উত্তরসাধক (Uttarsadhak) : 08
‘মেধা ভাটনগর’ নামটা অনেক দিন পর শুনলেন ইদ্রিস আমেদ। বয়স আশির ওপরে গিয়েছে। স্মৃতি মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে বড্ড লুকোচুরি খেলে। হিন্দি নিউজের সময় নাগাদ ফোন করেছিল মেয়েটি। ‘উজান আছে? একবার ডেকে দেবেন!’ খুব কচি-কাঁচা গলা না হলেও গলাটা নরম। অল্প বয়সের মেয়ে মনে হয়। আফতাবের মেয়ে-বন্ধুর কিছু কমতি নেই। ফোন আসছে আকচার। হই-হই করে পেন্টুলুন পরা ফ্রক-পরা মেয়েরা চলে আসে। হাউ হাউ করে কথা বলে। আমেদ সায়েব পছন্দ করছেন কি করছেন না তাদের ভারি বয়েই গেল। আস্তে চলন, আস্তে বলন দেখা যাবে না। সব ধেই ধেই করছে চব্বিশ ঘণ্টা। আজকাল সর্বত্র এই। বলে কিছু লাভ নেই। কিন্তু নাতি ফিরছে সকাল বেলায়, দুপুরবেলা বাড়ির ভাত ধ্বংস করে আবার বেরিয়েছিল, কিছুক্ষণ আগেই মৈথিলী ত্রিপাঠী ফোন করেছিল। ঘড়ি ধরে দেখেছেন আমেদ সায়েব টানা দশ মিনিট কথা বলল। আবারও মেয়ে গলার ফোন! তার ওপর যেন তেরিয়া—‘উজানকে একবার ডেকে দেবেন।’ তু করলেই যেন উজান এসে পড়তে বাধ্য। ইদ্রিস আমেদ বাহান্ন সাল থেকে এম পি। একটি দিনের জন্যও তাঁকে ক্ষমতার আসন থেকে সরে দাঁড়াতে হয়নি। কমান্ড কাকে বলে তাঁর জানা আছে। মেয়েটির কমান্ডিং টোন। স্বভাব-গম্ভীর গলাকে আরও গম্ভীর করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি—‘উজান এইমাত্র ফিরেছে গ্রাম সফর সেরে।’ দেখি তোর দায়িত্ব বোধ কি বলে! বিবেচনা বলেও তো একটা জিনিস আছে! প্রতিক্রিয়া অবশ্য ভালোই। ‘এইমাত্র ফিরল? ও আচ্ছা।’ ওকে বলে দেবেন যেন আমার সঙ্গে তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করে। আমি মেধা ভাটনগর।’
ওপক্ষ ফোনটা রেখে দেবার পরও আমেদ সাহেবের হাতে রিসিভারটা ধরা। মাথার মধ্যে ক্রিং ক্রিং করে কি বাজছে।
‘সাবেরা! সাবেরা!’—উজানের মা এসে মুখ বাড়ায়।
‘আব্বা কিছু বললেন?’
‘মেধা ভাটনগরটি কে? জানো?’
বউ ঠোঁট উল্টোলো, জানে না।
‘অঞ্জুরে ডাক তো?’
অঞ্জু এলো বেশ খানিকটা পরে, একটু যেন বিরক্ত।
‘মেধা ভাটনগর মেয়েটি কে?’
‘মেধা ভাটনগর?’ ওহো, সে তো রোকেয়ার এক নম্বর বন্ধু ছিল। আমাদের বৈঠকখানার বাড়িতে কত আসত!
‘তাই তো বলি! ব্রাইট ছিল খুব, স্কলার না?’
‘বোধ হয়। হঠাৎ তার কথা?’
‘মেধার সাথে আফতাবের যোগাযোগ কিসের?’
‘আফতাবের? মেধার সঙ্গে?’ অঞ্জুমন অবাক হয়ে তাকালেন—‘আমি তো যদ্দূর জানি মেধা বস্টনে থাকে।’
‘রুকুর সাথে তার দহরম-মহরম আছে!’
‘তুমি জানবে। রোকেয়া তো আজকাল আমাকে চিঠি দেয় না। যাই হোক, উজানকে জিজ্ঞাসা করলেই তো চুকে যায়। উজান!’
উজান সবে চান সেরে বেরিয়েছে। চানের পর তার অভ্যাস হল, একটা মাঝারি তোয়ালে দু হাতে দুপ্রান্ত ধরে পিঠ কোমর ইত্যাদি ঘষা। সে আস্তে আস্তে খেলা ছেড়ে দিচ্ছে। টেনিসটা এখনও ছাড়েনি। ক্রিকেট প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। খেলাধুলোর জগতের নোংরা রাজনীতি তাকে ছাড়তে বাধ্য করেছে। কলেজের হয়ে একটু আধটু খেলা। বাস। কিন্তু শরীর ঠিক রাখতে ব্যায়াম দৌড়নো এগুলো সে নিয়মিত করে যায়। তোয়ালে দিয়ে টানাটানি করে ডাইনে বাঁয়ে চামড়াটাকে ঘষে সে শরীরে রক্ত চলাচল ঠিক রাখে। বাবার ডাক শুনে তোয়ালে কাঁধে খালি গায়ে সে বেরিয়ে এলো।
মেধা ভাটনগর কি এখন এখানে?’ অঞ্জুমন জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ, কেন?’
‘কেন তা জানি না। আব্বা জিজ্ঞেস করছিলেন।’
উজান দাদুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, কিন্তু দাদুর মুখ দু হাঁটুর মধ্যে নেমে পড়ছে। যত রাত হয় দাদু ততই এইরকম হয়ে যান।
‘মিস ভাটনগর সম্পর্কে কি জিজ্ঞেস করছিলেন দাদু।’ উজান কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে বলল।
‘মেধা ভাটনগর তোমাকে কি করে চিনল?’ উজানের দাদুর মামাবাড়ি বাংলাদেশে। সেখানেই তিনি বাল্য কাটিয়েছেন। তাঁর বাচনে প্রায়ই বঙ্গজ ভঙ্গি মিশে যায়।
উজান বলল ‘উনি তো আমাদের প্রোফেসর।’
‘তোমাদের? মেধা তো রুকুর সাথে পড়ত। আর্টস!’
‘উনি আমাদের ফার্স্ট ইয়ারে সোশ্যাল সায়েন্স পড়িয়েছেন।’
‘অ। তোমারে ফোন করে ক্যানো?’
উজান ব্যস্ত হয়ে বলল—‘এম ভি ফোন করেছিলেন? আমাকে? এতক্ষণ বলোনি কেন?’ সে তৎক্ষণাৎ ঘর ছেড়ে যাচ্ছিল।
‘শোন, শোন, এত রাতে কোথায় যাস?’
‘ফোন করি একটা অন্তত।’
‘এতো রাতে ভদ্দরলোক ভদ্দরলোককে ফোন করে না।’
উজান বিরক্ত হয়ে বলল—‘আমি ভদ্রলোক নই।’
সে চলে যেতে অঞ্জুমন বললেন—‘কতবার তোমায় বলেছি ওকে ঘাঁটাবে না। আজকালের ছেলে। তোমাদের যুগ আর নেই। আমাদের ওপর যা লাঠি ঘোরাবার ঘুরিয়েছ।’
‘আমি লাঠি ঘুরাইছি তোদের ওপর?’ বেশ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন ইদ্রিস আমেদ। কিন্তু এখন বেশ রাত। কিরকম ঝিম ধরে গেছে শরীরটাতে। মনের ওপরও তার প্রতিক্রিয়া হয়।
ঝিমন্ত বৃদ্ধটির ফোকলা দাঁত। বাঁধানো দাঁতের পাটি পাশে কাচের বাটিতে ডোবানো। স্তিমিত চোখের দৃষ্টি। দেখতে দেখতে অঞ্জুমনের মনে হল এই আমাদের মেমবার অফ পারলামেন্ট। দেশের হর্তা-কর্তা ভাগ্যনিয়ন্তা। পরিবারেরও। লোচচর্ম, ক্ষীণদৃষ্টি, স্থবির, কিন্তু হাতে অপার ক্ষমতার শাসনদণ্ড।
উজান বারবার চেষ্টা করেও ফোনটা লাগাতে পারল না। হতাশ হয়ে বাবাকে বলল—‘আমাকে সময় মতো বলবে তো?’
বাবা বললেন—‘আমি জানলে তো! শী ওয়াজ এ জেম অফ এ গার্ল। আমাদের সময়ে। এখন কি হয়েছে জানি না।’
‘এখনও জেম’, উজান বলল, ‘তুমি ওঁকে চিনতে বাবা?’
উদাস চোখে শূন্যের দিকে তাকিয়ে অঞ্জুমন বললেন,—‘চিনতাম মানে? তোর পিসির ফ্রেন্ড ছিল। আমাদের বাড়ি কত আসত।’
‘আমাদের বাড়ি!’
‘এ বাড়ি নয়। বৈঠকখানা রোডের যেটা আব্বা বিক্রি করে দিলেন। রোকেয়ার সঙ্গে কত এসেছে, খেয়েছে, রাত কাটিয়েছে!’
উজান এই প্রথম এ কথা শুনল, সে বলল—‘রিয়ালি!’
‘রিয়্যাল না তো কি! আমাদের অতীতের তুই কি জানিস! মেধা এখনও পার্টি করে?’
‘না তো!’
‘আমারই ভুল। এখন কমিউনিস্ট রাজ। পার্টি করলে মেধা এখন কতো ইনফ্লুয়েনশ্যাল হয়ে যেত। রোকেয়ার মতো ও-ও ছেড়ে দিল। সাদী করেনি এখনও?’
‘সাদী করা না করাটা তোমাদের খুব ভাবায়, না বাবা?’
অঞ্জুমন ছেলের কথায় কেন কে জানে একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন। বললেন—‘তোরা এতো জ্যাঠা তোদের সঙ্গে কথা বলাই দায়।’
উজান হাসছিল, বলল—‘সত্যি বাবা, তোমাদের জেনারেশনে কিছু লোক বিয়ে শাদী না করলে দেশের অবস্থাটা আজ টিক এমনি হত না। নৌকো টলমল করছে একেবারে। ক্যাওড়াখালি বলে যে গ্রামটাতে কাজ করে এলাম একেবারে ছোট্ট চাষী গাঁ। কিন্তু গত সীজনে মানে গরম কালে আন্ত্রিকে মারাই গেছে পনেরটা বাচ্চা। ভাবতে পারো?’
‘বলিস কি রে? সেখানকার জল তোরা খেলি?’
‘ফোটানো হল। ওষুধ দেওয়া হল। ওদেরও ব্যপারটা শেখানো হল। মুশকিল হচ্ছে গ্রামটাতে একটাও বহতা নদী নেই। অথচ মাতলা পিয়ালী, কুমড়ো নাকি একটা নদী—সবই ওই অঞ্চল দিয়ে বইছে। মাতলা থেকে কয়েকটা খালমতো এসে ঢুকেছে, তা সে কচুরীপানায় সর্বদা ভর্তি থাকে, কাদায়, বালিতে আধবোজা হয়ে রয়েছে। জোয়ারের সাময়েও সেখানে জল ঢোকে না। বড় গোছের পুকুর একটা মাত্র। আমরা পাতকুয়া আর টিউবওয়েলের ব্যবস্থা করছি। দাদুকে বলো না কিছু ডোনেশন দিতে। অনেক টাকা লাগবে। অত তুলতে পারছি না আমরা।’
সরকারি সাহায্যের জন্যে চেষ্টা কর না, আব্বা তদ্বির করতে পারেন।’
উজানের মুখের রেখা কঠিন হয়ে গেল। বলল—‘না।’
‘কেন?’
‘না।’ দ্বিতীয়বার না’টা বলে উজান আর কথা বাড়াল না, সে সেখান থেকে চলে গেল।
এম ভির কড়া নির্দেশ আছে সরকারি সাহায্য কোথাও চাওয়া হবে না। কেন তিনি পরিষ্কার করে বলেননি, কিন্তু কেওড়াখালিতে প্রথম পর্বে গিয়ে ওরা যে সার্ভে করল তাতেই তারা বুঝতে পেরেছে সরকারি সাহায্য চাওয়া কেন অর্থহীন। সরকারের কাজ করার প্রশাসনিক বন্দোবস্ত তো রয়েছেই, পঞ্চায়েত থেকে জেলা বোর্ড পর্যন্ত ত্রিস্তর বিন্যাস। তা সত্ত্বেও তো কিছু হয়নি! সর্ষের মধ্যেই যদি ভূত থাকে কে কি করবে? সরকার গ্রামসেবকের ব্যবস্থা করে, টাকা কড়ি দিয়ে খালাস। এখন সেই অনুদানের টাকাকড়ি, ঋণের অধিকার সবই যদি পঞ্চায়েত তার ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে, গরিব মূর্খ গ্রামবাসী কি করতে পারে! কেওড়াখালিতে পঞ্চায়েতের অফিস নয়। নখানা ওইরকম গ্রাম নিয়ে তবে ওদের পঞ্চায়েতের এলাকা। গতবার ভোটের আগে কোনক্রমে একটা শ্যালো টিউবওয়েল বসানো হয়েছিল। মাস দুয়েকের মধ্যে সেটা অকেজো হয়ে যায়; বহুবার বলা-কওয়া সত্ত্বেও তাকে সারানোর ব্যবস্থা করা যায়নি। পাশের গ্রাম ফলসার অবস্থাও এমন কিছু ভালো নয়, তবে এদের থেকে ভালো। ভোটের ঠিক আগেটায়, কি পঞ্চায়েত, কি সাধারণ নির্বাচন, ওরা ঢালাও কেরোসিন তেল পায়, রাস্তাঘাটে হাত পড়ে। তারপর সব ভোজবাজির মতো উবে যায়। ওদের সবচেয়ে কাছের সম্পন্ন গ্রাম সুযযিপুর। সেখানেই পঞ্চ-এর অফিস। বি ডি ও সাহেব আসেন। মোটর গাড়ি চলার মতো রাস্তা আছে। চাইলেই কৃষিঋণ মিলছে। সে ঋণ থেকে থেকেই মকুব হয়ে যাচ্ছে। বড় বড় বর্গাদার। কাঁড়ি কাঁড়ি ফসল ঘরে তুলছে। রাজশরিক আঙুল চোষে আর জলকর গোণে।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর উজান ছাদে চলে গেল। যোধপুর পার্কের একেবারে প্রথম দিকে বাড়িগুলোর মধ্যে তাদেরটা একটা। দুতলা ছিল, তিনতলা হয়ে গেছে ইদানীং। দাদু বলেন, ‘আমি যদ্দিন আছি বাড়িয়ে যাই।’ দালান, সিঁড়ি সব পেল্লায় মাপের। ছাদের ওপর উঠলে ঢাকুরিয়া ব্রিজটা অনেকটা দেখা যায়। চকচক করছে আলোয়। সে এখন ঘণ্টাখানেক পায়চারি করবে। একটা দুটো সিগারেট খাবে। তারপর ছাদেরই ঘরে শোবে। নিচে যথেষ্ট ঘর থাকা সত্ত্বেও সে ছাদের এই ঘরখানাকে তার আসল আস্তানা করেছে। নিচের ঘরটাতে বন্দু-বান্ধব এলে বসে। বসবার ঘর। এখানে উঠে এলে নিচের সঙ্গে আর কোনও সংস্রব থাকে না। সম্পূর্ণটাই তার নিজের জগৎ। ক্যাওড়াখালি সফর করে সে দুজনকে নতুন করে চিনল। মৈথিলী আর দেবপ্রিয়। মৈথিলী যে কতটা সরল, কাজ পাগল, আন্তরিক স্বভাবের মেয়ে তা যেন নতুন করে জানা হল। স্কুল থেকেই সে মৈথিলীকে জানে। বাবার আগ্রহে সে এই কো-এডুকেশন স্কুলে ভর্তি হয়। দাদুর ভীষণ অমত ছিল। মায়েরও পছন্দ ছিল না। বাড়িতে এলেই স্কুল সম্পর্কে এই বিরূপ হাওয়াটা সে অনুভব করতে পারত।
দাদু বলতেন, ‘কি চান্দু, ইয়ার দোস্ত হচ্ছে?’
মা বলত—‘হবে না? আপনি দেখেন না কত কিসিমের ইয়ার? চুননি ওড়না ঘাঘরা। ওর বাপের ইচ্ছে-সাধ মতোই সব আসে আব্বা।’
তা সে সময়ে মৈথিলী লুকুর সঙ্গেই বেশি মিশত। আরও অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিল তার। মৈথিলী বরাবরই খুব মিশুক। উজানের তখন খেলা মন, খেলা প্রাণ। ইদানীং, ছত্রসংঘ হয়ে মৈথিলী উজানের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে। খেলাধুলোয় শরীর মনের স্ফুর্তিটা আসল কথা, তার জন্য যতটা অনুশীলন, যতটা প্রতিযোগিতা দরকার, অবশ্যই করা উচিত। কিন্তু অনুশীলন যদি জীবনের সময়টুকুকে খেয়ে নেয়, প্রতিযোগিতা যদি ক্রমশই যোগ্যতার প্রশ্ন থেকে অন্যান্য পক্ষপাত বিশেষত টাকা চালাচালির নোংরা দলাদলিতে গিয়ে পৌঁছয়, খেলার আনন্দটা আর থাকে না। উজান আফতাব উদীয়মান অল-রাউন্ডার হিসেবে ক্রমশই খ্যাতি পাচ্ছিল এমন সময় সে ক্লাব-পলিটিকসের জঘন্য আবর্তে পড়ে গেল। অন্যান্য প্রতিযোগীদের কাউকে দেখল হিংস্র, কাউকে দেখল নিরাশ। আর যেসব কর্তা ব্যক্তিদের ক্রীড়াপ্রেমী বলে শ্রদ্ধা করত তাঁদের মধ্যে ভেতরে ভেতরে লোভী পক্ষপাতদুষ্ট, কখনও বা নিজের জালে নিজে জড়ানো নির্বোধকে প্রত্যক্ষ করল সে। এই ছাতের ঘরে একদিন চলে এসেছিল আরমান। পার্ক সার্কাসে থাকে। মিডিয়াম পেস বল করে। ব্যাটও ভালো। আরমান বললে—‘উজান আমি খবর পেয়েছি, ওরা আমাদের দুজনের মধ্যে একজনকে রাখবে। তুই থাকলে আমার চান্স কম। সত্যেনদা আমার জন্যে চেষ্টা করছেন, কিন্তু বোর্ড শেষ পর্যন্ত কি করবে….।’
‘সত্যেনদা তোর জন্যে চেষ্টা করছেন? কি ভাবে?’
‘আগরওয়ালার সঙ্গে তো ওঁর খুবই আঁতাত। আগরওয়ালা যদি আমার পক্ষে থাকে…’
সত্যেনদা উজানকে কিছুদিন আগেই বলেছিলেন—‘উজান তুমি থাকছোই, তোমাকে এবার রণ্জীতে ডিসপ্লে করা হবে।
উজান বললে—‘তুই কি বলতে চাস আরমান।’
আরমান প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল—‘উজান খেলাটা তোর প্যাসটাইম। আমার কেরিয়ার। সমস্ত জীবনটা খেলায় দিয়ে দিয়েছি। জানিস তো আমাদের অবস্থা। এক পাল ভাইবোন, দুই মা, বাবা হাই-ভোল্টেজ নিয়ে কাজ-কারবার করেন। সব সময়েই রিস্ক্। খেলার সূত্রেও যদি একটা চাকরি পাই…। তাছাড়া তোর তো টেনিসও রয়েছে।’
উজান ক্লাবে যাওয়া ছেড়ে দিল। সত্যেন ঘোষ কয়েক দিন এসে ফিরে গেলেন। বাবা জানতে পেরে খুব রাগারাগি করল। ওরা কিন্তু তা সত্ত্বেও উজান, আরমান দুজনকেই রেখেছিল। উজানের ভাগ্যক্রমে টীমের দুজন বসে গেল। এক জনের বুড়ো আঙুল জখম, আরেকজনের রক্ত আমাশা। সে খেলল, দারুণ খেলছিল, আরমানের নিরাশ মুখটা মনে পড়ে, কনসেনট্রেশন নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল শেষটায়। তারপর একটা সাধারণ বলে আউট হয়ে গেল। বোল্ড্। পরে শুনেছিল, বোদ্ধারা বলেছিলেন, খেলছে ভালো, টেমপারামেন্ট নেই। আরমান আলি জান লড়িয়ে দেয়। দিক। আনন্দই যদি না থাকল তাহলে খেলার আর রইল কি!
উজান এখন অন্য খেলা খেলতে চায়। খেলা নয় কাজ। সীরিয়াস কাজ, যাতে সত্যি-সত্যি জান লড়িয়ে দেওয়ার মানে হয়। মৈথিলীই তাকে এ খেলায় এ কাজে নামিয়েছে ঠিক। কিন্তু এখন তার মনে হয় বহুকাল আগে থেকে এই কাজের জন্য সে চিহ্নিত ছিল। যে নির্বাচনী বোর্ড তাকে এখানে নামিয়েছে, তারা তার যোগ্যতা, প্রবণতা, টেম্পারামেন্ট সব বিচার করে নিঃসংশয় হয়ে একটা গুরুদায়িত্ব তার হাতে তুলে দিয়েছে অসীম আস্থাভরে।
ক্যাওড়াখালিতে হেন অসুবিধে নেই যার সঙ্গে ওরা নিজেদের মানিয়ে নেয়নি। জল নেই, জল ফোটাও, ছাঁকো, এর বাড়ি ওর বাড়ি খাও, বড়দের, ছোটদের দফায় দফায় জড়ো করো। চিৎকার করে বক্তৃতা দাও, কাছে ডেকে বোঝাও, প্রশ্নের জবাব দাও, ঘর নেই, আলুর ঘরে শোও। খড়ের গাদায়। সে এক কেলো! কিন্তু এরই মধ্যে সবচেয়ে মজার হল মৈথিলী। যেখানেই হোক ও ডায়েরি লিখবেই। ভোর বেলায়, আলো ফোটবার সঙ্গে সঙ্গে দাওয়ায় খড়ের গাদার ওপর বসে মৈথিলী ডায়েরি লিখে যাচ্ছে। পাখি ডেকে যাচ্ছে চার দিকে আধো আধো স্বরে, ছানার জলের মতো ভোরের আলো, কুয়াশা-কুয়াশা শীত, তার মধ্যে আপাদমস্তক খড়ের কুচি লাগা মৈথিলী ডায়েরি লিখে যাচ্ছে।
উজানের ভোরবেলায় ওঠা অভ্যাস। যত রাত করেই শোয়া হোক, তাকে ভোর-ভোর উঠতেই হবে। সে চলে যেত মাঠ-ঘাট বন বাঁদাড় পেরিয়ে অনেক দূরে কুলতলির মাঠ বরাবর, ভোরের টাটকা হাওয়ায় জগিংটা অন্তত করতেই হবে। গ্রামের রাস্তা দিয়ে হঠাৎ যদি সে তার ট্র্যাক সুট পরে দৌড়তে আরম্ভ করে, তাহলে হয়ত, পাগলদের কারবার বলে অপারেশন ক্যাওড়াখালির ওইখানেই পরিসমাপ্তি ঘটবে! ওর দ্যাখাদেখি কিছু কিছু স্থানীয় ছেলে অনন্ত, মুচিরাম, সমু, প্রদীপ, এরসাদ বা খোকা জগিং করতে শুরু করেছিল। উজানও সঙ্গে সঙ্গে লেকচার আরম্ভ করে দেয়।
‘হ্যাঁ এই ভাবে এক জায়গায় দৌড়ও। পায়ের পেশী শক্ত হবে। কোমর, শিরদাঁড়া সব নরম থকবে। শরীরটাকে নিয়ে যা খুশি করতে পারা চাই। জানো তো শরীরমাদ্যং। আগে স্বাস্থ্য ভালো করো, তবে অন্য সব।’
সমু বলল—‘নিরঞ্জনদা এক লপ্তে দশ মাইল হাঁটতে পারে।’
অনন্ত বলল—‘কুড়ি কুড়ি চল্লিশ কেজি মাল দু কাঁধে বইতে পারবে।’ অর্থাৎ নিরঞ্জন খাঁড়া হেড মাস্টারমশাই ওদের স্থানীয় হিরো। ওরা আশা করছিল উজান বলবে—‘আমিও পারি।’ উজান মনে মনে হাসল, বলল ‘তোমরাও চেষ্টা করো।’
‘নিরঞ্জনদা এক কাঠা চালের ভাত খেয়ে নেবে একটা গোটা পাঁঠা দিয়ে। আবার উপোস থাকবে তিনদিন চারদিন।’
‘তাজ্জব কি বাত! বাঃ।’
এরসাদ বলল—‘আপনে মুসল্মান?’
উজান হেসে বলল—‘হ্যাঁ, কেন?’
‘পাঁচ ওয়ক্ত নেমাজ পরেন?’
‘এ কথা জিজ্ঞেস করছো কেন?’
‘কাল শুককুরবার ছিল মসজিদে গেলেন না তো!’
‘কাল সারাদিন তোমাদের খাবার জলের ব্যবস্থা করার জন্যে ঘুরেছি এরসাদ। দেখোনি! কোথায় কুয়ো হবে কোথায় টিউবওয়েল, হাতল ঠেলবে আর মাটির ভেতর থেকে জল এসে তোমাদের মুখে পড়বে’, মজা করে জিনিসটা করে দেখাল উজান।
‘অর্জুনের বাণে যেমন ভীষ্মের মুখে জল পড়েছিল?’ সমু বলল।
‘ঠিক ঠিক।’ উজান উৎসাহের সঙ্গে বাহবা দেয়। ব্রাঞ্চ লাইনে চলে গেল আলোচনা। স্বাস্থ্য থেকে ধর্মাচরণ, ধর্ম থেকে পুরাণ। তা সত্ত্বেও উজান গ্রামের বালক বালিকাদের কিছু যোগাসন, কিছু ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম দেখিয়ে দিয়ে এসেছে। ওরা ফুটবল চায়, ক্রিকেটের ব্যাট বল, উইকেট চায়, সেগুলোর প্রতিশ্রুতি দিতে হল। খাদ্য সম্বন্ধে ওদের বলবার কিছু নেই। যা পায় তাই খায়। সঙ্ঘের পরবর্তী প্রোগ্রামে আছে গ্রামে একটা ডেয়ারি এবং পোলট্রি স্থাপন করা। আশেপাশে জলায় মাছ জন্মায়, কিন্তু চারদিকের যত ক্ষেত ভাসা জল সেখানে এসে পড়ে, তাতে পোকামারা ওষুধ থাকে, ফলে ওই জলার মাছ খেলে তখন এদের সাংঘাতিক পেটের গোলমাল হয়ে যায়। নদীর মাছ ওরা খাবার জন্য পায় না কখনোই। এ বিষয়টা নিয়েও ওরা অলোচনা করেছে। কুয়ো এবং নলকূপের সংখ্যা যদি পরিকল্পনামাফিক বাড়ানো যায় তাহলে স্নান খাওয়া এবং অন্যান্য কাজের জলের অভাব থাকবে না। সেচের সমস্যারও সমাধান হবে। মাঝের পুকুর, মাতলা-পিয়ালির মজা খাল আর জলাগুলো সম্পর্কে কিছু করা যায় কিনা, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে। প্রমিত আর বুল্টু শিগগীরই বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। কিন্তু খোঁজখবরগুলো আসলে নেবার কথা ছিল দেবপ্রিয়র।
‘ব্রাইটেস্ট ইয়ংম্যান অফ দা ইয়ার’ বলে মৈথিলী তার সহপাঠী দেবপ্রিয় চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করায় উজানের।
উজান বলে, ‘প্রাউড টু মিট ইউ।’
দেবপ্রিয় বলল—‘খেলো? তোমার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে ছিল।’ কিন্তু ইচ্ছেটা খুব বলবান বলে কখনও মনে হয়নি উজানের। কেমন একটু আলগা ভাব। সুইচ লুস কনট্যাক্ট্ হয়ে গেলে যেমন আলো কখনও জ্বলে, কখনও জ্বলে না, দেবপ্রিয়র সঙ্গে সম্পর্কও তাই। এই একগাদা কাজ করে ফেলল। যা বলা হল তাও, যা না বলা হল তা ও, তারপরই হঠাৎ ফিউজ। হঠৎ ওকে লক্ষ্য করলে মনে হবে খেয়ালী। কিন্তু তা নয়, ওর ভিতরে কিছু গণ্ডগোল আছে। একে অত্যন্ত সিক্রেটিভ টাইপ। তার ওপরে এইরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন। আসব বলে শেষ মুহূর্তে এলো না কেওড়াখালিতে। স্টেশনে বহুক্ষণ অপেক্ষা করেছে তারা ওর জন্য। সেদিন দেরি হয়ে গেলেও পরে নিজে নিজেই আসতে পারত। কিন্তু একদম ডুব গেলে আছে। বেশ কিছুদিন থেকেই সে লক্ষ্য করছে দেবপ্রিয় কারো সঙ্গে বিশেষ মিশছে না, ছাত্রসংঘের ব্যাপারে গা করছে না। এমন কি একটা কাজ করব বলেও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ কি, ওদের কারোই জানা নেই। মৈথিলী খুব চিন্তিত। কিন্তু উজানের চিন্তা আরও বেশি। দেবপ্রিয় গোপনে গোপনে কোনও রাজনীতি করে কি না তা-ই কে জানে! সে গ্রাম-ট্রামের ব্যাপারে বেশি জানে বলেই তার ওপর ওরা নির্ভর করছিল। হঠাৎ একটা কথা মনে হল উজানের। দেবপ্রিয়, ব্রাইটেস্ট ইয়ংম্যান অফ দা ইয়ার কি উজান আফতাবের প্রাধান্য চায় না! গ্রামের ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে, ওর কি উজান মুসলিম বলে কোনও সংস্কার আছে? তা যদি থাকে তো দেবপ্রিয় চৌধুরী ছাত্র সংঘে একেবারেই থাকবার যোগ্য নয়। তাদের প্রতিষ্ঠানে উপায় এবং লক্ষ্য, এন্ড মীনস শতকরা শতভাগ শুদ্ধ হতে হবে। যেমন তেমন করে সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হল, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় থাকবার জন্য যা করছে, কে সুযোগসন্ধানী, কে সমাজবিরোধী, কে অতি রক্ষণশীল, কে ধর্মান্ধ এসব চিন্তা না করেই, এ জিনিস যে কখনো মঙ্গল আনতে পারে না, তা দেশের বর্তমান অবস্থা দেখেই স্পষ্ট বোঝা যায়। উজান আফতাব ছাত্রসঙঘর সেক্রেটারির পদ দেবপ্রিয়কে দিয়ে দিতে পারে কিন্তু দেবপ্রিয় বৃথা ঈর্ষা করলেও না, আর মুসলিম বলে তার সঙ্গে সহজ হতে পারছে না বলেও না। দেবপ্রিয়কে প্রমাণ করতে হবে সে উজানের চেয়ে বেশি যোগ্য, বেশি উদারচেতা। এগুলোর কোনটাই সে এখনও প্রমাণ করতে পারেনি। এ নিয়ে মৈথিলীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। খুবই অপ্রিয় প্রসঙ্গ। তবু। এম ভির সঙ্গেও। সম্ভব হলে। এম ভি কেন ফোন করেছিলেন জানা হল না, কাল সকালে চলে যাওয়া যেত। কিন্তু তখন উনি ব্যস্ত থাকবেন। বরং সন্ধের দিকটায় গেলে হয়ত অসুবিধে হবে না। ফোনটা ভালো বলছে না, ডেড মনে হচ্ছে।