Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » একজনের ভেতরে দুজন || Anish Deb

একজনের ভেতরে দুজন || Anish Deb

অজয়কে নিয়ে কখনও গল্প লিখব ভাবিনি৷ কিন্তু গতকাল সন্ধেবেলার একটা ঘটনায় অজয় মনের সামনে চলে এল৷ সময়ের গাড়ি এক ঝটকায় আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল পঞ্চাশ বছর পেছনে৷ আমি পৌঁছে গেলাম আমার স্কুলে৷ ক্লাস সেভেনের ‘সি’ সেকশানের ক্লাসরুমে৷ কতই বা বয়েস তখন আমার? সত্যি-সত্যি ‘বাও কি তেও—মা বলেছে আও কম’৷

অজয় আমার সহপাঠী ছিল, কিন্তু বন্ধু ছিল না৷ সত্যি বলতে কী, গোটা ক্লাসে অজয়ের কোনও বন্ধু ছিল না৷ ও ছিল একা, কিন্তু দ্রষ্টব্য৷ ও নানান ঢঙে বিচিত্র সব দুষ্টুমি পারফর্ম করত৷ আর আমরা, ক্লাস সেভেনের বাকি আটত্রিশ কি উনচল্লিশ জন, অজয়ের পারফরম্যান্স অবাক হয়ে দেখতাম৷ অজয় ছিল বলতে গেলে ‘হিরো’৷ আমরা ছিলাম নীরব দর্শক৷

অজয়ের কথা লিখতে গিয়ে ওর মুখটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে৷

গোলগাল চেহারা, মাথায় কোঁকড়ানো চুল, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা৷ চশমার কাচের আড়ালে দুটো প্রাণবন্ত চঞ্চল চোখ৷ ঠোঁটের ওপরে হালকা গোঁফের রেখা৷

শুধু অজয় কেন, একইসঙ্গে ভেসে উঠছে ক্লাসরুমটাও৷ আমরা সবাই যে-যার ডেস্কের সামনে ছোট-ছোট চেয়ারে বসে আছি৷

আমাদের স্কুলটা ছিল মাঝ-কলকাতার এক বিখ্যাত সরকারি স্কুল৷ ট্রামরাস্তার পাশেই তার বিশাল বিল্ডিং৷ বিল্ডিং-এর লাগোয়া এক প্রকাণ্ড পার্ক৷ পার্কে প্রচুর গাছপালা, এবং তার ঠিক মধ্যিখানে এক মনোরম চৌকো দিঘি৷ সেই বিশাল চৌকো দিঘিকে ঘিরে ছিল বেশ কয়েকটা সাঁতারের ক্লাব৷

আমাদের ক্লাসরুমটা ছিল পার্কের দিকে, দোতলায়৷ লাস্ট পিরিয়ডে ক্লাসরুমের জানলা দিয়েই আমরা দেখতে পেতাম বাচ্চাকাচ্চারা হাত-পা ছুড়ে সাঁতার শিখছে৷

অজয় আমার প্রথম নজর কাড়ে ওর গানের জন্যে৷

একজন টিচার ক্লাস শেষ করে চলে যাওয়ার পর পরের টিচার ক্লাসে ঢুকতে-ঢুকতে দশ কি পনেরো সেকেন্ড সময় পেরিয়ে যেত৷ সেই অবসরটুকুতে আমরা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠতাম৷ সকলের কথাবার্তা মিলেমিশে গিয়ে এক প্রবল গুঞ্জন তৈরি হয়ে যেত ক্লাসরুমে৷

কিন্তু অজয় সেসবের মধ্যে ছিল না৷ দুটো ক্লাসের মাঝখানের এই ফাঁকটুকুতে ও ডেস্কে তাল ঠুকে গান ধরত৷

না, অজয়ের গানের গলা ছিল না৷ বেসুরো হেঁড়ে গলায় ও গান গাইত৷ দেশাত্মবোধক গান৷ যেমন, ‘ছেড়ে দাও রেশমি চুড়ি বঙ্গনারী কভু হাতে আর পোরো না’, ‘জননী গো লহ তুলে বক্ষে সান্ত্বন বাস দেহ তুলে চক্ষে’, ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’৷

কিন্তু স্যার ক্লাসে ঢুকলেই ও চুপ করে যেত৷

ক্লাসে আমি যেখানে বসতাম, আর অজয় যেখানে বসত, এই দুটো জায়গার মধ্যে দূরত্ব ছিল অনেকটাই৷ তাই আমি দূর থেকে আমার সহপাঠীকে লক্ষ করতাম৷ ও সবসময় শক্তি আর ফুর্তিতে টগবগ করত৷ বেশ বুঝতে পারতাম, ঠিকঠাকভাবে লেখাপড়া করার জন্যে ওর জন্ম হয়নি৷

আমাদের সময়ে স্কুলের জানলাগুলো ছিল পুরোনো ধাঁচের৷ কাঠের ফ্রেমে কাচের শার্সি বসানো৷ জানলাটার মোট তিনটে ভাগ৷ জানলার মাঝের অংশটা ছিল ফিক্সড—দেওয়ালের মতো৷ আর তার দু’পাশের দুটো অংশে ছিল দুটো এক পাল্লাওয়ালা জানলা৷ তবে জানলার কোথাও কোনও গরাদ কিংবা গ্রিলের ব্যাপার ছিল না৷ অনেকটা ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর মতো৷ আর জানলার বাইরে বেশ চওড়া কার্নিশ৷ ফলে ইচ্ছে করলে কেউ বাইরে থেকে বেয়ে উঠে জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়তে পারে৷

জানলা নিয়ে এত কথা বলার কারণ, অজয়ের কীর্তিকাহিনির প্রথম এপিসোডে জানলার একটা বিশেষ ভূমিকা আছে৷

সকালবেলার প্রথম ক্লাস৷ বাংলার স্যার পীতাম্বরবাবু ক্লাসে ঢুকে গুছিয়ে বসেছেন৷ পোশাক ধপধপে ধুতি আর পাঞ্জাবি৷ রোগা, ফরসা চেহারা৷ চোখে চশমা৷

কয়েকমাস এই স্যারের ক্লাস করার অভিজ্ঞতায় আমরা সকলেই জেনে গেছি এই স্যার বেশ কড়া এবং গম্ভীর প্রকৃতির৷ তাই আমরা ওঁকে নিজেদের মধ্যে ‘ভোম্বল’ নামে ডাকি৷

শুধু তাই নয়, একদিন অঙ্কের স্যার মহাদেববাবুর পিরিয়ডে প্রক্সি দিতে পীতাম্বরবাবু এসেছিলেন৷ এসেই মাপা গলায় বলেছিলেন, ‘অ্যাই, শোনো৷ তোমাদের মধ্যে একজন এখানে এসো৷ এসে একটা গল্প বলো৷ বাকি সবাই মন দিয়ে শুনবে—কেউ কোনও গোলমাল করবে না—৷’

স্যারের কথা শেষ হওয়ামাত্রই অজয় হাত তুলে বলেছিল, ‘আমি গল্প বলব, স্যার?’

‘হ্যাঁ, চলে এসো—৷’

অজয় গম্ভীর মুখে স্যারের খাটো মঞ্চের পাশে গিয়ে দাঁড়াল৷ গম্ভীর গলায় স্যারকে জিগ্যেস করল, ‘স্যার, ‘‘ভোম্বল সর্দার’’ গল্পটা বলব?’’

স্যার ‘হ্যাঁ’ বলার আগেই আমরা গোটা ক্লাস হেসে কুটিপাটি৷ কিন্তু অজয় তখনও গম্ভীর মুখে স্যারের দিকে তাকিয়ে স্যারের অনুমতির অপেক্ষা করছে৷

তো যেদিনের কথা বলছিলাম৷

সকালবেলার প্রথম ক্লাসে এসে পীতাম্বরবাবু রোলকল করতে শুরু করেছেন৷ আমরা রোল নম্বর অনুযায়ী পরপর সাড়া দিচ্ছি : ‘প্রেজেন্ট, স্যার’, ‘ইয়েস স্যার’, ‘প্রেজেন্ট প্লিজ’ ইত্যাদি৷

অজয়ের রোল নম্বর ছিল আঠেরো৷ স্যার ‘এইটিন’ বলে ডাকার সঙ্গে-সঙ্গে কোথা থেকে যেন উত্তর ভেসে এল, ‘প্রেজেন্ট প্লিজ৷’

অজয় যে-ডেস্কে বসত সেইদিকে তাকালেন পীতাম্বরবাবু৷

অজয়ের ডেস্ক-চেয়ার খালি৷

অবাক হয়ে স্যার আবার ডাকলেন, ‘রোল নাম্বার এইটিন—৷’

আবার উত্তর এল, ‘প্রেজেন্ট প্লিজ—৷’

কিন্তু অজয়কে দেখা যাচ্ছে না৷

আমরাও বেশ অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে অজয়কে খুঁজে বেড়াচ্ছি, কিন্তু অজয় ক্লাসে কোথাও নেই৷

‘অজয়, তুই কোথায়? শিগগিরই বেরিয়ে আয়—৷’ বেশ উত্তেজিত হয়ে ডেকে উঠলেন পীতাম্বরবাবু৷

উত্তরে এক অদ্ভুত শব্দ ভেসে এল৷ দু-ঠোঁট মুখের ভেতরে ঢুকিয়ে বাতাস টানলে যে বিচিত্র শব্দ তৈরি হয়, সেরকম শব্দ করে কেউ একটা তাল বাজানোর চেষ্টা করছে৷ স্যারের হুঙ্কারে সে-শব্দ মোটেই থামেনি৷

ততক্ষণে আমাদের অনুসন্ধানী চোখ সেই মিউজিশিয়ানকে খুঁজে পেয়েছে৷ সে আর কেউ নয়—আমাদের অজয়৷

একটা জানলার বাইরে কার্নিশে অজয় চিত হয়ে শুয়ে রয়েছে৷ দু-হাঁটু ভাঁজ করা৷ মুখে ওই পিকিউলিয়ার শব্দ করছে, আর হাত দিয়ে নিজের দু-হাঁটুতে তাল ঠুকছে৷

আমরা সবাই মজা পেয়ে হেসে উঠেছিলাম, কিন্তু স্যার ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন৷ কারণ, ওই কার্নিশ থেকে অজয় যদি অসাবধানে পড়ে যায়!

এক অদ্ভুত স্নেহমাখা গলায় পীতাম্বরবাবু ডেকে উঠেছিলেন, ‘বাবা অজয়, আয় বাবা, ক্লাসের ভেতরে চলে আয়৷ অ্যাই, তোরা কয়েকজন ওকে হেলপ কর৷ সাবধানে ধরে ওকে ক্লাসের ভেতরে নামা…৷’

আমরা কয়েকজন অজয়কে হেলপ করার জন্যে উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই অজয় জানলা দিয়ে ঢুকে এল, এক লাফে নেমে পড়ল ক্লাসরুমে৷

আমরা সবাই চুপ৷ মনে একটা কী হয়, কী হয় ভাব৷ লক্ষ করলাম, পীতাম্বরবাবু এবার পালটে গেছেন৷ একটু আগের আশঙ্কা, স্নেহ এখন উধাও৷ তার বদলে তিনি ঠান্ডা চোখে অজয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন৷ এমন ঠান্ডা সেই দৃষ্টি যে, ওঁর চোখের পাতাও পড়ছে না৷

স্যার যেন হিসহিস করে অজয়কে কাছে ডাকলেন, ‘আয়, এদিকে আয়…৷’ তারপর ফার্স্ট বেঞ্চে স্যারের কাছাকাছি বসা অশোক নামের এক সহপাঠীকে বললেন, ‘অশোক, তোর স্কেলটা দে তো৷’

অশোক বরাবরই স্যারদের প্রতি অনুগত প্রাণ৷ ও সঙ্গে-সঙ্গে নিজের স্কেল বাড়িয়ে দিল স্যারের দিকে! সে-আমলের কাঠের স্কেল—এক ফুট লম্বা৷

পীতাম্বরবাবু অস্বাভাবিকরকম রেগে গেলে তবেই শারীরিক আক্রমণের পথে যেতেন৷ এবং সেইসব আক্রমণে ওঁর বরাবরের হাতিয়ার ছিল স্কেল৷

অজয় পায়ে-পায়ে স্যারের কাছে এগিয়ে গেল৷ ক্লাসরুম থমথম করছে৷ কারও মুখে কোনও কথা নেই৷

‘জানলার বাইরে ওই কার্নিশে গিয়ে উঠেছিলিস কেন?’ স্যার কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে বাতাসে স্কেল নাড়ছিলেন৷

‘কার্নিশে গিয়ে তো উঠিনি, স্যার৷ জানলার বাইরে ওই যে শিমুল গাছটা রয়েছে, ওটা বেয়ে পার্কে নেমে গিয়েছিলাম…৷’

এই পর্যন্ত শোনামাত্রই বাতাসে স্কেল নাড়ার ব্যাপারটা থেমে গেল৷ দেখলাম, স্যার গোল-গোল চোখ করে অজয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন৷ অজয় তখনও ওর অ্যাডভেঞ্চারের কৈফিয়ত দিয়ে চলেছে৷

‘পার্কে স্যার, একটা কাঠগোলাপ গাছ আছে৷ তাতে অনেক ফুল৷ আর কী সুন্দর গন্ধ!’ এ-কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে পকেট থেকে রুমালের একটা পোঁটলা বের করে ফেলেছে অজয়৷ রুমালের ঢাকনা সরাতেই প্রকাশিত হল একরাশ কাঠগোলাপ ফুল৷ তাদের অসংখ্য সাদা পাপড়ি৷ আর অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ৷

স্যারের দিকে ফুলের আঁজলা বাড়িয়ে অজয় বলল, ‘আপনি এগুলো নিন, স্যার—খুব সুন্দর ফুল…৷’

পীতাম্বরবাবু পলকে আবার পালটে গেলেন৷ অশোকের স্কেল টেবিলে রেখে অজয়ের হাত থেকে ফুলগুলো নিলেন৷ সেগুলো টেবিলে রেখে অজয়ের চুল ঘেঁটে দিয়ে বললেন, ‘এত সুন্দর প্রাইজ কেউ কখনও আমায় দেয়নি রে! কিন্তু তাই বলে এত বড় রিসক কেউ নেয়৷ যদি পড়ে-টড়ে যেতি! যা, ডেস্কে গিয়ে বোস…৷’

সেদিন থেকেই অজয়কে আমি মনে-মনে ‘হিরো’ বলে মেনে নিয়েছিলাম৷

অজয় ফুটবল খেলতে ভালোবাসত—আর সেটা খেলতও বেশ৷ ওর গাঁট্টাগোঁট্টা শরীরে বয়েসের তুলনায় শক্তি অনেকটাই বেশি ছিল৷ ফুল ব্যাক পজিশানে খেলে সেই শক্তি ও দিব্যি কাজে লাগাত৷

আমাদের স্কুলের ভেতরে সিমেন্ট বাঁধানো উঠোন ছিল৷ উঠোনটার চেহারা ছিল ইংরেজি ‘L’ অক্ষরের মতো৷ আমাদের টিফিনের জন্যে বরাদ্দ সময় ছিল মাত্র কুড়ি মিনিট৷ টিফিন খাওয়ার পর যেটুকু সময় হাতে থাকত সেই সময়টা আমরা অনেকেই একটা ইটের টুকরোকে ‘ফুটবল’ বানিয়ে সেই বাঁধানো উঠোনে দিব্যি ফুটবল খেলতাম৷ আমাদের পায়ে থাকত কালো রঙের চামড়ার বুটজুতো—যেটা স্কুল ড্রেসেরই অঙ্গ৷ ফলে ওই বিচিত্র ‘ফুটবল’ খেলার সময় পায়ে চোট পাওয়ার তেমন ভয় ছিল না৷

ওই ‘ফুটবল’ খেলার সময়েই আমি অজয়ের বাড়তি শক্তির ব্যাপারটা বেশ টের পেয়েছিলাম৷

অজয়কে নিয়ে দ্বিতীয় যে-ঘটনাটার কথা মনে পড়ছে সেটা হয়েছিল ইতিহাসের স্যার রমাপদবাবুর ক্লাসে৷

রমাপদবাবু ভীষণ রোগা ছিলেন৷ হাত-পাগুলো ছিল দড়ি পাকানো৷ নাকটা ঈগল পাখির মতো৷ গাল ভাঙা৷ সবসময়েই বিরক্তিতে যেন কপাল কুঁচকে আছেন৷

ওঁর চোখে চশমা ছিল৷ ধুতির খুঁট দিয়ে সেই চশমার কাচ পরিষ্কার করাটা ওঁর একরকম মুদ্রাদোষ ছিল বলা যায়৷

আমরা স্যারের ডাকনাম দিয়েছিলাম ‘কঞ্চি’৷ সেই নামটা আমরা শুধু নিজেদের মধ্যেই ব্যবহার করতাম৷

আর স্যার আমাদের সব্বাইকে একটাই নামে ডাকতেন: ‘বাঁদর৷’ শুধু মাঝে-মাঝে ওঁর পছন্দসই কোনও বিশেষণ ওই ‘বাঁদর’ শব্দটার আগে বসিয়ে দিতেন৷ যেমন, আমাদের চেহারার সাইজ দেখে রমাপদবাবু কাউকে বলতেন ‘বড় বাঁদর’, কাউকে বলতেন ‘মিডিয়াম বাঁদর’৷ আবার কাউকে বলতেন ‘ছোট বাঁদর’৷ তবে অজয়ের জন্যে স্যারের স্পেশাল ডাক ছিল ‘লঙ্কা বাঁদর’৷ এই নামের যে কী তাৎপর্য তা আমরা কখনও বুঝতে পারিনি৷

রমাপদবাবু সবসময় বলতেন, ‘শোন, প্রত্যেকটা মোমেন্টে আমাদের বয়েস বাড়ে৷ বয়েস বাড়ে, আর ইতিহাস তৈরি হয়—বুঝলি? এই যে চল্লিশ মিনিট ধরে তোরা আমার ক্লাস করলি, তোদের সবার বয়েস ফর্টি মিনিটস করে বেড়ে গেল, আর হিস্ট্রি তৈরি হয়ে গেল৷ ইতিহাস এত চুপিচুপি তৈরি হয় যে, খেয়াল না করলে টের পাওয়া যায় না৷’

এই ধরনের কথাবার্তা রমাপদবাবুর ফেভারিট ছিল৷ সুযোগ পেলেই সেগুলো একদফা করে আউড়ে নিতেন৷ সবসময়েই বোঝাতে চাইতেন যে, বিষয় হিসেবে ইতিহাস কী সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ৷

একদিন রমাপদবাবুর ক্লাস চলছিল৷ ক্লাসের মাঝামাঝি সময়ে ফোর্থ বেঞ্চ থেকে অজয় হাত তুলল: ‘স্যার, একটু বাইরে যাব?’

‘কেন রে, লঙ্কা বাঁদর? কী এমন জরুরি কাজ পড়ল যে বাইরে যাবি?’

উত্তরে অজয় ওর বাঁ-হাতের কড়ে আঙুলটা উঁচিয়ে দেখাল: ‘ছোট বাইরে যাব, স্যার—৷’ নরম সুরে অজয়ের আবেদন শোনা গেল৷

‘যা, যা—চটপট সেরে আয়৷’

স্যারের অনুমতি পাওয়ামাত্রই অজয় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে এবং ক্লাসরুমের দরজার দিকে চটপটে পায়ে রওনা দিয়েছে৷

ব্যাপারটা সাদামাঠা ‘ছোট বাইরে’-র কেস বলেই আমরা সবাই ধরে নিয়েছিলাম৷ কিন্তু বহু মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পরেও অজয় ফিরছে না দেখে আমরা কেউ-কেউ প্রমাদ গুনলাম৷

সাধারণত ‘ছোট বাইরে’-র অপারেশানে বড়জোর তিন কি চার মিনিট লাগে৷ কিন্তু অজয় তো দেখছি প্রায় বিশ মিনিট পার করে দিয়েছে!

রমাপদবাবু পড়ানোর ফাঁকে-ফাঁকে বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছিলেন৷ দেখছিলেন, অজয় ফিরল কি না৷

হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে ক্লাসের দরজায় অজয় এসে হাজির৷

‘স্যার, আসব?’

স্যার অজয়ের দিকে তাকালেন৷ আমরাও৷

আমরা সবাই একসঙ্গে অবাক হয়ে গেলাম৷ কারণ, অজয়ের মাথা ভরতি পাকাচুল!

‘ক-কী-কী রে? তোর মাথার এ কী অবস্থা হয়েছে?’

অজয় বলল, ‘স্যার, আমার বয়েস বেড়ে গেছে৷’

আমরা সবাই হো-হো করে হেসে উঠলাম৷

স্যার আমাদের দিকে ফিরে ‘চোপ!’ বলে ধমক দিয়ে অজয়কে আবার জিগ্যেস করলেন, ‘বাথরুমে গিয়ে এতক্ষণ ধরে কী করছিলি, হতভাগা?’

‘চুপিচুপি ইতিহাস তৈরি করছিলাম, স্যার৷’ অজয়ের নিষ্পাপ উত্তর৷

এরপর যে-হাসির রোল উঠেছিল, স্যারের মালটিপল ধমকও তাকে থামাতে পারল না৷

উত্তেজিত রমাপদবাবু চেয়ার ছেড়ে তিরবেগে ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন অজয়ের ওপরে৷ ওর চুলের মুঠি ধরে গালে একটা থাপ্পড় কষালেন৷

হয়তো স্যার আরও কিছু করতেন, কিন্তু তার আগেই পিরিয়ড শেষের ঘণ্টা পড়ে গেল৷ এবং অজয়ও বেঁচে গেল৷

স্যার চলে যেতেই অজয়কে আমরা অনেকে চেপে ধরেছিলাম: ‘বল, কী করে তোর চুল পাকালি?’

অজয় হেসে বলল, ‘আটা দিয়ে৷ বাড়ি থেকে খানিকটা আটা ঠোঙায় করে নিয়ে এসেছিলাম৷ বাথরুমে গিয়ে সেই আটা মাথায় বুলিয়ে নিয়েছিলাম৷ দেশের বাড়িতে দেখেছি, যাত্রাপালায় মাথায় আটা বুলিয়ে মেকাপ নিচ্ছে, চুল পাকাচ্ছে—৷’

আমরা সবাই আলোচনা করতে লাগলাম, অজয় রমাপদবাবুকে রীতিমতো ‘ঐতিহাসিক’ ধাক্কা দিয়েছে৷

বন্ধুদের কার কাছে যেন শুনেছিলাম, অজয়দের একটা ছোট্ট মনিহারি দোকান আছে—কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের (এখন যার নাম বিধান সরণি) ট্রামরাস্তার ওপরে৷ নাম ‘দাদুভাই স্টোর্স’৷ অজয়ের বাবা দোকান চালান৷ আর অজয় নাকি স্কুল ছুটির পর সন্ধেবেলা দু-ঘণ্টা করে দোকানে বসে, বাবাকে একটু বিশ্রাম দেয়৷

আমি হাতিবাগান থেকে রোজ স্কুলে যাতায়াত করতাম—ওই কর্নওয়ালিস স্ট্রিট ধরে৷ যাতায়াতের পথে ট্রাম কিংবা বাস থেকে গলা বাড়িয়ে অজয়দের দোকানটাকে খুঁজতাম৷

দেখতে-দেখতে একদিন খুঁজেও পেলাম৷ ছোট্ট মলিন দোকান৷ রংচটা সাইনবোর্ড৷ দোকানে ধুতি আর ফতুয়া পরে একজন রোগামতন বয়স্ক মানুষ বসে আছেন৷ গাল বসা, মাথায় টাক৷ খোঁচা-খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি-গোঁফ৷ অজয়ের বাবা৷

দোকানটাকে খুঁজে পাওয়ার পর থেকেই স্কুলে যাতায়াতের পথে আমার চোখ আমার অজান্তে ‘দাদুভাই স্টোর্স’-কে খুঁজে বেড়াত৷ এবং পেয়েও যেত৷

ক্লাস এইটে ওঠার পরেও অজয়ের সঙ্গে একই সেকশানে পড়ার ‘সৌভাগ্য’ আমার হয়েছিল৷ সেই ক্লাসে অজয় এমন এক কীর্তি ঘটিয়ে বসেছিল যেটা আমি আজও ভুলতে পারিনি৷

ব্যাপারটা হয়েছিল হরিনাথবাবুর ক্লাসে৷

এখানে হরিনাথবাবু সম্পর্কে দু-চারটে কথা বলা দরকার৷

তিনি আমাদের অ্যাডিশন্যাল ইংলিশ পড়াতেন৷ অর্থাৎ, প্রথাগত ইংরেজি ক্লাসে যে-টেক্সট বই বা গ্রামার পড়ানো হত, ওঁর পড়ানোর এলাকা ছিল তার বাইরে৷ ফলে হরিনাথবাবুর ক্লাসে আমরা নতুন-নতুন ইংরেজি শব্দ আর সেসব শব্দ দিয়ে মজার-মজার বাক্যরচনা, কিংবা শব্দের জাগলারি শিখতাম৷

যেমন, তিনি ক্লাসে প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন, ‘বল—, How can you make a mile smile?’

আমরা উত্তর না দিয়ে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম৷

পাঁচ কি দশ সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর স্যার হেসে বলতেন, ‘এই সহজ প্রশ্নটার উত্তর কেউ দিতে পারলি না? The letter ”s” makes a mile smile, বুঝলি?’

হরিনাথবাবু মাঝবয়েসি মানুষ৷ চোখে গোল-গোল কাচের চশমা৷ মাথায় কদমছাঁট চুল৷ উচ্চতায় খুব খাটো ছিলেন৷ সবসময় ধুতি আর পাঞ্জাবি পরতেন৷ আর হাঁটতেন আরশোলার মতো তাড়াতাড়ি৷ স্কুলের লম্বা বারান্দা ধরে ওঁর হেঁটে যাওয়া দেখলে আমরা হাসি চেপে রাখতে পারতাম না৷ শুধুমাত্র হাঁটার ঢঙের জন্যেই আমরা স্যারের গোপন ডাকনাম রেখেছিলাম ‘ককরোচ’৷

হরিনাথবাবুর মধ্যে একটা কমিক-কমিক ব্যাপার ছিল৷ তা ছাড়া ওঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে আমাদের নিজেদের মধ্যে নানান তর্ক-বিতর্ক চলত৷ এর কারণ ছিল আমাদের বাৎসরিক স্কুল ম্যাগাজিন৷

আমাদের স্কুল ম্যাগাজিনে হেডস্যার থেকে শুরু করে সব টিচারের নাম ছাপা হত৷ আর সেই নামের পাশে-পাশে ছাপা হত স্যারদের সব অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি৷ সেই ম্যাগাজিনেই আমরা দেখেছিলাম, আমাদের অঙ্ক স্যারের এম. এ. ডিগ্রি—যা বহুকাল হল দেখা যায় না৷ আমাদের বাংলা স্যার পীতাম্বরবাবুর নামের পাশে ডবল এম. এ. ডিগ্রি ছিল—একটা বাংলায়, আর অন্যটা সংস্কৃতে৷ সেই ডবল এম. এ. ডিগ্রিও অনেক বছর হল উধাও৷

তো নানান স্যারের নানান ডিগ্রির মধ্যে হরিনাথবাবুর নামটা আমাদের চোখে কটকট করত, কারণ স্যারের নামের পাশে কোনও ডিগ্রিই লেখা থাকত না৷ ব্যাপারটা আমাদের ভারী অদ্ভুত লাগত৷ তাই স্যার আসলে যে ঠিক কী পাশ, কতটুকু পাশ, এসব নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম৷ এসব আলোচনা যে অশোভন এবং অন্যায় সেটা ওই ছোট বয়েসে আমরা বুঝতে পারিনি৷ তবে স্কুল কর্তৃপক্ষও স্কুল ম্যাগাজিনে স্যারদের নামের পাশে-পাশে তাঁদের অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি ছাপার প্রথাটা না রাখলেই পারতেন৷ ছাত্রদের কাছে স্যারদের শুধু নামই কি যথেষ্ট নয়!

সে যা-ই হোক, হরিনাথবাবু একদিন অজয়ের দুষ্টুমির শিকার হলেন৷

স্যার ক্লাসে হাসি-হাসি মুখ করে আমাদের ইংরেজি শেখাচ্ছিলেন—অ্যাডিশনাল ইংলিশ৷ যেটাকে আমরা কখনও-কখনও বলতাম ‘বাড়তি’ ইংরেজি৷

যেমন, স্যার প্রশ্ন করতেন, How a lot goes through a slot?

আমরা উত্তর দিতে পারি বা না পারি, স্যার একটু পরেই হেসে বলতেন, ‘The letter ”s” makes a lot go through a slot,’—বুঝলি?’

এরকমই আর-একটা প্রশ্ন ছিল, ‘What makes a road broad?’

এভাবেই আমরা হরিনাথবাবুর কাছে ‘বাড়তি’ ইংরেজি শিখতাম৷

একদিন ক্লাস চলার সময় অজয় হাত তুলে স্যারের কাছে বাথরুমে যাওয়ার পারমিশান চাইল৷

কোনও স্যারের ক্লাসের মাঝে অজয় বাথরুমে যাওয়ার পারমিশান চাইলেই আমরা নতুন কোনও দুষ্টুমি দেখার প্রত্যাশায় থাকতাম৷

হরিনাথবাবু অজয়কে জিগ্যেস করলেন, ‘বিগ অর স্মল?’

অজয় বলল, ‘লিকুইড, স্যার—৷’

অজয়ের মুখে ‘লিকুইড’ শুনে আমরা সবাই তো হেসে খুন৷ কিন্তু হরিনাথবাবু কী এক আশ্চর্য ক্ষমতায় নিজের গাম্ভীর্য ধরে রাখলেন৷ তিনি তাড়াতাড়ি অজয়কে অনুমতি দিয়ে ব্যাপারটার নিষ্পত্তি করলেন৷

‘যা, তবে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি—৷’

অজয় মুখে কোনও কথা না বলে প্রায় চল্লিশ ডিগ্রি ঘাড় হেলিয়ে দিল এবং চটপট পা চালিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল৷

কিন্তু ও ফিরে এল এক মিনিটের মধ্যেই৷

‘মে আই কাম ইন, স্যার?’

গলাটা অজয়ের, কিন্তু মানুষটা কে?

মোটা লোমশ ভুরু৷ চোখে এক অদ্ভুত চশমা৷ চশমার দুটো সার্কেলের মাঝে বিশাল মাপের খাড়া গোলাপি নাক৷ সেই নাকের নীচে পাকানো মোচ৷

কে এই লোকটা?

আসলে ব্যাপারটা হল, সেই সময়ে প্লাস্টিকের এই খেলনাটা কিনতে পাওয়া যেত৷ ভুরু, চশমা, নাক এবং ওই পেল্লায় মোচ একইসঙ্গে আটকানো—অনেকটা একটা মুখোশের মতো৷ তবে সেই চশমায় কাচ অথবা প্লাস্টিকের কোনও লেন্স থাকত না৷

বাথরুমে যাওয়ার নাম করে অজয় বাইরে গিয়ে নিজের চশমাটা পকেটে পুরে তার বদলে ভুরু-চশমা-নাক-মোচের এই অদ্ভুত মুখোশটি পরে নিয়েছে৷ তারপর কেউকেটা এক অচেনা আগন্তুক সেজে হরিনাথ স্যারের ক্লাসে ফিরে এসেছে৷

হরিনাথবাবু একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার করে অজয়কে লক্ষ্য করে লাফ দিলেন৷ এবং দরজার প্রায় কাছাকাছি গিয়ে ল্যান্ড করলেন৷ একইসঙ্গে স্যারের মুখ দিয়ে দুটো গালাগাল বেরিয়ে এল৷ প্রথম গালাগালটা খুবই সাধারণ মানের৷ একটি মাত্র শব্দে তৈরি৷ দু-অক্ষরের শব্দ—যার শেষ অক্ষরটি ‘লা’৷

আর দ্বিতীয় গালাগালটি কিঞ্চিৎ উন্নত মানের৷ দুটি শব্দে তৈরি—যার সাহায্যে কোনও ব্যক্তিকে একটি বিশেষ পশুর সন্তান হিসেবে সম্বোধন করা হয়৷

হরিনাথ স্যারের মুখে আচমকা এইরকম একজোড়া অশিষ্ট সম্বোধন শুনে আমরা যেমন আঁতকে উঠেছি, তেমনই—অন্যায়ভাবে—অদ্ভুত একটু মজাও পেয়েছি৷

কিন্তু স্যার ওকে ধরে ফেলার আগেই অজয় দে ছুট৷ আর কী আশ্চর্য, স্যারও ওকে তাড়া করলেন!

ক্লাসরুমের করিডরের দিকের জানলা দিয়ে আমরা কেউ-কেউ বডি অর্ধেক ঝুঁকিয়ে দিয়ে সেই রেস দেখতে লাগলাম৷ আর বাকিরা ভিড় জমাল ক্লাসরুমের দরজায়৷

সে এক অদ্ভুত দৃশ্য!

স্কুলের লম্বা-চওড়া করিডর ধরে অজয় তিরবেগে দৌড়চ্ছে৷ আর ওর বেশ খানিকটা পেছনে ছুটে চলেছে ‘ককরোচ’ স্যার৷

একটা ভারী খাতা হাতে উলটোদিক থেকে হেঁটে আসছিল তৃপ্তিদা—আমাদের স্কুলের পিওন৷ তৃপ্তিদা একটু দুলে-দুলে হাঁটত৷ তাই আমরা ওর নাম দিয়েছিলাম ‘দোলনা’৷

স্যার বোধহয় ছুটে-ছুটে হাঁপিয়ে পড়েছিলেন৷ তাই তৃপ্তিদাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ অজয়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘অ্যাই তৃপ্তি,কে এক্ষুনি হেডস্যারের কাছে নিয়ে যা—৷’

চার অক্ষরের এই তৃতীয় গালাগালটি দ্বিতীয়টির তুলনায় আরও কিছুটা উন্নত মানের৷ এবং একইসঙ্গে বেশ ধাক্কা দেওয়ার মতো৷ আমরা তো সে-ধাক্কা খেয়েই ছিলাম, দেখলাম তৃপ্তিদাও ধাক্কা খেয়ে করিডরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে৷

না, অজয়কে ধরা যায়নি৷ ও ততক্ষণে পগার পার৷ হয়তো ছুটে পালিয়ে গিয়ে বারান্দার পাশের কোনও গাছ বেয়ে নীচের উঠোনে নেমে গেছে৷

এই ঘটনার দু-চারদিন পর থেকে হরিনাথ স্যারকে স্কুলে আর দেখিনি৷ কানাঘুষোয় শুনেছিলাম, স্কুলের মধ্যে অশিষ্ট শব্দ ব্যবহারের জন্যে ওঁকে স্কুল ছাড়তে হয়েছে৷

এ-ঘটনায় অজয়েরও মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল৷ কারণ, ও স্যারের সঙ্গে নিছকই একটু মজা করতে চেয়েছিল৷ তার ফল যে এমনটা হবে সেটা ও ভাবতে পারেনি৷

ক্লাস এইটের পর অজয়ের সঙ্গে আর পড়ার সুযোগ পাইনি৷ কারণ, ক্লাস নাইন থেকে ছাত্রদের চারটি শাখায় ভাগ করা হত—সায়েন্স, টেকনিক্যাল, আর্টস ও কমার্স৷ আমি সায়েন্স নিয়ে পড়েছিলাম, অজয় নিশ্চয়ই অন্য কোনও শাখায় পড়াশোনা করেছিল৷ ফলে আমার সঙ্গে ওর দেখা হয়নি৷

কথাটা ভুল বলা হল৷ আমার বলা উচিত, আমি ওকে দেখতে পাইনি৷ কারণ, অজয় আমাদের কাউকেই সেভাবে চিনত না, কিন্তু আমরা সব্বাই ওকে চিনতাম৷ আর আমি বোধহয় মনে-মনে একটু-একটু অজয় হতে চাইতাম৷

স্কুলের পালা শেষ হল আমার৷ হয়তো অজয়েরও৷ তারপর সময়ের স্রোতে পেরিয়ে গেল প্রায় পঞ্চাশ বছর৷ আমি অজয়কে ভুলিনি৷ ভুলিনি ‘দাদুভাই স্টোর্স’ দোকানটিকেও৷ কিন্তু কাজের জগৎ আমাকে কলকাতার অন্যান্য অঞ্চলে এমন ব্যস্ত করে তুলল যে, ‘দাদুভাই স্টোর্স’-এর রাস্তায় কখনও যাওয়া হয়নি৷ যদি বা কখনও গিয়ে থাকি, আমার মন তখন এতই ব্যস্ত ছিল যে, দোকানটা খেয়াল করিনি৷

কিন্তু গতকাল সন্ধেবেলা একটা ব্যাপার হল৷ বাড়ির একটা জরুরি কাজে একজন ল’ইয়ারের চেম্বারে গিয়েছিলাম৷ কথাবার্তা শেষ করে বিধান সরণির ট্রামরাস্তার ধারে বাস ধরব বলে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎই চোখ গেল উলটোদিকের ফুটপাথের একটা ছোট্ট দোকানের দিকে৷ জীর্ণ, মলিন চেহারা৷ তোবড়ানো সাইনবোর্ড৷ দোকানের নামের কয়েকটা অক্ষর মুছে গেলেও ‘ভাই’ এবং ‘স্টো’ অংশ দুটো পড়া যাচ্ছে৷ অজয়দের দোকান!

আমার পা দুটো সঙ্গে-সঙ্গে রাস্তা পার হয়ে গেল৷ আমার দ্বিধা-সঙ্কোচকে পাত্তা না দিয়ে ওরা সটান গিয়ে হাজির হয়ে গেল অজয়ের দোকানের সামনে৷

কিন্তু কোথায় অজয়?

দোকানে বসে আছে আঠেরো-উনিশ বছরের একটি ছেলে৷ রোগা৷ মাজা রং৷ সবে দাড়ি-গোঁফ উঠেছে৷ চোখ দুটো বড়-বড়—যাকে পরিভাষায় আয়ত বলে৷ মাথার চুল খাড়া-খাড়া৷ গায়ে একটা চেক-চেক হাওয়াই শার্ট৷ পায়ে পাজামা৷

দোকানের শো-কেস ময়লা৷ কাচ দু-তিন জায়গায় ফাটা৷ সেইসব ফাটল পিভিসি টেপ দিয়ে তাপ্পি মারা৷

দোকানের শো-কেসের ভেতরে হরেকরকম বলপয়েন্ট পেন, পেনসিল আর রিফিল৷ দু-পাশের তাকে লাট করে রাখা খাতা আর দিস্তে কাগজ৷ দোকানের ডানদিকে সুতোয় বাঁধা অনেকগুলো প্লাস্টিকের বল আর খেলনাপাতি ঝুলছে৷ বোঝাই যাচ্ছে, খাতা, পেন, পেনসিলের পাশাপাশি বাচ্চাদের টুকিটাকি খেলনাও ‘দাদুভাই স্টোর্স’ বিক্রি করে থাকে৷

বাঁ-দিকের তাকগুলোর মাঝে একটা ছোট্ট খাঁজে ঠাকুরের আসন চোখে পড়ল৷ সেখানে খুব সরু-সরু কালো রঙের ধূপকাঠি জ্বলছে৷

দোকানে দাঁড়ানো ছেলেটিকে ভালো করে দেখলাম৷

না, আমার স্মৃতিতে অমলিন অজয়ের মুখের আদলের সঙ্গে ছেলেটির মুখের আদল কিছুতেই মিলছে না৷

তা হলে কি অজয়দের দোকানটার হাতবদল হয়েছে? পঞ্চাশ বছর সময়ের মধ্যে সেটা হতেই পারে৷ একবার কেন, দু-চারবারও হাতবদল হয়ে থাকতে পারে৷ কিন্তু ছেলেটিকে অজয়ের কথা একটিবার অন্তত জিগ্যেস না করে আমি ফিরে যাব না৷

‘ভাই, এটা কি অজয়দের দোকান? অজয়—মানে, আমার সঙ্গে ও স্কুলে পড়ত…৷’

ছেলেটি হেসে বলল, ‘আপনি আমার বাবাকে চেনেন? হ্যাঁ, বাবা ওই স্কুলটাতেই পড়ত—৷’

‘অনেক বছর পর ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি—একবার দেখা করা যাবে?’

ছেলেটি ঘাড় কাত করল: ‘হ্যাঁ—কেন যাবে না? বাবা তো সবসময় বাড়িতেই থাকে…৷’

কথা বলতে-বলতে ছেলেটি কাউন্টারের কাঠের ডালা তুলে দোকানের বাইরে বেরিয়ে এল৷ হাত দুটো ঘষে-ঘষে পাজামায় মুছল৷ পাশেই একটা ছোট টেলারিং-এর দোকান ছিল৷ সেই দোকানের ভেতরে গলা বাড়িয়ে ছেলেটি কাকে যেন বলল, ‘পারভেজদা, আমার দোকানটা একটু দেখো তো৷ আমি এই কাকুকে একটু বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসছি৷ উনি বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন—৷’

টেলারিং-এর দোকানের ভেতর থেকে কারও তীক্ষ্ণ গলা শোনা গেল: ‘ঠিক আছে৷ তবে জলদি-জলদি ব্যাক কোরো—৷’

আমরা রওনা হলাম৷ ছেলেটি আগে, আমি পেছনে৷

বড় রাস্তা ছেড়ে বাঁ-দিকের গলি৷ সেই গলিতে কিছুটা হেঁটে যাওয়ার পরই আবার বাঁ-দিক৷ এবারে আরও সরু একটা গলি৷ সেখানে অনেক পুরোনো-পুরোনো খাটো মাপের সব বাড়ি৷ তারপর কয়েকটা বাড়ির পরেই একটা মলিন বাড়ির ছোট্ট দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল ছেলেটা৷ পেছন ফিরে আমাকে ডাকল, ‘আসুন—৷’

শেষ পর্যন্ত একটা ঘরে এসে পৌঁছোলাম৷

ছোট মাপের ঘর৷ বাতাসে পুরোনো গন্ধ৷ ঘরে একটা খাট, আর দুটো টুল৷ একপাশে একটা টেবিলে বই, খবরের কাগজ আর কয়েকটা জামাকাপড় ডাঁই করা৷ দেওয়ালের কোণে একটা সেলাই-মেশিন৷ দেখেই বোঝা যায়, বহুদিন ওই মেশিনে কেউ হাত দেয়নি৷

ঘরের শেষ আইটেম হল, বিছানায় বসে থাকা একজন বয়স্ক মানুষ৷ খালি গা, পরনে লুঙ্গি, রোগা, গাল বসা, মাথায় টাক৷ খোঁচা-খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি- গোঁফ৷ পাঁচ দশক আগে দূর থেকে যে-মানুষটিকে আমি ‘দাদুভাই স্টোর্স’-এর কাউন্টারে দেখেছিলাম৷

তখনই আমি অজয়কে চিনতে পারলাম৷

ছেলেটি আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘বাবা, ইনি তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন—তোমার স্কুলের বন্ধু…৷’

অজয় আমাকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল৷ বোধহয় পুরোনো ‘আমি’-টাকে খুঁজছিল৷

একটা টুল দেখিয়ে ছেলেটি আমাকে বলল, ‘আপনি বসুন৷ বাবার সঙ্গে কথা বলুন৷ আমি দোকানে যাই—নইলে পারভেজদা আবার খচে যাবে—৷’

এই কথা বলে অজয়ের ছেলে চলে গেল৷

আমি একটা টুল টেনে নিয়ে অজয়ের কাছে বসলাম৷

‘অজয়, কেমন আছ? আমি অনীশ—৷’

অল্প হেসে অজয় বলল, ‘ও—৷’

বুঝলাম, আমাকে ওর একটুও মনে নেই৷ আবার জিগ্যেস করলাম, ‘কেমন আছ তুমি?’

‘চলে যাচ্ছে, ভাই৷ গ্যাসট্রিকের পেইন নিয়ে আছি৷ লাস্ট মাসে হার্নিয়া অপারেশন হয়েছে৷’

মনে হচ্ছিল, আমার চেনা অজয় নয়, তার ছায়ার সঙ্গে আমি কথা বলছি৷

এরপর আমিই কথা বলতে লাগলাম৷ অজয় শুধু ‘হুঁ’, ‘হাঁ’ শব্দ করে ঠেকা দিতে লাগল৷

আমি ওর ছোটবেলার কাহিনি ওকেই শোনাতে লাগলাম৷ সেসব শুনে ও প্রথম-প্রথম ঠোঁটে হাসছিল, অল্প-অল্প মাথা নাড়ছিল৷ কিন্তু একটু পরেই কেমন যেন চুপ মেরে গেল৷

আমি কথা বলতে-বলতে সেই পুরোনো ‘অজয়’কে খুঁজছিলাম৷ কোথায় হারিয়ে গেল আমার সেদিনের সেই হিরো?

সেই ‘হিরো’-কে অজয়ও বোধহয় খুঁজছিল৷

হঠাৎই দেখলাম, ও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল৷ মাথাটা ঝুঁকিয়ে দিল বুকের কাছে৷ ওর পলকা শরীরটা ফুলে-ফুলে উঠতে লাগল৷

আমারও কেমন একটা কষ্ট হচ্ছিল, তাই টুল ছেড়ে উঠে পড়লাম৷ চুপচাপ বেরিয়ে এলাম ওর ঘর থেকে৷

বুঝতে পারছিলাম, আজকের ‘অজয়’ সেদিনের সেই ‘অজয়’কে সবসময় খুঁজে চলেছে৷ খুব মিস করছে সেই দুষ্টু ছেলেটাকে৷

আসলে আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে দুজন করে মানুষ থাকে৷ তারা বিশাল সময়ের দূরত্বে দাঁড়িয়েও হাতধরাধরি করে চলতে চায়৷ একে অপরকে মিস করে৷

কিন্তু ‘অজয়’-কে তো আমরা হারাতে চাই না!

আমি চাই, আমরা যারা-যারা ‘অজয়’ হতে পারিনি তাদের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ‘অজয়’-রা চিরকাল বেঁচে থাকুক৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *