একুশ
তুফানে উঠে বসেছি। আর কিছুপরেই ট্রেন ছাড়বে। সঙ্গে মালপত্র বিশেষ কিছুই নেই। পকেটে গোটা কুড়ি টাকা মাত্র আর খুচরো কিছু পয়সা। জানলার ধারে বসতে পেয়েছি। এইটুকুই যা আনন্দের। বাকি সবই নিরানন্দের। মন যদি আকাশ হয়, তাহলে সেখানে রোদ নেই। ঘন কালো মেঘ। কী করতে চলেছি নিজেই জানি না। আমি কোথায় চলেছি, সে—কথা কারোকে বলিনি। এমনকী দেবুদাকেও না। সংসারে যার কেউ নেই, সে কোথায় থাকল কোথায় গেল, সে খবরে কার কী প্রয়োজন? একটা গাছ যেমন নিজে নিজে, নিজের চেষ্টায় বেঁচে থাকে, পাতা ঝরায়, পাতা গজায়, আমাকেও সেইরকম যতদিন পারি বাঁচতে হবে। যখন আর পারব না তখন মরে যাব। নিজের ভবিষ্যৎ তো জানি, আগাছার ভবিষ্যৎ।
হঠাৎ প্ল্যাটফর্মের দিকে চোখ পড়ল। এতক্ষণ তাকিয়ে থাকলেও চোখে কিছু পড়ছিল না। সব তালগোল পাকানো একটা মহাব্যস্ততা। অনর্গল শব্দ, অবিরাম ছোটাছুটি। এইবার দৃষ্টিতে মন লাগিয়েছি। আর তখনই দেখতে পেলুম, হুইলারের স্টলের পাশে রুমকি দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। ভাসা ভাসা, বড়ো বড়ো চোখ। ঢালু কপাল চকচক করছে। একগুছি চুল উড়ে সামনে ঝুলে পড়েছে। সবুজ শাড়ি। গোল গোল হাত। ভীষণ সুন্দর। রুমকি আমার দিকেই তাকিয়ে আছে—আকাশ যেভাবে তাকিয়ে থাকে মানুষের দিকে। আকাশ কথা বলে না। মানুষ যা ভাবে আকাশ সেই ভাবনাটাকেই দৃষ্টি করে নেয়। আমি হাসলে আকাশ ঝলমল করে, আমি কাঁদলে আকাশ বিষণ্ণ হয়।
যতবারই তাকাই, দেখি রুমকি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো কোনো মানুষের মন দুর্গের মতো। অনেক গোলাগুলিতেও ভাঙে না। আমার মন ঝুরঝুরে মাটির দেয়াল। রুমকিকে দেখে ভাঙতে শুরু করেছে। আমি ওর ভেতরটা দেখতে পাচ্ছি।
বাঁশি বাজল। ট্রেন নড়ছে। দু—এক কদম এগিয়েই হুসহুস গতিতে ছুটবে। কে যেন আমাকে ঠেলে আসন থেকে তুলে দিলে। বাংকের ওপর থেকে এক ঝটকায় ব্যাগটা টেনে নিয়ে দরজার কাছে চলে এলুম। স্পিড বেড়েছে। প্ল্যাটফর্ম গলগল করে পেছনদিকে ছুটছে। ঝপ করে নেমে পড়লুম। অল্প একটু টাল খেলেও সামলে নিয়েছি।
পাশ দিয়ে ট্রেনটা হু—হু করে বেরিয়ে গেল। ঝাপটা একটা মন্তব্য কানে এল—মরার ইচ্ছে হয়েছে? তুফানের শেষ কামরাটা—তুমি পারলে না, তুমি পারবে না, বলতে বলতে অদৃশ্য হয়ে গেল। ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে রোদের লুটোপুটি। রুমকি যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেইখানেই দাঁড়িয়ে রইল। আমি এগিয়ে গেলুম। রুমকির দু—চোখ জলে টইটম্বুর। খুব আস্তে জিজ্ঞেস করলুম,—তুমি এখানে দাঁড়িয়ে? কোথাও যাবে?
রুমকি কিছু একটা বলার চেষ্টা করেও বলতে পারল না। গলায় কান্না জমে আছে। শুধু বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
—আমি তোমার জন্যেই চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে পড়লুম। তুমি এইভাবে এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছ?
রুমকি ফিস ফিস করে বললে,—তোমার জন্যে। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারতুম না। তুমি নেমে না এলে আমি আত্মহত্যা করতুম।
আমার ভেতরে কিছু একটা লাফিয়ে উঠল। মাছ যেভাবে জলে লাফায়। ভালোবাসা কাকে বলে আমি জানি না। ভালোবাসতেও জানি না। এই নীরস ব্যস্তসমস্ত প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে, এই মেয়েটির কথা শুনে মনে হল পৃথিবীতে প্রেমের চেয়ে বড়ো কিছু নেই। নারীর ভালোবাসাতেই জীবনের সবকিছু গোপনে আছে। সমস্ত বাদ্যযন্ত্র, সমস্ত সংগীত, বৃষ্টি, ঝরনা, পাহাড়, নদী, সমুদ্র, রোদ, জ্যোৎস্না, পাখি, প্রজাপতি, মেঘ, নীল আকাশ, সব—সব আছে নারীর একটি কথায়, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
রুমকির হাতে একটা টোকা মেরে বললুম, চলো।
হাত ধরার সাহস হল না। অনেক লোক, অনেক জোড়া চোখ, গনগনে রেলচাতাল।
রুমকি বললে—কোথায়?
—বাড়িতে।
—সেখানে গিয়ে কী হবে?
—আর তো কোথাও যাবার জায়গা নেই।
—আমরা কিছুদিনের জন্যে কোথাও একটা যেতে পারি।
—তোমার বাবা থানায় ডায়েরি করবেন। আমি জেলে যাব, তুমি উদ্ধার আশ্রমে।
—পুরীতে আমার পিসিমা থাকেন, পিসেমশাইয়ের বিরাট ব্যাবসা। আমরা সেখানে যেতে পারি। সেইখানেই আমাদের বিয়ে হবে।
—এখন বাড়ি চলো। অনেক কিছু ভাবার আছে।
—যাই ভাব, তোমাকে আমি ছাড়তে পারব না।
—নিজের জীবনটা কেন নষ্ট করতে চাইছ? দারিদ্র্য জিনিসটা কী তোমার জানা নেই। সিনেমায় বড়োলোকের মেয়ে গরিবের ছেলেকে বিয়ে করে। বাস্তবে তা করে না। করতে নেই। তুমি যদি এমন করো, আমাকেই আত্মহত্যা করতে হবে তোমাকে বাঁচানোর জন্যে।
—তুমি তা পারবে না। তুমি আমাকে ভালোবাস।
—ভালোবাসি বলেই বিয়ে করতে পারব না।
—আর আমি ভালোবাসি বলেই তোমাকে বিয়ে করব।
আলোচনাটা একটা বেয়াড়া জায়গায় এসে আটকে গেল। দাবা খেলায় যেমন হয়। দুজনেরই চাল আটকে গেছে। অসহায়ের মতো চারপাশে তাকালুম। ধীরে ধীরে একটা ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। কোন ট্রেন কে জানে? কে একজন পাশ দিয়ে বলতে বলতে গেল—গীতাঞ্জলি, গীতাঞ্জলি। হঠাৎ আমার খেয়াল হল, টিকিটটা ফেরত দিলে কিছু টাকা পাওয়া যেতে পারে। রুমকিকে বললুম—চলো, টিকিটটার ব্যবস্থা করি, কিছু রিফান্ড পাওয়া যেতে পারে।
—তোমার ব্যাগটা আমাকে দাও।
—তুমি আমার ব্যাগ বইবে নাকি?
—কথা বাড়িয়ো না।
—এই বিশ্রী ব্যাগ তোমার হাতে মানায় না।
—সেটা আমি বুঝব।
রুমকি ব্যাগটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। পায়ে পায়ে লোক। পিলপিল করে গেটের দিকে এগোচ্ছি। মাঝে মাঝে দু—জনে আলাদা হয়ে যাচ্ছি। আবার জনস্রোতে ভাসতে ভাসতে পাশাপাশি চলে আসছি। মনে একটা ঘোর লেগে গেল। জীবনের শেষ পর্যন্ত এইভাবেই আমরা যদি চলে যাই ক্ষতি কী?