উত্তরসাধক (Uttarsadhak) : 05
বহুবার খড়ি দিয়ে লেখা এবং মোছার পর শ্লেটের যেরকম রং হয়, হেমন্তর আকাশ অনেকটা সেইরকম। একটা ময়লাটে আলো যেন নোংরা ন্যাতা হাত বুলিয়ে দিয়েছে শহরটার গায়ে। রঘুনন্দন সাত সকালেই খবর পেলেন অফিসের রাস্তায় বিশাল জ্যাম। গতকাল শেষ রাতে নাকি বড়বাজারে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। তাঁকে যেতে হবে নিউ সেক্রেটারিয়েট। ওদিকে যখন এতো জ্যাম, তখন তিনি মেয়েকে মেডিক্যাল কলেজে নামিয়ে ধীরে সুস্থে যেতে পারেন। দাড়ি কামাচ্ছিলেন বাথরুমের বেসিনে, গালের ওপর দিয়ে রেজারটা টানতে টানতে চেঁচিয়ে বললেন,—‘অরু, মুন্নিকে রেডি হতে বলো। আমার সঙ্গে বেরুবে।’ কোনও উত্তর পেলেন না। চানটান সেরে ঘরে এসে দেখেলেন তাঁর গ্রে রঙের সুট, ব্রাউন টাই সব বিছানার ওপর চিৎপটাং হয়ে আছে। অরুণা ধারে কাছে কোথাও নেই। রান্নাঘরের দিক থেকে অবশ্য ছ্যাঁক ছোঁক শব্দ আসছে। কিন্তু ছ্যাঁক ছোঁক শব্দ তোলবার জন্যে তো বৈজুই রয়েছে। অরুণাকে সেখানে থাকতেই হবে এমন ব্যবস্থা রঘুনন্দনের বাড়ির নয়।
খাবার টেবিলে এসে অবশ্য অরুণাকে পাওয়া গেল। হাতে উল কাঁটা। নীরবে খুব মনোযোগের সঙ্গে দুটো তিনটে রং-এর মিশেলে কিছু একটা বুনে চলেছে। টেবিলের ওপর রঘুনন্দনের খাবার থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। রান্নাঘরের দিক থেকে কফির খুশবু। রঘুনন্দন টাইয়ের গিটটা ধরে দু-একটা ঝাঁকি দিয়ে তাকে জায়গামতো বসিয়ে দিতে দিতে বললেন—‘মুন্নিকে দিলে না? বললাম যে মুন্নিকে নামিয়ে দিয়ে যাবো।’
অরুণা বুনতে বুনতেই জবাব দিলেন—‘মুন্নি কোথায়, যে তাকে দোব? সে আজ চার পাঁচ দিন বাড়িই ফেরেনি।’
—সে কি?’ রঘুনন্দন পরোটার প্লেট থেকে হাত গুটিয়ে নিলেন।
—‘কালও ফেরেনি?’ রঘুনন্দনের ভ্রু কুঁচকে উঠেছে।
বললেন—‘কোথায় আছে ও? খবর পেয়েছ?’
—‘খবর পেয়েছি,’ অরুণা তাড়াতাড়ি বললেন, ‘লুকুর বাড়িতে খুব সম্ভব।’
—‘ঠিক আছে। লুকুর বাড়ি থেকেই ওকে পিক্আপ করব। এতদিন ধরে কলেজ কামাই করছে! ডাক্তারি জিনিসটা ফাঁকি দিয়ে পাস করা যায় না। গেলেও উচিত নয়।’
—‘আমি ঠিক জানি না ও লুকুর বাড়িতেই আছে কি না। আন্দাজে বললুম। ও তো শুধু “ফিরছি না” বলেই ফোন রেখে দিল।’
রঘুনন্দন খুব গম্ভীর মুখে বললেন —‘আই ডোন্ট লাইক ইট অরুণা।’ ভালো করে খেলেন না, মুখ মুছে গরম কফিটা কয়েক চুমুকে শেষ করে উঠে পড়লেন।
অরুণা বুনতে বুনতেই রঘুনন্দনের গাড়ির চলে যাওয়ার শব্দ পেলেন। তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বোনার সরঞ্জাম সব থলিতে ভরে বারান্দার চেয়ারে এসে বসলেন। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময়ে বলে গেলেন —‘বৈজু আমার কফিটা বারান্দায় দিও।’
খবর পেয়েছেন, মেয়ে ফোন করেছে বললেন বটে, কিন্তু অরুণা কোনও খবর, কোনও ফোনই পান নি। মাত্র দুদিনের কড়ারে কোন গ্রামে মেয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে গ্রাম-উদ্ধারের কাজে গেছে। এই জানেন। বেরোবার সময়ে বলে গিয়েছিল —‘সময়মত না ফিরলে ভেবো না। বেশি দেরি হলে ফোন করে দেবো।’ কিন্তু গত পরশু থেকে ফোনের জন্যে হা-পিত্যেশ করে করে তাঁর কপাল ব্যথা হয়ে গেছে। রঘুনন্দন দিল্লি থেকে ফিরেছেন কাল অনেকরাতে। ফিরেই চান করে শুয়ে পড়েছেন। অরুণা সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারেননি। মেয়ে তাঁর খুবই ভালো। নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারে। কিন্তু নিজের কাজ ছাড়া আর সব কাজে যেন ওর মন। কিসের জাল যে বুনে যাচ্ছে। এতো রকম ব্যাপারে ওর মাথা দেবার দরকারটাই বা কি? অরুণার জীবনে স্বামী এবং মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। শ্বশুরকুল নেই। পিতৃকুল মাতৃকুল কিছু নেই। মুন্নির বাবা চাকরির সুবাদে জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, দিল্লি-কলকাতা করছেন তাও বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। মেয়ের পড়াশোনার যাতে অসুবিধে না হয় তাই কলকাতায় এই ছোট বাংলো বানালেন অরুণাকেও ছেড়ে দিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল মেয়েও বাপের মতো আই. এ. এস হোক, আর সত্যি তিনি তা চাইতেই পারেন। বৃত্তি পরম্পরাগত হলে মানুষের সামর্থ্য বাড়ে, স্বাভাবিক ভাবেই সে অন্যদের থেকে পিতৃপিতামহের বৃত্তিতে কুশলী হয়ে ওঠে, এই ধারণা রঘুনন্দনের। উপরন্তু মুন্নি ছোট থেকেই খুব ধীর, স্থির, বিচক্ষণ। কিন্তু মুন্নি নিজের পড়াশোনার ব্যাপারে বাবা-মার ইচ্ছেকে আমল দিল না। সে ডাক্তারি পড়তে ঢুকেছে, খুব ভালো কথা, কিন্তু সেটাকেও যেন খুব গুরুত্ব দেয় না। অরুণা বরাবরই তাঁর সময় রঘুনন্দন আর মুন্নির মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। যখন কলকাতার বাইরে যান মুন্নি থাকে বৈজুর তত্ত্বাবধানে একা। কদিন বাইরে কাটিয়েই হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসেন তিনি। অথচ মজার কথা এই যে তাদের দুজনকে নিয়ে তাঁর এই হাঁসফাসানি তারা দুজনেই অতিমাত্রায় স্বনির্ভর। রঘুনন্দন চিরকাল হোস্টেলে মানুষ। নিজের জামাকাপড় নিজে কাচা, জুতোয় পালিশ লাগানো, ইস্ত্রি করা এসবে চিরকাল অভ্যস্ত। এখন সরকারি আমলা হয়ে এগোতে আর্দালি, পেছোতে আর্দালি, অরুণার কিছু করবার দরকার হয় না। সেখানে যে শক্তিটা খরচ করতে পারতেন সেটাশুদ্ধ অরুণা মেয়ের সেবায় লাগিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও মুন্নি স্বনির্ভর। ইদানীং দিন সাত আট দিল্লি কাটিয়ে অরুণা যখন ধড়ফড় করতে করতে ফিরে আসেন মুন্নি শান্তমুখে দরজা খুলে দেয়।
—‘ঠিক আছিস তো, মুন্নি?’
মুন্নি হেসে ফেলে। কোনও জবাব দেয় না।
—‘কি করছিলি?’
—‘পড়ছিলুম।’
—‘কি পড়ছিলি?’
—‘হাইডেগার।’
—‘কি ডেগার?’
—হাইডেগার’
—‘খুব অসুবিধে হয়েছিল?
—‘অসুবিধে হবে কেন?’
পরে বৈজুর কাছ থেকে শুনলেন তার নাকি তিনদিন জ্বর ছিল। মুন্নিই তার সেবা যত্ন করেছে, নিজেও বেশ রান্না করে খাওয়া-দাওয়া করেছে। বৈজু বলে দিয়েছে সে বৈজুর জন্য বার্লি তৈরি করে দিয়েছে। বন্ধুরা এসেছে তিন চার দিন। সবাই মিলে বাড়িতে ফীস্ট করেছে। দিদি এক দিনও দেরি করে ফেরেনি। রেণু আসেনি বলে একদিন ঘর ঝাঁটপাটও দিয়েছে। আর নিজের জামাকাপড় তো সে বরাবর নিজেই কাচে।
অরুণা বলেছেন—‘মাকে তাহলে তো তোর কোনোও দরকারই নেই!’
—‘কি যে বলো মা, কত যে অসুবিধে!’
—‘এই যে বললি, কোনও অসুবিধে নেই। তাছাড়া এই তো নিজে নিজে রান্না-টান্না, বৈজুর সেবা-পথ্য সবই তো করতে পেরেছিস!’
—‘করলেই বা।’
—‘এসব ভালোও তো লাগে তোর। কেমন সব বন্ধুবান্ধব মিলে হই-চই করলি। আমি থাকলে তো বাড়িটাকে এমনিভাবে ব্যবহার করতে পারিস না।’
—‘তাই বলে মা না থাকলে অসুবিধে হবে না?’
—‘কি জানি।’
—‘শোনো মা। কে তোমাকে এই ইউটিলিটেরিয়ানিজম্ শিখিয়েছে? তুমি না থাকলে আমার বুকের মধ্যে টেনিস বলের মতো একটা ভ্যাকুয়াম থাকে। একদম মধ্যিখানে। কিছুটা হার্ট কিছুটা লাং। এই ভ্যাকুয়ামটা ভরবার জন্যে আমি খুব লম্ফঝম্প করি। যদিও একটা ভাল্ভ আমার কিছুতেই কাজ করে না। নিঃশ্বাসে বায়ু থাকে মা, প্রাণ থাকে না।’
—যা যা চুপ কর তো!’
প্রথমটা খুব হাসতে থাকে মুন্নি, তার থাক কাটা কাটা চুল দুলিয়ে। তারপর হাসি থামিয়ে বলে—‘মা বিশ্বাস করো!’ মুন্নি যখন বিশ্বাস করতে বলে, তখন অবিশ্বাস করার থাকা শুধু অরুণা কেন, মুন্নির বাবাও ভাবতে পারেন না।
রাস্তার দিকে চোখ পেতে থাকতে থাকতে অরুণার আধ-কপালে মাথা-ধরাটা আরম্ভ হল। তিনি নিশ্চিন্ত হলেন। একটা চিন্তা নিয়ে থাকতে থাকতে যখন মাথাটা পাগল-পাগল লাগে তখন ভাবনা করার যন্ত্রটা বিকল হয়ে গেলে বড় শান্তি। তিনি নিজের ঘরে এসে ভেনিশিয়ান ব্লাইন্ডটা নামিয়ে দিলেন। কপালে ঘষলেন একটা সবুজ ওষুধ। ও ডি-কলোনের জলে রুমাল ভিজিয়ে নিয়ে চোখে চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লেন। মাথার ঠাণ্ডা অনুভূতির ওপর মনটা পড়ে রইল। ঠাণ্ডা, খুব ঠাণ্ডা। আস্তে আস্তে মাথার নানান অলিগলিতে, ফাঁকে ফোকরে ঢুকে পড়ছে ঠাণ্ডাটা।
কেন যে নিজের কেরিয়ারটা ছাড়লেন। রঘুনন্দন মুখে বলেন নি ছাড়তে। কিন্তু তাঁর যখন অন্যত্র পোস্টিং হল অরুণা নিজেই থাকতে পারলেন না। বাপের বাড়ির সবাইকে চটালেন। তাদের সঙ্গে আজ আর কোনও সম্পর্ক নেই। শ্বশুর বাড়ি তো কোনদিনই তাঁকে গ্রহণ করেনি। রঘুনন্দনের তাতে কিছু আসে যায়নি। যতদিন তাঁর মা বেঁচে ছিলেন, মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছেন। কর্তব্য করেছেন, কিন্তু স্ত্রীকে কোনদিন অবহেলা করেননি। প্রথমটা অরুণা বড় সুখী হয়েছিলেন। বাপের বাড়ির পছন্দের কাউকে বিয়ে করলে এভাবে সুখী হতে আর পারতেন না। এখন মনে হয় যৌবন বড় স্বার্থপর। দায়-দায়িত্ব মাথায় নিতেও যতক্ষণ, আত্মসুখের জন্য সব নামিয়ে দিতেও ততক্ষণ। এখন নিজেকে খুব একলাও লাগে। রঘুনন্দন নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। একজন সিনিয়র আমলার নিজস্ব বলতে সময় খুব কমই থাকে। মেয়েও এখন নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, মগ্ন। তিনজনে একত্রে থাকতে তো পারছেনই না এখন। রঘুনন্দন রিজার্ভ-ব্যাঙ্কের চাকরিটা নিলে এমন হত না। যে যার উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে এক চুলও নড়বে না… ফলে সুখ যা হবার চূড়ান্ত হয়েছে। মান সম্মানও প্রচুর, কিন্তু অরুণার নিজের জীবন ক্রমশ কিরকম অর্থহীন আনন্দহীন হয়ে যাচ্ছে। রঘুনন্দন তাঁর