সাত
এইটুকু বেশ বুঝেছি বৃদ্ধ যেমন লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটে, সেইরকম সাধারণ মানুষ যদি একটা বিশ্বাসকে ধরতে না পারে তাহলে জীবনটাকে মনে হয় নিরালম্ব। আলনায় ঝুলে থাকা জামার মতো ল্যাতপ্যাতে। কিন্তু আমার যে ভীষণ ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। নারীর কোমলতা, দিঘির মতো গভীর চোখ, নরম খোঁপা আমার যে মনে হয় কবিতার মতো।
ছোট্ট একটা বাড়ি, একচিলতে বাগান, কিছু ফোটা ফুল। উঠোনের মাঝখানে একটা বাতাবি লেবুর গাছ। ভোরে তোলা উনুনের ধোঁয়া, বাটনা বাটার শব্দ, ধনে—জিরের গন্ধ। তারে দুলবে ভিজে ডুরেশাড়ি। ফর্সা দুটো পায়ের গোছ। গোড়ালিতে লাল আলতা। ঢালু কপালে টিপ। সন্ন্যাসীর গেরুয়া তো এর থেকে দূরে থাকে। সে—জীবনে কঠিন, কঠোর নিয়ম। ত্যাগ, বৈরাগ্য। আমি যে ওই সব পারব না। আমার মন যে দুর্বল। আমি লতার মতো গাছ বেয়ে উঠতে চাই।
দেয়ালে ঠাকুরের ক্যালেন্ডার ফাল্গুনের বাতাসে দোল খাচ্ছে। তাকিয়ে আছি। বলো ঠাকুর, আমার গতি কী হবে!
—তোমাকে তো আমি সন্ন্যাসী হতে বলিনি। সে বলেছিলুম আমার দ্বাদশ শিষ্যকে। সন্ন্যাসীর আদর্শ খুব কঠিন। কামিনী আর কাঞ্চনই হল মায়া। আমি তুলসীদাসের মতোই বলেছিলুম।
অজগর ন করে নকরি, পনছি ন করে কাম।
দাস মুলুককো এহি বচন হ্যায়, সব কি দাতা রাম।।
আর কী বলেছি, যদি রামচন্দ্র হৃৎপিণ্ডে নিরন্তর বাস করেন আর তিনখণ্ড কৌপীন ও নুন ছাড়া ভাজা খাবার পাওয়া যায়, তাহলে সুরপতি ইন্দ্রের চেয়েও নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি,
তিনটুক কপীনকো, আউর ভাঁজি বিন লোন।
তুলসী রঘুবর উর বসঁ, ইন্দ্র বাপুর কোন।।
তিন টুকরো কৌপীন যৎসামান্য আহার আর নিরন্তর ঈশ্বর—চিন্তা সন্ন্যাসীর জীবন। শঙ্করাচার্যের মতো বলতে পারি,
সুরমন্দিরতরুমূলনিবাসহশস্যা ভূতলমজিনং বাসঃ।
সর্বপরিগ্রহভোগত্যাগঃ কস্য সুখং ন করোতি বিরাগঃ।।
মন্দির অথবা বৃক্ষতল তোমার গৃহ। হরিণের চর্ম তোমার পরিধান। ভূতল তোমার শয্যা। উপহার অথবা ইন্দ্রিয়সুখ পরিত্যাগ। এরই নাম সন্তোষ। এমন ত্যাগীই ধন্য পৃথিবীতে।
তোমার পথ গৃহীর পথ। সৎ হও, সংসারী হও, সংযমী হও, একটি কি দুটি সন্তান, তারপর ভাই বোন। কর্তব্য করো। প্রয়োজনের অতিরিক্ত উপার্জন পাপ। কর্তব্য শেষ হলে পুরোপুরি ঈশ্বর। ভ্রষ্ট সন্ন্যাসীর চেয়ে সৎ গৃহী অনেক ভালো। ভক্তি আর বিশ্বাস এই সার। ধর্ম হল আনন্দ। ধর্ম হল পবিত্রতা। ধর্ম হল বিবেক, ধর্ম হল জ্ঞান। ঈশ্বর আছেন এইটি জ্ঞান, ঈশ্বর নেই এইটি অজ্ঞান।
—ঠাকুর, আমার যে বড়ো আকাঙ্ক্ষা ছিল গেরুয়াধারী মস্ত এক সন্ন্যাসী হব। আমার বিভূতিতে সবাই মুগ্ধ হয়ে যাবে। সমীহ করবে। আমি যে তেমন সন্ন্যাসীর সঙ্গ করেছি। তাঁদের জ্যোতির্ময় মূর্তি দর্শন করেছি। অলৌকিক সব ক্রিয়াকাণ্ড দেখেছি।
—শোনো, শোনো, পূর্বজন্মে করা না থাকলে এ—জন্মে কিছু হয় না।
—আমার পুণ্য কর্মফল কি কিছুই নেই?
—নিশ্চয় আছে, তা না হলে আকাঙ্ক্ষাটা জাগছে কেন? তবে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হওয়ার সংস্কার তোমার নেই। দুঃখ কোরো না। তোমার ভিতরে বৈরাগ্যের অঙ্কুর বিকশিত হয়েছে; কিন্তু ভোগের ইচ্ছাটাও সুপ্ত হয়ে আছে। মনে নেই, আমার কাছে নরেন আর ভবনাথ দু—জনেই আসত। দু—জনকেই আমি সমান পছন্দ করতুম। আমি দু—জনকেই বলতুম ‘নিত্যসিদ্ধ’ ও ‘অরূপের ঘর’।
—নিত্যসিদ্ধ কাকে বলে ভগবান?
—শোনো, স্বভাব অনুযায়ী মানুষকে চার ভাগে ভাগ করা যায়, বদ্ধজীব, মুমুক্ষুজীব, মুক্তজীব ও নিত্যজীব। এইবার দেখ, নিত্যজীব—যেমন নারদাদি। এরা সংসারে থাকে জীবের মঙ্গলের জন্যে—জীবদিগকে শিক্ষা দিবার জন্য। বদ্ধজীব—বিষয়ে আসক্ত হয়ে থাকে, আর ভগবানকে ভুলে থাকে—ভুলেও ভগবানের চিন্তা করে না। মুমুক্ষুজীব—যারা মুক্ত হবার ইচ্ছা করে। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ মুক্ত হতে পারে, কেউ বা পারে না। মুক্তজীব—যারা সংসারে কামিনীকাঞ্চনে আবদ্ধ নয়—যেমন সাধু—মহাত্মারা; যাদের মনে বিষয়বুদ্ধি নাই, আর যারা সর্বদা হরিপাদপদ্ম চিন্তা করে।
কিন্তু হল কী জানো, নরেন আমার ঠিক রইল ভবনাথ গেল ভেস্তে। সংসার তাকে গ্রাস করে নিলে। আমার তিরোধানের পর বি.এ. পাস করে, স্কুল ইনস্পেকটরের চাকরি নিয়ে কলকাতার বাইরে চলে গেল। বরাহনগর মঠের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে গেল। তবে তোমরা আমার সমাধিস্থ অবস্থার যে—ছবি দেখ সেই ছবিখানি ভবনাথই তুলিয়েছিল বরাহনগরের অবিনাশ দাঁর ক্যামেরায়। ভবনাথই মঠের জন্যে মুনসীদের ভুতুড়ে বাড়িটা মাসিক ১০ টাকা ভাড়ায় ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। দক্ষিণেশ্বরে আমার ঘরে ধ্রুবর যে ছবিটা দেখ, সেই ছবি ভবনাথই আমাকে দিয়েছিল। সে দুটো বইও লিখেছিল ‘নীতিকুসুম’ ও ‘আদর্শ নারী’। তার একটি মেয়ে হয়েছিল, নাম রেখেছিল প্রতিভা। মেয়ের বয়েস যখন দশ, তখন সে ভবানীপুরে থাকে। ওই বাড়িতেই আমার ভবনাথ মারা গেল—কালাজ্বরে।
নরেন তো কারও খাতির করতে শেখেনি, ও ছিল আগুন, ও ছিল আমার খাপখোলা তরোয়াল, যা দুটো ধার—জ্ঞান আর বৈরাগ্য। সে মনে হয় ভবনাথের ওপর শেষটায় অসন্তুষ্ট হয়েছিল, তা না হলে বরাহনগর মঠে বসে শশীকে কেন বলছিল—’ভবনাথের মাগটা বুঝি বেঁচেছে, তাই সে ফুর্তি করে দক্ষিণেশ্বরে বেড়াতে গিছিল।’ আমি জানতুম ভবনাথের সংসারে আসক্তি হয়েছে। কামিনী ভালো লাগছে, তাহলে তো কাঞ্চনও চাই। বয়স তখন তেইশ কী চব্বিশ, বিয়ে করলে। আমি তো ভেবে মরি, কর্মকাজ চাই, টাকা চাই। নরেনকে বললুম, ‘ওকে খুব সাহস দে।’ ভবনাথকে বললুম—’খুব বীরপুরুষ হবি। ঘোমটা দিয়ে কান্নাতে ভুলিসনে। শিকনি ফেলতে ফেলতে কান্না!’ মাস্টার আর নরেন খুব হাসছে। আমি ভবনাথকে বলছি, ‘ভগবানেতে মন ঠিক রাখবি; যে বীরপুরুষ, সে রমণীর সঙ্গে থাকে, না করে রমণ। পরিবারের সঙ্গে কেবল ঈশ্বরীয় কথা কবি।’ এই কথা হয়েছিল কাশীপুরের বাগানে। তোমাকেও আমি সেই একই উপদেশ দিয়ে গেলুম।