রামায়ণ : উত্তরাকাণ্ড – হনুমানের জন্মকথা ও বরপ্রাপ্তির বিবরণ
অগস্ত্য বলেন, কি কহিব তার কথা।
হনুমানের কত গুণ না জানে দেবতা।।
তাহার যতেক গুণ কহিতে না জানি।
সংক্ষেপেতে কহি কিছু শুন রঘুমণি।।
জননী অঞ্জনা তার পিতা যে পবন।
হনুমানের জন্মকথা কহি বিবরণ।।
অঞ্জনা বানরী ছিল পরমা-সুন্দরী।
তারে বিভা করিলেন বানর কেশরী।।
বানরীর রূপ গুণ বড়িই অদ্ভুত।
রূপে আলো করে যেন পড়িছে বিদ্যুৎ।।
মলয় পর্ব্বতোপরি কেশরীর ঘর।
অঞ্জনা লইয়া কেলি করে নিরন্তর।।
প্রবেশিল চৈত্রমাস বসন্ত সময়।
আইল পবনদেব পর্ব্বত মলয়।।
অঞ্জনার রূপে বায়ু আকুল হৃদয়।
কহিতে না পারে কিছু কেশরী দুর্জ্জয়।।
এক দিন একাকিনী পাইয়া পবন।
পরিধান উড়াইয়া দিল আলিঙ্গন।।
অঞ্জনা বলেন বায়ু কৈলে জাতিনাশ।
দেবতা হইয়া তব বানরী-বিলাস।।
বায়ু বলে আর কিছু না বল অঞ্জনা।
তোর রূপ দেখে আমি পাসরি আপনা।।
শাস্ত্রে মহাপাপ পর-রমণী গমনে।
জাতি কুল বিচার করয়ে কোন্ জনে।।
সকল সম্বরি তুমি যাহ নিজ ঘরে।
জন্মিবে দুর্জ্জয় বীর তোমার উদরে।।
এতেক বলিয়া বায়ু গেল নিজ স্থান।
আঠার মাসেতে জন্ম নিল হনুমান।।
অমাবস্যা দিনে হৈল হনুর জনম।
জন্মমাত্রে সেই দিন বিশাল বিক্রম।।
জন্মিয়া মায়ের কোলে করে স্তন্যপান।
রক্তবর্ণ উদয় হইল ভানুমান।।
ফলজ্ঞানে ধরিতে সে চাহিল কৌতুকে।
অঞ্জনার কোল হৈতে উঠে অন্তরীক্ষে।।
পর্ব্বত সূর্য্যেতে হয় লক্ষৈক যোজন।
এক লাফে উঠে তথা পবন-নন্দন।।
জন্মামাত্র বালক সে উঠিল আকাশে।
সূর্য্যকে ধরিতে যায় অসীম সাহসে।।
সূর্য্যতে গ্রহণ লাগিবেক সে দিবসে।
ধাইয়াছে রাহু সূর্য্যে গিলিবার আশে।।
হনুমানে দেখে রাহু পলাইলা ডরে।
কহিল সকল কথা ইন্দ্রের গোচরে।।
মম অধিকার ইন্দ্র দিলে তুমি কারে।
না জানি কে আসিয়াছে সূর্য্যে গিলিবারে।।
শুনিয়া রাহুর কথা দেবের তরাস।
সূর্য্যকে গিলিতে কেবা করিয়াছে আশ।।
ঐরাবতে চড়ি ইন্দ্র বজ্র হাতে লয়ে।
সূর্য্যের নিকটে হনু দেখিল আসিয়ে।।
হনুমানে দেখি ইন্দ্র ভয়েতে অস্থির।
সুমেরু পর্ব্বত জিনি প্রকাণ্ড শরীর।।
ঐরাবতের মাথা রাঙ্গা হিঙ্গুলে মণ্ডিত।
তাহা দেখি হনুমান হৈল হরষিত।।
সূর্য্যে এড়ি যায় ঐরাবতেরে ধরিতে।
কোপেতে উঠিল ইন্দ্র বজ্র লয়ে হাতে।।
ক্রোধ হইলে দেবরাজ আপনা পাসরে।
বিনা দোষে বজ্রাঘাত তার শিরে করে।।
হনুমান পীড়িত হইল বজ্রাঘাতে।
অচেতন হয়ে পড়ে মলয়-পর্ব্বতে।।
নিরখিয়া অঞ্জনার উড়িল পরাণ।
ব্যাকুল হইয়া কান্দে কোলে হনুমান।।
পুত্র পুত্র বলি করে অঞ্জনা ক্রন্দন।
হেনকালে আইলেন দেবতা পবন।।
অঞ্জনা বলেন নাথ তব অপকর্ম্মে।
পাপেতে জন্মিল পুত্র মরিল অধর্ম্মে।।
অঞ্জনার বচনে পবন পড়ে লাজে।
জগতের প্রাণ আমি ধরি কোন্ কাজে।।
জগতেতে হই আমি জীবনের নিধি।
পুত্র মরে আমার কৌতুক দেখে বিধি।।
বিধাতা করিল সৃষ্টি বড় করি আশ।
স্বর্গ মর্ত্ত্য আদি আজি করিব বিনাশ।।
বহে শ্বাস পবন সে লোকের জীবন।
পবন ছাড়িল অচেতন ত্রিভুবন।।
স্থাবর জঙ্গম আদি মরে যত জীবী।
মুনি সব অচেতন সকল পৃথিবী।।
ইন্দ্র আদি অচেতন সকল দেবতা।
সৃষ্টিনাশ হয় দেখি চিন্তিত বিধাতা।।
মলয়- পর্ব্বতে ব্রহ্মা আসিয়া সত্বর।
বলেন পবন শুন আমার উত্তর।।
সৃষ্টি সৃজিলাম আমি বহুতর ক্লেশে।
হেন সৃষ্টি নাশ কর যুক্তি না আইসে।।
পবনে সৃজিলাম আমি লোকের জীবন।
শ্বাসেতে পবন বহে এই সে কারণ।।
হেন বায়ু রোধ করি মারিলা জগৎ।
আপনি মরিবে বুঝি কর সেই মত।।
আত্ম রাখ সৃষ্টি রাখ শুনহ উত্তর।
চারি যুগে তব পুত্র হইবে অমর।।
শুনিয়া ব্রহ্মার কথা পবনের হাস।
রুদ্ধ ছিল সে পবন হইল প্রকাশ।।
আপনা প্রকাশ যদি করিল পবন।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল উঠিল ত্রিভুবন।।
বিধাতা বলেন শুন কহি দেবগণ।
হনুমানে আশীর্ব্বাদ করহ এখন।।
সর্ব্ব অগ্রে যম বলে আমি দিনু বর।
আমা হৈতে নাহি তব মরণের ডর।।
তবে বর দিলেন যে দেবতা বরুণ।
না হবে আমার জলে তোমার মরণ।।
অগ্নি বলে হনুমান দিলাম এ বর।
অগ্নিতে না পুড়িবে তোমার কলেবর।।
যত যত দেবতা যতেক বল ধরে।
আপন আপন বল দিলেন তাহারে।।
ইন্দ্র বলে হনুমান পবন-নন্দন।
বড় লজ্জা পাইলাম তোমার কারণ।।
যেই বজ্রাঘাতে তুমি হইলে অস্থির।
সে বজ্র সমান হউক তোমার শরীর।।
ব্রহ্মা বলে মারুতি আমার এই বর।
এই বরে হও তুমি অজর অমর।।
আপনি দিলেন বর আপনি বিমর্ষে।
ধ্যানে জানিলেন ব্রহ্মশাপ হবে শেষে।।
বর দিয়া দেবগণ গেল নিজ স্থান।
মলয়-পর্ব্বতে রহিলেক হনুমান।।
পিতৃঘরে আছে বীর পর্ব্বত-শিখর।
নানা বিদ্যা মল্লযুদ্ধ শিখিল বিস্তর।।
পড়িবারে গেল বীর ভার্গবের স্থানে।
চারি বেদ মল্লযুদ্ধ শিখে চারি দিনে।।
গুরু পড়াইতে নারে তারে ঘৃণা করে।
কুপিয়া ভার্গব মুনি শাপ দিল তারে।।
বানর হইয়া রে গুরুকে কর ঘৃণা।
বল বুদ্ধি বিক্রম সে পাসর আপনা।।
সেই শাপে হনুমান আপনা পাসরে।
তেঁই পলাইয়া ছিল সে বালির ডরে।।
হনুমান বীর যদি আপনারে জানে।
ভুবন জিনিতে পারে একদিন রণে।।
অযুত বৎসর যদি করি পরিশ্রম।
বলিতে না পারি হনুমানের বিক্রম।।
রাম তুমি আপনি সাক্ষাৎ নারায়ণ।
তোমার সেবক আর কি কব কথন।।
যত গুণ ধরে বীর কি কহিতে পারি।
শ্রীরাম বিদায় দেহ দেশে গতি করি।।
সে দুই বৎসর পূর্ব্ব বৃত্তান্ত কহিয়া।
স্বদেশে গেলেন মুনি বিদায় হইয়া।।
নানা ধনে পূজা রাম করেন তাঁহার।
মহাহৃষ্ট অগস্ত্য পাইয়া পুরস্কার।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিতের কাব্য সুধাভাণ্ড।
বাল্মীকি- আদেশে গায় গীত উত্তরকাণ্ড।।