Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » একুশে পা || Bani Basu » Page 14

একুশে পা || Bani Basu

ঘরেও নহে, পারেও নহে।

গৌতমের বাবা হরিসাধনবাবু স্থানীয় বয়েজ স্কুলের হেড মাস্টারমশাই। তাঁর প্রধান দুঃখ স্কুলের ছেলেগুলির মধ্যে থেকে দু-চার বছর অন্তর অন্তরই এক আধটা প্রথম দশের মধ্যে হয়। কিন্তু নিজের ছেলেদের মধ্যে কেউই সুবিধে করতে পারল না। বড়টি তো আবার এম. এসসি পড়তে পড়তেই বিয়ে করে ফেলেছে সহপাঠিনীকে। সে এক কাণ্ড, ভাবলেও এখন গায়ে কাঁটা দেয়। ও পাড়ার ছেলে এসে এ পাড়ায় শাসিয়ে যাচ্ছে, এ পাড়ার ছেলে যাচ্ছে ও পাড়ায় শাসাতে। মেয়েটি বাবা-মার কাছ থেকে পালিয়ে তাঁর বাড়িতে এসে আশ্রয় নিল, গিন্নি তাকে চুপি চুপি নিজের বাপের বাড়ি চালান করলেন। ওফ্। ছেলে বউ দুজনেই এখন স্কুলে কাজ করছে। সায়েন্সের কোচিং। দু হাতে টাকা রোজগার করছে। বরানগরের দিকে চমৎকার ফ্ল্যাট কিনেছে। যে কোনদিন উঠে যাবে। বড় মেয়েটি কিছুতেই বিয়ে-থা করল না। তার আবার কিছু গোপন কথা আছে কি না বুঝতে পারেন না হরিসাধনবাবু। কিন্তু ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে তার একদমই বনিবনা নেই। মেয়েও স্কুলে চাকরি করছে আজ অনেক বছর হল। ছেলে-বউ চলে গেলে সংসারে মুখ কমবে তিনটে কিন্তু টাকা কমে যাবে অনেকটা। আমোদ আহ্লাদের ভাগেও কমবে অনেক। নাতিটা চলে যাবে। ছেলে-বউ লোক খাওয়াতে ভালবাসত। সে-সব জিনিস আর থাকবে না বাড়িতে। তাঁর বয়স হয়েছে, এক্সটেনশন পিরিয়ড শেষ হয়ে এলো। এখন আর টুইশন করতে পারেন না। তাঁর আশা ছোট ছেলেটি শিগগির দাঁড়াবে। মেয়ের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিতে হলে তিনি মরমে মরে যাবেন।

তিনি গৌতমকে আজ ডেকে পাঠিয়েছেন। তার মা বোতাম বসাবার নাম করে ঘরের কোণে একগাদা পাঞ্জাবি, শার্ট, ছুঁচ, সুতো নিয়ে বসেছে। ছোট ছেলেকে কিচ্ছুটি বলবার জো নেই। গৌতম এসে দাঁড়িয়েছে।

‘বাবা, ডাকছিলে?’

‘হ্যাঁ, মানে পড়াশোনা কি রকম হচ্ছে? ফাইনাল তো এসে গেল।’

‘হচ্ছে ভালোই!’

‘বসতে তো দেখি না’।

‘এ বাড়িতে বসবার জায়গাটা কোথায়?’

ছেলের মা বললেন, ‘ঠিক কথা। দু’খানা ঘর খোকন নিয়ে আছে। মিনু আর আমি একটাতে। এ ঘরে সর্বক্ষণ তোমার সঙ্গে থাকা ওর পোষায়? কারুর চোখের সামনে সদাসর্বদা পড়াশোনা হয় না বাপু। সে তুমি যা-ই বলো।’

‘তাহলে পড়াশোনা তোমার একেবারেই হচ্ছে না?’ বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

‘হবে না কেন? কলেজে, লাইব্রেরিতে, বন্ধুর বাড়িতে।’

‘বন্ধু, মানে ঘেঁটু? ঘেঁটুদের বাড়ি তো একটা মেছোবাজার বিশেষ। সেখানে পড়া?’

‘মেছোবাজারের মধ্যেই নিরিবিলি আছে। ওর মেজদাদু ওকে দু’খানা ঘর দিয়েছেন।’ শেষ কথাগুলো বেশ জোর দিয়ে বাবাকে শুনিয়ে বলল গৌতম।

‘দু’খানা না হোক, একখানা ঘর তুমি শিগগিরই পেয়ে যাবে মনে হয়, খোকনরা বরানগরে চলে গেলে। তবে তোমার পরীক্ষার পড়া কি আর তদ্দিন বসে থাকবে!’

‘তারপর? কী করবে কিছু ভেবেছ? এরপর পার্ট টু। তারপর?’

‘দেখি। এম. এ পড়ব, ঠিকঠাক রেজাল্ট হলে।’

‘তার মানে আরও দু তিন বছর আমায় টানতে হবে। বি-এ-তেই আড়াইশ করে কোচিংয়ের জন্যে দিতে হচ্ছে, এম-এ-তে তো পাঁচশ নেবে। পাব কোথায়?

‘গৌতম বলল, ‘দিতে হবে না।’

‘কোত্থেকে পাবে, তবে?’

‘পাব না। এম. এ পড়ব না। এ পরীক্ষাটা দিয়েই মোটর-ড্রাইভিং-এ ট্রেনিং নেব ঠিক করেছি। ট্যাকসি ড্রাইভার হয়ে যাব।’

‘তুমি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ?’ হরিসাধনবাবু উত্তেজিত হয়ে বলেন।

‘তুমি ঠাট্টা করলে আমাকেও ঠাট্টা করতে হয়।’

‘আমি? আমি তোমার সঙ্গে…?’

‘পরীক্ষার আর ঠিক তিন মাস বাকি। এমনিতেই দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না। এখন ডেকে এইভাবে বিরক্ত করাটা ফ্রাসট্রেশন বাড়িয়ে দেওয়াটা একটা ক্রুয়েল ঠাট্টা ছাড়া কী?’ গৌতম উত্তেজিত না হয়েই কথাগুলো বলল।

গৌতমের মা বললেন, ‘সত্যিই তো, এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। এত অসুবিধের মধ্যেও খোকা তো চুপচাপ নিজের কাজ করে যাচ্ছে। নিজে সারা জীবন ওদের কখনও পড়ালে না, শোনালে না। গণ্ডা-গণ্ডা পরের ছেলে মানুষ হয়ে গেল। এখন তেণ্ডাই-মেণ্ডাই করলে কী হবে?’

‘গণ্ডা গণ্ডা পরের ছেলে কি পড়িয়েছি সাধ করে? তোমার সংসারটি চলেছে কিভাবে?’

‘অমনি সংসার আমার একলার হয়ে গেল?’ গৌতমের মা রাগ করে সেলাই নিয়ে উঠে গেলেন। গৌতম আগেই বেরিয়ে গিয়েছিল।

দালানের ও প্রান্তে দাদাদের দুটো ঘর। একটাতে সারাক্ষণ কোচিং চলে। বউদির মর্নিং স্কুল। এগারোটায় বাড়ি এসে একটা অবধি জিরিয়ে নিয়ে পাঁচটা পর্যন্ত বউদি ব্যাচকে ব্যাচ পড়ায়। দাদা শুরু করে ভোর সাড়ে ছটা থেকে সাড়ে ন’টা পর্যন্ত। আবার ছটা থেকে নটা। নটার পর ঘরখানা খালি হয়। কিন্তু সারা দিনে একশ দেড়শ ছাত্র-ছাত্রীর চটি জুতোর নোংরায় অকথ্য হয়ে থাকে। এটাই ছিল আগে বৈঠকখানা। এখানে বাবাও একসময়ে ছাত্র পড়িয়েছেন, এখন যে দু’চারজনকে পড়ান, ভেতরের শোবার ঘরেই পড়ান। বাবার ঘরেই ভিন্ন তক্তপোশে শোয় গৌতম। বাড়িতে টেঁকাটাই তার কাছে একটা সমস্যা। তার আবার পড়া? সে আজকাল ভেঙ্কটের আস্তানায় জুটেছে। কিন্তু ভেঙ্কটের পড়াশোনা ছাড়া আর সব ব্যাপারে দুরন্ত উৎসাহ। পড়তে পড়তে ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে যায় গৌতম।

‘কী আকাশ-পাতাল ভাবছিস?’ ভেঙ্কট একটা গদিমোড়া বাহারি আরাম কেদারায় শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে বলল।

গৌতম বলল, ‘তোর আর কি?’

ভেঙ্কট তেমনি পা নাচাতে নাচাতেই বলল, ‘জানিস তো বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। আর ম্যান ইজ দা আর্কিটেক্ট অফ হিজ ওন ফেট। নিজের ভাগ্য নিজেকে গড়ে নিতে হয়।’

‘গড়তে হলেও কিছু একটা চাই তো! শূন্যের ওপর কি কিছু গড়া যায়?’

উঠে বসল ভেঙ্কট, বলল, ‘দাঁড়া, রাবড়ি আর ওমলেট খা আগে, তবে বুদ্ধি খুলবে।’

সে তাড়াতাড়ি ঘরের কোণে হিটারে ওমলেট ভাজতে লেগে গেল। প্লেটে ওমলেট, আর পলিথিনের কাপে রাবড়ি। এগিয়ে দিয়ে, নিজে বেশ খানিকটা মুখে পুরে বলল, ‘খা, তারপর কী বলবি বল!’

‘আমি কিছুই বলব না। বলবার কিছু নেই।’

‘এরকম স্যাঁতসেঁতে মেরে যাচ্ছিল কেন দিন কে দিন? প্রথম যখন কলেজ ভর্তি হলি কত ফুর্তিবাজ ছিলিস তখন!’

‘কিছু হয়নি। কিছু হবে না। আমার মতো ছেলেদের জীবন একটা বিরাট নো।’

‘পথে আয়। এই কথাই বলছিলি তো একটু আগে? শোন, তুই বলছিলি আমার পায়ের তলায় মাটি আছে। ছিল না, ছিল না গৌতম বিশ্বাস কর। জয়েন্টে চান্স না পেতে বাবা আর দাদা এমন করতে লাগল যেন আমি অচ্ছুৎ। আর কাজিনগুলো? মুখে একটা ব্যঙ্গের হাসি, কী, কেমন হল? এমনি ভাব। এইসব পুরনো কালের যৌথ পরিবার জানবি হিংসে, পরশ্রীকাতরতা আর স্বার্থপরতার এক একটি ডিপো। আমার কাজিন দাদাগুলো তো বেশির ভাগই এঞ্জিনিয়ার, ভালো চাকুরে, কিন্তু কী পরিমাণ মক্ষিচুষ তুই ধারণা করতে পারবি না, সেই সঙ্গে পিপুফিশু। আর দুটো বুড়ো আছে মেজদাদু আর ছোড়দাদু। মেজদাদু কাজ-কর্ম চাকরি-বাকরি কী করত জানি না, কিন্তু শেয়ারের ঘুণ, প্রচুর টাকা করেছে, ছেলে নেই একটাও। আমার মায়ের হাত তোলা সেবা নিতে বাধ্য হচ্ছে তাই। এত কঞ্জুষ বুড়ো উপুড় হস্ত হবে না কখনও। আর ছোড়দাদুটা হচ্ছে দুঁদে উকিল। দিদা নড়াচড়া করতে পারে না এমন আর্থরাইটিস। মেয়েদের দূরে দূরে বিয়ে হয়েছে। ছেলেদের একটাও কাছে থাকে না, ওই দিদার ভয়ে। বুড়ো-বুড়ি দুজনেই প্রচণ্ড সেকেলে, শুচিবেয়ে, আর প্রচণ্ড ফরমাশ করতে পারে। এই গৌতম, শুনছিস?’

গৌতম বলল, ‘শুনছি। কিন্তু তোদের ফ্যামিলির কেচ্ছা শুনে আমার কী হবে। বল!’

‘আঃ, শোনই না। কেচ্ছা করছি না। ইনফ্রাস্ট্রাকচারটা বললুম। আমি কী করলুম জানিস তো! তোষণ নীতি নিলুম।’

‘কী নীতি?’

‘তোষণ, তোষণ! যার যা দরকার হচ্ছে। এ কাকিমার ঝুলঝাড়া দরকার, ও বউদি ফুলঝাঁটা পাচ্ছে না, এ দাদা সময় পাচ্ছে না বউদিকে ডাক্তার দেখিয়ে আনতে। ও জেঠির কল্পতরু উৎসবে যাবার ইচ্ছে, সব করতে লাগলুম। সব। স-ব। আর মেজদাদুর এইসা সেবা লাগালুম না! একেবারে তাক লেগে গেল। আর সমানে ছোড়দিদার পেছনে লেগে রইলুম। এ ডাক্তার আনি, ও মালিশ আনি, উপোস করে বারাসত থেকে কবরেজি ওষুধ, তার আচার-বিধি বলব কি গৌতম বছর খানেক প্রাণ একেবারে বেরিয়ে গেছে। তারপর আস্তে আস্তে সব বেরুলো। সববাইকে এক ধার থেকে হাত করে নিয়েছি। মেজদাদু তো ঘেঁটু বলতে অজ্ঞান। আমিও তো এখন রীতিমতো শেয়ার খেলছি রে! পারছি। লাভ হচ্ছে। তবে খুব খেয়াল রাখতে হয়। তবে মনে করিসনি আমি ভোগা দিচ্ছি। মেজদাদু আর ছোড়দিদা সত্যি অসহায় লোক। আমার বড্ড কষ্ট হত রে ওদের জন্যে। বাড়িখানা কিরকম তাক লাগাবার মতো করে ফেলেছি দেখেছিস।’

‘তা তো দেখছি। কিন্তু এ বাড়িটা। টাকা বার করবার মতো অতগুলো পকেট, অসহায় দাদু দিদা এগুলোও তো তোর ছিল, এগুলোই তো তোর ক্যাপিট্যাল।’

ভেঙ্কট গম্ভীর ভাবে বলল, ‘মোটেই এসব ক্যাপিট্যাল নয়। আসল হল এই দিলটা। দিলটা কে এমন খুলে দিলে বল তো! বলতে পারবি না তো? রাজেশ্বরী।’

গৌতম হেসে ফেলে বলল, ‘এখনও তুই রাজেশ্বরীর পেছনে সেঁটে আছিস।’

‘তুই তাই দেখলি? সেঁটে আছি! মেয়েটাকে দেখে মাইরি আমার কেমন একটা মহাভাব হয়। বিরাট বিরাট স্কেলে চিন্তা করি। বিশাল বাড়ি, বিরাট গাড়ি, অজস্র টাকা, প্রচুর খরচ করার মতো দিল।’

‘তুই কি বাড়িটাকে ওর উপযুক্ত করবার চেষ্টা করে যাচ্ছিস? ভেঙ্কট বাড়ি, বংশ, টাকাকড়ি এই-ই সব নয়। ধর এসব সত্ত্বেও যদি ওর তোকে পছন্দ না হয়?’

‘আরে দূর। পছন্দ তো হবেই না, ওর থেকে তো আমি বেঁটে। আমিই বা কোন লজ্জায় একটা নিজের থেকে লম্বা মেয়ের পাণিপ্রার্থী হব বল! চিরকাল পেছন পেছন হাঁটতে হবে।’

‘তাহলে?’

‘আরে ও হচ্ছে আমার জীবনে প্রথম ইনসপিরেশন। ও অনেক উঁচুতে। দেবী। শী ইজ এ গডেস। সব কিছু ওর বড় মাপের। আমি যদি আর্টিস্ট হতুম তো ওর ছবি আঁকতুম, মূর্তি গড়তুম, লেখক হতুম তো কবিতা লিখতুম। তা এসব গুণ তো আমার কিছু নেই, আমি নিজের জীবনটাকেই বিরাট করে গড়ি। মানে,’ একটা লজ্জা পেয়ে ভেঙ্কটেশ বলল, ‘বিবেকানন্দ-টন্দর মতো বিরাট নয় এই আমি যা পারি, আমাকে যা মানায়…ধুর আমি ঠিক এক্সপ্লেন করতে পারছি না ইয়ার।’

গৌতম খানিকক্ষণ হাঁ করে ভেঙ্কটের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে গিয়ে ওর মাথাটা টিপেটুপে দেখতে লাগল।

‘কী করছিস, এই কী করছিস?’

‘দেখছি শালা, তোর খোপরিটা নরম হয়ে গেছে কি না।’

‘হ্যাঁ ঠিক ধরেছি। ব্রহ্মতালুর কাছটা বহুৎ নরম। তলতল করছে।’

‘ভেঙ্কট বলল, ‘ঠিক আছে তুই রাবড়িটা খেয়ে নিয়ে পড়। এই ভেঙ্কট থাকতে তুই ভবিষ্যতের কথা ভাবা ছেড়ে দে। মন দিয়ে পড় দিকিনি গৌতম!’

‘আর তুই? তুই পড়বি না? তোর পরীক্ষাটা কি রাজেশ্বরী দিয়ে দেবে?’

‘আহা হা, যখন তখন কি দেবী-নাম করতে আছে? পড়ব, পড়ব, এখন একটু দিবাস্বপ্ন দেখি।’ বলে ভেঙ্কট আবার আরাম কেদারায় শুয়ে শুয়ে আস্তে আস্তে পা নাচাতে লাগল।

কে জানে কেন গৌতমের মনের ভেতরের জমাট মেঘ, কুয়াশা সব একটু একটু করে কেটে যেতে লাগল। সে কিছুক্ষণের মধ্যেই ইন্ডিয়ান কনস্টিট্যুশনের মধ্যে মগ্ন হয়ে গেল।

সন্ধে হলে পট পট করে আলোগুলো জ্বেলে দিল ভেঙ্কট। তারপর গৌতমের পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়ে বলল, ‘এই গৌতম, আর কতক্ষণ পড়বি। অল ওয়ার্ক অ্যান্ড নো প্লে?’

গৌতম বই বন্ধ করে দিল। হাতের পেনসিলটা রেখে দিল। হতাশ গলায় বলল, ‘নে, খেল, কি খেলবি।’

‘খেলব না বলব। সোশ্যালটা কনডাক্ট করল কী রকম? বক্তৃতা দিল কী! দুর্দান্ত বল? তারপর ডান্সড্রামা, নাটক সব ওর নিজের পরিচালনা। কিন্তু কিরকম সংযম দেখ! অত ভালো গাইতে পারে, একটি গানও গায়নি। পরিচালনা করছে তো! অন্যরা তো এটা ওটা করবার জন্যে ঠেলাঠেলি। হুড়োহুড়ি। ও দেখ কা-ম। অন্য মেয়েগুলো সোশ্যালে এসেছে প্রজাপতির মতো সেজে। ও দেখ, লাল পাড় গরদের শাড়ি। খোলা এত খানিক চুল। দুর্দান্ত, একেবারে দেবী দুর্গা।’

‘লক্ষ্মী হলে তোর সুবিধে হত!’

‘কেন? ও। আরে তোকে তো আগেই বলেছি, আমি ও লাইনে নেই। ভোটে জিতে কিরকম রেজিগনেশন দিল? বন্ধুর কষ্ট হল দেখে। জাস্ট এই। কী মহাপ্রাণ দেখ মেয়েটা। তারপর উজ্জয়িনীর বাড়ি গান গাইল? আহা ক্যয়সে ভঁরু গা গরিয়া। মনে আছে গানটা? আর পন ঘট পে নন্দ লালা, লতার গলায় শুনেছি একরকম। ওর গলায় গানটা যেন একেবারে অন্যরকম হয়ে এলো।’

‘লতার চেয়ে ভালো?’

‘সত্যি বলব? আমার কাছে লতার চেয়েও ভালো লেগেছে। কী দরদ।’

গৌতম বলল, ‘চল একটু রাস্তা থেকে ঘুরে আসি। ঘরটা ভ্যাপসা লাগছে।’

হেদুয়া পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে, বেশ কয়েকটা পাক দিয়ে রাত আটটা বাজলে ফিরতে লাগল দুজনে। ভেঙ্কট বলল, ‘তুই রাত্তিরটাও আমার বাড়ি থেকে যা না গৌতম। তড়কা রুটি কিনে আনব। খাওয়া হয়ে যাবে। ভোর বেলা উঠে পড়তে পারবি।’

‘তুই তো সারা রাত রাজেশ্বরী রাজেশ্বরী করবি। ঘুমোব কী করে?’

ভেঙ্কট বলল, ‘এই দেখ, প্রমিস করছি প্রমিস। তুইও পড়বি। আমিও পড়ব। চল মাইরি চল।’

গৌতম বলল, ‘না, আজ নয়। আরেক দিন। আরেক দিন।’

গৌতম বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। ভেঙ্কটও তারই মতো সাধারণ। তবু ভেঙ্কটের কত আছে। সবচেয়ে বড় কথা, স্বপ্ন আছে। গৌতমের তা-ও নেই। তবলটা ভালো খেলত হাতে। কিন্তু যেই একটু এদিক-ওদিক যেতে শুরু করেছে বাজাতে, বাড়িতে “নো” হয়ে গেল। সে ভেঙ্কটের মতো কিছু দিয়ে নিজেকে ভোলাতে পারে না। যতই দিন যাচ্ছে, কঠিন কঠোর বাস্তব তার চোখের সামনে, পায়ের তলায় কঠোরতর, রূঢ়তর হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই পৃথিবীতে, সরু গলির একতলার ঘরে, আইবুড়ো দিদি, নিজেদের স্বতন্ত্র আস্তানা করার সংকল্পে মুখে রক্ত উঠিয়ে খটিতে থাকা দাদা-বউদি, বুড়িয়ে যাওয়া বাবা-মা, আর উঠতি ইংশিল-মিডিয়ামে পড়া পাকা ভাইপো নিয়ে সে গৌতম একদম একটা জেলখানায় বন্ধ হয়ে গেছে। সে এখানে থাকবে না। কোথাও চলে যাবে। কিন্তু বাবা-মার কী হবে? মা, মা বেচারি বড় খোকা অন্ত প্রাণ, সব ঝড়-ঝাপটা থেকে খোকাকে বাঁচাতে মা এক পায়ে খাড়া। কী রকম বুড়িয়ে গেছে মা, যেন একতাল কাদা নিয়ে কে যেমন খুশি তেমন ভাবে থেঁতলে গেছে। ওই তো উজ্জয়িনীর মা-ও তো মা! তার মায়ের থেকে এমন কিছু ছোট হবেন না। কিন্তু কী সতেজ, কথাবার্তা চলা-ফেরা স-বই আলাদা। তার মায়ের এক সময়ে সুন্দরী বলে খ্যাতি ছিল। এদেশে সবাই ফর্সা মেয়ে খোঁজে। হরিসাধন মাস্টারমশাইয়ের বাবা-মাও তাই খুঁজেছিলেন। মার অল্প বয়সের ছবি দেখলে এখনও বারবার খুলে দেখতে ইচ্ছে করে। বেশি কথা কি। সেই মায়ের স্মৃতি গৌতমের ছোটবেলার স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই মা যেন উজ্জয়িনীর মার কাছে হেরে গেছে। সুদ্ধু পয়সার অভাবে। কিভাবে উঠবে গৌতম? কিভাবে? মাথার ওপরে একটা বিরাট পাহাড়ের বোঝা, এই বোঝা নিয়ে কি গৌতম কোনদিন উঠে দাঁড়াতে পারবে? তার মায়ের সঙ্গে যদি ডক্টর রজত মিত্রর বিয়ে হত, আর উজ্জয়িনীর মার সঙ্গে তার বাবার। তাহলে উজ্জয়িনীর জায়গায় আজ সে! কে এই নির্বাচনগুলো করে, কিভাবে এগুলো হয়, কোনও নিয়ম মেনে, না একেবারে দৈবাৎ, সবই দৈব! ভাগ্য!

একটু তাড়াতাড়ি গৌতম কোচিং-এ চলে গেল আজ। আজ ভেঙ্কটের বাড়ি যায়নি সে। সকালবেলা চান খাওয়া করতে দেরি হয়ে গেল। বাড়িতে প্রচণ্ড ঝগড়া। দাদা-বউদি বরানগরের ফ্ল্যাটে চলে যাবার কথা ঘোষণা করতেই দিদি ক্ষেপে লাল। এই বাড়িতে তাকে, ওই ঘরখানাকে এক্সপ্লয়েট করে সুখ কিনেছে দাদা-বউদি। ভাবতে গেলে কথাটা মিথ্যে নয়। বৈঠকখানা ঘরটাকে সকাল থেকে রাত্তির অবধি আটকে রেখেছে দাদা-বউদি। বাবা ক্রমশ ছাত্র কমিয়েছেন। শোবার ঘরে পড়ান। দিদি বলছে সে-ও তো কোচিং করে কিছু রোজগার করতে পারত, ঘরটা আগলে রেখে সে পথও বন্ধ রেখেছে দাদা-বউদি। বউদি বলেছে ‘ভারি তো ইংলিশ। ও আজকাল আর কেউ পড়ে না, আর যায় কোথায় দিদি হেঁচে, কেশে, কেঁদে একসা। দিদিটা বরাবরই ভীষণ সেন্টিমেন্টাল। ওইতেই ওর সব গেল। দিদির যে ভদ্রলোকের সঙ্গে বিয়ে হবার কথা ছিল অলকদা। খুব মজাদার লোক ছিলেন। একদিন দিদি ঘর থেকে বাইরে যাচ্ছে লম্বা আঁচলটা খাটের কোনায় আটকে গেছে, অলকদা বললেন, ‘রিনি তোমার ল্যাজটা ফেলে যাচ্ছ কোথায়।’ বাস দিদি সেই যে ঘরে দোর দিল, কিছুতেই অলকাকে বিয়ে করল না। অনেক সাধ্য-সাধনা করে শেষ পর্যন্ত অলকদা কালো মুখে হাল ছেড়ে দিয়ে চলে, গেলেন, যাবার সময় গৌতমকে বললেন, ‘সেন্স অফ হিউমার নেই এমন মেয়ের সঙ্গে কখনও ভাব করো না।’ দিদির ওপর কথা বলবার সাহস তখন গৌতমের ছিল না। তার দাদা বলেছিল, ‘রিনি, ভুগবি। শুধু শুধু অত ভালো ছেলেটাকে ফেরালি?’

‘অত ভালো ছেলে?’ দিদি ফোঁস করে উঠেছিল, ‘আমার আঁচল একটু লম্বা পরার অভ্যেস, যখন-তখন বলবে বারো হাত কাঁকুড়ের তের হাত বিচি। এটা আমার হাইটের প্রতি কটাক্ষ না?’ দিদির চার ফুট দশ ইঞ্চি হাইট। মুখখানা অতি সুন্দর, মায়ের মতো। কিন্তু ওই হাইট নিয়ে কী কমপ্লেক্স। অলকদাও না বুঝে ওর দুর্বল জায়গাতেই আঘাত দিলেন বারবার। এখন দিদির সেই সুন্দর মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। রঙ জ্বলে গেছে। মুখে হাসি দেখা যায় না। সারা দিন ঘরের কাজ করছে। মায়ের সঙ্গে। বউদি কোন কিছুতেই হাত লাগায় না। তার পর দুপুরে স্কুল করবে। দিদিটা সত্যিই বেচারি। বাবা-মার দায়িত্ব ছোট বোন আর ভাইয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে স্বার্থপরের মতো বেরিয়ে যাচ্ছে দাদা—এই বলে দিদির কী চিৎকার! বাবা বললেন, ‘আমাদের কাউকে দেখতে হবে না। নিজেদের দেখো।’ মা বললে, ‘বিয়ের সময়ে কি ভাবে তোমাকে এ-বাড়িতে গ্রহণ করা হয়েছিল সে কথা কী করে ভুলে গেলে বীথি।’ দাদা বলল, ‘মাসে মাসে তিনশ’ করে দেব।’ বউদি বলল, ‘আমাকে কত দিতে হবে বলুন, বিয়ের সময়ে গ্রহণ করেছিলেন যখন…।’ সে এক তুলকালাম কাণ্ড। মাথাটা গরম হয়ে গেছে। দিদি শেষকালে বলল, ‘কী রে খোকা! তোর কবে পাখা গজাবে? তুই কবে পালাবি?’ গৌতম বলেছিল, ‘এত চেঁচামেচি করলে এক্ষুনি।’

হঠাৎ গৌতম দেখল সারের বাড়ি থেকে লিক বেরিয়ে আসছে। গৌতমকে দেখে পুলক দাঁড়িয়ে গেল। গৌতম বলল, ‘পুলক, তুমি এখানে?’

‘আমি তো সারের কাছে টুইশন নিচ্ছি,’ পুলক চোরের মতো হেসে বলল, তারপর যোগ করল, ‘সার হেভি সেন্টিমেন্টাল বুঝলি? আমি তো পরদিনই গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি। বাস তখন থেকেই পড়ান। আলাদা। কিন্তু কিছুতেই আর টাকা নেন না! কী লজ্জা বল তো! বলবেন, তোকে ভালোভাবে অনার্স পাইয়ে দেওয়াটা আমার চ্যালেঞ্জ। যদি টিচিং লাইনে যেতে পারিস, এই ঘটনাগুলো মনে রাখবি।’ পুলক হাসল, ‘একদম ফোকটিয়া, ওইরকম স্পেশ্যাল কোচিং···ভাবতে পারিস? তবে জানিস, আমারও একটা যেন ওবলিগেশন এসে গেছে। ভালো রেজাল্ট আমাকে করতেই হবে। নয়তো সারের কাছে মুখ থাকবে না।’

গৌতম শুধু বলতে পারল, ‘তাজ্জব!’

‘যা বলেছিস!’ পুলক মন্তব্য করল।

হঠাৎ গৌতম অনুভব করল পুলকের মতো অভদ্র হতে পারাটাও একটা পারা। একদিনের দুর্ব্যবহারের সূত্র ধরে পুলক দিব্যি পৌঁছে গেল সারের অন্তঃপুরে। সেই শত্রুভাবে ঈশ্বরভজনার মতো। সে তা-ও পারেনি। সে ঘরেও নহে, পারেও নহে, তার কী ভবিষ্যৎ!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress