উজান যাত্রা (Ujan Jatra) : আমি ও ওরা
সমাজসেবা আজকাল আর চ্যারিটি ওয়র্ক নেই। রীতিমতো পেড জব। তবে হ্যাঁ, খাটতে হয়। সময়েরও ঠিক-ঠিকানা নেই, কোন জবেই বা আছে! আমি পাশ করার এক বছরের মধ্যেই ভাগ্যক্রমে একটা এন.জি.ও-তে কাজ পেয়ে গেছি। টাকাপয়সা অনিয়মিত। সুতরাং আমিও একটু আধটু অনিয়মিত হতেই পারি। সাহিত্য নিয়ে পড়েছিলাম, কেননা বিজ্ঞানে চান্স পাইনি। তবে বিজ্ঞানে আমার ন্যাক নেই এটা সেন্ট পারসেন্ট সত্যি কথা। না পেয়ে আমার কোনও দুঃখ হয়নি। বাবা বলেছিল— তুই তোর যা ইচ্ছে পড়। বাবা নাকি সাহিত্য ভালবাসত। লিটল ম্যাগট্যাগ করেছে এককালে। বড়রাই বাবাকে জোর করে মেকানিক্যাল এঞ্জিনিয়ার বানালেন। তখন, ষাটের দশকে এঞ্জিনিয়ার উদ্বৃত্ত হতে শুরু করে। অনেকেই চেষ্টা-চরিত্র করে বিদেশ, বিশেষত, আমেরিকা চলে যায়। ওখানে তখন যথেষ্ট চাহিদা। আমার বাবা চাকরি পেল, কিন্তু সুদূর জামনগরে। দাদু ছিলেন, ঠাকুমা খুব রুগ্ণ, তার ওপরে মায়ের একটা খুব ভাল স্কুলে চাকরি ছিল। মাকে থেকে যেতে হয়। সারা জীবন বাবার একলাই কাটল। যা-ই হোক। এত কথা বলা— যা পড়তে চাই, যা করতে চাই— আর যা চাই না কিন্তু করতে হয়— এই বাধ্যবাধকতা যে কত বিরক্তিকর তা বোঝাতে। এতদিন যা পড়েছি শিখেছি তা সরাসরি প্রয়োগ করার তেমন সুযোগ নেই আমার জবে। কিন্তু এই বদলটা আমার মন্দ লাগে না।
কলেজ-ইউনিভার্সিটি জীবন আর তারপরে চাকরি বা বিয়ে যা-ই হোক, সে জীবনটার কেমন একটা সূক্ষ্ম তফাত হয়ে যায়। বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু বদলে যায়। পোশাক দ্যাখো সেই একই, জিনস্ আর টি-শার্ট, চটি কিংবা হিল, চট করে বাস-ট্রাম মেট্রোর হাতল পাকড়ে উঠে যাওয়া যায়। গোঁত্তা খেতে খেতে আঁচল-চুন্নি এসব সামলাতে কি ভাল লাগে! দেখে কেউ বুঝবে না কে ছাত্রী, কে কম্পিউটারবাগীশ, কে অফসর, কে বা অভিসারে যাচ্ছে। আমাদের এই পোশাক নিয়ে বড়দের মহলে একটু রি-অ্যাকশনারিপনা আছে। নীতা তো ওর কেমিস্ট্রি স্যারের বউয়ের কাছে হেভি ঝাড় খেয়েছিল। ওর অবশ্য একটু বেশি বাড়াবাড়ি! এত টাইট পরে যে মডেল, না ছাত্রী, বোঝা যায় না। স্যারের স্ত্রী বলেছিলেন—‘এখানে পড়তে আসতে হলে তোমাকে আর একটু আলগা পরতে হবে। যখন র্যাম্প ওয়াকিং করবে তখন যা খুশি পোরো।’ নীতা এক নম্বরের টেঁটিয়া মেয়ে। এরপরে ও সালোয়ার কামিজ পরে যেতে লাগল। নো ব্রা। স্যারের স্ত্রী বললেন— তুমি বরং অন্য কোনও টিউটর খুঁজে নাও। আমার বাড়িতে আমি বেয়াদপি সহ্য করব না। আর শোনো, অপরিণত আছ, তাই বুঝছ না, কিন্তু নিজের সম্মান নিজের হাতে।
ভোলেভালা স্যারকে নীতা খুব জোকস্ বলত, স্যারও হা-হা করে হাসতেন, তিনি ওর পোশাকের আঁটোমি খেয়াল করেছিলেন কিনা জানি না। তবে নীতা যখন বলে, স্যার আপনার বাড়ি পড়তে আসতে আমার অসুবিধে হচ্ছে, আমার বাড়ি আসবেন? গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে যাব। উনি বলেন, তোমার সাহস তো কম নয়!
