একুশে পা (Ekushey Paa) : 01
‘এতটা সর্দারি প্রথম দিনেই? ইস্স্….’
ইমনকে হঠাৎ দেখলে সে ছেলে কি মেয়ে বোঝবার উপায় নেই। চুল ছেলেদের মতো, সামনে বড় বড়, পেছনে ছোট ছোট করে কাটা। মাথার পেছনটা পরিষ্কার তিনকোণা। মাজা গায়ের রং। মুখখানা বালকসুলভ। চোখে একটা মৃদু হাসি। যেন যা-যা দেখছে মোটের ওপর সমর্থনই করছে সে। লম্বায় বোধ হয় পাঁচ পাঁচ। মেয়ে হিসেবে বেশ লম্বাই তো! ছেলে হিসেবে কি একটু বেঁটের দিকে! খাপ ছাড়া তাপ্পি-দেওয়া রঙ-জ্বলা জীনস আর ঝলঝলে টি-শার্ট পরে আছে। ভীষণ স্টাইলিশ দেখাচ্ছে। আলগা আলগা ভাবে অথচ বেশ স্বচ্ছন্দে, যেন কুশলী সাঁতারুর মতো সে যে কোনও পরিপার্শ্বর মধ্যে দিয়ে চলে যাচ্ছে, নিজেকে বুঝি তার মনে নেই। এই পরিবেশও বুঝি আদৌ তার অচেনা নয়। অথচ, হোস্টেলে উঠেছে যখন তখন ধরেই নেওয়া যায় সে বহিরাগত। এই শহরের অন্তহীন শব্দবাদ্য, উৎসবপ্রিয়তা, মিছিল, জট, ধোঁয়ায় এখুনি এখুনি তার অভ্যস্ত হয়ে যাবার কথা নয়।
অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি এখন। প্রখর রোদ, ভ্যাপসানি গরম। রাস্তার পিচ তলতল করছে। আকাশের রঙটা এই সময়ে ক্ষয়াটে নীল হয়। কাকগুলো উড়ছে না, ডাকছে না। গাছপালার ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে আছে বোধহয়। কলেজ-গেটের বাঁ দিকে একটা কৃষ্ণচূড়া। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নিম, তেঁতুল এই সব দেখলে ইমনের মনটা কিরকম হালকা হয়ে যায়। গাছগুলো চেনা বলে কি? না বোধহয়। বট অশত্থও তো চেনা, তাদের দেখলে তো কিছু হয় না! এই গাছগুলোরই ঝিরিঝিরি পাতায় কোনও বিশেষ গুণ আছে। মনের মধ্যে গিয়ে ঝিলমিল করতে থাকে, গুমোট কেটে যায়।
এই মাত্র যে ‘টু বি’ বাসটা চলে গেল সেটা থেকে নিজেদের টেনে হিঁচড়ে নামাল কয়েকটি মেয়ে। একজন নিজের কচি-কলাপাতা চুন্নিটা টেনে নিতে নিতে বাসের সংকীর্ণ প্রবেশ-পথের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল ‘ডিসগাসটিং! স্পেস-স্যুট পরে যাতায়াত করতে হবে দেখছি এ রুটে!’ এই মেয়েটি মেমসাহেবের মতো লালচে ফর্সা। একটু বাদামি রঙের চুলে দুটো মোটা বিনুনি করা। চওড়া মুখ। লম্বা দোহারা চেহারা। বেশ গোটা গোটা স্পষ্ট নাক-চোখ-মুখ-দাঁতের মেয়ে। এ উজ্জয়িনী। একে দেখলে মনে হয় ভীষণ অহঙ্কারী, কাউকে গ্রাহ্য করে না। এর পাশেপাশে যে হাঁটছিল সে মিঠু। উজ্জয়িনীর মাথায় মাথায়। রোগা বলে আরও লম্বা দেখায়। রঙ চাপা। চুলে স্টেপকাট। মিঠুর চিবুকের কাছটা সরু হয়ে এসেছে। বুদ্ধিমান চোখ। হাসলে গোটা মুখটাই ঝিকিয়ে ওঠে। মিতু তার লম্বা স্কার্ট দুলিয়ে বলে উঠল ‘কষে থাপ্পড় দিলি না কেন?’
উজ্জয়িনী বলল ‘কম চালাক নাকি? লাস্ট মোমেন্টে….’
‘পেছনে আসছে অণুকা, মোটাসোটা, চুলে ববকাট। সে গালে টোল ফেলে বলল ‘এই লোকগুলোকে এলিমিনেট করে দেওয়া উচিত। একদম শটাশট।’
ওরা তিনজনে রাস্তা পার হল। কলেজ গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে ইমনকে ওরা লক্ষ্য করেছিল। মিঠু হতাশ গলায় বলল ‘দূর এ তো গরুর গোয়াল! কত দিন ধরে আশা করে আছি প্রেসিডেন্সিতে পড়ব। ঠি-ক সেই হল না! অথচ কী ভাল পরীক্ষা দিয়েছিলাম!’
