Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » উত্তরসাধক || Bani Basu » Page 6

উত্তরসাধক || Bani Basu

গলার ব্যথায় লুকু ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। লুকুর যে কত ব্যথা! কখনও হাত-পা ব্যথা। কখনও মাথা ব্যথা, কখনও বুকের মধ্যেটা ভারি হয়ে থাকে। এ সব সে কাউকে বলে না। বাবাকে তো নয়ই। বন্ধু-বান্ধবদেরও নয়। তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুন্নি, মৈথিলী। কিন্তু ছোটবেলায় তারা যেমন অবিচ্ছেদ্য ছিল, এর পুতুল ওকে দিত, জামাকাপড় বদলি করত, এখন আর তেমন নেই। মৈথিলীর দৈত্যের মতো স্বাস্থ্য, একেক সময়ে তাকে দেখলে মনে হয় সে যেন ব্যাসল্ট কি গ্রানাইট পাথর দিয়ে গড়া। দেশ, সমাজ আর মানুষ নিয়ে সে এখন এমন মেতেছে যে আপনজনদের কথা শোনবার, ভাববার ফুরসৎ পায় না। লুকুর মনে হচ্ছে মৈথিলীর পথ এবার ক্রমশই তার থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। মৈথিলী কাজে মগ্ন, এই বিচ্ছেদ সে বুঝতে পারছে না, লুকু বুঝতে পারছে, বুঝে তার ভেতরের ব্যথা বেড়ে যাচ্ছে আরও। সারাজীবনটা কি শুধু হারাবারই খেলা! কিছুই কি তার প্রপ্তিযোগ নেই! মুন্নিকে একদিনই সে তার স্বাস্থ্যের অবনতির কথা বলেছিল, সে বলল—‘ওই যেগুলো বলছিস লুকু, এগুলো কাদের হয় জানিস?’

‘কাদের?’

—‘একদম অলস, নিষ্কর্মাদের। তুই আরও বেশি কাজ কর লুকু। আর একদম ব্রুড করবি না। ব্রুড করাটা তোর একটা বিলাস হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’

লুকু যেখানে সমর্থন পায় না, সেখানে আর মুখ খোলে না। ব্যাস। আর কোনদিন সে এ সব কথা মৈথিলীকে বলেনি।

আপাতত তার যা কষ্ট তা ডাক্তারসিদ্ধ। অর্থাৎ স্বয়ং পাস-করা ডাক্তার এসে দেখে, পরীক্ষা করে বিধান দিয়ে গেছেন, এ কোনও অস্পষ্ট শরীর খারাপ নয়, যে ভোক্তা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারে না, সাইকোসোম্যাটিক বলে যেগুলোকে উড়িয়ে দেওয়া সহজ। তার বাঁ কানের তলা ফুলেছে। খেতে পারছে না। গলা গলা ভাত তাও গিলতে পারছে না। উপরন্তু গলায় একটা মাফলার জড়িয়ে রাখতে হয়েছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি হওয়া সত্ত্বেও শীত এখনও তেমন পড়েনি। গরম লাগছে তাই। নিজেকে দিনে অন্তত দুবার আপাদমস্তক পরিষ্কার না করলে, লক্ষ্মীশ্রীর নিজের শরীরটাকে কেমন ঘেন্না করে। এখন যেন মনে হচ্ছে গায়ে ইদুঁর-পচা গন্ধ। ডিওডোরান্টটা ভালো করে স্প্রে করে একটু ট্যালকম পাউডার হাতে পায়ে ঘষে নিল সে। চুলগুলো ভালো করে ব্রাশ করল। মা বলত হান্ড্রেড স্ট্রোকস আ ডে। এখন সে ক্ষমতা নেই। একটু যেন ফ্রেশ লাগছে এবার। নিজের ঘরে থাকতে ভালো লাগছে না। ঘরটা যেন তার নিঃশ্বাসে নিঃস্বাসে ভর্তি হয়ে গেছে। নিজের ওপর কি রকম রাগ হচ্ছে। গ্ল্যান্ড হবার আর সময় পেল না! ওরা সকলে কি সুন্দর গ্রামে ঘুরে এলো। নিশ্চয়ই অনেক মজা করেছে। চ্যারিটি শো করতে গিয়েই যা মজা!

আচ্ছা…আমার বদলে কি কেউ গিয়েছিল? কে যেতে পারে? মেয়েদের পক্ষে বাড়ি থেকে পারমিশন যোগাড় করা একটু মুশকিল। কলেজ থেকে এক্সকার্শন যাওয়া হচ্ছে সে এক রকম, বন্ধুরা মিলে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হচ্ছে সে-ও চলে, কিন্তু কয়েকজন ছেলে-মেয়ে মিলে জনৈক অধ্যাপকের নেতৃত্বে গ্রাম সংস্কার! হরি বলো! কথাগুলো বুল্টুর। সে এইভাবে অভিভাবকদের নকল করে। গুঞ্জনের কি পরীক্ষা আছে। আগেই বলে দিয়েছিল যেতে পারবে না। মউমিতা, সর্বাণী কি বাড়ি থেকে অনুমতি পাবে? তবে কি মৈঘিল একাই গেল? একবার ফোন করে দেখলে হত। কিন্তু গলা খুলতে বড় কষ্ট। তার চেয়ে একটা বই নিয়ে ড্রয়িংরুমে সোফায় গিয়ে বসি। বাবা অফিস থেকে কখন ফিরবে তার ঠিক নেই। ভাইয়ের স্কুল থেকে ফিরতেও বেশ দেরি।

বাড়িটা একদম ফাঁকা। ড্রয়ার থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করি। ধরাই, হ্যাঁ? দিস ইজ ফান, জাস্ট ফান। আচ্ছা তোমরাই বলো ছেলেরা যত খুশি স্মোক করবে, মেয়েরা কেন করবে না? দুজনেরই যদি কাজকর্ম এক হয়, টেনশন এক প্রকৃতির হয়, সব দিক থেকে সমান… শুধু শরীরের গঠন আলাদা! শান্তনু, প্রমিত, উজান সবাই স্মোক করতে পারে। দেব, হ্যাঁ দেবও টানে লুকিয়ে লুকিয়ে। দেব সব ব্যাপারে শহরের ছেলেদের টেক্কা দিতে পারে, খালি চালচলনে পারে না। এ জন্য ওর একটা কমপ্লেক্স আছে। নির্ঘাৎ তাই ও লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খায়। যখন কেউ থাকে না, তখন। কোন মামার বাড়িতে থাকে সেখানে পারে না, নিজের দেশের বাড়িতে পারে না। ওর মেজ জেঠু শকড্‌ হবেন, অন্যদের সামনে সেজে থাকে গুডি বয়। কিন্তু আড়ালে আবডালে ও স্মোক করা ভালোমতো অভ্যেস করছে। হঠাৎ একদিন পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে রিং টিং ছেড়ে সব্বাইকে চমকে দেবার ধান্দা। আমার স্মোক করতে দারুণ লাগে। কি রকম একটা অতিরিক্ত ব্যক্তিত্ব আসে। খুব ভালো করে তখন বুঝতে পারি ছেলেরা কেন এতো স্মোক করে। ব্যক্তিত্বের অভাব, শক্তি সামর্থ্যে স্মার্টনেসে ঘাটতি সবই পুষিয়ে যায় ধোঁয়ায়। যে ছেলেকে এমনিতে কেউ পাত্তা দেয় না, সে-ই যখন ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে, চোখ আধরোজা করে একটু একটু করে ধোঁয়া ছাড়ে, তার চেহারায় একটা আলাদা ডাইমেনশন আসে। লোকে বলবে তুমি মেয়ে, তোমার তো পুরুষত্বের দরকার নেই, তুমি কেন স্মোক করবে, বাজে অভ্যাস ধরবে একটা! পুরুষত্ব মানে কি? বায়োলজিক্যাল পুরুষত্ব একটা হাস্যকর প্রত্যঙ্গ। ওটার জন্যে কোনও দুঃখ নেই। কিন্তু আদেশ করবার ক্ষমতা, যে কোনও কাজে একটা অনায়াস সামর্থ্য এইগুলোর জন্য ভেতরে ভেতরে একটা ভীষণ তাগিদ আছে, বুঝতে পারি এগুলো মুন্নির আছে। জীবনে যদি কিছু করতে হয় তো ওটা চাই। মৈথিল, মৌমিতা, আমি, উজান, গুঞ্জন, প্রমিত সব এক স্কুলের ছাত্রছাত্রী। কেউ এক বছর আগে, কেউ পরে। এইচ. এসের পর একেক জন একেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। আমার ইচ্ছে ছিল আর্কিটেকচার পড়ি। কিন্তু জয়েন্টে পারলাম না। বাবা বলল, ‘হিসট্রিতে তো তোমার বরাবর ভালো মার্ক্স। হিসট্রি নিয়ে পড়াশোনা করো। একেবারেই আর সায়েন্স নয়।’ মৈথিলও তাই বলল। কিন্তু আমরা পুরনো স্কুলের বন্ধুরা সবাই ছাত্রসঙ্খে আছি। নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ হয়। নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা আমরা বলাবলি করি।

এমনিতেই আমাকে সুন্দর দেখতে বলে, নরম বলে, অনেকে অনেক সুযোগ নেয়। লোকের হাবভাব দেখে মনে হয় রূপ দেখানো আর রূপ দেখিয়ে পাঁচজনকে এনটারটেইন করা ছাড়া আমার আর কোনও কাজ নেই। মউমিতা খালি বলবে—‘তোর আর কি? তোর যা রূপ, মুণ্ডু ঘুরে যাবে, যেখানেই যাবি।’

—‘আই অবজেক্ট।’ আমি চেঁচাই ‘রূপ আছে আছে, তাই বলে সব কিছুর সাবস্টিট্যুট সেটা নয়।’

—‘তাহলে অত সাজিস কেন?’

—চুলের যত্ন, গাত্রত্বকের যত্ন, ম্যাচ করে ড্রেস করাটা সাজ হল? এ সব সে জন্মে থেকে মায়ের কাছে শিখেছে। তার মা লিপস্টিক, ব্লাশার ছাড়া বেরোত না। মাসে দু বার বিউটি সেলুনে গিয়ে চুল সেট করে আসতো। ছোট্ট লুকু সে সব সময়ে ধৈর্য ধরে মায়ের ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে সেলুনের উঁচু চেয়ারে বসে থাকত। যে সময়ের যা, তা ছাড়া অন্য কিছু মাকে পরাও তো! সন্ধের শাড়ি আলাদা, রাত্রের শাড়ি আলাদা, সকালের আলাদা, বিকেলের আলাদা। লুকুকেও মা ডজন ডজন, ফ্রক করিয়ে দিত, একটু বড় হতে কত রকম ড্রেস। মায়ের তুলনায় লুকু তো কিছুই করে না। মায়ের সঙ্গে সঙ্গেই চলে গেছে তার সাজগোজ। আসলে তার গায়ের চামড়াটা শুধু মাখনের মতো নরমই নয়, স্বচ্ছও। ভেতরে সূক্ষ্ম লাল রক্তবহা নালীগুলোর লালিমা যেন দেখা যায়। মনে হয় সে খুব প্রসাধন করেছে। লুকুর চোখের জমি নীল, মণিগুলো গাঢ় নীল, কাচের মতো একটা স্বচ্ছতা সেখানেও। যেন মণির ছিদ্রপথ ধরে বহুদূরে তার শরীর মনের অভ্যন্তরে রোমাঞ্চকর এক যাত্রায় নেমে যাওয়া চলে। শ্যাম্পু করলেই লুকুর চুলে ঢেউয়ের ওঠানামা শুরু হয়। অন্য সময়ে নরম সুগন্ধ, সামান্য সোনালি আভার দ্যুতিময় একঢাল চুল। তার চোখের পাতা মস্ত লম্বা, বাঁকানো। মায়ের একটা কথা লুকুর প্রায়ই মনে পড়ে— ‘লুকু, চেহারাটা তোমার একটা অ্যাসেট। তাকে কোনমতেই নষ্ট করো না। শুধু চেহারার জন্য জীবনে অনেক সুযোগ, অনেক ভক্তি, ভালোবাসা পাবে তুমি, যেগুলো অন্যরা পাবে না।’

কিন্তু শুধু রূপের জোরে কোথাও পৌঁছতে লুকুর ঘৃণা হয়। এমন কোনও দেবপাদপীঠ সে আরোহণ করতে চায় না, যেখানে মানুষের রূপজ-মোহ তাকে অন্ধের মতো তুলে দেবে। গা ঘিনঘিন করে তার যখন বয়স্ক মানুষেরা মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাসের সীট ছেড়ে দেয়। লেডিজ সীটের কাছে লেপটে থাকে মাঝবয়সীরা। দেখুক না, সৌন্দর্য দেখবারই জিনিস। উজানকেও একবার দেখলে আবার দেখতে ইচ্ছে করে লুকুর। কিন্তু অমন লোভ থাকবে কেন দৃষ্টিতে! সেদিন এসপ্লানেডে নেমেছে, মেট্রোয় বাড়ি ফিরবে। একজন ভদ্রলোক মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন—‘আহা হা হা, মে গড ব্লেস ইউ।’ এই প্রতিক্রিয়াটা ভারি অদ্ভুত, ভারি নতুন লেগেছে লুকুর। সুন্দর চেহারার জন্যে যদি লোকের কাছ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আশীর্বাদ পাওয়া যায় তো মন্দ কি? কিন্তু তারপর? রূপ তো প্রথম দর্শন। তার পরও তো অনেক দর্শন আছে, তখন? তখন নিজের মূল্য প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অন্য কিছুও তো চাই। পরীক্ষার মার্ক্সটা পর্যন্ত আশানুরূপ না হলে ওরা বলে ‘তোর আর দরকার কি?’

এ রকম যখন বলে কেউ, তখন রাগে তার শরীরের ভেতরটা কেমন করতে থাকে। কিন্তু ভাবমূর্তি তৈরি করেছে ভদ্র, নরম মেয়ের, চট করে তার থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারে না। মৈথিলী যে বুদ্ধিতে, অন্যান্য গুণে তার থেকে শ্রেষ্ঠ সেটা সে মেনে নিয়েছে। যা সূর্যের মতো স্বতঃপ্রকাশ তাকে মেনে না নেওয়ার কোনও মানে হয়? তার সঙ্গে লুকুর প্রতিযোগিতা নেই। ছিল না। কিন্তু গুঞ্জন, মৌমিতা, উজান তাকে ছাড়িয়ে গেলে তার ভীষণ অপমান বোধ হত। উজানের সঙ্গে এক ব্র্যাকেটে থেকে তার স্বস্তি হত। আর উজান তো এখন ভিন্ন পথের যাত্রী হয়ে গেছে।

পুরো সিগারেটটা শেষ করে খানিকটা আরাম পাওয়া গেল। সকাল থেকে মনটা খারাপ হয়ে ছিল। এখন অনেকটা হালকা লাগছে। ফ্রাস্ট্রেশন বড় বিশ্রী জিনিস।…

এক এক সময় ভাবি কি দরকার আমার এই দৌড়বাজির! আমি যা, যতটুকু মেনে নিই না কেন? কিন্তু ভেতর থেকে কিসে যেন আমায় কামড়ায়। আমি না দৌড়ে পারি না। সাধে কি আর আমার বাবা অত স্মোক করে। খুব রিল্যাক্সড লাগে। মনটা এখন কত হালকা লাগছে। নিশ্চয়ই পারবো। এম. ভির মতো আমি উড়ে যাচ্ছি দেশে দেশে। উনি সমস্ত ইয়োরোপ ঘুরেছেন, ইউ. এস. এ. তো বটেই। এখন থেকেই ওঁকে আমার অ্যামবিশনের কথাটা বলা উচিত। যাবো স্টেটস, সেখানে এম. এস করব, পি. এইচ. ডি। তারপর ওখানকার ইউনিভার্সিটিতে পড়াবো। গ্রেটকোট পরা এম. ভির একটা ছবি আছে মার্কিন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে…ওই রকম একটা ছবি…ঘরে চলে যাই… ঘুম পাচ্ছে। ভাবল বটে কিন্তু এতো ঘোর আলস্য লাগছিল যে লুকু সোফার ওপরেই ঘুমিয়ে পড়ল। মাথাটা তার বুকের ওপর ঝুঁকে পড়েছে; চুলগুলো গোছা গোছা হয়ে ঝুলছে মাথার দু পাশ থেকে। হাতটা সোফার হাতলেরর ওপর। পাশে চৌকোণা টেবিলে অ্যাশট্রেতে সিগারেটের স্টাব। তার আঙুলে এখনও সিগারেট ধরার ভঙ্গি।

পাখির ডাকে তাদের বাড়ির বেল বাজল। লক্ষ্মীশ্ৰী শুনতে পেল না। তাদের বাড়িতে একটি অল্পবয়সী ছেলে কাজ করে, বুদ্ধিশুদ্ধি কাঁচা, সে সাহেবের নির্দেশমতো ফুটো দিয়ে দেখল লুকুদিদির বন্ধু। দরজা খুলে দিল। দেবপ্রিয়র চোখ দুটো ঈষৎ লাল, চুলটা ভালো করে আঁচড়ায়নি। সে তার স্বভাবের বিপরীত দ্রুত ভঙ্গিতে ঢুকে এলো। ঢুকেই লুকুকে অদ্ভুত একটা ট্যাবলোর মতো ঘুমন্ত দেখতে পেলো। দেবপ্রিয় ছেলেটিকে বলল—চা করতে পারবে? শুধু লিকর হলেই হবে। আমাদের দুজনেরই।

—‘দিদি বেশি দুধ চিনি ছাড়া চা খায় না।’

—‘আচ্ছা আজ খাবে। তুমি নিয়ে তো এসো।’

ছেলেটি রান্নাঘরে চলে গেল। দেবপ্রিয় লম্বা লম্বা পায়ে ঘরটা পার হলো, যেখানে লুকু ঘুমিয়ে পড়েছিল, সেখানে পৌঁছে হাঁটু গেড়ে কার্পেটের ওপর বসে পড়ল, তার ঠিক সামনে। পাশের অ্যাশট্রেটা ভালো করে দেখল। আস্তে করে লুকুর আঙুল দুটো ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। নাকের কাছে ধরলো, হঠাৎ কারো দেখলে মনে হতে পারে সুন্দরী লক্ষ্মীশ্রীর আঙুলে সে চুমো খাচ্ছে। তারপর দেবপ্রিয় লুকুর মাথাটা আস্তে আস্তে সোফার পিঠে রেখে দিল। ডাকলো ‘লুকু, লুকু চোখটা খোলো।’

বেশ কিছুক্ষণ ডাকবার পর লুকু সামান্য একটু চোখ খুলল। বেশ লাল।

দেবপ্রিয় বলল—‘লুকু সোজা হয়ে বসো। এতে ঘুমোচ্ছ কেন? ওষুধ খেয়েছে কিছু?’

লুকু সোজা হতে চেষ্টা করছিল, পারছিল না। চা এসে গিয়েছিল। দেবপ্রিয় বলল—‘একটু চা খাও লুকু।’

লুকু এবার কথা বলল—‘চা খাব না।’

—‘হ্যাঁ খাবে। তোমার গ্ল্যান্ড ফুলেছে, গলায় ব্যথা, না? ভালো লাগবে খাও। আমি ধরছি।’ দেবপ্রিয়র হাতে ধরা কাপ থেকে এক চুমুক খেয়ে লুকু মুখ বিকৃত করল।

—‘খাও, আরও একটু খাও।’ একটু একটু করে পুরো দু পেয়ালা চা-ই তাকে ধৈর্য ধরে খাওয়ালো দেবপ্রিয়। তার পরে বলল—‘লুকু, আমার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা কে সরিয়েছে? তুমি? না?’

লুকু অস্পষ্টভাবে হাসছে—‘কেন দেব, আমার খাবার ইচ্ছে হলে কি আমি এক প্যাকেট কিনে নিতে পারি না?’

—‘পারোই তো! আমারটা নিলে কেন?’

—‘পারি না। সিগারেটের দোকানদারগুলো যা বিশ্রী। তা ছাড়া, তুমি? তুমিই বা কেন খাবে? তোমার কিসের কমপ্লেক্স দেব…’ লুকু জড়িয়ে বলল।

—‘কি আবোল-তাবোল বকছ? আমি খাই না খাই সেটা আমার ব্যাপার। তুমি কেন আমার প্যাকেটটা নিতে গেলে? শোনো, প্যাকেটটা আমাকে দাও।’

লুকু উঠতে পারছিল না, কোনমতে উঠতে গিয়ে একবার ধপাস করে বসে পড়ল। তারপর বলল—‘দেব, আমায় একটু ধরবে?’

দেবপ্রিয় সারাক্ষণ ওকে খুব চিন্তিতভাবে লক্ষ্য করছিল। বলল—‘নিশ্চয়ই ধরবো। কোথায় যেতে চাও?’

—‘বাপীর ঘরে।’

ধরে ধরে লুকুকে তার বাবার ঘরে নিয়ে যাবার পর বাবার টেবিল-ড্রয়ার থেকে ‘লুকু এক প্যাকেট সিগারেট বার করল, দেবপ্রিয়র দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আলগা-আলগা গলায় বলল—‘তোমার প্যাকেটটা আমি শেষ করে ফেলেছি দেব, বাপীরটা থেকে তোমাকে গোট্টা একটা দিয়ে দিলাম। আই মে হ্যাভ টু গিভ হিম অ্যান এক্সপ্ল্যানেশন। মাই বাপী ইজ সো পার্টিকুলার। স-ব গোনা গাঁথা। আই নেভার থট ইউ আর সো স্টিঞ্জি। একটা প্যাকেটের জন্যে এ তো!’ বলতে বলতে লুকুর চোখ মুখ কেমন হয়ে যাচ্ছিল। দেবপ্রিয় তাকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বাইরের বেসিনের কাছে নিয়ে গেল। সব বমি করে দিল লুকু। পাতলা সাবুর খিচুড়ি খেয়েছিল, পায়েস, লেবুর রস, কিছুক্ষণ আগেকার চা-স-ব। দেবপ্রিয় বলল—থ্যাংক গড। মুখে-চোখে জল দিয়ে, লুকুকে তার ঘরের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সে পাখাটা চালিয়ে দিল। লুকুর গলাটা ভালো করে ঢেকে দিল, পরে বলল—‘লুকু তোমার বাবার প্যাকেটটা কিন্তু আমার চাই না। আমার প্যাকেটটা চাই।’

—‘হারিয়ে গেছে যে!’ লুকু এখন খানিকটা শান্ত, ‘শেষ করে ফেলেছি তো!’

—‘সবগুলো খেয়ে ফেলেছো? আটটাই?’ আতঙ্কিত গলায় দেবপ্রিয় বলল।

—‘আটটা নয়, সাতটা। উঃ দেব তুমি কী কিপটে? একদম শাইলক একটা! সুদ দিতে হবে না কি আরেকটা প্যাকেট, কিংবা আ পাউণ্ড অফ ফ্লেশ?’

—‘শোনো লুকু, কি ভাবে-খেয়েছে?’

—‘অফ অ্যান্ড অন! একলা হতে পারলেই খেয়েছি।’

—‘ভালো লেগেছে…নিশ্চয়!’

—‘ওহ শিওর!’

—‘তুমি খালি প্যাকেটটাই আমাকে দাও।’

—‘খালি প্যাকেট?’ লুকুর চোখে বিস্ময়।

—‘লুকু, প্লীজ!’

—‘দেখো টেবিলের তলায় গার্বেজ বিন আছে। ওখানে থাকতে পারে।’

দেবপ্রিয় টেবিলের তলা থেকে কাগজের ঝুড়িটা টেনে আনছে, হাঁটকাচ্ছে, লুকু অবাক হয়ে দেখছে। ওটা পেল শেষ পর্যন্ত। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল—‘লুকু তুমি যতক্ষণ না সুস্থ বোধ করছ, চুপচাপ শুয়ে থাকো, আমি চলি।’

—‘সে কি বসবে না? গল্প করবে না? কেওড়াখালির গল্প!’

—‘কেওড়াখালি আমি যাইনি। ওরা এখনও ফেরেনি যদ্দূর জানি। আমার বড্ড জরুরি কাজ আছে’ আরেক দিন এসে আড্ডা মারা যাবে।’

লুকুর এতো ক্লান্ত লাগছে যে সে তার হতাশাটাকেও ভালো করে প্রকাশ করতে পারছে না। দেবপ্রিয় ঘর থেকে বেরোতে ফিরে তাকাল, বলল—‘লুকু, তুমি আর সিগারেট খেয়ো না।’

—‘হোয়াই? হু আর ইউ টু সে সো?’

—‘আমি ডাক্তার। লুকু, আমি বন্ধুও। তুমি স্মোক করবে না। কেউ খেলাচ্ছলে, গল্পচ্ছলে দিলেও না। কথাটা শুনো।’

দেবপ্রিয় ঘর থেকে বেরিয়ে সামান্য গলা তুলে ডাকল—‘ঝড়ু!’

ঝড়ু রান্নাঘরের পাশের স্টোর রুম থেকে বেরিয়ে এলো। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল দেবপ্রিয়র দিকে। তারপর পেছন পেছন গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress