উত্তরসাধক (Uttarsadhak) : 04
স্কুটারটাকে গ্যারাজে তুলে গেটের তালা খুলতে খুলতেই মেধা শুনতে পেলেন ভেতরে টেলিফোনটা বাজছে। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিট্যুট হয়ে তিনি গিয়েছিলেন সংস্কৃত বিভাগের নন্দিতার বাড়ি। নন্দিতার কাছে কিছু প্রাচীন পুঁথি এসেছে। অনুবাদ করছে ও। মেধাদির কাছে সাহায্য চেয়েছিল। মেধার নিজেরও উপকার। এইসব পুঁথি প্রাচীন ভারতের নানান সময়ের সমাজ-ব্যবস্থা, প্রশাসন, অভিজাতদের জীবন-যাপন, অর্থনীতি, ইত্যাদির ওপর অনেক সময়েই তির্যক আলো ফেলে। গভীর রাত্রে রাত্রির সঙ্গে রঙ-মেলানো বসন পরে অভিসারিকারা পথে বার হত। খুবই পারমিসিভ সোসাইটি সন্দেহ নেই, কিন্তু মেয়েগুলো অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসত। মেয়েদের ওপর যখন-তখন অত্যাচার, হালের ভারতবর্ষে যা হচ্ছে, তার বিন্দুমাত্রও যে তখন ছিল না, অভিসারিকা-সিসটেমটা তো তারই প্রমাণ? সেটা কি শাসকের গুণে না সামাজিক শিক্ষার গুণে? এই যে বারাঙ্গনা শ্রেণী যাঁরা চৌষট্টি কলায় শিক্ষিত হতেন, যাঁদের গৃহে নগরের বিদগ্ধ ব্যক্তিরাও এসে আলাপ-আলোচনায় যোগ দিতেন তাঁরা কি জাপানের গেইশাদের সঙ্গে তুলনীয়? না প্যারিসে যাঁরা সালোঁ বসাতেন শিল্পী-সাহিত্যিক এদের খাতির করে তাঁদের মতো? ব্যাপারটা প্রিমিটিভ না অতি-আধুনিক?
সিঁড়ি দিয়ে খানিকটা উঠে মাঝের ল্যান্ডিংটা বড় মাপের। বিরাট পেতলের আধারে একটা রবার গাছ। বাবার জিনিস। তারই কোলে আবলুশ কাঠের ছোট্ট স্ট্যান্ডে টেলিফোনটা বাজছে। ধরতে ধরতেই রিংটা বন্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে রইলেন মেধা। কিন্তু ফোনটা আর বাজল না। অগত্যা ওপরে উঠে কোল্যাপসিব্লের তালা খুলে ঘরে ঢুকলেন, আলো জ্বাললেন, ব্যাগটা টেবিলের ওপর নামিয়েছেন এমন সময়ে টেলিফোনটা আবার বাজল। এক রকম দৌড়ে গিয়েই ধরলেন মেধা। বহুদূর থেকে ক্ষীণকণ্ঠ ভেসে আসছে ‘ম্যাডাম। ম্যাডাম আপনার সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে, আমায় একটু সময় দেবেন?’
—‘তুমি কে সেটা আগে বলবে তো!’ মেধা বললেন।
—“আমি…’ ফোনটা আবার কেটে গেল।
মেধা বিরক্ত, হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ইচ্ছে করে কলকাতার প্রত্যেকটি টেলিফোন-যন্ত্রকে গুলি করে মেরে ফেলতে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও আর রিং হল না। লাইন পাওয়া একেই কঠিন। ক্ষীণস্বর শুনেই বোঝা যায় ঠিকমতো কাজও করছে না। ফিরে আসতে আসতে মেধা ভাবতে লাগলেন কে হতে পারে? ম্যাডাম বলে তাঁকে কে কে ডাকে? ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের মধ্যে বলে এম. ভি। প্রয়োজন হলে মেধাদি বলে। ঘরে এসে শাড়ি বদলাতে বদলাতে তাঁর মনে হল এ নিশ্চয়ই ছাত্রসঙেঘর কেউ। ছাত্রসঙ্ঘ ব্যাপারটা মৈথিলীর উদ্ভাবন না মেধার বলা শক্ত। মেধা যখন বস্টন থেকে ফিরে এলেন, তখন শিক্ষাজগতের আবহাওয়ায় একটা লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখলেন। চিত্রটা খুব হতাশাজনক। ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর থেকে সততা ও নীতির চাপটা একেবারে উঠে গেছে। তারা বিশৃঙ্খল, অরাজক। ক্লাসে অসম্ভব হল্লা করে সুবিধে পেলেই। আরও ভয়াবহ চিত্র অধ্যাপক মহলের। তাঁদের বেশির ভাগই কোনও না কোনও দলীয় রাজনীতি করেন। এবং পড়ানোর সময়ে সুকৌশলে সেই রাজনীতি বক্তৃতায় ঢুকিয়ে দ্যান। এর ওপর, তাঁদের ক্লাশে যাওয়াটাই একটা ব্যতিক্রম। অল্পবয়স্করা সব থিসিস, পেপার, এম. ফিল করতে ব্যস্ত। নাহলে তাঁদের ইনক্রিমেন্ট হবে না। কয়েকজন আন্তরিক স্বভাবের মানুষ আছেন। ছাত্রদরদী না হন, যে কাজের জন্য নিযুক্ত আছেন সেটা যথাসাধ্য ভালোভাবে করা দরকার এটা তাঁরা মনে করেন। অধ্যাপকদের মধ্যে এই শৈথিল্য যে আগেও ছিল না, তা নয়। কিন্তু এঁরা ছিলেন মুষ্টিমেয়। এঁদের নাম-ডাক, প্রশাসনিক কাজকর্মের দায়, অন্যান্য বহু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ এঁদের দুর্ভেদ্য করে রাখত। সরকারি কলেজে ছাত্রদরদ জিনিসটা চিরকালই কম। বদলি এবং প্রোমোশন এই দুটো জিনিসই সাধারণত সেখানে বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। কিন্তু যান্ত্রিক ভাবে হলেও পঠন পাঠনের কাজটা চলত। এবার এসে মেধা দেখলেন বেশিরভাগ অধ্যাপকই ক্লাসে যাচ্ছেন না, বা গেলেও ফিরে আসছেন। কারণ ক্লাসে ছাত্র নেই। ছাত্রদের মধ্যে নাকি একটা নতুন কথা চালু হয়েছে পাস-কোর্সের ক্লাস গাধারাই করে। হঠাৎ এই প্রজন্মের ছাত্ররা কি করে এতো স্বাবলম্বী হয়ে গেল মেধা ভেবে পেলেন না। পরে দেখলেন তারা আদৌ স্বাবলম্বী নয়, প্রত্যেকটি বিষয়ের জন্য তারা কোচিং ক্লাসে যায়, সেখানে তৈরি নোট পায়, পরীক্ষাটা ছাত্রদের হয় না, হয় অধ্যাপক-টিউটরদের। আরও অনেক জিনিস তাঁর দৃষ্টিগোচর হল, খাতা দেখার সময়ে কলেজ এবং এলাকা ধরে ধরে বাছ-বিচার হয়। এবং কোচিং ক্লাসগুলোর সঙ্গে পরীক্ষার ফলাফলের কোথাও একটা সূক্ষ্ম অসাধু যোগাযোগ আছে। মেধা তাঁর পূর্ব-অভিজ্ঞতা থেকে জানেন সোজাসুজি প্রতিবাদ এবং বিদ্রোহ বিশেষত : তিনি একলা করে কিছু করতে পারবেন না। সৎ এবং আন্তরিক ছাত্রও আছে অধ্যাপকও আছেন, কিন্তু তাদেরও একটা বড় অংশ ভীরু, অনেকে পরিকাঠামোর এই শৈথিল্যের সুযোগ নেন। যদিও নিজেরা সোজাসুজি অসৎ নন। এই অন্যায়ের প্রতিকারের ভাব ছাত্রদের হাতে তুলে দেওয়া যায় না। কারণ সাধারণ ছাত্রসমাজ মুণ্ডহীন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন-দানবের মতো। তারা যত সহজে ভাঙতে পারে তত সহজে গড়তে পারে না, বিধ্বংসী তাদের প্রাণশক্তি। এই প্রাণশক্তিকে খুব সাবধানে ব্যবহার করতে হয়। ভারতবর্ষের ইতিহাস বলছে কেউ এদের যথাযথ ব্যবহার করেননি। স্বাধীনতা-পূর্ব দিনগুলি থেকে নকশাল আন্দোলন পর্যন্ত এই বিপুল প্রাণশক্তি আত্মধ্বংসী বন্যার কাজে ব্যবহার হয়েছে, যে বন্যা কোনও পলির প্রলেপ রেখে যায় না, রেখে যায় শুধু ধূ-ধূ বালির উষর চড়া।
মনের অবস্থা যখন ভীষণ অশান্ত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, মেধা সরকারি কলেজ ত্যাগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন সেই সময়ে একদিন তাঁর মেজদার বন্ধু রঘুনন্দন ত্রিপাঠীর মেয়ে মৈথিলী তাঁর কাছে একটি প্রস্তাব নিয়ে আসে। মৈথিলী মেয়েটি অত্যন্ত গুণী, চৌখস, ইচ্ছে করলেই সে দেশে কিম্বা বিদেশে অনেক উঁচুতে উঠতে পারবে। পরিবারও প্রভাবশালী। কিন্তু মৈথিলী খুব আন্তরিকভাবে তাঁকে জানাল যে ছাত্রদের নিয়ে সে এবং তার কয়েকজন বন্ধু একটা প্রতিষ্ঠান গড়তে চায়। সে স্কুলে, কলেজে, সবরকম প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির অনুপ্রবেশ লক্ষ্য করেছে, এতে সে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন, এর মধ্যে ছাত্রদের কোনও মঙ্গল নেই এই তার ধারণা। তাদের প্রতিষ্ঠান হবে সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত, সমাজ-কল্যাণই হবে তাদের প্রধান লক্ষ্য। সব কলেজ, ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা এর সদস্য। মৈথিলী মেধাকে উপদেষ্টা হিসেবে চায়। এবং এই প্রসঙ্গেই জানায় যে সমস্ত অধ্যাপকের সৎ, আন্তরিক, কর্মী এবং নির্ভীক বলে সুনাম আছে তাঁদের অনেককেই তারা এই উপদেষ্টা মণ্ডলীতে থাকবার অনুরোধ জানাচ্ছে। মেধা প্রথমে রাজি হননি। কিন্তু মৈথিলী যখন বার বার করে জানালো তাদের রাজনীতির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই, এবং তারা শুধু অলস সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানটা গড়ছে না, গড়ছে মৈথিলীর ভাষায় ‘উইথ ডেড সীরিয়াসনেস’, তখন মেধা রাজি হয়েছিলেন। এরা ইতিমন্ন্যে বেশ কিছু সাক্ষরতা-অভিযান করেছে, ‘স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন’ এটাও ছিল এদের কয়েকটা অভিযানের মুখ্য উদ্দেশ্য। সংগ্রহ করেছে প্রচুর ছাত্র সদস্য। সাধারণ সদস্যদের সংস্পর্শে খুব বেশি না এলেও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক সমিতির সভ্য মেডিক্যাল কলেজের মৈথিলী ত্রিপাঠী ও দেবপ্রিয় চৌধুরী, এঞ্জিনিয়ারিং-এর উজান আফতাব, তাঁর নিজের প্রত্যক্ষ ছাত্রী লক্ষ্মীশ্রী মজুমদার ও গুঞ্জন সিং, এবং সায়েন্স কলেজের প্রমিত গুপ্ত তাঁর সঙ্গে অধিবেশনে মাঝে মাঝেই বসে। এদের মধ্যে প্রথম তিনজন যে অসাধারণ তাদের সংকল্পে, কল্পনাশক্তিতে ও চরিত্রবলে তা তিনি টের পেয়েছেন। উপদেষ্টাদের মধ্যে প্রধানত আছেন নন্দিতা সাহা, ডঃ প্রভাস সোম, সূর্য দাস, মধুচ্ছন্দা দাশগুপ্ত। মুশকিল হচ্ছে এঁরা সকলেই সংসারী মানুষ। নিজের নিজের বৃত্তিতেও আকণ্ঠ নিমজ্জিত। নন্দিতা লেখে, ডঃ সোম রিসার্চ প্রজেক্ট পরিচালনা করেন, সূর্য ভীষণ ভালো ছেলে, কিন্তু বিরাট যৌথ পরিবারের দায় তার কাঁধে, মধুচ্ছন্দার নাচের কেরিয়ার রয়েছে। সংসার-জীবনেও তার নানা গোলমাল। অনেক অধিবেশনেই মেধা দেখেন এদের ‘উপদেশ’ দিতে তিনি একাই এসেছেন। এবং সে ‘উপদেশে’র জন্য ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় সমিতির আগ্রহ ও শ্রদ্ধা অসীম। যদিও তারা প্রত্যেকটি পরামর্শ নিয়ে আলোচনা করে, সময়ে সময়ে সেটাকে আংশিক বদলায়ও। এদের সঙ্গ মেধার উজ্জীবন, উদ্দীপন।
রাত্রের খাবার তৈরি করতে করতে হঠাৎ একটা নাম মেধার মনে এলো। দেবপ্রিয়। খুব সম্ভব ফোনটা করেছিল দেবপ্রিয়। স্যুপটা গরম করতে বসিয়েছেন, রুটি দুটো হয়ে গেছে মেধার ইচ্ছে হল মোটা মোটা আলুভাজা খাবেন। আলুগুলো কাটতে কাটতে ক্ষীণ টেলিফোন-স্বরটা স্মৃতিতে মৃদু ধাক্কা দিচ্ছিল। গরম তেলের মধ্যে আলুগুলো চড়াৎ করে ছেড়েছেন এমন সময় নামটা মনে এলো। দেবপ্রিয়র গলা চট করে শোনা যায় না। এগজিকিউটিভ কমিটির মীটিং-এ থাকলেও সে বেশির ভাগ কথাই মৈথিলী ও উজানকে বলতে দেয়। মাঝে মাঝে, খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সময়ে তার বক্তব্য একবার দুবার শোনা যায়, এবং তখনই বোঝা যায় সে কোনক্রমেই ঘুমন্ত সদস্য নয়। সম্পূর্ণ সজাগ, কাজে আগ্রহী। কিন্তু সবাইকার সঙ্গেই দেবপ্রিয় একটা দূরত্ব রেখে চলে। ছেলেটি গ্রাম থেকে এসেছে। মেয়েদের সঙ্গে খুব সহজ হতে পারে না। এটা অবশ্য একটা অনুমান। কিন্তু উপদেষ্টা কমিটিতে যেসব পুরুষ অধ্যাপক আছেন তাঁদের সঙ্গেও তো সে খুব ঘনিষ্ঠ নয়। মেধার সহজাত বোধ বলে দেবপ্রিয় ছেলেটি আরও একটু সক্রিয় হলে ভালো হত। তার নিজের পক্ষে তো বটেই। ছাত্রসঙেঘর পক্ষেও। কারণ মৈথিলী সমাজ-কল্যাণ বা গ্রাম-কল্যাণ করতে চাইলেও তার সঙ্গে মাটির যোগ খুব কম। দেবপ্রিয় যখন মতামত দেয় বোঝা যায় সে সমস্যার সঙ্গে আরও অনেক প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। লাজুক, মুখচোরা দেবপ্রিয় আজ কেন তাঁকে ফোন করেছিল জানতে মেধা খুব কৌতূহল বোধ করছিলেন। কিন্তু কলকাতার টেলিফোন সিসটেম যদি কোনও ব্যাপারে বাধা দেবে মনে করে তো সে বাধা অতিক্রম করে কার সাধ্য!
খাওয়া শেষ করে মেধা-অন্যমনস্কভাবে মুখ ধুলেন। এখন তিনি অনেকক্ষণ পড়াশোনা করবেন। গবেষণার কাজ মেধা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। যে বছরগুলো মার্কিন দেশে ছিলেন ওরা তাঁর মস্তিষ্ক, অন্তরাত্মা নিংড়ে একটার পর একটা পেপার করিয়ে নিয়েছে। স্প্যানিশ ইমিগ্র্যান্টসদের ইতিহাস, ইজরায়েল-মার্কিনি সম্পর্কের প্রথম দশ বছরের তাৎপর্য, বেশির ভাগই আন্তজাতিক সম্পর্কের ওপরে। এসব পেপার লেখার কোন প্রয়োজন তাঁর ছিল না। কোনকালে তিনি নিছক পাণ্ডিত্যের জন্য পড়াশোনা করেননি। এখনও তিনি মনে করেন ইতিহাসে গবেষণার চেয়ে জীবন্ত ইতিহাস গড়ে তোলা আরও অনেক জরুরি, অনেক রোমাঞ্চকর কাজ।
রাতের পোশাক পরে আলোটা নিভিয়ে দিতে যাচ্ছেন এমন সময়ে বাইরের দরজার বেলটা বাজল। ড্রেসিং গাউন পরতে এক মিনিট। বড় বড় পায়ে জানালার কাছে এগিয়ে নিচে টর্চ ফেললেন মেধা—‘কে?’
নিচ থেকে সাড়া এলো—‘আমি দেবপ্রিয়।’
‘এত রাতে?’
—‘কলেজ স্ট্রিট থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসছি। অনেকবার ফোন করবার চেষ্টা করলুম! বেশিক্ষণ সময় নেবো না।’
দরজা খুলে দিয়ে মেধা বললেন—‘ওপরে এসো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা হয় না।’ দোতলার দালানে সোফার ওপর খুব আত্মসচেতন সঙ্কুচিতভাবে বসল দেবপ্রিয়। মেধা বললেন—‘কটা বেজেছে জানো?’
—‘জানি। সাড়ে এগারটা।… আসলে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলুম।… ফিরে এসে ফোন করলুম। লাগল না ঠিকমতো।… বাস পেলুম না…
—‘তার মানে তোমার খাওয়া-দাওয়াও হয় নি?’
—‘ও হ্যাঁ, মানে না… খাওয়া-দাওয়ার কথা আমার মনে ছিল না।
মেধা কথা বলতে বলতেই ফ্রিজ খুলছিলেন। বললেন—‘রাত্রে ভাত খাও?’
দেবপ্রিয় উঠে দাঁড়িয়ে বলল—‘খাওয়া-দাওয়ার সময় আমার নেই ম্যাডাম। আমি শুধু বলতে এলুম পরবর্তী প্রজেক্টগুলোয় আমি থাকতে পারছি না।’
—‘হঠাৎ?’ মেধা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
—‘হয়ত আমি ছাত্রসংঘও ছেড়ে দেবো?’
—‘ছেড়ে দেবে? তো সে কথা ছাত্রসঙ্ঘের সেক্রেটারিকে প্রেসিডেন্টকে জানাও, আমাকে কেন?’
—‘ম্যাডাম, বাইরে থেকে ছাত্রসঙেঘর কাজ-কর্ম আমি সবই করব, শুধু কোনও সম্মেলনে যাবো না। এর কারণটা খুব সিরীয়স, এক্ষুণি জানাবার সময় আসেনি।
কিন্তু কেউ যেন বুঝতে না পারে আমার এই সিদ্ধান্তের কথা। শুধু আপনি জানবেন।’
—‘তুমি যে কী বলছ, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘এখন আপনাকে বোঝাতে পারবো না। বোঝাবার বিপদ আছে। উজান, বা কেউ যেন জানতে না পারে। আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন।’ দেবপ্রিয় বলতে বলতে সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিল। মেধা পেছন থেকে গিয়ে তার বাহু ধরলেন—‘এতরাতে কোথায় যাবে? খেয়ে নিয়ে এখানেই শুয়ে পড়ো। আমার কোনও অসুবিধে নেই।’
দেবপ্রিয়র চোখে রীতিমতো আতঙ্ক। বলল—‘ম্যাডাম, প্লীজ আমাকে মাপ করুন।’ মেরুন রঙের ড্রেসিংগাউন পরা দীর্ঘাঙ্গী মেধা ভাটনগর রাত সাড়ে এগারটার ভুতুড়ে আলোয় যেন কোনও অতিপ্রাকৃত লোকের অধিবাসী। দেবী না অপদেবী বোঝা যায় না।
—‘তুমি কি হোস্টেলে থাকো?’
—‘না। আমি একটা ফ্যামিলিতে থাকি। রাতে বাড়ি না ফিরলে কালকে আর ঢুকতে পাবো না।’
মেধা হেসে বললেন ‘রাত দুটোয় ফিরেলে ঢুকতে পাবে?’
দেবপ্রিয় হাসল, বলল—‘একটু অশান্তি হবে। কিন্তু পাবো।’
মেধা বললেন—‘তাহলে অন্তত খেয়ে নাও। নিয়ে অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়ো। মধ্যরাতের কলকাতার দুঃসাহসিক অভিযান রোমাঞ্চকর হতে পারে, কিন্তু কুকুর, পুলিস, মাতাল, গুণ্ডাদের পাশ কাটিয়ে বেরোতে হলে খালি পেটে পারা সম্ভব নয়।’
দেবপ্রিয় নিতান্ত নাচারের মতো খেলো। রুটি মাখন, দুধ আর কিছুটা স্টু ছিল তাই-ই দিলেন মেধা। ওর খাওয়া দেখতে দেখতে তিনি অনুমান করবার চেষ্টা করতে লাগলেন ছেলেটা কেন ছাত্রসংঘ ছেড়ে দিতে চায়। ছাত্রসংঘের জন্মের পেছনে কোনও নির্দিষ্ট মতবাদ নেই, যেমন তাঁদের সময়ে ছিল। কেউ বিপ্লবে বিশ্বাসী, কেউ শোধনবাদে—এইসব প্রশ্নে চৌষট্টি সালে পার্টি ভাগ হয়েছিল। সাতষট্টির নির্বাচন পর্যন্ত একই নামে দুটি পার্টি চালু রইল। তারপর দুজনেই যখন নির্বাচন নামল, নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে গণ্ডগোল দেখা দিল। এসবের নাড়িনক্ষত্র জানত রোকেয়া, সে-ই তাঁকে ওয়াকিবহাল করে, এত কথা সান্যালদা জানাতে চাইতেন না। কিন্তু এদের মধ্যে তো সে সব প্রশ্ন নেই। এদের কাজের ধরন হল সরাসরি একটা পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করে অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা করা। তবে কি কোনও মনোমালিন্য? অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে খেয়োখেয়ি, মন কষাকষি, জিনিসগুলো একেবারে বরদাস্ত করতে পারেন না তিনি। সেটাই যদি কারণ হয় তবে দেবপ্রিয়কে তিনি দ্বিতীয়বার ফিরে ডাকবেন না। অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার আবহাওয়া ধ্বংস হয়ে সহযোগিতার যুগ আরম্ভ হোক এদের মধ্যে এই তাঁর মনের গোপন সংকল্প। কিন্তু দেবপ্রিয় একটা রহস্যময় গোপনতাও রাখতে চাইছে। বলতে চাইছে না যখন নিশ্চয় সঙ্গত কারণ আছে। মেধা জোর করতে চান না। কিন্তু কারণটা তাঁকে জানতেই হবে, নিজের চেষ্টায়।