উজ্জয়িনী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ‘তুই নাকে-কান্না ছাড় তো মিঠু। হল না তো হল না! কী আমার প্রেসিডেন্সি রে! যার যাতে ন্যাক নেই তাই পড়তে হবে না কি তাই বলে। ইংলিশ নিয়ে পড়বার চান্স পেয়েছিস, এর জন্যেই ভাগ্যকে ধন্যবাদ দে। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের সুষ্মা ভার্গব! অত ভাল মেয়ে তো! জয়েন্টে পেলো? আই. আই. টি পেলো? এখন শেষ পর্যন্ত ম্যাথ্স্ নিয়ে বিদ্যাসাগরে পড়ছে। আমার এক মামাত কাজিনের কথা জানিস? কেমিস্ট্রিতে ব্যাক পেল! অবাক কাণ্ড! পরের বছর গ্র্যাজুয়েশন করে স্টেটসে চলে গেল। ওখানে ওর প্রোফেসররা কী বলে জানিস ‘ঘোষ, য়ু আর একসেপশন্যালি ব্রিলিয়ান্ট।’ অতদূর কেন, বাঙ্গালোরে যা না, স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটিতে চান্স্ পেয়ে যাবি, যে সাবজেক্টে ইচ্ছে, খরচটা একটু বেশি হবে খালি। এখানেই খালি সব পেটারন্যাল প্রপার্টি। পরীক্ষাটা মেরিটের হয় না, হয় ভাগ্যের।’
মিঠু চুপ করে গেল এই তোড়ে বক্তৃতার সামনে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে তার মনের কষ্ট যায়নি। চোখ চকচক করছে।
কলেজ-হলের মুখোমুখি তাদের অভ্যর্থনা জানাল সন্তোষ আগরওয়াল। ‘আরে! তুমলোগ ভী ইঁহা!’ হাসিতে চশমার পেছনের চোখ দুটো প্রায় বুজিয়ে বলল সন্তোষ ‘তব্ তো বড়া মজা আ জায়েগা।’ সন্তোষ ওদের সাঁতার ক্লাবের বন্ধু।
মিঠু বলল ‘ঋতুকে চিনিস তো? ঋতু, রাজেশ্বরী ওরাও এখানেই ভর্তি হয়েছে। পল সায়েন্স। আমাদের পুরো গ্রুপটাই বলতে গেলে এখানে।’
পেছন থেকে একদল ছেলে চটির শব্দ করতে করতে এগিয়ে আসছিল। খুব। উত্তেজিত। ‘কী হওয়া উচিত জানিস তো? ছাত্র-রাজ। এখন গভার্নিং বডিতে রিপ্রেজেনটেটিভ দিতে বাধ্য হচ্ছে। এরপর বিধানসভায়, পার্লামেন্টে সব জায়গায় দিক। নইলে দুর্নীতি, ছাত্র এক্সপ্লয়টেশন কোনদিন বন্ধ হবে না….’
ওরা কথা বলতে বলতে অনেক দূর চলে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠছে খুব সম্ভব ‘গভমেন্ট অফ দা স্টুডেন্টস, বাই দা স্টুডেন্টস…ফর দা স্টুডেন্টস্’ ভেসে এলো হাওয়ায়।
মিঠু ফিক করে হেসে বলল ‘ছাত্র এম. এল. এ? এ ছাত্র এম. পি? পড়বে কখন রে ছাত্ররা, এই অণু! এই উজ্জয়িনী! গভমেন্ট যখন, তখন মিনিস্টারও হবে…’।
‘বিনা পরীক্ষায় পাশ করাটা ছাত্র এম. এল. এ, এম. পি-দের পার্কসের মধ্যে পড়বে। বুঝলি না?’ উজ্জয়িনী বলল।
সন্তোষ আগরওয়াল বলল ‘তবে তো আমি জরুর এম. এল. এ, এম. পি-ই হচ্ছি।’
‘আচ্ছা আচ্ছা আগে চল তো এখন ক্লাসরুম-টুম গুলো খুঁজে বার করা যাক। কী বিশাল কলেজ! বাব্বা!’
‘ইমন মুখার্জি! রোল নাম্বার সিক্সটীন!’ বি. ডি. জি অর্থাৎ বেলা দাশগুপ্ত রোল কল করছেন। প্রথম দিনের প্রথম ক্লাস। ভাঙা-ভাঙা গলায় জবাব এলো ‘ইয়েস ম্যা’য়াম।’ বি. ডি. জি কয়েক সেকেন্ড গাবদা পেনখানা রেজিস্টারের দিকে তাক করে রেখে চশমার ঘন কাচের মধ্যে দিয়ে ভালো করে চেয়ে দেখলেন, তারপরে চোখ নামিয়ে পরের রোল নম্বরে চলে গেলেন। ‘তন্ময় হালদার—সেভেনটীন!’
ফাস্ট, সেকেন্ড, থার্ড বেঞ্চে ছড়িয়ে বসতে হয়েছে ওদের। কথা বলতে হলে থার্ড বেঞ্চের মেয়েদের সামনে ঝুঁকে পড়তে হচ্ছিল, সেকেন্ড বেঞ্চের মেয়েরা আড় হয়ে বসেছিল, ফাস্ট বেঞ্চের মেয়েরা ক্রমাগত পেছন ফিরে যাচ্ছিল। ছোটখাট একটা সভা-ঘরের মতো উপছো-উপছি ভর্তি ক্লাস। স্কুলের শৃঙ্খলা, বকুনি শোনা, এ-সবের অভ্যেস একদিনেই অনেকটা পেছনে পড়ে গেছে। এখন তো যা-খুশির দিন। কলেজ! বেলা একটা পঁয়তাল্লিশের ক্লাস। এর আগে পর্যন্ত একটা ক্লাসও আর হয়নি। টাইম-টেব্ল দেখে-দেখে এক একটা ঘরে গিয়ে বসছে আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হুড়হুড় করে বেরিয়ে আসছে ওরা। এর ঠিক আগের ক্লাসটা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ঝাঁকড়া-চুলো একটা হিলহিলে ছেলে সামনে এগিয়ে এসে খাতা ঝাঁকিয়ে বলল ‘বন্ধুগণ, ওয়েট করে লাভ নেই। অনেকগুলো ডিপার্ট এখনও নাকি রুটিন পায়নি, আজকের স্কুপ। এখনও কদিন এমনি চলবে।’
এর চেয়ে ভারী গলার একজন বলে উঠল ‘নেক্সট উইকে ফ্রেশার্স, তারপরই স্বাধীনতা দিবস, তদ্দিনই এমনি চলবে।’
ওরা বেরিয়ে এসেছিল করিডরে। হলে। চশমা-পরা, পড়ুয়া-চেহারার একটি বেণী দোলান মেয়ে সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, যেরকম সীরিয়াস, মনে হয় থার্ড ইয়ার। মোটা গলার ছেলেটি তাকে গিয়ে পাকড়াও করল ‘এই যে দিদি, ভেতরের খবরটা ছাড়ুন তো, এ-কলেজে ক্লাস-টস হয়? না স্রেফ অ্যাডমিশন দিয়ে সব যে-যার চরে খেতে ছেড়ে দেয়!’
মেয়েটি ভাল করে ওর দিকে তাকিয়ে বলল ‘এসো, দেখছি।’ শাঁ করে ঢুকে গেল, হল পেরিয়ে পাশের ডানদিকের ঘরে। দু সেকেন্ড পরেই ঝোলা গোঁফ, মোটা ফ্রেমের চশমা-পরা একজন প্রোফেসর বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে আগের মেয়েটি। মেয়েটি ইশারায় ওকে দেখিয়ে দিল।
‘এই যে শোনো, শোনো হে, কী নাম তোমার?’
‘আজ্ঞে ভেঙ্কট।’
‘কী বললে? ভেঙ্কট? সাউথ ইন্ডিয়া?’
‘না সার, ঈস্ট। ভেঙ্কটেশ পাল, তিরুপতির দোর ধরা..তাই… গ্র্যান্ডমাদার…’
‘তা বেশ বেশ। নন্দিতাদিকে কী যেন বলছিলে?’
ভেঙ্কটেশ ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করতে আরম্ভ করল।
‘না মানে ক্লাস কখন..ক্লাসের টাইম…’
‘উঁহু তুমি চরে-খাওয়া টাওয়ার কথা কি সব জিজ্ঞেস করেছিলে না?’ চোখের চশমা এবার স্যারের ডান হাতে নেমে এসেছে। চশমা সুদ্ধ ডান হাতটা নেড়ে-নেড়ে ভেঙ্কটেশকে বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন তিনি। নন্দিতাদি নামের ম্যাডাম সারের হাতে ভেঙ্কটেশ পালকে তুলে দিয়ে পর্দা সরিয়ে সুড়ুৎ করে ভেতরে ঢুকে গেছেন।
‘ক্লাস যথা সময়ে হবে…কিন্তু বাকি কথাগুলোয় তুমি ঠিক কী মীন করেছ, আমাদের জানা দরকার।’
‘না স্যার, ম্যাডামকে ম্যাডাম বলে ঠিক বুঝতে পারিনি স্যার…।’
‘ম্যাডামকে ম্যাডাম বলে…তুমি কি ওঁকে জেন্টলম্যান বলে ভেবেছিলে?’
‘না স্যার, না স্যার…’ ভেঙ্কটেশ তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠে।
‘ঠিক আছে। এবারের মতো তোমায় ছেড়ে দেওয়া গেল। কি বললা নন্দিতা?’ পদার্টা একটু সরিয়ে উনি ভেতর দিকে স্বর পাঠালেন।
ক্ষীণ স্বরে জবাব এল ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আবার কী?’
‘ভেঙ্কটেশ, নন্দিতাদি তোমায় ক্ষমা করেছেন। বেলাদি-ই-ই।’ আবার উনি পর্দা তুলে ভেতরে স্থিত কোনও মহিলাকে লক্ষ্য করে হাঁক পাড়লেন, কী সব কথাবার্তা বললেন, তারপর ফিরে বললেন, ‘একটা পঁয়তাল্লিশে তোমাদের সোনার পাথরবাটির ক্লাসটা হবে আট নম্বর রুমে। বেলাদি নেবেন। বেলা দাশগুপ্ত। আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে?’
ভেঙ্কটেশ তার সঙ্গীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল একেবারে সামনে। পেছনে, বেশ পেছনে মিঠু-উজ্জয়িনী এরা। এদের আর কী? মিটিমিটি হাসছিল। ভেঙ্কটেশ যেন কাছাকোঁচা খুলে যাচ্ছে এমনি ভাব করতে করতে দৌড় মারল ‘চরে গৌতম, একেবারে গুলবাঘার খপ্পরে।’ উজ্জয়িনীরা শুনতে পাচ্ছিল স্টাফরুমে ভীষণ হাসির হল্লা উঠেছে। গুলবাঘার জোরালো বাঘা গলা সর্বোচ্চ হাঃ হাঃ হাঃ। সেই সঙ্গে কিছু সরু মোটা তারের হাসি। উজ্জয়িনী বলল ‘শীগগির চ। আট নম্বর রুম দোতলায়। সামনে জায়গা পাবো না। সোনার পাথরবাটি ক্লাস আবার।’
‘সোনার পাথরবাটি ক্লাস ব্যাপারটা কী রে?’ অণু জিজ্ঞেস করল।
মিঠু বলল ‘কমপাল্সারি অ্যাডিশন্যাল, বুঝলি না?’
উজ্জয়িনী বলল ‘ওটা ক্লাস নয় ওটা আসলে ট্লাস।’
সেই সোনার পাথরবাটি ট্লাসেই ওরা বসে সবাই এখন। সায়েন্সের ঘর কি না কে জানে। গ্যালারি। দেয়াল-জোড়া ব্ল্যাকবোর্ড। তাতে লাল রঙ দিয়ে গ্রাফ আঁকা। কী সব গ্রাফ কষাও রয়েছে চক দিয়ে। ক্লাসটা মস্ত বড় বলেই বোধ হয় এ ঘরে ব্যবস্থা। একবারটি পেছন দিকে চেয়ে নিয়ে মিঠু বলল ‘সমুদ্র’।
‘দিঘি-টিঘি বল্’, উজ্জয়িনী ফুট কাটল। রাজেশ্বরী ঢুকছে। ছাপা শাড়ি পরেছে। ‘দ্যাখ, দ্যাখ, মিঠু, রাজেশ্বরী শাড়ি পরেছে, রাজেশ্বরী-ই, আমরা এখানে…।’
মিঠু বলল ‘ওই তো ঋতু, ঋতু কী সেজেছে দ্যাখ, কী মড লাগছে!’
বাইরের দিকের জানলাগুলো দিয়ে গাছের শ্যাওলা-ভরা গুঁড়ি, ঘন সবুজ পাতাভরা ডাল। একগুচ্ছ দোলনচাঁপা না গুলঞ্চসুদ্দু একটা ডাল মাঝের জানলার ঠিক বাইরে। ওখানটা খুব ছায়া। কী একটা পাখি ডাকছে কু কি কি! কু কি কি!
ইমন মুখার্জি বসেছিল একেবারে শেষ বেঞ্চে। গ্যালারির উঁচুর দিকে, যেখান থেকে ক্লাসের সব ছেলেমেয়ের মাথা গুনতি করা যায়। আশেপাশে তার ছেলেই বেশি। অণুকা বলল ‘এই মিঠু, ও ছেলে না মেয়ে রে?’
মিঠু ঠোঁট উল্টোল। অর্থাৎ জানে না। সন্তোষ আড় হয়ে বসে বলল ‘শী ইজ এ গার্ল। ডোন্ট য়ু সী!’ সে একটু অর্থপূর্ণ হাসল। কিন্তু গলার আওয়াজটা শোনবার জন্য ওরা ব্যস্ত হয়ে ছিল। ‘ইয়েস ম্যা’আম’ শোনার পর সন্তোষ বলল ‘দেখলে?’
উজ্জয়িনী বলল ‘কী জানি! ছেলেদের গলা ভাঙে না! সেইরকম ভাঙা-ভাঙা গলা বাবা! যাই বলো, আমি এখনও শিওর হতে পারিনি। আমরা কি জীন্স্ পরি না? আমাদের কারও কি বয়-কাট চুল নেই? তখন কি আমাদের নিয়ে ধাঁধায় পড়তে হয়?’
‘নামটাও কিরকম উভলিঙ্গ দেখলি? ইমন!’ মিঠু গলা বাড়িয়ে বলল।
‘নামের কথা যদি বলিস তো আমাদের সন্তোষের সঙ্গে কেউ পাল্লা দিতে পারবে না …উজ্জয়িনী বলল, ‘আমার পিসেমশাইয়ের আর ওর এক নাম, বুঝে দ্যাখ! পিসেমশাইকে যদি দেখিস না! যেমনি মোটা, তেমনি গাল ফোলা, এতখানি গোঁফ দাড়ি তার ওপরে, ট্রিম করে না। আমাকে দেখলেই বলবে “আহো উজ্জয়িনী নাম্নী নগরী, তোমার কালিদাস কোথায়? বিক্রমাদিত্যই বা কই?”
ওদের হাসি দেখে সন্তোষ বলল ‘আমার নাম শুনেই ঘাবড়াচ্ছো? আমার মাম্মির নাম জানো— কৈলাশ, আমার দিদির নাম—ভিজয়, আন্টিব নাম অজিত, অজিত কাউর।’
‘অজিত? অ-জিত? অনেক শুনেছি তোদের অদ্ভুত নাম, অজিত কখনও শুনিনি’, ঋতু বেঞ্চের ওপর তবলা বাজিয়ে দিল ‘আমার বাপীর নাম তো অজিত। এবার থেকে মিস অজিত কাউর বলে খেপাব।’
অণুকা বলল ‘তুই বাবাকে খেপাস? বাবা কি তোর ছোট ভাই? না ইয়ার?’
ঋতু বলল ‘বাপীকে যদি খেপাতে না পারবো তো জীবনে মজা কোথায়?’
মিঠু বলল ‘জানিস না ঋতুটা কী আহ্লাদি! বাবা মা সব ওর ইয়ার। আমার বাবাও বন্ধুর মতো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভীষণ স্ট্রিক্ট্। একটু এদিক-ওদিক হয়েছে তো “মিঠু, এটা তোমার থেকে আশা করিনি”।’
বেলাদির রোলকল শেষ হয়ে গেছে বোধহয়। উনি মেয়েদের জটলাটার দিকে তাকিয়ে যারপরনাই বিরক্তি প্রকাশ করলেন। অণুকাকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন উনি এতক্ষণ ক্লাসে কী বলছিলেন। অণুটা সবসময়েই ছটফট করে, যেন ওকে ছারপোকায় কামড়াচ্ছে। সেইরকম নড়তে নড়তেই জবাব দিল ‘ইউ হ্যাড বীন কলিং দ্য রোল, ম্যা’য়াম।’
ক্লাসের পেছন দিক থেকে একটা হাসির রোল উঠল। মেয়েদের গলা ছাপিয়ে আছে ছেলেদের শ্রীকণ্ঠ। ‘এই অণু’ পেছন দিক থেকে উজ্জয়িনী ওর কুর্তার তলাটা ধরে টানছে, ‘সিলেবাস বলছিলেন রে! অণুকা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওর পেটেন্ট তোয়ালে-রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে লাগল।
হাসি অগ্রাহ্য করে বেলাদি বললেন মর্নিং শোজ দ্য ডে। ইউ ক্যান সিট ডাউন। ডোন্ট টক।’
বসে পড়ে ফিসফিস করে বলল অণুকা ‘আমাদের কথা বলছিলেন নাকি রে? মর্নিং শোজ দ্য ডে?’
উজ্জয়িনী হাসতে হাসতে ফিসফিসোলো ‘দূর অ্যাম্প্লিফিকেশনের জন্যে কতকগুলো আইডিয়া দিচ্ছেন!’
‘চাইল্ড ইজ ফাদার অফ দ্য ম্যান’ থেমে থেমে বললেন বেলাদি। সবাই লিখে নিচ্ছে। অণুটাও এতক্ষণে পেন বার করল।’
‘এ বার্ড ইন হ্যান্ড ইজ ওয়ার্থ টু ইন দ্য বুশ’, বেলাদি শেষেরটা বলে থামলেন। ‘দীজ য়ু মাস্ট লার্ন, দীজ ফাইভ। লার্ন অ্যাট হোম, অ্যান্ড রাইট ইন দ্য ক্লাস। দিস ইজ মাই পলিসি। নাউ ইউ মে গো।’ রেজিস্টার এক হাতে, হাঁটুতে আরেক হাতের ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন বেলাদি। এক পা এক পা করে নামলেন প্ল্যাটফর্ম থেকে। তারপর টলমল টলমল করতে করতে বেরিয়ে গেলেন। পেছন থেকে কে মন্তব্য করল ‘জাহাজ’। আবার হাসির হুল্লোড়।
মিঠু বলল ‘এসব তো আমরা স্কুলে থাকতেই করেছি রে!’
উজ্জয়িনী বলল ‘সরকারি স্কুলে তো সিক্স থেকে ইংলিশ আরম্ভ হয়। ভালোই তো আমাদের এই এলেবেলে ব্যাপারগুলো করতে হবে না।’
ক্লাসের তিনটে পেল্লাই দরজা দিয়ে সবাই হুড়মুড় করে বেরোচ্ছিল। ভেঙ্কটেশ আর গৌতম এসে ধরল উজ্জয়িনীদের।
‘দ্যাখো! শাসানোর ভঙ্গিতে তর্জনী তুলল ভেঙ্কটেশ ‘যা দেখছি, এইট্টি পার্সেন্টই মেয়ে, মাত্র টোয়েন্টি পার্সেন্ট এই আমরা, হতভাগ্যরা, নিজেদের মধ্যে গ্রুপ করে থাকবে তো দেখাব মজা! স্কুল থেকে এসেছে, না?’
মিঠু হাসি-হাসি মুখে বলল ‘হ্যাঁ।’
‘দেখেই বুঝেছি। স্কুলের বালিকা সব। দুগ্ধপোষ্য এখনও।’
‘কী করে বুঝলে?’ উজ্জয়িনী পাশ থেকে বলে উঠল, জাস্ট চেহারা দেখেই বোঝা যায় বুঝি?’
‘শুধু চেহারা নয়, ওই হিহি হিহি আর খুঁক খুঁক খুঁক, স্কুলবালিকাদের আইডেনটিফিকেশন মার্ক। একমাত্র স্কুলবালিকারাই এভাবে হাসিয়া থাকে!’
‘তুমি বুঝি কলেজ থেকে দু’ বছর ডিগ্রির ক্লাস করে ফেরৎ এসেছ?’ উজ্জয়িনী ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলল।
‘ওরে গৌতম, চাট মারে রে! স্কুলবালিকা বলাতে অপমান হয়েছে! নো অফেন্স মেন্ট ফ্রেন্ডস’, ভেঙ্কটেশ হাত বাড়িয়ে দিল ‘হাত মিলাও কমরেড লোগ, দোস্তি কে পহলে দিন আজ, সেলিব্রেট তো করো কম সে কম কুছ খিলাকে!’
কেউই ওর হাতে হাত মেলাল না। উজ্জয়িনী বলল ‘হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে এসো আগে। নো অফেন্স মেন্ট।’
‘ঠিক আছে ভাই, শোধবোধ, তবে আমি কিন্তু হেলথ-সোপ লাইফ-বোয় দিয়ে চান করি। লাইফ-বোয়’ বলে বিজ্ঞাপনের গানের কলি তার ভারী গলায় গেয়ে উঠল ভেঙ্কটেশ ‘আমাকে অচ্ছুৎ ভাবার কোনও কারণ নেই।’
গৌতম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ‘ছেলেরা সায়েন্স না পড়লেই আজকাল আনটাচেব্ল্ হয়ে যাচ্ছে রে। এক গেলাস জল দিয়ে দ্যাখ খাবে না।’
রাজেশ্বরী পেছনে ছিল, সবার ওপরে মাথা তুলে মিটিমিটি হেসে বলল ‘আইসক্রিম দিলে খাবো।’
‘ঠিক হ্যায়, আইসক্রিমই খিলাবো, কী নাম কমরেড তোমার?’ ভেঙ্কট জিজ্ঞেস করল।
‘রাজরাজেশ্বরী।’
‘ক্কী? ক্কী? রাজ-রাজেশ্বরী? আই বাপ এরকম ঘ্যাম নাম তো কখনও শুনিনি!’ শর্ট ফর্মে শুধু রাজেশ্বরী বলেও ডাকতে পারো।’
‘পারি? অনুমতি দিলে? আরও শর্ট করে নিয়ে যদি রানী বলি?’
‘সেক্ষেত্রে অনুমতি ফিরিয়ে নেবো।’
‘কেন? রাজরাজেশ্বরী মানে তো রানী!’
‘ভেঙ্কট তো বিষ্ণুর নাম, তোমাকে বিষ্ণু, কি নারাণ, কি হরি বলে ডাকি তা হলে?’
‘ও হো হো, সরি ভাই, ভেঙ্কটটাই যথেষ্ট গোলমেলে, তার ওপর বিষ্ণু, হরি, নারাণ? দয়া করে এই আমার তরবারি সারেন্ডার করে দিলুম।’ সে দু হাতে তরোয়াল ধরে রাজেশ্বরীর পায়ের কাছে নামিয়ে রাখার ভঙ্গি করল।
উজ্জয়িনী বলল, ‘চল চল, আইসক্রিম খাওয়া যাক, গেটের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে।’
ভেঙ্কটের ঘাড় ভেঙে আইসক্রিম খাবার সময়ে ইমনকে ওরা মেয়েদের কমন রুমের দিকে যেতে দেখল। গৌতম বলল ‘একে চেনো?’
‘না কে ও?’
ভেঙ্কট অবাক হয়ে বলল, ‘চেনো না? দু বছর পর পর টেবল টেনিস চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বেঙ্গলে! জুনিয়র। আরে তোমাদের মেয়েদেরই তো গৌরব। আমাদের কী! এবার ওকে দিয়েই আমাদের কলেজ খেলাধুলোয় খাতা খুলবে। স্পোর্টস ম্যাগে নাম উঠবে অনেক দিন পর আই মুখার্জির দৌলতে।’
‘ওই আই মুখার্জি! তা মুখটা চেনা চেনা লাগছিল।’ মিঠু বলল।
‘অমনি তোর চেনা-চেনা লেগে গেল!’ উজ্জয়িনী আইসক্রিম এক চামচ মুখে তুলে বলল।
‘বিশ্বাস করছিস না? বছর দুই আগে ওর ছবি বেরিয়েছিল কাগজে। বাবা দেখতে দেখতে বলেছিল মফঃস্বলের মেয়ে, কম কথা না! এ মেয়েটার পোটেনশ্যালিটি আছে।’
গৌতম বলল ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ও ঠিকই বলেছে। দু বছর আগে ও প্রথম আবিষ্কৃত হয়। রানাঘাটের মেয়ে। দুর্দান্ত ফুট-ওয়ার্ক। আর ফোর হ্যান্ড। বেঙ্গল টি টি অ্যাসোসিয়েশন থেকে বোধ হয় ওকে কোনও…’
ভেঙ্কট ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘বৃত্তি দেয়। রাইট! এখানে কারুর বাড়ি থাকে, না হোস্টেলে থাকে বল তো!’
গৌতম বলল, ‘জানি না। তবে জানতে কতক্ষণ। এই উজ্জয়িনী, ও তো লেডিজ কমন রুমে গেল। যাও না। ভাবসাব করো। উঠতি স্টার বলে কথা!’
ইচ্ছে ছিল, কিন্তু উজ্জয়িনী তক্ষুনি গেল না। এই ছেলে দুটো মহা সর্দারি আরম্ভ করেছে। এই দলটার মুকুটহীন রানী সে। কারও কারও সঙ্গে খুব নিচু ক্লাস থেকে এক সঙ্গে পড়েছে, যেমন মিঠু, অণুকা, আবার কেউ-কেউ এইচ-এস-এ এসে যোগ দিয়েছে ভিন্ন স্কুল থেকে। যেমন রাজেশ্বরী। এদের সবইকার সঙ্গেই যে স্কুলে থাকতে খুব ভাব ছিল তা-ও না। যেমন ঋতু। অনেক ছোট থেকে এক সঙ্গে পড়ছে। মোটের ওপর কাছাকাছিই থাকে। তবু খুব একটা মাখামাখি ছিল না। ছোটবেলার বন্ধুরা অনেকেই ভিন্ন স্ট্রীমে চলে গেছে। শেষ পর্যন্ত এই কজন। যাই হোক। কলেজ একটা বিরাট ব্যাপার। সেখানে এসে খুব স্বাভাবিক ভাবেই সে তার স্কুলের বাকি মেয়েদের রাখাল। কিন্তু ভেঙ্কট এমন ভাব করছে যেন ও-ই লীডার। ও যা বলবে এই সব বালখিল্য স্কুল বালিকারা তাই-ই করবে। এতটা সর্দারি প্রথম দিনেই! ইস্স্! সে বলল, ‘না, না, আমরা এখন কমন রুমে যাচ্ছি না, আমরা লিন্ডসে যাবো। এই সন্তোষ, অণু আমরা যাচ্ছি তো! মিঠু, রাজেশ্বরী।’
রাজেশ্বরী বলল, ‘আমার গানের ক্লাস আছে তিনটেয়। আমি চলি। আইসক্রিমের জন্য ধন্যবাদ ভেঙ্কট’ সে উত্তরের অপেক্ষা না করেই ব্যাগটা সামলে হন হন করে এগিয়ে গেল।
ঋতু বলল, ‘আমারও একটা জরুরি কাজ আছে। সী ইউ’ —হাসি হাসি মুখে সবাইকার মুখের ওপর দিয়ে চোখ দুটো ঘুরিয়ে নিয়ে সে চলে গেল।
বাকিরা লিন্ডসে যাবে বলে ব্যাগের পয়সা গুনতে লাগল। এই সময়ে মিঠু চেঁচিয়ে উঠল, ‘বিষ্ণুপ্রিয়া না!’ মাথায় খাটো, কিন্তু খুব সুশ্রী একটি শাড়ি পরা মেয়ে মিঠুর দিকে তাকিয়ে এগিয়ে এলো, ‘মিঠু! মিঠু চৌধুরী! আরে উজ্জয়িনী না! এমা! কত বড় হয়ে গেছিস!’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ আর তুই কত ছোট হয়ে গেছিস!’ উজ্জয়িনী বলল। ‘আমরা লিন্ডসে যাচ্ছি, যাবি?’
বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, ‘কদ্দিন পর তোদর সঙ্গে দেখা, যাবো না? ইস্স্ এক যুগ।’
বিষ্ণুপ্রিয়া ওদের স্কুলেই পড়ত। মাঝে ওর বাবা বদলি হয়ে যাওয়ায় ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এখন দেখা যাচ্ছে বিষ্ণুপ্রিয়া একই কলেজে ঢুকেছে।
উজ্জয়িনী বলল ‘ভেঙ্কট, যাবে আমাদের সঙ্গে? গৌতম?’
‘মার্কেটিং করতে যাচ্ছ নাকি?’
—‘লিন্ডসে যাচ্ছি। তারপর মার্কেটিং করব কি কী করব সে-সব এতো আগে থেকে জানা নেই।’
—‘ওরে ওরে কী দিচ্ছে?’ ভেঙ্কট বলল ‘কিন্তু মেয়েদের মার্কেটিং-এর মতো ক্যাডাভেরাস হায়ারোগ্লিফিক মেগালোম্যানিয়া আর নেই, কী বল গৌতম?’
‘ওহ একেবারে ল্যাকাডেইজিক্যাল গোনাডোট্রাপিক হাইড্রোপনিক্স্।’ বলতে বলতে গৌতম ক্যানটিনের পথে পা বাড়াল। পেছনে ভেঙ্কট।
রাস্তায় বেরিয়ে উজ্জয়িনী বলল, ‘উঃ ছিনে জোঁকের মতো লেগেছিল এতক্ষণে দুটোতে। এখন শান্তি। লিন্ডসেতেই যাবি তো!’
অণুকা বলল, ‘এই প্লীজ আজ লিন্ডসেতে যাস না। আমার স্ট্রেংথ কম।’
‘তাতে কী! আমরা কি নিউ মার্কেটটা উঠিয়ে নিয়ে আসব নাকি? স্রেফ উইনডো শপিং করব। পুড়ে যাবার পর নতুন উইংটা কি রকম করল আমার দেখাই হয় নি।’
‘দেখিস নি এখনও?’ বিষ্ণুপ্রিয়া বলল ‘দারুণ করেছে। ট্রেজার আইল্যান্ডের মতো অনেকটা। তবে আরও বড়। চল তোদের দেখাই।’
উজ্জয়িনী বলল, ‘ধুর তোর দেখা! তবে তো মজাই মাটি। সারাক্ষণ গুরুগিরি করবি। চল তার চেয়ে এ.সি. মার্কেটে যাই। অনেক এক্সক্লুসিভ জিনিস পাওয়া যায়।’
উজ্জয়িনী যখন মনে করেছে নিউ মার্কেট যাবে না, এ.সি মার্কেট যাবে, তখন সে তা-ইই যাবে। তার ইচ্ছাশক্তির জোর অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং ওরা এ.সি. মার্কেটেই চলল। গুমোট বেশ। আকাশময় এখন ভাঙা ভাঙা মেঘ। তাইতে ভ্যাপসা ভাবটা আরও বেশি। মিঠু বলল, ‘বাকি দুপুরটা এ.সি. মার্কেটে উইনডো শপিং করে কাটিয়ে দেব, বুঝলি? বাব্বা! যা গরম! ব্যাগে যা আছে তাতে হয়ত একটু ঠাণ্ডা খাওয়া হয়ে যাবে, কী বল উজ্জয়িনী!’
উজ্জয়িনী ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কত ঠাণ্ডা খাবি? এই তো আইসক্রিম খেলি? জানিস তো ঠাণ্ডা খেতে হয় শীতকালে। আইসল্যান্ডের লোকেরা আইসক্রিম খায় শরীর গরম রাখতে।’
উজ্জয়িনীর এখন আর এ.সি. মার্কেটে যেতে ইচ্ছে করছে না। বাড়িতে ফিরতেও ভালো লাগছে না। কিন্তু এখন মত বদল করলে বন্ধুরা ক্ষ্যাপা ভাববে। শুধু নিজের কথা ও কাজের সামঞ্জস্য রাখতে তাকে যেতে হচ্ছে। কিন্তু তার ভুরু কুঁচকে আছে। মিঠু আর বিষ্ণুপ্রিয়া নিজেদের মধ্যে কলকল করতে করতে বাসে উঠল। পেছন পেছন অণু আর সন্তোষ। বাসটা ছেড়ে দিল। অণু, সন্তোষ ব্যস্ত হয়ে কনডাকটরকে কিছু বলছে। উজ্জয়িনী খানিকটা চেঁচিয়ে, খানিকটা হাত পা নেড়ে বলল, ‘তোরা যা, আমি পরেরটাতে আসছি।’ কিন্তু কিছুদূরে গিয়ে বাসটা ঘ্যাঁচ করে থেমে গেল। কনডাক্টর মুখ বাড়িয়ে তাকে হাত নেড়ে ডাকতে লাগল। ‘ও দিদি শীগগির করুন।’ অগত্যা জোর পা চালিয়ে তাকে বাসে উঠে পড়তেই হল। অণুর পেছনে বসে সে বলল, ‘এইটুকু রাস্তা আমাকে ছেড়ে যেতে পারিস না? আমি তো পরের বাসেই এসে যেতাম! থিয়েটার রোডের মোড়ে একটু দাঁড়াতিস!’ এখনও বিরক্তিতে তার কপাল কুঁচকে আছে। মা খেল কি না কে জানে?