উত্তরসাধক (Uttarsadhak) : 22
উজান আর বুল্টুর কাছ থেকে রিপোর্ট পেলেন মেধা ওরা তেল-সিঁদুর দিয়ে পান দিয়ে জোড়া শাঁখ বাজিয়ে উলুধ্বনির মধ্যে দিয়ে বরণ করেছে কলের লাঙল। খুব উৎসাহ গ্রামে। যেদিন প্রথম লাঙল পড়বে সেদিন পর্যন্ত উৎসব। হেলে গরু আর লাঙল বেশির ভাগই ভালো দামে বিক্রি হয়ে গেছে। কিছু কিছু এখনও রেখে দিয়েছে ওরা। বলছে—‘উজানদাদা, বুল্টুদাদা কলেরও তো সর্দি কাশি, জ্বর, পেটের ব্যামো আছে। ওকেও তো রেস্টো দিতে হবে? না কি বলো!’
ছাত্রসঙঘ থেকে মাত্র দুজন গেছে, দিদিরা কেউ যাননি বলে ওদের ভারি দুঃখ। উজান কি করে বলে—ওদের মিলিদিদির এখন মা এসেছে সে থেকে থেকেই সব কিছু থেকে ছুটি নিয়ে নিচ্ছে, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়ায় হবে এবার তাদের নতুন প্রজেক্ট। কি করেই বা বলে লুকু দেবপ্রিয় নতুন বিয়ের পর পাহাড়ে বেড়াতে গেছে। এও সে বলতে পারছে না প্রমিত নার্সিং হোমে, যদিও এখন আগের থেকে অনেক অনেক ভালো, কিম্বা মেধাদি এখন গুঞ্জনের বিদেশ যাবার পোশাক-আশাক কেনা, তার পাসপোর্টভিসার জন্য ছোটাছুটি করতে ব্যস্ত। উজানের ক্যামপাস ইনটারভিউয়ে অনেকগুলো চাকরির অফার এসেছে, সে এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, বুল্টু মফঃস্বলের কলেজে অধ্যাপনার কাজ পেয়েছে, মুখ ভীষণ ভার।
উজান বলেছিল ‘তুই আচ্ছা ছেলে তো! গ্রামের জন্য কাজ করছিস আর মফঃস্বলের কলেজে কাজ করতে চাস না?’
বুল্টু উবাচ—‘গ্রামের জন্য কাজ করছি ঠিকই। কিন্তু ফাউগুলো বড় ভালো ছিল রে! আড্ডাগুলো কি জমত বল্!’
‘আমরা আড্ডা জমাতুম!’ উজানের র্ভৎসনা তীব্র হয়ে ওঠে।
বুল্টু বলে— ‘না না, কাজ করতিস, কাজ। তাতে কোনও সন্দেহ আছে? ওই কাজটাই বেশ আড্ডার সঙ্গে মিলে মিশে সাড়ে বত্রিশ ভাজা হয়ে যেত না?’
—‘এর পরে তো মেদিনীপুরেই কাজ হবে, তুই ওখানে সঙ্ঘের কর্ণধার হবি।’
—‘দ্যাখ উজান, কান-টান আমি করো ধরতে-টরতে পারি না। আমার কান যদি বন্ধুলোক কেউ ধরে তো ক্ষ্যামাঘেন্না করে অনেক সময় ছেড়ে দিই। ব্যাস। কানের সঙ্গে আমার এইটুকু সম্পর্ক।’
বুল্টুর দিদি বলে— ‘ওরে তোরা ওকে প্রথমে ওটা নিয়ে নিতে বল। পরে না হয় শহরের দিকে চেঞ্জ করে নেবে।’
বুল্টু বলে— ‘পাঁচ বছরের মুচলেকা দিতে হয়, তা জানো? জয়েন করো বললেই হলো, না? উজান ভেবে দ্যাখ তোরা কিন্তু বুল্টু দাসের মতো একজন উৎসাহী অভিজ্ঞ, মূল্যবান, শক্তিমান কর্মীকে হারাতে যাচ্ছিস!’
—‘গ্ল্যাডলি, মোস্ট গ্ল্যাডলি’—উজান বলে।
বুল্টু বোধহয় চাকরিটা নিয়ে নিয়েছে। কিছুদিন দেরি আছে চাকরিতে যোগ দিতে। ইতিমধ্যে ও মুখ শুকিয়ে মেধাদির বাড়ি আসা-যাওয়া করছে। গুঞ্জনের কেনাকাটার সঙ্গী হচ্ছে। অনেক সময়ে দিদিকে বলে— ‘দেখুন দিদি, এই এতো মার্কেটিং বওয়া কি আপনাদের কাজ? ভার বইবার জন্যে একজন পুং ভীষণ দরকার আপনারা বুঝতে পারছেন না।’ মেধা বলেন— ‘খুব বুঝতে পারছি। আমাদের এবার স্বাবলম্বী হবার সময় এসেছে। শুধু তোর জন্য হতে পারছি না।’
কেওড়াখালির সর্বশেষ রিপোর্টটা শুনে থেকে মেধার ভেতরে কি যেন একটা অনুভূতি ফুলে ফুলে উঠছে। এ কি গর্ব! নির্লিপ্ত ভাবটা প্রাণপণে ধরে রাখবার চেষ্টা করছেন তিনি। আনন্দের প্লাবনে সেটা ভেসে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ক্লাস নেন, তাঁর গলায় যেন একটা শাঁখের মতো আওয়াজ বাজে, চলনে একটা নতুন ছন্দ, করিডর দিয়ে চলে গেলে মনে হয় একটা মশাল হেঁটে গেল। সংস্কৃত বিভাগের নন্দিতা একদিন ঘরে এসেই বলেই গেল ‘মেধাদি, তোমার নামে এবার নতুন গুজব ছড়াচ্ছে কিন্তু। কি জানো তো? সবাই বলছে মেধা ভাটনগর প্রেমে পড়েছে। সত্যি নাকি?’
মেধা মিটিমিটি হাসেন, বলেন—‘আমি যে প্রেমে পড়েই আছি, কতদিন কত যুগ থেকে, সে খবর ওরা জানে না?’
দুজনে মিলে খুব হাসেন।
নতুন ফসল উঠবে অঘ্রাণ মাসে। কলের লাঙলে চষা জমির প্রথম ফসল। কেওড়াখালি এখন সবুজ হলুদের গালচে। পাকা হয়ে গেছে স্কুলঘর, মহিলা সমিতি, গ্রন্থাগার। মাটির খড়ো ঘরগুলি ঠিক তেলরঙে আঁকা ছবির মতো। জলার চারপাশে ইঁটের বাঁধ। হরেকরকম ছোট মাছ আর চিংড়িতে ভর্তি। দিঘি কুয়ো সব পরিচ্ছন্ন বাঁধানো। জঙ্গল বাঁশঝাড় বাগান যেখানে যা আছে সব নিয়মিত সাফ হয়। কলের লাঙল এসে চাষীদের হাতে এখন কাজ অনেক কমে গেছে। তারা সব সাফ-সুরত রাখে। সোনালি গোলাগুলো দেখলে মনে হবে এসব পত্রিকার পাতা থেকে কেউ কেটে রেখেছে। পংক্তিবদ্ধ শিশু ও বালক-বালিকার দল উজ্জ্বল, সরল, নীলকান্তমণি চোখ মুখ নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে-আসছে, অঙ্গে বাড়ির মেয়েদের তৈরি শাদা শার্ট, খাঁকি প্যান্ট, শাদা ফ্রক, ঘাসে-ছাওয়া জমির ওপর শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছে গোলাপি বাঁট-অলা, দোহারা নধর-চেহারার ভোলেভালা গাইগুলো। আশেপাশে গ্রামের প্রবীণরা রোদ পোহায়, বসে বসে সারাই, ঝালাইয়ের কাজ করে। লাল-হলুদ ডুরে শাড়ি পরে পদ্ম তার জায়ের কোলের মেয়েটিকে দুধ খাওয়াতে বসেছে। মকবুল মিঞা গ্রামের হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার, পাশ দেয়নি কিন্তু হাতযশ খুব। সে যেতে যেতে বলে গেল, ‘অমন হাত-পা চেপে ঢকাস ঢকাস খাইও না চাচী। ওতে লিভার খারাপ হয়। যতটুকু খাবার ও আপনি খাবে।’ ডিম বোঝাই হচ্ছে খড় বিছানো ঝোড়াতে। ভ্যানগাড়ি করে চলে যাবে গঞ্জের বাজারে, ক্যানিং-এর হোটেলগুলো বড় খদ্দের। বড্ড দেরি হয়ে গেল আজ। নির্জন সকালের বুক চিরে কাঠ চেরাইয়ের আওয়াজ ওঠে ঘসঘস। শীতের শুরুতেই আনোয়ার তার ছুটকি বিবির তৈরি নস্যি রঙের সোয়েটারটা পরে ফেলেছে। কানঢাকা টুপি। যেন ঠাণ্ডা না লাগে। ভালো মন্দ খেয়ে খেয়ে, ওষুধ আর বিশ্রামের জোরে তার চেহারাখানা হয়েছে বেশ চুকচুকে একটা খাসীর মতো। সে নিজেই কথাটা বলে আর হাসে। তাকত এসেছে শরীরে, কিন্তু সাবধানে থাকতে হচ্ছে। বিবি দুটিও তার ধারে-কাছে ঘেঁষছে না আজকাল। খুব যত্ন করে মালিশ করে দিচ্ছে অবশ্য। আনোয়ার বলে ‘পালিশ চড়াইছে।’ মেয়েরা ভাত বেড়ে দেয়, পাখা করে। বিবি দুটি ফুকফাক পালিয়ে যায়। আনোয়ার ভোটকম্বল চাপা দিয়ে গরগর করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কানে আসে তার বড়কি বিবির কন্যা ফতিমা গান ধরেছে, বেহুলো বিবির গান।
ওরে আমার সোনার নখীন্দর রে
কুন ডাঙাত্থে কুন ডাঙায় আইলাম জেবন মান্দাসে ভর।
চান সদাগর শ্বশুর পাইলাম, সন্কা বিবি মা
নোয়ার বাসর সোনার বাসর
(ওরে) সোনার বাসর হীরার বাসর কপালে সইল না।
(আমার) কপালে সইল না।
(এখন) অকূল পাথারে ভাসাইলাম জৈবন
মনসায় করি গড়
মনসা মায়েরে করি গড় রে……।
কেওড়াখালির সবার ইচ্ছে ছাত্রসঙ্ঘ হা-ই একবার যেমন অনেকে মিলে এসেছিল, তেমনি আসুক আবার। গাঁ জুড়ে মেলা বসে যাক। খাওয়া-দাওয়া আহার আপ্যায়ন কিছুর জন্য ভাবতে হবে না। নিরঞ্জন খাঁড়া হেড মাস্টারমশাই বড় বড় মোচ্ছব আর মেলা পরিচালনা করে করে এখন এক্সপার্ট হয়ে গেছেন। এসব নাকি এখন তাঁর কাছে কিছুই না। সেক্রেটারি উজান আফতাব তাই ছাত্রসঙেঘর সাধারণ সভায় ঘোষণা করে দিয়েছে অভিযানের দিন। যে যে যেতে চায় সবাই যেতে পারে। যাওয়ার দায়িত্ব নিজেদের। খাওয়া-দাওয়াও তাই। কারণ সংখ্যা কত দাঁড়াবে কোনও হিসেব পাওয়া যাচ্ছে না। অনিশ্চিত সংখ্যার দায়িত্ব নিরঞ্জনদার হাতে তুলে দেবার ইচ্ছে তার নেই। যতই তাঁর অভিজ্ঞতা থাক। কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। সারাদিন ধরেই এই যাওয়া আসা চলবে। প্রথম সারির কর্মী যারা অর্থাৎ বরুণ হালুই, অনমিত্র সরকার, সায়ন্তনী সেনগুপ্ত, অচিরা পল্লে, সুচিত্রা সাত্তার, অজয় চোংদার এরা তো আসছেই। সেইসঙ্গে আসবে অজস্র সাধারণ সদস্য। দেবপ্রিয়র খুব ইচ্ছে মেজজেঠু আসেন, মেধার ইচ্ছে রণজয় আসেন, উজান তার দাদুকে আনতে চাইছে। পলিটিক্যাল পার্সনদের আসায় মৈথিলীর আপত্তি ছিল, যেমন তার মা ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা কর্মী খুব সম্ভব পরবর্তী নির্বাচনে একজন প্রার্থী। মাকে সে বাদ দিয়ে রেখেছে তাই। কিন্তু উজান বারবার আশ্বাস দিয়েছে তার দাদু পলিটিক্যাল পার্সন হিসেবে আসছেন না। তিনি তাঁর মামার বাড়ি বরিশাল জেলার কীর্তনখোলা গ্রামের কথা কিছুতেই ভুলতে পারেন না।
—‘এ গুলা কি গ্রাম নাকি? গাঁ দেখতি হয় ও বাংলায় যা।’ এই হল তাঁর মুখের বুলি। দাদুকে স্বভূমি হারানো একজন বিরহী মানুষ হিসেবে নিজেদের গড়া গ্রামের চাঁদমুখ দেখিয়ে ভোলাতে চায় উজান। তা ভোলাক। মেধা বা মৈথিলী আর আপত্তি করেননি।
সকাল থেকেই অগ্রবাহিনী আসছে। ঝাঁকে ঝাঁকে ছাত্রসঙ্ঘের ছেলে মেয়ে। উত্তর কলকাতা, পূর্ব কলকাতা, দক্ষিণ কলকাতা, হাওড়া…আসছে তো আসছেই। আকাশ গাঢ় নীল। এখনও বেশি শীত পড়েনি। বিদ্যেধরী মাতলার দিক থেকে একটা ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা হাওয়া গরম হত হতে আবার গাঁয়ের পুবে জলাভূমিতে কাক-চান করে মিঠে মিঠে ঠাণ্ডা হয়ে কেওড়াখালির ওপর দিয়ে বয়ে যায়। আকাশে শাদা শাদা তুলো মেঘের পাশাপাশি বহু বিচিত্র পাখি। হায়ার সেকেন্ডারির চৈতালি বলল—‘ছাগলছানাগুলোকে কি জুতোর পালিশ দিয়ে পালিশ করেছে নাকি রে?’
—‘যা বলেছিস।’ তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সারং বলল।
এঞ্জিনিয়ারিং ফাইন্যাল ইয়ারের উদিত সুইটজারল্যান্ড ঘুরে এসেছে। বলল— ‘এই লেকটা অবিকল সুইস লেকের মতো নীল। এতে নীল যেন মনে হয় আর্টিফিশিয়াল।’
সুমিতা বলল—‘আসলে লেকটা এ তো পরিষ্কার যে আকাশটা পুরোপুরি রিফ্লেকটেড হয়েছে, তীরের গাছগুলোর ছায়া পড়েছে কী ওয়াণ্ডারফুল দ্যাখ্।’
—‘ওই দ্যাখ্, মাছ খেলা করছে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তলায় জলজ বন। হ্যারে, এখানে মুক্তোর চাষ করা যায় না?’
অমৃক ভরদ্বাজ বলল—‘দিস ইজ নিপা পাম, আই হ্যাভ রেড অ্যাবাউট দীজ ইন কনর্যাড।
‘সুমিতা হোয়াট ইজ ইট্স্ লোক্যাল নেম?’
সুমিতা অপ্রস্তুতের হাসি হেসে বলল— ‘সরি, জানি না রে, লোক্যাল পীপলরা বলতে পারবে, এই খোকা; তোমার নাম কি?’
—‘এরসাদ।’
‘এই গাছগুলোকে তোমরা কি বলো ভাই?’
‘হেঁতাল।’
—‘এই হেঁতাল? এখানে বাঘ লুকিয়ে থাকে না?’
এরসাদ ফিক করে হেসে ফেলল। বলল—‘আমরা নুকুই।’
—‘চকলেট খাবে?’
—‘তুমি বাদাম খাবে?’ হাতের মুঠো ফাঁক করে দেখাল এরসাদ। রাস্তায় ঘাটে, শিশু বালক বৃদ্ধ সবার সঙ্গেই কিশোর-কিশোরীদের ভাব হয়ে যাচ্ছে। জঙ্গলে। বাঁশবনে। পুকুর ধারে, উজ্জ্বল রোদ্দুরের মধ্যে তাদের সাদা শাড়ি, ফ্রক, পাজামা-পাঞ্জাবি জিনস, সালোয়ার-কুর্তা ঝলমল করছে। মৈথিলীদির নির্দেশ আছে সবাই যেন যথা সম্ভব শুভ্র বেশ পরে। শুভ্রতার মধ্যে ধনী দরিদ্র, শহর-গ্রাম, উন্নত-উন্নয়নশীল সব একাকার হয়ে যাক। এতোজন ছেলে মেয়ে যদি আজকালকার বাজার-মাত করা বহুবর্ণ বিচিত্র ছাঁটের পোশাক পরে আসতে থাকে তো—গ্রামের সদ্য জাগ্রত শিশু-বালক-কিশোর মনগুলি উদ্ভ্রান্ত হয়ে যেতে পারে। মেধাদি সেবার এদের পুরনো কাপড় দেওয়ায় খুব আপত্তি করেছিলেন। এখন ওদের মা মাসি পিসি জেঠি কাকীদের হাত দিবারাত্র চলছে। হাটে কেনা কাপড়, সমিতিতে সেলাই-করা পরিচ্ছদ পরে যে যার নিজস্ব পরিচ্ছন্ন চেহারায় আছে। শহরের ছেলেমেয়েদের বাতিল পোশাকের ময়ূরপুচ্ছ পরেনি। রণজয় বিশ্বাস এবং উজানের বাবা তার দাদুকে নিয়ে পৌঁছে গেছেন। মেধাই কেন্দ্রীয় কমিটির ছেলে-মেয়েদের নিয়ে পৌঁছতে দেরি করে ফেললেন। খালি দেবপ্রিয় এখনও আসেনি। সে মেজজেঠুকে নিয়ে আসছে। লুকু এসেছে তার বাবা ও ভাইকে নিয়ে। এরকম পেল্লাই সাইজের পিকনিক কেউ আশা করেনি। সবাই অবাক হয়ে গেছে। অঞ্জুমন বললেন— ‘এ যে দেখি মহতী জনসভা। মেধা, এরকম তো চিন্তা করিনি।’ মেধা স্মিত মুখে বললেন—‘ ছেলেকে শুধান।’ লুকুর মাথায় সিঁদুর দেখে পদ্ম, বিজলি, কমলা, সুবচনী, রেহানা বিবি, শরিফা বিবি, সব ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। ‘লুকুদিদি, বিয়ে করেচো, খাবার দাও নাই? নুকিয়ে, নুকিয়ে, অ্যাঁ? লুকু লাজুক মুখে বলে— ‘এতজন বরযাত্রী গেলে আমার বাবা হার্ট ফেল করত কাকী।’ ‘হা-ই দ্যাকো, বরযাত্তর কেন, তুমি আমাদের কন্যা নয়? আমরা কনের ঘর তো?’ লুকু লজ্জায় বরের পরিচয় দিতে পারছে না। ইদানীং স্বাস্থ্যকেন্দ্র ঢেলে সাজাবার জন্য, গ্রামের ছেলেদের ট্রেনিং দেবার জন্য দেবপ্রিয় গ্রামে ঘন ঘন আসছে। দেবুদাদা বলতে এরা অজ্ঞান! সে বাচ্চাদের পিপারমিন্ট দেবার ছল করে উৎসুক নারীজনতার ভিড় থেকে কোনক্রমে নিজেকে সরায়। দুর্গাপ্রতিমার সঙ্গে ওরা লুকুদিদির কোনও তফাৎ খুঁজে পাচ্ছে না, কেউ কেউ অবশ্য লক্ষ্মী কিম্বা সরস্বতীর নামও করছে। কিন্তু বেশির ভাগই একমত যে এ সাক্ষাৎ অসুরদলনী মা দুর্গা। উজান তার বাবাকে বলল— ‘সভা নয় বাবা মেলা, আমরা সংখ্যায় কতো তোমরা দেখো, তোমাদের দেখা দরকার।’
ইদ্রিস আমেদ স্কুল বাড়ির বাইরের দাওয়ায় জমিয়ে বসেছেন, মেধা তাঁর দলবল নিয়ে পৌঁছতে তাঁর মামার বাড়ির ভাষায় বললেন, ‘আমায় চিনতে পারস? ধিঙ্গি, কদমবুসী কর, অনেক বড় হইছস, বুড়া তো হস নাই আমার মতো!’ মেধা হেঁট হতেই বৃদ্ধ তাকে ধরে ফেললেন। আশির অনেক ওপারে বয়স চলে গিয়েছে। মুখময় পাকাদাড়ি। অর্ধেক দাঁত নেই। মেধার গালে তিনি সশব্দে চকাস করে একটা চুমু খেলেন—‘বিয়া করস নাই? খালি নাচ? নেচে নেচে বেড়াইছস? ভারি মজা!’ তাঁর কাণ্ড দেখে মৈথিলী উজান হাসছে। রণজয় বিশ্বাসের পরিচয় নিয়ে পাশে বসতে বলছেন—‘তুমি শুনি পুলিসের লোক, ধিঙ্গির সাথে জুটছ ক্যান? আমারে সরকারি বান্দর কয়, তা জানো? তোমারে কি কইসে?’ লাঠির বাঁকানো ডগা বাড়িয়ে বৃদ্ধ উজানকে ধরেন—‘এই দ্যাখো, আজকালের পোলাপান সব আমারে খেদায়, আমি নিষ্কম্মা, আমি ঢেঁকি…।’
বাড়িতে বাড়িতে আলাদা আলাদা করে খবর নিতে নিতে এগোচ্ছেন মেধা। ‘সিধু ভাই, সর্ষে হবে? পাটের দর কত যায়?’ ‘সর্ষে হবে, পাটের দর ভালোই।’ ‘ময়না, তোমার ছোটটা হামা দিচ্ছে? ‘ধরে ধরে দাঁড়ায়’, ‘বলো কি? তবে তো আনোয়ার সায়েবের আর একটি বংশধরের আসবার সময় হয়ে গেল!’ ময়না হাসে। হাত মুখের ভঙ্গি করে জানিয়ে দেয় সেটি আর হতে হচ্ছে না। স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নীলমণি বসে। বলছে ‘গাঁ থেকে একটা ডাক্তার বার করতেই হবে দিদি, বাইরে যাবে না, এখানেই বসবে, এই কড়ারে।’ মেধা আশ্বাস দিচ্ছেন—‘কড়ার করতে হবে না, এ স্বাস্থ্যকেন্দ্র ক্রমে বিরাট হাসপাতাল হয়ে উঠবে। দেবদাদা সেই চেষ্টা করছে। লাইব্রেরিতে রয়েছে নিতাই। তার অভিজ্ঞতা ছেলেরা বড় বৈজ্ঞানিক রূপকথা পড়ছে। এতোটা কি ভালো? এতো সত্যি বিজ্ঞান নয় কো দিদি।’ মেধা বললেন— ‘তোমার বার্ষিক বই কেনার লিস্টিটা মৈথিলিদিদির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে কিনো। পড়ুক না ছেলেরা সায়েন্স ফিকশন। সেই সঙ্গে ওরা ছড়ার বই, কবিতার বইও পড়ছে তো? সহজ জ্ঞান-বিঞ্জানের যে সব সিরিজ কেনা হয়েছে। বাংলা এনসাইক্লোপিডিয়া সেগুলোও নিচ্ছে তো?’
—‘নিচ্ছে, তবে গল্পের দিকে ঝোঁক বেশি।’
গরু-মহিষগুলি দেখে রণজয় মুগ্ধ। বললেন—‘তোমরা এ দুধ শহরে পাঠাতে পারো না?’
অনিল বাইরি, বাথানের ভারপ্রাপ্ত ছেলেটি বলল— ‘টাটকা দুধ অল্প লাভে ছাড়া হয় দাদা খুব তাড়াতাড়ি উঠে যায়, ছানা, তা-ও বড় শহর পর্যন্ত পৌঁছতে পায় না। আজকাল তালদী, ধপধপি, ক্যানিং সব জায়গায় ভালো ভালো মিষ্টির দোকান ফেঁপে উঠছে। কেওড়াখালির দুধ খেতে হলে, আপনাকে আজ্ঞে এখানে এসে কদিন থাকতে হয়! আসুন না!’
মেধা হেসে বললেন—‘আসলে রণজয় ব্যবসার নীতি নিয়ে এগুলো এরা করেনি। নিজেরা পরিপূর্ণ খেয়ে যেটুকু উদ্বৃত্ত থাকে সেটা বিক্রি করে খরচ উশুল হয়। নিজেরা খাবো না, সব চালান যাবে, দেশের লোক চেয়ে চেয়ে আঙুল চুষবে এ এদের একেবারে ইচ্ছে নয়। এদের জলায় ভালো চিংড়ি হচ্ছে। কলকাতায় দেড়শ টাকা কিলো। এরা গ্রামেই বেচে, আসে পাশে অনেক খদ্দের আছে। শহর থেকেও লোক এসে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। অনিল বাইরি বলল— ‘কিন্তু পাইকারকে আমরা দিই না দাদা। এক কেজি দু কেজি নিজেদের ব্যবহারের জন্য নিতে চাইলে ঠিক আছে।’
ঘুরতে ঘুরতে গ্রামের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে মেধা বললেন—‘এটা কি নিরঞ্জন? এ স্ট্রাকচারটা কিসের?’
দাওয়ায় নামানো নতুন ঝকঝকে সাইনবোর্ড। সেটা উল্টে দেখিয়ে নিরঞ্জন বলল— ‘আজ্ঞে চা-ঘর দেখুন!’
—‘কে করল এত বড় চায়ের দোকান? তুমি?
—‘আজ্ঞে না।’ নিরঞ্জন জিভ কাটে, ‘আমার সময় কই দিদি? আমি তো ঝালে ঝোলে অম্বলে সবেতে রয়েছি। পঞ্চ থেকে লাইসেন্স বার করে দিয়েছে গঞ্জ থেকে লোক এসে করেছে।’
—‘বুঝলাম না।’ মেধার মুখে বিস্ময়। এ গ্রামে কোথায় কি হচ্ছে তার ব্লু-প্রিন্ট সব সময়ে ছাত্রসঙ্ঘের কাছে থাকে।
মৈথিলী বলল— ‘আপনারা তো এটার কথা আমাদের জানাননি নিরঞ্জন দা!’
নিরঞ্জন বলল— ‘আজ্ঞে পঞ্চ থেকেই করল একরকম। ভোট আসছে, বলছে ভিডিও বসাবে। গ্রামের লোক দেশ-বিদেশের খপর পাবে। ওরাই কাকে লাইসেন্স্ দিয়েছেন, আমি আর কি বলবো! তাছাড়া এই তো কদিনও হয়নি। স্ট্রাকচার সবে শেষ হয়েছে। ধরুন গত পরশু।’
—‘এ বিষয়ে কথা-বার্তা নিশ্চয়ই হচ্ছে অনেকদিন থেকে, জানাতেও তো পারতেন,’ উজানের কণ্ঠ তীক্ষ হয়ে উঠছে।
সায়ন্তনী এতোক্ষণ কাছ থেকে মেধাদিকে দেখবার আনন্দে বিভোর হয়েছিল, সে বরুণকে ইশারা করল, আরও ছেলেমেয়েদের এখানে ডাকতে।
মেধা বললেন—‘ভিডিও পার্লার বানাচ্ছে উজান বুঝেছিস? চা-ঘরের সাইনবোর্ড সামনে। কেন? মৈথিল বুঝলি কিছু?’ তিনি নিরঞ্জনের দিকে চকিতে ফিরে বললেন—‘নিরঞ্জন তোমার কটা চোঙা আছে স্কুল ঘরে?
—‘আজ্ঞে পাঁচ ছটা তো হবেই।’
—‘একটা আমাকে দাও। আর কয়েকটা নিয়ে ছেলেমেয়েদের দাও। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ওরা লোক জড়ো করুক, এখানেই ডাকো সবাইকে। ফাঁকা আছে অনেক লোক ধরবে। আমি এখানেই সবাইকে বুঝিয়ে বলব। যাও নিরঞ্জন, কুইক।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই চা-ঘরের সামনেটা লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। চোঙা হাতে মেধা সদ্য-নির্মিত ঘরের উঁচু দাওয়ায় উঠে দাঁড়ালেন।
‘কেওড়াখালির ভাইবোনেরা। আমরা এতদিন শহর গ্রাম, ছাত্র গৃহস্থ, ছেলেমানুষ-বুড়োমানুষ সবাই মিলে একমন একপ্রাণ হয়ে নিজেদের সুখে, আনন্দে থাকবার মতো একটা পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছি। আমাদের আনন্দের সীমা নেই এই ভেবে যে এইখানে পরিচ্ছন্ন, শিক্ষিত, সাবলম্বী, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসায় মমতার একতাবদ্ধ একটি পরিবারের মতো এই গ্রাম গড়ে উঠেছে। পৃথিবীর যে কোনও জায়গা থেকে যে-কেউ এসে এখানে থেকে যেতে পারে, সকলেই বিনা দ্বিধায় বলবে এ গ্রাম আদর্শ গ্রাম। কিন্তু সম্প্রতি চা-ঘর বলে যে দোকানটা এখানে বসানো হয়েছে এটা আপনাদের সর্বনাশ করবে। সামনে চা-ঘর সাইনবোর্ড টাঙিয়ে পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে এরা ভেতরে ভিডিও-যন্ত্র বসাবে। যদি জঘন্য, নোংরা ছবি দেখাবার ইচ্ছে ওদের না থাকত, এই কারচুপিটা ওরা করত না। এই সব ফিল্ম দেখতে আসবে আপনাদের ঘরের ছেলে-মেয়ে-বউরা, পরে লুকিয়ে-চুরিয়ে আসবে অল্পবয়সীরাও। যে-সব পাপের কথা, অন্যায়ের কথা, নোংরামির কথা ওরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না সেগুলো এখানে দেখানো হবে সামান্য পয়সার বিনিময়ে। আমোদ-প্রমোদের বস্তু বলে, হাসতে হাসতে দেখানো হবে। আপনাদের কষ্ট করে জমানো পয়সা পাপ ব্যবসায়ীর থলিতে চলে যাবে। সেই সঙ্গে যাবে আপনাদের ছেলেমেয়েদের চরিত্র। আপনাদের ফুলের মতো ছেলেমেয়েরা, এমনকি নিষ্পাপ ভাই-বোন-স্বামী-স্ত্রীরা সেই সব পাপ বয়ে আনবে আপনাদের পবিত্র সংসারের ভেতর, সমাজের ভেতর’—উজান তার ব্যাটারি-সেটে টেপ করে নিচ্ছিল এই ভাষণ, বার বার পুনরাবৃত্তি করবার দরকার হতে পারে এ ভাষণ। এখানে, অন্যত্র। এ তাদের এক নতুন অভিজ্ঞতা। নতুন বাধা।
মেধা বলতে লাগলেন—‘আপনারা এখানে সুখের, আনন্দের স্বর্গ গড়েছেন, আমরা আপনাদের দেখে প্রেরণা পেতে আসি। আদমের ইডেন উদ্যানে সর্বনাশের পরামর্শ নিয়ে এসেছিল খল শয়তান, জানেন তো সামান্য অপবিত্রতার কারণে নলরাজার কী দুর্গতি হয়েছিল কলির হাতে? এই কলি, এই শয়তান আপনাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনারা এই চা-ঘর চালু করতে দেবেন না। আপনারা সবাই আছেন, আমি দরখাস্ত লিখে দেবো, পঞ্চায়েতের কাছে এর লাইসেন্স বাতিল করার দাবি করুন। ছাত্ৰসঙ্ঘ আপনাদের টিভি সেটের ব্যবস্থা শীগগীর করবে, আপনারা এই ভিডিও-পার্লার বন্ধ করুন, বয়কট করুন, জ্বলন্ত আগুনের হাত থেকে, উদ্যত সাপের ছোবল থেকে, বাঘের থাবা থেকে যেমন বাচ্চাদের রক্ষা করেন, ঠিক সেই ভাবে রক্ষা করুন ওদের এই সর্বনেশে চা-ঘরের হাত থেকে।’
জনতার মধ্যে থেকে শোরগোল উঠল, মহিলা কণ্ঠে। পুরুষ গলায়। অনেকে চিৎকার করে উঠল—‘লিখে দ্যান দিদি, সই করে দিচ্ছি।’
‘আমরা আজকেই পঞ্চে ছুটব, ঠকাচ্ছে, আবার আমাদের ঠকাচ্ছে।’
‘শয়তানের পো রক্তবীজের ঝাড়। একদিকে কোপ মারি তো আরেক দিকে বাড়ে।’
মেধা বললেন—‘নিরঞ্জন কাগজ-কলম নিয়ে এসো।’ জনতার মধ্যে থেকে প্রধান প্রধান লোকেরা সামনে এগিয়ে আসছে, মেধা চা-ঘরের দাওয়া থেকে নামছেন, হঠাৎ কোথা থেকে দমকা হাওয়ার মতো কয়েকটা লোক ছুটে এলো উজান মৈথিলী দেখল নিমেষের মধ্যে মেধাদি উধাও।’
নিরঞ্জন খাঁড়া ভীষণ চিৎকার করে উঠল—‘ওই দিদিকে নিয়ে যায়, উজান ভাই। গুণ্ডা, গুণ্ডা। চোট্টা,’ নিরঞ্জন বাঘের মতো লাফ মেরে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিরাট জনতা মুহূর্তে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। জনতার মধ্যে থেকে কান্নার রব উঠেছে ‘বাঁচাও।’ ‘মেরে ফেললে।’ ‘পালা’। ‘পালা’। ‘দিদিমণিকে ওরা কোথায় নিয়ে গেল গো?’ ‘রণজয়দা…মেধাদি কোথায়’ দেব আর্তস্বরে চেঁচাচ্ছে, ‘দক্ষিণের মাঠের দিকে চলো, ‘বাবা, বাবা, বুল্টু! গুঞ্জন!’ মৈথিলীকে দেখছি না কেন’ ‘প্রমিত ফলসাগাঁয়ের দিকে চল।’ পদ্ম কেঁদে বলল—‘ও দিদি গো, ওরা বোধহয় ফুলতলির দিকে গেল, আমার ছোট ছেলেটার মাথা ফাটিয়ে দিয়ে গেছে।’
পদ্মর কথাই ঠিক। ওরা বোধহয় দলে অনেক ছিল। ভিড়ের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছিল। জনতাকে বিভ্রান্ত করবার জন্যে কেউ কেউ ফলসা গ্রামের দিকে ছুটে গিয়েছিল। মেধাকে শেষ পর্যন্ত ফুলতলির মাঠে যাবার পথের জঙ্গলটায় পাওয়া গেল। অভিজ্ঞ পুলিসের চোখ, রণজয় বিশ্বাসই প্রথম তাঁকে পেলেন। তিনি একটা প্রকাণ্ড শিশু গাছের তলায় উপুড় হয়ে পড়ে আছেন যেন কেওড়াখালির এই বনস্থলীকে প্রণাম করছেন, কিম্বা চুমো খাচ্ছেন। আশেপাশে বন্য ঝোপ। পরনের পাটকিলে রঙের কলাক্ষেত্র শাড়ি বিস্রস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু তাঁর কুমারী জননীদেহের সমস্ত লজ্জাস্থান আবৃত করে রয়েছে এখনও। তিনি বলতেন শাড়িগুলো খুব টাফ।
পুরুষদের সঙ্গে মেয়েদের বাহুবলের যুদ্ধ এমনিতেই অসম যুদ্ধ। কিন্তু সমাজ যখন সামগ্রিকভাবে সর্ব অর্থে গৃধ্নু হয়ে ওঠে, তার সমস্ত মূল্যমান যখন ভোট আর টাকা, টাকা আর ক্ষমতার মাপকাঠিতে নিরূপিত হতে থাকে তখন সে সমাজে পুরুষ আর পুরুষ থাকে না, কিম্পুরুষ হয়ে যায়। নারীর সঙ্গে লড়াইয়ে নামলে সম্মুখসমরে তাকে প্রাণে মারবার আগে এই কিম্পুরুষরা আগে তাকে তার করুণতম স্থানে আঘাত করে। নারী যেন এ সময়ের এক নিরপরাধ দুর্যোধন, অন্যায় যুদ্ধে যার উরু ভঙ্গ করছে ওরা। মেধা প্রাণপণ শক্তিতে ওদের ঠেকিয়েছেন। ঠেকিয়েছেন জীবনের শেষতম সংগ্রামে। হয়ত শেষ পর্যন্ত পারতেন না, কিন্তু রণজয়রা আসছেন টের পেয়ে ওরা বোমা ফাটাতে ফাটাতে চলে গেছে। দেবপ্রিয় ভাঙা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল ‘স্ট্রেচার।’ পদ্ম, সিধু, নিতাই, নীলমণি নিমেষের মধ্যে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে স্ট্রেচার এনে দিয়েছে। দেহটা উল্টেই দেবপ্রিয় আর মৈথিলী স্থির হয়ে গেল। দলা দলা রক্ত। রক্তে ভাসছে চারদিক। কেওড়া এবং ফলসা, সুযযিপুর, সরাল এবং আরও কিছু কিছু নিকটবর্তী গাঁয়ের জনতা ততক্ষণে আঘাতে আঘাতে ধরাশায়ী করে ফেলেছে চা-ঘর। তার ভেতর থেকে রঙিন টিভি, ভিসিপি, ক্যাসেটের প্রাথমিক আয়োজন সব টুকরো টুকরো হয়ে চতুর্দিকে ছিটকে যাচ্ছে। দলে দলে ছাত্র ছুটে আসছে উত্তর কলকাতা, মধ্য কলকাতা, দক্ষিণ কলকাতা, বৃহত্তর কলকাতা, হাওড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুরের কলেজ, য়ুনিভাসিটি, এঞ্জিনিয়ারিং মেডিক্যাল কলেজ থেকে। গ্যারিসনের পর গ্যারিসন অস্ত্রধারী সৈনিকের মতো। তাদের ছুটন্ত পায়ের তলার মেদিনী কম্পমান। তারা শুভ্র, স্নাত, নিষ্কলঙ্ক। মেধাদি, মেধা ভাটনগরকে অজ্ঞাত আততায়ী মেরেছে। তাই তারা ছুটেছে, সকলে এক দিকে, এক লক্ষ্যে। আজ বহুদিন হল মেধা ভাটনগর জীবন্ত কিংবদন্তী হয়ে গেছেন। কেউ সেভাবে বলেনি তবু তিনি তাদের মধ্যে প্রচারিত, প্রসারিত হয়ে গেছেন। তিনি তাদের সমস্ত আশা সমস্ত স্বপ্নের কাণ্ডারী। তাদের শেষ নির্ভর।
দেবপ্রিয়, উজান, প্রমিত, নিতাই স্ট্রেচার নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে, পথ করে দাও, মৈথিলী লুকু গুঞ্জন ছুটেছে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দিকে। নীলমণি আর মকবুলের সঙ্গে যদি প্রাথমিক কিছু ব্যবস্থা করা যায়। বৃদ্ধ আমেদ সায়েব ঘোলাটে চোখ আকাশের দিকে তুলে বলছেন ‘অত মন্দ কিসু কয় নাই, হায় আল্লা তোরা রুকুরে মারস ক্যান?’ নিরঞ্জন খাঁড়া আর সিধু দুটো বিরাট পাহাড়ের মতো জনতা সামলাচ্ছে। পৃথ্বীন্দ্রকে নিয়ে রণজয়ের জিপ সগর্জনে ছুটে আসছে, মেধাকে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাবে সোজা। এখুনি। রণজয়ের মুখের রেখা ক্রমশ কঠিন টান টান হয়ে যাচ্ছে। এখুনি বুঝি ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।
দেবপ্রিয় জানে, মৈথিলী জানে, উজান লুকু গুঞ্জন যারা ডাক্তার নয় তারাও জেনে গেছে নিয়ে যাওয়া বৃথা। হয়ত যেতে যেতেই সব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এই হাজারে হাজারে ছাত্রদল তা জানে না, মানেও না। তারা এখনও ছুটে চলেছে তাদের চোখ সংকল্পে জ্বলছে, নিষ্পাপ হাত প্রতিবাদে ওপরে তোলা, পদভরে মেদিনী প্রকম্পিত, তারা ছুটছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, গ্রামান্তর থেকে গঞ্জে, গঞ্জ থেকে শহরে, বস্তিতে বস্তিতে, বাস্তুতে বাস্তুতে, সেই সঙ্গে ছুটছে কেওড়া, আজিগ্রাম, মখতবপুর, ভাঁটরো, কেতুপাড়া, ফলসা, সরাল, মনসাপাড়া, নবগ্রাম, হর্তুকি, শিমুলডিহি…। তারা বিশ্বাস করে মেধা ভাটনগর বেঁচে উঠবেন, বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। শুধু এই আশ্বাসটুকু নিয়েই তারা পরবর্তী শতাব্দীর দিকে অনির্বাণ মশাল হাতে দৌড়য়।