উজান যাত্রা (Ujan Jatra) : তিনি ও জেঠু
মৈত্রী যখন কাজলকে নিয়ে পৌঁছোল, কস্তুরী সেদিনের বাংলা কাগজ আর একটা পুরনো ডায়েরি হাতে করে বসেছিলেন। চুপচাপ। ওরা একবার সাবধানে চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। কাজল আবেগের সামনে অপ্রতিভ হয়ে থাকে। যদিও তার নিজের আবেগ যথেষ্ট এবং তা সে ভেতরে কোথাও লুকিয়ে রাখে। কিন্তু মৈত্রী সবকিছু সামলাতে পারে। সে এগিয়ে গিয়ে মাটিতে হাঁটু গেড়ে কস্তুরীর কোলে হাত রাখল।
দিদি যাবেন?
কোথায়?
স্নেহলতা ঘোষের বাড়ি, এঁড়েদ’! আমরা ঠিক নিয়ে যাব।
জানো মৈত্রী, একটা মাত্র বাংলা কাগজের ভেতরের পাতায় নীচের দিকে ছোট্ট করে খবরটা ছেপেছে। নো অবিচুয়ারি, নাথ্থিং । স্নেহলতা ঘোষ আরও কয়েকজনের মতো ছিলেন সুভাষপন্থী। উনি গাইতেন ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে— আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো।’ শুনেচ গানটা?
হ্যাঁ, শুনেছি দিদি।
—উনি অতি ওল্প বোয়েস থেকে সুভাষচন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবোক দোলে ছিলেন। আমার বাবার ধারণা ছিল উনি অতি গোপনে শোরৎচন্দ্র বসুর মারফত নেতাজির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ আসবে, তাদের অভ্যর্থনা জানাতে হবে বোলে উনি তোখনকার দিনে সাড়ে তিনশো মেয়ের একটি গুপ্তবাহিনী গোড়েছিলেন। কেউ জানত না। ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা ছাড়া। এমিলি শেঙ্কলের সঙ্গে বিয়ের খবরে যখন সারা বাংলা তোলপাড়, নেতাজিকে ধিক্কার দিচ্ছে, তখন উনি একা বিবৃতি দিয়েছিলেন— সুভাষচন্দ্র যদি কাউকে বিয়ে করে থাকেন, সে মহিলা নিশ্চিত তাঁর উপযুক্ত, তাঁর কর্মসঙ্গী। যদি উনি ব্রহ্মচারী থাকবেন বলে কখনও স্থির করে থাকেন সে তাঁর ইচ্চা। পোরে যদি তা ভেঙে থাকেন সেও তাঁর ইচ্চা। তার পেছনে সঙ্গত কারণ থাকবেই। আর বিবাহ বা অবিবাহ কিছুতেই তাঁর মহিমা যাবে না।
দুজনে চুপ করে আছে দেখে উনি বললেন, চিনো না, না! শোরৎচন্দ্র বসু— চিনো না।
—চিনি দিদি, সুভাষচন্দ্রের দাদা।
—মেজোদাদা। বাট হি ওয়জ আ গ্রেট স্টেটসম্যান ইন হিজ ওন রাইট। ওঁর সোম্পর্কে কিচু জানো না তো স্নেহলতা ঘোষকে কী বুঝবে? নেতাজিকে কী বুঝবে? ডু ইউ নো হাউ বেঙ্গল, অ্যান্ড হিজ ওন পার্টি রি-অ্যাক্টেড অ্যাট দা নিউজ অব হিজ ম্যারেজ!
—জানতাম না দিদি, এইমাত্র জানলাম, আপনি বললেন না তোলপাড়, ধিক্কার।
কাজল চুপ করে ওঁর উত্তেজনা দেখছিল। উনি এসেছেন ওঁর মা-ল্যান্ডে। ওঁর কথা অনুযায়ী। কিছু খুঁজছেন, অতীতের কিছু সূত্র। উনি অতীতকে জানতে চান। এই মানুষটি, প্রাক্তন বিপ্লবী স্নেহলতা ঘোষ ওঁর একটা সূত্র ছিলেন। খুব গভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ ওঁর এই খোঁজ। তার থেকেও! হ্যাঁ, বোধহয় তার থেকেও। কেননা সে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে একটা ধারাবাহিক ইতিহাসের খোঁজ করছে। সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক তা বলা যায় না। কিন্তু এই প্যাশন তার নেই। নেই। সে ফিল্ডে যায় না এভাবে। এখনও যায়নি। সে প্রভূত রেফারেন্স বই নিয়ে কম্পিউটারে কাজ করে। ইন্টারনেট লাইব্রেরি …। কিন্তু কস্তুরীবেনের তাগিদ এতটাই যে উনি সোজা ফিল্ডে চলে এসেছেন। নিজের পুরনো ডায়েরি থেকে ঠিকানা বার করছেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে উনি অনেককে খুঁজেপেতে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। ওঁর রেফারেন্স হলেন জ্যান্ত মানুষেরা। কস্তুরী মেহতা ওঁর অতীতকে এত ভালবাসেন! কী নিদারুণ ভালবাসা! ছুটবেলাই সোব বেলা। কী জানি ম্যাডাম, কত সুন্দর, সুখের ছিল সে ছোটবেলা যে আপনি একজন সফল ব্যাবসাদার, প্রখ্যাত সমাজসেবিকা এভাবে এই বয়সে ছুটে আসতে পেরেছেন!
সে? সে তার অতীতের প্রতি বিতৃষ্ণা অনুভব করে। অজেয় বিতৃষ্ণা। কিন্তু সে একজন গবেষক, এই জনজাতিদের অতীত পরিচয় এবং তার ধারাবাহিকতা তাকে বার করতেই হবে, না হলে যেন সে, কাজল মুণ্ডা মিথ্যে হয়ে যায়। ওঁর যদি প্যাশন হয়, তা হলে তারটা হল মিশন।
মহেঞ্জোদড়ো হরপ্পা থেকে সে এই জনজাতিদের খুঁজতে খুঁজতে এসেছে। হিন্দিতে বলে— হড়প্পা। হড় মানে মানুষ, আদিবাসীরা সবাই হড়। শুধু বিরহড়রা নয়। তপা মানে সমাধি, হড়প্পা তা হলে মানুষের সমাধি। কোন বিস্মৃত অতীতে, বন্যা, ভূমিকম্প, কি অন্য দুর্যোগে একটা সভ্যতা মৃতের সমাধিতে পরিণত হয়েছিল। ‘মহে’র সঙ্গে ‘য়েন’ দিলে ‘মহেন’ হয়, যার মানে প্রস্ফুটিত। ‘জ’ মানে ফল, মুণ্ডারিতে দারে বা দারু হল বৃক্ষ। এ শব্দ মুণ্ডারি থেকেই তাহলে সংস্কৃতে ঢুকেছে!
মহেঞ্জোদড়ো মানে তা হলে দাঁড়াচ্ছে— প্রস্ফুটিত ফল, বৃক্ষ। দুটি সিল দেখে তাদের পূজা-অর্চনা, সাজপোশাকের কথা এবং সাত পূজারীর কথা যা পণ্ডিতরা অনুমান করেছেন, তা সাঁওতাল সংস্কৃতির সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়।
কস্তুরী বললেন, না। গিয়ে একটি হোতাশ বিফোল বৃদ্ধ মৃত মুখ দেখে আমারও কুনও লাভ না, ওঁরও না। তুমরা ভেবো না। শান্ত হও। শান্তি করে বস। যোদি ইচ্চা হয় আমরা তিনজনে প্রে করতে পারি। উনি যেন ওঁর চাওয়ার জিনিস একদিন পান। যেন কোনওদিন সোৎ, শ্রেণীহীন, সুশাসিত ভারতবোর্ষ দেখতে পান। এ তো আমাদেরও চাহত, কী না?
হ্যাঁ দিদি, আমি প্রে করব, নিশ্চয়ই।
কাজল কোনও পরজন্মে বিশ্বাস করে না। কিন্তু সে গোঁড়া নয়, চুপ করে বসে থাকলেই তো হয়। এ জন্ম যাঁর শেষ হয়ে গেল তাঁর দেহাবশেষ পুড়ে যাবে, সামান্য কিছু অস্থি আর নাভি যাবে নদীগর্ভে। সেখানকার মাখনের মতো মাটির সঙ্গে ক্রমশ মিশতে থাকবে জলতলের অজানা রসায়নে। আর দেহের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণবায়ু মিশে যাবে বাতাসের আবহমান দীর্ঘশ্বাসে। কেননা সে তো পৃথিবীরই বাতাস। মহাকাশের নির্লিপ্ততার সঙ্গে তার কোনও যোগ নেই। পৃথিবীর মানুষের প্রাণবায়ু নিয়ে সে যেমন ঋদ্ধ হয়, তেমনই বিষণ্ণও হয়। তবে হ্যাঁ, সৎ, শ্ৰেণীবৈষম্যহীন, সমৃদ্ধ, সুশাসিত, সুশিক্ষিত এক ভারতের স্বপ্ন সে দ্যাখে। তার জন্য প্রার্থনা করাই যায়। সে দেখতে পাবে না, ভোগ করতে পারবে না, কিন্তু ভবিষ্যতের মানুষ পারবে। কোনও সুদূর অপরিচিত ভবিষ্যৎ যেখানে সবই সম্ভব হতে পারে।
মিনিট দশেক নীরব প্রার্থনার পর কস্তুরীবেন উঠে পড়লেন— রামলাখন, রামলাখন!
—হাঁ মাজি, রামলাখন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। ছুটতে পারে না— একটু নোদল-গোদল করতে করতে আসে। উনি তাকে পাঁচশো টাকা গুনে গুনে দ্যান।
—গোলপার্ক সে ফুল লাও! মালা গুলাব, রজনীগন্ধা, অউর সোব।
মৈত্রী লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল— আমি যাচ্ছি দিদি, ও পারবে না।
তাহলে সোকালে খাওয়া এনো। রাধাবল্লভি আলুদম। অমৃতি, গোজা।
মৈত্রী হাসি-হাসি মুখ করে চলে গেল।
কস্তুরী উঠে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকটি ফটো খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। বাইরে এলেন। বাঁ দিকে সিঁড়ি বরাবর সমান ব্যবধানে হুক আছে। আপন মনেই বললেন— এইখানে যতীন সেনগুপ্তো ছিলেন, এইখানে যতীন দাস, বৈকুণ্ঠ শুকুলের রেয়ার ছবি বাবা-মা রেখেছিলেন। ক্যাপ্টেন সায়গল, ধীলন, ঝাঁসি রানি, লক্সমি স্বামীনাথন। এখন মিসেস সায়গল হয়েছেন। কী স্টুডেন্ট হাঙ্গামা হল সিক্সটিজে-সেভেনটিজে, ভেতরে ঢুকে পড়ে কিছু মানুষ সব ভেঙে দিলে, ওরা ভাল নয়, তারা ভাল। বিদ্যাসাগর বাজে, রাসবিহারী বসু বাজে, শ্যামাপ্রসাদ বাজে, আশুতোষ বাজে— তারা, তারা শুধু কাজের।
—ট্র্যাম পুড়াবে না তুমরা?
কাজল হেসে ফেলল। —দিদি আমাকে কি হুলিগান-টাইপ মনে হচ্ছে?
—হুলিগান দোরকার নাই। ক্রাউডে সোব হুলিগান হোয়। য়ু হ্যাভ আ পাওয়ারফুল বডি।
—তো তাই আমি ট্র্যাম-বাস ভাঙব? কাজল ঈষৎ হেসে বলল, আমি তাহলে চললাম।
—এই এই তুমি ঠাট্টা বুঝো না! বোসো, একানে চুপ করে বোসো, যোতখন না ফুল, খাবার সোব আসে।
ঘণ্টাদেড়েক পরে মিঠু ও রামলাখন রাশি রাশি ফুল আর মালা নিয়ে এল। চারজনে মিলে সব ছবিতে মালা পরানো হল। যাঁদের মালা কুলোল না, কস্তুরী বড় বড় প্রাচীন ফুলদানি বার করে ফুল সাজিয়ে তাঁদের ফটোর তলায় রাখলেন। বিবর্ণ পেতলের ফুলদানে জ্বলতে থাকল লাল গোলাপ, হলুদ সূর্যমুখী, সাদা রজনীগন্ধা। মুহূর্তে ঘর ফুলের গন্ধে ভরে গেল। কস্তুরী বললেন, ফুলের মতুন জিনিস নাই। এসো এবার পেটপুজো কোরা চাই। … ও কী! তুমরা ওতো হাসচো কেন!
মিঠু কিছুতেই তার হাসি থামাতে পারে না।
কস্তুরী আস্তে আস্তে বললেন— হ্যাভ য়ু নোন ডেথ?
মিঠু মাথা নাড়ল। তার মুখ থেকে সব হাসি হারিয়ে গেছে।
কে?
আমার দাদু … আমার মা!
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে কাজলকে বললেন, তুমি, বীরপুরুষ?
খানিক ভেবে কাজল বলল, ফাদার মরিসন, মেদিনীপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন চার্চের। স্কুলটার উনি রেকটর ছিলেন।
—ডেথ যদি খুব বোয়েসে আসে যেমন স্নেহলতা ঘোষ, যেমন আমার বাবা, যেমন আই গেস, তুমার ফাদার মরিসন— ইয়াং ম্যান— তেমন ডেথ ইজ রিলিজ অ্যান্ড ইউনিয়ন উইথ ইনফিনিটি। কিন্তু যোখন ইয়াং পিপল ডাই! মৈত্রী! মা কী ওসুখ করেছিল?
—দিদি আমি এ প্রসঙ্গ চাই না, প্লিজ।
তাদের অপরিচিত স্নেহলতা ঘোষের মৃত্যুতে যে বিষাদ আসব আসব করেও হঠাৎ অসময়ের মেঘের মতো হারিয়ে গিয়েছিল, সে ফিরে এল হাসিখুশি, ছটফটে মিঠুর চোখেমুখে। সেখান থেকে আবহাওয়ায়। এবং কস্তুরীর গাম্ভীর্যে, কাজলের নিশ্চলতায়।
একটা কচুরি ছিঁড়েছিল মিঠু, একটু নাড়াচাড়া করে হঠাৎ বলল, দিদি, আমি আজ চলি।
—মৈত্রী, মৈত্রী প্লিজ বসো। স্যরি, আ’য়্যাম স্যরি মাই ডিয়ার।
—না না, স্যরি কেন … এমনি … মানে আমার কাজ … মিঠু মুহূর্তে লম্বা লম্বা পায়ে চৌকাঠ পেরিয়ে সিঁড়িতে নেমে গেল। কোনও শব্দ হল না। যেন সে চলে যাওয়ার কোনও চিহ্ন রাখতে চায় না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কস্তুরী খুব অভিমানী স্বরে বললেন— কাজল, তুমিও কি খাবে না?
কাজল একঝলক হেসে বলল—এই তো খাচ্ছি। সে কচুরিতে আলুর দম মুড়ে মুখে পুরল— আপনি খান!
—এই যে খাই।
নিঃশব্দে দু’জনে খাচ্ছেন। চারদিক থেকে ফুলের গন্ধ ডুবিয়ে দিয়েছে আর যা যা গন্ধ আছে, হাওয়া আছে সব।
কস্তুরী ছোট্ট গলায় বললেন, মৈত্রীর মা কতদিন চলে গেছেন? ওঁর কী হয়েচিল কাজল!
কাজল একটা অমৃতিতে কামড় বসিয়েছিল। রসটা সামলে নিয়ে বলল, আই হ্যাভ নো আইডিয়া!
—হোয়ট?
—আমি জানি না দিদি। সত্যি, কখনও জিজ্ঞেস করিনি।
—স্ট্রেঞ্জ! তুমরা খুব বন্ধু না?
—হ্যাঁ, নিশ্চয়ই!
—তোবে?
তবেটা কাজল কী করে বোঝাবে? তার নিজের কোনও পরিবার নেই। সে মনে করতে পারে না তার বাবার মুখ। তার ছ’ বছরে ছেড়ে-আসা মায়ের মুখ। ফ্যামিলি আপনজনহীন একটা সম্পূর্ণ একলা অস্তিত্ব সে। তার এসব সম্পর্কে কোনও কৌতূহল নেই। জিজ্ঞেস করার কথা মনেই হয়নি।
দেখেছে মিঠুর বাড়িতে ওর পাঞ্জাবি-পাজামা পরা গম্ভীর বাবা আরামকেদারায় শুয়ে শুয়ে ভগবদগীতা আর রাসেলের অটোবায়োগ্রাফি পড়ছেন। বাড়িতে আর কেউ নেই। মিঠু বলল—কী রে চা না কফি?
যেটা তোর সুবিধে!
কফিটাই করি তা হলে?
সুতরাং মিঠুর মা দৃশ্যমান নয়। নামাল খাটতে গিয়ে ফেরেননি? না কী? মিঠুর টেবিলে সিরিয়াস মুখ এক মহিলার ফোটো। কত বয়স হবে? চল্লিশের কোঠায় হবেন? চশমার কাচের আড়ালে ঝিলিক দিচ্ছে চোখ। ঠোঁটে হাসি নেই, কিন্তু চোখ হাসছে। প্রথম দর্শনেই যা নজর কাড়ে তা হল আলো। পরিপূর্ণ শিক্ষা মানুষের চেহারায় একটা অন্যতর আলো দেয়, সেটা কাজল যত তাড়াতাড়ি পড়তে পারে, আর কেউ পারবে কিনা সন্দেহ। মিতু চা-কফি করতে গেলে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফোটোটা দেখত। অস্পষ্ট একটা টান। নাঃ, তার চরিত্রে সেন্টিমেন্ট নেই। সে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে পৃথিবীর যাবতীয় রক্ত-সম্পর্কের দিক থেকে। তার ভয় করতে লাগল— এবার কি কস্তুরীবেন তার মা-বাবার কথা জানতে চাইবেন? তখন তো তাকেও বলতেই হবে— এ প্রসঙ্গ থাক দিদি, প্লিজ। মিঠু রূঢ়ভাবে বলেনি, কিন্তু তার গলায় নির্ঘাত রূঢ়তা এসে যাবে।
ফাদার মরিসন তাকে মাঝেমাঝেই জিজ্ঞেস করতেন— সে তার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে চায় কিনা। সে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলেছে, আমার কেউ নেই, ফাদার।
—আর ইউ শিয়োর?
—হ্যাঁ।
না, কস্তুরী কিচ্ছু জিজ্ঞেস করলেন না। হঠাৎ তাঁর মনে হল তাঁকে যদি কেউ এই ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ করে তিনি কী বলবেন? তাঁকেও হয়তো বলতে হবে— এ প্রসঙ্গ তিনি চান না। এভাবে বলবেন না, শুধু নিপুণভাবে প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দেবেন। এদের থেকে বয়স বলো, অভিজ্ঞতা বলো সবই তো তাঁর অনেক অনেক বেশি!
তিনি কাজলের অন্যমনস্ক ভাব লক্ষ করেছিলেন। গ্র্যানাইট না কষ্টিপাথরের ছেলেটি এখন তার ভাস্কর্য-অস্তিত্বে ফিরে গেছে। ও কি দেখেছে ইলোরার কৈলাস মন্দির? ও জানে না ও অন্য কোনও জায়গা নয়, ওই কৈলাস মন্দির টন্দির থেকেই বেরিয়ে এসেছে। সর্বত্র যোদ্ধা দ্বারপাল প্রভৃতির মূর্তিতে এই আদল। হঠাৎ ঈষৎ কৌতুকের সঙ্গে তাঁর মনে হল তিনি যদি যুবতী হতেন নির্ঘাত এর প্রেমে পড়তেন। সেক্ষেত্রে মেহতা আর মুণ্ডা, আমদাবাদ, আর সাঁওতাল পরগনায় কী উত্তাল অশান্তিই না হত! আচ্ছা, ওই চমৎকার বুদ্ধিমতী মেয়েটি, মৈত্রী, যে নাকি তার মায়ের মৃত্যুকে এখনও মেনে নিতে না পারার মতো সহৃদয় আছে, ওই মেয়েটির সঙ্গে কাজলের সম্পর্ক কী? শুধু কি বন্ধুত্ব? না প্রেম? আজকালকার ছেলেমেয়েদের বোঝা যায় না। তাঁর অল্প বয়সে ডাণ্ডিয়া নাচের সময়ে কত ছোটখাটো রোম্যান্স হত, এখন ছেলেমেয়েগুলো যেন ডাণ্ডিয়ার লাঠিটার মতোই শুষ্কং কাষ্ঠং হয়ে গেছে। যদি বা কিছু বোঝে তো সে আদৌ রোম্যান্স নয়, মন নয়।
কাজল বলল, আপনার লিস্টে আর কে কে আছেন, যদি জানতে পারি অঞ্চল হিসেবে একটা প্ল্যান ছকে ফেলতে পারি দিদি। আপনি অত সহজে পারবেন না। আমাকে বলেই দেখুন না। আমি জাস্ট আপনাকে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে চলে আসব। আপনার প্রাইভেসি আপনার থাকবে। ইউ নিড নট ওয়ারি অ্যাবাউট দ্যাট।
কিছু বললেন না উনি। গোজায় প্রচণ্ডভাবে মনোনিবেশ করলেন। ছেলেটার চোখ আছে।
আপনার নোটবুকটা বার করুন। আমাকে বলুন, দেখি একটা শর্ট লিস্ট করতে পারি কিনা।
কাজল অপেক্ষা করছে, দৃঢ় সংকল্প নিয়ে, মেহতা ম্যাডামকে সে হেল্প করবেই। কারণ ও স্পষ্ট বুঝতে পারছে, উনি অন্ধকারে হাতড়াচ্ছেন।
ধীরেসুস্থে খাওয়া শেষ করে পড়ার চশমাটা চোখে লাগালেন কস্তুরী, নোটবইটা বার করলেন। যেন তিনি কাজলের প্রবল ইচ্ছাশক্তি দ্বারা চালিত হচ্ছেন এই মুহূর্তে।
১। রবিপ্রসাদ বৰ্মন— ৪৫, শিকদারবাগান লেন, কলকাতা-৪।
২। রমা সরকার— ৩০/১/এ, গরচা ফার্স্ট লেন।
৩। যতীন মণ্ডল— ৫, শিমলা স্ট্রিট।
৪। স্বরূপচাঁদ রোহাদগি— ৩৩, নাগের বাজার, দমদম।
৫। সিরাজ আলি— ২৫এ, সার্কাস রো।
৬। তৃপ্তিকণা মজুমদার— বেহালা? একটা প্রশ্নচিহ্ন। নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই।
লিস্টটা পড়ে কীরকম বোকার মতো কস্তুরী চোখ তুললেন। যেন উদ্ভ্রান্ত।
দিদি, কতকগুলো নর্থ ক্যালকাটা, বেশ দূর। আপনি যদি এই সার্কাস রো আর গরচা আগে যান। অবশ্য আপনার প্রেফারেন্সটা কী বলবেন।
কাজল, আমি শিকদারবাগানে রবিজ্যাঠা মানে রবিপ্রসাদ বর্মনের বাড়ি যেতে চাই। আগে।
ঠিক আছে। আমরা তো এখনই যেতে পারি।