তেরো
কখন কোন কথা যে মুখে আসে! ফস করে বলে ফেলার পর লজ্জা পাই। কে যেন পেছন থেকে ঠেলে দেয়। আমি বলি না। আমাকে বলায়। কে তিনি?
কর্নেল সায়েব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। বয়েসের তুলনায় ভারী কথা। এইবার আমার লজ্জা করছে। আমি পালাতে চাইছিলুম। দরজার দিকে এগোচ্ছি, কর্নেল সায়েব গম্ভীর গলা বেশ কিছুটা নরম করে বললেন, ‘যাচ্ছ কোথায়? বোসো!’
এইবার আমি খুব জড়সড় হয়ে বসলুম।
কর্নেল বললেন, ‘তুমি যখন কিছু বলো, তখন বুঝতে পার কী বলছ?’
—আজ্ঞে না।
—তখন তোমার কী হয়?
—মাথাটা কেমন হয়ে যায়। মুখটা আলগা হয়ে যায়। ভাবনা চিন্তা সব শুকিয়ে যায়। আমি অন্যরকম হয়ে যাই।
—এই অবস্থাটাকে কী বলে জানো, পসেসড। তোমাকে কেউ অধিকার করেন। এইরকম কতদিন হচ্ছে?
—বেশ কিছু দিন।
—তোমার অতীতটা জানতে ইচ্ছে করছে। একদিন আসতে পারবে আমার বাড়িতে?
—তা পারব, তবে আপনি তো ভীষণ বড়োলোক, আমার অস্বস্তি হবে।
—আমার চেয়ে হাজারগুণ বড়োলোক আছে। তুমি একবার এসেই দেখ না!
—বলুন, কবে আসব?
—এই রবিবার। সকাল দশটায়। এই নাও আমার কার্ড।
কার্ডটা হাতে নিয়ে আবার রাস্তায়। টাকাটা ফেরত পেয়ে গেছি। বিতিকিচ্ছিরি খিদে পেয়ে গেছে। রান্না করতে আমার একেবারেই ইচ্ছে করে না। অথচ রান্না করতেই হয়। একবার মনে হল বাইরে কিছু খেয়ে নিই। পরক্ষণেই মনে হল, পাঁচ টাকা সম্বল। বাড়িতে চাল, ডাল, গোটা দুই আলু আছে। কোনো রকমে ফোটাতে পারলে রাতটা হয়ে যাবে। আমার গুরু বলতেন, না খেলে কিছুই হয় না, বরং খেলেই শরীর খারাপ। না খেয়ে ক—টা লোক মরে? বরং গাণ্ডেপিণ্ডে খেয়েই বেশি মরে। আমার গুরু বলতেন, খুব লাউ খাবি। লাউ হল সন্ন্যাসীদের খাদ্য। পেটে থাকে অনেকক্ষণ। শরীর শীতল হয়। কামনা—বাসনা মরে। ওই দুটোকে মারতে পারলেই তুমি রাজা। যত বন্ধন তো, ওই দোনো চিজকে নিয়ে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিসভাঙা ভিড়ে তলিয়ে গেলুম। সবাই ছুটছে বাড়ির দিকে। স্ত্রী—পুত্র—পরিবার। এই মানুষগুলোকে দেখতে আমার খুব মজা লাগে। ঘামতে ঘামতে, কত রকমের কথা বলতে বলতে দৌড়চ্ছে। কেউ আবার বাজার করেছেন। একজন আর একজনকে কী সব বোঝাচ্ছেন। ট্রেনের ঠাসাঠাসি ভিড়ে সবাই কথা বলছেন। কেউ খুব উত্তেজিত। এরই মধ্যে একজন গুনগুন করে গান গাইছেন। চাকায় চড়ে চলেছে ভগবানের জগৎ।
আমার ডানপাশে ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছেন এক ভদ্রলোক। মধ্যবয়সি। দেখতে খুব সুপুরুষ। থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলুম, ‘শরীর খারাপ লাগছে আপনার?’
ভদ্রলোক ধরা—ধরা গলায় বললেন, ‘আমার খুব অসুখ’।
—কী হয়েছে?
—গলায় ক্যানসার।
—কে বললে?
—টেস্ট—ফেস্ট সব হয়ে গেছে।
—কী চিকিৎসা করাচ্ছেন?
—কিচ্ছু না, কোনো চিকিৎসাই নেই তো করাবো কী?
—এই ভাবে এই ভিড়ে বেরিয়েছেন কেন?
—উপায় নেই, যতদিন পারা যায় সংসারটাকে টেনে যাই। এরপর তো সব উপোসে মরবে। ভদ্রলোকের গলাটা ধরে ধরে এসেছে। কামরা—ভরতি লোক। আপাতত সবাই বাড়ি যাচ্ছেন, কেউ কেউ কিন্তু অন্য একটা গাড়ি চড়ে আরও অনেক দূর চলেছেন। দুটো যাত্রা একই সঙ্গে চলেছে। গাড়িও ছুটছে, কালও ছুটছে।
হঠাৎ মনে হল, এমন একটা মানুষকে বাঁচানো যায় না? এ যেন বাঘে ধরেছে। জলজ্যান্ত একটা মানুষকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। এমন কোনো বন্দুক নেই যা দিয়ে সেই বাঘটাকে মারা যায়? এই মানুষটির জন্যে আমি একটা কিছু করতে চাই। ওঁর বদলে আমি মরতে চাই। একজনের টাকা, জমি, সম্পত্তি অন্যের নামে বদল করা যায়, অসুখটা যায় না? অনেক মহাপুরুষ পারতেন। রোগটা তুলে নিতেন। আমি শুনেছি।
ভদ্রলোক ঝিম মেরে ছিলেন। জিজ্ঞেস করলুম—আপনার জন্যে কী করতে পারি? আপনার এই কষ্ট কমাবার জন্যে আমি কী করতে পারি?
ওই ভিড়ের মধ্যেই আমার একটা হাত চেপে ধরে ভদ্রলোক বললেন, ‘এমন কথা আজকাল কেউ বলে না। এমন কি আমার আত্মীয়—স্বজনরাও বলে না। আমার একটাই উদ্বেগ, মৃত্যুর পর আমার পরিবারের কী হবে? এই হৃদয়হীন পৃথিবীতে তারা কী ভাবে বাঁচবে? আমার তো সঞ্চয় কিছুই নেই!’
—আপনি মারা যাবেন এমন কথা ভাবছেন কেন?
—এ রোগে কেউ বাঁচে না, আজ আর কাল।
—আপনার পরিবারে কে কে আছেন?
—আমার বউ, আর আমার একটা সুন্দর মেয়ে। সবে কলেজে ঢুকেছে।
—আপনি কী করেন?
—একটা ফার্মে চাকরি করি। মাঝারি গোছের চাকরি। যা পাই, সংসারটা চলে যায়। একদিন আসুন না আমাদের বাড়িতে। আমার বউ খুব ভালো রাঁধে, আমার বউ খুব ভালো গান গায়। মেয়েটা রবীন্দ্রসংগীত শিখছে। বেশ গায়।
ভদ্রলোক তাঁর ঠিকানা বললেন। আমার স্টেশান এসে গেল। গুঁতোগুঁতি করে নামলুম। এমন একজন মানুষ দেখলুম, যাঁর ভেতরে ঘড়ির কাঁটার মতো মৃত্যু চলেছে টিক টিক শব্দে। আজ হোক কাল হোক মরব জেনে, পৃথিবীতে কয়েকদিন বেঁচে থাকতে কেমন লাগবে, সেইটাই অনুমান করার চেষ্টা করলুম। গঙ্গার ধারে দাঁড়াতেই দক্ষিণেশ্বরের মন্দির চোখে পড়ল। নির্জন গঙ্গা চাঁদের আলোয় ভাসছে। একটু দূরেই হিন্দুস্থানির দোকান। রুটি তৈরি হচ্ছে গরম গরম। কম রেস্তর খদ্দেরদের জন্যে। সেইখানেই বসে গেলুম। আজ রাতে আর রান্নার মেজাজ নেই, কিন্তু খিদে আছে। মন বসে আছে মাথায়, খিদে বসে আছে পেটে। দূরত্ব অনেকটা, একতলা, তিনতলা, কিন্তু যোগাযোগ আছে। এটা জৈব তো ওটা দৈব।
গাবদা দুখানা রুটি, খানিকটা সবজি। উদোম ঝাল। টনক নড়ে যায়। খাচ্ছি আর মনকে খাওয়াচ্ছি। একটা আশ্বিনে বাতাস বয়ে আসছে গঙ্গার বুক থেকে। মা—দুর্গার চিঠির মতো। হঠাৎ মনে হল রুটিটা কে চিবোচ্ছে, আমি না মৃত্যু? আমিটা কে? আমিই তো মৃত্যু। আমার আমিটাই তো মৃত্যু। পাখি বসে আছে ডালে। গাইছে, শিস দিচ্ছে, ফল ঠোকরাচ্ছে। হঠাৎ উড়ে যাবে। পড়ে রইল ত্রিভঙ্গ ডাল। মৃত্যু পাখিটাই তো! ঘরের মধ্যে সে ছিল। ডেকেছি, সাড়া দিয়েছে, দোর খুলেছে। একদিন সাড়া নেই, বৃথাই ডাকাডাকি। কী হল? বললে, ‘বাবু নেই, কাল চলে গেছে।’
‘খাও মৃত্যু রুটি খাও। যতদিন পার বেঁচে থাক।’
মাথার মধ্যে কোথায় একটা ঝিম মেরে শব্দ হল। সব যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে শ্রীকৃষ্ণ। সেই বিশ্বরূপের মূর্তি। কৃষ্ণকালো গাত্রবর্ণ। মুখগহ্বরে ফরফরে আগুন। অনন্ত, অনল, অনির্বাণ শ্মশানচিতা। পতঙ্গের মতো জীব অগ্নিমোহে ঝাঁপ দিচ্ছে সেই আগুনে। ভগবানের কণ্ঠস্বর বাতাসে।
কালোহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো
লোকান সমাহর্তুমিহ প্রবৃত্তঃ।
আমি মহাকাল। আগুনের ফরফর শব্দ আমার উল্লাসের অট্টহাসি। আমি ভীষণ। আমি সংহারিণী। মারো অথবা নাই মরো, আমার অগ্নিবলয়ে তোমাদের ভোজন, ভজন, বিভাজন।
ঋতেহপি ত্বাং ন ভবিষ্যন্তি সর্বে
যেহবস্থিতাঃ প্রত্যনীকেষু যোধাঃ।।
আমার গুরুর মৃত্যু মনে পড়ে গেল। ঠিক তিন দিন আগে তিনি বললেন, ‘আসন পেতে দাও।’ আমরা আসন পেতে দিলুম। বললেন, ‘আসনে ফুল বিছিয়ে দাও, তিনি এসে গেছেন।’
গুরুজি দেখতে পেয়েছিলেন, আমাদের সে—দৃষ্টি ছিল না। বললেন, ‘গান শোনাও।’
গুরুজি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথা বলতে লাগলেন, ‘সাধু মরণে হুঁশিয়ার। মরবার সময় যা ভাববে তাই হবে। ভরতরাজা হরিণ ভেবে হরিণ হয়েছিল। তাই ঈশ্বরকে লাভ করার জন্যে সান চাই। রাতদিন তাঁর চিন্তা করলে মরবার সময়ও সেই চিন্তা আসবে।’
সেই শূন্য আসনে কে ছিলেন জানি না। গুরুজি তাঁর সঙ্গে শাস্ত্র—আলোচনা করছেন। দুয়ার বন্ধ, আমরা বাইরে থেকে শুনছি। হাসি—ঠাট্টা হচ্ছে। গান—গল্প হচ্ছে। হঠাৎ শুনলুম, ‘সময় হয়েছে। চলুন এইবার ওঠা যাক।’
পড়ে রইল সব। সেই শূন্যতা কী অসীম।