আঠারো
জমাট একটা অন্ধকার আমার দিকে এগিয়ে আসছে। জলে দাঁড় পড়ার ছপ ছপ শব্দ। একটা নৌকো আসছে। একজন দাঁড়ি, একজন মাত্র যাত্রী। নৌকোটা একেবারে আমার পাশে এসে থেমে গেল। দুলতে লাগল জলে। যাত্রীর মুখ একেবারে আমার মুখের কাছে। চমকে উঠলুম, ঠাকুরের মুখ। শ্রীরামকৃষ্ণের সেই পরিচিত মুখ।
‘কী হচ্ছে তোমার? আত্মহত্যা?’
চমকে উঠলুম। এমনও হয় নাকি। মধ্যরাতে অনেকের জীবনে অনেক কিছু ঘটে। সাধকের কাছে বিদেহী সাধক আসেন। আমার মতো অখ্যাত, অজ্ঞাত এক পাপীর কাছে তাঁরা আসবেন কেন? আমার কি এমন পুণ্যকর্ম আছে? সাধনভজনই বা কী করেছি?
আমি এত ভয় পেয়েছি যে শরীর শিথিল হয়ে আসছে। হাত পা অবশ। চোখে কুয়াশার আবরণ। জানতুম আধার তৈরি না হলে এইরকমই হবে। এক ছটাকি পাত্রে একসের ধরবে কেন? আমি ভগবানকে দেখার আনন্দের বদলে ভূতের ভয়ে সিঁটিয়ে গেছি। নৌকোটাও ভূত, যাত্রী দু—জনও ভূত। সাহস করে আর একবার তাকালুম। মাঝিকে এতক্ষণে চিনতে পেরেছি—স্বামী বিবেকানন্দ। দৃপ্ত সন্ন্যাসীর বেশ। মুণ্ডিত মস্তক। তপ্ত কাঞ্চনের মতো গাত্রবর্ণ। অন্ধকারেও বুঝতে পারি। আসলে অন্ধকার আর নেই। স্নিগ্ধ চাঁদের আলোর মতো অলৌকিক একটা আলোয় সব উদ্ভাসিত। ভরা গঙ্গার গেরুয়া জল খল খল করে হাসছে।
হঠাৎ মনে হল, ঠিকই তো! স্বামীজিই তো উপযুক্ত মাঝি। তিনিই তো আবিশ্ব ঠাকুরকে বহন করছেন। তখনও করেছেন, আজও করছেন। ভয়ের বদলে একটা বিস্ময়, একটা কৌতূহল জাগছে মনে। সত্যই কি কিছু ঘটছে, না সবটাই আমার মনের ভুল? মায়া দেখছি? কী খেয়েছি সন্ধে থেকে, গাঁজা—টাজা কিছু? কয়েক গেলাস জল ছাড়া কিছু খাইনি। জোটেনি কিছু। নীচের ওরা আজ ভাড়ার টাকা দেবে বলেছিল।
চিন্তার আবর্ত থেকে বেরিয়ে এলুম, শুনতে পেলুম ঠাকুর বলছেন, ‘আত্মহত্যা করা মহাপাপ, ফিরে ফিরে সংসারে আসতে হবে, আর এই সংসার—যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। তবে যদি ঈশ্বরের দর্শন হয়ে কেউ শরীর ত্যাগ করে, তাকে আত্মহত্যা বলে না। সে শরীর ত্যাগে দোষ নাই। জ্ঞানলাভের পর কেউ কেউ শরীর ত্যাগ করে। যখন সোনার প্রতিমা মাটির ছাঁচে ঢালাই হয়, তখন মাটির ছাঁচ রাখতেও পারে, ভেঙে ফেলতেও পারে।
অনেক বছর আগে বরাহনগর থেকে একটি ছোকরা আসত, উনিশ কুড়ি বছর হবে। গোপাল সেন যখন এখানে আসত তখন এত ভাব হত যে, হৃদয়কে ধরতে হত—পাছে পড়ে গিয়ে হাত—পা ভেঙে যায়। সে ছোকরা একদিন হঠাৎ আমার পায়ে হাত দিয়ে বললে, আর আমি আসতে পারব না—তবে আমি চললুম। কিছুদিন পরে শুনলাম যে, সে শরীর ত্যাগ করেছে।
‘শোনো, অপঘাতে মৃত্যু হলে প্রেত হয়। সাবধান! মনকে বুঝাবে, এত শুনে দেখে শেষকালে কি এই হল!’
ঠাকুর হাসছেন। স্বামীজি দাঁড় তুলে ভোলানাথের মতো বসে আসছেন। নৌকো মৃদু মৃদু দুলছে। ধীরে ধীরে সমস্ত জায়গাটা কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। কতক্ষণ এই ভাবে কাটল আমি জানি না, একসময় প্রবল হরিধ্বনিতে আমার ঘোর কাটল। তখন শেষ রাত। আকাশে জ্বলজ্বলে শুকতারা। শ্মশানে কোনো ভক্তজনের মৃতদেহ এসেছে। প্রবল হরিনাম সংকীর্তনে চারপাশ মুখর।
নিজেকে জল থেকে টেনেটুনে তুলে ঘাটে বসালুম। ভীষণ আক্ষেপ। কৃপা করে দর্শন দিলেন, প্রণাম করা হল না! আরও কিছু প্রশ্ন ছিল আমার। এই কর্মহীন জীবন আমার কাছে দুঃসহ। না ভোগে, না যোগে।
ভোরের আগেই বাড়ি ফিরে এলুম। সেই বন্ধ কারাগার। নীচেটা নীরব সুনসান। সব বন্ধ থাকায় ভ্যাপসা একটা গরম। কাঁঠালি চাঁপার গন্ধ। এই গন্ধটা মাঝেমাঝেই বেরোয়। তখনই আমি ভয় পাই। বাড়িতে একটি বাস্তু সাপ আছে। তার বয়স কত বছর কেউ জানে না। এই সাপ এই পরিবারের মঙ্গলদায়ক। তবে পরিবারই তো নেই। কার মঙ্গল? হঠাৎ একটা যোগসূত্র খুঁজে পেলুম। ঠাকুরের দর্শন আর বাস্তব গন্ধ! ওই কারণেই এই কারণ? সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য জলের স্রোতে এসে জলের স্রোতে ভেসে গেল।
দোতলায় নিজের ঘরে ঢুকে অবাক। এত অবাক যে দমবন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। আমি যখন ছিলুম না, তখন ঘরে কেউ পুজো করে গেছে। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ ও নারায়ণের ছবিটি দেয়াল থেকে নামিয়ে মেঝেতে পাশাপাশি রেখেছেন তিনি। সামনে আসন, কোষা, কুষি, নৈবেদ্য, গঙ্গাজল। ধূপ দীপ জ্বলছে। চারপাশ তকতকে পরিষ্কার। পেতলের থালায় ফুল, বেলপাতা। পুজোর একটা আয়োজন স্তব্ধ হয়ে আছে।
গঙ্গার মাটি মাখা শরীরে ঘরে ঢুকতে অস্বস্তি হচ্ছে। বুঝতে পারছি না, পুজো হয়ে গেছে না হবে! দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভালোভাবে দেখলুম আর একবার। তাম্রকুণ্ডে জল পড়েনি। ঠাকুরের চরণে পড়েনি পুষ্পাঞ্জলি। পুজো হয়নি, পুজো হবে।
কে এমন করে সাজালে? পূজারি কোথায়?