উজান যাত্রা (Ujan Jatra) : তিনি ও সে
কস্তুরী দেখলেন কালো পাথরের একটি ভাস্কর্য তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। ছাট আসছে বলে জানলা বন্ধ, ঘর আধো-অন্ধকার। যতক্ষণ পেরেছেন জানলা খুলে রেখে বৃষ্টিকে আসতে দিয়েছেন, কিন্তু একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছিল, বৃষ্টি তক্তপোশের বিছানার দিকে হাত বাড়াতে জানলা বন্ধ করতেই হয়েছে। একটা পুরনো তোয়ালে দিয়ে ঘরখানা নিবিষ্ট মনে মুছছিলেন তিনি। দুষ্কর্মটি নিজেই করেছেন, তার শাস্তি তাঁকেই ভোগ করতে হবে। টপটপ করে ঘরের মধ্যে জল পড়ছে কোনও অজানা উৎস থেকে। ছাত ফুটো হল নাকি? মুখ তুলে দেখলেন কালো পাথরের ভাস্কর্য। বৃষ্টিভেজা কালো জিনস ব্রাউন শার্ট, সব গায়েই লেপটে, সেঁটে গেছে একেবারে। সেইসব ভাঁজও আদি অকৃত্রিম পাথরের। চুলগুলো মাথা থেকে নেমে এলোমেলোভাবে কী চমৎকার লেপটে আছে কপালে, কানে। তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল— বাঃ!
তাঁর প্রশংসাবাক্য বুঝতে পারে নি কাজল। সে ভেবেছিল ওটা ধমক। একেই ঘর ভরতি জল মুছতে হচ্ছে ওঁকে। তার ওপর সে একখানা মুর্তিমান জলস্তম্ভ হয়ে হাজির হয়েছে। কিন্তু কী করবে? রামলাখন নামে দারোয়ানটি দরজা খুলে খুব নিস্পৃহভাবে তাকে সিঁড়ি দেখিয়ে দিল। সে বাথরুমের কথা জিজ্ঞেস করেছিল।
রামলাখন বলে, পতা নেই।
আচ্ছা তো! থাকিস এই বাড়িতে। বাথরুম কোথায় জানিস না! তারপর মনে হল ও টয়লেট কথাটা ব্যবহার করেছিল। রামলাখন বোধহয় বুঝতে পারেনি।
—গোসল-কামরা নেই হ্যায়?
রামলাখন আবারও ওপরে দেখিয়ে দিল।
আশ্চর্য। এদের একতলায় কি কোনও কলঘর নেই? এ দারোয়ানপ্রবর যায় কোথায়? মাঠে-ঘাটে!
দু’-চার কদমে সিঁড়ি টপকে সে তিনতলার ঘরে হাজির হয়েছিল। উনি নিপুণ বাইয়ের মতো ঘর মুছছেন। নিংড়ে একটা বালতিতে ফেলছেন আবার মুছছেন। যেন এটাই ওঁর একমাত্র কাজ। এ বাড়িতে ঠিকে কাজ নিয়েছেন, ঘর মোছামুছি করছেন তাই। আধো-অন্ধকারে ওঁর সাদা শাড়ি চমকাচ্ছে। মুখের সাদাও, সেটাকে এখন জ্যোতি-জ্যোতি দেখাচ্ছে। উনি বললেন— বাঃ। অর্থাৎ বেশ! আমি ঘর শুকনো করছি, তুমি এমনি বে-আক্কিলে যে দিলে তার বারোটা বাজিয়ে। কাজ দুনো করে দিলে।
সে অসহায় অপ্রস্তুতের মতো একটা বোকা হাসি দিল। উনি ন্যাতা ফেলে উঠে দাঁড়ালেন ইস্স্ এতো ভিজেচো? যাও বাথরুমে যাও, আমি তোয়ালে দিচ্চি।
বিনা বাক্যব্যয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল সে। হাত বাড়িয়ে একটা তোয়ালে নিল। কিন্তু তোয়ালের সঙ্গে সঙ্গে একটি শাড়িও এল। সাদা চিকনের কাজ করা শাড়ি। কাজল খুব খানিকটা হেসে, ভাল করে গা-হাত পা মুছে, শার্ট প্যান্ট নিংড়ে জল ঝরিয়ে পরে ফেলল। বেরিয়ে দেখল ঘরের কোণে স্টোভ জ্বলছে— চা তৈরি হচ্ছে।
চা চিনি দুধ তেজপাতা গরমমশলা আদা দিয়ে ফোটানো জলের মার্কামারা গুজরাতি চা। একটা কাঁসার মোটা চাদরের পেটমোটা ঘটিতে চা-টা তৈরি করে দুটো মোটা মোটা কাচের গেলাসে ঢাললেন উনি। এক দিকের জানলা খুলে দিলেন, বৃষ্টির ধার কমেছে। বললেন, শাড়িতে ওপোমান হোলো?
কাজল একগাল হেসে বলল, মান-অপমানের কথা নয়। এই তো সব জল নিংড়ে নিয়েছি। আমি এরকম কত ভিজি! কিছু হয় না।
বেশ মহাশয়, বীরপুরুষ, চা খাও।
ওঁর কোনও জোরজারি নেই। তুমি ভিজে এসেছ, শুকনো তোয়ালে, কাপড় দিয়েছেন, তুমি তোয়ালে নিয়েছ, কাপড় নাওনি। বাস, মিটে গেল। —ও মা! গায়ে জল বসবে! শরীর খারাপ হবে। শিগগিরি শোনো, দিদির কথা শুনতে হয়। —এসব কিচ্ছু না। এইটাই ভালো, স্বস্তির।
এই যদি মিঠুর বাড়ি হত! বাবার পাজামা-পাঞ্জাবি নিয়ে এসে চরম আদিখ্যেতা করে তাকে জোরজুলুম করে পরাত। তারপরে দৈর্ঘ্যে ছোট পায়জামা পাঞ্জাবিতে তাকে মজার দেখাচ্ছে বলে হেসে হেসে চোখ থেকে জল বার করে ফেলত। এত জলও মেয়েদের টিয়ার-ডাক্টে থাকে। কাঁদলে জল, হাসলেও জল।
উনি বললেন, এই বৃষ্টিতে মৈত্রী কি আসচে? মোনে হচ্ছে না।
মৈত্রীর পারগতা অপারগতার সম্পর্কে কোনও পূর্ব-ধারণা করে না নেওয়াই ভাল, কাজল অভিজ্ঞতা থেকে জানে। সে জানলার কাছে গিয়ে বাইরেটা দেখল। ঘণ্টাখানেকের কাছাকাছি বৃষ্টি হয়েছে। এ গলিতে চট করে জল দাঁড়ায় না বোধহয়। কোলের দিকে জল বইছে। তবে বড় রাস্তায় যে গোড়ালি জল, তা সে দেখেই এসেছে। বৃষ্টিটা ধরে এসেছে। বাঃ চা-টা চমৎকার লাগছে তো! সে মশলা-চা তো কোন ছার দুধ দেওয়া চাও পছন্দ করে না। লিকর। ইনফিউশন শুধু। চিনি দেয় না। কিন্তু আজকের এই বৃষ্টি এবং ভিজে জাব জামা-কাপড়ের আবহাওয়ায় চা-টা সত্যিই দারুণ লাগছে।
চা-টা ফার্স্টক্লাস হয়েছে দিদি।
উত্তর এল— রান্নায় আমি ওলওয়েজ ফার্স্ট। আমদাবাদে গেলে প্রমাণ পাবে, একানে যদি ভাবো খিচড়ি-ওমলেট করে খাওয়াব তো সে বালি গুড়ে।
কাজল হাসি চাপল, কারেক্ট করে দিল না মোটেই। বাচ্চাদের ভুলভাল এত মিষ্টি লাগে! এখন তুমি যদি ‘টু মেনি ব্ৰথস স্পয়েল দা কুক’ বল তাহলে ইংরেজদের কানে তা তো মিষ্টি লাগবেই না, আমাদের এদেশিরাও হাসাহাসি করেটরে তোমাকে অপাঙ্ক্তেয় করে দেবেন। অশিক্ষিত উজবুক— নিজেদের মধ্যে বলাবলি চলবে। এই এক যাত্রায় পৃথক ফলের প্রকৃত কারণ কী! ইংরেজি ভাষার কলোনি সূত্রে পাওয়া বিশাল বাজার, না আমাদের হীনম্মন্যতা, বলা মুশকিল। ইডিয়মে ভুল, উচ্চারণের অশুদ্ধতা রীতিমতো পদস্থ দক্ষিণী বা উত্তরপ্রদেশীয়দের মধ্যে খুবই দেখা যায়। সে নিয়েও আমরা প্রচুর ক্যারিকেচার করি। ওদের কিন্তু হেলদোল নেই। আমরাই লজ্জায় রেঙে যাই। অফ্ন বলব, না অফটেন বলব, ইডিওলজি বলব, না আইডিওলজি বলব, এ নিয়ে আমাদের চিন্তার শেষ নেই। অবশ্য এর মধ্যে একটা সঠিক জানা, সঠিক বলতে চাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষাও আছে, শেখার আগ্রহ। এটা ভাল দিক।
সে কি বাঙালি? ঝাড়গ্রামে তাদের কত পুরুষের বাস! মানভূমের দিকেও তো তার পূর্বপুরুষেরা থেকে ছিল। সে বিহারি না বাঙালি বলা শক্ত। কোনও কোনও জায়গায় সীমান্তরেখা যে সত্যিই খুব ছায়াময়, তা স্বীকার করতেই হয়। তবে এসব নিয়ে সে ভাবলেও কাজল খুব সচেতন যে সে তার নিজস্ব আইডেন্টিটি তৈরি করেছে। শিক্ষাসূত্রে সে বাংলাটা খুব ভাল জানে। ইংরেজিও। এবং সংস্কৃতিসূত্রে সে তো বাঙালিই। এখন বাঙালি বলতে যদি শুধু কোঁচানো ধুতি, রসগোল্লা, আর ইলিশ-চিংড়ি বোঝায়, তবে তো মুশকিল। ঠিক আছে সে আদি-বাঙালি, ট্রাইব্যাল বাঙালি বেশ। এই জাতি-পরিচয়টা তাকে বেশ শান্তি-সন্তোষ দেয়।
কস্তুরীবেন বললেন, মৈত্রী যদি টাইম না রাখতে পারে আমরা চলে যেতেই হবে, কেন কী ওনাকে কথা দেওয়া আচে।
কাজল হাঁ হাঁ করে উঠল। এই মুষলধার বৃষ্টি যদি উত্তরেও হয়ে থাকে তা হলে এখন সেখানে মহাসাগর ও জ্যাম। শুনে কস্তুরীবেন বললেন, হ্যাঁ, পরানো কলকাতা তো বোটে! আমাদের শোহরটা লম্বা লেজের মতো, কিসের লেজ, কে জানে?
—আপনার শহর তো আমদাবাদ, সেখানে তো এ সমস্যা নেই।
টিক, আমদাবাদও আমার শোহর— পিতৃভূমি, বাপুল্যান্ড। কলকাতাও আমারই মা-ল্যান্ড, তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন— আমার জোন্মো তো একানেই।
কথাটা কাজল কয়েকবারই শুনল। উনি এখানে জন্মেছেন, ওঁর ছুটবেলা এখানেই কেটেছে, যে ছুটবেলা নাকি সব বেলা। এবং কলকাতার রাস্তাঘাটে উনি এমন বীরদর্পে হাঁটাচলা করেন যে এ শহরের ওপর ওঁর অধিকারে কোনও সন্দেহ থাকে না।
কস্তুরী বললেন, তা ছাড়া আমদাবাদে ট্র্যাফিক প্রবলেম নেই কে বললে! বৃষ্টির দেখা নেই, এটা একটা সোমস্যা বোটে। তবে যোখোন হোয় তোখন ছোট্ট খুকি সবরমতী উপচে সে এক কাণ্ড। তাপ্তী-নোর্মদাও আছেন— ফ্লাড। তুমি কোখনও যাওনি না?
সেভাবে কাজল কোথাওই যায়নি। ভ্রমণের শখ নেই। মানুষের বিশাল বিশাল কীর্তি তার কাছে একটা বিরাট ঠাট্টা বলে মনে হয়। কাজে গেছে। দিল্লি গেছে ইনস্টিটিউটের কাজে। তাজমহলটা পর্যন্ত দেখে আসেনি। রাধিকা কৃষ্ণান অবাক হয়ে বলেছিলেন, তুমি তাজমহলটা দেখলে না?
—কত দেখেছি, কত কতবার দেখেছি, ছবিতে, রেপ্লিকায়, তাজমহল লাইভ অন টিভি, তাই আর দেখতে হচ্ছে করল না।
—তুমি কি নিরাশ হবার ভয়ে গেলে না? জাস্ট টু কিপ ইয়োর ড্রিম ইনট্যাক্ট? কাজল হেসে ফেলেছিল— তাজমহল নিয়ে আমার কোনও স্বপ্ন নেই। পৃথিবীতে সুন্দর এবং আশ্চর্য সব মানুষের কীর্তি তো প্রচুর আছে! তো থাক না। আমি সব দেখে শেষ করতে পারব? দেখলে কি আমার দুটো ডানা গজাবে ম্যাডাম?
একটু চিন্তিত মুখে উনি বলেছিলেন, তা যদি বলো, ডানা গজাতেও পারে। গজানোটাই ইন ফ্যাক্ট আসল। লোক্যাল প্রবলেম নিয়ে সবসময়ে ডুবে থাকলে, হয়তো সংকীর্ণ হয়ে যেতে পারে মন, ক্ষমতা।
—আ অ্যাম ডেফিনিটলি নট আ ট্যুরিস্ট অন দিস আর্থ, ম্যাডাম, নর আ পরিব্রাজক।
—তা হলে তুমি কী?
—লেটস সি। তাছাড়া মন সংকীর্ণ হওয়ার প্রশ্ন নেই। ইট হ্যাজ টু বি কিন, ইনটেন্স।
ইউ মিন ইনটেনসিটি ইজ অল?
এগজ্যাক্টলি।
এখন এই ম্যাডাম, কস্তুরীবেনও পরিব্রজনে বিশ্বাসী কিনা কে জানে! দেশভ্রমণ, দেশে দেশে মোর ঘর আছে আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া। রবীন্দ্রনাথ বা বিবেকানন্দ, বা হিপি বা ইসকন…। মিঠু বলে— তোর মধ্যে একটা দম্ভ আছে। কারওর ওপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছিস না, বা মানহানি করছিস না, এই যা বাঁচোয়া।
ভুল বলছিস। ওটা জেদ, কোনও গোপন আকাঙ্ক্ষা, অ্যাসপিরেশন আছে আমার মনের মধ্যে তাই সেটাতেই ধ্যান দিয়ে থাকি, তাই আমাকে অ্যালুফ দেখায়, সেটাই তোরা দম্ভ ভাবিস। ভাব, আমি বারণ করছি না, কে কী ভাবল তা নিয়ে আমার কোনও ভাবনা নেই। আসে যায় না।
—তুই যখন নিজেকে এত ভাল পড়তে পারিস বলে মনে করিস তখন আর সামান্য একটু ইনভলভ্ড্ হবার চেষ্টা কর। লোককে ভুল ইমপ্রেশন দিয়ে কী লাভ! পাঁচজনের সঙ্গে একটু জড়ালে তোর মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
সামান্য একটু সেন্টিমেন্ট এখানে মিশিয়ে দিচ্ছে মিঠু, নির্ভুল বুঝতে পারে কাজল। ও হয়তো নিজেও জানে না। কিন্তু মিঠু জানে না, ওপর ওপর উদাসীন হলেও কাজলের ব্যারোমিটার কী নিখুঁত! পাঁচজন বলতে সাধারণভাবে মিঠু পাঁচজনকে বোঝাচ্ছে কিন্তু বিশেষভাবে বোঝাচ্ছে নিজেকে। নিশ্চিত।
—দি-দি। —ঠিক এই সময়ে বাইরে থেকে শোনা গেল। কাজল বলল, ওই তিনি এসে গেছেন।
হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গোটানো, একটা ওয়াটার প্রুফে ঠ্যাং ছাড়া সব ঢাকা। মাথায় ওয়াটারপ্রুফি বনেট— মিঠু বাইরে থেকে গলা বাড়িয়ে বলল— জলো জিনিসগুলো বাইরে রেখে, শুকনো আমি ভেতরে ঢুকছি দিদি। এখানে কি একটা হুকটুক আছে?
—বাম দিকে দেখো, ঠিক পেয়ে যাবে, পোর পোর হুক…
—পেয়েছি।
সানডাক খুলে ওয়াটার প্রুফ হুকে টাঙিয়ে শ্রীমতী পেল্লাই ব্যাগের ভেতর থেকে একটা ঝাড়ন বার করে পা মুছলেন। তারপর আঙুলে ভর দিয়ে হাসি-হাসি মুখে ভেতরে ঢুকলেন।
—ওয়ান্ডারফুল— কস্তুরীবেন বললেন।
—কী হিসেবে? কাজল জিজ্ঞেস করল।
—শি ইজ আ ওয়েল-অর্গ্যানাইজড ইয়াং লেডি। তুমার মুতন ভিজে ভাত নয়।
—ভাত? ভাতকে আপনারা কী বলেন দিদি? এরকম ইডিয়ম আছে গুজরাতিতে? আমরা বলি ভিজে গোবর। মিঠু বলল।
—ভাত ইজ ভাত। তা ছাড়া তুমরা ভুলে যাচ্চো আমার ছুটবেলা কেটেচে কলকাতাতে।
অর্থাৎ কথাটা উনি ওদের ভুলতে দেবেন না। ভুলে গেলে আহত হবেন। যদি ছুটবেলা কলকাতাতেই কেটে থাকে তা হলে উচ্চারণের তফাত কেন? জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না কাজলের। যদি কিছু মনে করেন! নিজেকে অকৃত্রিম কলকাতিয়া ভেবে উনি খুব খুশি আছেন। আমদাবাদ যেমন ওঁর শোহোর কলকাতাও তেমনই ওঁর। ওঁর বাপু-ল্যান্ড আর মা-ল্যান্ড। কতটা কৌতূহল বা ঠাট্টা-তামাশা ওঁর সইবে— সে এখনও বুঝতে পারেনি।
মিঠু বলল, আমি একবার বেরিয়ে প্রচণ্ড ভিজে আবার ফিরে গেছি, জানেন? তারপর একটু অপেক্ষা করলাম, বৃষ্টিটা একটু ধরতে আবার চেঞ্জ করে ধড়াচূড়া পরে বেরোলাম। ঠিকই করেছি। আমাদের ওখানে জল নেই কিন্তু গোলপার্ক জলে জল। আবার দেখুন আপনাদের এখানেও তেমন কিছু নেই। নর্দমার দিকটা জমে আছে, ওখানটা লাফ মেরে পেরিয়ে এসেছি।
ঠিক করেচো— কস্তুরীবেন বললেন। —কাজল এবার কি যাওয়া যাবে? থ্রি মাস্কেটিয়ার্স!
বলতে পারছি না ম্যাডাম। দক্ষিণেশ্বর তো এখানে নয়, মাঝরাস্তায় গাড়ি যদি বিকল হয়ে যায়, বিপদে পড়বেন। মানে পড়ব। স্ট্র্যান্ডেড হয়ে যেতে পারি। এদিকেও আসতে পারব না, ওদিকেও যেতে পারব না।
দ্যাটস ব্যাড— কস্তুরীবেন খুব চিন্তিত হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। স্নেহলতা ঘোষের সঙ্গে দ্যাখা করা তাঁর খুবই দরকার। দরকারটা ব্যক্তিগত। কিন্তু সম্ভবত প্রথম দেখাতেই সেটা মিটবে না। দু’বার অন্তত যেতে হবে।
তা হলে কি আমরা চলে যাব? কাজল জিজ্ঞেস করল। হঠাৎ মিঠু একটু আবদেরে সুর ধরল। —এত দূর ভিজে টিজে কষ্ট করে এসেছি দিদি। মোটেই ফিরে যাব না। এই কাজল, তেলেভাজা মুড়ি নিয়ে আয় না।
ওই যে, মিঠুদেবীর পারগতা অপারগতা সম্পর্কে কোনও পূর্ব ধারণা করে নেওয়া ঠিক নয়! যা কাজল পারে না, মিতু তা অনায়াসেই পেরে যায়। এই ম্যাডাম বোঝাই যাচ্ছে কেমন অন্যমনস্ক, কিছু একটা প্রবলেম আছে ওঁর। কেউ ওঁর সঙ্গে ঘুরুক উনি চান না। নেহাত দক্ষিণেশ্বরের কাছে এই এঁড়েদ’ জায়গাটায় রাস্তা, বাড়ি ইত্যাদি খুঁজে পাওয়া খুব শক্ত, তাই ওদের কথায় রাজি হয়েছেন। এখন এই তেলেভাজা, ওঁর সময়ের মধ্যে অনধিকার প্রবেশ এসব ওঁর কত দূর বরদাস্ত হবে কে জানে!
কস্তুরী বললেন— কাজল, রামলাখনকে ডাকো। ও আনবে। তুমরা আরামসে বসো।
মিঠু তার আবদেরে ভঙ্গি অবিকৃত রেখে বলল, দিদি, আপনি আপনার দেশের গল্প বলুন। ছোটবেলার গল্পও তো আছে। প্লিজ দিদি…।
—তুমাদের মতুন আমাদের ছুটবেলা নয় মৈত্রী। আমরা খেলতুম কুকুর নিয়ে, বেড়াল নিয়ে, পুতুল নিয়ে, অ্যাসর্টেড ডলস— বেনেপুতুল, মুড়কি পুতুল, কাচের পুতুল, আলুর পুতুল…।
আলুর পুতুল? —মিঠু হেসে উঠল।
আলু নয়, সেলুলয়েডের ছিল, কিন্তু আলু বুলতো, কেন জানি না। তো আমরা খেলতে খেলতে পড়তে শিখে যেতুম, মেঝেতে চকখড়ি দিয়ে অ আ ক খ, এ বি সি ডি, যোগ বিয়োগ, গুণ, ভাগ— সমস্ত। পিঠে ক্রিশ্চানের পাপের বুঝা নিয়ে আমাদের স্কুল যেতে হত না। দুই চার পাতলা বই, খাতা, পেনসিল বক্স। বাস। হাতের লেখা করতে হত। চার পাঁচ ছে পাতা।
আমরাও করেছি দিদি, প্যাটার্ন ড্রয়িং দিয়ে কত ছোটতে শুরু করেছি। প্রিপেয়ারেটরিতে।
তাতে হাতের লেখা ভাল হয়েচে?
মিঠু অপ্রস্তুত হয়ে জিভ কাটল— এ মা! হ্যাঁরে কাজল, আমার হাতের লেখা ভাল!
—পাতে দেওয়া যায়— কাজলের চটপট জবাব, যদিও সে বলে থাকে মিতুর হাতের লেখা ছাপা হরফের মতো।
—তোরটা পাতে দেওয়াও যায় না।
কাজল বলল, একটু জড়ানো, পড়তে অসুবিধে হয়, তো আজকাল তো কম্পিউটারেই সব করি। আমার হাতের লেখা কেমন, ভুলেই গেছি।
আমারটা দেখবে? —উনি দারুণ উৎসাহে উঠে দাঁড়ালেন— ব্যাগ খুঁজে একটা কার্বন কপি বার করে নিয়ে এলেন।
—এই দ্যাকো, নিতাইবাবুকে যে চিটি দিই তার কপি। ওনার ই-মেল নেই। তা ছাড়া আমি যেসব মানুষের সঙ্গে করেসপন্ডেন্স করি, তাঁদের ই-মেল থাকে না।
চিঠিটা হাতে করে কাজল, মিঠু অবাক। ইংরেজি নয়, পরিষ্কার বাংলায় লেখা। গোটা গোটা। খানিকটা পুঁথির মতো লাইন টেনে টেনে লেখা।
সহযোগীবরেষু নিতাইবাবু,
আমি ষোলো অগস্ট কলকাতা যাচ্ছি, আমদাবাদ-হাওড়া এক্সপ্রেসে। বেশ কয়েকজন পুরাতন স্বাধীনতা-সংগ্রামীর সহিত দেখা করিব। নামধাম গিয়া বলিব। আমার কিছু শূন্য পাতা পূর্ণ করিবার প্রয়োজন। আপনার সহায়তা লাগিবে। আশা করি নিরাশ করিবেন না। সম্মানপূর্বক নিবেদনমিতি
কস্তুরী।
পড়ে ওরা অবাক হয়ে গেল। কতকাল আগেকার ভাষা-ভঙ্গি। সাধুভাষা আজকাল প্রায় উঠে গেছে। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ সাধু ক্রিয়াপদে লেখা বলে বাচ্চারা পড়তে চায় না। এরকম ভাষা দাদুর পুরনো চিঠিতে মিঠু দেখেছে। সযত্নে বাবা রেখে দিয়েছেন একটা কাঠের হাতবাক্সে। একগোছা চিঠি, একগোছা চাবি, দাদুর সোনার ফ্রেমের পড়ার চশমা, আর একটা হিসেবের খাতা। আধ সের খয়রা মাছ ১ পয়সা, একজোড়া শান্তিপুরী শাড়ি ৯২ টা ইত্যাদি।
কী সুন্দর হাতের লেখা দেখেছিস কাজল! ইস্স্। দিদি আমার হিংসে হচ্ছে!
স্পষ্টই দারুণ খুশি কস্তুরী। মুখে বললেন, হিংসা না করে প্র্যাকটিস করলে কাজে দিবে।
এখন এই বয়সে প্র্যাকটিস? দিদি? —মিঠু হেসেই আকুল।
কেনো? কোতো বোয়োস তুমার দিদিমোণি! যোতোদিন বাঁচে, ততদিন শিকে জানো না?
মিঠুর হাসি এবার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
পরিস্থিতি সামলাতে কাজল বলল, ম্যাডাম, কোন স্কুলে পড়তেন আপনি?
মুরুলিধোর চিনো?
হ্যাঁ। চিনি বই কী!
মুরুলিধোর কে ছিলেন জানো?
না, জানি না।
তুমরা কিছুই জানে না। শুনো মুরুলীধোর ছিলেন— বিখ্যাত আইনের লোক। উনি ওঁর তিন ছেলে সব আইন। অনেক দানধ্যান ছিল। আরও ছিলেন চারুচন্দ্র চ্যাটার্জি, সমাজসেবক, বিদ্বান লোক, সব এখানকার মানুষ।
হ্যাঁ দিদি ওঁর নামে একটা কলেজ হয়েছে এখন।
এখন কে বললে? সেই সাতচল্লিশ নাগাদই হয়েছে দিদিমোণি। মঙ্গিরাম বাঙ্গুর ছিলেন আরেক ধনী। বিড়লাদের থেকেও ধনী। ওঁর নামে তো হসপিট্যাল আছে। এঁরা সব এই সাউথ ক্যালকাটার গোড়ার দিকের লোক ছিলেন।
আপনি এত জানলেন কী করে দিদি? — অকৃত্রিম বিস্ময় মিঠুর গলায়।
বলেচি না আমার ছুটবেলা…
কাজলের ভীষণ হাসি পাচ্ছিল, হাসিটাকে প্রাণপণে সে প্রশ্নে পরিণত করল।
এই তো মিঠুরও ছোটবেলা কেটেছে কলকাতায়, আমার একটু বড়বেলা— আমরা তো জানি না!
এবার বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন কস্তুরীবেন— তুমরা জানতে চাও না, কেয়ার করো না। আমি পোস্ট-ইনডিপেন্ডেন্স জেনারেশন প্রচুর দেখেছি, নিজেদের নিয়ে মোত্ত। ডোন্ট কেয়ার আ ফিগ ফর দা পাস্ট। মোত্ত হও না কে বারণ করেচে? কিন্তু নিজের দেশের পাস্ট জানবে না?
—হিস্ট্রির লোকেরা জানে… খুব নার্ভাস গলায় মিঠু বলল।
—সে তারা কুঁটিনাটি জানুক, কিন্তু সাদারণভাবে য়ু সিম টু কেয়ার মোর অ্যাবাউট নোয়িং দা নেমস অব অ্যামেরিকান প্রেসিডেন্টস, দ্যান দ নেমস অব ইন্ডিয়ান ফ্রিডম ফাইটার্স।
—না দিদি, স্যরি।
—নো স্যরি, য়ু শুড বি অ্যাশেম্ড্, তুমাদের লোজ্জা কোরা উচিত।
তারপরই কস্তুরী যেন তাঁর ভেতরের কাঠিন্যকে গলে যেতে দিলেন, নরম প্রায় ভয় পাওয়া গলায় বললেন, না, না, আ অ্যাম স্যরি, এভাবে বোলা আমার উচিত করেনি। আই কান্ট ইকোয়েট য়ু উইথ আদার্স। টিক আছে, সাদারণ, খুব সাদারণভাবে জানবে, শুদু নেহরু, মহাত্মা, পাটেল, বোস জানলে হচ্চে না। আরও একটু, আরও এক-টু। একটু থেমে বললেন, তুমরা টিক কী কাজ করো বলো দিকি!
—আবার সেই কাজ? মিঠু কাতরায়।
—বা। কাজেই তো তুমার পরিচয়, নোয়?
অসহায়ের মতো মিঠু কাজলের দিকে চায়।
কাজল বলল, আমি লোকসংস্কৃতি নিয়ে রিসার্চ করছি দিদি। একটু ঘুরতে হয়। থিয়োরিটিক্যাল কাজও আছে।
তুমি মনভূম গেচো?
মানভূম? আজকাল তো আর মানভূম বলছে না। যে জায়গাটাকে সাঁওতাল পরগনা বলত—গালুডি, রিখিয়া, শিমুলতলা, মধুপুর, ও অঞ্চলের অনেক গ্রাম জানি। যাইনি। জাস্ট জানি।
—মঝিহিডা বলে কোনও জায়গা আছে?
—মাঝিহিড়া? অনেক রকম কাজকর্ম হয়। আপনি জানেন?
—কী ধোরোন? —জানা না জানার প্রসঙ্গ না তুলে উনি বললেন।
—এই ধরুন সর্ট অব গান্ধীয়ান বেসিক ট্রেনিং?
কাজলের থেকে হঠাৎ-ই মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে মিঠুর দিকে। তাকালেন উনি।
—বালো বালো বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, ফ্যাশন ডিজাইনিং সোব ছেড়ে তুমি সোশ্যাল সার্ভিসে এলে কেন দিদিমোণি? মিঠু সামান্য ঠোঁট উলটে বলল, দুর! কম্প্যারেটিভ লিটরেচার নিয়ে মাস্টার্স করেছি দিদি। খালি পাবলিক রিলেশন্স্ জব পাচ্ছিলাম আর টিচিং একদম বাজে। সবার মন রাখা আমার কর্ম নয়। পেয়ে গেলাম একটা এন.জি.ও-য়। ভ্যাগর্যান্টস্ নিয়ে ওদের কাজ।
আচ্চা! ইনটরেস্টিং!
—কিন্তু আমি শুধু ডকুমেন্টেশনটা করি। প্রত্যেকের হিস্ট্রি রাখি। সি.ডি. করি, হেড কোয়ার্টার্সে, আরও কিছু কিছু রিসার্চ অর্গ্যানাইজেশনে পাঠাতে হয়।
—বা। হিস্ট্রি! কেমন এই ভ্যাগর্যান্টসরা?
—দিদি আজব আজব ব্যাপার! আপনি ভাবতেই পারবেন না, ভাল সচ্ছল পরিবারের ছেলে ছিল। স্বভাবেই ভবঘুরে-টাইপ, এখন ধরুন বিয়াল্লিশ মতো বয়স। বাড়ি থেকে পালিয়েছে তেরো বছর বয়সে। একটা ভিখারির সঙ্গে কোনও তফাত ধরতে পারবেন না। পিকিউলিয়ার।
কস্তুরী বললেন, কেনো যে মানুষ পালিয়ে যায়! কোতা থেকে কোতায়। পালাবার জায়গা আচে? —একটু কি নিশ্বাস ফেললেন? — বাড়ির কোঁজ করোনি?
—করেছি। বলতে কি চায়? অন্যদের থেকে ভাসাভাসা মতন জেনে, আমাদের ডিরেক্টর খোঁজ করতে পাঠিয়েছিলেন। বর্ধমানের এক গ্রাম শ্রীরামপুর, ওদের যথেষ্ট জমি-জায়গা। উগ্র ক্ষত্রিয় বলে ওদের। প্রচুর টাকা থাকে ওদের। মা বাবা বেঁচে নেই। এক দাদা বললেন— দুর, ওর আশা আমরা ছেড়ে দিয়েছি। বেশ পড়াশোনা করছিল কিন্তু থেকে থেকেই পালাত। কেন? কী অসুবিধে? কোনও অসুবিধে নেই। ফেল করেনি, বাড়িতে অনাদর নেই। কে জানে, মন টেকে না, জাস্ট পালিয়ে গিয়ে কোনওরকমে খাবার জোগাড় করে কাটিয়ে দিত। তারপর হয় নিজেই ফিরে আসত। নয় বাড়ি থেকে খোঁজখবর করে ধরে নিয়ে আসত। শেষবার পালাল। তারপর ওই আমাদের থেকে ওর খবর পেলেন ওঁরা। দাদাটি বললেন— গিয়ে কোনও লাভ নেই। এমনিতেই ওর মন টিকত না, এখন তো মানাতেও পারবে না।
—তারাপদ টাইপ— কাজল বলল।
—তারাপদ কে? কস্তুরী জিজ্ঞেস করলেন।
—ও আপনি চিনবেন না। রবীন্দ্রনাথের একটা গল্পের…
—রাইট। ওতিথি নয়? কেনো চিনবো না—রবীন্দ্রনাথ আমার ওনেক পোড়া আচে। এই ফিল্মও আমি দেকেচি। বালো কাজ।
গল্পসল্প গড়াতে গড়াতে রাত ন’টা হয়ে গেল।
বেস্ট লাক দ্য নেক্সট টাইম! কাজল বিদায় নিল। মিঠু তখনও বসে। তার যাবার ইচ্ছে নেই। নিজেই নেই-আঁকড়ার মতো বলল— আর একটু থাকি দিদি, হ্যাঁ? কাজল তুই যা, কেমন? অধিকারী মাসিমা আবার মনে কষ্ট পাবেন।
এই হল মিঠুর মার্কামারা বিচ্ছুমি।
খোলা জানলা দিয়ে কস্তুরী দেখলেন— কাজল রাস্তা ক্রস করল। বাঁক ফিরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ফিরলেন মিঠুর দিকে। একটু ইতস্তত করে বললেন, দিদিমণি, এই চেলেটি মুণ্ডা মিনস সাঁওতাল, কোল, হো…
—হ্যাঁ দিদি। ও নিজেকে বলে আদি বাঙালি।
—মানে?
—আসলে বাঙালি তো সংকর জাতি দিদি। কাদের সঙ্গে কাদের মিশ্রণে বাঙালি হয়েছে বলা খুব শক্ত। সাদা কালো তামাটে সবকিছু মিশে গেছে পুবের এই মেল্টিং পটে। তাই ও নিজেকে আদি বাঙালি বলে।
—কিন্তু ও চোমৎকার বাংলা-ইংরেজি বোলে, সিম্স ভেরি ওয়েল এডুকেটেড!
—ওয়েল এডুকেটেড তো বটেই। ও হিস্ট্রির এম.এ দিদি— সোশিওলজিতেও। ডক্টরেট করছে এই আদিবাসীদেরই ওপর। তা ছাড়া ও খুব ছোট থেকে ব্যাপটিস্ট মিশনে মানুষ, পরে রামকৃষ্ণ মিশন। ভীষণ ট্যালেন্টেড।
—মিশনে মানুষ? মা-বাবা নাই?
—এসব কথা আমি জানি না দিদি। ও কখনও এ আলোচনার মধ্যে যেতে চায় না। আমি… আমি কখনও জিজ্ঞেস করিনি। তবে মিশনে মানুষ যখন, তখন ধরেই নেওয়া যায়— অনাথ। দিদি, আপনার কথা বলুন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। অবশ্য আপনার যদি আপত্তি না থাকে।
কস্তুরী চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, নিতাই তোমাদের বোলেনি?
—হ্যাঁ, আপনি খুব বড় বিজনেসম্যান ফ্যামিলির। আপনি সোশ্যাল ওয়র্ক করেন।
—এই তো জানো। আর কী!
—বাস? —এত নিরাশ গলায় মিঠু বলল যে কস্তুরী হেসে ফেললেন, তারপরে মিঠুর গাল টিপে আদর করে বললেন, দুঃখো করবে না। শুনো তোবে। আমার বাবার নাম নরেন্দ্র মেহতা। কাপড়ের ব্যবসায়ে প্রচুর কামিয়েছেন। আমি কুড়ি-একুশ থেকে ওঁর সঙে আছি। আই টূ হ্যান্ডল বিজনেস। কোতো নং সুতায় কুন মেশিনে কাপড় বুনলে আকাশের মতো নীল, বাতাসের মতো ফুরফুরে শাড়ি হোবে, রাজকুমারী একদিন পোরে ফেলে দিবে, জাহাজ জাহাজ সোনা দাম হোবে তার, চাঁদের মা চোরখায় সুতা কাটছে সুতা কাটছে, সোব আমি হাত পেতে নিতে জানি।
মিঠুর মুখচোখ ক্রমশই উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল, বিস্ময়ের গলায় বলল, দিদি, আপনি ক্ষীরের পুতুল, ঠাকুরমার ঝুলি— জানেন? পড়েছেন?
—তোবে? দিদিমণি তুমাকে কোতোবার বলতে হবে, আমার ছুটবেলা কেটেছে কোলকাতায়। জোন্মো একানে, কোর্মো— আমদাবাদে।
—চলে গেলেন কেন? কবে?
—সে কোতোকাল আগে কে জানে। বাবাকে চলে যেতে হল। আমাকেও যেতে হচ্ছে, না কী!
—কী ধরনের কাজ করেন আপনি দিদি? মানে সমাজসেবা!
—ছাইয়ের সোমাজসেবা। কিচ্চু করি না। সোব ছুটো ছুটো বাচ্চাদের পোড়ানো খেলানোর বন্দোবস্ত করি। দুঃখী বাচ্চা— হিন্দু, হরিজন, মুসলিম… ব্লাইন্ড, ডেফ অ্যান ডাম, —সাপোর্ট করি। গরিবের হাতের কাজ শিখানো চাই। সেসব বিক্রি করি। সোবোরমতী জানো?
—হ্যাঁ, গান্ধীজির আশ্রম।
—তোবে তো তুমি ভাল মেয়ে। জানো। সোবোরমতী জানে না কোতো! উনি তো লোবোন সত্যাগ্রহের পোর আর গুজরাত ফিরলেন না, ওয়ার্ধায় চলে গেলেন। জানো?
—ওয়ার্ধা নামটা চেনা চেনা লাগছে।
—চিনা চিনা যোথেষ্ট। ডিটেল জানার দোরকার কী!
মিঠু বুঝতে পারল না উনি তাকে তিরস্কার করলেন কিনা।
—তো সে যা হোক, সোবোরমতী প্রোডাক্টস মার্কেটিং কোরবার চেষ্টা করি। বাস।
—আর মানে ওই দাঙ্গা…
—ও তো সারা ভারতের জানা হয়ে গেচে। ওই বাস। গুন্ডা এলিমেন্ট ওস্ত্রশোস্ত্র নিয়ে কাটছে, ভাঙচে, মারচে, মার-খাওয়া লোক পিছনের দোরজা দিয়ে ঢুকাচ্চি। উরা চেঁচাচ্চে, আমায় মেরে ফেলে দিবে। লুঠ কোরবে। বাড়ি জ্বালিয়ে দিবে। আমি শুনচি না। চোপ্। কোরো কী কোরবার। বাস। সোবাই বলতে লাগল কস্তুরী মেহতা বহুৎ কিচু করেচেন। মুসলমান লোকের মেসায়া। মেসায়া কিচু নোয় দিদিমোণি। ওন্যায় দেখলে রুকতে হোয়। আমার টাকা ছে, ফোর্টের মুতুন বাড়ি ছে, সাহস ছে, আমি যদি না করি, কে করবে?
দিদি, কিছু মাইন্ড করবেন না, এটা আপনার আয়রনি মনে হয় না, গান্ধীজি মুসলমানদের জন্য এত করলেন, কলকাতায়, খুলনা, নোয়াখালি, দিল্লি— সব জায়গায়। আর ওঁর নিজের জায়গা গুজরাতেই…
কস্তুরী বললেন— হিস্ট্রি ইজ ফুল অব আয়রনিজ, জানো না দিদিমোণি?