একুশে পা (Ekushey Paa) : 24
শূন্যে ভাসে—একলা।
বেরোল তো বেরোল ঠিক পুজোর আগেটায় রেজাল্ট বেরোল। শরতের কাশফুল তখন সারা আকাশময়। যদিও রোদের তেজ বিন্দুমাত্র কমেনি। ‘গৌতম ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে’, কে যেন চেঁচিয়ে বলল। পল সায়েন্সে একমাত্র গৌতম। তন্ময়ের এগারো নম্বর কম। ইস্স্স্! অণুকা ভালোই করেছে, যদিও যা বাজার তাতে এম-এ’র সিট পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। উজ্জয়িনী মিঠু দুজনেই ভালো সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে, কিন্তু ওদের আশানুরূপ হয়নি রেজাল্ট, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ইমন আর বিষ্ণুপ্রিয়া টায়েটায়ে অনার্স। ভেঙ্কট আর ঋতু পায়নি।
বাইরে বেরিয়ে ভেঙ্কট বলল, ‘চল, আজই চল আমার বাড়ি সেলিব্রেট করব।’ ইমন ঋতু আর বিষ্ণুপ্রিয়া আসেইনি। গৌতম বলল, ‘ধ্যাৎ, কী যে বলিস, সেলিব্রেট করবার আছেটা কী!’
ভেঙ্কট বলল, ‘বলিস কি রে? তুই ফাস্টো কেলাস পেলি, আমরা সেলিব্রেট করব না? আমার কথা ভেবে মন খারাপ করিসনি। আরে আমি কি পড়াশোনার লাইনের লোক, যে পাশ করব? গ্র্যাজুয়েট নয়, একথা তো আর কেউ বলতে পারবে না।’
কিন্তু ভেঙ্কট আর ঋতুর জন্য সবারই মন খারাপ। কেউ রাজি হতে চায় না। ‘রাজেশ্বরী প্লিজ এদের বোঝাও।’ ভেঙ্কট রাজেশ্বরীকেই ধরল। তন্ময় চুপিচুপি পেছন দিয়ে পালাবার চেষ্টা করছিল, ভেঙ্কট তাকে ক্যাঁক করে ধরল। তার রকম-সকম দেখে শেষ পর্যন্ত তন্ময় হেসে ফেলল।
‘হেসেছে, হেসেছে’, ভেঙ্কট হাততালি দিয়ে উঠল। মিঠু আস্তে আস্তে তন্ময়ের একপাশে গিয়ে দাঁড়াল, অন্য পাশে উজ্জয়িনী এসে দাঁড়াচ্ছে। ওদের মন খারাপ তন্ময়ের জন্যেও। তন্ময় জানে। বুঝতে পারছে। হঠাৎ তার মনে হল, এই ঘটনাটা জীবনে আর কখনও ঘটবে না। সে ফার্স্ট ক্লাস পায়নি বলে তার দুজন বন্ধু মলিন এবং উৎকণ্ঠিত মুখে দু পাশ থেকে তাকে ঘিরে ধরে আছে, মা বাবা ভাই বোন নয়। বন্ধু। বান্ধবী। এই উৎকণ্ঠার ভীষণ দাম। সে চশমার মধ্যে থেকে গাঢ় চোখে সবার দিকে চাইল, বলল, ‘পালাচ্ছি না, মায়ের কলেজে একটা ফোন…।’
‘সকলকেই তো ফোন করতে হবে, আমার বাড়ি গিয়ে করিস’, ভেঙ্কট বিধান দিল। তারপর গৌতমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই ওদের নিয়ে এগিয়ে যা। এই নে আমার ঘরের চাবি। আমি একটু পরে আসছি।’ সে ঝড়ের বেগে চলে গেল।
গৌতমের সঙ্গে ট্রামে চড়ে ওরা উত্তর অভিমুখে চলল। মিঠু গৌতমের পাশে বসেছিল। বলল, ‘দুপুরের কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটটা কী সুন্দর! ঠিক যেন একটু সরু, আর একটু পুরনো রাসবিহারী, পুরনো বলেই কেমন ইতিহাস-ইতিহাস গন্ধ। দেখ গৌতম, এই রাস্তা দিয়ে সুভাষ বোস পড়তে এসেছেন স্কটিশ চার্চে। হেঁটে গেছেন নরেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথকে কতবার মাড়াতে হয়েছে এই রাস্তা। ব্রাহ্মসমাজের বাড়িটা দেখ!
গৌতম বলল, ‘সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডারও অনেক দিনের দোকান। আমাদের স্কটিশ চার্চ স্কুল কত পুরনো। এই কলকাতায় সুকুমার সেন থাকতেন, সত্যেন বোস থাকতেন, সুধীন দত্তর আদি বাড়ি এই দিকে। কতজনের নাম করব। কত ভালো ভালো ছেলে বেরিয়েছে এখানকার স্কুল-কলেজ থেকে।
‘তুইও একটা ভালো ছেলে বেরোলি’, মিঠু বলল।
‘ধুস’, গৌতম লজ্জা পেয়ে বলে উঠল, ‘ফ্লুক, আমারটা। পাওয়া উচিত ছিল তন্ময়ের।’
উজ্জয়িনী সামনের সিটে ছিল, পেছন ফিরে বলল, ‘কী ফ্লুক রে?’
মিঠু বলল, ‘ও বলছে ওর ফার্স্ট ক্লাস পাওয়াটা ফ্লুক, তন্ময়েরই পাওয়া উচিত ছিল।’
‘কেন?’ তন্ময় আস্তে আস্তে বলল, ‘তুমি পার্ট ওয়ানে ফিফটিএইট পার্সেন্ট রেখেছিলে, মেকাপ করেও তোমার সাত নম্বর বেশি আছে। গৌতম, তোমার তো খুব ব্যালান্স্ড্ রেজাল্ট। আমার কথা বাদ দাও।’
‘তোর কথা কী হিসেবে বাদ দেব?’ মিঠু পিছন ফিরে বলল, ‘তোর তো একশবার পাওয়া উচিত ছিল।’
‘দূর আমার শেষের দিকে ইনট্রেস্ট লাগছিল না। এখন মনে হচ্ছে পল সায়েন্স না নিলেই হত।’
‘তবে কী নিতিস?’
‘বাংলা।’
‘বাংলা? নিয়ে কী করতিস?’ অণুকা বলল।
রাজেশ্বরী বলল, ‘বাংলা সাহিত্য পড় না, অসুবিধে তো কিছু নেই! চেষ্টা করলে ওটা আমরা নিজেরাও পড়ে নিতে পারি, নয়?’
‘অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার একটা আলাদা দাম আছে’, তন্ময় বলল।
‘তা অবশ্য।’
ভেঙ্কটের বসবার ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিতেই একদিকে ম্যাডোনার, আরেক দিকে অমিতাভ বচ্চনের পোস্টার দেখে উজ্জয়িনী বলল, ‘যার পোস্টার থাকা উচিত ছিল, তারই কিন্তু নেই।’
‘কার?’ মিঠু বলল।
‘কার আবার? চার্লি চ্যাপলিনের? পড়ে যেতে-যেতে সামলে যাবার একটা কায়দা দেখায় ভেঙ্কট, মনে পড়ছে?’
‘প্রত্যেকটা ফার্নিচার কিন্তু অ্যান্টিক দেখেছিস উজ্জয়িনী’, মিঠু অবাক হয়ে দেখতে দেখতে বলছিল।
গৌতম বলল, ‘বোধ হয় ওর ঠাকুর্দাদেরও বাবার আমলের জিনিস। সব গুদাম হয়ে পড়েছিল। ঘেঁটু এসব সরিয়ে, পালিশ করিয়ে এমন করেছে।’ উঁচু সিলিংটার দিকে তাকিয়ে অণুকা বলল, ‘দেখ, এত উঁচু ঘরে থাকে বলেই বোধ হয় ভেঙ্কটের মনটা ওরকম উদার। এনভায়রনমেন্টের একটা প্রভাব আছে তো মানুষের ওপর।’
রাজেশ্বরী বলল, ‘তাহলে সেকালের সব রাজা-জমিদাররা সবাই উদার হতেন, সবাই কি তাই?’
মিঠু বলল, ‘তবু বোধ হয় মানুষগুলো বড় মাপের ছিল, বল তন্ময়!’
তন্ময় বলল, ‘কী জানি!’
‘তুই মানছিস না?’
তন্ময় বলল, ‘একটু বেশি সরলীকরণ হয়ে গেল না? উঁচু ঘর, উঁচু মন। অতটা সহজ বোধ হয় নয়।’
গৌতম মিক্সিতে লস্যি করছিল। ভ্যানিলা সিরাপ দিয়ে, বরফের কুচি সমেত সে পরিবশেন করল সবাইকে।
‘ঠিক যেন রেস্তোরাঁ দেখ,’ মিঠু খুশির হাসি হেসে বলল, ‘নেক্সট আইটেম কী?’
গৌতম তখন দেয়াল আলমারি খুলে দেখাল তার মধ্যে ভেঙ্কটের কত কি গোছানো আছে। দেখেশুনে উজ্জয়িনী বলল, ‘ভেঙ্কটটা তো একটা রীতিমতো গিন্নি দেখছি।’
‘গিন্নি গিন্নি ঘেঁটু-গিন্নি ভালো নাম বার করা গেছে’, অণুকা হাততালি দিয়ে চেঁচাল। তারপরেই জিভ কাটল, ‘ইস কেউ শুনতে পেলে কী মনে করবে?’
‘কেউ শুনতে পাবে না’, গৌতম হেসে বলল, ‘কুড়ি ইঞ্চি গাঁথানির দেয়াল ভাই। এ দিকটাতে ওর এক দাদু ছাড়া কেউ থাকেন না। তিনিও আবার কানে খাটো। ঘেঁটুর এটা স্যাংকচুয়ারি।’
‘তুইও কিন্তু কম গিন্নি নয়’, মিঠু মন্তব্য করল, ‘লস্যিটা দারুণ বানিয়েছিস।’
‘ঘেঁটুর সঙ্গে থেকে থেকে শিখতে হয়েছে সব’, গৌতম স্মিতমুখে বলল। রাজেশ্বরীর মনে পড়ে গেল, সে বলল, ‘তোরা জানিস ভেঙ্কটের এবার সাঙ্ঘাতিক বিশ্রী টাইপের টাইফয়েড হয়েছিল, গৌতম ওকে দিবারাত্র সেবা করেছে।’
গৌতম লজ্জা পেয়ে বলল, ‘ধুস্। কী যে বলিস!’
হঠাৎ মিঠু তার শরবতের গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে এসে বলল, ‘দেখ রাজ, গৌতমের, ভেঙ্কটের, তোরও কতগুলো দিক। তোরা কেউ জীবনটাকে একটা সরলরেখা করে ফেলিসনি। কিউবের মতো তোদের জীবন, কতগুলো পিঠ! এটা আমাকে, কী বলব ম্রিয়মান… না-না মুহ্যমান করে দেয়।’ মিঠুর চোখ একটু চকচক করছে। কেন না তার ইদানীং প্রায়ই মনে হচ্ছে জীবন যেন বন্ধ দরজা, সে বাইরে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত সেই দরজা খোলবার চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু তার কব্জিতে যথেষ্ট জোর নেই।
রাজেশ্বরী বলল, ‘মিঠু আমি মোটেই মানতে পারছি না যে তুই, তোরা মালটি-ডাইমেনশ্যন্যাল নয়। কিন্তু তুই একটা খুব সত্যি কথা বললি এই উপলক্ষ্যে। এই যে জন্মালুম, প্রকৃতির নিয়মে বড় হলাম, গতানুগতিকভাবে স্কুল, কলেজ, খেলাধুলো করে ঠিক আর পাঁচজনের মতো চাকরি, বিয়ে, সংসার তারপর মৃত্যু, এই সরলরেখার জীবন, এটা কিন্তু আমাকে আনন্দ দিতে পারে না। তোদের কথা জানি না। আমার, ব্যাপারটা ভীষণই অকিঞ্চিৎকর মনে হয়, তাই দেখ খুঁজে বেড়াই, খুঁজে বেড়াই, অনেক সময়ে খ্যাপার মতন…।’
‘তুই কি সেজন্যেই পলিটিক্স করিস?’ উজ্জয়িনী জিজ্ঞেস করল। এই মুহূর্তে তার মনে পড়ে যাচ্ছিল তার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরের ভারী পর্দাটা টুক করে যখন সরে গিয়েছিল একটু, তখন সে কী ভয়ানক শূন্যতা দেখেছিল তার পেছনে।’
‘রাজনীতি ঠিক করি না’, রাজেশ্বরী বলছিল, পাকে-চক্রে কিভাবে জড়িয়ে গেলাম, তুইই তো তার সাক্ষী আছিস। কিন্তু রাজনীতির সুবাদে অনেক রকম মানুষের সংস্পর্শে আসি, এটা আমাকে খুব…কী বলব জীবন্ত করে তোলে।’
‘তুই কি গানটা ছেড়ে দিচ্ছিস?’ গৌতম ধীরে বলল।
‘না তো। তবে আজকাল একটু কম রেওয়াজ করি।’
‘আমার কথা যদি শুনিস রাজেশ্বরী। আমি অবশ্য সামান্য মানুষ, গানটা ছাড়িস না। আমি তবলা বাজাতুম, ভালোই শিখেছিলুম, বন্ধ হয়ে যাবার পর আমার ভেতরে খানিকটা জায়গা কি রকম অসাড় হয়ে গেছে, সত্যি বলছি।’
‘তুই তো খুব ভালো বাজাস, উজ্জয়িনীদের বাড়ি শুনেছিলাম,’ মিঠু বলল, ‘ছাড়লি কেন?’
গৌতম বলল, ‘মিঠু আমাদের মতো ছেলেরা যে কেন কিছু ধরে, আর কেন কিছু ছাড়ে তোরা ঠিক বুঝতে পারবি না। ডোন্ট মাইন্ড। প্র্যাকটিস করব তার জায়গা কই? যেখানে বাবা খাতা দেখছেন, সেখানেই দিদি পড়ছে, মা বারবার আসছে যাচ্ছে, ছোট ভাইপোটা দুমদাম বন্দুক ফাটাচ্ছে। সকালে বাজার করে এলুম, একটু পরেই মা বলবে, ‘এইয্যা একশ গ্রাম পোস্ত আনতে বলতে ভুলে গেছি, যা না রে একটু!’ বউদি বলবে, ‘বেরোচ্ছই যখন লাইব্রেরির বই দুটো ফেরত দিয়ে দিও প্লিজ। কী আনবে এই যে লিখে দিয়েছি।’ এই চলল, যতক্ষণ বাড়ি থাকব। দেখ, তোরা মেয়েরা অনেক কাজ করিস, তোরা অবশ্য করিস কি না জানি না, কিন্তু আমাদের মতো ছেলেরাও অজস্র কাজ করে, নিছক ফরমাশ। বলব—আনঅরগ্যানাইজড্ লেবার। তার মধ্যে কোনও স্যাটিসফ্যাকশন নেই।’ গৌতম চুপ করতে সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বেশ কিছুক্ষণ পর মিঠু বলল, ‘সত্যি তোকে অভিনন্দন জানাচ্ছি রে গৌতম। সিনসিয়ারলি বলছি। তুই এতসবের মধ্যে ভেঙ্কটের সেবা করেছিস দিনরাত্তির। তা সত্ত্বেও ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিস। সত্যি তুই একটা…।’
গৌতম খুব জোরে বলে উঠল, ‘ধুস্।’ তারপর বলল, ‘শোন বাড়িতে খবরটা দেওয়া দরকার। তোরা আড্ডা জমা। আমি চট করে ঘুরে আসছি।’
গৌতম আর দাঁড়াল না। ধাঁ করে বেরিয়ে গেল।
তন্ময় হঠাৎ শিরদাঁড়া সোজা করে বসল, বলল, ‘তোমরা একটা কবিতা শুনবে?’
উজ্জয়িনী বলল, ‘শিওর। তুই তো ভীষণ ভালো আবৃত্তি করিস।’
তন্ময় বলল ‘এটা একটা তাৎক্ষণিক কবিতা।’ তার পরে গলা অন্যরকম করে বলে উঠল—
চড়ই তিতির খুঁটে খুঁটে বাঁচে,
শালিখ নাচে উঠোনে, কার্নিশে।
ঘুঘুর মন-খারাপ ছড়িয়ে যায়
ঈশান থেকে নৈঋত
দুপুর বিকেল সন্ধে।
টিয়ারা ঝাঁক বাঁধে।
বক মালা গাঁথে।
চিল ছোঁ মারে হাড় কাঁপানো হ্রেষা রবে মাত্র একবার।
সূর্যের কাছাকাছি উড়ে যায়।
শূন্যে ভাসে।
সারাবেলা
একলা॥
রাজেশ্বরী বলল, ‘কবিতাটা বুঝতে পারলুম বলে ভালো লাগছে। আমি তোর আবৃত্তির ধরন দেখেই বুঝতে পারতাম তুই লিখিস।’
একটু আগে নিচে একটা ট্যাক্সির মিটার নামানোর টিং টিং শব্দ হয়েছিল, কেউ অত খেয়াল করেনি। এখন ঝড়ের মতো হাতে একগাদা প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকল ভেঙ্কট। তার পেছনে আরও প্যাকেট হাতে কিমাশ্চর্যম! ইমন! ইমনের পরনে টেনিস স্কার্ট। তাকে এখন ষোল আনা খেলোয়াড় লাগছে।
দু তিনজন আগে পরে বলে উঠল, ‘কী ব্যাপারে? এসব কী? ইমন কোত্থেকে?’
ইমন বলল, ‘তোমরা সকলে আমার কথা ভুলে গিয়েছিলে, ভেঙ্কট মনে রেখেছে, আমি তো জাস্ট কিছুক্ষণ আগে পৌঁছেছি, কাল জামসেদপুরে টুর্নামেন্ট ছিল। রেজাল্ট দেখে সোজা বাড়ি ফিরে যেতুম, ভেঙ্কট কলেজের গেট থেকে ধরে এনেছে।’
ভেঙ্কট বলল, ‘গৌতম কোথায় গেল? আচ্ছা তো! তোরা আমাকে বাদ দিয়েই ভ্যারাইটি প্রোগ্রাম আরম্ভ করে দিয়েছিস?’
মিঠু বলল, ‘গৌতম এখুনি এসে পড়বে, বাড়িতে খবর দিতে গেছে, আমাদের সবাইকে লস্যি খাওয়ালো।’
‘আর আমরা? আমরা খাব না?’ ভেঙ্কট সবার দিকে তাকিয়ে বলল।
উজ্জয়িনী আর রাজেশ্বরী একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল, ‘দাঁড়া, করে দিচ্ছি।’
‘বাঃ তোরা কি করে জানবি, কোথায় কি আছে? দাঁড়া’, ভেঙ্কট বেরিয়ে গেল। একটু পরে ঠাণ্ডা এক ভাঁড় দই এনে টেবিলে রেখে বলল, ‘কর, কে করবি!’ তার মুখ উজ্জ্বল। নিজের ঘরেই যেন সে আজ বিশেষ অতিথি।
গৌতম এসে পড়েছে। ভেঙ্কট প্যাকেটগুলো খুলছে একের পর এক, খাবারের গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে ঘরময়।
মিঠু বলল, ‘তুই করেছিস কি ঘেঁটু? এই অ্যাতো? আমরা তোকে হেলপ করব তো!’
‘অফ কোর্স, ভেঙ্কটেশ পাল আর নড়ছে না’ ভেঙ্কট নিজের চেয়ারে বসে মৃদুমৃদু পা নাচাতে নাচাতে বলল।
‘তোর নতুন নাম কী হয়েছে জানিস তো? গিন্নি’, অণুকা বলল।
ভেঙ্কট বলল, ‘অরিজিন্যাল কিছু হল না যে!’
‘আমরা অরিজিন্যাল নই, ছোটখাটো, বড় কিছু না, ধর তিতির, চড়ুই, শালিখ এইসব, না রে তন্ময়?’ খাবার সাজাতে সাজাতে উজ্জয়িনী বলল।
তন্ময় বলল, ‘কে জানে, কে যে কী অত সহজে, এত তাড়াতাড়ি কি আর বোঝা যায়।’
ভেঙ্কট বলল, ‘ইমনের একটা ভালো খবর আছে। ইমন বল্।’
ইমন হাসি মুখে বলল, ‘আমি একটা খুব ভালো চাকরি পেয়েছি বম্বেতে। পাবলিক রিলেশন্স্-এর। সাড়ে চার হাজার মাইনে, প্লাস পার্কস। কোয়ার্টার্স পাবো।’
‘উরিবাস সাবাশ্।’ অণুকা বলল।
‘কংগ্র্যাট্স্’। অনেকেই হাত বাড়িয়ে দিল। মিঠু খালি ক্ষুণ্ণ স্বরে বলল, ‘তুই তা হলে বম্বে চলে যাবি? আর পড়বি না?’
ইমন বলল, ‘যা মার্কস এসেছে তাতে কোনও য়ুনিভার্সিটি আমাকে এনট্রি দেবে মিঠু? তা ছাড়া পড়ে আর কী হবে? এবার মন দিয়ে চাকরি করতে হবে, খেলতে হবে। পড়াশোনার আর সময় পাব না।’
মিঠু বলল, ‘মাসিমাকে, কল্যাণকে নিয়ে যাবি তো?’
‘নিশ্চয়ই! সেটাই তো আসল কথা। একসঙ্গে থাকতে পারব আমরা। কল্যাণ খুব ভালো চিকিৎসার সুযোগ পাবে। ভেঙ্কটের কাছে ঠিকানা পাঠিয়ে দেব। তোমরা যাবে আমার কাছে। যখন ইচ্ছে।’
মিঠু বিষণ্ণ মুখে বলল, ‘যাঃ। এবার খেলা ভাঙার খেলা। কে কোথায় ছিটকে যাব। এখন খুব দুঃখ হচ্ছে ভেবে আগে কেন তোদের সঙ্গে আরও আরও বেশি করে মিশিনি। মনে আছে সেই প্রথম দিন ভেঙ্কট বলেছিল, “খবর্দার গ্রুপ করে থাকতে পারবে না…”
ভেঙ্কট চকোলেট ক্রিম ভরা পেস্ট্রি মিঠুর মুখের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘এ শর্মা যা বলে ঠিক বলে বাবা, হাজার হোক প্রেসিডেন্ট তো!’
গৌতম বলল, ‘সত্যিই, আমাদের লাস্ট চ্যাপ্টারটা হেভি জমলো।’
‘তোদের এখনও অনেক চ্যাপ্টার বাকি রে গৌতম, লাস্ট চ্যাপ্টার হল আমার। ছাত্র-জীবন হয়ে গেল। সমা-প্তি।’
মিঠু বলল, ‘মন খারাপ করে দিচ্ছিস কেন রে ঘেঁটু!’
‘নো, নো, নো। মন খারাপ-টারাপ নয়। আমি কিন্তু খুব শিগগিরই জীবনযুদ্ধে নেমে পড়ছি। দমদমের দিকে একটা ফাসক্লাস মাল্টি-স্টোরিড করছি, প্রোমোটার, বুঝলি? প্রোমোটার। ওই যে ইমন বলল আর পড়ে কী হবে? লাখ কথার এক কথা। জীবনযুদ্ধকে বেশিদিন ঠেকিয়ে রেখে লাভ কী! বল! তোরা ভুলে যাবি ভেঙ্কটেশ পাল বলে একজন কেউ ছিল—এটাই!’
গৌতম বলল, ‘হেভি সেন্টু দিচ্ছিস। এই, তোরা কেউ ভেঙ্কট দা গ্রেটকে ভুলে যাবি!’ সবাই হাসতে হাসতে বলল, ‘ওরে বাবা। সম্ভব সেটা!’
ভেঙ্কট দু হাত তুলে ওদের আশীৰ্বাদ করল, ‘ফ্রেন্ডস মে কাম, অ্যান্ড ফ্রেন্ডস মে গো, বাট ভেঙ্কট উইল বী দেয়ার ফর এভার। যাক তোদের কার কী প্ল্যান এখন বল। তন্ময়!’
তন্ময় হঠাৎ বলল, ‘মিঠু, পার্থপ্রতিম তো তোদের রিলেটিভ। ওঁর ঠিকানাটা আমায় দিতে পারিস?’
মিঠুর মুখটা মুহূর্তে ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল, সে মৃদু স্বরে বলল, ‘কেন?’
তন্ময় সোজাসুজি এ কথার জবাব না দিয়ে অন্যদের দিকে চেয়ে বলল, ‘তোরা কেউ পার্থপ্রতিমের “কল্লোলিনী উনিশশ” দেখেছিস?’
উজ্জয়িনী বলল, ‘খুব নাম করেছে। মিঠু কাদম্বিনীর রোল-এ ছিল। শেষ পর্যন্ত করলি না কেন রে?’
‘মিঠু যেগুলোতে করেছিল কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চের সেই প্রথম শো সেটাই আমি দেখেছি, মিঠু কংগ্র্যাচুলেশন্স্!’ তন্ময় হাত বাড়িয়ে মিঠুর হাত ধরতে গেল। মিঠু লাজুক, নিবে যাওয়া স্বরে বলল, ‘খাচ্ছি যে!’
তন্ময় বলল, ‘তোরা দেখলে বুঝতিস কী অসাধারণ করেছে মিঠু। ঋতুও করেছে। কিন্তু ঋতুর বেশির ভাগটাই নাচ, মিঠুকে অনেক এক্সপ্রেশন দিতে হয়েছে। গাইতে হয়েছে। মঞ্চে গান গাওয়া খুব ইজি ব্যাপার নয়। ডাকসাইটে সব শিল্পীদের সঙ্গে করে গেছে, কোথাও বোঝা যায়নি। মিঠু কিছুক্ষণ আগেই বলছিল না তোদের কত দিক আছে, মিঠু নিজেই তো একটা স্পেকট্রাম!’
মিঠু বলল, ‘ভালো হবে না বলছি তন্ময় আমার লেগ পুল করলে।’
তন্ময় বলল, ‘সে যাই হোক। আমার আজকাল মনে হয় পার্থপ্রতিমের কাছ থেকে কিছু শিখে নিতে না পারলে আমার জীবনটা ব্যর্থ হয়ে যাবে। ঠিকানাটা দিস।’
ওই একই ঠিকানা খুঁজতে ঋতুও মরিয়া হয়ে গিয়েছিল। নাটক চলল একাদিক্রমে দু মাস। প্রতি শনি রবিবার, প্রথমে অ্যাকাডেমিতে, পরে রবীন্দ্রসদনে। ওরা সবাই জানত, কলকাতার পালা শেষ করে এবার যেতে হবে টাউনে। সম্ভব হলে গ্রামে। গ্রামে গিয়ে পার্থপ্রতিম নাটকটার ফর্ম বদলে দেবেন। অনেকটা যাত্রার মতো হবে সেটা, এটাও সে কানাঘুষোয় শুনছিল। এই সময়টায় পার্থপ্রতিম যেন স্বেচ্ছাচারী সম্রাট। কোথাও সামান্য বিচ্যুতি হলে তিনি বাঘের মতো গর্জন করে ওঠেন। কাদম্বিনীর ভূমিকায় একটি অভিজ্ঞ মেয়ে এসেছে। কিন্তু তার কাজ তাঁর আদৌ পছন্দ হয়নি। সেই আক্ষেপ অন্য উপলক্ষ্য করে বেরিয়ে আসছে। শহরের শেষ শোগুলোতে লোক উপছে পড়ছে। যত আনন্দ, তত টেনশন। ঋতু প্রতিদিন বাড়ি ফেরে যেন মদ খেয়ে টলতে টলতে। যত গর্ব, তত আনন্দ, তত ক্লান্তি। কিন্তু পার্থপ্রতিমের দেখা মেলে না শোয়ের পর। অতএব, শেষ শো হয়ে গেলে সে আশা করল এবার পার্থপ্রতিম আবার স্ব-মেজাজে ফিরে আসবেন। দুদিন সে অপেক্ষা করল। পার্থপ্রতিম ফোন করুন। পরের প্রোগ্রাম জানান। কিন্তু ফোন বাজল না। ঋতু অগত্যা গলফ গ্রীনে গেল। গলফ গ্রীনের এই ফ্ল্যাট পার্থপ্রতিমের কোন আমেরিকা না কানাডাপ্রবাসী বন্ধুর। কলকাতায় এলে এখানেই থাকেন তিনি। দোতলায় উঠে সে সবিস্ময়ে দেখল তালাবন্ধ। সকাল আটটার সময়ে ঘর ছেড়ে বেরোবার লোক নন পার্থপ্রতিম। বিশেষত এই কমাস ওইরকম ভূতের খাটুনির পর। কাউকে জিজ্ঞেস করতে তার সম্মানে বাধছে। অবশেষে, সে আলোক সম্পাতের মৃগেনদার কাছে গেল। মৃগেনদা বললেন, ‘পার্থপ্রতিম? সে কোথায় এখন কে বলবে? পার্মানেন্ড অ্যাড্রেস তো দিল্লি—কমলানগর। কিন্তু সেখানে কি এখন ও যাবে? এখন ও কোথাও কোনও গর্তে লুকিয়ে বসে আছে। গুহায় আদি মানবের মতো। এক একটা কাজ শেষ হলে ও ওইরকমই করে।’ মৃগেনদার কাছ থেকে দিল্লির ঠিকানাটা জোগাড় করে একটা দুঃসাহসিক কাজ করল ঋতু।
দিল্লিগামী ভেস্টিবিউলের টিকিট কাটল। বাবা-মাকে বলল, ‘কদিনের জন্যে উজ্জয়িনীদের বাড়ি থাকতে যাচ্ছি।’
তার খামখেয়ালিপনায় এখন তার বাবা মা অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। উপরন্তু তার মেজাজকে তাঁরা যমের মতো ভয় করেন। সম্প্রতি আবার নাটকে তার খুব নাম হয়েছে। অর্থাৎ সে খানিকটা তাঁদের গর্বেরও পাত্র। ঋতু যেন তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাঁদের দিকে তাকিয়ে বলতে চায়, ‘ওকে, সি হোয়াট আই ক্যান ডু।’ আজ উজ্জয়িনীর বাড়ি যাবার কথা শুনে মীনাক্ষী, বললেন, ‘উজ্জয়িনীর বাড়ি আবার থাকতে যাবার কী আছে? এত কাছে! ঘুরে এলেই পারিস। রাতে বাড়ি না থাকলে বড্ড খালি খালি লাগে।’
ঋতু বলল, ‘মেয়ে রাতে বাড়ি না ফিরলে দুর্নামের ভয়, না কি?’
অজিত দাশ বেকার মতো বলে ফেললেন, ‘সেটাও একটা কথা বই কি? কত রাত বাড়ি ফিরিস না বল তো, খালি মিঠু-মিঠু। এখন আবার উজ্জয়িনী ধরেছিস! কই ওরা তো তোর বাড়ি থাকতে আসে না!’
‘তবেই বোঝ কি রকম একটা গুমোট আবহাওয়া করে রেখেছে! কারোর ভালো লাগে না।’
‘গুমোট আবহাওয়া! কারুর ভালো লাগে না!’ দাশ সাহেব আর তাঁর স্ত্রী মর্মান্তিক আহত হলেন।
‘এনি ওয়ে, মিডল-ক্লাস মেন্টালিটি দিয়ে আমার বিচার করবে না। আই ডোন্ট বিলঙ হিয়ার!’
‘ঋতু!’ চাপা আর্তনাদ করলেন মীনাক্ষী।
‘বাবা আমাকে শ পাঁচেক টাকা দিতে পারবে?’
‘শ পাঁচেক? হঠাৎ? কী করবি?’
‘কৈফিয়ত দিতে পারব না, দিতে হলে দাও।’ আসলে ঋতুর হাতখরচ, উপহার ইত্যাদি বাবদ ব্যাঙ্কে যা জমেছে তা সব মিলিয়ে বারো তেরো হাজার হবে। সম্প্রতি নাটকের সুবাদেও কিছু পেয়েছে। কিন্তু কত দিন দিল্লি থাকতে হবে, পার্থপ্রতিমকে সেখানে না পেলে, অন্য কোথাও যেতে হবে কি না এগুলো তো তার জানা নেই! তাই যতদূর সম্ভব তৈরি হয়েই যেতে চায়। পাঁচশটা কোনও টাকাই নয়। পাঁচ হাজারের জায়গায় পাঁচশ বলেছে সে। সেটা বলে ফেললে বাবা-মার মনে কৌতূহল জেগে উঠতে পারে! তাইই কমিয়ে বলেছে।
ভেস্টিবিউল পৌঁছল দুপুরে। একটা ট্যাক্সির শরণাপন্ন হল ঋতু। ঠিকানাটা ড্রাইভারকে দিয়ে জিজ্ঞেস করল পৌঁছে দিতে পারবে কি না। মাথায় পাগড়ি শিখ ড্রাইভার কলকাতার রাস্তায় স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতিনিধির মতো, তাই সে নিশ্চিন্তে হেলান দিয়ে বসল। মাঝে মাঝে চোখ খুলে ভালো করে রাস্তা দেখে। আবার চোখ বুজিয়ে ফেলে। হঠাৎ তার খেয়াল হল একই রাস্তা সে যেন দুবার দেখল, একই ধরনের দোকান পাটের বিন্যাস, এবং ঘড়িতে একঘণ্টা পার হয়ে গেছে। যে জায়গাটা দিয়ে যাচ্ছে, তার নাম কালকাজী। ঋতু বুঝতে পারল সে বিপদে পড়েছে, সে তড়িঘড়ি বলল, ‘থোড়া রুখিয়ে তো জী, উও ডিপার্টমেন্টাল স্টোর হ্যায় না, উধার।’ সর্দারজী ট্যাক্সি থামাতে সে চটপট করে তার ওভারনাইট ব্যাগটা নিয়ে নেমে পড়ল। মিটার দেড়শ ছাড়িয়ে গেছে। সে খুব খানিকটা চোটপাট করে টাকাটি মিটিয়ে দিয়ে দোকানে ঢুকল। কাচের পাল্লার ওদিকে ক্যাশ কাউন্টারে এক বিশালাকৃতি পাঞ্জাবি মহিলা তার লক্ষ্য। ঋতু আগে বাবার সঙ্গে একবার দিল্লি এসেছে। কিন্তু সে ছিল ঝটিকা-ভ্ৰমণ। দিল্লি-রাজস্থান। সে বুঝতে পারল ওভাবে বেড়াতে এসে দিল্লির মত এত বড় শহর চেনার কোনও আশাই নেই। নেহাৎ দিনের বেলা তাই। মহিলাটির কাছে গিয়ে ঠিকানাটা দিয়ে সে সাহায্য প্রার্থনা করল। ট্যাক্সি-বিপর্যয়ের কথাটাও ইতস্তত করে বলেই ফেলল।
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘ইয়ে তো পুরানী দিল্লি হ্যায়। ট্যাক্সি ছাড়া যেতে মুশকিল। উও লোগ বহুত বদমাশ আছে। অনজান প্যাসেঞ্জার মিলনে সে অ্যায়সা হী করতে হ্যায়। আচ্ছা এক কাম করো। এখানে বসে যাও, খাও, আরাম করো। আমার হাজব্যান্ড কাউন্টারে আসলে, আমি খুদ তোমাকে নিয়ে যাব।’
অভাবনীয় এই সাহায্যে ঋতু তৎক্ষণাৎ রাজি। কিছুক্ষণ পর মহিলা আড় চোখে চেয়ে বললেন, ‘ঘর সে ভাগনেওয়ালী তো নহী!’
ঋতু কাউন্টারে মাথা রেখে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল, বলল, ‘হোয়াট ননসেন্স।’
‘তো অকেলী কিঁউ? কিস্কা পতা লগানে আয়ী হো বাবা, বয় ফ্রেন্ড?’ মহিলা কৌতূহলী, কূট চোখে চাইলেন।
‘মে বি।’ ঋতু সংক্ষেপে বলল।
আর একটু পরে ভদ্রমহিলা, অর্থাৎ মিসেস অরোরার নির্দেশে দুটো থালী এলো। খাওয়া-দাওয়া করে ঋতু টাকা বার করে মিটিয়ে দিল দামটা। মিসেস অরোরা তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে টাকাটা নিলেন। ভেতরের দিকে একটা রেস্টরুম ছিল সেখানে একটা পরিষ্কার ডিভান পেয়ে ঋতু খুব খানিকটা ঘুমিয়ে নিল। উত্তেজনায়, এবং সারা রাস্তা বসে বসে তার ঘুম হয়নি গতরাতে।
মিসেস অরোরা যখন তাকে ডাকলেন, ঋতু দেখল বিকেল ছটার কাছাকাছি। কাউন্টারে পাকা দাড়িঅলা হাজব্যান্ডকে কিছু বলে মিসেস অরোরা ঋতুকে নিয়ে একটা নীল মারুতি-ভ্যানে উঠলেন। ঋতু তার উড়ন্ত চুল ঠিক করতে করতে বলল, ‘ট্যাক্সি-ফেয়ারের হিসেবে তুমি টাকাটা নিয়ে নেবে কিন্তু। ইউ মাস্ট।’ মিসেস অরোরা স্টিয়ারিং-এ চোখ রেখে বললেন, ‘অফ কোর্স।’ গীয়ার বদলালেন তিনি।
এইভাবে মিসেস অরোরার সহায়তায় সে যখন কমলানগরের বাড়িটায় এসে পৌঁছল তখন সাতটার কাছাকাছি। যদিও চারদিকে ফটফট করছে আলো। বাড়িটা উত্তর কলকাতার পুরনো বাড়ির মতো। সদর দরজায় সবুজ-হলুদ চৌখুপী-চৌখুপী নকশা। মিসেস অরোরাকে ধন্যবাদ এবং পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিয়ে ঋতু দরজাটার সামনে এসে দেখল, কোনও বেল নেই। একটু ঠেলতেই খুলে গেল। সামনে দিয়ে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে। আধো-অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে সে একটা বন্ধ দরজার গায়ে পেতলের ফলকে পার্থপ্রতিমের নাম জ্বলজ্বল করছে দেখতে পেল।
সে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণে তার বুক দুরদুর করছে, হাত ঘামছে। কে জানে হয়ত পার্থপ্রতিমকে এখানে পাওয়া যাবে না, সে ক্ষেত্রে সে কোথায় যাবে, তা-ও ভাবেনি। বেলটা বাজাতে না বাজাতেই দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল। সামনে একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে। খুব সম্ভব পাঞ্জাবি, ওইরকম লম্বা দোহারা, নিটোল চেহারা, হাতে আ-বাঁধা বেণী। বোধ হয় চুল বাঁধতে বাঁধতে দরজা খুলে দিয়েছেন। খুব গম্ভীর। কিন্তু অদ্ভুত একটা লাবণ্য ভদ্রমহিলার চেহারায়। এত ব্যক্তিত্ব যে ঋতু প্রথমটায় কথা কইতে পারেনি, যেন তার কলেজের প্রোফেসর। কিছুক্ষণ পর সে বলল, ‘পার্থপ্রতিমজী হ্যাঁয়?
‘তুমি কে?’ বাংলায় প্রতি-প্রশ্ন করলেন ভদ্রমহিলা।
এতক্ষণে ঋতু তার ঝাঁঝাল ব্যক্তিত্ব ফিরে পেয়েছে আবার।
‘আমি কে সেটা আনইমপর্ট্যান্ট। উনি যদি থাকেন তো দয়া করে ডেকে দিন।’
‘আনইমপর্ট্যান্ট কি না সেটা আমি বুঝব।’ ভদ্রমহিলা গম্ভীর মুখে বললেন।
‘আমি…আমার নাম ঋতুপর্ণা দাশ—ওঁর ট্রুপে আছি।’
‘কোন ট্রুপে?’
‘কোন ট্রুপে?’ ঋতু একটু থমকালো। ‘কল্লোলিনী উনিশশ’ বলে একটা নাটক হয়েছিল কলকাতায়, তাইতে ছিলাম’, অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে বলল।
‘এখানকার ঠিকানা পেলে কী করে?’
‘মৃগেনদা দিয়েছেন।’
‘মৃগেনদা!’ ভদ্রমহিলা যেন স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন, ‘মৃগেন বিশ্বাস? কার সঙ্গে এসেছ? কোথায় উঠেছ?’ এখনও ঋতু দরজার বাইরে। কপাটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ভদ্রমহিলা।
‘কোথাও উঠিনি, একা এসেছি।’ সে অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে বলল। গাম্ভীর্য আর ব্যক্তিত্ব দেখে বেশিক্ষণ ঘাবড়াবার মেয়ে সে নয়। পার্থপ্রতিমকে তার চাই-ই চাই।
ভদ্রমহিলা চমকে উঠলেন, ‘এত রেকলেস?’ আত্মগত বললেন।
ঋতু রূঢ়ভাবে বলল, ‘উনি আছেন কি না, কোথায়, সেটা বলবেন তো!’
‘উনি আছেন। কিন্তু দেখা করা যাবে না।’
‘আপনার কথায় নাকি? এত দূর থেকে আমি ফিরে যাবার জন্যে আসিনি।’
ঋতু দু পা এগোলো।
—ভদ্রমহিলা এবার কড়া গলায় বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছ! যাবে না। যাবে না।’ তিনি দু হাতে ভেতর দিকের আরেকটা দরজা আগলে দাঁড়ালেন।
‘আমি যাবই। আপনি বারণ করবার কে? মিসেস নাকি?’
‘যদি তাই হই। তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে যদিও আমি বাধ্য নই।’
‘বাজে কথা বলছেন। ওঁর কোনও স্ত্রী আছেন বলে আমরা শুনিনি।’ ঋতু জোর করে ভদ্রমহিলার হাত ঠেলে দিয়ে ভেতরে ঢুকতে গেল।
‘কেন যেতে চাইছ? কী দরকার সেটা বলো আগে।’ উনি কেমন উৎকণ্ঠিত গলায় বললেন।
‘বিকজ আই চুজ টু’, ঋতু রুক্ষভাবে বলে, আচমকা ওঁর হাত সরিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল, প্যাসেজ দিয়ে সে প্রায় দৌড়চ্ছে। তার কাঁধে ওভারনাইট ব্যাগ। পরনে স্কার্ট ব্লাউস। ‘পার্থপ্রতিম! পার্থপ্রতিম! হোয়্যার আর ইউ?’
ভেতরের দিকের একটা ঘর থেকে হঠাৎ সাড়া এলো, ‘কে?’ পার্থপ্রতিমের গলা গম্ভীরই, কিন্তু আজ যেন জলদগম্ভীর। ঋতু স্বর লক্ষ্য করে ডান দিকের একটা ঘরের ভেজানো কপাট খুলে ফেলল। ‘পার্থপ্রতিম!’ সে আকুল গলায় ডাকছে। ঘরের ভেতর একটা শ্বাসরোধী গন্ধ। চেক-চেক লুঙ্গি পরে বিশাল চেহারার পার্থপ্রতিম একটা চেয়ারের ওপর বসে আছেন। দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে। ঘরময় সিগারেটের টুকরো ছড়ানো, সেইসঙ্গে খাবারের টুকরো— পাঁউরুটি, ভাত, মাংসের হাড়। পার্থপ্রতিম সোজা ঋতুর দিকে চেয়ে আছেন, চোখ দুটো রক্তাভ, ভেতরে মণি দুটো হঠাৎ কেমন জ্বলে উঠল, তিনি টেবিলের ওপর থেকে একটা টাইমপিস তুলে নিয়ে প্রাণপণে ঋতুর দিকে ছুঁড়ে মারলেন। ঋতুর পেছন থেকে দুটো বাদামি হাত ছিটকে এলো সামনের দিকে, টাইমপিসটা হাতের পাতায় লেগে ঝনঝন শব্দ করে মেঝেয় পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। হাত দুটো সজোরে ঋতুকে পেছনে টেনে এনে দরজাটা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল।
ঋতু ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। মহিলার হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে। ঋতু সেই দিকে তাকিয়ে স্থাণু হয়ে আছে। মহিলা কাটা আঙুলটা মুখের মধ্যে পুরে চুষে নিলেন, তারপর শান্ত চোখে ঋতুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নিষেধ করেছিলাম, শুনলে না। এখন ওঁকে বিরক্ত করতে নেই। ডিপ্রেশন চলছে। ডিপ্রেশন বোঝো?’
ঋতু পায়ে পায়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। ভদ্রমহিলা বললেন, ‘এখন কী করবে? তুমি তো কিছুই ঠিক করে আসোনি!’
ঋতুর মাথাটা ফাঁকা। গলা শুকিয়ে গেছে। সে কোনমতে মাথাটা নাড়ল শুধু।
‘তা হলে এক কাজ করো। রিটার্ন টিকেট করে এসেছ তো?’
‘না।’
‘না? চমৎকার! তুমি কি ভেবেছিলে বাকি জীবনটা এই কমলানগরেই…বাঃ, তা দেখো। থাকতে পারবে?’ গলায় শ্লেষ। কিন্তু ওঁর মুখটা বিষণ্ণ।
ঋতুর চোখ দিয়ে বিন্দু বিন্দু জল পড়ছে এবার। সে ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আপনি ওঁকে নিয়ে এইভাবে থাকেন। ভয় করে না?’
‘ভয়?’ উনি হাসলেন, ‘ভয় করলে চলবে? এটা সাময়িক। কেটে যাবে। তারপর আবার উনি ঝড়ের মতো কাজ করবেন, বিদেশ যাবেন, নাটক করবেন। ছবি আঁকবেন যত দিন না…’
‘যত দিন না!’ ঋতু আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল।
‘যত দিন না এইভাবে, এখানে ফিরে আসতে হয়।’
‘উনি কতদিন এ রকম? বিয়ের আগে থেকেই?’
‘বিয়ে? ও আমার কথা বলছ। হ্যাঁ, ধরো আগে থেকেই…।’
‘তা হলে তো…তা হলে তো অনায়াসেই আপনি ডিভোর্স নিতে পারেন।’
ভদ্রমহিলা এবার হাসলেন, বললেন, ‘তাই তো, ঠিক বলেছ তো! ভারি সাহসী আর হিসেবী মেয়ে তো তুমি?’ এবার ওঁর গলা পাল্টে গেল। বললেন, ‘শোনো ঋতুপর্ণা। আমার সঙ্গে ওঁর কোনরকম বিয়েই হয়নি। আমি যে কোনও দিন, যে কোনও মুহূর্তে ওঁকে ফেলে চলে যেতে পারি।’
‘তা হলে?’
‘তা হলে? “তুমি” জিজ্ঞেস করছ?’ “তুমি”টার ওপর জোর দিলেন উনি, তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ‘চয়েস। এটা আমার ইচ্ছা।’
ঋতু দরজার দিকে এগোচ্ছিল। উনি বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছ? কোথায় যাবে এই সন্ধেবেলায়? শোনো, এখানে অনেক ঘর আছে। থাকার কোনও অসুবিধে হবে না। খালি খুব চুপচাপ থাকতে হবে।’
ঋতু কেঁপে উঠল, বলল, ‘না, আমি মরে গেলেও এখানে থাকতে পারব না। অন্য কোথাও ব্যবস্থা করে দিতে পারেন না?’
‘এখন যা অবস্থা দেখছি, বাড়ি ছেড়ে যাওয়া তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়! কাল সকালে দেখব।’
‘কী করছ? অমৃতা!’ হঠাৎ ও দিকের ঘর থেকে হুহুঙ্কার ভেসে এলো। ঋতু খোলা সিঁড়ি দিয়ে পড়িমরি করে দৌড়েছে। বাইরে বেরিয়ে অনেকটা উর্ধ্বশ্বাসে হাঁটবার পর তার মনে হল পেছন থেকে কে তাকে ডাকছে। ফিরে দেখল নীল মারুতি ভ্যান। মিসেস অরোরা।
‘ইউ?’ ঋতু অবাক হয়ে বলল।
‘চলী তো আও পহলে’, মিসেস অরোরা পাশের দরজা খুলে দিলেন। সে উঠে বসতে, গাড়িতে স্পিড দিয়ে গলি থেকে বেরোতে বেরোতে উনি খুব সাবধানে বললেন, ‘পতা তো ঠিকই লগা, লেকিন লৌট আয়ী কিঁউ?’
ঋতু মুখ নিচু করে হাতের নখ দেখছে, এখনও তার মুখ রক্তশূন্য।
‘লাগতা হ্যায় কি তুম ডর গয়ী হো? ক্যা হুয়া!’
ঋতু শিউরে উঠে বলল, ‘সামবডি ইজ আ লুজি ইন দ্যাট হাউস। আই ডিডন্ট্ নো।’
‘সো ইউ ডিডন্ট নো এনিথিং, অ্যান্ড জাস্ট-অ্যারাইভ্ড্? স্ট্রেঞ্জ!’
ঋতু কথা বলছে না। মিসেস অরোরা বললেন, ‘ডু ইউ রিয়ালাইজ দ্যাট আই টু ক্যান বী আ ভেরি ব্যাড উওম্যান! কুছ হুলিগান লোগ আভি আ জায়ে তো! মে বি আয়্যাম গোয়িং টু সেল য়ু টু ফ্লেশ-ট্র্যাফিকার্স! ষোলা উমর কী এক লড়কী, ইউ জাস্ট লেফ্ট ইয়োর হোম, টু চেজ সামবডি ইন দিস বিগ ব্যাড সিটি?’
ঋতু বলল, ‘আয়্যাম টোয়েন্টি। গোয়িং অন টোয়েন্টিওয়ান।’
মিসেস অরোরা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন, ‘তব তো সব ঠিকই হুয়া, না? কিতনী মাসুম সুরত! ইউ বেঙ্গলি গার্লস লুক সো ইয়াং অ্যান্ড ইনোসেন্ট!’
ঋতু জীবনে এই প্রথম বাকশূন্য হয়ে রইল। তার জিজ্ঞাসা করতেও সাহস হলে না মিসেস অরোরা এবার তাকে নিয়ে কী করবেন। সে জানতো, শুনেছিল রাজধানীর লোকেরা খুব স্বার্থপর, উদাসীন হয়। উনি এখন কোথায় যাচ্ছেন?
দুটো রাত অরোরাদের বাড়িতে কাটল ঋতুর। ওদের বাড়িতে ছেলেমেয়ে কেউ নেই। সবাই ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে কর্মরত। দুদিন মিসেস অরোরা দোকানে গেলেন না। তৃতীয় সন্ধ্যায় বহু চেষ্টায় জোগাড় করা টিকিট নিয়ে সে দিল্লি ছাড়ল। মিঃ অরোরা তাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘ও কে, সী ইউ।’ মিসেস তর্জনীটা নেড়ে বললেন, ‘বাট আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু সী ইউ এগেইন। সমঝী?’
কলকাতা পৌঁছে ট্যাক্সি নিয়ে আগে উজ্জয়িনীদের বাড়ি ছুটল ঋতু। মাসি দরজা খুলে দিলেন। দুটো বাজছে ঘড়িতে।
‘আরে ঋতু? ব্যাগ কাঁধে কোথায় গিয়েছিলে?’
‘উজ্জয়িনী কই?’
‘আজকে তো রেজাল্ট! জুনি কখন বেরিয়ে গেছে। একটু আগে ফোন করে ছিল ভেঙ্কটের বাড়ি গেছে সবাই মিলে। তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি?’
ঋতুর সমস্ত শরীরে মনে হঠাৎ কি রকম একটা তোড় এলো। কিসের যেন বাঁধ ভেঙে গেছে ভেতরে। সামনে মা। একজন মা। এটাই যেন এখন তার পক্ষে অনেক। সে অমিতাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।
‘কী হয়েছে?’ অমিতা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ‘ঋতু কাঁদছ কেন? শোনো, রেজাল্ট নিয়ে একদম ভাববে না। কত পরীক্ষা আছে এখন! উন্নতির কত সুযোগ তোমাদের চারপাশে! ইস্স্ দেখো তো, মুখটা শুকিয়ে গেছে একেবারে।’
অমিতা ঋতুকে জোর করে এনে সোফায় শুইয়ে দিলেন। ঋতুর যেন পায়ে জোর নেই। সে হাঁটতে পারছে না। উজ্জয়িনী যখন প্রায় আটটা নাগাদ প্রচুর আড্ডা মেরে জ্বলজ্বলে মুখে বাড়ি ফিরল তখন ঋতু খাওয়া দাওয়া সেরে একটা পাটভাঙা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে উজ্জয়িনীর বিছানায় শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। অমিতা ফিসফিস করে বললেন, ‘কী রেজাল্ট হয়েছে রে ওর? ভীষণ কান্নাকাটি করছে।’ উজ্জয়িনী চুপি চুপি বলল, ‘অনার্স হয়নি।’ ইস্স্, জুনি তুই ওর দিকে একটু নজর রাখ। আমি এবার ওর বাড়িতে ফোন করে দিই। নম্বরটা নেই। কত ভাবছেন বল তো ওঁরা!’
এমনি করে আরও কয়েক বছর কাটবে। তারপরে আরও বছর। আরও আরও। ওদের মধ্যে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ ডিঙিয়ে যাবে। রাজেশ্বরী হয়ত রাজনীতির ক্ষুরধার পথে জনকল্যাণের দিকে এগোতে গিয়ে এম.এ-টা আর শেষ করতে পারবে না। বিষ্ণুপ্রিয়া নিশ্চয়ই তার নতুন তন্ময়ের হাত ধরে ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজের প্লেনে উঠে গেছে।
নতুন তন্ময়, যার ডাক নাম তনু। পুরননা তন্ময় কি পার্থপ্রতিম ওরফে কবিতা ওরফে গ্রুপ থিয়েটার ওরফে তার সার্থকতার ঠিকানা খুঁজে পেল? অণুকা তো এখন কম্পুটার-ট্রেনিং নিয়ে রীতিমতো গর্বিত চাকুরে। কাঁধে ব্যাগ, অহংকারী পা ফেলে অফিস যাচ্ছে। ভেঙ্কটের মাল্টি-স্টোরিড সম্পূর্ণ হওয়ার মুখে। শেয়ার বাজারে মন্দা দেখা দেবার আগেই সে বেশ কিছু লাভ করে নিয়েছিল। এইবারে গাড়ি বুক করেছে। তার এতো সমৃদ্ধি দেখেও কিন্তু গৌতমের হেলদোল নেই। সে জাত মাস্টার। মাস গেলে নিশ্চিত আয়ের অভ্যাস তার মজ্জায় মজ্জায়। কলকাতার কলেজে না গেলেও তার চলবে। সে একটু জায়গা নিয়ে, হাত পা মেলে থাকতে চায়, সম্ভব হলে একা। ন্যাশন্যাল লাইব্রেরির স্টপে কে কে যেন নামল? উজ্জয়িনী মিত্র আর মিঠু চৌধুরী না? মিঠু কি তার ভেতর থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসা সেই সুদুর্লভ কাদম্বিনীত্ব একেবারে হারিয়ে ফেলেছে? উজ্জয়িনী কি মনে রেখেছে পর্দার ওপারের সেই ভয়াবহ শূন্যতা যা তাকে একটা খণ্ড সময়ের জন্যে হলেও গতিহীন, গৃহহারাদের সঙ্গে স্বাজাত্য দিয়েছিল? হায় ঋতু। তুমি কেন বিপত্নীক হঠাৎ-বুড়িয়ে-যাওয়া অজিত দাশের মাথার কাছে বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে আছ? কেন আর এত ভয়, গ্লানি, অপরাধবোধ! দেয়ালের ছবি থেকে মায়ের হাসি-হাসি মুখ তো সমানেই অভয় দিচ্ছে! ইমন এখন বম্বেয়। তার খেলা, সংসার, চাকরি খুবই দ্রুততালে চলছে নিশ্চয়। বাবুয়াকে সে দাঁড় করাবেই। চাকরিটাও সে মন দিয়ে করছে। স্মিত, সরল অথচ প্রত্যয়ী মুখে ইমন খুব সফল জনসংযোগ করছে। আচ্ছা! সুহাসকে তো প্রায়ই বম্বে আসতে হয়! ও কি ইমনের সঙ্গে তার নরিম্যান পয়েন্টের অফিসে দেখা করে? দুজনে কি হেঁটে যায় কখনও সমুদ্রের ধার দিয়ে দিয়ে? ইমন সুহাসের বিষয়ে মনস্থির করতে পারল কি না কে জানে! ও তো বেশি কথা বলে না, খালি হাসে। আর হাঁটতে পারে। হাঁটতে ওর ক্লান্তি নেই। শুরু করেছিল সেই চূর্ণী নদীর ধার থেকে। মহকুমা হাসপাতাল, ভাংরা পাড়া, ব্রজবালা ইস্কুল, চট্টেশ্বরী কালী মন্দির পেরিয়ে, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, চৌরঙ্গি নেতাজী ইনডোর হয়ে ওয়াংখাড়ে স্টেডিয়াম, জাহাঙ্গির আর্ট গ্যালারি পার হয়ে ক্রফোর্ড মার্কেট, ফ্লোরা ফাউন্টেন দিয়ে গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ায় এসে পৌঁছল। সামনে আরব সাগর। তারপরে মহাসাগর। জীবন মহাজীবন। সময় কেটে যাবে, আরো সময়। আরো, আরো।