উত্তরসাধক (Uttarsadhak) : 17
ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশের সঙ্গে সরাসরি দেখা করবার ব্যবস্থা করে রেখেছে উজান। দাদুকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে। মেধা বললেন ‘তোরা দাঁড়া। প্রথমে আমি কথা বলি।’
দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেই মেধা অবাক হয়ে বললেন—‘রণজয়!’ পদস্থ লোকেদের অতিথি-অভ্যর্থনার রীতি এক। সামনে কিছু ফাইল-টাইল জাতীয় জিনিস নিয়ে তাঁরা পড়তে ব্যস্ত থাকেন। ইনিও তাই ছিলেন। ‘রণজয়’ নামটা কানে যেতে সঙ্গে সঙ্গে মুখ তুলে তাকালেন।
‘মেধা!’ চতুর্গুণ বিস্ময়ের সঙ্গে ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘মেধা ভাটনগর, তুমি এখানে? কেমন আছো? কি করে এলে?’
মেধার ছাত্রজীবনের সহপাঠী রণজয় বিশ্বাস প্রথমেই পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থনে একেবারে উন্মন হয়ে গেলেন।
‘আঃ সেই সব দিনগুলো! কলেজ স্ট্রিটের ট্রাম-বাস-মোটরগাড়ির অবিরাম আবহসঙ্গীত। আশুতোষ বিল্ডিংয়ের মধ্যে সিনারিও আরম্ভ হল। এস. ডি. ঘরে ঢুকেই রোল কল করতে করতে ধুন্ধুমার বকতে আরম্ভ করলেন। কাট। পেছনের বেঞ্চ থেকে প্রদীপ হেঁড়ে গলায় বলল, ‘সার, মে আই শাট দা ডোরস অ্যান্ড দা উইনডোজ?’—‘কেন? হোয়াই?’ বকুনির স্রোতে বাধা পড়ায় এস. ডি. খানিকটা থমকে গেছেন। প্রদীপ বলল—‘বড্ড অপমান লাগছে সার। অন্যরাও তো সব শুনছে। তাছাড়া জানলা-দরজার ফাঁক দিয়ে কিছুটা এসকেপ করেও যাচ্ছে। টোটাল এফেক্টটা হচ্ছে না! কাট। এবার ক্যামেরা সরে যাবে মেয়েদের মুখের ওপর। ভয়ের চোটে হাসি চেপে আছে, মুখগুলো টকটকে।’
মেধা হাসতে লাগলেন, ‘হ্যাঁ প্রদীপ ছিল একের নম্বর বিচ্ছু…। তুমিও কিছু কম ছিলে না। আচ্ছা রণজয় আমার ছাত্র দেবপ্রিয় চৌধুরীকে ড্রাগ-চালানের দায়ে ধরেছ কেন? প্রিপসট্রাস!’
রণজয়ের চোখ সতর্ক হয়ে উঠল। বললেন, ‘ও! তা এই দেবপ্রিয় চৌধুরীটি তো মেডিক্যাল কলেজের ছেলে, তোমার ছাত্র হল কী সুবাদে?’
—‘আমি ইতিহাস পড়াই রণজয়। ইতিহাস সবার পাঠ্য।’
—‘জবাবটা মেধা ভাটনগরের মতোই হয়েছে’—রণজয় হেসে ফেললেন, তারপর বললেন
—‘সিরিয়াসলি বলো তো মেধা, ব্যাপার কি? ড্রাগ-অ্যাবিউজ ফাইট করবার জন্য আমাকে কলকাতায় ট্রান্সফার করা হয়েছে। এই ছেলেটিকে আমার লোক বেশ কিছুদিন চেজ করে করে ধরেছে। এর সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কি?’
মেধা বললেন—‘আমার সঙ্গে কিছু ইমপর্ট্যান্ট উইটনেস রয়েছে। তাদের সঙ্গে তুমি একটু কথা বলো।’
—‘ওর আত্মীয় স্বজন?’
—‘ওর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এখানে আমিই। আমার আরও কিছু ছাত্র-ছাত্রী আছে, ওরা সবাই একসঙ্গে নানা ধরনের সোশ্যাল ওয়ার্ক করে, ওদের সঙ্গে কথা বললেই জিনিসটা তোমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে!’
রণজয় ওদের ডেকে পাঠালেন।
—‘তুমি এই মেয়েটির সঙ্গে কথা বলো’—মৈথিলীকে দেখিয়ে দিলেন মেধা।
মৈথিলী এগিয়ে এসে রণজয়কে নমস্কার করে বলল—‘দেবপ্রিয় চৌধুরী আমাদের বছরের সবচেয়ে উজ্জ্বল ছাত্র। এইচ. এস-এ রেকর্ড মার্ক্স পেয়ে ফার্স্ট হয়। মেডিক্যাল কলেজেও ওর পার্ফম্যান্স খুব ভালো। ও গ্রামের ছেলে। এখানে কোনও পারিবারিক বন্ধুর বাড়ি থেকে পড়ে। আমাকে ও গত নভেম্বর মাসের সতেরই, সন্ধে সাতটা নাগাদ কথাচ্ছলে জানায় কে বা কারা ওকে ড্রাগ ধরাতে চাইছে ওর সিগারেটের প্যাকেট বদলে দিয়ে। ওর কথা শুনে মনে হয় এদের ধরতে ও বদ্ধপরিকর।
—‘প্রথমে হয়ত সদুদ্দেশ্যই ছিল। কিন্তু ড্রাগ এমনই জিনিস…’
—লক্ষ্মীশ্রী হঠাৎ বাকি দুজনকে সরিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে এলো। তার চোখ জ্বলছে। বলল—‘মিঃ ইন্সপেক্টর, আমাকেও কেউ ড্রাগ ধরাতে চেয়েছিল। দেবপ্রিয় চৌধুরী হ্যাজ প্রিভেনটেড ইট। আপনারা আসল নকল ধরতে পারেন না? দেবপ্রিয় এদের ধরবার জন্য আজ তিন বছর সাধনা করছে। আপনারা আসল বদমাশগুলোকে ধরতে পারবেন না। অনেস্ট প্রোবিং যে করছে, তাকে ধরছেন! ওয়ান্ডারফুল!’
উজান বলল—‘লুকু তুই চুপ কর।’
রণজয় অবাক হয়ে লক্ষ্মীশ্রীকে দেখছিলেন। বললেন—‘তোমাকে ড্রাগ ধরাতে চেয়েছিল কে? কিভাবে?’
—‘অতসব বলবার দায় আমার নেই। আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমি সামলাবো। আপনি দেবকে ডেকে পাঠান, পাঠিয়ে দেখুন ও ড্রাগ অ্যাডিক্টের মতো আচরণ করে কি না।’
রণজয়ের ইঙ্গিতে একটু পরেই দেবপ্রিয়কে আনা হল। দেখেই মেধা উঠলেন। এরা ওকে মারধোর করেছে। দেবপ্রিয়র চোখ লাল, চুল অবিন্যস্ত। যে দুজন কনস্টেবল ওকে ধরে এনেছিল তাদের একজন বলল—‘সার, জামাকাপড় থেকে পর্যন্ত উৎকট গন্ধ বেরোচ্ছে।’
—‘পকেট সার্চ করে কি কি পাওয়া গেছে দেখাও তো।’
কনস্টেবল দুটি তিন-চার রকম সিগারেটের প্যাকেট, দেশলাইয়ের বাক্স, মানিব্যাগ, এবং গোটা দুই রুমাল এনে রাখল টেবিলের ওপর। মানিব্যাগটা উপুড় করে তার থেকে কিছু খুচরো টাকাপয়সা বার করল ওরা। সব মিলিয়ে টাকা তিরিশের মতো এবং কিছু রেজগী। তারপর বার করল একটা প্যাকেট, রণজয় বিশ্বাসের দিকে সেটা এগিয়ে দিয়ে বলল—‘সার ব্রাউন সুগার।’
হঠাৎ দেবপ্রিয় কথা বলে উঠল। বলল ‘সিগারেটের প্যাকেট চারটে আছে দেখবেন। যে দুটো খালি হয়ে এসেছে, সেগুলো অর্ডিনারি চারমিনার। অন্য দুটোয় সিগারেটের মশলার সঙ্গে হেরোইন মিক্স করা আছে। দেখবেন দুটোই ভর্তি।’ প্রশান্ত স্বরে কথাগুলো বলে দেবপ্রিয় টলতে লাগল।
লুকুর চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসছে। সে ছুটে গিয়ে দেবপ্রিয়র পাশে দাঁড়াল—‘দেব, তোমাকে ওরা মেরেছে, না?’
দেবপ্রিয় বলল—‘লুকু উত্তেজিত হয়ো না।’ তারপর রণজয় বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল—‘মাফ করবেন, আমি আপনার নাম জানি না, পদ জানি না, শিক্ষক ছাড়া কাউকে ‘সার’ বলি না, আমি টলছি, ড্রাগের নেশায় নয়, কাল থেকে না খেয়ে, ঘুসুড়ির ঠেকে পুলিশের প্রতীক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা মারিজুয়ানা আর হেরোইনের ধোঁয়ার মধ্যে বসে থেকে এবং তারপর যখন সত্যিই আপনারা এলেন তখন আপনাদের হাতে উত্তম-মধ্যম খেয়ে।’
রণজয় কনস্টেবল দুটিকে বললেন—‘ওকে ছেড়ে দাও, বসতে দাও, দুধ আনো খানিকটা।
কনস্টেবল দুটি চলে গেলে রণজয় বললেন—‘এক্সপ্লেন ইওরসেল্ফ।’
দেবপ্রিয় একটু ঝুঁকে বসেছিল— সে বলল—‘গত তিন বছর লুকোচুরি খেলার ধরন দেখে মনে হয়েছে বিশ্বাস করার মতো মানুষ এখানে খুব কম। আপনাকে কি বিশ্বাস করা যায়? এনিওয়ে আই ডোন্ট কেয়ার এনি মোর।’
মেধা বললেন—‘দেব কি বলছিস? ঠিক করে বল।’ তাঁর ইঙ্গিতে উজান কোথা থেকে দুটি ঠাণ্ডা দুধের বোতল যোগাড় করে এনেছিল। মেধা বললেন—‘রণজয়, এগুলো ওকে দিতে পারি?’
—‘দাও।’ একটা খেলো দেবপ্রিয়। তারপর ঝোঁকহীন ইংরেজিতে বলল— ‘আই ওয়ান্টেড দা পুলিশ টু ফলো মি। আই ডেলিবারেটলি স্টেইড ইন দা ডেন লং আফটার আদার্স ক্লীয়ার্ড আউট, প্রিটেন্ডিং দ্যাট আই ওয়াজ আউট। আই ডিড দিস টাইম অ্যান্ড এগেইন। বাট ইয়োর পীপল ইনভেরিয়েবলি অ্যারাইভ্ড্ হোয়েন দা কোস্ট ওয়াজ ক্লীয়ার। দে কলারড্ অ্যান্ড ম্যানহ্যাণ্ড্ল্ড্ মি। ইউ নো বেস্ট হোয়েদার অল দিস ইজ ডেলিবারেট অর নট।’
দেবপ্রিয়র কথা শেষ হতে না হতেই কলিংবেল টিপেছিলেন রণজয়। কনস্টেবলকে কি ইঙ্গিত করলেন, একজন পুলিশ অফিসার এসে ঢুকলেন। তিনি অন্যদের সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সোজা রণজয় বিশ্বাসের কাছাকাছি চলে গেলেন এবং চুপিচুপি কি সব বলতে লাগলেন। শুনতে শুনতে রণজয়ের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠছিল। অফিসারটি চলে যাবার পর তিনি লক্ষ্মীশ্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার নাম কি?’
লক্ষ্মীশ্ৰী বেশ কড়া সুরে নিজের নাম বলল। রণজয় বললেন—‘ঠিক আছে তোমরা তিনজন তোমাদের বন্ধুকে নিয়ে যেতে পারো। ওর নামে কোনও চার্জের রেকর্ড নেই। ওকে আমরা ধরিনি। নাউ ইউ ক্যান অল গো। ও কে?’
লক্ষ্মীশ্রী দৃঢ়স্বরে বলল— ‘কিন্তু আপনারা ওকে শুধু শুধু মেরেছেন। এর জবাবদিহি আপনাদের করতে হবে। নইলে আমরা ছাড়ব না। অনেকদূর পর্যন্ত যাবো এর জন্য।’
—‘ঠিক আছে’, রণজয় হঠাৎ তাঁর টেবিলের ড্রয়ার খুললেন, একটা বড় প্যাকেট বার করে ছিঁড়ে ফেললেন। বার হল অনেকগুলো পাতলা পাতলা চকোলেট বার। তিনি সেগুলো চার বন্ধুর দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন—‘এগুলো সুইস চকোলেট। ভেতরে খুব সুন্দর নির্দোষ ওয়াইন আছে। এগুলো তোমরা খাও, উই আর ফ্রেন্ডস নাউ। আর তোমাদের বন্ধুকে খুব সাবধানে নিয়ে যেও। আমি তোমাদের দিদির সঙ্গে একটু কথা বলে নিচ্ছি। ওঁর কাছ থেকে পরবর্তী করণীয়গুলো তোমরা জেনে নেবে।’
চকোলেটগুলো কেউ ছুঁলো না। রণজয় নিজেই একটার মোড়ক ভেঙে দেবপ্রিয়র দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন—‘তোমার নাম কি? দেব? শোনো, এগুলো খুব নারিশিং। মিলিটারিতে ডিস্ট্রিবিউট করা হয়। তোমার ওপর খুব ধকল গেছে কাল থেকে। য়ু আর লিটর্যালি আ হাংরি ইয়ং ম্যান। টেক ইট, সে, ফ্রম অ্যান আঙ্কল।’
দেবপ্রিয় নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে চকোলেটটা নিল। কিন্তু মুখে পুরল না। সে উঠে দাঁড়াল। মেধা বললেন—‘বাইরে বিশ্বজিৎদা আছেন, তোরা সবাই লুকুর বাড়ি যা। আমি ওখানেই তোদের সঙ্গে দেখা করব।’
ওরা চলে গেলে রণজয় বিশ্বাস কয়েক মিনিট চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রইলেন। তারপর যেন আপন মনেই বললেন— ‘ওরা তা হলে আমার সঙ্গে সন্ধি করল না!’
টেবিলের ওপর ছড়ানো চকোলেটগুলোর দিকে তাকিয়ে মেধা হেসে বললেন, ‘ওরা যে সুবিচার চেয়েছিল, তা তো তুমি ওদের দাওনি! কি করে সন্ধি করবে?’
রণজয় বললেন—‘মেধা, পুলিশ কিন্তু ভারত সেবাশ্রম সংঘের সাধু নয়। তার সঙ্গে টক্করে এলে দু-চার ঘা খেতে হতে পারে।’
—‘সেটা টক্করে এলে। যে সহযোগিতা করছে…’
হঠাৎ রণজয় ভেতরে ভেতরে কি যেন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়লেন, নিচু গলায় বললেন—‘মেধা, দ্যাট বয় ইজ ইন গ্রেট ডেঞ্জার।’
—‘মানে?’ মেধা সোজা হয়ে বসলেন।
—‘কিছুদিন আগে, ধরো বছরধানেকের সামান্য বেশি! এক বিখ্যাত কলেজের ছাত্রকে সার্কুলার রেলের কোনও একটা জায়গায় গলা-কাটা অবস্থায় পাওয়া যায়। নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেনটা এসে গেলে, অ্যাকসিডেন্ট বলেই চলে যেত জিনিসটা। মনে আছে?’
মেধা মাথা নাড়লেন।
—তা হলে এ-ও নিশ্চয় মনে আছে তার এক সহপাঠীকে পুলিশ মার্ডার চার্জে ধরে। কেসটা দাঁড়ায়, এক সহপাঠিনীকে কেন্দ্র করে এদের মধ্যে লাভ-ট্র্যাঙ্গল ছিল, যার ফলে এই খুন। কনভিকশন শেষ পর্যন্ত হয়নি, অভিযুক্ত ছেলেটির বাবা খুব প্রভাবশালী মহলে ঘোরাফেরা করেন। কিন্তু আমার কাছে খবর আছে সংশ্লিষ্ট মেয়েটির কাছে কে বা কারা বার বার ফোন করে এই প্রেম-ত্রিভুজের কথা স্বীকার করে নিতে বলে। অভিযুক্ত ছেলেটি নাকি মরিয়া হয়ে উঠেছিল, মাঝে মাঝেই হত্যার ভয় দেখাত, এটাও তারা মেয়েটিকে স্বীকার করে নিতে বলে। মেয়েটি ছিল অনমনীয়। তাকে একবার একটা অ্যামবাসাডর গাড়ি আরেকবার একটি ট্রাক ধাক্কা মারে, সামান্য ক্ষতি হয় তাতে। সেই অবস্থায় আবার ওই ফোন আসে। যাই হোক, এই মেয়েটি তার সাক্ষ্যে অটল থাকে বলেই সহপাঠী ছেলেটি রক্ষা পেয়ে যায়।’ রণজয় চুপ করলেন।
মেধা অধৈর্য গলায় বললেন—‘সো হোয়াট? এই সব পুরনো স্ক্যান্ডাল আমাকে শোনাচ্ছো কেন?’
—‘শোনাচ্ছি এইজন্যে যে আসলে এই ছেলেটি ড্রাগ-ট্র্যাফিকারদের শিকার। খুব ট্যালেন্টেড ছেলে। তার রোখ চেপে গিয়েছিল যেমন করে হোক ছাত্রদের সর্বনাশ যারা করছে, তাদের ধরবে। ওই তার পরিণাম।’
—‘জানো যদি, তো আসল অপরাধীদের ধরলে না কেন?’
—‘কোনও প্রমাণ ছিল না। তা ছাড়াও ছেলেটির পেছনের পকেটে একটা “জেনুইন” সুইসাইড নোট পাওয়া যায়।’
—‘তাহলে নিশ্চিতই বা হচ্ছো কি করে যে এটা ড্রাগ-ব্যবসায়ীদের ব্যাপার?’
—‘সব কথা তোমাকে বলা সম্ভব নয় মেধা, দো য়ু আর মাই ওল্ড ফ্লেম,’ হাসতে হাসতে বললেন রণজয়;—‘এইটুকু শুধু জেনে রাখো এই ডেনগুলোর পেছনে প্রচুর পলিটিক্যাল ইনফ্লুয়েন্স আছে। বিরাট র্যাকেট একটা। পলিটিকস করতে গেলে আজকাল গুণ্ডাদের হাতে রাখতে হচ্ছে, গুণ্ডাদের চাই রেস্ত, অনে-ক অনে-ক, যা দিয়ে গোটা সমাজকে ভীত, কোণঠাসা করে রাখা যায়। সুতরাং ড্রাগ। সবটাই ভিশাস সার্কল। এ এক নতুন প্রেমচক্র। তোমার এ ছাত্রটি আগুনে হাত দিয়েছে। ওরই বিপদ বুঝে আমাদের ইন্স্পেক্টর রক্ষিত ওকে ধরে এনে, খানিকটা ধোলাই দিয়ে, ধরে রাখতে চেয়েছিল। সবটাই আই-ওয়াশ। আমাদের লোকেরা ইশারায় বুঝে যায় কে জেনুইন, কে জেনুইন নয়।’
—‘ইশারা-টিশারা নয়। তোমাদের লোকেরা সব কিছুই বোঝে।’
—‘জেনেশুনে ন্যাকা সাজে। সময়। সময়ের জন্য অপেক্ষা করে। বুঝলে কিছু?’
—‘তাহলে এখন উপায়?’ মেধা উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
—‘ওকে কিছুদিন কলকাতা থেকে সরিয়ে দাও।’
—‘রণজয়, তোমরা তাহলে এই ডেনগুলোকে, এই ড্রাগের ব্যবসাদারদের উচ্ছেদ করবে না?’
—‘লেটস সী’—নিচু গলায় বললেন রণজয়। তারপর হঠাৎই একটু চড়া সুরে বললেন ‘যাক এই উপলক্ষ্যে যে আবার এতদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল এটাই আমার ভাগ্য। তোমার ছাত্রটিকে কোনও নার্সিংহোমে রাখার ব্যবস্থা করো দরকার হলে। আর মেধা, কোনও অসুবিধেয় পড়লে অবশ্যই আমার কাছে আসবে। তোমাকে আমার প্রাইভেট নম্বর দিয়ে রাখছি, আমি যখন যেখানেই থাকি, এই নম্বরটা দিয়ে আমাকে খুব তাড়াতাড়ি রীচ করতে পারবে।’
নম্বরটা নিয়ে মেধা চলে আসছিলেন। হঠাৎ কি মনে হল ফিরে গেলেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই নিচু গলায় বললেন—‘রণজয়, তুমি এইজন্যই ট্রান্সফার হয়েছ বলছ, তোমার নিজেরও তো বেশ বিপদ মনে হচ্ছে!’
—‘বলছ?’ রণজয় দশ আঙুলের মাথা দিয়ে মন্দিরের চুড়ো করতে চেষ্টা করছেন। বললেন—‘ইন দ্যাট কেস, বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’
—‘প্রার্থনাটা কার কাছে করছ?’
—‘দ্যাট ডিপেন্ডস, কনফার্মড মার্কসিস্টদের কাছে বিশ্বাসের কথা প্রার্থনার কথা বলতে হলে ভাবতে হয়। আচ্ছা মেধা তুমি এইসব ছেলেদের নেত্রী? ওই ছেলেটি দেবব্রত না দেবপ্রিয়, ওকে ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে যোগ দিতে বলো না! বুদ্ধিমান, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, হী ইজ স্পিরিটেড। ঠিক যতটা দুঃসাহস থাকা প্রয়োজন সেটুকুও ওর আছে। এরকমই দরকার, নইলে পুলিসি-ব্যবস্থা ক্রমেই ভেঙে পড়বে।
—‘কিন্তু ও তো শীগগীরই ডাক্তার হয়ে বেরোচ্ছে! তাছাড়া ওরা সরকারি কাজ করবে না। যেটুকু না করলেই নয়, সেটুকু ছাড়া সরকারি ব্যাপারের সঙ্গে ওরা সম্পর্ক রাখতে চায় না।’
—‘কেন?’
—মেধা চুপ করে রইলেন।
—‘বলবে না?’
—‘রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যেতে ওরা চায় না।’
—‘সরকারের বাইরেও তো রাজনীতি রয়েছে।’
—‘তাকেও ওরা এখনও পর্যন্ত বর্জন করে চলেছে।’
—‘ওদের পরিচালিকা তো একদা আকণ্ঠ নিমগ্ন ছিলেন রাজনীতিতে।’
কি যেন বলতে গিয়ে সামলে নিলেন মেধা। তারপর বললেন—‘লক্ষ্যে পৌঁছতে গিয়ে কেউ যদি একটা পথ ধরে এগিয়ে দেখে সামনে অতলস্পর্শ খাদ, তখন কি ভিন্ন পথ ধরবার স্বাধীনতা বা অধিকার তার নেই?’
—‘সেটাতেও যদি সামনে খাদ থাকে?’
—‘দ্বিতীয়বার সে নিশ্চয়ই খানিকটা সার্ভে করে নিয়ে এগোবে। হয়ত এ পথের খাদ তেমন চওড়া নয়।’
—‘ভালো!’ রণজয় বললেন, ‘রাজনৈতিক সচেতনতা বাদ দিয়ে চলবে? চলা সম্ভব নাকি?’
—মেধা অবাক হয়ে বললেন, ‘রাজনৈতিক সচেতনতা বাদ? কে বললে? এরা পুরোমাত্রায় সচেতন। কোথায় কি ঘটছে, কেন ঘটছে সব জানে, হিসেব রাখে, তাছাড়া আমি পরিচালক এটা তোমার ভুল ধারণা। এরা স্বাধীনভাবে নিজেদের গড়ছে। আমি একজন সাজানো উপদেষ্টা, তার বেশি কিছু নয়।’
—‘হ্যাঁ, তুমি সাজানো, আর ওরা আপনি গড়ে উঠছে! এসব মিথ্ আমায় বিশ্বাস করতে বলো না মেধা। ওই মেয়েটি, কি যেন নাম বললে? লক্ষ্মীশ্রী? শী ইজ এ ভেরি আনইউসুয়াল টাইপ। ওকে দেখে আমার ছাত্রজীবনের মেধা ভাটনগরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।’
মেধা মনে মনে অবাক হলেন। মুখে কিছু প্রকাশ করলেন না। যাবার সময়ে শুধু বললেন—‘এইসব ছেলেমেয়েদের আত্মশক্তিতে বিশ্বাস করতে না পারলে ঠকবে, রণজয়। এরা সত্যিই স্বয়ম্ভর।’
বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে লাগলেন মেধা। ডালহৌসি গিয়ে মিনিবাস ধরবেন। তাঁকে প্রথমেই যেতে হবে বিশ্বজিৎ মজুমদারের বাড়ি রিচি রোড। সেখানে ওরা নিশ্চয়ই তাঁকে আশা করছে। রণজয় বলল লক্ষ্মীশ্রী তাঁর মতো, রঘুনন্দন বলেছিলেন মৈথিলী তাঁর মতো। মৈথিলী আর লক্ষ্মীশ্রী কতো আলাদা! যদিও দুজনের খুব বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব তো অনেক সময়েই বিপরীত মেরুর সঙ্গে হয়। হঠাৎ তাঁর মনে হল তিনি কি তা হলে বিশ্বময় ছড়িয়ে যাচ্ছেন? লক্ষ্মীশ্রী তাঁর মতো, মৈথিল তাঁর মতো, এর পরে কারো মনে হবে গুঞ্জন তাঁর মতো, ছাত্রসংঘের আরও সব কর্মী মেয়েরা—উজ্জ্বল, বুদ্ধিময় মুখচোখ, প্রত্যয়ে সংকল্পে স্থির, তারা সবাই কি মেধা ভাটনগরের আদলে গড়া? ভাবতে কি অসম্ভব ভালো লাগল। তাঁর শরীরটা যেন বিশাল হতে হতে ক্রমশই ঢেকে ফেলেছে কলকাতার রাজপথ, জনপথ। তারপর হঠাৎ সেই মহাকায় শরীর ভস্মে পরিণত হল, ভস্ম উড়ে যাচ্ছে এখানে, ওখানে, সেখানে। উঠে দাঁড়াচ্ছে শত শত মেধা ভাটনগর। এক রূপে নয়, শতরূপে। দেবপ্রিয় রূপে। উজান আফতাব রূপে, পূর্ণিমা, হাসিনা, সঙ্ঘমিত্রা, মীনাক্ষী, সন্দীপ, মৌমিতা, অজপা, শান্তনু, প্রমিত, শর্মিষ্ঠা, অনমিত্র, সঞ্জয়..অনেক..অনেক। সারা পথটা রোমাঞ্চিত হয়ে হাঁটতে লাগলেন মেধা। তিনি বিবাহিত, কিন্তু কুমারী। সন্তানধারণ করা কি জিনিস জানবার সুযোগ হয়নি। কিন্তু কাল রাত থেকে তিনি যেন গর্ভভারে পীড়িত। কেউ কি তাঁকে শত পুত্রের জননী হও বলে আশীর্বাদ করেছিল? স্বামী অন্ধ বলে তিনি তো নিজের চোখ কখনও আবৃত করেননি! তাহলে তাঁর শত পুত্র-পুত্রী নিশ্চয় কুলক্ষয়ী হবে না। তাছাড়াও তাঁর এ গর্ভ তত আবিষ্ট গর্ভ, ইম্যাকুলেট কনসেপশন। ইতিহাস বলছে কুমারী জননীর সন্তানরা সব সময়ে সন্ত হয়।