এক
বসে আছেন তিনি।
ঠিক যেমন বসে থাকতেন গত শতাব্দীতে। বাইরেটা অনেক বদলে গেছে। বৈষয়িক জগৎ তো পালটাবেই। মোমের আলো, প্রদীপের বাতি, ছায়া অন্ধকার, নিঃসীম নির্জনতা, বাতাসের পত্রশাখার দীর্ঘশ্বাস, হাতপাখার মন্থর আন্দোলন, ধীরগামী যানবাহন, শতাব্দী গুটিয়ে নিয়েছে। এখন চড়া আলো, কর্ণবিদারী শব্দ, ব্যাবসাবাণিজ্য, থইথই জনসমুদ্র। তবু তিনি আছেন। বাস্তবের খাটে, ভাবের জগতে, ভক্তির দৃষ্টিতে।
তিনি বসে আছেন, সব শূন্যতা পরিপূর্ণ করে। বসে আছেন ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ।
‘হ্যাঁগা, তোমার সমস্যাটা কী?’
‘ঠাকুর আমার ভীষণ ভয়।’
‘কীসের ভয়?’
‘হারাবার ভয়।’
‘কী পেয়েছ যে হারাবে? তুমি তো এসেছ। এসে পড়েছ। যা ছিল তার মধ্যে এসে পড়েছ। আবার একদিন সময় হলেই চলে যাবে। যা ছিল তা পড়েই থাকবে। তুমি আছ, তুমি থাকবে না। এর মধ্যে তোমার কোনটা! একদিন তুমি তাকালে। আলো, আকাশ। ছোটো ছোটো কিছু প্রবৃত্তি। খিদে পায় কেঁদে ওঠ। অস্বস্তি হয় চিৎকার কর। গর্ভধারিণীকে খোঁজো। অসহায়, অজ্ঞান একটি শিশু। তখনও তোমার কথা ফোটেনি। বোধের বিকাশ ঘটেনি। জান না কোথায় আছ, কাদের মধ্যে আছ! তুমি কেমন আছ! তুমি ধনী না দরিদ্র! তোমার জাত কী! তোমার ভাষা কী! তুমি তখন শুধু গন্ধ চেন। মায়ের গায়ের গন্ধ। উষ্ণতা। সময় কিন্তু তোমাকে নিয়ে চলেছে। তুমি সময়ে বাড়ছ। এই সময় এক অদ্ভুত প্রবাহ। কেউ ফুটছে, কেউ ঝরছে। কারও শেষ হচ্ছে, কারও শুরু।’
‘আমার যে সেই গানটা মনে পড়ছে ভগবান।’
‘মনে যখন পড়ছে তখন গেয়েই ফেলো। আমাকে তো অনেকেই অনেক গান শুনিয়ে গেছে।’
তাহলে শুনুন রবীন্দ্রনাথের গান :
‘তোমার হল শুরু, আমার হল সারা
তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা।।
তোমার জ্বলে বাতি তোমার ঘরে সাথি
আমার তরে রাতি, আমার তরে তারা।।
তোমার আছে ডাঙা, আমার আছে জল
তোমার বসে থাকা, আমার চলাচল।।
তোমার হাতে রয়, আমার হাতে ক্ষয়
তোমার মনে ভয়, আমার ভয় হারা।।’
‘ওই তো আমি তোমাকে যা বলছিলুম, অনেকটা সেই ভাব। ঘুরছে। ঘুর্ণায়মান মঞ্চ। প্রবেশ, অবস্থান, প্রস্থান। সময় যখন তোমাকে চেতনার স্তরে পৌঁছে দিল, সে যেন হঠাৎ, আরে, ওই তো নীল আকাশ, ওই তো পাখি, সবুজ গাছের পাতা। এই তো রোদ, সকাল। চারটে দেয়াল, দরজা, জানলা, রক, বারান্দা। এ কে? আমার মা। ওই তো আমার বাবা, দাদা, কাকা, দিদি, পিসি। এরা সব ছিল, এইভাবেই ছিল। তুমি এসেছ। একটা নৌকোয় তুমি উঠেছ। জনমঘাট থেকে মরণঘাটের যাত্রী তুমি। ফিতের মতো পড়ে আছে লম্বা সময়। এপাশে একটা বাঁশ ওপাশে একটা বাঁশ। টান টান বাঁধা তার। বৃষ্টি হয়ে গেল। জলের ফোঁটা ঝুলছে তারে। একটা, দুটো, অনেক। জীবন। ফোঁটাগুলো তার ধরে এগোচ্ছে সুড়সুড় করে। এক একটা ফোঁটা এক এক দূরত্বে গিয়ে ঝরে পড়ছে। কোনোটা অনেকটা যাচ্ছে, কোনোটা ঝরে পড়ছে একটু গিয়েই। এই হল আয়ু। একটু বেশি, একটু কম। সেই যে পেনেটির মহোৎসব থেকে ফেরার পথে মতি শীলের বাগান—বাড়িতে ওরা সব ঝিল দেখাতে নিয়ে গেল, তুমি কি সেই দলে ছিলে?’
‘হয়তো ছিলুম, আবার নাও থাকতে পারি! পূর্বস্মৃতি তেমন জোরালো নয়।’
‘ওদের বলেছিলুম, জল দেখলে মন শান্ত হয়। নিরাকার ধ্যান ভালো জমে। তাই নিয়ে গেল। সেদিন আমার শরীরটা সুবিধের ছিল না। সর্দি হয়েছিল। তার আগে পেনেটিতে মণি সেনের বাড়িতে খুব নাচানাচি হয়েছে। তবু গেলুম। বাগান, ঠাকুরবাড়ি, ঝিল, লোভ সামলানো যায়! তুমিই বলো না। সন্ধে হয় হয়। মন্দিরে শ্রীগৌরাঙ্গকে দর্শন করে পূর্ব দিকের ঝিলের ধারে গেলুম। মাস্টারকে বলেই রেখেছিলুম। নিরাকার ধ্যান কী ভাবে আরোপ করতে হয় শেখাব। তুমি ধ্যান করো। ধ্যান কাকে বলে জান?’
‘আজ্ঞে ধ্যান কাকে বলে জানি; কিন্তু ধ্যান করতে পারি না। মন ছিটকে যায়। ফুটবলের মতো।’
‘তা তো যাবেই। বিষয়ীর মন মাছির মতো। মন থেকে বিষয় ফেলে দিতে না পারলে ধ্যান হয় না। হ্যাঁ, যে—কথা হচ্ছিল, ঝিল। মতি শীলের বাগানবাড়ির ঝিল। জলে মাছ খেলা করছে। কেউ মাছ মারতে আসে না তাই নির্ভয়। মুড়িটুড়ি দিলে ঝাঁক বেঁধে আসে। সেই মাছের খেলা দেখতে দেখতে ওদের একটা কথা বলেছিলুম, তোমাকেও সেই কথাটা বলি—চিদানন্দ সাগরে ওই মতি শীলের ঝিলের শত—শত মাছের মতো আনন্দে বিচরণ করো। দিন ফুরোলে মৃত্যু এসে তোমাকে তুলে নিয়ে যাবে।’
‘মানে মুক্তি।’
‘কে বলেছে বাপু মৃত্যু মানে মুক্তি। আসবে যাবে, আসবে যাবে, এই তো জীবের জীবন। মুক্ত হবার ইচ্ছে না থাকলে মৃত্যু কি মুক্তি দিতে পারে। কামনা—বাসনার টানাপোড়েনে জীবনের নকশা। কামিনী আর কাঞ্চন। শিশ্ন আর উদর। বলছিলে না, তোমার ভয় করছে। হারাবার ভয়। ইঁট দিয়ে গাঁথা চারটে দেয়াল। মাথার উপর ছাত। এক চিলতে জানলা। কয়েকটি প্রাণী। তোমার স্ত্রী—পুত্র—পরিবার। উনুন জ্বলছে, কয়লা পুড়ছে। জীবন জ্বলছে। অভাব—অনটন। রোগ—শোক। দেনাপাওনা। জালে পড়ে আছো। আমার সেই উদাহরণটা তোমার মনে আছে? বলেছিলুম, সেদিন এই ঘরে কে কে ছিল? বিজয়, মানে তোমাদের বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, বলরাম, মাস্টার আরও সব ছেলেরা। ওই কথাই হচ্ছিল, মৃত্যু আর মুক্তি। শরীর ত্যাগ করলেই জীবের মুক্তি হয় না। জীবের চার থাক—বদ্ধ, মুমুক্ষু, মুক্ত, নিত্য। সংসার হল জাল, জীব যেন মাছ। ঈশ্বর, যাঁর মায়া এই সংসার, তিনি জেলে। জেলের জালে যখন মাছ পড়ে, কতকগুলো মাছ জাল ছিঁড়ে পালাবার অর্থাৎ মুক্ত হবার চেষ্টা করে। এরা হল মুমুক্ষু জীব। মুক্তি খুঁজছে। যারা পালাবার চেষ্টা করছে, সকলেই পালাতে পারে না। দু—চারটে মাছ ধপাঙ শব্দ করে পালায়। তখন লোকেরা বলে, ওই মাছটা বড়ো পালিয়ে গেল! এই যে পালাল, এইরকম দু—চারটে লোক হল মুক্তজীব। কিছু মাছ এত সাবধানী যে, কখনো জালে পড়ে না। উদাহরণ, নারদ। এঁরা হলেন নিত্যজীব। কিন্তু অধিকাংশ মাছ জালে পড়ে, অথচ এ—বোধ নেই যে, জালে পড়েছে মরতে হবে। জালে পড়েই জালসুদ্ধ চোঁ—চা দৌড় মারে ও একেবারে পাঁকে গিয়ে শরীর লুকোবার চেষ্টা করে। পালাবার কোনো চেষ্টা নেই বরং আরও পাঁকে গিয়ে পড়ে। এরাই বদ্ধজীব সংসারে—অর্থাৎ কামিনী—কাঞ্চনে আসক্ত হয়ে আছে; কলঙ্ক—সাগরে মগ্ন, কিন্তু মনে করে বেশ আছি। যারা মুমুক্ষু বা মুক্ত, সংসার তাদের পাতকুয়া বোধ হয়; ভালো লাগে না।’
ভগবান ভাবমগ্ন হলেন। হঠাৎ গান ধরলেন, অপূর্ব কণ্ঠস্বর,
শ্যামা মা কী কল করেছে,
কালী মা কী কল করেছে
চৌদ্দ পোয়া কলের ভিতর, কত রঙ্গ দেখাতেছে।।
আপনি থাকি কলের ভিতরি কল ঘুরায় ধ’রে কলডুরি,
কল বলে যে আপনি ঘুরি, জানে না কে, ঘুরাতেছে।।
যে কলে জেনেছে তাঁরে কল হতে হবে না তারে,
কোন কলের ভক্তি—ডোরে, আপনি শ্যামা বাঁধা আছে।।
পশ্চিমে কলস্বিনী ভাগীরথী। মালগাড়ি চলেছে ব্রিজের ওপর দিয়ে। ওপারে কোথাও সানাই বাজছে। স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ভগবান বললেন, ‘তোর ভয় করে, তাই না। নিজেকে ল্যাংটো কর। ল্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়। হিসেব করে দেখ, তোর কী আছে! একটা অভ্যস্ত জীবন ছাড়া তোর কিছুই নেই। অভ্যাস ছেড়ে বেরিয়ে আয়। যখন যেমন তখন তেমন, যেখানে যেমন যেখানে তেমন, যার কাছে যেমন তার কাছে তেমন।’