Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » এক মহিলার ছবি || Syed Shamsul Haque

এক মহিলার ছবি || Syed Shamsul Haque

নাসিমা ভাবলো

নাসিমা ভাবলো, এখন নাইতে পারলে অনেকটা সুস্থ অনেকটা হালকা বোধ করতে পারত সে। যখনি সে গেছে যেখানে, নাইবার সুবিধে না থাকলে টিকতে পারেনি এক মুহূর্ত। পালিয়ে এসেছে। পালিয়ে এসেছে সারাটা গায়ে অদৃশ্য কাদার, থুতুর আলপনা নিয়ে। পালানো, শুধু পালানো। এক শহর থেকে অন্য শহরে, এক মানুষ থেকে অন্য মানুষ, তৃষ্ণায়। শুধু তৃষ্ণায়।

থুতু আর থুতু। গান নেই, প্রীতি নেই। কাদা আর কাদা।

আরজু ঢাকায় থাকলে তাকে সে কপালে চুমো খেত তার এই বাসার জন্যে, যেখানে তুমি নাইতে পারো ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাত পা প্রচুর এলিয়ে, কুয়াশা কাঁচের ভেতর দিয়ে আসা। দুধ–রোদে সারাটা শরীর ডুবিয়ে–ঠাণ্ডায়, আরো ঠাণ্ডায়।

কিন্তু ঘণ্টা দুয়েকও হয়নি সে দিনের দ্বিতীয় অবগাহন সেরে ফিরেছে। তাছাড়া সময়টাও শীতের মাঝামাঝি। তাই তৃতীয়বার তাকে এই লোভনীয় শীতলতা টানলেও নাসিমা দ্বিধা করলো। তবু নাসিমা আবার নাইতে গেল। ফিরল যখন, তখন টেবিল ঘড়িতে পাঁচটা বেজে গেছে।

নতুন করে আবার প্রসাধন করতে বসলো সে।

আরজুর রুচি আছে, আছে রুচি মেটানের জন্যে উদার স্বামী। ইউনিভার্সিটির ক্লাশ পড়ানো ছাড়াও যার আরেকটা কাজ আরজুকে ভালোবাসা।

আচমকা গলায় হাত থেকে পাউডারের তুলিটা কেঁপে গেল।

মতির মা দরোজার কাছে উঁকি দিয়ে বলছে, চা দেব?

প্রশ্নটা আবার করে মতির মা। কোরে, মিষ্টি মিষ্টি হাসে। এ হাসিr অর্থ প্রথম দিনেই জানা হয়ে গেছে নাসিমার। বলতে চায় কৌতুকে—-আবার নেয়েছ তুমি?

নাসিমা আখতার, ডুব দাও আরো অতলে।

আজ আটদিন হলো ঢাকায় আরজুদের এখানে সে উঠে এসেছে। আর সে পৌঁছুবার ঠিক পরদিনই কক্সবাজার চলে গেছে আরজু, তার স্বামী আর বাচ্চা মেয়েটা। নাসিমা এসেছিল হঠাৎ কোনো খবর না দিয়ে, তাই আরজুদের বেরুনোর তারিখ বদলানো সম্ভব হয়নি। আরজু বলেছিল, তুই থাক, আমরা দিন দশেকের বেশি থাকব না। তারপর গল্প করা যাবে, কী বলিস? তুইতো আমাদের এমন ভুলে গেছিস যে তিন বছরে একটা খবরও নিসনি। না, না, তুই যেতে পারবিনে। ঢাকায় এসেছিস, আমার এখানেই থাকবি। আগে জানলে আমরা না হয় দুদিন পরেই যেতাম। উনি সব টিকিট-ফিকিট কিনে ফেলেছেন। একলা থাকতে পারবি না?

আরজুও জানে, নাসিমাকে প্রশ্নটা করা শুধু কিছু একটা বলার জন্যেই। একাকীত্ব যার জন্ম-সহোদর এ প্রশ্ন তার কাছে অর্থহীন। তবু সে বলেছে, পারব। কেন পারব না?

বরং এতে খুশিই হয়েছিল নাসিমা। এই ভালো হলো! সারাটা বাড়িতে একটা সাজানো সংসারে সে একা থাকবে—-হোক মাত্র কয়েকদিনের জন্য—-এই ভালো হলো, এই মুক্তিই সে তার ঈশ্বরের কাছে চেয়েছিল আজ– করাচি থেকে তার প্লেন যখন লাফিয়ে উঠেছিল আকাশে, সেই তখন থেকে। সমস্ত বাড়িঘর পৃথিবী আর ঘাস পায়ের তলায় বিলীন হয়ে যেতে যেতে তাকে যেন পাঠিয়ে দিচ্ছিল এমনি একটা পরিবেশে, যেখানে কেউ তাকে জানবে না, যেখানে যারা চেনা তারাও যাবে চলে, যেখানে তাকে একটা একটা করে সমস্ত কিছু ক্লান্ত দুচোখ দিয়ে আবিষ্কার করে নিতে হবে।

নাসিমা তখন চোখ ভরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আরজুর সারাটা সংসার দেখার প্রেরণা অনুভব করেছিল। যে দ্রুত আকাশযান তাকে নিয়ে এসেছে এই দীর্ঘপথ ঠিক তারই মত অনায়াস একটা ধাতবগতি সঞ্চারিত হলো তার অনুভূতিতে সে অনুভূতি চলেছে দ্রুত কিন্তু তার প্রেক্ষিত অপসারিত হচ্ছে মেঘমন্থর রীতিতে। ডুব দাও অতলে, আরো অতলে।

.

এরোপ্লেন আকাশপথে তার দিশারী নীলরেখায় পড়বার সঙ্গে সঙ্গে সিটবেল্টা খুলে ফেলল নাসিমা আখতার। অদ্ভুত একটা শিরশির সুরভি জড়ানো ঠাণ্ডা হাওয়া সারাটা প্লেনের গহ্বর আচ্ছন্ন করে আছে। আর একটানা একটা ধ্বনি, নাসিমার হৃদস্পন্দনের মত ধুকধুক, নিয়মিত, দায়িত্বশীল।

নাসিমার পাশের সিটে বসেছে বছর এগারোর একটা ছেলে। মাথায় বাদামি রঙ চুলের দুষ্টুমি ছেলেটার রক্ত উজ্জ্বল সারাটা মুখের সঙ্গে প্রীতিময় হয়ে আছে। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, চোখ ফিরিয়ে নেয়া যায় না। এয়ারপোর্টে ছেলেটাকে তুলে দিতে এসেছিল বোধ হয় কোন নিকট আত্মীয়। অনর্গল কথা বলছিল ছেলেটা তার সঙ্গে। সেই তখনই নাসিমার চোখে পড়েছিল। এখন বসেছে ঠিক তার পাশে। আত্মীয়টি তাকে টফি কিনে দিচ্ছিল আর মাথায় আঙ্গুল দিয়ে ব্রাশ করছিল তার। নসিমা একটা মোচড় অনুভব করছিল তার বুকের ভেতর। ছেলেটার দ্রুত দুহাতে ছিঁড়ে ফেলা টফির সিলোফেনের মত তার হৃদয়ের পর্দাগুলো যেন কোথাও একটা অদৃশ্য হাতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছিল।

প্লেনে ওঠবার যখন সময় হলো তখন, না তখন নয় তার কিছু আগেই, ছেলেটা কেমন নিভে গেল। আত্মীয়টি আধে: উবু হয়ে তার কানের কাছে মুখ রেখে বলল, ডোন্ট ক্রাই বব, ইউ আর গোয়িং টু ইওর ড্যাড—- উওর নিউ মম–ইওর ফাদারস বিগ ব্রাদারস গার্ল—-দে আর ওয়েটিং ফর ইউ। ডোন্ট ক্রাই, ডোন্ট ক্রাই।

ছেলেটার চোখে আঙটির পাথরের মত অশ্রু টলটল করছে।

নাউ বি এ ব্রেভ বয়। সে গুডবাই। নাউ–ডোন্ট লুক ব্যাক–গো অন।

ভিড়ের ভেতরে ডুবে যেতে যেতে নাসিমাব মনে হলো, ছেলেটা কি পেছনে তাকিয়েছিল? কিন্তু ফিরে সে দেখল না। ডোন্ট লুক ব্যাক। নাসিমা প্লেনের গহ্বরে চলে যেতে যেতে একবারও তাকায়নি পেছনে। আমরা কেউ কখনো তাকাই না অতীতের অন্ধকারের দিকে। কিন্তু অতীত তার দুই গভীর চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে আমাদের চলমান মিছিলের দিকে। বিন্দু বিন্দু ঘাম নাসিমার কপালে একসার ফৌজের মত স্থির হয়ে থাকে। প্লেন তখন টেক অফ করছে। সারা শরীরে হঠাৎ একটা শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাসিমা মুহূর্তের জন্য নিজেকে যেন ফিরে পেল। মনে হলো, এমন একটা শূন্যতার বিনিময়ে সে আজ তার সমস্ত দুয়ার খুলে দিতে পারে। এই অতল শূন্যতা দিয়ে বাহিত হয়ে যাওয়া অনেক ভালো, মাটিতে দাঁড়িয়ে তৃষ্ণার তীরে রক্তাক্ত হওয়ার বদলে।

নাসিমা আখতার আবিষ্কার করে এই বিরাট ধাতব পাখির প্রাণ–যন্ত্রের সঙ্গে তার হৃদস্পন্দন এখন এক, অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেছে। এ এক অদ্ভুত আত্মীয়তা, এর কোনো ইতিহাস নেই, আজই যেন প্রথম প্রতিষ্ঠিত হলো এই আত্মীয়তার সূত্র। চলছে, এগিয়ে চলছে। হ্রদে ঢেউয়ের মত চলছে তারা। সমস্ত যান জুড়ে কাঁপছে একটা মৃদু তরঙ্গ। আর তেমনি তরঙ্গ কাঁপন তুলছে আমার চেতনায়। এখন, এই মুহূর্তে, যদি সে থেমে যায় তাহলে নির্বাপিত হবো আমিও। আমি বিশ্বাস দিয়েছি এই আকাশযানকে।

কিন্তু দিয়েছে কি সবাই? প্রতিটি যাত্রী? সুখী মসৃণ মানুষের ভিড়। নাসিমা দৃষ্টি করে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি, যেখানে মুঠোর মত প্যাসেজটা সরু হয়ে এসেছে।

নাসিমার মনে হলো একপাল ভিন্ জাতের প্রাণীদের ভেতরে কেউ তাকে জোর করে পুরে দিয়ে দরোজা দিয়েছে সেঁটে।

একমাত্র পাশের ছেলেটা কী সূত্রে তার মনের কাছে আপন হয়ে উঠেছে তা সে নিজেই জানে না। ছেলেটা তখন জানালা দিয়ে অপসৃয়মাণ নিচের পৃথিবীকে তাকিয়ে দেখছে টফি খেতে খেতে। নাসিমার মনে হলো পৃথিবীর সুন্দরতম একটা ড্রয়িং ঈশ্বর ধরে রেখেছেন। পাশ দিয়ে হোস্টোস যাচ্ছিল। নাসিমা তাকে ডাকলো। পলকে সুন্দর মুখখানা ফিরিয়ে স্বচ্ছ গলায় শুধালো একটু ঝুঁকে পড়ে, ইয়েস মাদাম। নিড এনি হেল্প।

নাসিমা তাকে আদৌ ডেকেছিল কি? আর যদি ডেকেই থাকে, তাহলে হয়ত সে শুধোতে চেয়েছিল, সে ভাবলো—-যদি প্লেনটা হঠাৎ জ্বলে ওঠে, আগুন ধরে যায়, তাহলে তাহলে কী হবে হোস্টেস?

তাহলে তুমি মুক্তি পেয়ে যাবে এই অসীম মনে রাখার দায় থেকে, আর পাথরের মত এক মুহূর্তে জমে কঠিন হয়ে যাবে রক্তঝরার অদৃশ্য সেই উৎস।

মনের ভাবনাটা কখন কথা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে নাসিমা বুঝতে পারেনি। বিস্ফারিত চোখে সে শুধু দেখল, সে হোস্টেসের দুই বাহুমূল শক্ত মুঠোয় ধরে আছে। আর সেই সবুজবসনা নত হয়ে আস্তে আস্তে তার পায়ের কাছে বসে শুধোচ্ছে, ডিড ইউ সে সামথিং মাদাম?

নো নো আই হ্যাভন।

নাসিমার ঠোঁট কাঁপতে থাকে। একটু পরে বলে, আই নিড স্লিপিং ট্যাবলেটস—-দ্যাটস অল। ক্যান ইউ গেট মি সাম?

ইয়েস, অফকোর্স।

পায়ের তলায় পৃথিবীর একশো আশি ডিগ্রী ব্যাপ্তি কেবলি পেছনে সরে যাচ্ছে। আর আমার ফুসফুঁসে যন্ত্রের বানানো বাতাস। ধাতব পাখির যে অবিরাম গর্জন ছিল যাত্রার শুরু থেকে তার সহচর, একটু আগে তা কোন জাদু বলে যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। হোস্টেস চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই গর্জনটা যেন দ্বিগুণ হয়ে চিতাবাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল নাসিমার শ্রুতিতে।

পাশ থেকে ছেলেটা হঠাৎ শুধালো বাদামি চোখ চঞ্চল করে, আর ইউ স্কেয়ার্ড?

হাসলো নাসিমা। হাসির রেখা তার মুখাবয়বকে নতুন করল।

নো, আই অ্যাম নট, ডার্লিং।

বাট শি সেড—-ছেলেটা মুখ ঘুরিয়ে স্লিপিং ট্যাবলেট নিয়ে আগতা হোস্টেসকে ইঙ্গিত করল—-ইউ আর।

নাসিমা ধন্যবাদ জানিয়ে ট্যাবলেট আর পানি নিল হোস্টেসের হাত থেকে। তারপর হোস্টেস চলে গেলে ফিসফিস করে বলল, শি লাইজ।

ছেলেটা কৌতুকে হেসে উঠলো। নাসিমা শুধালো, বাট ইউ আর নট স্কেয়ার্ড।

হঠাৎ একটা দায়িত্ব ফুটে উঠলো ছেলেটার কণ্ঠে, নো। মাই আঙ্কল সে আই অ্যাম এ ব্রেভ বয়।

বাট ইউ আর, ডার্লিং।

তাহলে লোকটা ওর চাচা, কিংবা মামা, কিংবা ফুফাও হতে পারে। আস্তে আস্তে কথা জমে উঠলো ছেলেটার সঙ্গে নাসিমার। ডাক নাম—- বব, ভালো নাম আসাদ রেজা চৌধুরী। ববের বাবা ঢাকার নামকরা ব্যারিস্টার। সেই ইনে থাকবার সময় বিয়ে করে এনেছিলেন বিদেশিনীকে। কিন্তু দেশে ফেরার বছরখানেকের মধ্যেই প্রকট হয়ে উঠল একটা ফাটল–চিহ্ন দিনে দিনে। লন্ডনে ফিরে গেল ববের মা দুবছরের ববকে নিয়ে। বিদেশিনী এবার বিয়ে করলো তার স্বদেশেই। আট বছর বয়সে বব এলে করাচিতে আঙ্কলের কাছে। তার বাবার চাচাতো ভাই। নতুন ড্যাড তাকে একটুও ভালোবাসত না। কিন্তু মা পাঠাতে চায় নি ব্যারিস্টার চৌধুরীর কাছে, কেননা সেও ততদিনে দ্বিতীয়বার স্ত্রী নিয়েছে। অবশেষে করাচির নিঃসন্তান আঙ্কল কোলে তুলে নিয়েছে ববকে।

নাসিমা বুঝতে পারে, বাবা তাকে আজ ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাকে ধরে রাখতে পারেনি। বব বলল, আই উইল কাম ব্যাক টু মাই আঙ্কল। আই হেট মাই ফাদার! আই হেট হিম। অভিমানে ববের চোখ সজল হয়ে উঠলো। চোখ নামিয়ে সে সমুখের ছাইরঙা কুশনে লাথি ছুঁড়তে লাগলো আস্তে আস্তে।

আর নাসিমা তার পায়ের দিকে তাকিয়ে পাথরের মত বসে রইলো। একটু পরে বব সিটে হেলান দিয়ে নাসিমার উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে রইলো এতটুকু একটা পাখির মত। ঘুম এলো না নাসিমার। দুচোখ ভাব শুধু ঘুমের আর্তি। আর কিছু নয়। চব্বিশ বছর বয়সে যখন তার বিয়ে হয়েছিল সেই লোকটার সঙ্গে, তখন থেকে ঘুমের ওষুধ তার অভ্যেস হয়ে গেছে। আজকাল তিনটে ট্যাবলেট না হলে নাসিমার ঘুম আসে না। কিন্তু হোস্টেস দিয়ে গেছে একটা। শুধু একটা। এতে এমনকি তাও এলো না তার। কেবলি পেছনে ফেলে আসা। গ্রাম, ফসল, শহর আর পার্কের বৃক্ষবীথি আর ক্লিফটনের বালুকাবেলা। বব, ইউ আর এ ব্রেভ বয়—-বব, ইউ আর গোয়িং টু ইওর ড্যাড–বব–বব।

বব। ডাকলো নাসিমা।

তাকিয়ে দেখল বব নিস্পন্দ পড়ে আছে। শিথিল হয়ে এসেছে তার সারাটা শরীর। সমস্ত মুখে একটা অভিমান ফসিল হয়ে আছে।

চোখ বিস্ফারিত হয়ে এলো নাসিমার। তলিয়ে গেল এঞ্জিনের গর্জন। তার হৃদপিণ্ড কে যেন ছুঁড়ে ফেলে একতাল বরফ গুঁজে দিল বুকের ভেতর। নাসিমা চিৎকার করে উঠল, বব ইজ ডেড।

ঝনঝন করে চারদিকে বেজে উঠলো সেই কণ্ঠ।

যাত্রীদের সচকিত চোখ উৎস খুঁজে বের করার আগেই ছুটে এলো হোস্টেস।

হি ইজ ডেড। আসক দেম টু স্টপ দ্য ফ্লাইট।

ববের বুকে হাত রেখে হোস্টেস ধীর কণ্ঠে উচ্চারণ করল, দ’বয় ইজ স্লিপিং।

তারপর ববকে আরো ভালো করে শুইয়ে ডান হাত তার পাজরের চাপ থেকে বের করে বুকের ওপর বিছিয়ে দিয়ে হোস্টেস সোজা হয়ে দাঁড়াল। বলল, আই অ্যাম সরি, ইউ নিড রেস্ট, মাদাম।

হ্যাঁ, আমার বিশ্রাম প্রয়োজন। আর বিস্মৃতি। কিন্তু স্মৃতি ছড়িয়ে পড়ে অন্ধকারের মত বিন্দু বিন্দু করে সমস্ত কিছু সে তার লোমশ ধূসর থাবায় তুলে নেয়।

থুতু আর কাদা। তবু তৃষ্ণা।

আমাকে ভুলে যেতে দাও। আমি বড় ক্লান্ত। জীবন নয়, মৃত্যু নয়—- আমি আর কিছুতেই বাঁচি না। আমি শুধু প্রবাহিত হতে পারি এই দীর্ঘ বাতাসের করতালি পেরিয়ে, বাসনার চতুরালিকে তুচ্ছ করে অথবা না পেরিয়ে, অথবা তুচ্ছ না করে, কেননা কিছুতেই কিছু এসে যায় না।

আরজুর সংসার আবিষ্কার করার কাজটা টিকে ছিল মাত্র একটা দিন। ওদের চলে যাওয়ার পর দিনটাই শুধু। সেই একটা দিনে দেখা হয়ে গেছে সব—- ভেতর বার, অন্তরংগ, ইতস্তত সব কিছু। এমনকি এ বাসার প্রতিটি কোণ তার চেনা হয়ে গেছে। পুরনো হয়ে গেছে। মনে হয়েছে যেন তার জন্মের পর থেকে আজ এই বত্রিশটি বছর সে কাটিয়ে দিয়েছে এখানে। অথচ একাকীত্বের প্রথম মুহূর্তটা মনে হয়েছিল হঠাৎ পাওয়া একটা গিনির মত।

আরজু তার মেয়েকে নিশ্চয়ই আদর করে মাত্রারও বেশি, নইলে এত কাপড় থাকে অতটুকু চার বছরের মেয়ের? আর এত খেলনা? কাপড়গুলো আলনায়, এখানে সেখানে স্তূপ স্তূপ হয়ে আছে পাঁচমিশোল রঙের ছোপের মত। দূর থেকে চোখে পড়ে। আর কী ঠাণ্ডা! একবার হাতে করে দেখেছিল নাসিমা। একটা গোলাপি ফ্রক এত মুড়মুড়ে সিল্কের তৈরি যে, আলতো করে হাতে তুলতেই খসখস করে পড়ে গেছে মাটিতে। আবার আরেকটা সবুজে চুমকি বসানো চাঁদের অনুকরণে। আরেকটা কাঁচের মত স্বচ্ছ আর অনুভব কাগজের মত। লাল, রক্তিমাভ, ভায়োলেট। আরো, আরো, আরো।

খেপে ওঠা দুহাতে নাসিমা সবগুলো ছুঁড়ে খুঁড়ে জড়ো করেছিল মেঝের মাঝখানে। কী সে। বিতৃষ্ণা তাকে ভর করেছিল কে জানে। কেবলি থেকে থেকে কে যেন মনের ভেতর বলছিল—-নোংরা, বিশ্রী, জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে ফ্যালো। কেন? কেন থাকবে এখানে এগুলো? কিন্তু কোথায় যে হবে তার স্থান, তাও স্পষ্ট নয় তার কাছে।

কাপড়গুলো একটার ওপর আরেকটা পড়ে যেন কিলবিল করতে থাকে নাসিমার চোখের সমুখে। তারপর কী মনে হয়, আগের চেয়েও দ্রুত দুহাতে সব গুছিয়ে রাখে আলনায়। একটা ক্লান্তি, শরীর থেকে শক্তির একটা অপচয় অনুভব করতে করতে নাসিমা পড়ে থাকে বারান্দায় আরাম চেয়ারে।

তারপর থেকে মনটা যেন মরে গেছে ওই আলনায় রাখা কাপড়গুলোর জন্যে। যেন আর চোখেই পড়তে চায় না নাসিমার।

সেদিন নাইবার জন্য প্রাণ আকুল হয়ে ওঠে। সেদিন সময়টা ছিল ভর সন্ধ্যে। মনের অরণ্যে যে বিরাট গাছ তার সহস্র শেকড় প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে হোঁচট খেলে তার তৃক শিরশির করে ওঠে। তখন নাইতে হয়! ঠাণ্ডা পানির ধারায় নিজেকে শীতল করে তুলতে হয়। এক সময়ে যখন আর কোনো স্পর্শের বোধ থাকে না তখন সে উঠে আসে।

সেদিন নেয়ে এসে নিজের কাপড় বাছতে বসলো। কোনটাই টানলো না তাকে। তখন উঠে এলো আরজুর ওয়ার্ডরোবের কাছে। বেছে বেছে বার করল মাখনের মত নয়োম, মুঠো করলে এতটুকু, দুধ শাদা, পাড়ছাড়া একটা শাড়ি। মনটা যে হঠাৎ শুদ্ধ সুন্দর হয়ে উঠেছে, তার প্রতীক করে পরলো শাড়িখানা। কোমল ভেলভেটের লাল চটি দিল পায়ে। বাতাসের মত লঘু গতিতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল নাসিমা।

আহ, কী সুন্দর ফুল ফুটেছে আজ ওই লতানো গাছটায়! আরজুর যে ফুলের শখ তা কি জানতো নাসিমা? হয়ত এই তিন বছরের অসাক্ষাতের ব্যবধানে এই শখটা হয়েছে আরজুর। মনে আছে সেই তারা যখন কলকাতায় পড়ত কলেজে, কী এলোমেলো কাঠ–কাঠ ছিল মেয়েটা। প্রথম দিন এসে হস্টেলের ডরমিটরিতে থাকতে হয়েছিল আরজুকে। চাদরটা ময়লা ছিল ওর, নাসিমা তার নিজের ফুলতোলা চাদর ট্রাঙ্ক থেকে বের করে দিয়েছিল। সেইদিন থেকে ভাব। আরজু বলেছিল চোখ গোল করে, এত বড় ফুল চাদরে? কে করেছে?

কে আবার? আমি করেছি।

কথাটা মিথ্যে। বউবাজার থেকে শখ করে কিনেছিল সে একদিন।

ততক্ষণে আরজু শুয়ে পড়েছে বিছানায়। নাসিমা শুধিয়েছিল চোখে কৌতুক নাচিয়ে, কী, পিঠে ফুটছে?

উঁহু।

ফুটলোই বা। ফুল তো। তোমার ফুল ভালো লাগে না?

না।

সত্যি মেয়েটার সখ বলতে কিছু ছিল না তখন। ফুটপাথ থেকে কতদিন রিকশা থামিয়ে নাসিমা কোলভরে ফুল কিনে এনেছে। তার থেকে কয়েকটা স্তবক হয়ত শোভা পেয়েছে আবজুর শিথানে, কিন্তু সে নিজে কোনদিন সাগ্রহ হয়নি ফুলের জন্যে। বরং নাসিমা যখন বলত, একদিন ফুল না হলে, জানিস আরজু, মনে হয় কী একটা যেন হারিয়ে ফেলেছি। ভিতরটা কেমন হাহাকার করতে থাকে সব সময়। লোকে মদ খায়, রেস খেলে, আর আমার নেশা ফুল।

তখন একটু বাড়াবাড়ি ঠেকত আরজুর।

আজ আরজুর লতানো গাছে ফুল ধরেছে। শাদা শাদা ফুল। শাদা শাদা সুগন্ধের অস্পষ্ট কুচি। বুক ভরে ঘ্রাণ নিল নাসিমা।

মতির মা এসে বলল, একটা চেয়ার পেতে দেব আপামণি?

দে, আর ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিস।

আলো নিভিয়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারে ভিজে গেল বারান্দা। আর শাদা শাড়িটা ম্লান হয়ে এলো কুয়াশার মত।

মনের ভেতরে সাবেকি মেঘের যেন ঢল নেমেছে।

বসে বসে গল্প করতে ইচ্ছে করছে মতির মা–র সঙ্গে! একটা মধুর বাঙালপনা তাকে পেয়ে বসছে আস্তে আস্তে। আজ আমার নতুন জন্ম, এক মুহূর্ত আমি বাঁচবো, তারপর আবার আমি মরে যাবো।

নাসিমা আবছা গলায় বলল, মতির মা, ফুল ফুটেছে দেখেছিস? ছিঁড়ে দিবি কটা?

রাতে ফুল ছিঁড়তে বারণ যে।

থাক বারণ, তুই দিবিনে? না বাপু, ঝগড়া করতে পারিনে।

অগত্যা মতির মা–কে উঠতে হয়। একমুঠো ফুল চয়ন করে হাতে দিয়ে বলে, এই নাও।

বেশ বাস ছড়িয়েছে।

কয়েকটা ফুল ওর হাতে নিয়ে নাসিমা বলে, মাথায় পরিয়ে দে।

আর বাকিগুলো দুহাত ভরে কোলের কাছে রাখে। শরীর বেয়ে লতিয়ে উঠতে চায় ঘ্রাণ। ভীষণ প্রস্তুত মনে হয় তার নিজেকে। আমাকে তুমি তোমার দৃষ্টি দিয়ে স্পর্শ কর, আমি আজ ফলসম্ভবা। যোজন দূর থেকে তুমি আজ আমাতে সঞ্চারিত হও।

মতির মা স্তব্ধতা ভেঙে বলল, আপনার সোয়ামি নাই আপামণি?

তোর কী মনে হয়?

নাই।

থাকলে বুঝি তার কাছে হাত ধরে আজ পাঠিয়ে দিতি আমাকে?

রসিকতায় মুখর হয়ে ওঠে মতির মা। সত্যি বলছ আপামণি, নাই?

.

স্বামীর কাছ থেকে পালিয়ে বেঁচে, বিষে জর্জর মন নিয়ে সার্কাস–রো–তে এসে নাসিমা ছিল কিছুদিন। সার্কাস রো–তে থাকত তার বড় ভাই হামেদ। তখন একটা শহরের জন্যে মনটা ভীষণ রকমে উদ্‌গ্রীব হয়ে ছিল যে শহর হবে অনেক বড়, যেখানে থাকবে অনেক আলো, আর অনেককাল আগের পুরনো সব চেনা মানুষ। কলকাতায় তাই এক সকালে এসে হাজির হলো নাসিমা আখতার।

আসামের লাবু চা বাগান থেকে কলকাতা। শেয়ালদায় নেমে নাসিমা রক্তের ভিতর গতির একটা উন্মাদনা, শুধু কণ্ঠ আর শব্দের প্রপাত অনুভব করেছিল।

নাসিমা জানতো না হামেদ কঠিন অসুখে ভুগছে। থেকে থেকে রক্তবমি করে আর পেটে তীব্র একটা ব্যথা।

ছমাস হলো বিয়ে হয়নি এরই মধ্যে কোনো জানান না দিয়ে নাসিমাকে আসতে দেখে হামেদ বিস্মিত হয়। অসুস্থতায় কোটরাগত দুচোখ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে প্রশ্নে, চলে এলি যে? বেড়াতে?

না। বেড়াতে আসিনি। তোমার অসুখটা বেড়েছে আমাকে জানাও নি তো?

হামেদ বিছানা থেকে আধো উঠে বসে বলে, জানিয়েছিলাম। চিঠি পৌঁছোয় নি হয়ত। কিন্তু তুই এলি কেন?

জানিয়েছিল? তাহলে সে চিঠি তাকে দেয়া হয়নি। লাবু চা বাগানের ম্যানেজার, তার স্বামী—-সে চিঠি তার হাতে দেয়নি। হঠাৎ পুরনো কথাটা মনে পড়াতে নাসিমার সারা শরীর ঘৃণায় শিহরিত হয়ে উঠলো। জিভটা অশান্ত হয়ে উঠতে চাইল—-তুমি একটা পশু

উচ্চারণ করবার জন্যে। নাসিমা মুখে বলল, ভাবী কই? দেখছিনে।

রায়টের জন্যে উঁচড়োয় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আর আনা হয়নি।

আর একা তুমি অসুখে এখানে মরছ?

এতক্ষণে ম্লান হাসলো হামেদ। বলল, একা কই? তাছাড়া আমার ট্রিটমেন্ট দরকার, তাই কলকাতায় পড়ে আছি।

চাকর বাকর কেউ নেই?

আছে, থাকবে না কেন? নূরুকে তুই বোধ হয় দেখে গিয়েছিলি। ও–ই আছে।

বলতে বলতে হয়ত ব্যথাটা উঠে থাকবে হামেদের। ঠোঁটের দুপাশে শক্ত একটা কুঞ্চন পড়ল এক মুহূর্তের জন্যে।

নাসিমার হাসি পেল হামেদও একা থাকতে চায়। তুমি আমার সহোদর। আজ নতুন করে তোমার সঙ্গে আমার নাড়ির যোগ হলো।

নাসিমা বিছানার পাশ থেকে উঠে আসতে আসতে বলল, এখন থেকে আমি কলকাতায় থাকব। তোমার এখানে।

.

বিকেলে বেরিয়ে নাসিমা খুঁজে খুঁজে প্রথমেই পেল বিনতাকে। বিনতা আজো তেমনি সুন্দর আছে, তেমনি গৌর, সজ্জায় তেমনি নিপুণ। একটা লাল পেড়ে মিলের শাড়ি পরেছে। মাথায় একটু সিদুরের আভাস। আর খালি পা দুখানা মেঝের সঙ্গে প্রীতিময় হয়ে আছে। সব মিলিয়ে বিনতার অপূর্ব শ্রী মুগ্ধতাকে আহরণ করল।

বিনতা তাকে দেখে খুশি হয়ে উঠলো। মোড়ায় বসে মাই দিচ্ছিল খোকাকে, কাপড় টেনে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ওমা, বেঁচে আছিস তুই?

তুই কি মনে করেছিস, মরে গেছি! তোর খোকা?

মাই টানছে দেখতে পাচ্ছিস না!

বিনতা খোকার দিকে স্নেহদৃষ্টি করে। প্রশ্ন করে, তোর বুঝি হয়নি?

না।

লাবু চা বাগানে ফেলে আসা ঘৃণা তাকে শিহরিত কবল আবার স্থলিত কণ্ঠে একটু পরে সে যোগ করল, আমি চাই না। তারপর তোর কী খবর বল।

ভালো। সব ভালোই।

গান?

আজকাল আর গাই না।

তারপর একটু হেসে খোকাকে মেঝেয় বসিয়ে বলল, গাইব কী? এই নিয়ে তিনটে হলো, এখন এরাই আমার আর্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যেন ডাক্তার শুনছে রোগীর বিবরণ এমনি একটা মনোযোগ ধরে রাখে নাসিমা। বলে, তাই বলে গান ছেড়ে দিবি?

দিলাম।

সহজ কণ্ঠে বিনতা কথাটা বলে। বলে হাসতে থাকে।

সুবোধবাবু—- সুবোধবাবু কিছু বলেন না?

সুবোধকে অনেকদিন আগে দেখেছিল নাসিমা। চেহারাটা স্পষ্ট করে মনে নেই। কেবল মনে আছে নাকের নিচে একটা কালো তিল ঢাকবার জন্যে ভদ্রলোক মোটা করে গোঁফ রাখতেন।

সেই নিয়ে বিয়ের পর বিনতার কৌতুকের অন্ত ছিল না।

বিনতা বলে, সুবোধবাবু কী বলবেন? দোষটা কি তারই নয়?

কেন?

একটা স্পষ্ট আশঙ্কা কালো হয়ে ওঠে নাসিমার চোখে।

কেন আবার? ওর জ্বালাতেই তো এত দুর্ভোগ। নইলে থাকতাম ঝাড়া হাত পা। এত কষ্ট করে বাবা গান শিখিয়েছিলেন, শেষ অবধি দেখতাম।

নাসিমার তবু মনে হয় বিনতা অসুখী নয়। যে বিনতা এককালে এত ভালো গান গাইত, যার গান শুনে ইউনিভার্সিটির ছেলেরা ভিড় করত এক সময়ে চারপাশে, সেই বিনতা গান ছেড়ে দিয়েছে। ছেড়ে দেয়ার খেদ যতটুকু আছে কণ্ঠে, মনে তার ছায়াটুকুও নেই।

নিঃশ্বাস ছেড়ে নাসিমা বলল, বেশ আছিস তুই।

আর তুই? চা বাগানে যেতে আমার এত শখ। নিয়ে যাবি একবার?

বলতে পারে না নাসিমা, আমি আর কোনদিন সেখানে ফিরে যাবো না, বিনতা।

বিনতা বলে, বাইরেই বসে থাকবি নাকি? চল, ভেতরে চল। আমার শেষ রেকর্ডখানা তুই বোধ হয় শুনিসনি। শুনবি চল।

নাসিমা ওর সঙ্গে উঠে আসে শোবার ঘরে। খোকা তার দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দুর্বোধ্য—- করতে থাকে। বিনতার কাঁধ লালা দিয়ে বার্নিশ করে দেয়। ভারী দুষ্টু হয়েছে তো!

কী নাম রেখেছিস ওর?

চপল।

বাপের মত হয়েছে দেখতে?

কী জানি।

চোখ আর থুতনিটা কিন্তু তোর মত।

তাই নাকি?

ঘরের ভেতরে ঢুকে নাসিমা বলে, বেশ সাজিয়েছিস তো।

কী আর এমন! একটা ভালো বাসাই পেলাম না আজ অবধি।

এটাই বা মন্দ কী।

দূর। বাসা হবে বাসার মত ছবির মত। চোখভরে দেখতে ইচ্ছে করবে। বোস চেয়ারটায়। খোকাকে একটু নিবি?

নাসিমা হঠাৎ লজ্জিত হয়ে যায়। সাপটে ধরে চপলকে কোলে নিতে গিয়ে টাল খেয়ে পড়ে।

বিনতা গ্রামোফোনে চাবি দিতে দিতে বলে, দেখিস হিসু করে না দেয়।

দিলেই বা।

চপল কোল থেকে নেমে যায়। নেমে গিয়ে মেঝেতে হামাগুড়ি দেয়। হঠাৎ ধাবিত হয় এক টুকরো কাগজের দিকে।

বিনতা কাঁটা বসাতে বসাতে কাঁধ তুলে বলে, শোন।

ভক্ত কবিরের গান।

আমার হৃদয়কে আমি তুলে ধরেছি তোমারই গানে। আমার আর কোনো সাধ নেই। স্বপ্ন নেই, আমি তোমাতেই।

মিথ্যে, সব মিথ্যে। কখন যে সে ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল বুঝতে পারে নি। বিনতার কণ্ঠস্বরে সে চোখ তুলে তাকাল। বিনতা বলছে, কেমন শুনলি, বললি না কিছু?

ভাবছি, গান ছেড়ে দিয়ে ভুল করেছিস মস্ত।

হবেও বা।

ঘরের কোণে বিনতার তানপুরো ঠেস দিয়ে রাখা। মমতা দৃষ্টিতে সেদিকে বিনতা একবার তাকাল। পরে বলল, এসে অবধি আমাকে নিয়েই পড়েছিস তুই। তোর কিছু বল।

কিছু বলার নেই, তাই।

হঠাৎ গভীর চোখে বিনতা তাকে দৃষ্টি করে। বলে, তোর কী হয়েছে বলতো? এত রোগা হয়ে গেছিস।

কই, কিছু না। চিরকাল মানুষ এক রকম থাকে নাকি। বাইরে যাস না আজকাল?

খুব কম।

চল, আমার সঙ্গে বেরুবি। দুজনে মিলে মজা করে বেড়ানো যাবে। কলকাতা এত নতুন ঠেকছে, কেউ সঙ্গে না থাকলে হয়ত পথই হারিয়ে ফেলব।

সুবোধবাবু ফিরলেন একটু পরেই। নাসিমাকে দেখে মুখর হয়ে উঠলেন। নাসিমার মনে হলো অনেকদিন পরে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছে যেন সে। আর পেছনে পেছনে বিনতার বড় মেয়েটা আর মেজ ছেলে।

তারা যখন বেরুচ্ছিল, সুবোধবাবু বললেন, আজ আমার এখানেই খাবেন। বিনতা, তুমি ওকে ছেড়ে দিয়ো না যেন।

বিনতা মুখে ঢেউ তুলে বলে, আসবে, আসবে। আমার মাছের ঝোল ও যা ভালোবাসতো। মনে করেছ ও কি ফেলে যাবে? কি বলিস? ফেরার পথে তোর দাদা আর বৌদিকেও নিয়ে আসবো।

বৌদি তো নেই। চুঁচড়োয়। আর দাদার খুব অসুখ।

নাকি?

নিভে যায় যেন বিনতা।

সুবোধবাবু আবার বলেন, ওকে নিয়ে এসো কি। আজ প্রবীরও খেতে আসবে বলেছিল। বিনতা থমকে দাঁড়িয়ে মুখ গোল করে বলে, আজ নোটিশ না দিয়ে যে! দেখা হয়েছিল বুঝি?

বাবু যে রাজকর্ম নিয়ে থাকেন।

তোমার কাছে প্রবীরের আবার নোটিশ লাগবে নাকি?

ততক্ষণে ওরা পথে নেমে এসেছে।

প্রবীর সুবোধের ছোটভাই।

বিনতার কণ্ঠ যখন গ্রামোফোনে প্রথম কথা কয়ে উঠেছিল তখন নাসিমার মনে হয়েছিল বিনতা দুজন। একজন যার কণ্ঠ গান হয়ে উঠেছে, আরেকজন তার সমুখে দাঁড়িয়ে আছে। চিবুক নিচু করে। কোথাও তাদের মিল নেই। দুজন সম্পূর্ণ আলাদা।

আমাদেরও কি এমনি করে প্রতিটি মুহূর্তে মরে গিয়ে নতুন জন্ম নিতে হয়? একেকটা মুহূর্ত আমি পেরিয়ে আসি, আর পেছনের আমাকে মনে হয় অন্য নারী তার জীবন, তার আত্মা, তার পরিবেশ আমার নয়। আমি অনেক আমি—-এই কথা আর কেউ জানবে না। আমি যে নাসিমা নই, কোনদিন তা জানবে না বিনতা—- সুবোধবাবু, প্রবীর, কেউ না।

আমার মৃত্যু হয়েছে। আজকের যে আমি তার জন্ম হয়েছে কিছুক্ষণ আগে, কলকাতায় বিনতার বারান্দায়। আমাকে কি তৈরি হতে হবে আরো অসংখ্য মৃত্যুর জন্যে?

নাসিমা তার শীর্ণ বাহু বিনতার কাঁধে রেখে শুধালো, সুবোধবাবু তোকে খুব ভালোবাসেন, না?

তুই কি দেখলি?

অনেক ভালোবাসেন তোকে।

ছেলেমানুষের মত রক্তাভ হয়ে ওঠে বিনতার মুখ।

একেক সময় কি মনে হয় জানিস? মনে হয়, এত ভালোবাসার বদলে আমি ওকে কিছুই দিতে পারলাম না।

এটা তোর বাড়াবাড়ি।

মুখে এই কথাটা বলে নাসিমা, কিন্তু মনে মনে ভাবতে থাকে, তোমার আপনমকে দান করে আজ তুমি নিঃশেষিত, অদেয় কিছু নেই আর। তবু আরো দিতে হবে। তাই এ বেদনা?

নাসিমা মুখ ফিরিয়ে বলে, চল নিউ মার্কেটে যাই। কতদিন যাইনি।

কিছু কিনবি?

না এমনি।

চল, আমিও বেরোইনি অনেকদিন। আমার ভালো লাগছে বেশ। আমি ভাবতেই পারিনি তোকে নিয়ে এমনি বেড়াতে পাবো।

দুজনে এলো মার্কেটে।

বিনতা চঞ্চল দৃষ্টি করে শাড়ি দেখতে লেগে যায়। আবার চলতে থাকে। আপন মনে একশো একটা কথা কয়ে চলে নাসিমার সঙ্গে। তারপর ওদিকের গোল বাকটার কাছে এসে বলে, কিরে তুই যে কথা বলছিস না বড়।

তুই বল। আমি শুনবো বলেই তো তোকে নিয়ে এলাম।

বিনতা স্বচ্ছ একটা হাসি পাঠিয়ে দেয় বাতাসে। নাসিমা বলে, ভাবছি ফুল কিনবো। কতদিন ফুল কিনিনি।

কোল ভরে রজনীগন্ধা কিনে নাসিমা বেরিয়ে আসে। এসে রিকশা নেয়। বিনতা বলে, ফুলের জন্যে তুই চিরকাল পাগল হয়ে রইলি।

নাসিমা বুক ভরে ঘ্রাণ নেয় রজনীগন্ধার। সারাটা শরীর যেন ফেটে পড়তে চায় তার সৌরভে।

তোর হিংসে হয়, বিনতা?

আজ রাতে বিনতা অবসাদে বিভোর ঘুমোবে। নাসিমা আজ অনেক রাত অবধি বিছানায় ছটফট করবে, তারপর ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে কলকাতার বিশাল বুকে।

নাসিমা চুপ করে এইসব ভাবছিল।

বিনতার তখন সাবেকি কথা মনে পড়েছে। বিনতা শুধালো, সেই ছেলেটিকে তোর মনে আছে?

কে? কার কথা?

নাসিমা নিজেই অবাক হয়ে যায় যতটুকু সচকিত হওয়া তার উচিত ছিল এই প্রশ্নে ততটুকু সে হলো না বলে।

আনিসকে ভুলে গেছিস নাকি?

হৃদয়ের যে স্রোতোধারা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল আবার তা বইতে শুরু করল। নাসিমা উত্তর করল, ওহ্ আনিস? না, ভুলে যাবো কেন? সাপকে কেউ ভুলে যায় কখনো?

আনিস বিয়ে করেছে।

কাকে?

জানি না।

বউ দেখেছিস? কেমন, রাঙা টুকটুকে?

হয়তো। আমি দেখিনি।

নাসিমা ভাবলো, আনিস মরে গেছে। মরে গিয়ে নতুন জন্ম নিয়েছে। এই অসংখ্য মৃত্যুর বিয়োগ থেকে জীবনকে আমি কবে শুদ্ধ করে তুলবো? বিনতা বলে চলেছে, মাসখানেক আগে এসেছিল প্রবীরের সঙ্গে। বলে গেল।—-রাগ করলি নাকি? আগে জানলে বলতাম না।

নাসিমা কি অসতর্ক হয়ে পড়েছিল? জোর করে লঘু কণ্ঠে সে বলল, রাগ করবো কেন?

.

খেতে বসার আগে নাসিমা বালতি বালতি পানি ঢেলে এলো গায়ে। বিনতার ফর্সা তোয়ালে দিয়ে গা মাথা মুছলো। খোলা এলোচুল ছড়িয়ে দিল পিঠের ওপর। ভিজে ভিজে। কালো, শীতল। স্নিগ্ধতায় শ্রীমতি হয়ে উঠলো তার মন।

ঠিক তখন প্রবীরের সঙ্গে দেখা। প্রবীর বারান্দার থামে হাত রেখে হেসে বলল, অনেক দিন পরে দেখলাম। কেমন আছেন?

ভালো। আপনি?

ভালোমন্দ কিছুই বুঝতে পারি না।

বেশ তো।

নাসিমার ভালো লাগল প্রবীরকে। স্বচ্ছ, বোধগম্য। বলল, বিয়ে করে এবার বউ আনুন।

বউ? আপনাকেও বৌদির রোগে পেল নাকি? ওই ভয়ে তো বাড়ি ছেড়েছি।

তাই নাকি?

রান্নাঘর থেকে বিনতা বলল, নাসিমা একটু গল্প কর তুই। আমার মাছটা হতে যা দেরি।

সুবোধবাবু আবার এই রাতে রেরিয়েছেন রাবড়ি আনতে।

প্রবীর হঠাৎ কুয়াশা গলায় বলল, আপনাকে দেখলাম হঠাৎ। দেখে কেন যেন ভালো লাগল—- কিছু মনে করেন নি তো?

প্রীতিময় হয়ে উঠল নাসিমা।

না, না। মনে করবার কী আছে? আপনি বেশ কথা বলেন।

কতদিন থাকবেন কলকাতায়?

কী জানি।

আসামে থাকতেন, কী হলো সেখানে?

চলে এসেছি। আর যাওয়া হবে না।

বলেই গভীর চোখে তাকাল প্রবীরের দিকে।

প্রবীর থাম থেকে হাত নামিয়ে সোজা হয়ে বলল, বৌদির কাছে চলুন। আমি এসে পড়ে আজ বেচারির রান্না বাড়িয়ে দিয়েছি।

আমিও।

দুপা এগিয়ে, থেমে, পেছন ফিরে তাকাল প্রবীর। নাসিমার শরীরটা শিরশির করে উঠলো।

না প্রবীর, আনিসের কথা তুমি বোলো না।

আনিসের কথা সে বলল না। বলল, কাল রোববার। বেড়াতে যাবেন?

আশ্বস্ত হলো নাসিমা। উত্তর করল, কোথায়?

যেখানে খুশি।—-গঙ্গার পোলের দিকে অনেকদিন যাইনি। যাবেন?

মনে মনে নাসিমা উচ্চারণ করল, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, প্রবীর। আমার মমতার উৎস তুমি খুলে দিয়েছ। মুখে বলল, যাবো।

বিনতার ছেলেমেয়েরা এরই মধ্যে এত ভক্ত হয়ে উঠেছে নাসিমার যে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল।

Pages: 1 2 3 4
Pages ( 1 of 4 ): 1 234পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *