উনিশ
একটা বিরাট প্রশ্ন নিয়ে থম মেরে রইলুম কিছুক্ষণ, যেন ঝড়ের আগের প্রকৃতি। শেষরাতে এ আমি কী দেখলুম! স্বপ্ন অবশ্যই; কিন্তু জাগ্রত স্বপ্ন। আমি আত্মা দর্শন করেছি। আমি যে রূপে তাঁকে ভালোবাসি, সেই রূপ ধরে একটি নৌকোয় চড়ে ভেসে ভেসে আমার কাছে এলেন, শুধুমাত্র আমাকে পথের দিশা দেবার জন্যে। শুধুমাত্র আমার জন্যে, আমাকে হতাশা থেকে আশায় আনার জন্যে। সে তো আমি বুঝলুম। যা দেখেছি তা সাধারণ চোখের দেখা নয়, আমার কল্পনা। এত ঘোরতর কল্পনা যে বাস্তব বলে ভুল হয়েছে। একই ঘটনা অন্যভাবে ঘটেছিল তোতাপুরীর জীবনে।
সে ঘটনা তো ঠাকুর আমাদের বলেছেন, ‘স্বাধীন ইচ্ছা কোথায়? সকলই ঈশ্বরাধীন। ন্যাংটা অত বড়ো জ্ঞানী গো, সে—ই জলে ডুবতে গিছল। এখানে (দক্ষিণেশ্বরে) এগারো মাস ছিল। পেটের ব্যারাম হল, রোগের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে গঙ্গাতে ডুবতে গিছল। ঘাটের কাছে অনেকটা চড়া, যত যায়, হাঁটুজলের চেয়ে আর বেশি হয় না; তখন আবার বুঝলে, বুঝে ফিরে এল। আমার একবার খুব বাতিক বৃদ্ধি হল, তাই গলায় ছুরি দিতে গেছলুম। তাই বলি, মা, আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী; আমি রথ, তুমি রথী; যেমন চালাও তেমনি চলি; যেমন করাও তেমনি করি।’
আহা, অপূর্ব সেই সংগীত :
আমায় ধর ধর জনার্দন, পাপভার গোবর্ধন।
কামাদি ছয় কংসচরে ধ্বংস কর সম্প্রতি।।
বাজায়ে কৃপা বাঁশরি, মন ধেনুকে বশ করি।
তিষ্ঠ হৃদি গোষ্ঠে পুরাও ইষ্ট এই মিনতি।।
আমার প্রেমরূপ যমুনাকূলে, আশা বংশী বটমূলে
আমার প্রেমরূপ যমুনাকূলে, আশা বংশী বটমূলে—এইভাবের পৃথিবী বাস্তবে আর নেই। ঠাকুর যে—দুটিকে সাধনার অন্তরায় ভাবতেন, সেই দুটিই হয়েছে ইষ্ট—কামিনী আর কাঞ্চন। দেবুদা সেদিন এইভাবে বোঝাতে চাইছিলেন ব্যাপারটা—ধর একালের একটা মেটিরিয়ালিস্ট ছেলে, সে প্রোমোটার, বিরাট বিরাট ফ্ল্যাট তৈরি করে লাখ লাখ টাকায় বেচে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে। পুলিশ, করপোরেশান, নেতা—টেতা সব হাতের মুঠোয়। রাজার মতো ভোগে থাকে। ছেলেমেয়েদের বিলেতে লেখাপড়া করতে পাঠিয়েছে। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে। একটু একটু করে বুড়ো হচ্ছে। মানুষ যতই চেষ্টা করুক, যৌবন তার যাবেই। যে দুর্ভোগে আছে তার তাড়াতাড়ি যাবে, যে ভোগে আছে তার হয়তো একটু দেরিতে যাবে, কিন্তু যাবেই। দেহে স্বাভাবিক কারণেই রোগ—ব্যাধি আসবে। ভোগের জগতে অকারণ প্রেম থাকে না। সব কিছুই স্বার্থেই চাকায় ঘোরে। বার্টার সিস্টেম, তুমি কিছু দাও, ওজন করি, তারপর ওজন বুঝে তোমাকেও আমি দোবো। ছেলেমেয়েদের কেরিয়ারের পেছনে টাকা ঢালো, সে তোমাকে ‘বাবা’ বলবে। যেই লায়েক হবে, উড়ে যাবে। বাসা খালি। জিন চড়ানো ঘোড়া তৈরিই আছে। লাফিয়ে উঠেই জগৎ ধরতে বেরিয়ে যাবে। সুন্দরী, আধুনিকা স্ত্রী হীরের নেকলেস পরে যৌবনে প্রেম—প্রেম খেলা করত। সেবার ধারেকাছেও যেত না। সব কাজই করে দিত বাড়ির কাজের লোকেরা। বৃদ্ধ স্বামী চিকেন তন্দুর, মুর্গ মসল্লম চায় না, চায় সাহচর্য, সঙ্গ। একটু আন্তরিক প্রেম। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘কেয়ার’। কে দেবে? সেভাবে তো কারওকে তৈরি করা হয়নি? নিজের তৈরি পাঁচতারা হোটেলে ‘বিজনেস এগজিকিউটিভ’—এর মতো থেকেছে। সব কিছু কিনতে হয়েছে টাকা দিয়ে। প্রেম দিয়ে তো কেনা হয়নি কিছু। এই জগতে প্রেমের কারেনসি নোট অচল। জগৎটা বিশাল এক বিজনেস হাউস। তিনজাতের মানুষে ঠাসা—প্রোডিউসার, কনজিউমার, সেলসম্যান। রাজা যখন অথর্ব, সে তখন তার নিঃসঙ্গ ময়ূর সিংহাসনে বসে ভাবতে পারে, কী তাহলে হল? প্রাসাদ হল, গালচে হল, মোটর হল, নোট হল, লম্বা—চওড়া কথা হল, অহংকারের টঙ্কার হল, শেষে তলানিতে কী পেলুম ভাই? ফক্কা। আনন্দ কোথায়? কোথায় শান্তি? রেসের ঘোড়ার জকি, সে তো রেসটাই জেনেছিল। রেস্টের কথা তো ভাবেনি। তখন সে ফিরবে অতীতে। নিজের অতীতে নয়, মানব সভ্যতার অতীতে। কম আলো, কম গতির কালে। বিশাল বিশাল গাছ, ছাড়া ছাড়া জনপদ। লোহা দিয়ে ঢালাই করা। আকাশ—ছোঁয়া বাড়ির উদ্ধত অহংকার যখন ছিল না, মোটর গাড়ির একজস্টের ধোঁয়ায় শ্বাস যখন পীড়িত হত না, জেট প্লেন আর যন্ত্রের শব্দে পাখির ডাক চাপা পড়ে যেত না। মানুষ যখন ধীরে হাঁটত, ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ত না। মানুষ যখন সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে এসে পরিবার—পরিজনের সঙ্গে বসে গল্প করত, মদের দোকানে ঢুকে মত্ত হত না, দিনকে রাত রাতকে দিন করত না। মন্দিরের ঘণ্টা—কাঁসর, চার্চের বেল, মসজিদের আজানে যখন তার মনে অনন্তের অনুভূতি আসত, যখন উপনিষদের সুরে মানুষ জীবনের সুর বাঁধার চেষ্টা করত—
ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম।।
এ তোমার পরমেশ্বরের পৃথিবী, সমস্ত জগৎ স্বরূপতঃ ব্রহ্ম। তোমার আত্মাকে পালন করবে কীভাবে? না ত্যাগের দ্বারা, ত্যাগের মনোভাব নিয়ে। আসক্তিশূন্য হও। ধনের আকাঙ্ক্ষায় জীবনটাকে নষ্ট কোরো না। কার ধন? কে কাকে ভোগ করে? তার তখন মনে পড়বে বাইবেল, প্রথম শতাব্দীতে সন্ত ম্যাথু বলেছিলেন :
Blessed are the poor in Spirit : for
theirs is the kingdom of heaven.
Blessed are they that mourn : for
they shall be comforted.
Blessed are the meek, for
they shall inherit the earth.
Blessed are they which do hunger
and thirst after righteousness : for
they shall be filled.
Blessed are the merciful : for
they shall obtain mercy.
Blessed are the pure in heart : for
they shall see God.
Blessed are the peacemakers : for they
shall be called the children of God
তখন তার মনে পড়বে ষোড়শ শতকে তুলসীদাস কী বলেছিলেন :
গোধন গজধন বাজীবন, আত্তর রতন ধন খান।
যব আওত সন্তোষ—ধন, সব ধন ধুরি সমান।।
গোধন, গজধন, অশ্বধন, রতনখনি প্রভৃতি নিখিল ধন। তোমার মনে হবে তুচ্ছ ধুলো, যখন তুমি সন্তোষধন পাবে। সন্তোষরূপ ধনের তুল্য ধন আর দ্বিতীয় নেই। তার মনে পড়বে বালানন্দ ব্রহ্মচারীজির জীবনের একটি ঘটনা :
বি.টি. রোডের ধারে মতিশীলের বাগানবাড়ি। গুরু বালানন্দ কলকাতায় এসে ওই বাগানবাড়ির কাছে এক পোড়ো বাড়িতে উঠেছেন। ভূতের বাড়ি বলে সেই বাড়িতে কোনো ভাড়াটে আসত না। মহারাজ একদিন শীলদের পুকুরঘাটে স্নান করতে গেছেন। তিনি জানতেন না যে, ওই ঘাটে শীলবাড়ির মেয়েরাই শুধু স্নানে আসতেন। দারোয়ান এসেছে। রুক্ষ ভাষায় মহারাজজিকে অন্য কোনো ঘাটে চলে যেতে বলছে। মহারাজ দেখলেন ঘাটের কাছে রাস্তার ধারে একখানা গাড়ির মধ্যে মেয়েরা বসে রয়েছেন। মহারাজ হাসতে হাসতে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন: ‘এ ঘাট কার?’
দারোয়ান বললে, ‘এটা মতিবাবুর ঘাট।’
মহারাজ বললেন, ‘মতিবাবু কোথায়? তাঁকে ডেকে আনো।’
দারোয়ান বললে, ‘মতিবাবু মারা গেছেন।’
এইবার মহারাজ হা—হা করে হেসে বললেন, ‘তবে যে বললে মতিবাবুর ঘাট? তাঁর ঘাট হলে তিনি তো সঙ্গে করেই নিয়ে যেতেন। তা যখন যাননি, তখন তাঁর ঘাট বলছ কেমন করে? এ ঘাট এখন সকলের।
তার মনে পড়বে, কবীর বলেছিলেন, না ঘর মেরা, না ঘর তেরা, দুনিয়া সবকি বসেরা। বার্ধক্য সব মানুষেরই হবে, সে বর্তমানে বসে আছে অতীতে, ভেসে চলেছে ভবিষ্যতের বিলুপ্তির দিকে। তার কানের কাছে বাইবেল বলবেন :
What is a man profited, if he shall gain the whole world and lose his own soul?
সে তখন বাইবেলের কথাতেই উত্তর দেবে : They have sown the wind and they shall reap the whirlwind.
আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান।
দেবুদা সবশেষে বললেন, ‘শোনো ছোকরা, কালের হলাহল তোমাকে পান করতেই হবে। অতীত হয়ে যাওয়ার বয়েস তোমার হয়নি—খানিক দৌড়াদৌড়ি করো, ঘোড়ায় চাপো—তারপর।’
রিনঠিন চুড়ির শব্দে ঘোর কেটে গেল। আমার সর্বাঙ্গে গঙ্গার পলিমাটি। দরজার কাছে রুমকি। সাদা শাড়ি। পিঠে ভিজেচুল এলো। কপালে একটা সাদা টিপ। দেবীর মতো দেখাচ্ছে। তাকিয়ে আছে আমার দিকে অদ্ভুত চোখে। কী বলব আমি? কাছে ডাকব? না আবার পালাব? প্রশ্নটা করে ফেললুম, ‘এই, পুজোর জোগাড় তুমি করে রেখেছ?’