কর্মজীবনের নানান খুঁটিনাটির কথা তাঁর সঙ্গে আলোচনা করা আজকাল একরকম ছেড়ে দিয়েছেন। মুন্নি অবশ্য তার বন্ধু-বান্ধব, পড়াশোনা, সোশ্যাল ওয়ার্কের নানান কথা তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে, মতামতও চায়। কিন্তু কেমন আলগা-আলগা, যেন বুড়ি ধুঁয়ে যাওয়া। নিজের কাজ, নিজের জীবন, নিজের লক্ষ্য কিছু চাই-ই। না হলে এই মাথা-ব্যথা এই প্রতীক্ষার কষ্ট… এই টানাপোড়েন… এ চলবেই।…
মৈথিলী যখন বাড়ি ফিরল, বাড়িটা এই সকালেই নিঝুম। বৈজুদা বলল—‘মায়ের দরদ হচ্ছে মাথায়, দেখো হয়ত এখন ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছেন। বাবা খুব চিন্তা নিয়ে অফিস গেছেন।’
মৈথিলী তার ঝোল্লা ব্যাগটা বসবার ঘরের টেবিলে রেখে, জুতো খুলে পা টিপে টিপে মায়ের ঘরে ঢুকল। অঘোরে ঘুমোচ্ছে মা, চোখ থেকে রুমাল সরে গেছে। ওডিকলোনের মৃদু গন্ধ হাওয়ায়। মায়ের চোখের তলায় কালি। মৈথিলীর মাকে একটা চুমু খাবার ইচ্ছে হল, কিন্তু সে ইচ্ছে সংবরণ করে সে আবার পা টিপে টিপে বসবার ঘরে চলে এলো। ফোনের বোতাম টিপল …‘মিঃ ত্রিপাঠী আছেন? —বাবা আমি মুন্নি কথা বলছি। হ্যাঁ বাবা, অ্যাডাল্ট লিটরেসি প্রোগ্রামে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ভেতরে যেতে হয়েছিল। অনেক কাজ। ফিরতে পারিনি। না কেউ না। লুকু?… লুকু যায় নি। আমি এসে গেছি, তুমি দুপুরে ভালো করে খেও।… কি করে জানলাম? বৈজুদা দেখালো, তোমার আধধাওয়া প্লেটটা এখনও রেখে দিয়েছে।’
বৈজু রান্নাঘরের দুয়োর থেকে চোখ পাকাচ্ছে—‘ঝুট বলবে না মুন্নি, ফোন রেখে মুন্নি বলল— ‘মিথ্যে কথা! তুমি যেভাবে বর্ণনা দিলে তাতে আমি ওই বিষন্ন, বিদীর্ণ প্লেটটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম যে বৈজুদা!’ তার মুখে হাসি।
বৈজু মুন্নির কথাবার্তার ধরনে অভ্যস্ত। সে-ও হাসছে। কিছু না বুঝে। কিন্তু মুন্নি এসে গেছে। আবার ওইভাবে হাত নেড়ে শক্ত শক্ত শব্দ দিয়ে কথা বলছে তার ভারি আনন্দ।
মায়ের ঘর থেকে চাপা আওয়াজ ভেসে এলো—‘মুন্নি এলি!’ মৈথিলী প্রায় এক লাফে মার ঘরে ঢুকে গেল। মায়ের বুকের ওপর ঝুঁকে পড়তেই মা বললেন —‘তোর জামাকাপড়ে কি বিটকেল গন্ধরে!’
—‘গন্ধ হবে না? সারাদিন রোদে রোদে ঘোরা, না জামা-কাপড় বদলানো, না ভালো করে চান, সেই এক ধড়াচুড়ো। এতদিন থাকতে হবে, এত অসুবিধেয় পড়ব, তা কি আগে জানতাম? মা, কোথায় শুয়েছি জানো?’
—‘কোথায়?’
—‘খড়ের বিছানায়।’
——‘সে কি রে?’
—‘সে এক অজ পাড়া গাঁ মা। মাটির ঘর খড়ের চাল, এ ছাড়া কিছু নেই। ওদের এক জনদের একটা বাড়তি ঘর খালি করে দিল, চারচালা ঘর। মেঝেতে আঁটি আঁটি খড় বিছিয়ে দিল, তার ওপর যে যার চাদর পেতে ধড়াচুড়ো পরে শুয়ে পড়লাম।’
—‘কে কে ছিল?’
—‘প্রমিত, শান্তনু, বুল্টু আর উজান।’
—‘সে কি লুকু ছিল না? আর কোন মেয়ে না?’
—‘লুকু শেষ পর্যন্ত যেতে পারল না। ওর বোধহয় মাম্পস হয়েছে মা।’
—‘তুই একা মেয়ে?’
—‘হ্যাঁ। তাতে কি?’
—‘তুই আর ওই চারটে ছেলে এক ঘরে?’
—‘হ্যাঁ! আর কোথায় জায়গা পাবো?
—‘মুন্নি, তুমি এভাবে আর যেও না। এগুলো ঠিক হচ্ছে না। বড়দের মধ্যে কেউ ছিলেন না?’
—‘প্রোফেসর সোম ছিলেন।
—‘তিনিও ওই একই ঘরে?’
—‘বাঃ, তাছাড়া কি?’
—‘তোর অস্বস্তি হল না! আচ্ছা মেয়ে তো!’
—‘অস্বস্তি হলেই বা কি করবো? উজানের অবস্থা যদি দেখতে! আঁট জিন্স্ পরে শুয়েছে মাঝ রাত্তিরে উঠে বসে বলল—‘আমার কোমর, পা সব হাঙরে কেটে নিয়ে যাচ্ছে।’ গ্রোফেসর সোম বললেন—‘তুমি একটু আলগা করো, আলগা হও, মৈথিলী দেয়ালের দিকে মুখ করুক। তাছাড়া এই লণ্ঠনের আলোয় কাউকেই ভালো করে দেখা যাচ্ছে না,’ গলাটাকে অনুপস্থিত ডঃ সোমের মতো ভারী করে মৈথিলী বলল।
অরুণার রাগ হচ্ছিল। তা সত্ত্বেও তিনি হেসে ফেলতে বাধ্য হলেন, বললেন —‘তোরা কি রে? লাজ-লজ্জা সব বিসর্জন দিয়েছিস?’
—‘লাজ-লজ্জা আবার কোথায় বিসর্জন দিতে দেখলে মা! কাজ করতে গেলে অতো পুতুপুতু চলে না, অ্যান্ড কাজ ইজ আ হান্ড্রেড টাইমস মোর ইমপর্ট্যান্ট দ্যান অল দ্যাট ন্যাম্বি-প্যাম্বি অ্যাবাউট মডেস্টি।’
অরুণা বললেন—‘যত কাজ কি তোর একারই মুন্নি? আর কেউ নেই?’
—‘কাজ করবার লোক সত্যিই খুব কম, মা। এই দ্যাখো না, লুকুটা অসুখ বাধিয়ে বসল। দেবপ্রিয় টার্ন আপ করল না, গুঞ্জন তো কি সব পরীক্ষা দিচ্ছে। আসলে আমরা সবাই ভাবি ওরা তো আছে ওরা করবে। লোক এমনি করে করে কমে যায়। যাক, তোমার মাথার যন্ত্রণা গেছে তো?’
অরুণা বললেন—‘এক ঘুম তো দিয়ে নিলুম। এরকম ভাবে কি কারো যন্ত্রণা যায় মুন্নি? অন্য সংসারে দেখো কর্ত্রী হাল ধরে থাকে, তার কথামতো, তার সুবিধে মতো সবাই চলে। আমার হয়েছে তোমাদের দুজনের মধ্যে তাঁতের মাকুর মতো ঘোরা। আর ভালো লাগছে না।’
—‘মা, তুমি আজ একদম খাঁটি সত্যি কথাটা বুঝেছ। তোমার নিজস্ব কিছু কাজ দরকার। যদি করতে চাও মা তোমাকে আমি অনেক কাজ দিতে পারি।
—‘রক্ষা করো! অরুণা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘আমার কাজ আমি খুঁজে নেবো। তোমায় আর আমার কাজ নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। তবে মনে রেখো মুন্নি, আমার নিজস্ব কাজ হলে আর তোমরা আমায় এরকম এক পায়ে খাড়া পাবে না। আমিও ব্যস্ত হতে, অন্যমনস্ক হতে জানি।’
মৈথিলী বলল—‘মা, তুমি দেখছি সত্যি-সত্যিই খুব রাগ করেছে। রাগ হলেই তুমি ভালো ভালো লাগসই ইডিয়ম ব্যবহার করো। ‘এক পায়ে খাড়া’টা রাগ হলেই তুমি বলো।’
মায়ের কাছে মৈথিলী একটু তরল, বাবার কাছে তরলতর। কিন্তু একই মিশ্রণের গাঢ়তা যেমন তাপের তারতম্যে বাড়ে কমে, তার স্বভাবের ব্যাপারেও তাই। মা বাবার উত্তাপে সে খানিকটা গলে থাকে। বাইরের পৃথিবী যত শীতল, যত নৈর্ব্যক্তিক সে ততই ঘন, ততই ঋজু, সংকল্প কঠিন, ওজনদার ও তার নেতৃত্ব তখন মেনে নেয় সবাই। উজান পর্যন্ত যে উজান শতকরা নব্বই ভাগ পুরুষ, দেব পর্যন্ত জীবন সম্পর্কে যার ধারণা মৈথিলীর চেয়ে অনেক প্রত্যক্ষ।
ছাত্রসঙ্ঘের প্রথম প্রোগ্রাম হয় বয়স্ক শিক্ষা। মেধাদি এবং ডাঃ সোমের সঙ্গে আলোচনা করতে ওঁরা মৈথিলীর ওপরেই সব ভার দিলেন। সূর্যদা বয়স্কশিক্ষার পাঠক্রম ঠিক করে দিলেন। সে সব ঠিকভাবে সাজানো মেধাদি সূর্যদা আর নন্দিতাদির সাহায্য নিয়ে প্রধানত মৈথিলীই করল। সেই পরিকল্পনা মতো তারা শালকিয়ার পিলখানা বস্তিতে, কাঁকুলিয়ার বস্তিতে কাজ করল। কিন্তু মৈথিলীর একেক সময়ে সন্দেহ হয় সে এই ধরনের নেতৃত্বের যোগ্য কি না, সে বড্ড শহুরে, বড্ড বেশি উচ্চবিত্ত। শুভ-সংকল্প আর সমবেদনা ছাড়া এই স্তরের মানুষের সঙ্গে তার কোনও যোগ নেই। যখন তারা শহরের আশপাশের শ্রমিক-বসতিগুলোয় অভিযান চালানোর কথা আলোচনা করছে, পুলকেশ, প্রমিত, উজান সবাই-ই এতে সায় দিচ্ছে, সে সময়ে দেব একদিন বলল মফঃস্বলের লোকেরা যত দরিদ্রই হোক, কিছু-না-কিছু সুযোগ-সুবিধে তারা পায়ই। কিন্তু শহর থেকে বহু দূরে যেসব গণ্ডগ্রাম আছে সেখানকার অবস্থা সত্যিই ভয়াবহ। আগে এরা মহাজনের ওপর নির্ভর করে মার খেতো। এখন খাচ্ছে পঞ্চায়েত আর জেলা-বোর্ডের হাতে। এদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার সর্বপ্রথম দরকার। উজান তখন দেবদের গ্রামটাকেই কর্মকেন্দ্র করবার প্রস্তাব দেয়। দেব বলে হুগলি জেলায় এমনিতে লিটরেসি লেভেল হাই। তার ওপর ওদের গ্রামে পৃথ্বীন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি বলে একজন আছেন, তিনি নিজেই বয়স্ক শিক্ষার প্রোগ্রাম নিয়েছেন। ওদিকে না গেলেও চলবে। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর ঠিক হল দক্ষিণ চব্বিশপরগনার এই কেওড়া বা কেওড়াখালি গ্রাম। ওই গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার নিরঞ্জন খাঁড়া মশাইয়ের সঙ্গে এম ভি’র কিভাবে যেন যোগাযোগ হয়। খুব সম্ভব খরার সময়ে নিরঞ্জনবাবু নানান জায়গায় সাহায্য প্রার্থনা করে করে ঘুরতেন। এম ভি-ই প্রথম সূর্যদা আর নন্দিতাদিকে নিয়ে কেওড়াখালি গ্রাম দেখে আসেন। প্রোগ্রাম ছকা হল। মা বাবাকে অ্যাডাল্ট লিটরেসি বলে বুঝিয়ে দিলেও মৈথিলীদের পরিকল্পনা আরও ব্যাপক। তারা এর জন্য চ্যারিটি শো করে করে টাকা তুলেছে, ছাত্রসঙ্ঘের চাঁদার টাকা, এবং কিছু কিছু ডোনেশনও আছে।
স্টেশনের নাম কি অদ্ভুত অদ্ভুত— বহড়ু, তালদী, ধপধপি। অন্য স্টেশনে নেমেও যাওয়া যায়। ওরা ধপধপিতে নেমেছিল। বাসের রাস্তা শেষ হয়ে গেল। তারপর কুলতলির মাঠ। দক্ষিণ-পূর্ব কোণ ধরে এই তেপান্তর পার হতে হয়। ভীষণ গর্ত, জায়গায় জায়গায় কাদার দঁক, বালি। এখানে ওই গ্রামের উৎসাহী হেডমাস্টারমশাই নিরঞ্জন খাঁড়া একটা ভ্যানগাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সেই ভ্যানগাড়িতে তারা ছজন কিছুটা বসে কিছুটা ঠেলে গ্রামে পৌঁছল। ছেলেরা সবাই কিছুটা করে ঠেলেছে। ডঃ সোম, কিছুতেই ভ্যানগাড়িতে উঠবেন না, হাঁটছেন, আর কপালের ঘাম মুছছেন। সাইকেলের চাকা মাঝে মাঝেই বসে যাচ্ছিল ময়াল সাপের মতো কাদার ফালে। এদিকে বৃষ্টি হয়নি, কিন্তু ওদিকে, শহরের ছেলে মেয়েরা যাবে জেনে তাদের বিপদে ফেলবার জন্যেই যেন বেশ কয়েক দফা হৈমন্তী বৃষ্টি হয়ে গেল। শীতও বাড়ল। রাস্তার কষ্টও। ডঃ সোম বারণ করা সত্ত্বেও মৈথিলীও কিছুটা ঠেলেছে। মেয়ে বলে সে আলাদা সুবিধে নিতে চায় না। যদিও উজান বলেছিল—‘মৈথিল, বাড়াবাড়ি করিসনি। ডাক্তারি পড়ছিস, নিশ্চয় জানিস ছেলে হবো বললেই হওয়া যায় না।’
গ্রামটা এলোমেলো গাছ পালায় ভরা। শীতের গোড়ায় বহু গাছের পাতা ঝরে গেছে। রাস্তাঘাট, বসতবাড়ি, পুকুরঘাট ইত্যাদির শোচনীয় অবস্থা। কুটিরগুলো মোটামুটি পরিষ্কার। কিন্তু এদের পরিচ্ছন্নতার একমাত্র ধারণা গোবর। গ্রামটাতে নদী নেই। কিছু দূরে মাতলা নদী থেকে খালের মতো খানিকটা ঢুকে এসেছে। বাঁয়ে পিয়ালীরও এরকম দু-একটা খাল আছে। এগুলোকে ওরা কানা মজা আর বোজা নাম দিয়েছে। একটিমাত্র পুকুর। তাতেই গ্রামসুদ্ধু লোকের চান, বাসনমাজা, কাপড় কাচা, পানীয় জল সংগ্রহ সব চলে। দেখে শুনে বুল্টু বলল—‘এরা বেঁচে আছে কি করে বল তো? আন্ত্রিক আর কলেরায় এখনও উজাড় হয়ে যায় নি এটাই আশ্চর্য।’
নিরঞ্জন খাঁড়া জানালেন এবছর গরমকালেই প্রচণ্ড আন্ত্রিকের মড়ক লেগেছিল। প্রথমে ওদের দু দিন থাকার কথা ছিল। অবস্থা দেখে ঠিক হল পাঁচদিনের কমে কিছু হবে না। কোন্ কোন্ ব্যাপারে সংস্কার চাই, কোথায় নতুন উদ্যোগ দরকার সেগুলো সরেজমিনে ছকে ফেলা চাই। কুয়ো এবং নলকূপ খোঁড়া হবে। স্পটগুলো উজান ঘুরে ঘুরে ঠিক করল। ওরা থাকতে থাকতেই তো একটা পাতকুয়ো খোঁড়া হয়ে গেল। কিন্তু টিউবওয়েলের জন্যে তো শহরে এসে বিলিব্যবস্থা করতে হবে! খালগুলো থেকে কচুরিপানা পরিষ্কার করাতে হবে। বেশ কিছু জলা জায়গা আছে সেগুলোরও সংস্কার চাই। চারদিনই বিকেলবেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা করেছে মৈথিলী আর প্রমিত। সাধারণ স্বাস্থ্যের নিয়মপালন, পানীয় জল সম্পর্কে কড়াকড়ি। সাপের কামড়ে এখানে প্রায়ই লোক মরে, সর্পাঘাত, আগুন, জলে ডোবা ইত্যাদির ব্যাপারে ফার্স্ট এইড এবং পরবর্তী করণীয় পরিবার পরিকল্পনা। তালিকায় তো রয়েছে প্রচুর, চার দিনে আর কতটুকু হয়। বয়স্ক শিক্ষার ক্লাসও নিয়েছে বাকিরা, সন্ধেবেলায়। হেড মাস্টার নিরঞ্জনবাবুকেই বয়স্ক-শিক্ষার ট্রেনিং এবং দায়িত্ব দিয়ে এসেছে ওরা। তিনি প্রতি সন্ধেবেলায় তাঁর স্কুলঘরেই বড়দের পড়াবেন। দরকারি বইপত্র, স্লেট পেনসিল, বোর্ড চক প্রভৃতি প্রথম দফায় যা লাগবে তা সবই ওরা দিয়ে এসেছে। স্বাস্থ্য সম্পর্কে ওরা শুধু ক্লাসই নেয়নি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সরেজমিনে দেখে শুনে হাতে কলমে কিছু কিছু আচরণবিধি শিখিয়ে দিয়ে এসেছে।
দেব যে কেন গেল না! শেষ মুহূর্তে টার্ন আপ করল না। ওরও কি লুকুর মতো কিছু অসুধ-বিসুখ করেছে? মনে হয় না। চেহারার ধরণটা একটু পলকা হলেও দেব রীতিমতো ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী। এতদিনের মধ্যে একদিনও তার কোনও শারীরিক গণ্ডগোল হতে দেখা যায়নি। ওদের যাবার আগে, কি কি প্রয়োজন হতে পারে, বইপত্র ইত্যাদি কোথায় পাওয়া যাবে, আন্দাজ কতো নেওয়া হবে এ সবই ব্যবস্থা ও করেছিল। কারণ ওর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। ও-ই বলেছিল স্বাস্থ্য সম্পর্কে একটা দুটো বক্তৃতায় বা ফার্স্টএইড শিখিয়ে এলেই কাজ হবে না। স্থানীয় দুচার জনকে রীতিমতো ট্রেনিং দিয়ে, প্রাথমিক কিছু ওষুধ পত্র ব্যান্ডেজ, গজ, অ্যানটিসেপটিক ইত্যাদি দিয়ে স্বাস্থ্য কেন্দ্র খুলে দিয়ে আসতে হবে।
নিরঞ্জন খাঁড়া ছাড়া লেখাপড়া বলতে কেউ কিছু জানে না। একদম চাষীগাঁ। কিন্তু নিরঞ্জনবাবু সকালে ছোটদের স্কুল চালান। সন্ধেয় এখন থেকে বড়দের ক্লাস নেবেন, এর পরে যদি স্বাস্থ্যকেন্দ্রও চালাতে হয় তো তাঁর পক্ষে বড্ড বেশি হয়ে যায়। প্রাথমিক কিছু ওষুধপত্র তাঁর কাছেই রেখে এসেছে ওরা। তাঁর স্কুলের সবচেয়ে উজ্জ্বল ছেলেটির নাম নীলমণি, তাকে তৈরি করে দিতে পারবেন আশ্বাস দিচ্ছেন নিরঞ্জনবাবু।
ইতিমধ্যে গ্রামের মেয়েরা পাতকুয়ো এবং টিউবওয়েল খোঁড়া হবে শুনে খুব উৎসাহী। পঞ্চায়েতে বলে বলে ওরা হার মেনে গেছে। এ গ্রাম তো পুরোপুরি গ্রামের মর্যাদাও পায় না, মৌজা মাত্র। গ্রাম সেবকদের এ গ্রামের কথা মনে থাকে না। বড় বড় বর্গাদার আছে পাশের গ্রামে, তাদের গায়ের জোর, গলার জোর, ট্যাঁকের জোর সব বেশি। মনোযোগ সবটুকু তারাই কেড়ে রেখেছে। সেচের তো কথাই নেই, পানীয় জলের জন্যও শুখার দিনে ওদের বহুদূর যেতে হয়, সেই কষ্ট কমবে। বয়স্ক-শিক্ষার ব্যাপারে আবার এদের উৎসাহ কম। দু একজন গিন্নিবান্নি বলল—‘কি হবে গো দিদি! মেয়ে তো তোমার মতো পেন্টুল পরে শহরে বাজারে ঘুরবে না! ষোল পার হলেই বিয়ে দিয়ে দুব। নাউয়ের শাক রাঁধবার জন্যে কি গোবরছড়া দেবার জন্যে নেকাপড়া না শিখলেও চলবে।’
প্রমিত বলল আপনার মেয়ের ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবেন তো!
—‘সে শক তো মানুষের থাকেই দাদাবাবু।’
—‘তবে? নাতির বেলায় চাইছেন, মেয়ের বেলায় চাইছেন না কেন? মেয়ে লেখাপড়া শিখলে নাতির তো ঘরে বসেই অক্ষরপরিচয় হয়ে যাবে। ইস্কুলে যাবার আগেই। লেখাপড়া শিখলে কেউ ঠকাতে পারবে না, কাগজ পড়বেন, ইস্তাহার পড়বেন, সই কিসে দিচ্ছেন জানতে পারবেন।’
গিন্নি-মানুষটির মুখ তবু গোঁজ রইল। সন্ধেবেলায় মেয়ে ঘরে পিদিম দেখায় জল ছড়া দেয়, রান্না করে, সে সময়টা তাকে ছাড়তে হলে তার ক্ষেতি।
আসবার সময়ে আবার খাঁড়া মশাই হাত কচলে বললেন ‘এদের একটা ভীষণ অভাব পরনের বস্ত্রের। অনেকেরই একটি বই দুটি নেই। আপনারা যদি আপনাদের পুরনো জামাকাপড় কিছু দ্যান, ছেলেমেয়েগুলো পরে বাঁচে।
শান্তনু, প্রমিত, উজান নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করল ওরা এবার কলকাতা ফিরে গিয়ে পুরনো জামাকাপড় সংগ্রহ করবে। নিরঞ্জনবাবু কয়েক দফায় নিয়ে আসবেন।
মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা হওয়ার পর মৈথিলী ভালো করে চান করল, বেশ করে সাবান মেখে। তাররপর নিজের ঘরে ঢুকে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ডায়েরি লেখায় মগ্ন হয়ে গেল। এটা তার নিত্যকর্ম।