একটি বন্যার বছর -2
জলের উচ্চতা বাড়তে দেখে আমাদের গ্রামের বেশিরভাগ পুরুষ তাদের গরু , বাছুর, মোষ, ছাগল আর যার যা পোষ্য ছিল সব নিয়ে চলে গেল দেড় কিলোমিটার দূরের একটা দীঘিতে। প্রায় দু মানুষ সমান এই দীঘির পাড়ে জায়গা পেল আমার গ্রামের অবলা পশু আর তাদের অসহায় প্রভুরা। গোটা গ্রামে এই একটি মাত্র জায়গার টিউবয়েল, যা জলের তলায় যায় নি। যে কটা দিন বন্যার জল ছিল সবাই ওই টিউবয়েলের জল খেয়েই নিজেদের প্রাণ রক্ষা করেছিল। আশপাশের কিছু গ্রামে তো শুনেছিলাম বন্যার জল ফুঁটিয়ে তা ঠান্ডা করে খাচ্ছিল আর্তেরা। আমাদের প্রায় দশটা গরু নিয়ে আমার দাদু বন্যার সময়টা এই দীঘিতেই কাটিয়েছিলেন। দাদু বলছি বলে যে গায়ের জোর কম, বুড়ো মানুষ – তা কিন্তু নয়। আগেকার দিনের মানুষ, গ্রামের খাঁটি জল হাওয়ায় এরা বড়ো হয়েছে – এদের শক্তি নিয়ে কখনো সন্দেহ করতে নেই।
অবলা পশুদের ব্যবস্থা হলেও মানুষ জনের অবস্থা ছিল অতি শোচনীয়। শিশু মহিলা সব হাহাকার অবস্থা। এই সময় কাজে এসেছিল আমাদের সেই লম্বা স্কুল ঘরের মত ছাদটি। আমরা প্রায় দশ ঘর লোক ওই ছাদের উপর কোনো রকমে দিন কাটিয়েছিলাম।মাথার উপর সস্তার ত্রিপল টাঙানো। গ্রামের আরও মানুষ কেউ আমাদের প্রাইমারি স্কুলের ছাদে, কেউ ক্লাব ঘরের ছাদে তো কেউ আমাদের রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের ছাদের উপর নিজেদের জায়গা করে নিল। তবে এত ক্ষতির মধ্যেও প্রকৃতি একটা উপকার করেছিল – এই কটা দিন একফোঁটা বৃষ্টি হয়নি। যদি বৃষ্টি হত এবং একতলা বাড়ির ছাদ অব্দি জল পৌঁছিয়ে যেত তবে তাহলে দুটো বাড়ির গোটা কতক মানুষ আর কিছু আশ্রিত ছাড়া সবাই ভেসে যেত সেই জলে। আর আমিও এখন নিজের ঘরে বসে সেই বন্যার স্মৃতি রোমন্থনের সুযোগ পেতাম না।
এখানে বলে রাখি যে দুটো বাড়ির কথা বলা হচ্ছে সেই সময় আমাদের আশেপাশের তিনটি গ্রামের মধ্যে ওই দুটো মাত্র দোতলা বাড়ি ছিল। আসলে আবার সেই অর্থনৈতিক অসম বণ্টনের কথা চলে আসে। আজ সে কথা থাক, অন্য একদিন না হয় বলব।
আমাদের গোলার ধান, ঘরে রাখা পাট আর জমিতে দেওয়ার সার সব নষ্ট হয়ে গেছিল জলে। মানুষজনের থাকতে দিয়ে যেটুকু জায়গা ছিল তাতে সামান্য কিছু খাবার দাবার আর খুব দরকারি কিছু সরঞ্জামই তোলার সুযোগ হয়েছিল। পরে অবশ্য সরকার থেকে অনেক সাহায্য এসেছিল। কিন্তু সেই সাহাজ্যটুকু নেওয়ার জন্য প্রাথমিক ভাবে আমাদের জীবনরক্ষাটা জরুরি ছিল। জলের মধ্যে ডুবে যাওয়া কলা গাছ কেটে তা দিয়ে ভেলা অর্থাৎ ওই নৌকা মত বানানো হয়েছিল। তাতে সকলের সাথে যোগাযোগ রাখা হত। ওই রকম দুর্যোগের সময়ে এই ভেলা আমাদের খুব উপকার করেছিল। তাছাড়া সরকারি নৌকা করে প্রতিদিন খাবার আসতো। বাবা চলে যেত গ্রামের অন্যান্য মানুষদের মধ্যে সেগুলো বিলি করতে। (ক্রমশঃ)