Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » উত্তরসাধক || Bani Basu » Page 20

উত্তরসাধক || Bani Basu

মেডিক্যাল কলেজের ইনটার্নী মৈথিলী ত্রিপাঠীর দিনগুলো খুব ব্যস্ত কাটছে। ভীষণ খাটতে হচ্ছে। এদিকে, সেদিকে। আবার এই দম-বন্ধ-করা কাজ আছে বলেই হয়ত বাঁচোয়া। বেশ কিছু দিন ধরে তার মনটা খুব বিষন্ন হয়ে আছে। বার বার সে এই মন খারাপটাকে ঝেড়ে ফেলে দেবার চেষ্টা করছে, পারছে না। মেডিক্যাল কলেজ থেকে বেরিয়ে সে উত্তরমুখো হাঁটতে লাগল। এখন উত্তর-দক্ষিণ কোনও দিকেই চট করে ওঠার মতো বাস-ট্রাম পাওয়া যাবে না, তাকে যেতে হবে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের মাঝামাঝি একটা জায়গায়। প্রমিতকে এখানেই একটা নার্সিংহোমে দেওয়া হয়েছে আজ বেশ কিছু দিন হয়ে গেল। ডাক্তার আপাতত সময় নিয়েছেন চার মাস। হয়ত তার চেয়েও বেশি লাগতে পারে। প্রমিতের যন্ত্রণা চোখে দেখা যায় না। প্রমিত, উজানের সঙ্গে ছোট থেকে এক স্কুলে পড়েছে সে। ওদের সঙ্গে সে খুবই ঘনিষ্ঠ। প্রমিত যে এইভাবে তাদের চোখ এড়িয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়বে, এটা তার কাছে একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে। উত্তর কলকাতার বিবেকানন্দ রোডে প্রমিতদের একটা ফ্ল্যাট বছর তিনেক আগে খালি হয়ে যায়। প্রমিত মায়ের কাছ থেকে সেই ফ্ল্যাটটা ছাত্রসংঘের নাম করে চেয়ে নেয়। সেখানেই আসত ওর নেশার সঙ্গীসাথীরা। ওখান থেকেই ওরা প্রমিতকে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করে। সবচেয়ে ভয়ের কথা হচ্ছে, মাত্র এই তিন-চার বছরের মধ্যে প্রমিত হেরোইন তো নিয়েইছে, মিফকুয়ালোনের বড়ি খেয়েছে, হ্যালসিনোজেনস গ্রুপের ড্রাগ পর্যন্ত নিয়েছে। ডাক্তার বলছেন ওর অবস্থা খুবই খারাপ। জটিল। প্রমিতের ঘটনাটা জানবার পর এসব নিয়ে একটু আধটু পড়াশোনা করেছে মৈথিলী। কিরকম ছেলেমেয়েরা সাধারণত ড্রাগ অ্যাডিক্ট হয় তার মনস্তাত্ত্বিক বিবরণ বেশ কয়েকটা পড়া হল। বিবাহ-বিচ্ছিন্ন বাবা-মার সন্তান, নানারকম সাংসারিক অশান্তি, বাবা-মার অমনোযোগ, উচ্চাকাঙক্ষার পূরণ না হওয়া, ক্রনিক অসুখ এইরকম নানা কারণ থাকে এর পেছনে। কিন্তু প্রমিতের সঙ্গে সে এসব মেলাতে পারছে না। প্রমিতের অবশ্য বাবা পাঁচ ছ বছর হল মারা গেছেন, কিন্তু মা ছেলেঅন্ত প্রাণ। তিনি অপেক্ষা করে বসে আছেন কবে ছেলে ইউনিভার্সিটির পাট চুকিয়ে তার বাবার ব্যবসার হাল ধরবে। তিনি এখন বিশ্বস্ত কর্মচারীদের সাহায্যে কোনমতে চালিয়ে নিচ্ছেন। প্রমিতের স্বাস্থ্য ভালো। তার ফ্রাসট্রেশনের কোনও কারণই তো আপাতদৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। ইদানীং সে নিজে মারুতি চালিয়ে সায়েন্স কলেজে যাচ্ছিল। তার বাবার মৃত্যুর কারণে যদি নিরাপত্তাবোধের অভাব কারো ঘটে, তো সেটা রঞ্জুমাসীর ঘটবে। ধনী গৃহবধূ। তিনি কোনদিন বাইরের কাজে অভ্যস্ত ছিলেন না। স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর পর ব্যবসা গুটিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কর্মচারীরা এসে কান্নাকাটি করতে লাগল। তাদের রুজি বন্ধ হয়ে যাবে। তখন সেই অনভিজ্ঞ, অনভ্যস্ত হাতে হাল ধরলেন তো! এ সব প্রমিতের কাছেই ওরা শুনেছে বেশি। মাকে নিয়ে প্রমিতের যথেষ্ট গর্ব। গর্ব করার কারণ আছে। সেই প্রমিত এইভাবে ড্রাগের শিকার হয়ে গেল? ড্রাগ ধরার কথা তো তার! বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো যার মা স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছেন আজ দু বছর হয়ে গেল!

আকাশটা আজ কালচে হয়ে আছে। মনে হয় বৃষ্টি হবে, হোক। তার আগে প্রমিতের খবরটা নেওয়া দরকার। এখনও ওরা দেখা করতে দিচ্ছে না কাউকে। মাসী হয়তো এসে বসে থাকবেন, মৈথিলীরা গেলে তাঁর ভালো লাগবে। কাকুর মৃত্যুতেও উনি এতোটা ভেঙে পড়েননি! আকাশের দিকে তাকিয়ে সে তাড়াতাড়ি পা চালাল।

মন খারাপের কারণ আরো একটা আছে। গুঞ্জন। গুঞ্জনের বাবা এয়ারফোর্সে আছেন। বরাবরই বদলির চাকরি। গুঞ্জন বোর্ডিঙে, হোস্টেলে মানুষ। ছোট থেকে মৈথিলী, লুকু, প্রমিত, উজানের সঙ্গে ওর মেলামেশা। খুব স্মার্ট, করিৎকর্মা মেয়ে। গ্র্যাজুয়েশনের পর ও ইনটিরিয়র ডেকারেশনের একটা ট্রেনিং নিয়েছিল। ওর রীতিমতো প্রতিভা আছে এ বিষয়ে। ভালো টাকা রোজগার করছিল ও। আর ক’মাস পর ভিসার ব্যবস্থা হয়ে গেলেই ও আমেরিকা চলে যাচ্ছে। প্রধানত এগজিকিউটিভ হবার ইচ্ছে ওর। এখানকার কোনও প্রতিষ্ঠানে এম. বি. এ করার সুযোগ পেল না। পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে জেরবার হয়ে গেছে। বলছিল—‘রোজগার করছি ভালোই। কিন্তু জানিস মৈথিল, আমাকে ওরা চেক পেমেন্ট করে না। সব ক্যাশ। অর্থাৎ দু নম্বরী টাকা। আমাদের মতো যত জন আছে সবাইকেই। যখন একটা অ্যাসাইনমেন্ট থাকে কিভাবে খাটিয়ে নেয়, ধারণা করতে পারবি না, শনি-রবিবার বলে কিছু নেই, দিন রাত বলে কিছু নেই। প্রাণ দিয়ে কাজ করি। কয়েকটা নোট ঠেকিয়ে দেয়। টাকাটা ভালোই। কিন্তু কোনও নিয়মিত চাকরি নয়, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার মুশকিল। যে কোনওদিন চাকরি চলে যেতে পারে, প্রভিডেন্ট ফান্ড, এটা-ওটা অ্যালাওয়্যান্স ইত্যাদি যেসব সুবিধে যে কোনও নিয়মিত চাকরির থাকে, তার কিছুই আমার নেই। একেবারে শূন্যে ভাসমান।’ ওর মামা আছেন ওয়াশিংটনে। তাঁর সাহায্যেই ও চলে যাচ্ছে, দুটো তিনটে জায়গায় এম. বি. এতে সুযোগ পেয়েছে। ফিরে আসবে কি না ভবিষ্যতই জানে! ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় সমিতি থেকে এই রকম মূল্যবান দুজন কর্মীকে হারিয়ে তার মনটা বিষন্ন হয়ে আছে। শুধু কর্মীই নয়, বন্ধুও তো!

মেধাদি জানেন সবই। প্রমিতের নার্সিংহোমে তিনি নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন। গুঞ্জনের ব্যাপারটা শুনেও তিনি একই রকম শান্ত, অবিচলিত। বলছেন—‘আমি তো তোকে অনেক আগেই বলেছি মৈথিলী, নিজেদের ওপর খুব বেশি নির্ভর করিসনি। তোদের পরে, তার পরে, তার পরেও যদি তোদের বয়সী ছেলেমেয়েরা নিয়ম করে কাজটা করে যায় তবেই তোদের কাজ সত্যি সত্যি সার্থক হবে। গুঞ্জন তো তিন চার বছর যথেষ্ট খাটাখাটনি করেছে, তার চেয়ে বেশি সময় দিতে পারত ভালো। না পারে, তাতেও ইতরবিশেষ হওয়া উচিত নয়।’ গুঞ্জনের ভিসা যে কোনওদিন বেরোতে পারে, তাই ওর ফেয়ার ওয়েল উপলক্ষ্যে গতকাল মেধাদির বাড়িতে তাদের কয়েকজনের নিমন্ত্রণ ছিল। দিদি করেছিলেন খুব চমৎকার চিংড়িমাছের স্টু। ছোট ছোট রুটি বা ফুলকা তৈরি করল গুঞ্জন নিজে। উজান ওর বাবার রান্না মাংস এনেছিল। লুকু নিজে হাতে মালপো করেছিল। মৈথিলীর বৈজুদা করে দিল রাশিয়ান স্যালাড। দেবপ্রিয়ই একমাত্র যে বাসন-ধোয়া ছাড়া বিশেষ কিছু করল না। বুল্টুটা পর্যন্ত মনে করে ওর মায়ের ভাঁড়ার ঘর থেকে এক বোতল আমের আচার হাতিয়ে এনেছিল। দিদি বললেন—‘গুঞ্জন তুই তোর পছন্দমতো শিক্ষার জন্য চলে যাচ্ছিস আপাতত, তোর ভবিষ্যতের প্ল্যান কি?’

গুঞ্জন বলল—‘অনেস্টলি আমি জানি না মিস। আমার মামা বলছেন ইন্ডিয়ায় এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে আমেরিকায় সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন হয়ে থাকাও অনেক ভালো। আমাকে সেখানে গিয়ে দেখতে হবে তাঁর কথা সত্যি কিনা। সত্যি হলেও ওভাবে বাঁচতে হয়ত আমার সম্মানে বাধবে। তাছাড়াও বাবার রিটায়ারমেন্টের সময় হয়ে এলো, বাবার ইচ্ছে কলকাতাতেই কোথাও কাজ নেন। বরাবরের মতো বাবা-মাকে ছেড়ে থাকার আমার ইচ্ছে নেই। এতদিন তো হোস্টেলে হোস্টেলেই কেটে গেল। একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করব মিস?’

দিদি বললেন—‘কর, করে ফেল। অনুমতি চাইছিস যখন, খুব গোলমেলে কিছু জিজ্ঞেস করবি মনে হচ্ছে।’

—‘আপনি তো অনেক বছর ছিলেন, আপনি কী ফীল করতেন? কেন ফিরে এলেন?’

দিদি বললেন—‘আমি যখন ফিরেছি, তখন আমার বাবা-মা কেউই আর বেঁচে ছিলেন না, আমার বোনের সঙ্গে বরং ওখানে থাকতেই বেশি দেখা হত। ছাত্রছাত্রীরা খুব পছন্দ করত, পড়াশোনার ব্যবস্থা এত ভালো যে, পড়াটা ওখানে একটা আলাদারকম আনন্দের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।’ দিদি চুপ করলেন।

কিছুক্ষণ পর গুঞ্জন বলল—‘তো?’

দিদি একটু লাজুক হেসে বললেন—‘জানিস, আমার প্রতিদিন মনে হত বড় লজ্জাকর ভাবে হেরে যাচ্ছি। আমেরিকা দেশটা তো ইমিগ্রান্ট্‌স্‌দেরই দেশ। এই বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বিশাল ব্যাপ্তি। তবু তো শান্তি, শৃঙ্খলা, বৈজ্ঞানিক উন্নতি, সেই উন্নতিকে সাধারণ মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দেওয়া সবই সম্ভব হচ্ছে। আমাদের দেশে ভাষা ধর্ম জাতির ভিন্নতা নিয়েই তো চিরকালের বসবাস। যাতে এই সব ভিন্নতা সত্ত্বেও সবাই মানুষের মতো বাঁচতে পারি সেই ফর্মূলাটা আমরা কেন কিছুতেই বার করতে পারছি না? কেনই বা পারবো না! এই ভাবনাটা আমায় সবসময়ে কামড়াত।’

লুকু বলল ‘কিন্তু দিদি, ইতিহাস তো বলছে ভারতবর্ষ বরাবরই বিচ্ছিন্ন। একমাত্র মুঘল শাসন এবং ইংরেজ শাসনের আওতায় এসে তবে ভারত এক হয়েছে। তার আগে পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ তো চলতই!’

দিদি বললেন—‘তুই অশোককে ভুলে যাচ্ছিস। অশোকের সময়ে তো এ সমস্যা ছিল না!’

—‘সে সময়ে সেতুবন্ধনের মূল সূত্রটা কি ছিল? বৌদ্ধ ধর্ম?’

—‘বোধহয় না। ধর্ম না। অশোক তো বৌদ্ধধর্ম কারো ওপর চাপিয়ে দেননি!’ গুজ্ঞন এই সময়ে বলল— ‘দিদি, ধর্ম না হলেও, বোধহয় ধর্মের এসেন্স।’

দিদি বললেন—‘ঠিক। ধর্মের সার। টলারেন্সের শিক্ষা। বৃদ্ধ পিতা-মাতা, প্রতিবেশী, পশুপাখি, ভিন্ন জাতি ধর্ম সবই এই টলারেন্সের আওতায় পড়ে। ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করে আমরা এইটুকু পাই। কিন্তু পুরনো ইতিহাসের ছাঁচে কি আর নতুন করে সমাজকে গড়া যায়? অশোকের অনুশাসন এখন মাস-মিডিয়া চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে, তার ফল কি পুরোপুরি ফলছে? সমাজ এখন অনেক জটিল, সমস্যাও অনেক বেশি। মূল দুর্বলতাটা কোথায় জানিস? কুশিক্ষা। অশিক্ষা। অশিক্ষা তবু এক রকম, কিন্তু কুশিক্ষা অতি ভয়ানক।’

দেবপ্রিয় বলল—‘এই কুশিক্ষাকে ইচ্ছে করে জিইয়ে রাখা হচ্ছে চতুর্দিকে। রাজনীতির ভোটের স্বার্থে, ব্যবসাদারের মুনাফার স্বার্থে, মোল্লার ক্ষমতার স্বার্থে। শুধু একটা নাম সই করবার ক্ষমতা আবার শিক্ষা নাকি? ডিসক্রিমিনেশন চাই। বিচার-বুদ্ধি চাই।’

দিদি উজ্জ্বল মুখে বললেন—‘একমাত্র এই বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন শিক্ষাই আমাদের পঁচাশি কোটিকে মানুষের মতো বাঁচবার সামর্থ্য দেবে। চতুর্দিকে খালি শুনি জনগণ এখন নাকি পূর্ণমাত্রায় রাজনৈতিক সচেতনতা অর্জন করেছে, ছাত্ররাও। কথাটা ঠিক বলা হয় না। জনগণ কেউ এ দলের কেউ ও দলের কথা শুনে চলে অন্ধের মত, আর ছাত্ররা রাজনীতি করে আজকাল কেরিয়ার হিসেবে : চাকরি, মান, সম্মান ইত্যাদির আশায়। আসলে আমরা যদি নিজেদের ভালো-মন্দটা না বুঝি সরকার কতদূর করবে? সরকার কখনই আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার চূড়ান্ত গলদগুলো সরাতে পারবে না। যেমন পারেনি মুসলিম নারীস্বার্থ রক্ষা করতে, যেমন পারেনি পণপ্রথা রুখতে। যেটুকু হয়েছে সমাজের ভেতর থেকে হয়েছে। সু-শিক্ষার দরুন। দ্যাখ গুঞ্জন, এই সুশিক্ষা কি? ইংরেজি শিখে দিবারাত্র মিলস অ্যান্ড বুন্‌স্ পড়তে পারার শিক্ষা নয়, বা টি ভি আর কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে ঘর সাজাবার জন্য উন্মত্তের মতো কালো টাকা রোজগার করার ধান্দা করতে পারার শিক্ষাও নয়। এই শিক্ষার পুরো চেহারাটা কি তাই নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি দেশে ফিরেছি। যদি ওদেশে থাকতাম পুরো অ্যাকাডেমিক হয়ে যেতাম। তাতেও খুব সুখী হতাম। কিন্তু অনেকদিন আগে থেকেই আমার একটা কথা মনে হত…কনসেপচ্যুয়ালাইজেশন অর্থাৎ তত্ত্ব তৈরি করার অভ্যাসটা একদিক থেকে বড় বিপজ্জনক। তত্ত্ব তৈরি হয় বহু তথ্যের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে, তবেই। অথচ কি পরিহাস দ্যাখ, যে মুহূর্তে তত্ত্ব তৈরি হয়ে গেল, তাকে আমরা অভ্রান্ত সত্য বলে ব্যবহার করতে আরম্ভ করি। আর তার ছাঁচে ফেলতে থাকি চলিষ্ণু এই মানব সমাজকে। দেশ-কাল-পাত্রের কথা ভাবি না। প্রত্যেকটি ধর্মগুরুর শিক্ষা নিয়ে আমরা এই করেছি। কৃষ্ণ, বুদ্ধ, খৃষ্ট, মহম্মদ, শ্রীচৈতন্য সব। প্রত্যেকটি সেকুলার তাত্ত্বিকের শিক্ষা নিয়েও নিয়ত এই করে চলেছি, সবচেয়ে বড় উদাহরণ মার্কস। জাগ্রত বুদ্ধি অর্থাৎ দেব যাকে বলছে ডিসক্রিমিনেশন তা-ও বটে, আবার কনশেন্স যাকে বলে তা-ও। দুটোই যে সমাজে পূর্ণমাত্রায় রয়েছে একমাত্র সেই সমাজেরই অধিকার আছে তত্ত্ব নিয়ে নাড়াচাড়া করার। সুশিক্ষার সিলেবাসটা কি হবে ভাবতে ভাবতেই আমার দেশে ফিরে আসা। আর, নিজের দেশ ছাড়া কোথায়ই বা এর গবেষণা করব? দেশকে ত্যাগই বা করতে যাবো কেন? সামান্য ব্যক্তিগত অসুবিধার জন্য?’

গুঞ্জন বলল—‘মিস, আপনি তো সাধারণ মানুষ নন!’

—‘সেইজন্যে মুষ্টিমেয় তথাকথিত অসাধারণ মানুষের হাতে যাবতীয় দায় তুলে দিয়ে তোরা আত্মসুখ তৃপ্তির উদ্দেশ্যে চলে যাবি গুঞ্জন? সবাই ভাববি, ওরা তো আছে, ওরা করবে! অথচ এতদিনে তোরা নিশ্চয়ই বুঝেছিস সংঘবদ্ধ কর্মের যা ক্ষমতা কোনও ব্যক্তিমানুষের দ্বারা তা হবার নয়।’

দিদির কথায় ক্রোধ ছিল না, হতাশা ছিল না, খুব সূক্ষ্ম একটা আর্তি কি ছিল? কি যে ছিল মৈথিলী বলতে পারবে না। সে নড়ে চড়ে বসেছিল। উজান হঠাৎ বলেছিল—‘গুঞ্জন যেখানে যায় যাক দিদি আমরা যাচ্ছি না। আমরা মানে আমরা এই কজন নয় শুধু, ছাত্রসংঘের দেড় লাখ সদস্য। এই দেড় লাখ অঙ্কটা ক্রমশ বাড়তে থাকবে, তবে কিছু যোগ, কিছু বিয়োগের পর এই দেড় লাখ সংখ্যাটা সবসময়ে থাকবে। সেই ব্যবস্থা করাই এখন আমার, দেবের, লুকুর আর মৈথিলের এবং বুল্টুর প্রধান কাজ। আর সব তো এখন রুটিন কাজ হয়ে গেছে। স্বয়ম্ভর হয়ে গেল আজিগ্রাম, কেতুপুর, ফুলতলা। উত্তর চব্বিশ পরগণা, নদীয়া, মুরশিদাবাদ এলাকায় কাজ করছে ছাত্রসঙ্ঘ। রাজাবাজার আর নন্দীর বাগানের বস্তিতে কাজ এগিয়ে চলেছে। এগুলোর একটাও হাতে কলমে আমরা করছি না। ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ার, থার্ড ইয়ারের ছাত্ররা করছে। এখন হায়ার সেকেন্ডারি থেকেও আসতে চাইছে প্রচুর। তাদের আমরা প্রধানত সংস্কৃতি মেলার কাজগুলো দিই। এই ব্যাপারগুলোর আসলে গুঞ্জন এতদিন সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ছিল। মধুচ্ছন্দাদির কাছ থেকেও ও অনেক শিখেছে। কিন্তু আরও অনেক সদস্য আছে। তাদের মধ্যে থেকে অনেকেই ওর জায়গা নিতে পারবে। দিদি, আপনার ছাত্ৰশৃঙ্খল তৈরি হয়ে গেছে।’

বুল্টু এই সময়ে গোঁজ মুখে বলেছিল—‘গুঞ্জন অ্যাভারেজ ইন্ডিয়ানের থেকে অনেক ভালো অবস্থায় আছে। দু আড়াই হাজার টাকা মাসে রোজগার করছে। ওর বাবা এয়ার-ফোর্সের লোক। এবার নিশ্চয়ই সিভিল এভিয়েশনে এসে বসবেন। ওর জীবনে ইন্ডিয়ার স্বাভাবিক নিয়মেই শীগগীরই অনেক সুযোগ আসবে। তাছাড়া যতই যাই বলুক, বিয়ে করলে ওর কেরিয়ারের ওইরকম ভাইট্যাল প্রয়োজনীয়তা থাকছে কি? ওর চিরদিনের জন্য দেশ ছাড়ার কোনও যুক্তি নেই। সোজাসুজি বল না বাবা গরিব দেশে আর পোষাচ্ছে না, তোরা তো ভারতবর্ষের সাধারণ ছেলে মেয়ের মতো মানুষ হসনি। এয়ারকুলার, ক্যাডিল্যাক, তাজ-বেঙ্গলের আবহাওয়ায় মানুষ, ইন্ডিয়া ইজ ন্যাস্টি, ম্যারিকাই তোদের আসল লক্ষ্য। কেমন সুন্দর বুশ গভমেন্ট সব করে কম্মে দিচ্ছে। সারাদিন খেটে-খুটে সন্ধেবেলায় সেন্ট্রালি হিটেড রুমে বসে একটু মদ্যপান এবং একটু সোপ দেখা! মাঝে মাঝেই গাড়ির ব্র্যান্ড পাল্টানো। বন্ধু-বান্ধবরা মিলিত হলেই, কত ডলার থেকে কত ডলারে জাম্প করলি আলোচনা করবি। লাস ভেগাসে যাবি, জুয়ো খেলবি, রেস খেলবি…।

গুঞ্জন এই সময়ে বলল—‘স্টপ ইট বুল্টু, স্টপ ইট প্লীজ।’

বুল্টু বলল— ‘মনে কিছু করিস নি। আমি বি এস সিটা পাশ করার পরে একটা সুযোগ পেয়েছিলুম, মায়ের আর মেধাদির মুখ মনে করে যেতে পারলুম না। আচ্ছা দিদি, আমাকে ছাত্রসঙেঘর অ্যাকটিভ মেমবার করে কিছু অ্যালাউয়েন্স-টেন্স দেবার ব্যবস্থা করতে পারেন না? বাবার রিটায়ার করার সময় হয়ে এলো। দিদির বিয়ে ইমিনেন্ট। দিদিটা ভালো রোজগারপাতি করছিল তো হেন্‌স্ ফোর্থ সেটা দিদির বরের পকেটে যাবে!’

দিদি বললেন : ‘বুল্টু তুই ইকনমিক্স নিয়ে পাস করলি। কম্প্যুটর শিখেছিস। চাকরি চট করে জুটে যাবে। যদি নাও যায় তোকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য ছাত্রসঙ্ঘ সুদ ছাড়া টাকা ধার দেবে। ঘাবড়ে যাবি না একদম। ছাত্রসঙ্ঘ শুধু অন্যলোকের জন্য নয়, তোদেরও জন্য। কাউকে কষ্ট পেতে আমরা দেবো না। আর তোর দিদির সঙ্গে আমি কথা বলব। দিদির উপার্জন জামাইবাবুর পকেটে যাবে মানে? তোর দিদি যেমন ভালো বুঝবে খরচ করবে। ছেলে আর মেয়েকে আজকাল মধ্যবিত্ত বাবা মা সমান যত্ন ও খরচ করে তৈরি করে। মেয়েদের দায় নেই?’

গুঞ্জন এই সময়ে সংক্ষিপ্ত কয়েকটা কথা বলে— ‘মিস, আমি কোর্সটা শেষ করে হয়ত কিছুদিন চাকরি করবো। তারপর ফিরে আসব।’

—‘যদি ওখানেই বিয়ে করিস। করতেই পারিস।’

—‘না, পারি না।’ গুঞ্জন গোঁয়ারের মতো বলে, ‘আমি এখানে এসে বিয়ে করব।’

নার্সিং হোমে পৌঁছবার আগেই বৃষ্টি নামল। মৈথিলী ছাতা ব্যবহার করে না। বাড়িগুলোর গাড়িবারান্দার তলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যখন শেষ অবধি পৌঁছল তখন নাসিং হোমের অফিস বন্ধ করে দিচ্ছে। রঞ্জুমাসীর গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে। মৈথিলী ছুটতে ছুটতে গিয়ে ধরল। —‘মাসি! মাসি!’ ‘ঘ্যাঁচ্‌’ করে থেমে গেল মারুতি।

প্রমিতের মা দরজা খুলে বললেন—‘উঠে আয়।’ মৈথিলীর গায়ে হাত দিয়ে বললেন— ‘ইস ভিজে গেছিস যে রে!’

—‘হ্যাঁ মাসি। জিন্‌স্‌টা ভারি লাগছে।’

—‘চল তোকে তোর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাই।’

—‘সেই ভালো। বেশ বৃষ্টি পড়ছে। প্রমিত কেমন আছে মাসি? কিছু খবর পেলেন?’

—‘ওরা তো বলছে আগের থেকে ভালো। হ্যাঁরে মৈথিলী লুকু কি আজ কালের মধ্যে এসেছিল?’

—‘আজ যদি এসে থাকে বলতে পারব না। আমিই তো দেরি করে ফেললাম। গতকাল আসেনি জানি। তার আগের দিন আপনি চলে যাবার পর এসেছিল। কেন?’

একটু চুপ করে থেকে মাসি বললেন— ‘ডাঃ সিনহা জিজ্ঞেস করছেন লুকু নামে কি ওর কোনও বান্ধবী আছে! প্রমি নাকি বারবার ওর নামই করে। ওঁরা প্রথম প্রথম নামটা ধরতে পারতেন না। ইংরেজি লুক বলে মনে করতেন। যন্ত্রণার মধ্যে খালি লুক লুক করে চেঁচায়।’

মৈথিলী চুপ। হাসি-খুশি রহস্য-পটু প্রমিত যে এতো চাপা স্বভাবের ছেলে এতদিন মিশেও তারা কোনদিন বুঝতে পারেনি। বরং দেবকে ওদের বরাবর রহস্যময়, চাপা বলে মনে হয়েছে।

একটু পরে মাসি চুপি চুপি কাঁদো-কাঁদো স্বরে বললেন— ‘মৈথিলী তোরা ছোট্ট থেকে এক স্কুলে পড়ছিস। মেলামেশা করছিস। ভাইবোন সম্পর্কটা হওয়াই বেশি স্বাভাবিক ছিল না?’

মৈথিলী চট করে কিছু বলতে পারল না। মাসির তত্ত্বটা যে তাদের জীবনে একেবারেই খাটছে না। উজানের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী অদ্ভুত! ভাইও বটে। বন্ধুও বটে, আবার…আর লুকু তো ঘোষণাই করে দিয়েছে দেব যদি তাকে বিয়ে না করে তো সে আবার ড্রাগ ধরবে। দেব মৃদু মৃদু হেসে বলছে— ‘মৈথিল। লুকু কিন্তু আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে।’ মৈথিলী বলে—‘তো তুই ব্ল্যাকমেইল্‌ড্‌ হস না।’

—‘একটা বন্ধুলোক এভাবে ড্রাগ-অ্যাডিক্ট হয়ে যাবে, চোখে দেখা যায়?’

মৈথিলী মাসির হাতটা ধরে রাখল কোলের ওপর। একটু পরে বলল—‘মাসি, তাই-ই তো! আমরা সবাই আছি, ওর ভাই-বোন বন্ধু যা বলেন। প্রমিতকে আমরা স্বাভাবিক করে তুলবই। আপনি ভয় পাবেন না।’

—‘তুই এমন করে কথা বলিস মনে সত্যিই বল আসে।’ মাসি বললেন, ‘কিন্তু এ সমস্যার সমাধান হবে কি করে? লুকু তো…। তাছাড়া কারুর ভালোবাসার ওপর তো জোর চলে না!’

—‘মাসি বেসিক্যালি সব ভালেবাসা তো ভালোবাসাই। আন্তরিক টান আর শুভেচ্ছা। এই জায়গায় যদি কোনও গণ্ডগোল না থাকে, তাহলে ভালোবাসার চেহারাটা বোধহয় পাল্টে দেওয়া যায়। এখন আমাদের চারদিকে পটভূমি অনেক বড় হয়ে গেছে। সেই প্রেক্ষিতে দাঁড় করিয়ে দেখতে হবে আমাদের সো-কল্‌ড্‌ ভালোবাসার কতটা পজেসিভ ইনফ্যাচুয়েশন, আর কতটা এই আদি অকৃত্রিম শুভকামনা। আপনি আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখুন। আমাদের বলতে প্রমিতের কথাও বলছি কিন্তু।’

বাকি পথটা দুজনে চুপচাপ এলেন। মৈথিলীর বাড়ির দরজায় তাকে নামিয়ে দিতে দিতে মাসি বললেন— ‘আমি আশা হারাইনি। চট করে হারাই না। তোরা পাশে থাকলে আরও সাহস পাই। কতদিন যে একলা-একলা পথ হাঁটছি।’ তিনি মৈথিলীর হাতটা জড়িয়ে বুকের মধ্যে রাখলেন কিছুক্ষণ। বললেন—‘তোকে বহুদিন ধরে দেখছি, বড্ড ভালো লাগে তোকে আমার, প্রমিতটা লুক লুক করে না চেঁচিয়ে যদি মৈথিলী মৈথিলী করে চেঁচাত আমি বেশি খুশি হতাম।’

দুজনেই হেসে ফেললেন।

দরজা খুলে দিল বৈজুদা। একমুখ হাসি। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। বলল— ‘আবার ভিজেছ তো? বেশ করেছে, রোদে, জলে ভিজে, এতো করে বলি ছাতা নাও, কি ওয়াটারপ্রুফ নাও। যাও তাড়াতাড়ি এই ঝোলাগুলো পালটাও। আমি কফির জল বসিয়ে দিচ্ছি।’

মৈথিলী নিজের ঘরের পর্দা সরিয়ে দেখল অন্ধকার ঘরে পাখা চলছে। তার বিছানায় কে যেন শুয়ে। সাদা ধবধবে খাদির শাড়ি আর গাঢ় রঙের ব্লাউজ। তার বুকের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। এমন ঘন ঘোর বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকার সন্ধ্যায় যখন মৈথিলী মাতৃবিরহ সইতে শিখে গেছে, মা যখন আর তার অবলম্বন মাত্র নয়, বিশুদ্ধ আনন্দে পরিণত হয়ে গেছে, তখন সেই শুভক্ষণে মৈথিলীর মা ফিরে এসেছে।

মৈথিলী মায়ের পায়ের তলায় সুড়সুড়ি দিল। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে অরুণা মুন্নিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, অস্ফুটে বললেন— ‘ওরা আমাকে ঝাড়খণ্ড মুক্তিমোর্চার ক্যানডিডেট হিসেবে চাইছে মুন্নি। আমি এবার না করেছি। অনেক কাজ করে দিয়েছি মুন্নি। অনেক। টোলায় টোলায় ঘুরে, এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত…আমার আর মনে কোনও গ্লানি নেই।’

স্বামীর নিরাপত্তার জন্য না মেয়ের চরিত্র গঠনের জন্য না নিজের কর্মৈষণা পূর্ণ করতে না পিতৃ ভূমির ঋণ শোধ করতে…কিসের জন্য যে অরুণা রাধিকা সারেনের এই নিবার্সন, এই অজ্ঞাতবাস প্রয়োজন ছিল তা একমাত্র জনগণমন অধিনায়ক কোনও ভাগ্যবিধাতাই জানেন!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress