উত্তরসাধক (Uttarsadhak) : 15
প্রমিত একটা সিগারেটের দোকান দেখিয়ে বলেছিল ‘দেব এইখানে অলওয়েজ পাবি। একটা কোড আছে।’ বলে সে কোডটা দেবপ্রিয়কে নিচু গলায় বলেছিল। তারপর থেকে দোকানটা থেকে রোজ এক প্যাকেট দুপ্যাকেট স্পেশ্যাল এবং দামী সিগারেট কিনতে হয় দেবপ্রিয়কে। এই নতুন খরচের জন্য তাকে দু-একটা টুইশান ধরতে হয়েছে। এখানেই সাকসেনা এবং প্রবীর রায় নামে দুজন যুবকের সঙ্গে তার আলাপ হয়, যারা তাকে আরও অনেক মজাদার নেশার সন্ধান দেয়। এখন দেবপ্রিয় বেশ কয়েকটা ঠেকে যাচ্ছে। মধ্য কলকাতায় একটা, হাওড়ার শালকেতে একটা আর দক্ষিণ কলকাতার উপান্তে একটা। এতে করে তার এতো সময় যাচ্ছে যে সে পড়াশোনার জন্য বিশেষ সময় দিতে পারছে না। মেডিসিনে গোল্ড মেডেলটা মৈথিলীই পাবে মনে হয়। সার্জারিতে এখনও দেবপ্রিয় সর্বাগ্রে আছে। কিন্তু ছাত্রসংঘের কাজকর্ম সে একেবারেই করছে না। ছাত্রসঙ্ঘ এখন একসঙ্গে তিনটে ফ্রন্টে কাজ করছে গ্রাম, মফঃস্বল ও শহরের মধ্যস্থিত বস্তি অঞ্চল। বহু ছেলে মেয়ে পালা করে করে এই প্রজেক্টে অংশ নিচ্ছে। মৈথিলী উজান সবারই ফাইন্যাল ইয়ার, তারা হিসেব রাখা প্রজেক্ট তৈরি করা, রিপোর্ট দেখা এগুলোই প্রধানত করে। নতুনদের মধ্যে অনেকেই কেন্দ্রীয় সমিতির মীটিং-এ এসে কাজকর্ম শিখছে, নিজেদের মতামত দিচ্ছে, মেধাদির সঙ্গে আলোচনা করছে।
সেদিন কাজ কর্মের শেষে বেশির ভাগই চলে গেছে। আছে খালি উজান আর মৈথিলী। উজান বলল ‘মৈথিল মেধাদিকে একটু ডাক। আমার দরকারি কথা আছে।’ মৈথিল বলল ‘চল না আমরাই ওপরে যাই।’
ওপরে উঠে ওরা দেখল দালান অন্ধকার। দিদির ঘরে একটা মৃদু আলো জ্বলছে। মেধা তাঁর চেয়ারে সামান্য হেলান দিয়ে ভায়োলিন শুনছিলেন। চোখ বোজা। মৈথিলী দেখল দিদি একটা চাঁপা রঙের কালো পাড় টাঙ্গাইল শাড়ি পরেছেন। ঘরে মৃদু আলো। দিদিকে ভাস্বর দেখাচ্ছে। তাঁর মুখটা প্রশান্ত। প্রায় সদ্যমৃত মানুষের মতো। যেন পার্থিব কোন ব্যাপার আর তাঁকে স্পর্শ করছে না। মুখের রেখাগুলি যেন চিরতরে মিলিয়ে গেছে। ভায়োলিনে কোনও ভারতীয় সুর। সুরটা মৈথিলী জানে না। কিন্তু তার মধ্যে কান্না ভাবটা একেবারে নেই। মেধাদির ফার্ণ প্লেসের বাড়ির আধো-অন্ধকার দোতলার ঘরটা যেন শূন্যে ভাসমান একটা স্পুটনিক। আপাতত তিনি এ জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন। দুজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বাজনা শুনল। মৈথিলী উজানের পিঠে টোকা দিল, ইশারায় বলল বাইরে আসতে। বাইরের দালানে মৃদু আলো জ্বলছে। একদিকে গ্যাস উনুনের ওপর ছোট্ট একটা প্রেশারকুকার। ওর ভেতরে মেধাদির রাতের খাবার রান্না করা রয়েছে। হয়ত আজকে ভাত খাবেন, তাই সবকিছু প্রেশারে চাপিয়ে সেদ্ধ করে নিয়েছেন।
দুজনে পা টিপে টিপে নিচে নেমে এলো। মৈথিল নিচু গলায় বলল ‘উজান দিদিকে ডাকতে আমার মায়া হল।’
উজান বলল ‘ভায়োলিনটা অসাধারণ বাজছিল।’
মৈথিলী বলল ‘দিদিকে এতো নরম, স্নিগ্ধ দেখাতে আমি ইদানীং দেখিনি।
উজান দেখেছিলি যেন আপাদমস্তক কিরকম মোম দিয়ে গড়া। কবিত্ব করে বলতে ইচ্ছে করছে ভালোবাসার মোম।’
উজান বলল—‘য়ু আর রাইট। কিন্তু এই ভালোবাসা অন্যরকম। ঠিক আমাদের চেনা অনুভূতি বা আবেগগুলোর মতো নয়। ডিফরেন্ট ইন কাইন্ড।’
‘তা যদি বলিস’ মৈথিলী বলল ‘আবেগ জিনিসটাই যেন দিদির মধ্যে অনুপস্থিত। না তা-ও না। ইমোশনকে যদি ঘনীভূত সলিড স্টেটে রাখা যায় তো এই ধরনের একটা এফেক্ট আসতে পারে।
উজান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল—‘মৈথিল তুই মেধা ভাটনগরের অতীত ইতিহাস জানিস।’
‘সামান্যই। বাবার কাছ থেকে শুনেছি ওঁর বাবা ডাঃ অশোক ভাটনগর ছিলেন রেডিও ফিজিক্সের একজন কর্ণধার লোক। ওঁর মা ডাঃ লীলা ভাটনগর বায়ো-কেমিস্ট্রির গবেষক। দুজনেই পড়াশোনা আর ছাত্র-ছাত্রী ছাড়া আর কিছু জানতেন না। আমার বাবা ছিলেন ডাঃ ভাটনগরের ছাত্র। তবে বাবা সাইড-ট্র্যাক করে সরকারি আমলা হয়ে গেলেন। বাবার সঙ্গে একবার মেধাদির বিয়ের কথা হয়। আমার মায়ের সঙ্গে বাবার পরিচয়ের আগে। বাবা খুব কীন ছিলেন। দিদিই রাজি হননি।’
উজান বলল—‘এ পরিচয়টা তেমন কিছু নয়। আমি আমার দাদু আর বাবার কাছ থেকে শুনেছি মেধা ভাটনগর চূড়ান্ত বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ষাট সত্তরের দশকে। দাদু অবশ্য কথাটা বলেছেন নিন্দাচ্ছলে ‘ওরে বলে ধিঙ্গি।’ এই আমার দাদুর ভাষা। বাবার কিন্তু ওঁর ওপর ভীষণ শ্রদ্ধা বাবা নিজেও তো কিছুদিন এসব করেছেন। দাদুর প্রচণ্ড ধমক-ধামকে আবার ভালোমানুষ গৃহস্থ হতে বাধ্য হয়েছেন। আমার পিসিও এই রাজনীতি করত। হঠাৎ দাদুর বেছে দেওয়া বাংলাদেশি বড় ঘরের ছেলেকে বিয়ে করল, করে কয়েক মাসের মধ্যে আমেরিকা চলে গেল। যে আমেরিকার বিপরীত মেরুতে মার্কসিস্টদের অবস্থান। অথচ রোকেয়াপিসিই নাকি মেধাদিকে রাজনীতিতে নামিয়েছিল, ভাটনগর পরিবারের কেউ কস্মিনকালেও পলিটিক্স করেনি। সেইসময়ে মেধাদি নাকি একদিন উদ্ভ্রান্তের মতো আমার বাবার কাছে ছুটে আসেন বলেন—অঞ্জুদা দেখুন রোকেয়া কি লিখেছে, আমার তিনপাতার চিঠির উত্তরে একটা মাত্র লাইন—মেধা ড্রাইভিং শিখছি, এম এস করছি। আমার বিশেষ সময় নেই।’
‘বাবা বলে আমার মনের মধ্যে একটা খেদ রয়ে গেছে ভয়ে, সম্পদ থেকে বঞ্চিত হবার ভয়ে আমি আন্দোলন থেকে সরে এসেছি। কোট প্যান্ট পরা ভদ্দর লোক হয়ে জীবন কাটাচ্ছি। আরো একটা খেদ মেধার জীবনটা বোধহয় নষ্ট হয়ে গেল। আমি রোকেয়াকে বুঝি না, বোঝবার চেষ্টাও করি না আর, কিন্তু মেধাকে আমি একটু একটু বুঝি। তুই কি জানিস মৈথিল মেধাদি এখনও জানেন না, আমি রোকেয়া আমেদের ভাইপো। জানলে বোধহয় ছাত্রসঙ্ঘের কাজে কোনদিন আমাকে ডাকবেন না আর’
মৈথিলী এই সময়ে একটু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। তারা দুজনেই দোতলা থেকে নেমে সিঁড়ির দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। মৈথিলী একটু পাশ ফিরতে দেখল মেধাদি সিঁড়িটার প্রায় সবটা নেমে এসেছেন। চোখ এখনও তেমনি আবিষ্ট। খালি পা। উজান দেখতে পায়নি।
মেধাদি বললেন—‘তোরা বাড়ি যাবি না? হিন্দি খবর শুরু হয়ে গেল যে।’
উজান একটু চমকে দিদির দিকে ফিরে দাঁড়াল। মেধা স্নিগ্ধ স্বরে বললেন ‘কে তোকে বলেছে যে আমি জানি না তুই অঞ্জুদার ছেলে রোকেয়া আমেদের ভাইপো। না জানা কি সম্ভব? তোর দাদু দীর্ঘদিন এম পি রয়েছেন এ আমার জানা থাকবে না?’
উজান কথা বলতে পারছে না। ছটফটে উজান। স্মার্ট উজান। কথার পিঠে কথা যার কখনও আটকায় না সে দেবপ্রিয় চৌধুরীর মতো চুপ করে গেছে। সে যেন তার পিসির, তার বাবার সমস্ত অপরাধ মাথায় নিয়ে ঝুঁকে পড়েছে। প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়, নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন করে দিতে হলেও তার আপত্তি নেই।
মেধা আরও একটু এগিয়ে এলেন। তাঁর সমস্ত শরীর থেকে কি যেন একটা হালকা সুবাস উজানকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে আস্তে আস্তে। সে যেন একটা সুগন্ধময় আলোক বলয়ের মধ্যে অবস্থান করছে। মেধা ভাটনগর অতীত যুগের বর্তমান যুগের অনাগত দিনের এক চৌম্বক শক্তিধারী ব্যক্তিত্ব, যাঁর সম্পর্কে তার বাবা বলে থাকেন টোট্যাল ডিভোশন টু হার কজ, যিনি খানিকটা কাছাকাছি থাকেন বলেই সবসময়ে বোঝা যায় না, তিনি সত্যিই কী অসাধারণ এবং খুব কাছে এলে অনুভব করা যায় তাঁর শক্তি আর ভালোবাসা দিয়ে গড়া চৌম্বকক্ষেত্রের তীব্র আকর্ষণ এবং সে উজান যে তার এই অল্প বয়সেই খেলাধুলো, ধর্ম, রাজনীতি, পড়াশোনা ইত্যাদি বিভিন্ন বৃত্তে ঘুরে ঘুরে বুঝেছে এইসব সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে তার কোনদিন কিছুতেই পোষাবে না। তার অন্তরাত্মা চায় নিজেকে দুধারে ছড়িয়ে দিতে নিজেকে ছাড়িয়ে অনেক ওপরে উঠে যেতে। উজান এখন আর কাউকে, আর কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না। চোখ ধাঁধাচ্ছে না এই দীপ্তি, শুধু আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে মৃদু উত্তেজনায়, এই উত্তেজনা মাদক কিনা সে বিচার করতে পারছে না, খালি বুঝতে পারছে এই সেই ঈপ্সিত মণ্ডল। এই অনুপ্রাণনাময় জ্যোর্তিময় কালিমাহীন শক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে সে পৌঁছতে চায়।
মেধা মৃদু গলায় বললেন—‘উজান তুই কি জানিস আমাদের জেনারেশনের ভাঙা-গড়ার সেই অসহ যন্ত্রণার গোপন কথা! জানিস কি কীভাবে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ বিসর্জন দিয়ে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? পারেনি, শেষ পর্যন্ত পারেনি। কেউই বোধহয় পারে না। দে ওয়্যার সো মেনি এঞ্জেলস উইথ ফীট অফ ক্লে। সোনার মাথা, মাটির পা। তোরা ভাবিস তোদেরই যত সমস্যা। তোদের পরীক্ষার অ্যাসেসমেন্ট ঠিক হচ্ছে না, তোদের অধ্যাপকরা ঠিকমতো পড়াচ্ছেন না। তোদের চাকরি নেই, দাঁড়াবার মাটি নেই। নেই সত্যি। কিন্তু ওদেরও বড় দুরূহ সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তোরা তার কিছুই জানিস না। মৈথিলী তোরা উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়ে। তোরা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছিস ক্রমশ। লাখ লাখ টাকা দিয়ে একেকজনের কেরিয়ার গড়া হচ্ছে, তারপরে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে। বলছে এদেশটা উচ্ছন্নে গেছে, আর থাকা যায় না। তোরা ব্যতিক্রম। সত্যি কথা বলতে কি, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এতো সাফার করেছে, এতো আত্মত্যাগ করেছে এবং এত পিষ্ট হয়েছে যে বর্তমানে তার আর শিরদাঁড়া নেই। উজান-মৈথিলী তোরা যারা অনেক পেয়েছিস, তারা ওদের জন্য কিছু কর। ওদের ভরসা দে যে ডলারের প্রলোভনে আর লোড-শেডিংহীন জীবনযাপনের হাতছানিতে তোরা ওদের এই পাঁকের মধ্যে ফেলে যাবি না। আমাদের সময়ে উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্তের পোশাক আষাকে এতো ফারাক ছিল না। আমরা এতোটা স্টেটাস কনশাসও ছিলাম না। কলেজে কলেজে, স্কুলে স্কুলেও এমনি উচ্চবর্গীয় নিম্নবর্গীয় তফাত স্পষ্ট ছিল না। আমাদের সময়েরও অনেক দোষ ছিল, কিন্তু অল্প বয়স্কদের মধ্যে লোভ, উন্নাসিকতা, রুচির বিকার এইভাবে দেখিনি। যেসব জিনিস তোদের মূল্যবোধকে প্রতিদিন একটু একটু করে পঙ্গু করে দিচ্ছে তোরা সেগুলোকে চিনতে শেখ। ড্রাগ, মদ, বিকৃতরুচির ফিল্ম, রাজনীতি, ভারসাম্যহীন প্রতিযোগিতা, অসুস্থ উচ্চাকাঙ্খ। শুধু যন্ত্রের ওপর ভর দিয়ে একবিংশ শতাব্দীর দিকে যেতে দিসনি দেশকে। ভর করতে হবে প্রকৃতিস্থ মূল্যবোধের ওপরে।
উজানের ভেতরটা অনেকক্ষণ এই চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে থেকে কিরকম কাঁপছে। খুব কাছে উনি দাঁড়িয়ে আছেন, মৃদু আলোয় হালকা হলুদ ফুরফুরে শাড়ি-মোড়া একটা উন্নত মূর্তি। তার ইচ্ছে করছে মেধাদিকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে তাঁর বুকে ঊরুতে তাঁর পায়ে সে মাথা ঘষে-ঘষে ঘষে তার নিজের সার কি সে যেন খুঁজে পেতে পারে। তাঁর দেহ-মন মস্তিষ্ক হৃদয়ের সারাৎসার কি, তাঁর সঙ্গে এই যাত্রার শেষ কোথায়, কোন অনির্বচন পরিণতিতে সে যেন তার সন্ধিৎসু জীবনের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে বুঝে নিতে চায়।
মেধাদি বললেন—‘তোরা যা। উজান, বাইরের গেটের ছিটকিনিটা আটকে দিয়ে যাবি। দুজনে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো। কারুর মুখেই কথা নেই। ভেতরে লোহার খিল আটকানোর শব্দ হল। ফার্নপ্লেসের এই সুন্দর ছিমছাম পড়ুয়া দোতলা বাড়ির সদর দরজার ওপর অনেকখানি সানশেড। তার তলায় একটা গোল আলো থাকে। সেটা রোজ অনেকক্ষণ ধরে জ্বলে। অন্তত যতক্ষণ ছাত্রসঙ্ঘের ছেলেমেয়েরা যাতায়াত করে। আজ সেটা জ্বলছে না। উজান সহসা মৈথিলীকে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল। সে উন্মাদের মতো মৈথিলীর নতমুখের ভেতর ঠোঁট খুঁজছে।
—‘মৈথিলী বল, বল। কখনও কোনদিনও তুই আমায় ছেড়ে যাবি না। এমনিভাবে বরাবর আমার পাশে থাকবি। বল মৈথিল বল।’
মৈথিলী, যে খুব কাণ্ডজ্ঞানের কারবারী বলে খ্যাত, অতি সম্প্রতি তার মা রাধিকা সোরেনের কোনও এক অস্পষ্ট আন্দোলনের জন্য গৃহত্যাগের পটভূমিকায় যে সদ্য সদ্য মাত্রা-ছাড়া আবেগকে তার শরীরে মনে চিনতে শিখেছে, সে যে এমন সর্বাংশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে, এমনি করে তার সর্বস্ব দিয়ে সাড়া দেবে সে একমুহূর্ত আগেও বুঝতে পারেনি। উজান তার কথা বলার রন্ধ্র রাখেনি তবু সে অস্ফুট গুঞ্জনের মতো বলতে লাগল —‘কখনও না, কখনও না, নেভ্ভার।’
মেধা দরজা বন্ধ করে নিচের দালানের আলোটা নেভালেন। ছাত্রসঙ্ঘের অফিস ঘরের দরজাটা তালা দিয়ে গেছে মৈথিলী, তিনি আরও একটা তালা লাগালেন। টেনে দেখলেন দুটোই। এখানে শুধু ফাইল ক্যাবিনেট ভর্তি, টেবিল-ভর্তি কাগজপত্র নেই, প্রাথমিক সংগ্রহের টাকাকড়িও ব্যাংকে যাবার আগে পর্যন্ত থাকে। পাতলা পাতলা সিঁড়ির ধাপ। ওঠানামায় শব্দ হয় না। কষ্টও নেই। খুব সহজে উঠে যাওয়া যায়। মেধা ওপরে উঠতে উঠতে ভায়োলিনের ছড়ের শেষ টানটুকু শুনতে পেলেন। টেপটা বন্ধ করে হাত ধুয়ে ফেললেন। প্রেশারকুকারের একটা বাটিতে ভাত। আরেকটাতে চিংড়িমাছের স্টু। ছোট্ট রেফ্রিজারেটরের ভেতর থেকে কাটা শশা, টোম্যাটো বার করে নিলেন। আজকে ভীষণ চিংড়িমাছ খেতে ইচ্ছে হয়েছিল। মেধার বাবা ছিলেন নিরামিষাশী, মা প্রচণ্ড মৎস্য মাংসবিলাসী। মেধারা ভাইবোনেরা সবকিছুই খেতে শিখেছিলেন। কিন্তু মেধা লক্ষ্য করেছেন তাঁর জিভে কখনও বাবা, কখনও মা প্রবল হয়ে ওঠেন। তিনি আজ বছর পনের হল মাছ মাংস ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু আজকে যখন বাজারে চিংড়িমাছ দেখে হঠাৎ খেতে ইচ্ছে হল, তিনি নিজেকে না করলেন না। বাইরে থেকে চাপানো কোনও ত্যাগে বা ভোগে তিনি বিশ্বাস করেন না। মাংস সম্পর্কে তাঁর বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া একটা বিতৃষ্ণা আছে। কিন্তু মাছ সম্পর্কেও যখন সেটা দেখা দিল, তিনি সেটাকে মেনে নিয়েছিলেন। আজ মনে হচ্ছে তাঁর খাদ্যরুচি আবার একটু পালটেছে। ছেলেমেয়েগুলো রোজ রোজ আসে, খাটে। ওদেরও শীগগীরই একদিন চিংড়িমাছের স্টু খাওয়াতে হবে। এই বিলাসিতা হয়ত বছরে একবার কি দুবার। একশ পঞ্চাশ টাকার চিংড়িমাছ তৃতীয়বার খাবার সাধ নেই তার। সাধ্য আছে। সাধ নেই।
আজকের দিনটা অদ্ভুত একটা দিব্য প্রশান্তির। আনন্দময়, স্বর্গীয়। শিশিরকণা ধরচৌধুরীর এই হংসধ্বনির টেপ এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানের। মধুচ্ছন্দার কাছ থেকে পেয়েছেন। পশ্চিমের ধ্রুপদী সঙ্গীতের বিখ্যাত কম্পাোজারদের সৃষ্টি স্বরলিপিতে ধরা থাকে। দেখে দেখে ওস্তাদ বাজিয়েরা বাজিয়ে যেতে পারবেন চিরদিন। কিন্তু এই প্রাচ্য শিল্পীরা প্রত্যেকেই সৃজন করছেন, প্রতিবারই। ঠিক এই হংসধ্বনি হয়ত ইনিও আর দ্বিতীয়বার বাজাবেন না। মহাকালের সময়সূত্রে প্রতিটি খণ্ড মুহূর্ত যেমন অনন্য এই সংগীতও তেমনি। সৃষ্টি এবং লয়। স্থিতি যদি কোথাও থাকে তবে দুচার জন শ্রোতার স্মৃতির মধ্যে আনন্দসার হয়ে থাকবে। বিশদ বৃত্তান্ত বা ডিটেল যাবে হারিয়ে, শুধু একটা অতুলনীয় উদ্বর্তনের আমেজ হয়ে থাকবে বহুকাল। চিরকাল কি?
মেধার একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে যা দিয়ে তিনি অনেক কিছু না বলা জিনিস চট করে বুঝে ফেলেন। সব সময়েই যে এ ক্ষমতাটা কাজ করে তা কিন্তু না। আজ করেছিল। বেহালা শুনতে শুনতে তাঁর মনে হল মৈথিলী আর উজান এসে দাঁড়িয়েছে। যেন হংসধ্বনির বাদী আর সম্বাদী। ওরা তাঁকে না ডেকে নিচে নেমে গেল। বেহালার ছড়ের হৃদয়মন্থন করা টানগুলো ভেদ করে নিজের অন্তরের মধ্যে কোথাও তিনি ওদের গুন গুন শুনতে পাচ্ছিলেন। বাড়ির নিচেটা একদম নির্জন, কেউ কোথাও নেই। শুধু মৈথিলী আর উজান। মেধার হঠাৎ মনে হল তিনি যেন কোনও তুঙ্গ মুহূর্তের সামনে দাঁড়িয়ে। এখুনি কিছু একটা ফেটে পড়বে। মেঘের বুকে আগুন বজ্রনির্ঘোষে এখুনি সব ফালাফালা করে দেবে। কিম্বা মেঘের অভ্যন্তরের শুদ্ধ জলের সঞ্চয় ভেঙে পড়বে প্রলয় বাদলে। তিনি ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেলেন। ওদের কোনও ক্ষতি না হয়। জীবনকে এইরকম তুঙ্গ মুহূর্তের কাছে সমর্পণ করার আনন্দ যত, বেদনা তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি। ইদ্রিস আমেদ না বলতে পারেন—‘আমার নাতিটারে ভুলাইছিস ধিঙ্গি।’ রঘুনন্দন ত্রিপাঠী না ব্যথিত বিস্ময়ে তাকান ‘মেধা আমি তোমার কাছে মেয়েটাকে রেখে নিশ্চিন্ত ছিলাম। তুমি তো কখনও সন্তান গর্ভে ধারণ করোনি তুমি কিইবা বুঝবে?’ তিনি দেখতে পাচ্ছেন উজান উদ্যত, মৈথিলী উন্মুখ। ওরা কি নীল শূন্যে সোনালি ঈগলের মতো পাখসাটে পাখসাটে ভালোবাসাবাসি করবে?
রোকেয়া! আহা রোকেয়া। সে নিজেও কি জানত অমিয় নাথ সান্যালকে সে কী তীব্রভাবে চেয়েছিল। বিপ্লবের সঙ্গিনী, সহধর্মিণী হতে তিনি তাকে ডেকেছিলেন। সেই নীরক্ত, অ-ব্যক্তিগত, পরার্থে উৎসর্গিত ডাক রাকেয়া ফিরিয়ে দিয়েছিল বিপুল অভিমানে। জীবনকে নিয়ে সে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিল। অনেক কিছু দেবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে যখন তৃপ্ত হয়, একমাত্র তখনই বোধহয় মানুষের বহুর জন্য প্রাণভরে জীবন উৎসর্গ করার ক্ষমতা আসে। শুধু আদর্শবাদের সাধ্য নেই রক্তমাংসে গড়া, ঈশ্বরের মতো নিয়ত-সৃজনশীল মানুষকে বরাবরের জন্য তৃপ্ত রাখে। কে জানে এও আবার সেই নিরর্থক সামান্যকরণ কিনা, যার থেকে পৃথিবীর একটার পর একটা অনমনীয় তত্ত্ব তৈরি হয়েছে। রোকেয়া বলেনি, কিন্তু ক্যালিফর্নিয়া সিটিতে তাকে দেখবার পর মেধা একেবারে পুরোপুরি নিশ্চিত যে রোকেয়া অভিমানে কঠিন, কঠোর, নিঠুর হয়ে গেছে। মেধার দিক থেকে সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, দেশ এবং দেশের জন্য সমস্ত ভাবনা-চিন্তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, শুদ্ধু অমিয়নাথ তাকে ঠিক সময়ে ঠিক সুরে ডাকলেন না বলে।
রোকেয়ার শহরতলির বাড়ির সামনে মস্ত ফুলের বাগান। লম্বা রাস্তা, দুপাশে ফুল, তার ওদিকে সবুজ লন। আমেরিকার সবুজ দেখে অনেক সময় সন্দেহ হয়, এতো সবুজ, এত সতেজ, এসব কৃত্রিম নয় তো!
রবিবারের সকাল। মেধা তার নতুন টয়োটা নিয়ে ঢুকছে। সে তার নিজের সমস্ত অভিমান জয় করেছে। খবর নিয়েছে রোকেয়া বাড়ি থাকবে। যদিও তাকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দেয়নি সে আসছে। লম্বা নীল স্কার্ট পরা একটি মহিলা লনের ওপর পাতা হালকা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে। একটা কোল-কুকুর লুটোপুটি খেতে খেতে ছুটে আসছে। রোকেয়া অনেক মোটা হয়ে গেছে, কিন্তু স্বাস্থ্যবতী, উজ্জ্বল। চকচকে শ্যাম রং ছিল ওর। তাতে এখন রক্তাভা। রক্তমুখী নীলা। চুল ছোট, সযত্নে সেট করা, কত অন্যরকম দেখাচ্ছে ওকে। মেধা নামছে। রোকেয়া এগিয়ে আসছে—‘হাই।’ সারা জীবনে বাবা মা ভাই বোন ছাড়া একমাত্র রোকেয়ার সঙ্গেই তার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। দুজনে পাশাপাশি জড়াজড়ি করে শুয়ে গল্প করা এ-ওর বুকে, মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ার সম্পর্ক। লুকু আর মুন্নির মতো।
মেধা তখন সবে ওদেশে গেছে। অত সহজে অনুনাসিক স্বরে ‘হা-ই’ বলতে পারল না।
—‘মেধা।’ এগিয়ে এসে হাত দুটো ধরেছে রোকেয়া ‘তুমি কবে এলে।’
—‘এসেছি বছর খানেক হয়ে গেল।’
রোকেয়ার স্বরে অভ্যর্থনা নেই। মুখের বিস্মিত হাসিটুকুও মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। রোকেয়ার থেকে তার স্বামী রজ্জাক অনেক উৎসাহী, উচ্ছ্বসিত।
—‘ওহো। মেধা ভাটনগর! সেই কলকাতার মেধা! বৈঠকখানা রোডের ঠিকানায় কাঠ-দুপুরে সাদী মনে আছে মেধা? আপনার কনুই দিয়ে বিরিয়ানির ঘি নামছিল, গোস্তের সাইজ দেখে ভিরমি যাচ্ছিলেন। ইদ্রিসসায়েব সেই হুজ্জোতির সাদীতে বিরিয়ানি আর ফিরনি বাদে কিসসু করেন নাই। হা, হা, হা, খুব সংকট যায় সেদিন আপনার, খু-উ-ব। উঃ কত্তকাল পর। রোকেয়া ছিল না এমন একটা জীবন ছিল ভুলেই মেরে দিচ্ছি।’
রাতে ঘরে গুড-নাইট জানাতে এলো রোকেয়া। তার ফুলের মতো ছেলে মেয়ে দুটি আগেই গুডনাইট জানিয়ে গেছে।
রোকেয়া বলল—‘হ্যাভ আ গুড স্লীপ মেধা।’ তারপর একটু থেমে বলল—‘হাউ ডু য়ু ফাইন্ড হিম?’
—‘কাকে? রজ্জাককে? চমৎকার।’
—‘আ হানড্রেড টাইমস বেটার।’ রোকেয়া কঠিন মুখে বলল।
কার সঙ্গে তুলনাটা করছে মেধা বুঝতে পারছিস না। এক ঝলকেই বুঝতে পারল কার সঙ্গে তুলনা, কেন তুলনা। বুঝতে পারল সঙ্গে সঙ্গে রোকেয়াকেও। এতদিন পর।
কিন্তু রোকেয়াই কি অমিয় সান্যালকে ঠিকঠাক বুঝেছিল? মেধার সঙ্গে তাঁর যে বিয়েটা হয়েছিল সেটা তো নেহাতই কাগজের বিয়ে। আস্তে আস্তে তাই সেটা বাজে কাগজের ঝুড়িতে চলে গেল। রোকেয়া বোধহয় ঠিক বোঝেনি। নৈর্ব্যক্তিক সমস্যাগুলো ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের সঙ্গে যখন এমন পাকে পাকে জড়িয়ে যায় তখন কী জটিল হয়ে দাঁড়ায় জীবন। কী ভয়ঙ্কর দুর্বিপাক তখন। সান্যালদা যে চট করে আন্ডারগ্রাউন্ডে গেলেন, গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন, সে কি খানিকটা ইচ্ছে করেই? মেধা যেন এতদিন পর সান্যালদার সেই ধারাল, তেজস্বী নৈর্ব্যক্তিক মুখখানার ভেতর তাঁর আসল মুখটা দেখতে পেল। মুখটা ভেঙে চুরে যাচ্ছে, মেধার স্মৃতিহর্ম্যের মণিকুট্টিমে ভাঙা আয়নার মুখের মতো টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
মেধার সব স্বপ্ন জাগা স্বপ্ন। ঘুমিয়ে তিনি সাধারণত স্বপ্ন দেখেন না। আজ কেন কে জানে ঘুমোতে যাবার আগে বারবার মনে হতে লাগল দেবপ্রিয় অনেক দিন আসেনি। আসে না কেন? তিনি সবসময়েই নিজেকে খানিকটা নির্লিপ্ত নিরাসক্ত রাখতে চান। ছাত্রসংঘের পরিকল্পনা তাঁর নয়। মৈথিলীর। কিন্তু সেটাকে আরও ব্যাপক আরও অর্থময় এবং সফল করতে যা যা করা দরকার সবই তিনি করেছেন। এখন বৃহত্তর কলকাতার হেন কলেজ বা ইউনিভার্সিটি নেই যেখানে ছাত্রসঙ্ঘের সাধারণ সদস্য নেই। গঞ্জ ও গ্রামাঞ্চলের কলেজ থেকেও সদস্য নেওয়া শুরু হয়েছে। এ বছর সংখ্যাটা লাখ ছাড়িয়ে গেছে। সবচেয়ে আনন্দের কথা এরা সব ঘুমন্ত সদস্য নয়। মৈথিলী আজকাল তিন চারটে শাখায় ভাগ করে দিয়েছে সঙ্ঘকে। প্রত্যেকটি শাখার আলাদা কর্মনির্বাহক সমিতি যদিও কেন্দ্রীয় কমিটি এখনও পর্যন্ত খুবই সক্রিয় আছে। যাই হোক এক ফলে ছাত্রসঙঘ কাজ করছে খুব দ্রুত লয়ে। কিন্তু দেবপ্রিয় নীরবে এই ছাত্রসঙঘ থেকে সরে যাচ্ছে, এটা তাঁর ভালো লাগে না। অন্য কেউ ছেড়ে দিলে তিনি ততটা গুরুত্ব দিতেন না। কিন্তু দেবপ্রিয় ছেড়ে দিলে যেন ছাত্রসঙ্ঘকেই প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হয়। যে জিনিস সব প্রতিষ্ঠানকে ভাঙে সেই অন্তর্দ্বন্দ্ব নেই তো এর ভেতরে? সেরকম কিছু হলে মৈথিলী অন্তত তাঁকে জানাত। এই ধরনের চিন্তা করতে করতে মেধা শুয়েছিলেন। একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন : তিনি যেন গর্ভবতী হয়েছেন। বিশাল গর্ভ, নড়তে চড়তে পারছেন না। তারপর হঠাৎ কি করে সেই গর্ভ হালকা হয়ে গেল, দৌড়োদৌড়ি করে বেড়াচ্ছে একটি দশ বারো বছরের বালক। স্বপ্নে যার মুখ স্পষ্ট নয়। কারা যেন বলছে ‘বাপরে! এত বড় ছেলে হয়েছে? অস্ট্রেলিয়ায় দেখেছি চার পাঁচ বছরের পর্যন্ত হয়। কিন্তু একেবারে দশ-এগার?’ স্বপ্নের মধ্যে মেধার চেতনা আছে। ছেলেটা দেবপ্রিয়। যদিও আসল দেবপ্রিয়র সঙ্গে তার বিন্দুমাত্র মিল নেই। তিনি যেন ছেলেটিকে ডাকছেন, সে খালি পালিয়ে যাচ্ছে, তাঁর বুক টনটন করছে, দুধ ঝরে পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে শরীর। এইরকম অবস্থায় তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। কখন বিদ্যুৎ চলে গেছে। ঘামে ভিজে গেছে সব। দুর্দান্ত গুমোট গেছে রাত্তিরে। বুকে এখনও ব্যথা করছে। হাতের মুঠিটা বুকের মধ্যে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়েছিলেন। আস্তে আস্তে হাতটাকে মুক্ত করলেন মেধা।
এখন আলো ফোটেনি। তবে এইবারে ফুটবে। দু একটা পাখির ডাক হঠাৎ হঠাৎ অন্ধকারে শোনা যাচ্ছে, সেইসব বিরল চক্ষুষ্মান পাখি যারা অন্ধকারেও আলো দেখতে পায়। মহাজ্যোতিষ্ক সূর্য থেকে যখন পৃথিবীর সৃষ্টি তখন আলো ছিল না এমন দিন নিশ্চয়ই ছিল না। বাইবেল যতই বলুক ‘ডার্কনেস ওয়াজ আপন দা ফেস অফ দা ডীপ’। অন্ধকার আসে একটা নিয়মিত ছন্দে। প্রকৃতির জীবনে যেমনি মানুষের জীবনেও তেমনি। মানুষের জীবনে এই ছন্দটা অন্যরকম, এখনও কেউ বার করতে পারেনি এর সূক্ষ্ম হিসেব নিকেশ। জ্যোতিষশাস্ত্র খানিকটা চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। প্রকৃতি সচল হলেও নিয়মে বাঁধা। মানুষ এবং তার ঘাত-প্রতিঘাতে উৎপন্ন জীবন এতো জটিল যে সেই জীবনে আলো-অন্ধকারের যাওয়া আসার ছন্দ আবিষ্কার করা অতি দুঃসাধ্য কাজ।
ভোরের আলো-আঁধারির মধ্যে দিয়ে আকাশি-নীল রাতপোশাক পরে মেধা ছাতে উঠে গেলেন। হঠাৎ সূর্য-ওঠা দেখতে ইচ্ছে হল তাঁর একেবারে প্রথম আদি লগ্ন থেকে। কিছু বহুতল বাড়ির দৈর্ঘ্য দৃষ্টির গতি থামিয়ে দিচ্ছে, পূর্ব দিগন্তকে সোজাসুজি দেখা যায় না আর। কিন্তু সেই বহুতলের আশপাশ থেকে তিনি বিকীর্ণ হয়ে পড়তে দেখলেন সূর্যকে। স্বয়ং সূর্য হৰ্ম্য শিখরের আড়ালে। কিন্তু তার আলোর ছটা পূর্ব আকাশটাকে বিদীর্ণ করে দীপ্যমান। কাঞ্চনজঙ্ঘার পেছন থেকে যখন সূর্য ওঠে তখনও খানিকটা এইরকমই দেখায়। বরফে সেখানে রঙের খেলাটা জমে। এখানে বরফ নেই, শুধু ইঁট কাঠের প্রতিফলন ক্ষমতা নেই, তাই সূর্যকে তার ঐশ্বর্য সংবরণ করে নিতে হয়েছে।
ছাতে কয়েকটা গাছ। ছাতের ট্যাংকের কল থেকে জল ভরে সেগুলোকে স্নান করালেন মেধা। কাজটা করতে করতেই তাঁর শরীর মন টান টান হয়ে উঠল। কোথাও যেন ফোন বাজছে। কার বাড়িতে? এতো ভোরে? তাঁর বাড়িতে? হ্যাঁ, তাঁর বাড়িতেই। মেধা তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলেন। ফোনটা একবার স্তব্ধ হয়ে গেল, আবার ঝনঝন করে বেজে উঠল একটু পরেই।
—‘মেধা ভাটনগর বলছি।’
—‘দিদি, আমি উজান। দেবপ্রিয়কে পুলিস অ্যারেস্ট করেছে।’
—‘সেকি? কেন? করে?’
—‘আমি আসছি। পাঁচ মিনিট।’
ফোনটা নামিয়ে রেখে মেধা শাড়ি পরে নিলেন। একেবারে প্রস্তুত। যে কোনও সময়ে যে কোনও জায়গায় আবার ডাক আসলে তিনি শতকরা শতভাগ প্রস্তুত। চুল আঁচড়ে নতুন করে বিনুনি বাঁধলেন। সদর দরজাটা খুলে নেমে গেলেন তাঁর ছোট্ট রুমালের মতো লনে। ছোট ছোট ফুলগাছগুলো উন্মুখ, তৃষিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ওদের চাহিদা সামান্যই। আহা! তিনি জীবনের জটিল পদক্ষেপে বিচলিত বলে ওরা সেই সামান্যটুকু থেকে বঞ্চিত হবে কেন? মেধা জলের ঝারিটা নিয়ে এলেন।
উজান সাইকেল নিয়ে ঢুকছে। যোধপুর পার্ক থেকে ফার্ন প্লেস কতটুকুই বা! মেধা কিছু বলছেন না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন শুধু।