দুনিয়াতে কেবল আমারই দাঁড়াবার জায়গা খুঁজে হয়রান হলাম।
কত ঘাট আর বন্দর পেরুলাম। কত আন্তর্জাতিক উড়াল কেন্দ্রে
ঠেলাঠেলি করে শেষে জেটপ্লেনের উদরে সেঁধুলাম। যেন
অতিকায় উড়ন্ত তিমি আমাকে উগরে দিতে একটা পছন্দমত
রানওয়ে না পেয়ে আছড়ে পড়েছে ঢাকার শেওলাধরা জিয়া
আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে।
আমার কোনো লটবহর নেই কয়েকটা রংচটা কবিতার খাতা
ছাড়া। কোথায় যাব এই ভাবনার চেয়ে এই মুহূর্তে দাঁড়াবার মত একটা
জায়গা দরকার
পায়ের তলায় মাটি চাই। খালি পায়ে যারা এই ভূপৃষ্ঠ মাড়িয়ে গেছেন
তাদের মত ক্ষতবিক্ষত দুখানি পা চাই আমার। কি হবে চকচকে
উডল্যান্ড সুতে! আহা গান্ধীজী তার খটখটে খড়ম জোড়া
কোথায় রেখে গেছেন তা যদি জানতাম?
প্রকৃতপক্ষে দাঁড়াবার কথা বললে, কোথায় থামতে হবে তা আমি
জানি। প্রতিটি জেটিতে ধাক্কা খাওয়া জাহাজের মাস্তুলে বসা
সন্ত্রস্ত গাঙচিল আমি। দরিয়া ও নীলিমার মেশামেশি দেখে
মাঝে মাঝে ডানা ঝাড়া দিই। যাতে ভেজা নুনের বিন্দু
আবার অপরিসীম লবণেই মিশে যায়। আমার ডানার এই
শ্বেতাভ ধূসরতায় স্বাদের কোন সঞ্চয় নেই। আমি জমা করিনি
কিছুই তাই পেছন থেকে আমাকে কেউ ডাকে না। তবে না থামার
ছন্দ তা আমাকে অসীম শূন্যতার মধ্যেও ভেসে থাকার কৌশল
শিখিয়েছে। আমি নিজেই তো কবিতা যা ভবিতব্যের কলমে
রচিত। তাহলে
আমাকে কেন কবি বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া!
দিল্লি এয়ারপোর্টে এখন জেটপ্লেনের পেটে অবতরণের
কম্পনে আমার স্বপ্নের শিহরণ স্তম্ভিত। এতক্ষণ আমি
নিজামুদ্দীনের দরগায় লায়লাতুল কদরের জিকিরে
মশগুল ছিলাম।
তিনি তো সেই দরবেশ যিনি সম্রাটদের মুখের
ওপর মৃদু হাসি মিশিয়ে বলে দিয়েছিলেন, দিল্লি দূর অস্ত।
আমি কিন্তু আউলিয়ার মাজারে দাঁড়িয়েই অতিকায় তর্জনীর
মত কতুবুদ্দীন আইবেকের বিশাল ইশারা
হৃদয়ঙ্গম করছি।
হিন্দুস্তানের মুক্তির ইঙ্গিত। মাথা এমনভাবে সোজা করে
দাঁড়ানো যা মেঘবৃষ্টি, শীত-গ্রীষ্ম এবং সবরকম
ঝঞাঋতুর দাপটেও অকম্পিত।
সর্বপ্রকার দাসত্বের বিরুদ্ধে এক দাস সম্রাটের বিদ্রোহ কেবল
মাথা উঁচু রাখার ইঙ্গিত মাত্র।
তিনি দাস ছিলেন বলেই উপমহাদেশের দাসত্বের হীনতার
বিরুদ্ধে এই মেঘস্পর্শী মিনার গড়েছিলেন। যা
আজ উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির বিরুদ্ধে এক
প্রস্তরীভূত অঙ্গুলি সংকেত।
দাঁড়াবার ঠাঁই খুঁজতে গিয়ে এই কীর্তিস্তম্ভের গায়ে একটু
হেলান দিয়ে বসি
কত কবির আত্মা আমাকে জোনাকির মত ঘিরে আলোর
নকশা বুনছে। একটু পরেই আমি শের শাহসুরী
রোড ধরে পুরানা কিল্লার দিওয়ার পেরিয়ে শাহী
মসজিদে আজান দিতে যাবো।
বেপথুমান চিরচঞ্চল কবির আত্মায় এখন গুঞ্জরিত হোক–
দিল্লি নজদিক।