উত্তরসাধক (Uttarsadhak) : 18
উজান বলল, ‘আই ও য়ু অ্যান অ্যাপলজি দেব, আমি তোকে ভয়ানক সন্দেহ করেছিলাম। ভেবেছিলাম তোকে ছাড়িয়ে এনে এক্ষুনি কোনও ডি-টকসিফিকেশন সেন্টারে দিতে হবে।’
দেবপ্রিয় চান করে চুল আঁচড়াচ্ছিল লক্ষ্মীশ্রীর বড় বড় দাড়ার চিরুনি দিয়ে। তার চুল থেকে জল ঝরে ঝরে লুকুর বাবার পাঞ্জাবির উপরিভাগ ভিজিয়ে দিচ্ছে।
এখন রোদ চড়ে গেছে। পাখাগুলো সব ঘুরছে। লক্ষ্মীশ্রী জানলার ভেনিশিয়ান ব্লাইন্ডগুলো টেনে নামিয়ে দিল। সে আজ বাড়ি এসেই খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দেবপ্রিয়র ফার্স্ট এইড। তার জামাকাপড়। আগে বাপীর পায়জামা পাঞ্জাবি দিয়ে সে দেবপ্রিয়কে বাথরুমে চান করতে পাঠিয়েছে। আজকে বন্ধুরা এবং মেধাদি সবাই এখানে খাবেন এই তার ইচ্ছে। সে মাঝে মাঝেই ঝড়ুকে নির্দেশ দিয়ে আসছে। তার বাপী ড্রয়িংরুমে বসে বসে জয়দীপের সঙ্গে দাবা খেলছেন। কিন্তু উৎসুক হয়ে মাঝে মাঝেই তাকিয়ে দেখছেন লুকু বারবার রান্নাঘরে যাচ্ছে, ঝড়ুকে একবার ধমক হলো, চটপট ড্রয়িংরুম থেকে কয়েকটা চেয়ার সে উঠিয়ে নিয়ে গেল। বন্ধুরা বসবে। হুকুমের সুরে বলল—‘এই আমার বিছানা হাঁটকাবি না। চেয়ার এনে দিয়েছি, বোস।’
উজান বলল—‘আমাকে বলতে পারতিস, আমি এনে দিতুম।’
লুকু বলল—‘বেশি বকবক না করে বোস, এখন দেবকে বেশি বিরক্ত করিস না, ব্রেকফাস্ট খেয়ে এক ঘুম ঘুমিয়ে নিক তারপর ওর কথা শুনিস। দেব, তুই ঘুমো।’
মৈথিলী হাসতে হাসতে বলল—‘বাপরে লুকু, মনে হচ্ছে দেব তোর একলার সম্পত্তি!’
—‘না তো কি? পাবলিকের হবে না কি?’ লুকুর মুখ গম্ভীর। কয়েক সেকেন্ড সবাই চুপ। তারপর সবাই হাসতে শুরু করল। দেবপ্রিয়র গলা শোনা গেল—‘এসব কি আবোল তাবোল বলছ লুকু?’
‘বলেছি, বলেছি’—লুকু ঘর থেকে বেরিয়ে এলো—‘ঝড়ু তুই ওমলেটটা পুড়িয়ে ফেললি নাকি? আঁচটা সিম করে দে। হ্যাঁ। টোম্যাটো আর চীজের কুচিগুলো দিয়ে দে। এইবার ভাঁজ কর। উজান তোরাও ওমলেট খাবি নাকি রে?’
বিশ্বজিৎ বললেন—‘জিজ্ঞেস করছিস কি রে? দে সবাইকে!’
লুকু বলল—‘ওরা হয়ত ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছে। সেক্ষেত্রে আমি এতো খাটবো কেন?’
মৈথিলী বলল, ‘না রে আমি অন্তত খাইনি। উজান তুই?’
‘আমিও না’, উজান বলল, ‘তবে দেব ব্রেকফাস্ট খেয়েছে। কি বল দেব, বেশ উত্তম-মধ্যম?’
দেবপ্রিয় হালকা গলায় বলল—‘ব্রেকফাস্ট তো নয়, লেট নাইট ডিনার। আমি হঠাৎ অহিংস সেজে গেলুম বুঝলি? ওরা দু-তিনটে চড়, ঘুষি, কিল ইত্যাদি মেরে টেরে যখন দেখল রেজিস্ট করছে না, তখন হঠাৎ থেমে গেল। না হলে আজ আর ওমলেট খেতে হত না।’
লক্ষ্মীশ্রী আড়চোখে তার দিকে তাকাল। দেবপ্রিয় ঠিক বলছে না। ওকে এর চেয়ে বেশি মার খেতে হয়েছে। পিঠে কালশিটে দাগ আছে। পেটে খিচখিচে ব্যথা।
দেবপ্রিয় বলল—‘আমারও কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার আছে উজান। আমি তোমাকেই প্রথম প্রথম সন্দেহ করেছিলুম।’
—‘কিসের সন্দেহ?’
—‘কেউ আমার পকেটের সিগারেট-প্যাকেট বদলে দিত। সেম প্যাকেট, খালি সাধারণ তামাকের বদলে হেরোইন পাইল করা তামাক।’
—‘বলিস কি? উজান বলল—‘আমাকে সন্দেহ করেছিলি কেন?’
—‘তুই-ই তো আমার সবচেয়ে কাছাকাছি থাকতিস। তবে আমি আমার সন্দেহের কথা কাউকে জানাইনি। কেওড়াখালিতে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে গেল প্রমিতই ব্যাপারটা করে।
—‘প্রমিত?’ আশ্চর্য হয়ে মৈথিলী বলল।
—‘প্রমিত স্কুল ডেজ থেকে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছে, তুই ভুল দেখিসনি?’ উজান বলল।
—‘নাঃ। ওই তো আমাকে কলেজ স্ট্রিটের লালের দোকানটা দেখিয়ে ছিল। তবে প্রমিত নিজে নেশা করলেও ওকে আমি এত দিনের মধ্যে কোনও ঠেকে দেখিনি। ও কোথায় নেশা করে ভগবান জানেন!’
মৈথিলী বলল— ‘দু সপ্তাহ কি তারও বেশি ওকে দেখছি না। আগে খেয়াল করিনি। দেব তুই আমাদের সাবধান করে দিসনি কেন?’
—‘সাবধান করেছি ঠিকই। ওর নামটা বলিনি। একেবারে নিশ্চিত না হয়ে বলাটা কি ঠিক হত!’
মৈথিলী উদ্বিগ্ন গলায় বলল—‘তোর আগে বলা উচিত ছিল দেব। প্রমিতটা ড্রাগ-অ্যাডিক্ট হয়ে যাচ্ছে, তাকে আমরা বাঁচাব না?’
দেবপ্রিয় বলল, ‘আমার নানা সংশয় ছিল। ওর যোগাযোগগুলো কি ধরনের না জেনে ওর সম্পর্কে কোনরকম অ্যাকশন নেওয়ার বিপদ ছিল মৈথিলী। আফটার অল ও একজনকে তার অজান্তে, অনিচ্ছায় মাদকাসক্ত বানাবার চেষ্টা করেছিল। ও কোনও দলের এজেন্ট কি না সেটা জানারও চেষ্টা করছিলুম আমি। কাজটা সময়সাপেক্ষ।’
লক্ষ্মীশ্রী অভিভাবকসুলভ গলায় বলল—‘ওকে তোরা এবার ঘুমোতে দে। চল আমরা বাপীর কাছে গিয়ে বসি। এক্ষুনি বাপী ভাববে—লুকুটা বন্ধুদের মনোপলাইজ করে রেখেছে। না বাপী?’
বিশ্বজিৎ বললেন—‘তোর বন্ধুরা তো তোরই বন্ধু। আমার তো নয়।’
উজান মৈথিলী ছোট্ট থেকে দেখছে লুকুর বাবাকে। আগে খুব গম্ভীর, সুপুরুষ সাহেব মানুষ ছিলেন। উজানের বাবা যেমন তার বন্ধুর মতো, অনেক বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা করা যায়, তেমন নয়। মৈথিলীর বাবা যেমন কন্যা-অন্ত প্রাণ, রাশভারি অথচ স্নেহময়। তেমনও নয়। একটু যেন ফর্ম্যাল। একটু বুঝি উন্নাসিক। লুকুদের বাড়িতে মাঝে মধ্যেই পার্টি হতো। খুব শানদার কিছু ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা আসা-যাওয়া করতেন। দারুণ মড। অনেক দিন ওরা এসে দেখেছে লুকুর বাবা মা দারুণ সেজেগুজে পার্টিতে বেরোচ্ছেন। লুকু একটা লম্বা ড্রেস পরে মুখ চোখ ভারি করে বসে বাজে ইংরিজি নভেল পড়ছে। জয়দীপ একা একাই ব্যাডমিন্টন র্যাকেট আর কক নিয়ে ওদের বড় ড্রয়িংরুমটায় এদিক থেকে ওদিক মারছে, আবার কুড়িয়ে নিয়ে ওদিক থেকে এদিক মারছে।
এই বিশ্বজিৎকাকুকে তারা চেনে না। দুজনেই ড্রয়িংরুমে এসে দাবা বোর্ডটাকে ঘিরে বসল। লক্ষ্মীশ্রী বলল—‘দাঁড়া তোদের জন্যও ওমলেট বানাচ্ছি। টোম্যাটো চিজ দিয়ে ডবল ডিমের ওমলেট, খেয়ে দ্যাখ রেস্টুরেন্টের সঙ্গে তফাত করতে পারবি না।’
বিশ্বজিৎ বললেন—‘হ্যাঁ, এটা ঝড়ু ভালোই পারে।’
‘ঝ-ড়ু?’ লুকু ফিরে দাঁড়াল—‘বাপী ইয়ার্কি হচ্ছে, না? ঠিক আছে, তুমি পাবে না।’
—‘কিসের কথা বলছিস? ওমলেট? অ! আমি ভাবছি বুঝি চায়ের কথা বলছিস। চাটা ঝড়ুকে ভালোই শিখিয়েছিস!’
—‘খুব কথা ঘোরাতে শিখেছ’ লুকু হেসে ফেলছে। মৈথিলী, উজান, জয় সবাই হাসছে। ঝড়ুও একঝুড়ি মূলো বার করে ফেলেছে।
ঝড়ুকে দিয়ে, নিজেরটা প্লেটে নিয়ে লুকু গলদঘর্ম হয়ে ফিরে এলো।
মেধা যখন পৌঁছলেন তখন তিন বন্ধুই রান্নাঘরে। উজান বলছে ‘আমি বাবাকে মাংস রান্না করতে দেখেছি। পুরো প্রসেসটা দেখেছি বহুবার। থিয়োরিটা পুরোপুরি জানি। আজকে আমাকে মাংস রাঁধতে দিতেই হবে।’
লুকু বলল—‘দ্যাখ উজান, নিজের বাড়িতে রাঁধিস। আমার বাপীর খাওয়াটা নষ্ট করে দিস না প্লিজ। এই তো মৈথিলীও রয়েছে, ও তো জাস্ট সাহায্য করছে, উৎপাত করছে না তো তোর মতো?’
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘দে না, ওকে দিয়েই দ্যাখ না।’
আসলে, বিশ্বজিৎ একে তো উজানকে ভীষণ পছন্দ করেন। দ্বিতীয়ত উজান মুসলিম। তাঁর ধারণা মুসলিম মাত্রেই মোগলাই রাঁধতে পারে। উজানের রান্নার প্রস্তাবে তিনি তাই খুব উৎসাহী। মেধাকে দেখে তিনি বললেন—‘বাঃ এই তো মিস ভাটনগর এসে গেছেন। ওঁর জন্য তোরা কি ডিশ রেখেছিস?’
মেধা দেখলেন সকলেই খুব হাসিখুশী। বললেন—কেন? ‘মেনু কি?’
লক্ষ্মীশ্রী বলল—‘দেখুন না দিদি, বাপী অত ভালো মাংসটা আনল, এখন উজান বায়না ধরেছে ও রাঁধবে। দিদি আপনার জন্য পোস্তর বড়া করে দেবো!’
মেধা সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললেন—‘তোরা যা যা রাঁধবি সব খাবো আজ। দেব কোথায়?’
—‘ঘুমিড়ে পড়েছে।’
—‘হ্যাঁরে মৈথিলী, তোদের ফাইন্যাল কবে?’
—‘মাস দুই দেরি আছে।’
—‘কাল আমি দেবকে নিয়ে ওদের দেশ দেখতে যাবো।’
—‘দিদি, হঠাৎ?’ লক্ষ্মীশ্রী বলল।
—‘ইচ্ছে হল। ওর মেজজেঠু তো সেখানে দারুণ কাজ করছেন, দেখতে যাবো না?’
—‘কেন, তুই যাবি?’
—‘ন্ না।’ লুকু একটু লজ্জা পেয়ে গেল, ‘এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম।’
এবার গম্ভীর হয়ে মেধা বললেন, ‘তোদের জানা দরকার, দেবকে রণজয় বিশ্বাস ডি. আই. জি. কিছুদিন কলকাতা থেকে সরিয়ে দিতে বলছেন।
—‘কেন?’ লুকু জিজ্ঞেস করল, তার স্বরে উদ্বেগ।
মেধা বললেন—‘দেব উঠুক, একসঙ্গে সবাইকে বলব।’