উজান যাত্রা (Ujan Jatra) : তিনি ও স্মৃতিসত্তা
মনটা খিঁচড়ে গেছে। বৃষ্টি সুস্বাগতম। কিন্তু এভাবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে না পারায় কস্তুরী উদ্ভ্রান্ত। ধরো যদি কালও এমনি বৃষ্টি পড়ে! ধরো পরশুও। হেসে ফেললেন— কী অধৈর্য! এত অধের্য হলে কোনও কাজ হয় না। দু’-তিনবার স্নেহলতা ঘোষের বাড়ি ফোন করেছেন, পিঁ পিঁ করে যাচ্ছে। তারপর খবরে শুনলেন বৃষ্টিতে অনেক জায়গাতেই টেলিফোন বিকল হয়ে গেছে। বাঃ! অতঃপর কী করণীয়? সময় অনন্ত নয়। নাঃ ঠিক হল না। সময় অবশ্যই অনন্ত। কিন্তু তাঁর সময় খুবই সীমিত। বাবা বেশ কয়েক বছর পলিয়েস্টার খাদি শুরু করেছিলেন, তার নানারকম বৈচিত্র্যও আসছে, রঙে টেক্সচারে। নানা রং আরম্ভ হয়েছে ইদানীং। ভীষণ পপুলার হয়েছে। সারা ভারতবর্ষে যাচ্ছে, এখন ভারতের বাইরেও প্রচুর চাহিদা। সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে তাঁর কাজ, ব্যস্ততা, কমেছে সময়। নিজের এলাকাতে ব্যাবসার দেখাশোনার বাইরে তাঁর যে কাজ তা-ও প্রচুর সময় দাবি করে। সবরমতী আশ্রমের উৎপাদন মার্কেটিং করা তাঁর কাছে একটা ব্ৰতর মতন। আছে ব্লাইন্ড স্কুল, মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য সংস্থা। দরিদ্র মেয়েদের উপার্জনের জন্য একটা বড় সংস্থাও রয়েছে, তার শাখা-প্রশাখা বিস্তারও শুরু হয়েছে। এই সবগুলোরই তিনি কর্ণধার। কলকাতায় এসে অনির্দিষ্টকাল বিনা কাজে বসে থাকার সময় বা মানসিকতা কোনওটাই তাঁর নেই। কিন্তু এই ভিজে গরম ও মুষলধার বৃষ্টির দেশে অধৈর্য হয়ে তো কোনও লাভ নেই!
ক্রমশ রাত হয়। তাঁর বরাদ্দের রুটি ভাজি দহি খাইয়ে যায় রামলাখন যত্ন করে। কস্তুরী বই পড়বার চেষ্টা করেন। বিক্ষিপ্ত মন শান্ত করার যা যা উপায় আছে সবই একটু একটু চেষ্টা করেন। কিন্তু মন শান্ত হয় না। শেষে দুরন্ত শিশুর মতো ছুটে যেতে চায় পাঁচের দশকের কলকাতায় যখন ভোরের রাস্তায় হাইড্রান্ট্রের মুখে পাইপ লাগিয়ে রাস্তা ধোয়ার শব্দে চোখ মেলছেন, আবার ঘুমিয়ে পড়ছেন, ছায়াময় রাস্তা দিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে, গান করতে করতে চলে যাচ্ছে প্রভাতফেরি, দৌড়ে এসেছেন বারান্দায়—‘হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর, হও উন্নতশির নাহি ভয়/ ভুলি ভেদাভেদ জ্ঞান হও সবে আগুয়ান সাথে আছে ভগবান, হবে জয়।
কী অমোঘ সব উচ্চারণ, কত সরল অথচ সত্য! তখন তো কথাগুলোর মানে বুঝতে পারতেন না। গানের সুরে শব্দ বিভাগও হয়ে যেত আলাদা। হও ধরো, মেতে ধীর, হও উন, নত শির, নাহি ভয়। হও এবং ধরো, কী ধরতে হবে ভেবে পেতেন না। মেতে আবার ধীর কী করে হওয়া যায়! নত শির, মানে বড়দের সামনে মাথা নিচু করে থাকতে হবে তা হলেই আর ভয়ের কারণ থাকবে না, চড়চাপড় পড়বে না। কিন্তু উন জিনিসটা কী, আর কী করেই বা তা হওয়া যায়! ভেদাভেদটাকে ছোট্ট মেয়েটি অভেদানন্দের সঙ্গে মিলিয়ে ধরত, অভেদ ও ভেদাভেদ, তবে এঁদের তো মনে রাখতেই বলা হয়। ভুলতে হবে কেন? বাকিটুকু সোজা, বুক ফুলিয়ে এগিয়ে গেলে যে দুষ্টু বন্ধুরা ঘাবড়ে যায় তা বেশ দ্যাখা আছে। একদিন একটা কী ছোট্ট প্রশ্ন করেছিল মাকে, তাইতেই মা বিদ্যের দৌড় বুঝে যান। খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দেন। ধরম বা ধর্ম মানে এইসব পুজো-অর্চনা করা নয়, নামাজ পড়াটড়া নয়, ধর্ম মানে ভারচু, অর্থাৎ কিনা মানুষের যে মৌলিক গুণ, মানবিকতা, সেই মনুষ্যত্বে ধীর থাকতে হবে, উন্নতশির। মাথা উঁচু করে চলতে হবে, মানে উদ্ধত নয়, কিন্তু আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। অস্পষ্টভাবে হলেও কেমন গভীরভাবে সে বুঝেছিল কথাগুলো, মুদ্রিত হয়ে গিয়েছিল এক দফা মূল্যবোধ। মানবধর্ম থেকে কখনও বিচ্যুত হবে না। আত্মসম্মান হারাবে না। মানুষে মানুষে ভেদজ্ঞান ভাল নয়, কে কৃষক, কে বণিক, কে ধনী, কে দরিদ্র, কে উচ্চবর্ণ কে নিম্নবর্ণ, কে মুসলমান কে শিখ, এই বিভেদ ভুলে একটি অখণ্ড সামাজিক একক হয়ে এগোতে হবে—জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, মন্ত্রসাধনে, ঐশ্বর্য আহরণে, কুসংস্কার দূর করতে, সুসংস্কার রক্ষা করতে। এত কথা আস্তে আস্তে অনুভব করেছেন। একটা টেক্সট-এর ব্যাখ্যা যেমন ক্রমেই প্রসারিত হতে থাকে, এই দুটি সরল পঙ্ক্তির অর্থও তাঁর মননে, চেতনায় তেমন হচ্ছে। ঝোঁকটা যখন ‘ধরম’ থেকে ‘ধীরে’র ওপর পড়ে, তিনি ভাবতে থাকেন। ধীর মানে কি শুধু স্টেডি? না। তোমার মানবিকতার ধর্মকে প্রয়োগ করার সময়ে তুমি শান্ত, ধীর থাকবে, মিলিট্যান্ট হবার দরকার নেই। কর্মে বীর হওয়া যে কত কঠিন তা তো তিনি হাড়েহাড়েই বোঝেন। সাহস, প্রচণ্ড সাহস প্রয়োজন হয়, ধ্যান দরকার হয় যে কোনও কর্ম সম্পন্ন করতে গেলে। অনেক খারাপ সময় এসেছে গেছে, শরদকাকার সঙ্গে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাবা এক সময়ে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন। তখন শরদ শার সঙ্গে কথাবার্তা তাঁকেই বলতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যখন দেখলেন তাঁদের পারিবারিক গুড-উইলের সুযোগ অন্যায়ভাবে নিয়েই চলেছেন কাকা, তখন তাঁকে একটা অত্যন্ত সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। জুয়েলারি থেকে তখন তিনি বাবাকে কাপড়ের ব্যবসায়ে আসতে পরামর্শ দিলেন। নরেন্দ্র অবাক হয়ে গিয়েছিলেন— বলিস কী, কিকি? এত দিনের ফ্যামিলি ট্র্যাডিশন…। নতুন ব্রাঞ্চ… আমি কি পারব?
—তুমি তো অনেক কিছুই পেরেছ বাবা, এটাও পারবে।
তখন তাঁর কত বয়স? বাইশ? তেইশ! সবে আইন পরীক্ষা দিয়েছেন।
তারপর কাগজে কাগজে ফলাও করে নোটিশ চলে গেল ‘ইট ইজ হিয়ারবাই নোটিফায়েড দ্যাট নরেন্দ্রভাই অব নরেন্দ্রভাই শরদভাই ইজ নো লঙ্গার উইথ দা মেহতা জুয়েলার্স। শরদকাকাকে নিজের অংশ যখন বেচে দিলেন অবলীলায়, তখন শরদকাকা খুব অনুনয়-বিনয় করেছিলেন। তিনি অন্যায় করেছেন, নরেন্দ্র যেন তাঁকে মাফ করেন।
নিজের ভাই-ই বিশ্বাসঘাতকতা করে শরদ, আর তুমি তো পাতানো ভাই। কোনও আদর্শই বিত্তলালসার ওপরে নয়—আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার অসুবিধে কীসের? গুড উইলটাই তো তোমাকে বেচলাম। আমাদের বাপ-বেটির চলে যাবে একরকম।
একেবারে চুপ শরদ শা। কোনও কথা বলতে পারেননি। উদ্ধত জবাব, অন্যায় অপমানজনক আচরণ, কিচ্ছু না। চলে গেলে বাবা বলেছিলেন, সত্যি চলে যাবে কিকি? সত্যি পারব?
—পারবে না কেন? আমি রয়েছি তো!
হঠাৎ নরেন্দ্র বলে উঠেছিলেন, হ্যাঁ, সে-ও একথাই বলত। আমি আছি তো!
—কে বাবা? আমার মা?
নিঃশব্দে মুখ নিচু করেছিলেন বাবা। কন্যা আর প্রশ্ন করেনি। কাপড়ের কারবার ফলাও করতে তাঁদের তিন বছরের বেশি সময় লাগেনি। প্রথমে নামী মিলের এজেন্সি নিলেন। তারপর মিলটাই কিনে নিলেন। এখন কোথায় শরদ শা’র জুয়েলারি আর কোথায় নরেন্দ্রর কটন সাম্রাজ্য।
বড্ড ছটফট করছে মনটা। বড্ড। ছেলেমেয়ে দুটো যতক্ষণ ছিল বেশ ছিলেন। বয়স হলে তরুণ-তরুণীদের সঙ্গ বোধহয় স্বাস্থ্যকর। অবশ্য তেমন তেমন তরুণ-তরুণী। চতুর্দিকে যাদের দ্যাখেন দেখে খুব আরাম পান না কস্তুরী। তাঁরা ছোটবেলায় কত অন্যরকম ছিলেন। কত সুন্দর ছোটবেলা কেটেছিল। বাড়িতে সর্বক্ষণই লোক। মাকে কম পেতেন। তাতেও কিন্তু কোনও অসুবিধে হয়নি। তাঁর নিজস্ব জগৎ ছিল, খেলাধুলো, পড়াশুনো, কুৎরী, বেড়াতে যাওয়া, গান শোনা, মায়ের হাতের মাছের ঝোল। আশ্চর্য! এখন আর মাছ মাংস খেতে পারেন না তিনি। গন্ধ লাগে। ঘিন্নাও লাগে। এখন খাকরা, কড়হি, পুরণপুরী, ধোকলা, গাঁঠিয়া খমণ্ড। বাবা যে বাবা দীর্ঘদিন মাছ ছাড়া অন্যান্য বাঙালি খাবার খেয়েছেন মায়ের হাতে, তিনি সুদ্ধ রোটলি, ভাকড়ি, মেথিলি ভাজি, চেওড়ো জলেবি—এসব ছাড়া খেতে পারতেন না। শেষ পাতে একটু দুধপাক তাঁর চাই-ই চাই।
শাহপুরের পুরনো বাড়ি। দাদা, দাদি। সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। একটা বিরাট উঁচু উঁচু ঘর। দালান। একটু উঁচু কিন্তু চওড়া চওড়া সিঁড়ি। জাফরির কাজ করা জানলা, আর ছোট ছোট ঝুলবারান্দা। একটু গম্ভীর, শান্ত। ছোট মেয়ের ভাল লাগার মতো নয়। কিন্তু আস্তে আস্তে ওই স্থাপত্যের গাম্ভীর্য থেকে শান্তি ছড়িয়ে গেল ছোট্ট মেয়েটির শরীরে, মনে। কেমন করে যেন বাবার বন্ধু হয়ে গেলেন। আগে তো বাবার সঙ্গে এত ভাব ছিল না! তাঁর আঠারো বছর বয়স থেকেই তো বাবা ব্যাবসার ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতেন। খাঁটি ব্যাবসাদারি রক্ত শরীরে, ঝলকে ঝলকে আসতে থাকত সমঝদারি, নতুন নতুন আইডিয়া। তাঁর, তাঁদের তারুণ্যও ছিল অন্য রকমের। এদের মতো নয়। শুধু নিজেকে নিয়ে কাটত না তো দিন! বাবা ছিলেন। ব্যাবসার চিন্তা ছিল, পড়াশোনা ছিল, সবরমতী আশ্রম ছিল, কত ছোট থেকে ছোট ছোট বাচ্চাদের ধরে এনে পড়াতেন। কস্তুরীর মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করত নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। মহাত্মা গাঁধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একটা মহৎ সংসারের মধ্যে ছিল তাঁদের বসবাস। মারা গেছেন। তো কী? হাওয়ায় ভাসছে তাঁদের সুবাস। ট্রাম চলেছে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের তালে। ‘মারের সাগর পাড়ি দেব গো’ গেয়ে উঠলেন নিবেদিতা মাসি— এই বিষম ঝড়ের বায়ে/ আমার হালভাঙা এই নায়ে!
নরেন্দ্র মেহতা ও শরদ শাহ আমদাবাদে সেবাদলে ছিলেন। হরিপুরা কংগ্রেসের অধিবেশনে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেছেন। তারপরে সুভাষচন্দ্রের ভাষণ, তাঁর ব্যক্তিত্ব, তাঁর সংকল্প আস্তে আস্তে সম্মোহিত করে ফেলল তাঁদের। না, এখানে আর নয়, সুভাষ, অরবিন্দ, রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথের পবিত্র চুম্বকী চতুষ্কোণে যেতে হবে পথ খুঁজতে। বাবাকে লুকিয়ে চলে এসেছিলেন। পরে কুইট ইন্ডিয়ায় যোগ দিয়ে প্রেসিডেন্সি জেলে গিয়ে দ্যাখেন, আরে, সেবাদলের সেই শরদ না? গুজরাতি সাহিত্য সম্মেলনে হাঁ করে যমনালাল বাজাজের দিকে তাকিয়েছিল?
পাত্তা করতে পেরে বাবাই কিনে দিলেন ফার্ন রোডের বাড়ি। জাত ব্যবসাদার, বললেন, দেশের সেবা তো করবে, যুব আন্দোলন করবে, আধ্যাত্মিক করবে, কবিতা-কাব্য করবে তো পয়সা লাগবে না? হগ মার্কেটে দোকান দাও। তোমার ধর্মভাইকে নিয়ে ব্যাবসা করো। পয়সা না হলে কিচ্ছু হবে না। গলা ফাটিয়ে খালি চেঁচালে মুখে রক্তই উঠবে।
বাবার কাছ থেকে এইসব শুনতে শুনতে উত্তেজিত হয়ে উঠতেন কস্তুরী।
—বাবা তুমি রবীন্দ্রনাথকে দেখেছ?
—একবার। অনেক দূর থেকে। জোড়াসাঁকোয়। জন্মদিন ছিল। অনেক লোক। এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলুম।
—কী দেখলে বাবা? কীরকম?
—তখন উনি বেশ বৃদ্ধ। পুরো মানুষটাই রুপোলি। সন্তের মতো মনে হচ্ছিল, যেন চারদিকে একটা প্রভা ছড়িয়ে যাচ্ছে।
—প্রভা, কিন্তু প্রভাব কি? বাবা? ওঁর মতো দূরদর্শী কর্মী এবং ভাবুক, অত হৃদয়বান। এ সবের কম্বিনেশন তো একসঙ্গে ঘটে না। তবু তো ওঁর দেশের লোকেরা শুনতে পাই ওঁর গান আর ডান্স ড্রামা নিয়েই মেতে রয়েছে।
—শান্তিনিকেতনও আর শান্তিতে নেই কিকি—বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন।
—তবে?
—কেউ প্রচার করল উনি মেয়েলি পুরুষ, কেউ বলল উনি সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গ ভালবাসেন, কেউ বলল নিজে নিজের ওপর গুরুদেব কথাটা উনিই আরোপ করেছেন। কেউ বলল উনি নিজের মান, যশ, খ্যাতি ছাড়া কিচ্ছু বুঝতেন না, কত রকম কথা, কিকি—কেউ দেখল না, জালিয়ানওয়ালা বাগের পর মহাত্মা যখন প্রতিবাদ করতে রাজি হলেন না, তখন একটি অতুলনীয় চিঠি দিয়ে কীভাবে তিনি নাইটহুড প্রত্যাখ্যান করলেন। এর মর্ম যে কী, আজকালকার ছেলেমেয়েরা বুঝবে না। একক প্রতিবাদ।
আজকালকার কেন বলছ বাবা! কোনওদিনই এর গুরুত্ব তেমন করে কেউ বোঝেনি। উনি তো কবি! রাজনৈতিক ব্যাপারে ওঁকে আন্ডারপাবলিসাইজ করাই বোধহয় সচেতন নীতি ছিল তখন।
রাইট। নরেন্দ্র হঠাৎ তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছিলেন। — কিকি, তুমি তার মতো করে ভাবো। কী করে শিখলে? উত্তরাধিকার?
রক্তেরও। শিক্ষারও। সেই পাঁচ-ছ’ বছর বয়সে তাঁর মধ্যে কতকগুলো আইডিয়া ঢুকে গিয়েছিল, পরে তিনি সেগুলোকে নিয়ে মনের ভেতর অনেক নাড়াচাড়া করে তাঁর নিজস্ব দর্শন তৈরি করেছেন।
পেছন ফিরে চেয়ে দেখলে কস্তুরীর মনে হয়, তাঁর সারা জীবনটা বাস্তব দিয়ে গড়া স্বপ্ন একটা। রূঢ়, কঠিন বাস্তব। তাঁকে একের পর এক কষ্ট ও সমস্যার মোকাবিলা করতে করতে বড় হতে হয়েছে। কিন্তু সবটাই স্বপ্নময়।
মা স্বল্পভাষী, অন্যমনস্ক। খেলাধুলোর ব্যাপারে কোনও বাধা দিতেন না। কিন্তু দুষ্টুমি বিশৃঙ্খলা সহ্য করতেন না একদম। বলতেন এই নাও ‘ক্ষীরের পুতুল’ পড়ো, তারপরে দশটা পর্যন্ত নামতা লিখবে, তারপর ‘আবোল-তাবোল’ থেকে যে কোনও একটা কবিতা মুখস্থ করবে। রাতে স-ব ধরব। বাস, আর একটা কথাও নয়। কত ছোটবেলায় পড়তে শিখেছিলেন ভুলেই গেছেন। মাকে দারুণ ভয় পেতেন, কিন্তু সেই ভয়ের অঙ্গে অঙ্গে দুর্মর ভালবাসা জড়িয়ে ছিল। কখন মা একবার তাকাবেন, চুড়ির আওয়াজ শোনা যাবে, কখন মা রান্নাঘরে ঢুকবেন এবং অপূর্ব সুগন্ধ বেরোবে। কখন মা সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান ধরবেন—
তবে বজ্ৰানলে
আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা চলো রে।
এই গানটা হলেই মনে হত, বুকের ভেতর দারুণ শক্তি সাহস এসেছে। কিকি আর কিকি নেই। সে মা-বাবা-কাকা-পিসি-মাসিমাদের গানের আসরে বসে তার বাচ্চা গলা মেলাত। বজজানলে, আপন বুকে পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা চলো রে।
কত সময়ে সেসব আসরেও আলোচনার মধ্যে সবার অলক্ষ্যে বসে থাকতেন। সব বুঝতেন না, মনেও নেই সব। কিন্তু অহিংস পন্থা, আর সুভাষ পন্থার একটা তুলনামূলক আলোচনা প্রায়ই হত। এখন জানেন নরেন্দ্র ও শরদ মেহতা দু’জনেই গুজরাত ছেড়ে এসেছিলেন সুভাষের খোঁজে। সব উলটেপালটে গেল। কলকাতায় তখন সুভাষপন্থীদের সংখ্যা গাঁধীপন্থীদের থেকে অনেক বেশি। ওঁরা ভাবতেন— নিজেদের তৈরি করতে হবে, যে মুহূর্তে সুভাষ উত্তর-পূর্বে ভারত সীমান্তে এসে পৌঁছোবেন অমনি খুলে যাবে দ্বার। সমস্ত মণিপুর, আসাম, ত্রিপুরা, বাংলা তাঁকে স্বাগত জানাবে। তারপরে যোগ দেবে সমগ্র ভারতবর্ষ। ভেসে যাবে আজাদ-হিন্দ ফৌজ আর গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ইংরেজের সমস্ত প্রতিরোধ। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী সবই প্রস্তুত ছিল। তবু স্বপ্ন পূরণ হল না।
কিন্তু তখন তো ১৯৪৬, ৪৭, ৪৮-এর ৩১ জানুয়ারি সব পেরিয়ে গেছে। তখন এ ধরনের সভা-সমিতির কারণ কী?
—আমরা একটা সমন্বয় করতে চাইছিলাম, কিকি। কেউ কেউ ছিল কট্টর। কিন্তু সবাই মিলে চোখ রাখতাম নতুন নেহরু সরকারের ওপর, কীভাবে সুভাষের বলবীর্য, গাঁধীজির জনশিক্ষা ও নেহরুর আধুনিকতার একটা সুষ্ঠু মিশ্রণ হয় তারই জন্য আলোচনা করতাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল একটা সম্পূর্ণ নতুন দল গড়ব, যার মধ্যে এই সমন্বয় থাকবে। কী হতে পারে আমাদের কনস্টিটিউশন, আমাদের ম্যানিফেস্টো…এই নিয়েই আলোচনা হত।
—করতে পেরেছিলে দলটা?
—না কিকি, পারিনি। আলোচনার স্তরেই ছিল। কেননা অনেকেই ভিন্ন মত পোষণ করতেন।
—কে, কে? বাবা!
এইখানে বাবা একেবারে চুপ করে যেতেন। বেশি চাপাচাপি করলে বলতেন—মনে নেই। সে আজ অনেক যুগ হয়ে গেল। তাছাড়া শেষ দিকটাতে তো আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ব্যাবসা শুরু করলে আর থামা যায় না কিকি।
হঠাৎ মনস্থির করে ফেললেন কস্তুরী। কালকেই স্নেহলতা ঘোষের বাড়ি যাবেন। যাবেনই। একটা গাড়ি ভাড়া নেবেন। এই শহর আর শহরতলি তো! যতই বদল হোক সেই কলকাতাই তো! রাস্তা ভরতি পথচলতি মানুষ, দোকানদার, ট্যাক্সি-ড্রাইভার, রিকশাঅলা। খুঁজে বার করতে অসুবিধে হতে পারে, অসম্ভব কিছু নয়। স্থির করে নিয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লেন।
হঠাৎ সরু মোটা গলায় নানান হাসি বাজে। সারারাত ধরে শুধু কথা, কথা আর কথা। কে কী বলছে ধরা যায় না। কিন্তু কেউ কেউ যেন খুব উত্তেজিত। রাগারাগি হচ্ছে নাকি? তোমরা হাসো, কথা বলো, গান করো। কিন্তু রাগারাগি কোরো না। কিকি ভয় পায়। তার বুকের মধ্যে থম ধরে যায়। বাবা মা যে বড্ড কথা কাটাকাটি করেন। বাবা খুব রেগে যান। মা’র মুখ থমথম করে। কী যেন একটা কঠোরভাবে বলেন, তারপর চলে যান। এই কস্তুরী তুই অ্যালিসের গল্প পড়েছিস? এই কস্তুরী কিতকিত খেলবি? এই কস্তুরী তোর আলুর পুতুলটাকে একটু পাড় না, জামা পরিয়ে দেব। জামা তো পরানোই আছে। নতুন জামা পরাব। দে না রে! ন্না, মা রাগ করবেন, ওই পুতুলটার অনেক দাম, বাবা কিনে দিয়েছে। কাউকে দেব না।
কিকি! তুতুল তোমার বন্ধু অত করে খেলতে চাইছে, পুতুলটা একটু দিতে পারছ না? ছিঃ! কে বলেছে আমি রাগ করব? যাও, টুলে ওঠো, পাড়ো, ওঠো বলছি! গোঁজ হয়ে বসে রইলে? ওঠো! নইলে…এই শিখেছ? বারবার বলেছি না সবার সঙ্গে সব ভাগ করে নিতে হয়! এত খারাপ হয়ে গেছ তুমি! কস্তুরী ফোঁপাতে ফোঁপাতে জেগে উঠলেন। একদম কিকির মতো। অনেকটা জল খেলেন, চোখ ভেঙে ঘুম আসছে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন।
খুব নিবিড় গান হচ্ছে— সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাং শস্য শ্যামলাং মাতরম। কী যে চমৎকার সুর এই গান, না স্তোত্রটার! না তো, মন্ত্র! ওঁরা সবাই বলেন এটা মন্ত্র। মন্ত্র কাকে বলে! পূজায় মন্ত্র লাগে, কার পূজা? দুর্গাঠাকুর? কালী? সরস্বতী— এইসব পূজার মন্ত্র সে কিছু কিছু জানে। যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ, নমস্তস্যৈ, নমস্তস্যৈ নমো নমহ৷ মা দুর্গাকে এইভাবে ডাকতে হয়। মহালয়াতে সব গায়ক মিলে রেডিয়োতে ডাকেন। গায়ক হলে তবেই ওইভাবে ডাকা যায়, অন্ধকার রাতে মন্ত্র মর্মে প্রবেশ করে যায়, মা বাবা উঠে বসে শুনছেন, এত সকালে ওঁদের চান হয়ে গেছে, দু’জনে মেঝেতে বসে পিঠ সোজা করে শুনছেন। কালী? কালীপূজার মন্ত্রও সে জানে। অত শক্ত নয়। গানই! —শ্যামা মা কি আমার কালো রে, শ্যামা মা কি আমার কালো/কালো রূপে জগৎ আলো… নির্ভুল বাণীতে সুরেতে মাখামাখি পঙ্ক্তিগুলো অবিশ্বাস্যভাবে বাজতে থাকে চেতনায়, একটুও ভুল হয় না। সরস্বতীরটা আর গান নয়, স্তব। শ্বেত পদ্মাসনা দেবী শ্বেত পুষ্পোপশোভিতা…এ তা হলে কোন দেবীর পুজোর মন্ত্র! অন্ধকার মনের গলিতে গলিতে খুঁজে বেড়াতে থাকে। ঝনঝন করে কে গেয়ে ওঠে— ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে, তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে ওগো মা!
চমকে জেগে উঠলেন কস্তুরী, স্মৃতিভ্রষ্ট মানুষ যেন স্মৃতি ফিরে পেয়েছে। সুধাকাকা গাইছেন, দরাজ গলায়, ঘরের কড়িবরগা কাঁপিয়ে গাইছেন। বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/ তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!
তাই তো! সুধাকাকার গলা যেত সবার ওপরে। মা বলতেন, সুধা, তুমি যদি অত চড়ায় ধরো, কী করে গাইব?
স্নেহকাকিমা বলছেন, সব গান সবাইকে গাইতেই হবে তার কী মানে আছে কল্যাণী! ও একা গাক। আমরা মনে মনে গাইব। একাকী গায়কের নহে তো গান, মিলিতে হবে দুইজনে/ গাহিবে একজন খুলিয়া গলা/ আর একজন গাবে মনে।
ওঁরা কথা বলতেন কবিতায়। অনর্গল, প্রত্যেকটি মানুষ। —বাংলা ছাড়া অন্য দেশের মানুষও আছে এখানে ভাবী— শরদকাকা বললেন— হ্যাভ সাম কনসিডারেশন ফর দেম!
মা অবাক চোখে চেয়ে আছেন— শরদভাই, বাংলাকে নিজভূমি মনে করেই এসেছিলেন না! বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ, সুভাষচন্দ্রের বাংলা।
শরদকাকা লজ্জিত —না, না, ওটা এমনি ঠাট্টা।
মা গাইতে আরম্ভ করলেন— পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ— কী শরদভাই, এটাও তো আছে। আর তা যদি বলেন, বাংলা সবাইকে বুকে টেনে নিয়েছে, কেউ বাংলার পর নয়। বাংলার কবি, বাংলার দার্শনিক, বাংলার বিপ্লবী ছিলেন সবার।
বাবা বলছেন— বাংলা ভারতবর্ষের সেই ভূমি সেখানে আর্য-অনার্য রক্ত মিশেছে সবচেয়ে বেশি। কে জানে বাংলায় ভারতের ভাগ্য গড়া হবে কিনা।
ছাতে একটা পুতুল কিংবা কাঠি নিয়ে ঘুরে বেড়াত কিকি আর তোতাপাখির মতো মুখস্থ বলে যেত যা যা শুনেছে সব। বাংলা ভারতবস্সের সেই ভূমি যেখানে আয্য, অনায্য রক্ত মিশেছে সবচেয়ে বেশি।
দপ করে মনে পড়ে গেল— কাজল মুণ্ডা। মৈত্রী বলছিল— আসলে বাঙালি তো সংকর জাতি দিদি। সাদা, কালো, ব্রাউন কীভাবে কখন মিশেছে কেউ বলতে পারে না। কাজল নিজেকে বলে আদি বাঙালি। …কখনও জিজ্ঞেস করিনি…ও বলতে চায় না… মিশনে যখন মানুষ হয়েছে তখন নিশ্চয়— অনাথ।
অনাথ! অরফ্যান! তাঁর অনেক কাজ কারবার আছে অনাথ নিয়ে। তারা কত রকমের আলাদা আলাদা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছে। কই, তাদের কাউকে তো এভাবে দাঁড়াতে, বসতে, কথা বলতে দ্যাখেননি। বেশি কথা বলে না ছেলেটা, কিন্তু গভীর চিন্তাশক্তির নির্ভুল ছাপ আছে ওর মুখে। আদিবাসীদের নিয়েই ওর রিসার্চ। শুধু একটা পিএইচ. ডি-র জন্য গবেষণা? না কৌতূহল? না ইতিহাসবোধ! নাকি এ ওর ব্যক্তিগত অন্বেষণ! নিজের শেকড় খুঁজছে। পরিষ্কার জানতে চায় সব।
তার মানে কাজল মুণ্ডা ঠিক তাঁর মতো। তিনিও তো তাঁর অতীত জানতে এত দূর এসেছেন। আটচল্লিশ বছর অভিমানে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন, তারপর আর পারলেন না, মনে হল নিজের উৎস না জানলে বৃথা জীবন। কোথাও কোনও রহস্য রেখে তিনি মরতে পারবেন না। বাবা পারলেন। কী করে যে রহস্যের ভার একা বইলেন, তিনিই জানেন, কিন্তু কস্তুরী তা পারবেন না।
চানটান করে পাও ভাজি আর চা খাচ্ছেন, ফোনটা এল।
—হ্যালো…
—দিদি আমি কাজল।
—হ্যাঁ বল।
—আজকের কাগজটা দেখেছেন? স্নেহলতা ঘোষ প্রাক্তন বিপ্লবী মারা গেছেন। বয়স হয়েছিল সাতাশি। দিদি আমি এক্ষুনি আসছি।
সঙ্গে সঙ্গে কাজল ফোন অফ করে দিল।
কস্তুরী স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন।