উত্তরসাধক (Uttarsadhak) : 19
এখন এখানে পিচঢালা সড়ক হয়ে গেছে। বনবন করে রিকশা ছোটে, বাস ছোটে। বাসগুলো আপাদমস্তক যাত্রী-ঠাসা। এ সব অঞ্চলের বাসের সময়ের কোনও ঠিক নেই। সেইজন্য সব সময়েই বাক্স-পেঁটরা ঝুড়ি বালতি পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে লাইন দিয়ে যাত্রীরা দাঁড়িয়ে থাকে। খানিকটা যাওয়ার পর মেধার তবু বসবার জায়গা হয়েছিল। দেবপ্রিয় সারাটা পথ ঠায় দাঁড়িয়ে। বাস থেকে নেমে রিকশা ধরল দেবপ্রিয়—‘গাঙ্গুলিবাগান।’
রিকশার হুড তুলে দেওয়া হয়েছে। হুডটা ঘোমটার মতো সামনে অনেকখানি আড়াল করে রয়েছে। মেধা মুখ বাড়িয়ে দুদিকে দেখছেন। বললেন—‘তোদের এদিকটা বেশ প্রসপারাস না রে দেব? হুগলি, বর্ধমান দুটোই বর্ধিষ্ণু জেলা।’
দেবপ্রিয় বলল—‘হুঁ।’
—‘তুই কি আমার ওপর রাগ করে আছিস নাকি?’
দেব বলল—‘না।’
—‘শোন। সাহস ভালো। দুঃসাহস ভালো না, এটা একটা কথার কথা নয়। একেবারে নির্জলা সত্যি কথা। যার যা কাজ, তাকেই সেটা করতে দেওয়া ভালো।’
দেবপ্রিয় বলল—‘আপনার ধারণা পুলিস কিছু করবে?’
—‘তোর নিজেরই তো তাই ধারণা! না হলে তুই পুলিসকে ওই ঘাঁটিগুলোতে লীড করার জন্য অত কষ্ট করলি কেন? তোকে তো সবই বলেছি। রণজয় বিশ্বাসের ওপর আমাদের আস্থা রাখতে হবে। ইতিমধ্যে তুই মনে রাখিস তুই ডাক্তার। যে সব ডাক্তার মহামারিতে মাছি-মশার মতো থ্রাইভ করে তেমন না। তোর কাজ হবে প্রতিরোধ করতে শেখানো। তুই সামাজিক ব্যাধিরও ডাক্তার। ড্রাগের মতো এই সব এপিডেমিক সামাজিক ব্যাধি নির্মূল করতে হলে শুধু পুলিসি সার্জারিতে কিছুই হয় না। ভেতর থেকে মূল নষ্ট করতে হবে। প্রলোভন কোন না কোন রূপে বরাবর থাকবেই। সর্বনাশা প্রলোভন। আমরা প্রলোভিত হবো না, নষ্ট হবো না, এমনিভাবে আমাদের নিজেদের গড়তে হবে। ছাত্রদের সঙ্গে মেলামেশা করে ড্রাগের প্রতি তাদের আকর্ষণ নষ্ট করতে হবে। একমাত্র তখনই শয়তানরা ফণা গুটোবে, নইলে নয়।’
—‘তাহলে আপনি কেওড়াখালির নিরঞ্জন মাস্টারমশাইকে টি ভি সেট দিতে এতো আপত্তি করছেন কেন?’
মেধা বললেন—‘তোর কাছে নিরঞ্জন বুঝি নালিশ করেছে?’
‘না। আমি মৈথিলীর কাছে ঘটনাটা শুনলুম।’
—‘শোন ওদের টি ভি সেট নিশ্চয়ই দেবো। তার আগে রুচিটা সামান্য গড়ে দেবার চেষ্টা করছি। প্রথমত একবার ভিশূয়াল দেখতে আরম্ভ করলে ওরা আর বই পড়তে চাইবে না। বইয়ের নেশাটা আগে ধরিয়ে দেওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত, ওরা টি ভি পেলেই শনিবার-রবিবার এবং অন্যান্য হাজারোবার ওই সব অবাস্তব এবং ভালগার সিনেমাগুলো দেখবে। দেখে হাঁ করে থাকবে। অল্পবয়সী মেয়েগুলো হিরোর স্বপ্ন দেখবে আর ছেলেগুলো হিরোইনের স্বপ্ন দেখবে। আচ্ছা, তোরাও তো এই সব পোস্টার, কখনও সখনও এই সব সিনেমাও দেখিস, কিন্তু এসব কি তোদের বিভ্রান্ত করে? করে না। তার কারণ তোদের মনগুলো রুচির দিক থেকে সাবালক হয়ে গেছে। কিন্তু গ্রামের এই সব বয়স্ক মানুষগুলো, যারা নিজেদের বংশগত কাজ এত ভালো জানে, এতো পাকা বিষয়ী, রুচির দিক থেকে তারাও কিন্তু নাবালক। অল্পবয়সীদের তো কথাই নেই। আগে ওরা বই ভালোবাসতে শিখুক। বই পড়ে কল্পনা শক্তির ব্যবহার করে, বুদ্ধির ব্যবহার করে মাথার মধ্যে অডিও ভিশূয়াল তৈরি করতে পারুক তারপর তুই ওদের যত খুশি টি ভি সেট দে, অসুবিধে নেই।’
দেবপ্রিয় চুপ করে রইল। মেধা বললেন—‘আমার কথা কি তুই মানতে পারছিস না?’
দেবপ্রিয় বলল—‘না, ভাবছি। একেকটা গ্রাম পুরো মার্জিত, পরিশীলিত হবে, তারপর তারা সভ্যজগতের যন্ত্রপাতির সংস্পর্শে আসবে। কী দীর্ঘ প্রতীক্ষা?’
হু-হু করে হাওয়া এসে ওদের চুল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। মেধার শাড়ির সামনেটা হাওয়ায় ফুলে উঠছে, তিনি দু’হাতে তাকে ধরে আটকে রাখছেন।
মেধা হেসে বললেন—‘তুই কি ভেবেছিলি তোরই একার ওপর ভুবনের ভার? প্রাণহীন পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি হতে কত সময় লেগেছে ভেবে দ্যাখ, প্রাণ থেকে মন, মন থেকে সভ্যজগৎ! আমরা আমাদের যৌবনের অধৈর্যে ভাবি সব সমস্যার সমাধান চট করে হয়ে যাবে, একবার একখানা বিপ্লব করে ফেলতে পারলেই। কিন্তু আসল কাজটা হল মানুষের মন পাল্টানোর কাজ। সেটাতে তেমনভাবে কেউ হাত দেয় না। ধর্মগুরু যাঁরা তাঁরা আধ্যাত্মিক দিকটার ওপর জোর দেন, আধ্যাত্মিকতা সবার ধাতে হয় না, মনীষীরা বুদ্ধির ব্যবহার করতে শেখান, মনকে মুক্ত রাখবার শিক্ষা দেন, কিন্তু তাঁরাই আবার একটার পর একটা তত্ত্ব তৈরি করে বুদ্ধিরই পায়ে শেকল পরিয়ে দ্যান, নীতি শিক্ষা—তা-ও দেখি মানুষের ওপর জোর করে চাপানো। আমার নিজের মনে হয় ছোট থেকে মুক্ত হৃদয়ে এবং মুক্ত বুদ্ধিতে কর্ম, মানবিক সম্পর্ক এবং জ্ঞানের চর্চা করা দরকার। সেই সঙ্গে আমাদের শিল্পবোধ জাগ্রত করতে হবে। নীতিবোধ সৌন্দর্যবোধ সহৃদয়তা খোলা মন—কর্মে প্রীতি এবং জ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ এই সমস্ত মিললে একটা যথার্থ মানুষ তৈরি হয়। এই টোট্যাল হিউম্যান বীয়িংকে তৈরি করার জন্যই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, আমাদের সামাজিক বিন্যাস। দেশের রাজনৈতিক গঠন এই মানুষকে রক্ষা করবে, বিন্যস্ত করবে, প্রোমোট করবে। দু-চার দিনের আবেগ দিয়ে কিছু হয়নি, হবে না। তাই তো তোদের বলি ছাত্রসংঘের চেইনটা তোরা চালু রাখ। ছাত্রশক্তি মানে যুবশক্তি, বড়রা এতদিন সব রকম আন্দোলনে এদের ধ্বংসাত্মক, আত্মঘাতী কাজে ব্যবহার করেছে। আমার ইচ্ছে, এবার এরা সত্যি যা তাই হোক, এরা দেশের সংরক্ষিত শক্তিকূট, যা করবে সমস্ত অন্তর দিয়ে করবে, ওদের হাতে সংগঠনের কাজ, সৃষ্টির কাজ তুলে দাও, ওরা জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে করে যাবে কাজটা। সেই ফলটা এক্ষুণি পাবার জন্যে ধড়ফড় করিসনি।’
দেবপ্রিয় একটু হেসে বলল ‘আমার সমস্যাটা কি জানেন দিদি, আমি প্রচুর কাজ করতে পারি। কথা বলতে পারি না। এটাই আমার স্বভাব। আমার পক্ষে বক্তৃতা দিয়ে, সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করে ছাত্রদের ভেতরে ড্রাগ ইত্যাদির বিরুদ্ধে মানসিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজটা শক্ত।’
মেধা বললেন—‘আমি জানি দেব। সব মানুষেরই যদি একরকম ক্ষমতা হত, তাহলে বিচিত্র কাজের জন্য বিভিন্ন প্রকৃতির মানুষ আমরা কোথায় পেতাম? বাগ্মিতা তবু মেলে, কিন্তু নিঃশব্দে কাজ করার লোক পাওয়া যায় না দেব।
রিকশাওয়ালা বলল—‘গাঙ্গুলিবাগানের হাতায় এসে পড়েছি, এবার কোন দিকে যাবো দাদা?’
—‘জোড়বাংলার দিকে চলো’, দেবপ্রিয় বলল।
এই অঞ্চলের নাম পাল্টে দেবার অনেক চেষ্টা করেছেন পৃথ্বীন্দ্রনাথ। দায়পুর হাইস্কুল, দায়পুর পশু-পক্ষি-পালন প্রকল্প, তারপর সমস্ত জায়গাটার নাম রাখেন তিনি ‘বনশ্রী’। বড় বড় করে লেখাও আছে নামটা সাইনবোর্ডে। কিন্তু নানান নামের আসা-যাওয়ার মধ্যে দিয়ে গাঙ্গুলিবাগান নামটা ঠিক টিকে আছে। জোড়বাংলা পৃথ্বীন্দ্রনাথের নিজের থাকার জায়গা। দেবপ্রিয়র ইচ্ছে দিদিকে জোড়বাংলায় রেখে সে আপাতত বাড়ি চলে যায়।
‘বনশ্রী’র হাতায় ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গে মেধার সমস্ত দেহ-মন কণ্টকিত হয়ে উঠল। বঙ্গভূমি সবুজেরই দেশ, প্রাকৃতিক প্রাচুর্যের দেশ। কিন্তু প্রচণ্ড গ্রীষ্ম, যথেষ্ট যত্ন ও সৌন্দর্য সচেতনতার অভাব যে কারণেই হোক, গ্রামাঞ্চলে গেলেও একটা এলোমেলো সবুজ, খয়েরি, হলুদ মেশানো ধ্যাবড়া ছবি ছাড়া কিছু চোখে পড়ে না। মনে হয় একটা ছবিকে বারবার ধোয়া হয়েছে, শিল্পীর পছন্দ না হওয়ায়। ইংলন্ড বা আমেরিকার গ্রামাঞ্চলে সেই সবুজকে খানিকটা আকার দেওয়ার চেষ্টা হয়। পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা হয়। বিজলিচালিত যন্ত্রপাতির ব্যবহারের কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল। আজ এতদিন পর গাঙ্গুলিবাগান নামক এই জায়গাটাতে এসে তিনি পাশ্চাত্য গ্রামাঞ্চলের সেই প্রিয় সৌন্দর্য খুঁজে পেলেন। ছায়াবৃক্ষগুলোকে রেখে আশপাশের ছোট গাছগুলোকে কেটে ফেলা হয়েছে। দুটো তিনটে পরিষ্কার লাল রাস্তা ভেতরে চলে গেছে, দুধার সবুজে-সবুজ। তার মধ্যে দিয়েও ছড়িয়ে পড়েছে লাল পথের শাখা-প্রশাখা। শুকনো পাতা কাটি-কুটি ঝুড়িতে তুলতে তুলতে এগিয়ে চলেছে বেশ কয়েকটি ডুরে শাড়ি-পরা মেয়ে। ঘন সবুজের মধ্যে পা ডুবিয়ে এখানে ওখানে কয়েকটি লাল টালি ছাওয়া সাদা বাড়ি, সাইনবোর্ডে নামগুলো লেখা আছে। তাঁতঘর, আচারঘর, সেলাইঘর, বীজঘর। পাখি ডাকছে বিচিত্র সুরে এই বেলাতেও। একটা মাছরাঙা নীল আলোর ঝলক তুলে তীব্রগতিতে উড়ে গেল। চকচকে আয়নার মতো জল ডানদিকের বাঁধানো পুকুরে। তার ওধারে ঘন কালচে সবুজ গাঢ় গম্ভীর বনভূমি। দেবপ্রিয় বলল—ওইটাই বনশ্রীর প্রধান ফলবাগান। তরুণ শাল, সেগুন, দেবদারুর মধ্য দিয়ে জোড়বাংলার পথ। মাঝে মাঝেই খুঁটিতে পোঁতা পথ-নির্দেশক।
পৃথ্বীন্দ্রনাথ মাথায় বেতের টুপি পরে হনহন করে হাঁটছিলেন। তাঁর স্কুল, ডেয়ারি, পোলট্রি, সবজি ক্ষেত, ফলবাগান সব এতদিনে আপনা-আপনি চলতে আরম্ভ করেছে। তিনি শুধু ঘুরে ঘুরে দেখেন। দায়পুর গ্রামের বহু মানুষ তাঁর এই বনশ্রীতে নিযুক্ত। বাচ্চারা পড়তে আসে দুটো শিফ্টে, ছটা থেকে দশটা, দশটা থেকে চারটে, সন্ধে ছটা থেকে বায়োগ্যাসের আলোয় শুরু হয় বয়স্ক শিক্ষার স্কুল। এই সব স্কুলের শিক্ষকরা স্থানীয়। তিনি দুটো স্কুলেই কিছু কিছু ক্লাস নেন। এই স্কুল থেকে পাশ করে যারা কলেজে পড়তে চায় তারা সদরে কিংবা অন্য কোনও শহরে চলে যায়। কলেজ তৈরির আশা পৃথ্বীন্দ্রনাথ ছেড়ে দিয়েছেন। আজকাল আর প্রয়োজনও বোধ করেন না। কিন্তু একটা কৃষি বিদ্যালয় যেখানে পশু-পক্ষী পালন, মৌ চাষ, মাছ-আবাদ সম্পর্কেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে সেটা তাঁকে শুরু করে দিয়ে যেতেই হবে।
একটা জিনিস তিনি এ ক বচ্ছরে পেরেছেন। তা হল দায়পুরের লোকেদের বিশ্বাস ও ভালোবাসা অর্জন। প্রথম যখন আসেন তখন এরা সাঙ্ঘাতিক প্রতিরোধ করেছিল। তাঁর বাগানের ফল-ফুলুরি, গাছের কাঠ, ভাঙাচোরা ঘরবাড়ির ইঁট, দরজা-জানলা এসব বহুদিন ধরে এদের কাজে লেগে এসেছে। পঞ্চায়েতের সঙ্গে মিলে ভুয়ো দলিল দেখিয়ে তাঁর সমস্ত জমি এরা বর্গা করে নেবার চেষ্টা করেছিল। সেই সব পড়ো জমি, বাড়ি, বিশাল বিশাল বাগান তিনি একলা লড়ে উদ্ধার করেছেন। তিনি এদের রুজি দিয়েছেন, এই বিশাল বনশ্রী প্রকল্প গড়ে উঠেছে পুরোপুরি দায়পুরের লোকেদের হাতে। একজনও ‘বহিরাগত’ নেই। কৃষি ঋণের দরখাস্ত থেকে যে কোনও রকম বিষয়ে পরামর্শ তারা পৃথ্বীন্দ্রনাথ ভিন্ন অন্য কারো কাছে নেয় না। বয়স্ক শিক্ষার প্রসার এখন এখানে এতদূর হয়েছে যে গ্রামের বয়স্ক লোকেরা তাঁর কাছে বিশ্বের ইতিহাস, ভূগোল এমন কি দর্শন পর্যন্ত পড়তে আসে। তাদের চাহিদাতেই বনশ্রীর লাইব্রেরি এতো সমৃদ্ধ। পঞ্চায়েতও গ্রামের লোকেদের সঙ্গে বিশ্বাসভঙ্গের কাজ আজকাল করতে সাহস করে না। সবচেয়ে আনন্দের কথা ‘বনশ্রী’ বাদেও দায়পুর গ্রামের বাকি অংশ যেন বনশ্রীর উদাহরণ অনুসরণ করেই ক্রমেই সুন্দর, সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে, এবং উচ্চশিক্ষার তাগিদ ছাড়া অন্য কোনও কারণে গ্রামের কেউ শহরমুখো হতে চায় না। উপার্জনের কোনও না কোনও উপায় তাদের এখানেই হয়ে যায়। যারা মুশকিলে পড়ে তারা পৃথ্বীন্দ্রনাথের কাছে পরামর্শ নিতে আসে। এইভাবেই হয়েছে গ্রামের বহু ছেলের নিজস্ব রিকশা, দু-একজনের ট্যাকসি, ধানের কল, গম পেষাই কল, মিষ্টির দোকান, মনোহারি দোকান, ছোটখাটো সরাইখানা।
তিনি দেবপ্রিয়কে দেখতে পাননি। মুখ নিচু করে কৃষি বিদ্যালয়ের বিভাগ-বিন্যাসের কথা চিন্তা করতে করতে হাঁটছিলেন। ভারি সুন্দর একটি জামরঙের শাড়ি তাতে লম্বা লম্বা কালো কলকা পাড় চোখে পড়তে মুখ তুলে তাকালেন। পাশাপাশি দেবপ্রিয় ও মেধা ভাটনগরকে দেখে তিনি অবাক হয়ে গেলেন।
দেবপ্রিয় বলল—‘মেজজেঠু, ইনি আমাদের মেধাদি, তোমার বনশ্রী দেখতে এসেছেন।’
পৃথ্বীন্দ্রনাথের মুখের ভাব দ্রুত বদলে বদলে যাচ্ছে। তিনি বললেন—‘আসুন, নিশ্চয়ই দেখবেন।’
তখন পৃথ্বীন্দ্রনাথের ‘বনশ্রী’র সংসার এতো বড় হয়ে গেছে এবং শুধু তদারকি ও লেখা-জোকার কাজেই তাঁকে এত সময় দিতে হয় যে ব্যক্তিগত প্রয়োজনের জন্য কিছুটা এ সংসারের লোকজনের ওপর তাঁকে নির্ভর করতেই হয়। ইদানীং তাঁর রান্নাবান্না চাষের কর্মীরাই পালা করে করে দেয়। তিনি সেদিনের ছেলেটিকে ডেকে কিছু নির্দেশ দিয়ে এলেন।
দেবপ্রিয় বলল—‘জেঠু, আমি কিন্তু এখন সোজা বাড়ি চলে যাবো।’
—‘তাই যা। বাড়িতে বলে এখানে চলে আয়। একসঙ্গে খাবো।’
—‘না জেঠু তা হয় না। মা খুব রাগারাগি করবে। আমি তো এখন দায়পুরে থাকছি।’ সে আর দাঁড়াতে চাইল না। বেশ বেলা হয়ে গেছে।
—‘তাহলে আমার সাইকেলটা নিয়ে যা’ পৃথ্বীন্দ্রনাথ বললেন। সাইকেলটা নিয়ে দেবপ্রিয় প্রায় তৎক্ষণাৎ রওনা দিল। মোরাম-ছাওয়া পথে সাইকেলখানা শাঁ শাঁ করে চলে গেল, দেবপ্রিয়র শার্টের পেছনটা বেলুনের মতো ফুলিয়ে দিয়ে। চলতে চলতে যেখানে বাঁক নিল সেখানে দেবপ্রিয় হাতটা উঁচু করে নাড়ল, পৃথ্বীন্দ্র তাঁর টুপিটা নাড়ছিলেন, মেধা তাঁর রুমাল শুদ্ধু হাত।
দুজনে পেছন ফিরলেন। একটু এগিয়েই জোড়বাংলায় ওঠবার নিচু নিচু মাটির ধাপ। মেধা বললেন, ‘আপনার এই বনশ্রী কন্যাটির কথা অল্পসল্প শুনেছি দেবের মুখে। ও তো কথা বলে না। কাজে যা করবার করে। আমার কল্পনাকে ছাড়িয়ে গেছে। এতে সবুজ, এত সুস্থ নবীন এবং সবুজ। প্ল্যানিং রয়েছে অথচ প্রকৃতির স্বাভাবিক সৌন্দর্য নষ্ট হয়নি…আমার চোখ মন ভরে যাচ্ছে।’
—‘বিকেলবেলা আপনাকে সব ঘুরে ঘুরে দেখাবো’ সংক্ষেপে বললেন পৃথ্বীন্দ্রনাথ। সুন্দর ঠাণ্ডা কলঘরে চমৎকার ঠাণ্ডা জল ধরে রাখা। মেধা অনেকক্ষণ ধরে সেই ফুলের গন্ধমিশ্রিত জলে প্রাণভরে চান করলেন। চতুর্দিকে পাখি ডাকছে। ঘুঘু, কাক, কোকিল তো আছেই। আরও নানা রকম নাম-না-জানা মিষ্টি স্বরের পাখি থেকে থেকেই শিস দিয়ে উঠছে। চান সেরে একটা সাদা ধবধবে ভয়েল পরলেন মেধা, সাদা ব্লাউস। চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে নিংড়ে নিয়ে তোয়ালেশুদ্ধুই মাথার ওপর বেঁধে রেখেছেন। তাঁর জন্য নির্দিষ্ট ঘরটাতে এসে দেখলেন জানলায় খসখস টাঙানো। তাতে সদ্য জলের ছিটে দেওয়া হয়েছে। ভারি সুন্দর গন্ধ ঘরময়। খসখস একটু তুলতেই বহুদূর পর্যন্ত সবুজ ক্ষেত দেখা যায়। হু হু করে হাওয়া আসছে, খসখসের মধ্যে দিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে ঘরে ঢুকছে। দেয়ালে গোল আয়না। বাঁশের কারুকার্যকরা ফ্রেমে আটকানো। ভালো করে চুল আঁচড়ে মেধা নিজের ব্যাগটা বিছানার পাশের টেবিলে রাখলেন, খালি পায়ে বাংলোর সামনের দিকে চলে এলেন যেখানে সুপরিসর, বাঁশের জাফরি-ঢাকা বারান্দায় বেতের চেয়ার পেতে পৃথ্বীন্দ্রনাথ অন্যমনে চুরুট খাচ্ছিলেন। পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে নিঃশব্দে বসলেন মেধা। দুজনের কারোই বেশি কথা বলবার মেজাজ নেই। তাঁতঘর সম্পর্কে দু-একটা প্রশ্ন করলেন মেধা। পৃথ্বীন্দ্রনাথ উত্তর দিলেন, কেওড়াখালিতে পরবর্তী প্রোগ্রাম কি? পৃথ্বীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন মেধা উত্তর দিলেন। দু-একটা করে কথা নির্জন গ্রীষ্ম দুপুরের আলোকিত প্রকৃতির নৈঃশব্দ্যে টুপটাপ চিলের মতো ডুবে যেতে লাগল। রমেশ নামে ছেলেটিকে এখানেই খাবার পরিবেশন করতে বললেন পৃথ্বীন্দ্রনাথ। যা কিছু আহাৰ্যবস্তু সব ‘বনশ্রী’র। ভাত এবং সুগন্ধে মাত করা মুগের ডাল, পটল ভাজা এবং আলুর দম। লাউ এবং পালং শাক। এখানকার ডেয়ারির মাখন এবং দই।
খাওয়া হয়ে গেলে পৃথ্বীন্দ্রনাথ মেধার কাছ থেকে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য বিদায় নিলেন। বেলা চারটে সাড়ে চারটে পর্যন্ত বেতের ঝুড়ি চেয়ারে সেখানে বসে বসেই কাটিয়ে দিলেন মেধা। বহুদিন পর এমনি গ্রামীণ দুপুর, গ্রামীণ বিকেল। শালপাতার মধ্যে দিয়ে হাওয়ার দাপাদাপি, রোদ্দুরের রং-বদল, আকাশের রং-বদল, পাখির ডাকে আস্তে আস্তে ক্লান্তির আভাস, দূরে দূরে কর্মীদের যাতায়াত, সাইকেল চালিয়ে বেশ কিছু অল্পবয়সী মেয়ে বনশ্রীর সীমানা পার হয়ে চলে গেল। স্কুলঘর থেকে ঘণ্টা বাজার শব্দ মৃদুতর হয়ে হাওয়ায় ভেসে আসছে। দলে দলে ছেলেমেয়েরা, তাদের পেছনে শিক্ষক, সব বেরিয়ে এলেন, একটা বড় পাখির দলের মতো ওরা ওদিকের পথ দিয়ে ডানা মেলে চলে যাচ্ছে। মেধা একটু উঁচু থেকে, অনেক দূর থেকে এই মনুষ্যশাবকের ঝাঁককে পাখি এবং অন্যান্য পশুর পালের সঙ্গে একই বিবর্তন রেখার উঁচুর দিকে অবস্থিত বলে চিনতে পারলেন অনায়াসে। দল বেঁধে যাচ্ছে সব, পায়রার ঝাঁকের মতো, একটু দূরে পেছনে একটি দুটি শিক্ষক। আকাশে একলা চিল। আপন মহিমায় ঘুরে বেড়ায়।
পৃথ্বীন্দ্রনাথ যখন এসে বসলেন তখন ঘড়িতে সাড়ে চারটে বেজে গেছে। যদিও বাইরের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে এই পাকাধানের রঙের সোনালি দিন ক্রমশই আয়ুষ্মান, আরও আয়ুষ্মান হয়ে উঠছে।
পৃথ্বীন্দ্রনাথ একটু হেসে বললেন—‘কিছু খাতা-পত্র দেখা ছিল। তারপর একটু দিবানিদ্ৰামতোও হয়ে গেল।’ আপনি কি এখানেই সারা দুপুর কাটালেন!
—‘খুব ভালো লাগছিল, এখান ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না।’ মেধা নড়ে চড়ে বসলেন।
—‘ঘরের মধ্যেও কিন্তু খুব ভালো লাগত।’
রমেশ ধোঁয়া-ওঠা কফির কাপ রেখে গেল। মেধা এক চুমুক খেয়ে বললেন—দেবপ্রিয়কে ওর ফাইন্যাল পরীক্ষা পর্যন্ত আপনার জিম্মা করে দিয়ে গেলাম। এ সময়টা ওর কলকাতায় যাবার দরকার নেই।’
পৃথ্বীন্দ্রনাথ বললেন—‘জরুরি কারণ আছে নাকি?’
মেধা বললেন— ‘কারণ আছে। কতটা জরুরি আমি নিজেও জানি না। যাঁর জানবার কথা এমন কারো নির্দেশ পালন করছি।’
পৃথ্বীন্দ্রনাথ অন্যদিকে চেয়ে বললেন—‘ওরা কি ভেতরে ভেতরে আবার কোনও বিপ্লবের আয়োজন করছে?’
মেধা বললেন—‘বিপ্লব? হয়ত। বিদ্রোহ নয়। আপনার কেন এ কথা মনে হল?’
—‘প্রথমত ওর আত্মগোপন করা দরকার হয়ে পড়েছে বলছেন, অথচ কারণটা খুলে বলছেন না…’
উনি চুপ করে আছেন দেখে মেধা বললেন—‘আর দ্বিতীয়ত?’
—‘দ্বিতীয়তঃ ষাটের দশকের শেষে, সত্তরের গোড়ায় যে মেধা ভাটনগরকে লেখা অমিয় সান্যালের চিঠি সেনশর করেছি তিনি এদের লিডারশিপ দিচ্ছেন।’
মেধা যেন আকস্মিক আঘাতে একেবারে নিস্পন্দ হয়ে গিয়েছিলেন। একটু পরে অস্ফুট গলায় বললেন—‘আপনি?’
—‘ডি এস পি ছিলুম সে সময়টায়।’
—‘সেনশর করা চিঠিগুলো নিয়ে কী করতেন?’
—‘কোনোটা কোনোটা স্পেশ্যাল ফাইলে রাখা হত, নির্দোষ বিবেচিত হলে পাঠিয়ে দেওয়া হত।’
—‘সব পড়েছেন?’
—‘স-ব।’
—‘যে সব চিঠি আসত?’
—‘পোস্টে যা আসত, স-ব।’
—‘সেগুলো উনি পেতেন?’
—‘একই নিয়মে।’
মেধা খুব ধীর গলায় বললেন—‘চিঠির থেকে লেখকের গোটা চরিত্র বোঝা যায়?’
—‘বোঝাই আমাদের বিশেষ কাজ।’
—‘অমিয় সান্যালকে কি বুঝেছিলেন?’
—‘ক্লান্ত, হতাশ, আত্মনাশক।’
—‘মেধা ভাটনগরকে?’
—‘বৈপ্লবিক, আশাবাদী, চির-বিদ্রোহী।’
মেধা বললেন, ‘দেবপ্রিয় তার নিজস্ব উদ্যোগে, আমাদের কাউকেও ঘুণাক্ষরেও না জানিয়ে ড্রাগ-ব্যবসার পেছনে লেগেছিল, পুলিস তাকে তারই নিরাপত্তার জন্য ধরে, আমি খবর পেয়ে ছাড়াতে যাই। আমার প্রতি পুলিসের এই নির্দেশ।’
—‘কর্তাটি কে?’
—‘ডি আই জি রণজয় বিশ্বাস, আই. পি. এস, চেনেন?’
—‘রণজয় বিশ্বাস…রণজয়…’ পৃথ্বীন্দ্রনাথ বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে কপালে চাপ দিতে লাগলেন…‘মাস্ট বি সামবডি ফ্রম দা সেভেনটি এইট গ্রুপ’, না, মনে করতে পারছি না।
মেধা বললেন, ‘তাঁর একটা প্রাইভেট ফোন নাম্বার আমার কাছে আছে। ওই নাম্বারে সব সময়ে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে। আপনি নাম্বারটা আপনার কাছে রাখুন।’
তিনি উঠে গিয়ে নিজের হাতব্যাগের মধ্যে থেকে নোট-বইটা নিয়ে এলেন। নম্বরটা পৃথ্বীন্দ্রনাথের ডায়েরিতে লিখে দিতে দিতে বললেন—‘ছাত্ররা নিজেদের সদবুদ্ধিতে যা করে করে, আমি শুধু আমার অভিজ্ঞতা ও সংকল্পের সারটুকু তার সঙ্গে যোগ করে দিই। আবারও আপনাকে বলছি ছাত্রদের এই সব কার্যকলাপ বৈপ্লবিক, সমস্ত দেশের গণচেতনায় আস্তে আস্তে আমূল পরিবর্তন আনবে। হয়ত অনেক দিন লাগবে, তবু সে দিন যাতে নিশ্চিত আসে, তারই জন্য আমাদের যা কিছু উদ্যোগ। কিন্তু, আপনাকে আমি ঠিক মেলাতে পারছি না। সেভেনটির পুলিসের বড় কর্তা যিনি নিঃসন্দেহে নকশাল দমনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন…’
পৃথ্বীন্দ্রনাথ অস্বাভাবিক ভারি গলায় হাত দুটো মেলে বললেন ‘এই হাতে অনেক ভেঙেছি। ভাঙতে হয়েছে, মিস ভাটনগর। তাই অবসর নেবার পর ভাবলুম যদি কিছু গড়ে যেতে না পারি, ঈশ্বরের কাছে, আমার নিজের অন্তরাত্মার কাছে আমার আত্মপক্ষ বলে কিছু থাকছে না। কিছু আমি গড়বই।’ মেধা চুপ করে আছেন। পৃথ্বীন্দ্রনাথ ডান হাতের তেলোয় বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে যেন অদৃশ্য রক্তের দাগ মোছবার চেষ্টা করছেন, বললেন ‘বনশ্রী’ গড়েছি, ‘বনশ্রী’র প্রেরণায় গড়ে উঠেছে দায়পুর। দেবপ্রিয়ও আমার নিজের হাতের একসপেরিমেন্ট। মানস পুত্র যাকে বলে। হী ওয়াজ প্রাইমারিলি মেন্ট ফর দিস প্লেস, বাট হী ইজ ফাস্ট আউটগ্রোয়িং বনশ্রী অ্যান্ড দায়পুর। এটা আমি চাইনি। মিস ভাটনগর, আমাদের ব্যক্তিগত অ্যামবিশনকে আমরা যদি একটু কাট-ছাঁট না করি তাহলে এই পঁচাশি কোটির দেশ শেষ পর্যন্ত একটা নোংরা বস্তি অথবা একটা ভয়াবহ উন্মাদাগার হয়ে যাবে। এখন দেখছি ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙক্ষাও না, দেবপ্রিয় দেশসেবার অন্য এক বিপজ্জনক পথ নিচ্ছে। নেওয়াই হয়ত স্বাভাবিক। অল্পবয়স, রক্ত গরম, ট্যালেন্টেড ছেলে। কিন্তু আমরা তো বিজ্ঞানের যুগে বাস করছি মিস ভাটনগর। ডেটাগুলোকে, একসপেরিমেন্টের ফলগুলোকে তো আমরা আর অগ্রাহ্য করতে পারি না। আমাদের অভিজ্ঞতার ডেটা-ব্যাঙ্ক বলছে এভাবে হচ্ছে না। প্রত্যেকটা বিপ্লবই এক-একটা লং টার্ম ফেইলিওর। অল অফ দেম হ্যাভ টু কাম ব্যাক টু অ্যান্ড বিগিন ফ্রম স্কোয়্যার এ। দেবপ্রিয়কে স্যাক্রিফাইস করতে হলে…আই ডোন্ট নো হোয়্যার আই এগজ্যাক্টলি স্ট্যান্ড…’ মাথাটা নাড়তে লাগলেন পৃথ্বীন্দ্রনাথ।
বিকেল গাঢ় হয়ে আসছে। চারদিকে কিরকম একটা ভিজে খড়ের মতো রঙের রোদ্দুর। হাওয়াটা আরও উত্তাল, উদ্দাম হয়ে উঠছে ক্রমশ। পাখির ডাক আরও যূথবদ্ধ। একটা দুটো একলা পাখির কূজন থেকে বহু পাখির কাকলি। বাংলোর পাশে একটা মহীরুহ জামগাছ। সেটার মাথা ক্রমশ টিয়াপাখিতে ভরে যেতে থাকে। মেধা বলেন—‘একটা “বনশ্রী” দেবপ্রিয়র ক্ষমতার পক্ষে একটু ছোট হয়ে যাবে পৃথ্বীন্দ্রদা। আরও অনেক এমন শ্রীভূমি পরিচালনা করবে ও। ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙক্ষা তো নয়ই, ছোট মাপ, ছোট গণ্ডির কোনও সমাজ-ভাবনাও ওকে ধরে রাখতে পারবে না। নেতা নয়, ও অধ্যক্ষ হবে এই কর্মযজ্ঞের। বিপ্লব সম্পর্কে আপনি যা বললেন আমি তার সঙ্গে মোটামুটি একমত। খালি আমার মনে হয় এই সব অসফল বিপ্লবগুলোও নিশ্চয়ই ভাবী যুগ আরম্ভের অজানা পর্যায়গুলো কিছু-কিছু খুলে দিয়ে যায়। তা ছাড়া, নেতি নেতি করে এগোনোও তো অগ্রগতি!… আপনার আরও জানা দরকার রণজয় বিশ্বাস যিনি এখন পশ্চিমবঙ্গে ড্রাগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসেছেন তিনি একেবারে দেবপ্রিয়র আদলে বসানো। আমার সহপাঠী ছিলেন, আমি জানি। তিনি সাহস এবং সেই সঙ্গে সতর্কতা নিয়ে এগোচ্ছেন। তাঁকে অবিশ্বাস করা আমাদের ঠিক হবে না।’
পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখ তুলে বললেন—‘আপনি কি তাহলে অনেক বদলে গেছেন?’
—‘এ কথা কেন বলছেন?’
—‘পত্রালাপের ভাটনগরকে যদ্দূর মনে পড়ে খুব আবেগপ্রবণ, মরিয়া এবং সংশয়াকুল।’
মেধা বললেন, ‘সব মানুষই বদলায়। রাজনীতিকদের রং বদল নয়। অভিজ্ঞতার নিরিখে নিজেকে, নিজের ফর্মকে ক্রমাগত যাচাই করে করে বদলে যাওয়া। কিন্তু একদম মূলের দিক থেকে দেখতে গেলে মেধা তো বদলায়নি! আপনিই যে একটু আগে বললেন—সে আশাবাদী, বৈপ্লবিক, চির-বিদ্রোহী!’
—‘তাহলে একি ঋতুবদল?’
—‘তাই বা পুরোপুরি বলতে পারছি কই? বেসিক ঋতুটা তো বসন্তই দেখছি। গ্রীষ্মের খরা, বর্ষার প্লাবন, শীতের শুষ্কতা সবই সাময়িক! ঋতুরাজ আমাকে যেন পুরোপুরি অধিকার করে রেখেছেন। সৃজনের সম্ভাবনার বীজগুলোকে নিষিক্ত করতে করতেই তো আমার সময় চলে যায়। খরা-বন্যার কথা ভাবতে সময় পাই কই?’ মেধা মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে বললেন।
পৃথ্বীন্দ্রনাথের মাথার চুলগুলো সব সাদা। নিয়মিত ব্যায়াম আর স্বাস্থ্যের নিয়ম পালনে কর্মঠ, উজ্জ্বল শরীর। চোখ ঝকঝক করছে। বললেন—‘বসন্ত যাকে জীবনের গোড়াতেই নিষ্ঠুরভাবে ঠকিয়েছে এমন মানুষকে এভাবে বসন্তের জয়গান করতে আমি এই প্রথম শুনলুম।’
মেধা বুঝলেন ইনি অনেক জানেন। তাঁর জীবনের লুকোনো ইতিহাসের পাতাগুলো ইনি ঘনিষ্ঠভাবে পড়ে নিয়েছেন। হয়ত মেধা নিজেও যা জানেন না, তারও অনেক এঁর জানা। মানুষটি স্বল্পবাক, কিন্তু ঋজু এবং গভীর। তিনি একটু ইতস্তত করে বললেন—‘বিশ্বাস করুন দাদা, আমি ঠকিনি। আমার কিছুই হারায়নি। পূর্ণ থেকে পূর্ণ নিয়ে নিলেও দেখছি পূর্ণই বাকি থেকে যাচ্ছে।’