Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » একুশে পা || Bani Basu » Page 21

একুশে পা || Bani Basu

নেবার জন্যে কি কেউই নেই?

রাজেশ্বরী বড্ড জড়িয়ে পড়ছে। জড়িয়ে পড়তে তার আপত্তি ছিল না, যদি সত্যিকার কাজের কাজ কিছু হত। কিন্তু এখন তার ধারণা হয়েছে সে ভিড়ের একজন। মিছিল, মিটিং যখন হোক, যেখানে হোক—শামিল হতে হবে। বন্ধ স্থির হোক, যে কোনও কারণে, কারণটা যথেষ্ট মনে না হলেও তার সপক্ষে—ভাষণ দিতে হবে। এই সব কারণেই তার আজকাল সুকান্তদার সঙ্গে লেগে যাচ্ছে।

‘তোরা আসলে কি জানিস তো! ইনকরিজিবলি রোমান্টিক। মাটিতে পা দিয়ে কক্ষনো হাঁটবি না।’ সুকান্তদা কথাগুলো বলে মনযোগ দিয়ে সিগারেট ধরালো।

‘বেশ তো, রোমান্টিক হওয়াটা খারাপ কিসে বুঝিয়ে দাও। রোম্যান্টিসিজম থেকে এত কাব্য-কলা, এত বড় বড় থিয়োরি, এত মহৎ মানুষ, আনন্দ, আত্মত্যাগ…’ রাজেশ্বরী থেমে গেল।

‘বলে যা বলে যা, থামলি কেন?’ সুকান্তদা নিজের ধোঁয়ায় নিজেই আচ্ছন্ন হয়ে বলছে।

‘লিস্ট বাড়িয়ে তো লাভ নেই।’ রাজেশ্বরীর মুখ ব্যাজার।

‘না। আনন্দ আবেগ কাব্য কী সব বলছিলি না? তা ওগুলো দিয়ে পেট ভরবে? দিনমজুর, খেতমজুর, ফুটপাতে আশ্রয় নেওয়া মানুষ, ভরবে এদের পেট? জুটবে বস্তর?’

‘এসব, অর্থাৎ মানুষের ন্যূনতম চাহিদা কিভাবে মেটানো যায়, এ নিয়ে যাঁরা চিন্তা করে এসেছেন তাঁরাও তো ভিশনারি, ড্রীমার, সুকান্তদা। বেশি কথা কী! মার্কস নিজেই তো রোমান্টিক।’

‘শোন রাজেশ্বরী, ভিশনারি হতে পারেন। কিন্তু জাস্ট ড্রীমার এঁরা নন। মার্কস-এর মধ্যে যদি বা একটু থেকে থাকে, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও, হো-চি-মিন— এঁরা কেউ রোমান্টিক নন। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, স্ট্যাটিসটিকস পরিস্থিতি এসবই এঁদের কাজের ভিত। প্রথম ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজড কান্ট্রি ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডের অবস্থাই এঙ্গেলসের লেখার ভিত।’

‘তো তাতে পেট ভরেছে? বস্ত্র জুটেছে।’

‘সোভিয়েত রাশিয়ায় ভরেছিল, জুটেছিল। বিলাসদ্রব্য পাওয়া যেত না। হোর্ড করতে পারত না। অতিরিক্তের লোভ সবাইকেই সংবরণ করতে হত। ইমপোর্টেড কার, ক্যাবারে, ডিসকোথেক ছিল না। কিন্তু বলশয় ব্যালে ছিল, এমন কি বিবেকানন্দ অনুবাদ হচ্ছিল। আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্য জুটত না এইজন্যে যে সারা পৃথিবী ওদের দিকে মিসাইল উঁচিয়ে ছিল। ডিফেন্স বাবদ ওদের একটা প্রচণ্ড খরচ করতেই হত। টিকে থাকার প্রশ্ন ছিল এটা। তাই মোটা ভাত-কাপড়েই সন্তুষ্ট থাকতে হত।’

‘ওদের আর্থিক ব্যবস্থা যে একেবারে বেহাল হয়ে গেছিল সেটা কিন্তু স্বীকার করছ না একবারও। সন্তুষ্টও তো থাকল না শেষ পর্যন্ত। এখন তো ম্যাকডোনাল্ডের হামবার্গার নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে।’

‘হ্যাঁ। স্কুলের বাচ্চা মেয়েরাও রোজগারের ধান্দায় বেরিয়ে পড়েছে কলগার্ল হয়ে। দারুণ অভাব, দারুণতর লোভ। হাজির হচ্ছে পশ্চিমি দুনিয়ার পুরো কনজিউমার মার্কেট। এতদিন সুষম বণ্টনের যে ব্যবস্থাটা কাজ করছিল, সেটা দুম করে ভেঙে দিয়েছ গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্ৰৈকা দিয়ে। নাও, এখন ঠ্যালা সামলাও।’

‘তুমি বলছ তাহলে জোর করে প্রকৃতিবিরুদ্ধ সংযম মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়াই ঠিক! যত বজ্র আঁটুনি, তত ফস্কা গেরো, কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে দিল।’

‘কিছু মনে করিসনি রাজেশ্বরী মানুষ তো আসলে একটা জন্তুই। দীর্ঘদিন ধরে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে নিয়ে না গেলে, যেখানে জাবনা, যেখানে ক্ষেতখামার দেখবে মুখ দেবেই!’

‘বাঃ, মানুষ সম্পর্কে তোমার এই ধারণা, তোমার রাজনীতির দাদারা জানেন?’

‘আরে বাবা, মানুষেকে শিক্ষিত করে তোলা, সমষ্টির মুখ চেয়ে আত্মসংযম করতে শেখানো, এইসবই তো আমাদের কাজ। শোধরাবে মানুষ। আস্তে আস্তে। সময় লাগবে।’

‘চুয়াত্তর বছরেও শোধরালো না? কোন সোস্যালিস্ট দেশটাতে মানুষ খেয়ে-পরে, চিন্তা করে সুখে আছে বলো। চিন? —নেই— প্রমাণ তিয়েনানমেন স্কোয়ার। রুমানিয়া? চাওসেস্কু। চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, ইস্ট জার্মানি কোথায় শান্তি ছিল? চিন টিকে আছে, ধীরে ধীরে মডেল পাল্টাচ্ছে বলে। যাই বলো, সোশ্যালিজ্‌ম্ হ্যাজ রিয়ালি ফেইল্‌ড্।’

সুকান্ত প্রথম সিগারেটের নিবন্ত আগুন থেকে দ্বিতীয় সিগারেটটা আস্তে আস্তে ধরিয়ে নিল, সে গম্ভীর মুখে বলল, ‘রামমোহন বিদ্যাসাগর বাল্য বিবাহ, বহুবিবাহ বন্ধ করে বিধবাবিবাহ চালু করার জন্যে আন্দোলন করেছিলেন, মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার চেয়েছিলেন, নারীজাগরণ চেয়েছিলেন। তা দেখা যাচ্ছে এখনও কোথাও কোথাও সতীদাহ হচ্ছে। ছোটলোক যাদের বলিস তাদের কথা তো ছেড়েই দে। বহু ভদ্দরলোকের একাধিক সংসার আছে, বহুবিবাহ জিনিসটা অন্য ফর্মে চলছে। ডাউরি ডেথ যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে, শুধু শ্বশুর-ভাসুর নয়, ননদ-শাশুড়ি পর্যন্ত যেভাবে পিটিয়ে বউ খুন করতে লেগেছে, তাতে আর যাই বলিস নারী-জাগরণ হয়েছে বলতে পারিস না। পারিস?’

‘কী বলতে চাইছ? শেষ করো কথাটা।’

‘বলতে চাইছি, এখন কি বলবি বিদ্যাসাগর, রামমোহন অ্যান্ড দা লট হ্যাভ ফেইলড? গান্ধিজী-বিবেকানন্দ জাতপাত তুলে দিতে চেয়েছিলেন, তা এখনও মধ্য প্রদেশ, বিহার, উত্তর প্রদেশে হরিজন হত্যা হয়। জাস্ট হরিজন বলেই। সদগতি দেখেছিস তো! ইট ইজ ফ্যাক্ট। এখন কি বলবি গান্ধিজী বিবেকানন্দ ওয়্যাব রং?…’

কফির কাপটা নামিয়ে রেখে রাজেশ্বরী তড়বড় করে বলল, দাঁড়াও দাঁড়াও সুকান্তদা, মোটেই আমি এ ধরনের কথা বলিনি। আমি একবারও লক্ষ্যের কথা বলিনি। মেথড, মেথডের কথা বলেছি। জোর করে মানুষের মুখ বন্ধ করে সব কিছু রাষ্ট্রের অধীনে আনা, সাহিত্যিক-শিল্পী-বিজ্ঞানীদের ডিকটেট করা, স্বাধীন চিন্তাকে শৃঙ্খলিত করা…এইটার সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছি।’

এই সময়ে পুলক এসে ঢুকল। সুকান্তদা হাত উঁচু করে ডাকল, ‘পুলক এদিকে…এইদিকে।’

পুলক বসে পড়ে বলল, ‘কী খাওয়াবে?’

‘পাঁচ ছটাকার মধ্যে যা খাবি।’

‘ধুস। পাঁচ-ছ টাকায় কিছু হয় আজকাল?’

‘এই তো কেন্দ্র এবার ওপন ডোর পলিসি নিচ্ছে। কেমন ফুসমন্তরে সব সস্তা হয়ে যাবে দেখবি। তখন ভালো করে খাস।’

রাজেশ্বরী বলল, ‘আমি খাওয়াচ্ছি।’ বেয়ারাকে হাত নেড়ে ডাকতে ডাকতে পুলক বলল, ‘একটা মোগলাই পরোটা আর একটা চিকেন বল, সুকান্তদার মতো চিপ্পুসগিরি করিসনি, কাঁহা কাঁহা জায়গা থেকে ঘুরে এলুম। এত্তো খিদে পেয়েছে!’

‘এই না হলে মেয়ে? সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা একেবারে।’ পুলক বলল।

‘অন্নপূর্ণা-টুর্ণা বললে খাওয়াচ্ছি না পুলক।’

‘কেন? কেন? কমপ্লিমেন্ট দিলুম তো!’

‘কমপ্লিমেন্ট’, রাগের সুরে রাজেশ্বরী বলল, ‘এইসব তথাকথিত কমপ্লিমেন্টগুলো দিয়ে দিয়েই তো চিরদিন আমাদের এক্সপ্লয়েট করে এসেছিস। মুখে বলিস অন্নপূর্ণা, ব্যবহার করিস ক্রীতদাসীর মতো। খবর্দার, অন্নপূর্ণা তো বলবিই না, মেয়েটেয়েও বলবি না।’

‘মেয়েও বলব না।’ পুলক হাঁ করে রইল।

‘না বলবি না। এই তো জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াই করছিস। এদিকে মজ্জায় মজ্জায় জাতিভেদ। পুরুষজাতি, নারীজাতি। কিছুতেই তফাতটা ভুলতে পারিস না, না, যখন অত্যাচার করিস তখনও ভুলিস না, যখন খোসামোদ করিস তখনও ভুলিস না।’

‘যা বাব্বা, ছিলি সোস্যালিস্ট। হয়ে গেলি ফেমিনিস্ট!’ পুলক বলল।

‘বাজে কথা না বলে খা পুলক। পৃথিবীর যেখানে যত চিন্তানায়ক, বড় বড় মানুষ সব্বাই ফেমিনিস্ট। আমি তো কোন ছার!’

‘কী ব্যাপার সুকান্তদা, আজ থার্মোমিটার ফাটবে মনে হচ্ছে?’ পুলক চিন্তিত চোখে সুকান্তদার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘সোস্যালিজ্‌ম্ ব্যর্থ হয়ে গেছে বলে রাজেশ্বরীর মন খারাপ।’ সুকান্তদা বলল।

‘হবেই।’ পুলক ছুরি-কাঁটা দিয়ে মোগলাই পরোটাটাকে খণ্ড খণ্ড করতে করতে বলল পরম সন্তোষের সঙ্গে, ‘সিনসিয়ার ওয়ার্কার তো! তাছাড়া মেয়েরা’, বলেই অ্যাল্‌ল্ করে এত্ত বড় একটা জিভ কাটল পুলক।

রাজেশ্বরী বলল, ‘পুলক তুই আগে একটা অ্যাংরি ইয়াংম্যান ছিলি। তোর সে ইমেজটাই আমার বেশি ভালো মনে হয়। এখন অবিকল ভেঙ্কটের মতো ফক্কড় হয়ে যাচ্ছিস।’

‘আগে ছিলুম অ্যাংরি, এখন আপাতত হাংরি। এতে দোষের কী দেখলি? আর ভেঙ্কট? ভেঙ্কট হচ্ছে যাকে বলে একটি মচৎকার চ্যাপ। দেলখোশ, দিলরুবা।’

সুকান্তদা বলল, ‘বাজে বকবক বন্ধ কর তো! ওকে বোঝা কেন সোস্যালিজ্‌ম্ ছাড়া পথ নেই।’

‘খুব সিধে করে বুঝিয়ে দিচ্ছি রাজেশ্বরী, কান খোলকে শুন লে। সোস্যালিজমের উল্টো দিকে কী? ক্যাপিটালিজ্‌ম্ তো! ক্যাপিটালিজ্‌ম্-এর লক্ষ্য কী বল তো! সকল ধন-সম্পদ ধনিকদের করায়ত্ত রাখা। হল? ওরা কী চায়? পৃথিবী জুড়ে বাজার, কিন্তু মুনাফা আসবে ওদের হাতে। মজদুরকে ওরা কী দেবে? যতটুকু না দিলেই নয়, ঠিক ততটুকু। অর্থাৎ কী হচ্ছে? রেস্ট অফ দা ওয়ার্ল্ড ওদের স্লেভ। ওরা যা কিনতে বলছে কিনে যাচ্ছে, রাইট অ্যান্ড লেফট্। প্রফিট, জাস্ট প্রফিট। এখন স্টেটের হাতে যদি বণ্টনের ভার থাকে, ব্যবসা থাকে, তার মানেই জনগণের জন্যেই রইল। মুনাফাবাজি বন্ধ।’

রাজেশ্বরী বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তুই চুপ কর পুলক। সুকান্তদা, মার্কসের যুগের ক্যাপিটালিজ্‌ম্ তো আজ আর নেই। ইউনিয়ন আন্দোলনের চাপে পড়েও বটে, সোস্যালিজমের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেও বটে ক্যাপিটালিজ্‌ম্ এখন উদার হয়ে গেছে। মার্কস ভেবেছিলেন রাষ্ট্র-মালিকানার পরের স্টেপই নো স্টেট। কিন্তু তিনি ইতিহাস দেখতে পাননি। ক্যাপিটালিজ্‌ম্ হারিয়ে দিয়েছে তাঁকে। এখন তো সবাই প্রকারান্তরে মেনে নিচ্ছে যে আমেরিকাই ঠিক পথে চলেছে। যাই হোক, এসব আমার চিন্তা নয়, আমার চিন্তা—আমাদের কী হবে?’

‘তোর হাই-সেকেন্ড ক্লাস কেউ মারতে পারবে না।’ একমুখ খাবার নিয়ে পুলক বলল।

‘আঃ, আমি পরীক্ষার কথা বলছি না, আমাদের, মানে এই দেশের কী হবে?’

‘পঞ্চায়েত হয়েছে, অপারেশন বর্গা হয়েছে, লিট্‌র‍্যাসি প্রোগ্রাম নেওয়া হয়েছে। বক্রেশ্বর হবে, মাস এডুকেশন, মাস হেল্‌থ্ সব হবে। আফটার অল পুরো দেশটা তো আর আমাদের হাতে আসেনি। জগাখিচুড়ি চলছে। তো তার মধ্যে থেকেও এত হয়েছে। আরও হবে। যথেষ্ট দিন টিকে থাকা চাই।’

‘কত দিন? চুয়াত্তর বছর?’ রাজেশ্বরী হেসে বলল।

সুকান্তদা এলিয়ে ছিল, উঠে বসে বলল, ‘দিস আই কান্ট টেক রাজেশ্বরী। দিস ইজ হিটিং বিলো দা বেল্ট। চেষ্টা করা হচ্ছে, প্রচুর প্রচুর সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ, এগোনো হচ্ছে আবার পিছিয়ে আসতে হচ্ছে। কিছু ভড়ং আছে। নেতাদের সবাই ধোয়া তুলসী পাতা এমন ক্লেইমও আমি করব না। বাট দিস ইজ ফার ফার বেটার দ্যান বফর্স অ্যান্ড শেয়ার স্ক্যাম। আমাদের মধ্যে অনেকেই সিনসিয়ার। এখন তুমি নর্থ আর সেন্ট্রাল ক্যালকাটার মেয়ে-কলেজগুলোর ভার নেবে কি না বলো। তর্কাতর্কি অনেক হয়েছে। ওয়ার্ডস, ওয়ার্ডস, ওয়ার্ডস। দে অ্যাকমপ্লিশ নাথ্‌থিং। আমরা কেউ ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না ভাই। একটা রাজ্য, অন্ততপক্ষে একটা রাজ্যও যদি এককাট্টা হয়ে একটা গণমুখী শাসনতন্ত্র গড়ে তুলতে পারে, এইটুকুই, জাস্ট এইটুকুই এখন আমাদের সামনে লক্ষ্য। এখন বলো!’

রাজেশ্বরী দ্বিধাগ্রস্ত মুখে বলল, ‘সুকান্তদা, আমি এ ক’বছর কাজ কর্মের সূত্রে কলেজ-টলেজ অনেক দেখলুম। আমার ক্লান্ত লাগে। একই কথা, একই কাজ। একটুও গভীরে পৌঁছনো যায় না, ব্যক্তিগত ঝগড়ার পর্যায়ে সবকিছু নেমে আসে কখনো কখনো। তুমি আমায় তৃণমূল স্তরে কাজ করার সুযোগ দাও প্লিজ। আমি জানতে চাই। বুঝতে চাই।’

‘কিন্তু তুই এত ভালো বলতে পারিস। ক্যারিশ্‌মা আছে। ছাত্র-ফ্রন্টে আমাদের এরকম লোক যে বড্ড দরকার।’

‘কিন্তু আমার বলার ক্ষমতা কোন কাজে আসবে বলো, যদি ভেতরের বিশ্বাস থেকে বলতে না পারি! শেখানো বুলি কপচানোর কাজে আমি একেবারে অচল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি কাজ করতে চাই না।’

‘তুই তো পলিটিক্‌স্ থেকে সোস্যাল ওয়ার্কের দিকে চলে যেতে চাইছিস।’

‘সোস্যাল ওয়ার্কটাই কিন্তু বেশি জরুরি, তা যদি বল।’

‘কোনটাই বেশি জরুরি, কম জরুরি নয়, রাজেশ্বরী। কার কোন দিকে ট্যালেন্ট বুঝে আমাদের কাজ করতে হয়। ঠিক আছে আমি তোকে একটা সংস্থার ঠিকানা দিচ্ছি, দেখা কর। কিন্তু য়ুনিভার্সিটিটায় অন্তত আমার কথা রাখিস।’

রাজেশ্বরী ঠিকানাটা নিল। দুজনের মুখের দিকে তাকিয়েই হাসল। বলল, ‘চলি।’ পুলক তখন আরামে কফিতে চুমুক দিচ্ছে, সে বলল, ‘আয়। কাউন্টারে দামটা জমা দিয়ে যাস। দুগ্‌গা দুগ্‌গা।’

রাজেশ্বরী এখন এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে যে বছর তিনেক আগেকার দিনগুলোর কথা ভাবলে তার সেটাকে পুতুলখেলা-বাল্যকাল বলে মনে হয়। সেখানে সে আর ফিরে যাবার কথা ভাবতে পারে না। কিন্তু এখন সে দেখতে পায় কী জটিল বিন্যাস এই আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোর। এবং প্রতি পদক্ষেপ এখানে মাড়িয়ে যেতে হয় কত সঙ্কীর্ণ স্বার্থ, লোভ, উপকারের ছদ্মবেশে কত দলীয় হিংসা। সে যেন একটা তরুণী নদী সাগরের বদলে পৌঁছেছে এসে অন্তহীন এক জলাভূমিতে। যেখানে প্রতি ইঞ্চিতে মাটির চরিত্র, জলের চরিত্র প্রবঞ্চক। তার ঠাকুর্দা পলিটিক্যাল সাফারার। পুরো যৌবনকালটাই জেলে কেটেছে। কিন্তু সরকারি পেনশন নেন না। বলেন, ‘আমার পুরো যৌবনটার মূল্য নির্ধারণ হল ওই কয়েকশো টাকা! ছিঃ! তাছাড়া আমার তো পৈতৃক সম্পত্তি রয়েছে, শুধু শুধু আমি সরকারি খয়রাতি নিতে যাব কেন! যাদের প্রয়োজন আছে তারা নিক।’ দাদুই বাড়িতে একমাত্র মানুষ যাঁর সঙ্গে রাজেশ্বরীর বনে। ছোট থেকেই সে খুব যুক্তিবাদী। কোন জিনিস না বুঝে মেনে নেয় না। এর ফলে আগে আগে সে খুব তর্ক করত। একদিন এমনি বাদানুবাদ চলাকালীন মা বলে উঠল, ‘উঃ রাজি, কি তর্কই করতে পারিস! এত তার্কিক মেয়ের বিয়ে দেব কি করে তাই ভাবছি। কে বিয়ে করবে একে?’ দাদু ছিলেন। দাদু বললেন, ‘ও কি কথা বউমা! আমাদের দেশে পুরুষ আর কতকাল গণ্ডমূর্খ, যুক্তিভীরু হয়ে থাকবে, যে ন্যায়সিদ্ধ কন্যা বিয়ে করতে চাইবে না! না জুটুক বর, তোমরা ওর জিভ কেটে নিও না।’

রাজেশ্বরীর কাঠামো খুব লম্বা-চওড়া। টকটকে রঙ। মুখ-চোখে বরাবরই একটা দৃপ্ত ভাব। এ কারণেও মা বলে থাকে, ‘তোর সঙ্গে একটা পাঠান-টাঠান দেখে বিয়ে দিতে হবে দেখছি।’

দাদু বলেন, ‘দিতে যদি পার সাহস করে তোমায় আমি বাহবা দেব বউমা। জাত-ধর্মের বাঁদরামি ঘোচাবার এমন উপায় কমই আছে। তবে পাঠানের কাঠামো দেখেই শুধু ভুলো না, নাতনির হৃদয়ের মাপটাও নিও।’

এইসব হাসি-ঠাট্টায় দাদু খুব দড়।

রাজেশ্বরীর কলেজ-রাজনীতি যে আজকাল কলেজে সীমাবদ্ধ থাকছে না, বাড়ি ফেরার সময় তার অনিয়মিত, সে যে ক্রমশই আরো সাহসী, আরো স্বনির্ভর হয়ে উঠছে। লোকের কথায় কান দেয় না, এ সবেতে তার বাবা-মা দুজনেই অসন্তুষ্ট, চিন্তিত। বাবা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন, নিজের বিদ্যা-বুদ্ধি পুরোপুরি খাটিয়ে এখন একজন সফল মানুষ। দাদাও শিগগির বিদেশে যাবে। কিন্তু, বাবা তাঁর ছেলে-মেয়েদের জীবনে কোনও ঝামেলা চান না। তারা যত তাড়াতাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়, সুখী হয়, ততই তিনি খুশি। রাজেশ্বরীর জন্যে এখনই দুজন পাত্র আনা হয়ে গেছে, একজন ডেন্টিস্ট। এখনই খুব পসার। আরেকজন বিদেশে বসবাসরত এঞ্জিনিয়ার। বাবা-মার ইচ্ছা সে এদেরই একজনকে বিয়ে করে সংসারী হয়ে যায়। রাজেশ্বরী হেসে উড়িয়ে দিয়েছে প্রস্তাবগুলো।

দাদু বারান্দায় বসে পাশের বাড়ির বাচ্চার বইয়ে মলাট দিয়ে দিচ্ছিলেন। রাজেশ্বরীকে আসতে দেখে বললেন, ‘কী দিদি, দেশ উদ্ধার করে এলে?’ এ কথাটা দাদুদের সময়ের। সেই সময়ে তাঁরা এটা ব্যঙ্গ হিসেবে শুনেছেন। রাজেশ্বরী দাদুর পাশে টুল টেনে বসে পড়ে বলল, ‘দাদু, তুমি তো এককালে চেষ্টা করেছিলে, দেশ উদ্ধার করা যায়?’

দাদু বললেন, ‘আমাদের লক্ষ্য অনেক সরল ছিল দিদি, ইংরেজ-তাড়ানো। তা অত সরল কাজটাও ঠিকমতো করে উঠতে পারিনি। আর তোমাদের দেশ উদ্ধার? সে তো সত্যিকারের অষ্টাদশ-পর্ব ভাই। কী করে আর সোজাসুজি হ্যাঁ পারা যায় বলি।’

হতাশ গলায় রাজেশ্বরী বলল, ‘তাহলে চতুর্দিকে এই ব্যর্থতা সব কিছুতেই উৎসাহ নিয়ে আরম্ভ, প্রাণপণ কাজ, তারপর ব্যর্থতা—এটাই সত্যি? এটাই নিয়তি? যদিও নিয়তি আমি মানি না।’

দাদু বললেন, ‘সে কী? পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যেতে দেখছ সব? যতটা চেষ্টা, যতটা আশা ততটা হচ্ছে না। হয়ত এক কি দুই শতাংশ হচ্ছে। জীবন্ত মানুষ নিয়ে তো কারবার—তাই অঙ্ক মেলে না।’

‘তাই বলে এইভাবে স-ব বানচাল হয়ে যাবে?’

‘তুমি কি রাশিয়া আর পূর্ব-ইউরোপের কথা ভেবে বলছ?’

‘কতকটা তো তাই-ই। সারা পৃথিবীর মানুষ কি আশা আর বিশ্বাস নিয়ে চেয়েছিল না ওই দিকে? ভাবেনি এইভাবে মানুষের বেশির ভাগ মৌলিক সমস্যার একটা সমাধান শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল? এখন আমাদের কী হবে?’

রাজেশ্বরীর গলা দিয়ে উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ছে।

দাদু বললে, ‘দেখ দিদি, আমাদের এখানে তো এরা পার্লামেন্টারি ডেমোক্র্যাসি মেনে নিয়েছে আগেই। মেনে নিয়েছে মাল্টি-পার্টি সিস্টেম। আলাদা মডেলে কাজ হচ্ছে। সোভিয়েত রাশিয়ার ভাগ্য পরিবর্তনে আমাদের তো সত্যিকার কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হওয়ার কথা নয়?’

‘দাদু, পার্লামেন্টোরি ডেমোক্র্যাসি মেনে নিয়েছে বাধ্য হয়ে, কেন্দ্রে ক্ষমতা পায়নি বলে। কিন্তু ঝোঁকটা তো বরাবরই লেনিনিজমের দিকে! আমরা তো লেনিনিস্ট আদর্শের কথাই সর্বত্র বক্তৃতায় বলে বেড়াই, এখন সেই আদর্শটা মার খেয়ে গেলেও আমরা যদি একই কথা বলতে থাকি, কে শুনবে? কে বিশ্বাস করবে? এখনও কি আমরা এই ব্যর্থ তত্ত্বটাই আঁকড়ে থাকব?’

দাদুর হাতের কাজ থামিয়ে বললেন, ‘রাজি, পূর্ব ইউরোপের যদি এ অবস্থা না-ও হত তা হলেও ভারতে কখনও সোভিয়েত মডেল ব্যবহার করা যেত না। কাজে নামলেই পাল্টে যেত মত ও ব্যবস্থা। এত ভাষা, এত ধর্ম, আচার-বিচার, পোশাক-পরিচ্ছদ, লোকসংস্কৃতি! চিন, ইউরোপ, এমন কি সোভিয়েত রাশিয়াতেও এমনটা নেই। এতো সব স্বাতন্ত্র্য কিছুতেই এক খোঁয়াড়ে ভরা যেত না। জলে নামলে তখন বোঝা যায় কত ঢেউ, কত ডুবো পাহাড়, কত চোরা স্রোত। অ্যাবস্ট্রাক্ট ফিলসফির কম্মো নয়।’

রাজেশ্বরী বলল, ‘সত্যিই বলছি দাদু আমি কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছি না। আমার সামনে টোট্যালিট্যারিয়ান স্টেট যেমন কাঠগড়ায়, গণতন্ত্রও তেমনি কাঠগড়ায়। এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অশিক্ষিত বিরাট দেশে গণতন্ত্র তো পরিহাস! আবার ডিক্টেটরশিপকেও প্রাণ ধরে রাশ ছেড়ে দেওয়া যায় না। এখানে সমষ্টি যেমন অশিক্ষিত, গোষ্ঠী বা ব্যক্তিও যে ঠিক সেই অনুপাতেই দাম্ভিক, ক্ষমতালিপ্সু। সুকান্তদা ঠিকই বলেছে। বোধ হয়। তখন খুব খারাপ লেগেছিল, এখন মনে হচ্ছে ঠিকই।’

‘কী বলেছে তোর সুকান্তদা?’

‘বলছিল মানুষ আসলে জন্তু। মানে জানোয়ার।’

দাদু চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘মানুষ তো আসলে জন্তুই। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু জানোয়ার কী? খুবই চেঞ্জফুল, অনেকটাই পরিবেশ, শিক্ষা, সংস্কারের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু রাজি আমরা যখন কাজ করতুম, মানুষকে জানোয়ার দেখিনি ভাই। অনেকগুলো বছর হয়ে গেল। এখন…কী জানি! ভাবের কথা বলছি না, সত্যিই মানুষকে জানোয়ার দেখিনি…।’

রাজেশ্বরী হঠাৎ বুঝতে পারল— তার বাবা-মার সঙ্গে তার জেনারেশন গ্যাপ। এমন কি তার নিজের সমসাময়িকদের সঙ্গেও। দাদুই একমাত্র ব্যক্তি যাঁর সঙ্গে তার কোনও জেনারেশন গ্যাপ নেই। তারা দুজনেই এক মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে পুব দিকে মুখ করে, হাত ভর্তি আশা, উৎসাহ, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, কর্মৈষণা? হায়! নেবার জন্যে কি কেউই নেই?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress