Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » উত্তরসাধক || Bani Basu » Page 7

উত্তরসাধক || Bani Basu

…‘সেদিন আপনাকে বলা হয়নি ছাত্রসংঘ থেকে আমার তফাত থাকার কারণ। সব কথা আজও বলতে পারছি না। সময় আসেনি। শুধু এইটুকু বলছি আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টা বানচাল করে দেবার একটা ষড়যন্ত্র কোথাও খুব গোপনে কাজ করে যাচ্ছে। আপনারা সতর্ক থাকবেন। আমি দরকার হলে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে এই ষড়যন্ত্র আটকাবো। ওখানে কাজ করার লোক এখন অনেক। কিন্তু ডিফেন্স ফ্রন্ট-এ কেউ নেই। চট করে কাউকে বিশ্বাসও করতে পারছি না। ঝড়ু ওঠার আগে প্রকৃতির চেহারা এমনি হয়। আমার দেখা আছে। সে সময়ে মাঝিরা নদী থেকে ডিঙি তুলে ফেলে। আমি এখন ডিঙি তুলে ফেলার পক্ষপাতী…।’

ছেলেটা এতো ভাবুক-প্রকৃতির, কবি-কবি তা তো জানা ছিল না? কথা বলে কম। এখনকার ছেলেমেয়েরা ঠিক এই ভাষা, এই সব তুলনা, চিত্রকল্প ব্যবহার করে না। চিঠিটা আদ্যোপান্ত দুবার পড়লেন মেধা। হঠাৎ মনে হল দেবপ্রিয় ছেলেটি কোনও মানসিক ব্যাধিতে ভুগছে না তো? প্যারানয়েড যাকে বলে! মফস্বল শহরের অপেক্ষাকৃত সরল পরিবেশ থেকে সে অতি জটিল শহুরে সভ্যতার আবর্তে পড়েছে, অনেকেই মানিয়ে নিতে পারে না। কিন্তু ছেলেটি অতি বুদ্ধিমান, উপরন্তু অন্তর্মুখী প্রকৃতির। সে তো সহজে তাঁর এই ব্যাখ্যা মেনে নিতে চাইবে না! ওকে অন্যভাবে সুস্থ করতে হবে। ও খুব অস্পষ্টভাবে ওর ভয়ের একটা ধারণা দিয়েছে। ওকে সাহস দিতে হবে যাতে ও স্পষ্ট করে ওর ধারণার কথা বলতে পারে। বড় বড় কাজের সামনে দাঁড়িয়ে এ রকম ভেঙে পড়তে তিনি অনেক বিপ্লবীকে দেখেছেন। মেধা তাঁর ঠিকানা ও ফোন নম্বরের নোটবইটা উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলেন। ফোন নম্বর রয়েছে মৈথিলীর, লুকুর, উজানের, গুঞ্জনের…। দেবপ্রিয়র কিছু নেই। কোনও ঠিকানা সে চিঠিতেও দেয়নি। কি করে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন তিনি?

উজানকে ফোন করলেন মেধা। উজানের দাদু ফোন ধরেছেন বোধ হয়। ভাঙা গলা। কথাগুলো ফস্কে ফস্কে যাচ্ছে বোঝা যায়। দাঁত পরেনি বোধ হয়। উজান নাকি সবে ফিরেছে কেওড়াখালি থেকে। একটু যেন অসন্তুষ্ট ভদ্রলোক। মেধা নিজের পরিচয় দিয়ে ফোনটা নামিয়ে রাখলেন।

সারা পৃথিবী একভাবে চলছে। ভারতবর্ষ চলবে অন্যভাবে। এখানে এখনও পণ দিয়ে বিয়ে হচ্ছে আইন করে তা বন্ধ করে দেওয়ার পরেও, এখনও এখানে পণের প্রশ্নে বউ পিটিয়ে হত্যা করা হয়, এখনও বিধবা মেয়ে বিয়ে করার অপরাধে নিজের মা মেয়েকে খুন করে ফেলে। কলকাতার বুকে কোনও ছেলেকে কোনও মেয়ে ফোন করলে অভিভাবকের বিরূপ প্রতিক্রিয়া বোধ হয় এই সামাজিক পরিবেশে ভালোই খাপ খেয়ে যায়। ঢং ঢং করে ন’টা বাজল। হঠাৎ মেধার মনে হল যে সমস্ত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তিনি ক্রমাগতই জড়িয়ে পড়ছেন, তাদের সঙ্গে মেলামেশাটা যেন বড্ড বেশি তত্ত্বগত স্তরে হচ্ছে, তাদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তিনি কিছু জানেনও না, জানার চেষ্টাও করেন না তেমনভাবে। নিজেদের পরিবারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কি, তাদের বাবা মা দাদু এঁরা কে কিভাবে এদের গ্রহণ করেন এগুলো জানা দরকার। কারণ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু স্বার্থের তো নয়ই, শুধু অন্ধ ভালোবাসারও হওয়া উচিত নয়। বাবা-মার আদর্শ আর ছেলে-মেয়ে কী করতে চায়, এ দুটো জিনিসের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য, খানিকটা আপস থাকা দরকার। নইলে পরিবার ভেঙে যেতে থাকবে। পরিবারের কোনও বিকল্প নেই। মুক্ত মানুষের যৌথ সমাজব্যবস্থা, সরকারের হাতে সন্তানের নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎ কোনও কিছুই পারিবারিক সম্পর্কের মাধুর্য ও সৌন্দর্যের জায়গা নিতে পারবে না। গাছপালা, ফুল পাখি, আকাশ, মেঘ, বাতাস মিলিয়ে প্রাকৃতিক পরিপার্শ্ব যেমন সুস্থ সুন্দর জীবনের পক্ষে অপরিহার্য, ঠিক তেমনি অপরিহার্য মায়ের টান, বাবার দায়িত্বশীল স্নেহ, ভাইবোনের পারস্পরিক মমতা। যান্ত্রিক এবং আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও অগ্রগতি যদি পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে তো সে মূল্যে যন্ত্র সভ্যতা, এমনকি বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিও কেনার কোনও অর্থ হয় না।

কেওড়াখালিতে ওদের সঙ্গে তাঁর যাওয়া উচিত ছিল। আসলে নন্দিতা ও সূর্যর সঙ্গে ঘুরে এসে তিনি একটা খসড়া করে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে প্রথম পর্বটায় ডাঃ সোম যান, দ্বিতীয় পর্বে তিনি যাবেন। এখন মনে হচ্ছে তাঁরই যাওয়া উচিত ছিল। ছেলেমেয়েদের একলা ছেড়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। এর থেকে সত্যিই অনেক জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। ডাঃ সোম একেবারে বোমভোলা ধরনের মানুষ। আর মৈথিলী তো একটা কুড়ি-একুশ বছরের বাচ্চা মেয়ে। খুব পরিণত, বিচক্ষণ,। কিন্তু বয়সটা তো অল্পই। তাঁকে যখন উপদেষ্টা হিসেবে চেয়েছে এবং তিনিও রাজি হয়েছেন তখন তাঁকে আরও ভেতরে ঢুকতে হবে, আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। আসলে বহুবছর আমেরিকায় থেকে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের প্রখর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য দেখে দেখে তাঁর অভ্যাসটা এই রকম হয়ে গেছে। কিন্তু এটা ভারতবর্ষ। এখনও এখানে উপমন্যু-উদ্দালক, এখনও এখানে গার্গী মৈত্রেয়ী খনা লীলাবতী ছেলে-মেয়েদের রক্তে মিশে আছে। ওরা অনেকেই গুরুর আশীর্বচনের ওপর নির্ভর করে, শুধু আচার্য বলেই তাঁর নেতৃত্ব, অনেক অন্যায়ও মেনে নেয়। নিয়ে থাকে। এ তিনি প্রতিনিয়ত দেখছেন।

দরজায় বেল বাজল। নিশ্চয় উজান। বেচারি বোধ হয় চান-টান সারছিল, মিস ভাটনগরের ফোন এসেছিল, তাকে ডেকে দেওয়া হয়নি বলে সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছে। কোনও মানে হয়! দরজা খুলে দিয়ে মেধা দেখলেন রঘুনন্দন।

—‘আরে?’

–‘এলাম। বড়ই প্রাণের দায়ে মেধা…’ রঘুনন্দন ভারি পায়ে ভেতরে ঢুকলেন।

—‘বসো, কফি আনি।’

—‘আনো। আর কিছু না।’

মেধা কফি নিয়ে এসে বসলেন। রঘুনন্দন আপনমনে একটা দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে কানে সুড়সুড়ি দিচ্ছেন। চোখ আরামে বুজে আসছে। মেধা কফিটা নামালেন একটু শব্দ করে। চোখ মেলে রঘুনন্দন বিনা ভূমিকায় বললেন—‘আমার মেয়েটা ভাবালে। রাতে বাড়ি ফিরছে না। কি সব আউল-বাউল ট্যাঁকে করে ঘোরে, হিপি-টিপি হয়ে যাবে না কি বলো তো? জানো কিছু?’

আজকে মেধার অভিজ্ঞতায় এটা দ্বিতীয় অভিভাবকীয় প্রতিক্রিয়া। তিনি বললেন—‘আমি জানি এ কথা কেন মনে হল তোমার?’

রঘুনন্দনের পরনে গ্রে রঙের স্যুট। ব্রাউন টাই। চুলগুলো পরিষ্কার পাট পাট আঁচড়ানো। তা সত্ত্বেও মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। খুব সম্ভব অফিস থেকে এখনও বাড়ি ফেরেননি। তিনি বললেন—‘কি জানি! মেধাদি মেধাদি করে তো ক্ষেপে যাচ্ছে মেয়েটা। তিনি বললেন—তার মা মেয়ের কথা ভেবে ভেবে দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছে এদিকে। —‘আমি জানি এই যদি তোমার ধারণা হয়, তবে আমার ওপর ভরসাটাও রাখা উচিত ছিল।’

—‘দেয়ার য়ু আর। তোমাকে যদ্দূর জানি ভয়ঙ্কর উত্তেজক বিস্ফোরক তুমি মেধা, দায়িত্বশীল একেবারে নয়। অন্তত ছিলে না। আজ যে হয়েছে এ ধারণা করার কোনও কারণ দেখি না।’

মেধা ঠিক করে নিয়েছেন রাগ করবেন না, অন্তত দেখাবেন না। তিনি স্মিত মুখেই জিজ্ঞাসা করলেন—‘এ ধারণার কারণ দেখাও। শুধু শুধু কতকগুলো অভিযোগ তুললেই তো হবে না!’

—‘কারণ আমায় বলতে হবে?’ রঘুনন্দন কি ঈষৎ উত্তেজিত? ‘ডাঃ ভাটনগরের মেয়ে হয়ে কীর্তিদা মুক্তির বোন হয়ে ঊনসত্তর সালে তুমি প্রায় জেলে চলে যাচ্ছিলে? যাচ্ছিলে না? তখন তুমি কতটুকু? মুন্নির চেয়েও বোধ হয় ছোট। বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরের মধ্যে তোমার আরও একবার জেলে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। প্রজ্ঞা সেবার বুদ্ধি করে তোমাকে হংকং-এ আটকে, তারপরে য়ুরোপ বেড়াতে নিয়ে না গেলে তুমি হয়ত ঠিক এই মেধা হয়ে আর জেল থেকে বেরোতে না।’ …রঘুনন্দন আবার দেশলাইয়ের কাঠিটা কানে ঢোকালেন। গাঢ় নীল শাড়ির অন্তরালে মেধা নিজেও যেন নীল, সেই সঙ্গে কঠিন হয়ে উঠছেন, গলার স্বর থেকে রস উবে যাচ্ছে একটু একটু করে, বললেন—‘বলো, বলো রঘুদা, থামলে কেন? এই তোমার অভিযোগ? চুরি ডাকাতি কি হত্যার অপরাধে নিশ্চয়ই জেলে যাচ্ছিলাম না। আর দেশসুদ্ধ বয়স্ক লোক যখন নিজেরা ভাত পেয়েছে এই আত্মপ্রসাদে মগ্ন হয়ে হাই তোলে আর ভাত-ঘুম দেয় তখন ছোটদের ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া উপায় কি? নীলকমল না জাগুক, লালকমলকে তো জাগতেই হয়! সে হয়ত অতটা প্রাজ্ঞ নয়, তাই রাক্ষসের কবলে পড়াও তার ভবিতব্য। যাই হোক, এসব বারবার বলে তো লাভ নেই! সে অধ্যায় পুরনো হয়ে গেছে। সে আমার একার সিদ্ধান্ত নয়। একার সাফারিংও নয়। আমার নিজের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রমাণ তুমি কোথায় পেলে?’

চোখটা আধখোলা করে রঘুনন্দন বললেন, ‘অমিয় সান্যালকে বিয়ে করে তার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত কোনও সম্পর্ক রাখলে না।’

—‘তুমি কি করে জানলে?’ মেধা অবাক হয়ে গেছেন।

—‘কেন? তুমি কি নিজের কার্যকলাপ গোপন রাখতে চাও?’

—‘যতটা দরকার তার বেশি কখনোই নয়। তখন প্রয়োজনে চেয়েছিলাম। জেলবন্দী একটা মানুষ যদি ক্রমেই চিঠিপত্র দেওয়া বন্ধ করে দেয় এবং তার ঘনিষ্ঠরা যদি ক্রমশই তোমাকে এড়িয়ে চলতে চায়, কিভাবে তুমি সম্পর্ক কনটিনিউ করবে?’

—‘কাজটা শক্ত, খুবই শক্ত। কিন্তু মেধা তুমি চেষ্টাও করোনি। এটা ঠিক দায়িত্বশীল নারীর বা মানুষের কাজ নয়।’

মেধার মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে, রঘুনন্দন আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে বললেন—‘রাগ করো না মেধা আমার প্রতিও তুমি দায়িত্ব পালন করোনি।’

—‘অন্যায় কথা বলো না রঘুদা’, মেধার স্বর এখন আড়ষ্ট’, ‘আমি তোমায় কখনও কোনভাবে প্রশ্রয় দিইনি।’

—তোমাদের মনে হচ্ছে দাওনি। আমার মনে হচ্ছে দিয়েছ। যাই হোক ওটা না হয় কনট্রোভার্শিয়াল, ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু এদের মাথায় কী ঢুকিয়েছ বলো তো? মুন্নি বাম রাজনীতি করলে আমার ঘোর বিপদ। বুড়ো বয়সে কি শেষে ডিমোটেড হবো? জানি, তুমি আমার বিপদের কথা ভেবে আমার মেয়েকে সাবধান করবে না, তবু না জানিয়ে পারছি না।’

মেধা বললেন—‘রাজনীতি আমি অনেকদিন ছেড়ে দিয়েছি রঘুদা। কোনদিন করেছি বলেও পুলিশের খাতায় প্রমাণ করতে পারবে না। নইলে সরকারি কলেজে চাকরি নিয়ে ফিরে আসতে পারতাম না। এসব কথা তোমার মতো সরকারী লোকের কেন জানা নেই তা জানি না। আর তোমার মেয়ে যেটা করবে মনে করে সেটা করে তবে ছাড়ে, আমার কাছে মাঝে-মধ্যে শুধু একটু পরামর্শ নেয়। তুমি কি বলছো পরামর্শটাও ওকে দেবো না?’

—‘ওকে একটু হোম-এর দিকে চালিত করো। যদি পারো। “চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম””—এই সোজা কথাটা মেয়েটাকে বোঝাতে পারি না মেধা। ও অনেকটা তোমার মতোই। আমার মেয়ে অথচ তোমার মতো। কী সাংঘাতিক বলো তো?’

রঘুনন্দন উঠে পড়লেন; বললেন—‘মনে রেখো প্লীজ।’

—‘ও বাম ডান কোনও রাজনীতিই করে না।’

—‘করে না?’—অবিশ্বাসের সুরে বললেন রঘুনন্দন।

—‘ও দেশের সচেতন, দায়িত্বশীল নাগরিক। শুধু নিজের কেরিয়ার নিয়ে মত্ত থাকতে তোমার মেয়ের ঘৃণা হয়, অবশ্য ইফ শী ইজ কেপেবল অফ হেট্রেড।’

—‘এগুলো তোমার অ্যানালিসিস?’

—‘আমারই। কিন্তু এগুলো স্বপ্রকাশ। ওকে সিরিয়াসলি নিলেই বোঝ যায়। ও তো খুব জটিল মানুষ নয়!’

—‘বাঁচালে, রঘুনন্দন দরজার ওপারে যেতে যেতে বললেন, ‘আমার ধারণা ছিল ও খুব জটিল, গোপনতাপ্রিয়… আসলে বসা হয় না। যদি বা হয় এতো দীর্ঘ সময় পরে পরে যে এসব প্রসঙ্গ তুলতে ইচ্ছে করে না।’

—‘অথচ এগুলোই আসল। সন্তানকে জানাটা বাবা-মার সবচেয়ে বড় কাজ, বাবা-মা হিসেবে। এনি ওয়ে, আমি তোমার প্রতি দায়িত্বশীল না হওয়ায় তোমার কিন্তু লাভই হয়েছে’, মেধা অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন।

—‘আর তোমার? তুমি কি লাভ-ক্ষতির ঊর্ধ্বে না কি?’

—‘ঠিক তাই…। এতক্ষণে একটা ঠিক কথা বললে।’

মেধা হাসিমুখে বললেন, যদিও তাঁর ভেতরটা জ্বলছিল। রঘুনন্দন ত্রিপাঠীর গাড়ির আলো বাঁক ফেরবার আগেই তিনি দরজা বন্ধ করে দিলেন।

দোতলায় এসে কোল্যাপসিবলটা টেনে দিলেন অভ্যাসমতো। তালা লাগাবার সময়ে একবার মনে হল উজান যদি আসে। ঘড়ির দিকে তাকালেন, না উজানের আসবার আর কোনও সম্ভাবনাই নেই। ফোনও করল না। ছোড়দারা অনেক দিন আসেনি। হঠাৎ একা-একা লাগল। প্রজ্ঞা যেখানেই থাকুক, দু-তিন মাস অন্তর একবার অন্তত দীর্ঘক্ষণ ধরে ফোন করে। ফোনে কি ওকে বকা যায়? বকার জন্য দু চার দিনের অন্তত অবসর পাওয়া দরকার। তাঁর গোপন কথাটা প্রজ্ঞার ফাঁস করে দেওয়া উচিত হয়নি। বিশেষত, রঘুনন্দন ত্রিপাঠীর কাছে। তিনি বিয়ে করেছিলেন আঠার উনিশ বছর বয়সে সে বয়সটা বীরপূজার, আত্মনিবেদনের, বিদ্রোহের বয়স। বন্ধু রোকেয়া রোদ, জল, ঝড়ু উপেক্ষা করে মিছিল করত, বক্তৃতা করত। এইভাবে একটি সম্পন্ন পরিবারের মেয়ে যার কিছুর অভাব নেই সে মার্কসিজমের জন্য জীবনপাত করে দিচ্ছে, এতে একটা অসামান্য বিস্ময় এবং রোমাঞ্চ ছিল। আত্মগ্লানি হত একেক সময়ে। রোকেয়া কথা বলত অত্যন্ত মধুরভাবে, কখনও তর্কাতর্কির সময়ে মেজাজ খারাপ করত না। উল্টোনো ড্রাম কি প্ল্যাটফর্মের ওপর তার বক্তৃতা ছিল এক রকম—ধারাল, জ্বলন্ত, কিন্তু মুখোমুখি বা পাশাপাশি বসে সে যখন শ্রেণীসংগ্রাম, সামন্ততন্ত্র ধ্বংস করে বুর্জোয়াদের অভ্যুত্থান, প্রোলেতারিয়েতদের আবির্ভাব, উৎপাদন-উৎপাদকের সম্পর্ক, সংঘবদ্ধ প্রোলেতারিয়েতের শাসনযন্ত্র দখল এবং কমিউনিজমের প্রথমাবস্থায় সব কিছুর সরকারি মালিকানার তত্ত্বের কথা বোঝাতো তখন সেটা প্রায় প্রেমালাপের মতো মধুর এবং রোমাঞ্চকর শোনাতো!

মাথার ওপর চিকন সবুজ পাতার মধ্যে দিয়ে হলুদঝুরি ফুল নেমেছে। কেউই তার নাম জানে না। মেধা সেগুলো নিয়ে কবিতা রচনা করত ‘কুমারী লতার ডালে ডালে/কত মৃত আকাঙক্ষার কর্ণভূষা দোলে,/ হায়, ধু ধু অগ্নি জ্বলে।’ রোকেয়া হেসে বলত এই রোমান্টিক কবিতা তোকে কোথায় কতদূরে নিয়ে যেতে পারবে মেধা! আর তোকে যদি ব্যক্তিগতভাবে একটা মূর্খের স্বর্গে নিয়ে যায়ও শত সহস্র লক্ষ কোটি মেহনতি মানুষ বুর্জোয়া শিল্পের যন্ত্রের হাতে যাদের শ্রমের আনন্দ ও মর্যাদাটুকু পর্যন্ত লোপ পেয়েছে, যাদের শুধু শ্রমের প্রয়োজনে অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রাখার জন্য যতটা প্রয়োজন তার চেয়ে এক কড়াও বেশি দেওয়া হয় না, তাদের কোথায় নিয়ে যাবে?

মেধাকে স্বীকার করতেই হত এই সব কাব্যচর্চা তাকে জীবনের গভীরতর স্তর যাকে রোকেয়া মূর্খের স্বর্গ বলছে, সেখানে নিয়ে যেতে হয়ত পারবে। কিন্তু চাষী, চটকলের শ্রমিক এদের সেখানে পৌঁছবার কোনও আশা নেই। এবং যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই রকম নিরন্ন, নিরক্ষর, নিঃসহায়, সেখানে সমর্থ মানুষের পক্ষে কাব্য-চৰ্চা, এমন কি নিছক বিদ্যা-চর্চাও স্বার্থপরতার শামিল।

—‘হ্যা, তুই ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে পাশ করবি, তারপর কোনও কলেজে, কি ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হয়ে ঢুকবি, লেকচারার, রীডার, প্রোফেসর…। ভালো ভালো শাড়ি পরবি। খুব পদস্থ কাউকে বিয়ে করবি, দুটি তিনটি ব্রিলিয়ান্ট সন্তান, সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটবে, হয়ত বা এ দেশে থাকবিই না। তোর বাড়ির যা ব্যাকগ্রাউন্ড, তাতে সেটাই স্বাভাবিক। যা মেধা, তাই যা। ইন দা মীন টাইম…এই সব ইশাক, রজ্জব, হরিপদ, রামহরি, শিবু, কেষ্টা, রানী খালেদা, লক্ষ্মীমণি, অন্নদা, এরা মুখে রক্ত উঠে মরে যাবে। জেনারেশনের পর জেনারেশন একভাবে মরবে। আল্লার দোয়া চাইবে, দেবমন্দিরে দণ্ডি কাটবে, পীরের দরগায় শিরনি চড়াবে, আর মরে যাবে। আমি রোকেয়া, আমার মতো আরও অনেকে যেমন অমিয়দা, সুন্দরলাল অসীমাভ আমরা যারা প্রতিবাদ করবো, ওদের মুখে ভাষা দিতে চাইবো, ওদের গর্জে উঠতে শেখাবো, তারা জেলে পচব।’

মেধা বলতো—‘কিন্তু উপায়ই বা কি? রোকেয়া আমি যদি আজ আমার জীবনটা স্যাক্রিফাইসও করি, তাতেই কি জেনারেশনের পর জেনারেশন মানুষের মুখে রক্ত উঠে এইভাবে মরা থামবে? থামবে কি? বল তুই?’

রোকেয়ার চোখ জ্বলজ্বল করত—‘যদি বলি থামবে?’

‘আমার একার চেষ্টায়? থামবে? তুই বলছিস কি?’

—‘তুই মনে করছিস তুই একা। কিন্তু আসলে তো তুই একা নয়। তোর মতো আরও অনেক বুদ্ধিজীবী পরিবারের সমর্থ ছেলেমেয়ে আছে যারা শক্তিটা নিজেদের কেরিয়ার গড়বার কাজে পুরোপুরি খরচ করে। তারা যদি বোঝে। বুঝছেও, সারা পৃথিবী জুড়ে বুঝছে। দলে দলে যোগ দিচ্ছে, সেক্ষেত্রে তো তুই একা থাকছিস না।’

—‘ঠিক আছে, দশ, বিশ, ত্রিশ জন আমার মতো যোগ দিল। তাতেই বা এই কোটির দেশে কি হবে?’

—‘কি করলে কিছু হবে তুই-ই বল।’

একটু ভেবে নিয়ে মেধা বলল—‘সরকারকে সচেতন হতে হবে, সরকারি লেভল থেকে যদি কতকগুলো সঠিক নীতি নেওয়া হয়, একমাত্র তবেই…’

—‘বাস, বাস। তুই তাই মনে করিস তো?’ রোকেয়া উৎসাহে টগবগ করছে।

‘সরকারকে সচেতন করাটাই আপাতত আমাদের কাজ। আপাতত।

প্রধানত রোকেয়ার উৎসাহেই অমিয়নাথ সান্যালের ক্লাসে যাওয়া। নকশাল আন্দোলনের শুরুতে যখন চারদিকে গরম হাওয়া বইছে, সেই সময়ে পার্টি অফিসে অমিয়নাথ সান্যাল নামজাদা মার্কসিস্ট নেতার সঙ্গে মেধা ভাটনগরের বিবাহ। সান্যালদা বললেন—‘মেধা তোমার পদবী পাল্টানো না পাল্টানো তোমার ইচ্ছে। বিবাহ মানে আমি বুঝি দুটি স্বাধীনতার সমন্বয়।’ মেধা পদবী পাল্টালো না। ঠিক হয়েছিল আস্তে আস্তে খবরটা ভাঙা হবে বাবা-মার কাছে। সাতদিনের মধ্যে সান্যালদা অজ্ঞাতবাসে চলে গেলেন।

ওঁর কিন্তু আসল ইচ্ছে ছিল রোকেয়াকেই বিয়ে করা। রোকেয়া প্রায় শিশুকাল থেকে মার্ক্সসিস্ট বুলি কপচে মানুষ। অক্লান্ত কর্মী। কতজনকে যে সে দলে নিয়ে এসেছে তার ইয়ত্তা নেই। পার্টির নেতারা তার কাছে কৃতজ্ঞ। তার জ্বলন্ত আত্মপ্রত্যয়ের মূর্তি নিশ্চয় অনেকের মনে আগুন জ্বালাত। অমিয় সান্যালের সঙ্গে পাশাপাশি কাজ করছে সে একেবারে গোড়ার থেকে। এই বালিকার টিউটর ছিলেন অমিয়দা।

ওকেই খুব সম্ভব বিবাহের প্রস্তাবটা প্রথম দিয়েছিলেন সান্যালদা। রোকেয়া কিছুতেই রাজি হয়নি। ব্যাপারটা আন্দাজ করে মেধা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল—‘কেন তুই অমিয়দাকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিস না?’

রোকেয়া বড় অদ্ভুত উত্তর দিয়েছিল, একেবারেই রোকেয়ার মতো নয়, বলেছিল —‘আমাদের পরিবারে আমি একটা প্রচণ্ড প্রবলেম মনে করে সব্বাই। আমাকে, দাদাকে পড়াবার জন্য অমিয়দাকে টিউটর রাখলেন বাবা, পড়ালেখা তো শিখলাম ভালোই, সেই সঙ্গে বাবার উল্টো রাজনীতি। বাবা গোঁড়া কংগ্রেস, এত বছর ধরে এম. পি। দাদা আমি মার্ক্সসিজম করি বলে বাড়িতে ভীষণ অশান্তি। মাকে এর জন্য বাবার কাছে ভীষণ লাঞ্ছনা খেতে হয়। এগুলো আমি যথেষ্ট স্যাক্রিফাইস বলে মনে করি। ফ্যামিলির প্রতি কর্তব্য আমি পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারি না। বাবার আশ্রয়ে আছি, মায়ের স্নেহ ভালোবাসা পাচ্ছি এতো সত্ত্বেও, না হলে কি আমি এতো নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারতাম? কিন্তু বাবাকে আমি ফারদার আঘাত দিতে পারব না। কাউকে বলিসনি, আমি অমিয়দা এবং অন্যান্যদের সবাইকে বলেছি—‘আমি বিয়েতে বিশ্বাস করি না। বিয়ে করবই না।’

—‘বাবাকে খুশি করতে কি তা হলে কংগ্রেসী বিয়ে করবি তুই?’

—‘বাবাকে খুশি করতে আমি বাবার দেখে ঠিক করে দেওয়া পাত্রকে চোখ বুজে বিয়ে করে ফেলব। খুব সম্ভব সে নন-পলিটিক্যাল হবে।’

মেধা রোকেয়াকে বুঝতে পারছিল না। রাজনৈতিক জীবন সে অরাজনৈতিক গার্হস্থ্যের সঙ্গে খাপ খাওয়াবে কি করে? মুখে যার মার্ক্সসিজম-লেনিনিজম ছাড়া অন্য বুলি নেই, সাহিত্য শিল্পকলা সব কিছুকেই সে মার্ক্সের নিরিখে পরীক্ষা করে তবে ছাড়পত্র দেয়, বেশির ভাগ সময়েই দেয় না, কি করে সে বাবার নির্বাচিত বিবাহ করে দিন কাটাবে? কী চায় ও?

অমিয় সান্যাল যখন তারপর তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন তখন তার বিভ্রান্তি আরও গভীর হল। সে সাহস করে বলেছিল—‘কিন্তু আপনি তো রোকেয়াকে ভালোবাসেন, সান্যালদা, আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন?’

অমিয় সান্যাল জ্বলজ্বলে চোখে দূরের দিকে চেয়ে বলেছিলেন—‘ভালোবাসা কথাটা তুমি যে অর্থে ব্যবহার করছ, সে-অর্থে সান্যালদা কাউকে ভালোবাসে না। বাসতে পারে না। রোকেয়া শক্তিমতী মেয়ে, ওই শক্তি আমার প্রয়োজন, তুমিও তাই, তুমি আমার পাশে এলে আমার হাত আরও শক্ত হবে।’

—‘বিয়ে না করলেও তো তা করা যায়।’

—‘যায়। অতটা নিশ্চিন্ত থাকা যায় না মেধা। বিবাহের বন্ধনটা দরকার। এখনও।’

—‘আপনি বিবাহ-বন্ধনে বিশ্বাস করেন অমিয়দা? আপনি?’ মেধার বিস্ময় বুঝি আজ আর ফুরোবে না।’

—‘হ্যাঁ করি, পুরোপুরি মুক্তির আগে কিছুদিনের বন্ধন। পুরোপুরি কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার আগে যেমন সরকারি নিয়ন্ত্রণ।’

সান্যালদার চোখ দূরমনস্ক। কিসের একটা দ্যুতি সেখানে। মেধার এতোসব জিজ্ঞাসার দরকার ছিল না। কারণ অমিয় সান্যালকে সে তখন দেবতার সগোত্র মনে করে। অমিয়দা তাঁর আদর্শবাদের প্রয়োজনে বিয়ে করলেও মেধা বিয়ে করল তার নিজের প্রয়োজনে। রেজিস্ট্রি করে, সকলকে মিষ্টি খাইয়ে দুজনে যে যার বাড়ি ফিরে গেল। পর দিন থেকে অমিয় সান্যাল পার্টির অনেক গোপন কথা, অনেক নতুন পথ খোঁজার বিবরণ তাকে দিতে থাকলেন। যার বিন্দু বিসর্গ মেধা আগে জানত না। অমিয় বললেন,—শিগ্গীরই হয়ত আমাকে দার্জিলিঙের ওদিকে গিয়ে থাকতে হবে দীর্ঘ দিন। তোমাকে বেজিং যাবার জন্য তৈরি হতে হবে।’

সাতদিনের মধ্যে বিবাহটা সম্পূর্ণ করার সুযোগ এলো না। তারপর দীর্ঘ অজ্ঞাতবাস পর্ব। দিন দুপুরে যখন জলপাইগুড়ি জেলার নাগরাকাটা থেকে অমিয় সান্যালকে অ্যারেস্ট করল পুলিস, মেধা তখন এম. এর ছাত্রী, বেণী দুলিয়ে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস লেকচর শুনছে। খবরটা পেতে যেন একবার বুকের মধ্যে সাপে ছোবল দিল। সেই তীক্ষ্ণ কষ্টের স্মৃতি এখনও চেষ্টা করলেই মনে পড়ে। স্মৃতি তার অত্যন্ত শক্তিশালী।

এগুলো ইতিহাসের পাতা। কালের অমোঘ নিয়মে উল্টে যাবেই। মেধা এটা জেনে গেছেন। অমিয় সান্যাল তাকে বুঝতে পারেন নি, তিনি রোকেয়াকেও বুঝতে পারেন নি। আটষট্টি সালের বারোই ফেব্রুয়ারি দুটি ভিন্ন গ্রহের মানুষে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। অমিয়নাথ যে কারণে এই চুক্তি করেন, তা সফল হয়নি। মেধার পরবর্তী কার্যকলাপ, তার সব কিছুর ভেতর ঢাকবার, প্রশ্ন করবার, সংশোধন করবার, পরিকল্পনার চোরা গর্তগুলোর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করবার বাতুল ইচ্ছেগুলোকে দমন করতে করতে অমিয়নাথ নিশ্চয়ই জেলের ভেতর থেকেই বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন বন্ধনের সূত্রগুলো কাজ করছে না। প্রথম প্রথম চিঠি চালাচালি হত লোক মারফৎ। অনেক সাবধানতা অবলম্বন করে। জেলে যাবার পর তিনি সোজাসুজিই লিখতে লাগলেন, জেলকর্তৃপক্ষকে উপেক্ষা করে, মেধাও লিখতেন, গোপন নামে। সেই চিঠি পত্রের তর্কাতর্কি ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠল। তারপর বন্যা সরে গেল। মেধার মুক্তি ভেতর থেকেই এসে গেল।

রঘুনন্দন ত্রিপাঠী এই ইতিহাসের আদি-মধ্য-অন্ত কিচ্ছু জানে না, সে দিব্যি জাজমেন্ট সীটে বসে গেল। বাঃ! তিনি অমিয় সান্যালের প্রতি কর্তব্য করেননি, রঘুনন্দন ত্রিপাঠীর প্রতি কর্তব্য করেননি! অধিকার কি তার? এক সময়ে সে মেধার পাণিপ্রার্থী হয়েছিল এবং তাঁর ছোড়দা মুক্তিনাথের প্রাণের বন্ধু ছিল—এই। ভারি চমৎকার। মেধা নিজের মধ্যেকার জ্বলুনি কমাবার জন্যে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে লাগলেন। দিতেই লাগলেন। জ্বলুনি কমছে না। বাবা নেই যে দৌড়ে গিয়ে বলবেন—‘বাবা দেখো না, ওই লোকটা আমাকে কিভাবে অপমান করছে!’ মা নেই যে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে চোখের জল ফেলবেন। এটা মেধা খুব মাঝে মাঝে করতেন। মা প্রথমটা জিজ্ঞেস করতেন—‘কি হয়েছে কেন কাঁদচ্ছিস?’ মেধা কোনও সঙ্গত কারণ দেখাতে পারতো না। হয়ত একটি নিম্নবিত্ত বান্ধবীর শুকনো মুখ, হয়ত ফুটপাতের ওপর ভিখারি শিশুর ফোলা পেট নিয়ে চিতপাত হয়ে শুয়ে থাকা, কিম্বা সদ্য গোঁফ ওঠা কোনও কিশোরকে কোনও বয়স্ক পদস্থ ভদ্রলোকের অপমান….এগুলো কি বলা যায়।

—‘কেঁদে নে খুকু, কেঁদে নে। মনটা মাঝে মাঝে বড্ড ভারি হয়ে যায়।’ মা বলতেন।

অনেক দিন পর্যন্ত মনটা বড্ড খচখচ করত। মা চলে গেলেন, বলা হলো না, বাবা চলে গেলেন বলা হল না। বিয়ে করেছেন এতো বড় খবরটা মা-বাবার কাছে চেপে রাখা, এতো সোজা কাজ নয়। এখন মনে হয় খবরটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল না পুরো জীবনের, পুরো সময়ের প্রেক্ষিতে। শিশুকালের খেলা। তাই তাঁর সহজাত বোধই তাঁকে নীরব রেখেছিল। প্রজ্ঞারও কোনও অধিকার ছিল না এ কথা রঘুনন্দনের কানে তোলবার। ও কি ভেবেছিল কথাটা গোপনে রেখেই দিদি বিয়ে করবে? রঘুনন্দনকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলে তাকে নিশ্চয়ই বলতেন ব্যাপারটা। অমিয় সান্যাল একজন অতবড় সংগঠক, নেতা, পার্টির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেলেন, তাঁর মৃতদেহের ওপর দিয়ে বিপ্লব হল, পার্টি আরও ভাগ হল। জেলের মধ্যে তাঁর মৃত্যুটা কোনও কাজে লাগল না। জেলের মধ্যে পুলিসি অত্যাচারের একটা নথিবদ্ধ প্রমাণ হয়ে রইল শুধু। বাস ওই নথি ছাড়া-আর কেউ তাঁকে মনে রাখেনি। সাতদিনের স্ত্রী পর্যন্ত না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress