায়। শীগগিরই হয়ত ফ্রান্সে যেতে হবে একটা টিম নিয়ে। ম্যানেজমেন্ট থেকে একজন, টেকনিক্যাল তিন জন। খুব কম করে হলেও দশ এগারো সপ্তাহের প্রোগ্রাম। মীনাক্ষীকে নিয়ে যাওয়া যায়। মীনাক্ষী যদি ছুটি ম্যানেজ করতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে মেয়ে একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। তার কলেজ আছে, নাচ আছে। দিদির বাড়ি সে অনায়াসেই থাকতে পারে, কিন্তু সে থাকবে কি না এবং তার দিদি তাকে আদৌ আগলাতে চাইবে কি না সে কথা এই মুহূর্তে জানা নেই তাঁর। এতগুলো এক্স-ফ্যাক্টর থাকলে লম্বা সময় ধরে চান না করে উপায়?
সময়টা বোধ হয় একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। বেশির চেয়েও বেশি। বাথটবে জল ভরে, ভাসছেন তো ভাসছেনই। দরজায় করাঘাত।
‘কে?’
‘আজ রাতটা কি ওখানেই থাকবে?’
—‘আসছি। এখ্খুনি!’ মীনাক্ষীর মাথা ধরা তাহলে সেরে গেছে! হৃষ্টমুখে দাশসাহেব চটপট গা-হাত-পা মুছে, তোয়ালে কোমরে জড়িয়ে আরেকটা তোয়ালে দিয়ে মাথাটা জোরে জোরে মুছতে মুছতে বেরিয়ে পড়লেন।
মীনাক্ষী ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুলে। —‘এসকেপিজমের একটা সীমা আছে।’ সঘৃণায় উচ্চারণ করল।
যাঃ, দাশসাহেবের কূটনৈতিক চালের এক নম্বর ধপাস। মন্দের ভালো শয্যাটি খালি। শয্যাশায়িনী উপবিষ্টা।
‘কিছু তো বলবে?’—মীনাক্ষী একটা আলগা মেরেছে। এখন ক্যাচ উঠবে, না মাথার অনেক ওপর দিয়ে উড়ে ওভার বাউন্ডারি হয়ে যাবে দাশসাহেব ঠিক জানেন না। যা থাকে কুল-কপালে—‘এবার ফ্রান্স, এগারো সপ্তাহ, যাচ্ছ তো?’ মাথা মুছতে মুছতে যথাসম্ভব স্বর নিয়ন্ত্রণে রেখে বললেন তিনি।
‘আমি মরছি মেয়ের জ্বালায়, তুমি আমায় ট্যুর দিয়ে ভোলাতে এসেছ?’ ক্যাচ কট কট। দাশসাহেব হতাশ হয়ে পাঞ্জাবি গলালেন।
‘কী ব্যাপার?’
‘জানি না। রেগে এটা ছুঁড়ে ফেলছে।’ ওটা ছুঁড়ে ফেলছে। খায়নি। প্রচণ্ড না কি মাথা ধরেছে, শুয়ে পড়েছে।
‘কিছু দিয়েছিলে? ট্যাবলেট টেট?’
‘বলে কাছেই যেতে দিচ্ছে না। রাগের কোনও ওষুধ আছে? মাথায় এক বালতি ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেওয়া ছাড়া? সে কাজটা তুমিই করো।’
দাশসাহেব আউট। মিড্ল স্টাম্প ছিটকে গেছে। তিনি সোজা প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতের মুঠোয় চলে গেছেন। ব্যাট বগলে নিয়ে তিনি ফিরে চলেছেন। মাঝের দরজাটা দিয়ে টুক করে গলে পড়েছেন পাশের ঘরে। ভাবছেন মীনাক্ষীকেই খেলতে পারছেন না! মেয়েকে খেলবেন কী করে! সে তো দুর্ধর্ষ! কখন যে কোনটা মারে! মনে হচ্ছে সোজা আসছে বলটা, আসতে আসতে হঠাৎ আচম্কা বেঁকে গেল। আবার হয়ত মনে হচ্ছে মারছে একটা গুগলি, দেখা গেল একটা নেহাতই সাদাসিধে বল।
এক সময়ে ঘরটা ছিল দুই মেয়ের। সোমদত্তা আর ঋতুপর্ণা। এখন সোমার বিয়ে হয়ে গেছে। সুতরাং পুরো ঘরটাই ঋতুর দখলে। খুট করে একটা আলো জ্বাললেন দাশসাহেব।
‘বাপী, তুমি ফ্রান্স যাচ্ছ? আমি যাব!’ চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে আবদারের সুরে ঋতু বলল।
‘আচ্ছা সে পরে দেখা যাবে এখন। আপাতত তো খাবি চল। ভীষণ খিদে পেয়েছে আমার।’
‘যাচ্ছি, আগে প্রমিস করো।’
‘ওহ, প্রমিস করার আমার উপায় নেই ঋতু, খাবি আয়।’
ঋতু এক লাফে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। তার কাফতান মেঝেতে লুটোচ্ছে। দুহাতে সেটাকে একটু তুলে খালি পায়ে নাচতে নাচতে সে খাবার টেবিলে এসে বসল।
‘ইস্স্—টোমাটো স্টাফ।’ চট করে একটা তুলে নিয়ে সে ঠোঁট ফাঁক করে দাঁত দিয়ে কেটে কেটে খেতে লাগল পা নাচাতে নাচাতে।
‘তাই বলো, বাবা ফেরেনি বলে রাগ!’ মীনাক্ষী বললেন, ‘মা কেউ নয়।’
‘নয়ই তো কেউ!’ ঋতু তেমনি পা নাচাতে নাচাতে বলল, ‘মা কেউ নয়, সোমদত্তা অ্যান্ড কোং কেউ নয়, খালি অজিত কাউর ইজ সামবডি’
দাশসাহেব বললেন, ‘অজিত কাউর? আমি আবার মহিলা হলাম কবে থেকে?’ ঋতু ফিক ফিক করে হাসতে লাগল। মেয়ের মেজাজ ঠিক হয়ে গেছে এতেই মীনাক্ষী খুশি। তার এতক্ষণের অসভ্যতা, রাগ সব মাফ করে দিয়েছেন।
‘কি রে, আরেকটা টোমাটো দিই?’
‘ইচ্ছে হলেই নেব। ইউ নীড্ন্ট বদার।’
মীনাক্ষী মুখ গম্ভীর করে হাত গুটিয়ে নিলেন। যখন তখন এইভাবে তাঁকে অপমান করে ঋতু। ভেতরে ভেতরে কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলেও মুখে সেটা প্রকাশ করেন না। ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি মনে মনে বলছেন সব সময়ে।
বড় মেয়ে সোমা এর থেকে আট বছরের বড়। শান্ত, শিষ্ট, ধীর, স্থির। ইকনমিক্সে পি.এইচ.ডি করেছে। এখন জোকার আই.আই.এম.-এ রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হয়েছে। জামাইটিও যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের লেকচারার। সোমা থাকতে ঋতু এতটা বাড়েনি। আসলে আট বছর পরে হওয়ায় ঋতু বোধ হয় মা-বাবার কাছ থেকে একটু অতিরিক্ত আদর-প্রশ্রয় পেয়ে থাকবে। অন্তত সোমার তো দৃঢ় মত তাই। তবে সোমা যে ঋতুকে নিয়ন্ত্রণে রাখত সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সোমার বিয়ে হয়েছে বছর তিনেক। এই সময়টার মধ্যে ঋতু যেন একশখানা মানুষ হয়ে গেছে। মাকে থোড়াই কেয়ার, বাবাকে ব্যতিব্যস্ত করে ছাড়ে। কেন যে এমন এঁরা বোঝেন না। মীনাক্ষীর সন্দেহ যে ঋতু দিদির কাছে একটা হীনম্মন্যতায় ভোগে। দিদি লেখাপড়ায় চৌখস, স্বভাব চরিত্রও এমন সংযত দায়িত্বশীল যে সবাই সোমা বলতে অজ্ঞান। ঋতু দিদিকে ভেতরে ভেতরে হিংসে করে। দিদির শাসন কোনদিনই ভালো মনে নেয়নি সে। তখন ছোটও ছিল। এখন সুদ সুদ্ধ সব আদায় করে নিচ্ছে। মনে মনেই ভাবেন। ঘুণাক্ষরেও মুখে এসব কথা বলেন না মীনাক্ষী।
ঋতু তার খাওয়া প্রায় শেষ করে এনেছে। দু আঙুলে চাটনি চাটছে এখন। মীনাক্ষী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ফ্রান্স-ফ্রান্স করছিলে যেন?’
‘টুর আছে। দু’মাসের একটু বেশি সময়।’
—‘কবে?’
‘এই তো মাস তিনেকের মধ্যে কী তারও আগে। পুজোর ঠিক পরটাতেই বোধ হয়।’
ঋতু বলে উঠল, ‘আমি তো যাচ্ছি বাপীর সঙ্গে।’
‘শোন ঋতু’—চোখ ভয়ে গোল গোল করে অজিত বললেন, ‘তোকে যেতে অ্যালাও করবে না। তা ছাড়া তোর কলেজ-টলেজ আছে। এবার তো সিরিয়াস হতে হয়, যদি অ্যাট অল আই. এ. এস হতে চাস! নয়? তবে তোকে রেখে যেতে তোর মায়ের সমস্যা হবে।’
মীনাক্ষী বললেন, ‘আমি যাচ্ছি না, কাজেই কোনও সমস্যাই নেই।’
অজিত দাশের মুখটা কাতর হয়ে গেল। দু মাসেরও বেশি বিদেশে থাকতে হবে, মীনাক্ষী ছাড়া? সমুদ্রপারে তিনি বহুবার গেছেন। নিসর্গ-টিসর্গ কী মিউজিয়ম, আর্ট এসব কিছুতেই কোনও নতুনত্বের স্বাদ তিনি পান না। তবে হ্যাঁ, পরিচ্ছন্ন প্রশস্ত রাস্তাঘাট, সুশৃঙ্খল নগরজীবন, পরিকল্পিত সবুজ, ভালো হোটেল, ভিন্ন ভিন্ন দেশের খাবার, সাদা লোকজন—এসব বেশ ভালোই লাগে তাঁর। মীনাক্ষীর আবার যেখানে যাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব টুরিস্ট স্পট দেখার অভ্যাস আছে। মীনাক্ষী না গেলে এই স্বল্পমেয়াদী প্রবাসগুলো তার দুঃসহ লাগে।
ঋতু বলল, ‘অফ কোর্স তুমি যাবে। পুজোর ছুটির সঙ্গে আর কয়েক সপ্তাহ যোগ করে দিতে তোমাদের মিসেস ভিমানি যদি আপত্তি করে তো ছেড়ে দাও না শখের চাকরিটা! ওটা তো মড্ হবার জন্যে, ফেমিনিস্ট বন্ধুদের খুশি করার জন্যে নিয়েছ!’
তাঁর চাকরি সম্পর্কে এইরকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা মীনাক্ষী একদম পছন্দ করেন না। যার বলার, অর্থাৎ স্বামী, কখনও বলেন না। কিন্তু ছোট মেয়ে সুযোগ পেলেই বলে।
মীনাক্ষী গম্ভীরভাবে মেয়ের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললেন, ‘আমি গেলে তুমি থাকবে কোথায়?’
‘বাসন্তী রয়েছে, আমার তো কোনও অসুবিধে হবে না! অসুবিধেটা তো তোমাদের! তো সোমাদের রেখে যাও নিশ্চিন্ত হবার জন্যে!’
মীনাক্ষী হতভম্ভ হয়ে বললেন, ‘সোমারা? সোমাদের রেখে যেতে পারি? তুই সত্যি বলছিস?’
‘কেন? সোমা এলে আমি অশান্তি করি?’
অশান্তি করার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু সেটা বলা যাবে না। মীনাক্ষী বললেন, ‘সুবিধে-অসুবিধেও তো আছে! ওদেরও। তোমারও।’
‘সোমা থাকবে সোমার মতো। আমি থাকব আমার মতো। আমার ওপর খবরদারি করতে বারণ করে দেবে। আমার এ বছরই কত্থকের ফিফ্থ্ ইয়ার, এখন কোথাওই যাওয়া সম্ভব নয়।’
মীনাক্ষী বললেন, ‘সে তুমি যাইই বলো, আমি যাচ্ছি না।’
‘সেটা তোমার ব্যাপার। আমি পার্মিশন দিয়ে দিলাম।’ ঋতু উঠে পড়।
‘আচ্ছা গুড নাইট বাপী, গুড নাইট মা।’
ঋতু চলে গেলে দাশসাহেব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার?’
মীনাক্ষী ঠোঁট ওল্টালেন। তিনি জানেন না। বললেন, ‘আনপ্রেডিক্টেব্ল্। যা মেজাজ। আমাকে তো তৃণাদপি তুচ্ছ জ্ঞান করে।’
অজিত বললেন, ‘এখন পার্মিশন পেয়েছ, যাবে কি না ঠিক করো। এ সুযোগ রোজ রোজ আসবে না। আমার তেমন জরুরি কিছু কাজ থাকবে না। আসল কাজ তো সিসটেম অ্যানালিস্টদের। চাই কী ইয়োরোপের আরও কিছু-কিছু ঘুরে আসতে পারি। জাপান হয়েছে। ইউ. এস. এ হয়েছে। ইয়োরোপটা হলে একটা…’
‘ওকে আবার হওয়া বলে নাকি? অত বড় আমেরিকা মহাদেশটা, কতটুকু দেখিয়েছ?’
‘ওকে হা, ওই হলো, ওই হলো, খুঁটিয়ে দেখতে গেলে, তিন চার বছর বাস করতে হয়।’
‘কিন্তু সোমা কি ওকে আগলাতে চাইবে?’
‘সেটা দেখো। তবে এটা গুড সাইন। আফটার অল ও-ও তো বড় হচ্ছে। নাচটা সিরিয়াসলি নিয়েছে। আসলে কোথাও একটা জেনুইন ইন্টারেস্ট চাই, বুঝলে? শী ইজ আউটগ্রোয়িং আস।’
মীনাক্ষী নিচের ঠোঁটটা সামান্য একটু বিকৃত করলেন। বিপদ কেটে গেলেই দাশসাহেবের মাথায় নানা রকমের তত্ত্ব আসতে থাকে।
ঋতু নিজের ঘরে ঢুকে দুটো দরজাই বন্ধ করে দিল। মা-বাবার ঘরের দিকের দরজা। আর হলের দিকের দরজা। তার ঘরে ড্রেসিংটেবল নেই। একটা দেয়ালজোড়া আয়না আছে। বারান্দার দিক থেকে আসা আলোয় সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে লাগল, দেখতেই লাগল। ড্রয়ারের ভেতর থেকে ক্রিমের শিশি বার করে অনেকক্ষণ ধরে মাখল। মাখতেই লাগল। মাখতেই লাগল। নিজেকে এভাবে দেখতে, এইভাবে ক্রিম মাখতে অদ্ভুত ভালো লাগে আজকাল। আয়নার ভেতরের ওই মেয়েটাকে দারুণ ভালোবাসে সে। বাবার ইচ্ছে সে আই. এ. এস হয়। মুসৌরির রাস্তায় ঘোড়ায়-চড়া ট্রেনী আই. এ. এস—এই মূর্তিটা তার খুব মনে ধরেছিল তাই বাবার উচ্চাশায় সে বরাবর তাল দিয়ে এসেছে। এখন কিন্তু বুঝতে পেরে গেছে অশ্বারোহিণী রাজিয়ার রোম্যান্স আই. এ. এস-এর একেবারে গোড়ার দিকের নেহাত ভগ্নাংশ। রাজ্যের সরকারি ফাইল দেখবে বলে কি সে এতা ভালো কত্থক শিখল? আরও শিখবে, ওড়িশি শিখবে। বেসিসটা আছে। সে খাজুরাহোয় নাচবে। ঠিক যে নাচের জন্যে, নাচ শিল্পটার প্রতি ভালোবাসাবশত তা নয়। সে নাচবে ঋতু নামক এই বিশিষ্ট অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলোকে সৌন্দর্যে ছড়িয়ে দেবার জন্যে, নাচবে এই চোখ দিয়ে কটাক্ষপাতের তীব্র আনন্দে, ভিন্ন ভিন্ন গ্রীবাভঙ্গির অহঙ্কার অনুভব করবার জন্য।
কলেজের ফ্রেশার্স-এ সে বাধ্য হয়ে নেচেছে। দুপুর বেলা। হলের মধ্যে গুমোট গরম। চারদিক থেকে আলো ঢুকছে। এ গাইছে, ও আবৃত্তি করছে। এই ধরনের হট্টমেলায় মোটেই তার নামতে ইচ্ছে ছিল না। ড্রেস ছাড়া তো আর কত্থক হয় না। সে একটা রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে কম্পোজিশন করেছিল। অনেক হেলায় করলেও জিনিসটা ভালো উৎরেছিল। সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেমেয়েরা তো খুব বাহা বাহা করল। কিন্তু দেখাবার মতো লোক ওখানে কই? কে আছে তেমন সমঝদার?
ইতিমধ্যে ঋতু মা-বাবার আসন্ন ফ্রান্স-যাত্রা উপলক্ষে তার নিজের স্বাধীনতা দিবস কাছে এগিয়ে আসছে মনে করে আনন্দ ধরে রাখতে পারছে না। এত বড় ফ্ল্যাটটায় সে ছাড়া কেউ থাকছে না, বাসন্তী তার আজ্ঞাবহ। কিন্তু মা কি তাকে একদম একা রেখে যেতে চাইবে? ঠিক আছে সোমারা আসুক। তখনও কিন্তু ঋতুর পরিচালনাতেই সংসার এবং ঋতু নিজে চলবে। সেটা সোমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। ইতিমধ্যে সে মিঠুকে একটা ফোন করে ফেলল। সে রাশি রাশি ফোন করে বলে এবং তার প্রাইভেসি নষ্ট হবে বলে ফোনটা নিজের ঘরে করিয়ে নিয়েছে কবেই।
মিঠুই ধরেছে, ‘হ্যাললো।’
‘মিঠু, আমি ঋতু বলছি। হি হি।’
‘ঋতু? এত রাত্রে?’
জবাবে ঋতু শুধু বেশ খানিকটা হাসল—
‘হাসছিস কেন?’
‘আই হ্যাভ গন ক্রেজি। হি হি হি।’
‘মিঠুকে কী দরকার রে? ঘুমিয়ে পড়েছে, ডাকব?’
চৈতন্য ফিরে পেয়ে ঋতু বলল, ‘ও মা। মাসি! আমি একদম বুঝতে পারিনি। না না মিঠুকে ডাকতে হবে না।’
‘কোনও মজার কথা আছে মনে হচ্ছে?’
‘সে কালকে হবে।’ ঋতু অপ্রতিভ হয়ে ফোন রেখে দিল, তারপর সমস্ত ব্যাপারটার মজায় একলা একলাই হেসে গড়াতে লাগল।