নীতা গ্র্যাজুয়েশনের পরেই ফ্যাশন-ক্যাপিট্যাল মুম্বইতে চলে গেল। ঠিক কী করছে এখন জানি না। কে যেন বলছিল কল-সেন্টারে কাজ করছে। কোথায় সুপার মডেল হয়ে রাতারাতি ফ্যাশন-ক্যাপিট্যাল জয় আর কোথায় কল-সেন্টার!
ড্রেস নিয়ে কারও কারও বাড়িতে আপত্তি থাকলে আমাদের বন্ধুমহলে জোর আলোচনা হত। তখন আমরা কখনও আর্টস, কখনও সায়েন্স বিল্ডিংয়ের সিঁড়ির ধাপে বসে তর্কাতর্কি করতাম। কেউ বসেছে সবচেয়ে নিচু ধাপে, তার ঠিক ওপরে হয়তো তিনজন। তারও ওপরে দু’জন। কেউই সোজা হয়ে নেই, একটু এঁকেবেঁকে। নইলে মুখোমুখি হব কী করে! আমি অবশ্য শোনার দলে, মাঝে মাঝে মধ্যস্থতাও করতে হয়, ‘বলি কম, ভাবি বেশি’— আমার এক্স-টিউটর দীপক শর্মার দেওয়া এই ভাবমূর্তিটা বজায় রেখে।
রাজদীপ হয়তো বলল, এই তোরা ফেমিনিন জেন্ডাররা চিরকাল কন্ট্রোভার্সি ক্রিয়েট করে যাচ্ছিস। ফর নাথিং। কী পরবি, কী পরবি না— এটা কি একটা ইস্যু হল?
রৌনক তখন বলবে, আরে ইয়ার, একটু তদন্ত কর, দেখবে এখানেও সেই কজ অ্যান্ড এফেক্টের খেলা।
আমার কৌতূহল হবে। আমি বলব, কী রকম?
জেনারেশন গ্যাপ কারও বাড়িতে কম, কারও বাড়িতে বেশি। এই ধর পিয়া, ওর মা ওর থেকে জাস্ট বিশ বছরের বড়, গ্যাপ কম।
সাড়ে উনিশ— পিয়া শোধরাবে।
হোয়াটেভার… বিশ বছরের গ্যাপ হল হাফ জেনারেশন। পিয়ার মা-ও পেন্টুল পরেছে একসময়ে; কী রে পিয়া?
পিয়া সিগারেট ধরিয়ে বলবে, পেন্টুল ঠিক নয়। প্যারালেলস পরত মা, ছবি আছে। তখন স্লিম ছিল। এখন যা মুটিয়েছে!
তবে? ঠিক বলেছি কিনা! —রৌনক মহা খুশি— কিন্তু এই ধর মধুমিতা। শি ইজ দা থার্ড চাইল্ড অব আ লেট ম্যারেজ। তোর সঙ্গে তোর মায়ের কত গ্যাপ রে মধু?
মধুমিতা মুখ ঝামটা দিয়ে বলবে, তাতে শালা তোর কী?
ওয়েল, আমি পয়েন্টটা এসট্যাবলিশ করতে চাইছি। তোদের পোশাকে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসে গেছে। এনিওয়ে, মধুর মা মাস্ট হ্যাভ বিন ফর্টিজ হোয়েন শি ওয়জ বর্ন। অর্থাৎ কিনা বিগ বিগ গ্যাপ। বাস, পুজোর সময়ে ফ্রি-সাইজ ঢোলকের মতো সালোয়ার কামিজ চলে এল। নববর্ষে টাঙ্গাইল শাড়ি। খিটিমিটি। জিন্স-ফিনস্গুলো কিনতে ওকে লাগাতার ফাইট করে যেতে হয়। কী রে মধু, ঠিক বলেছি?
তুই তো সব জানিস। শেয়াল-পণ্ডিত। টাঙ্গাইল বানান কর তো?
রৌনক খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে হাসতে তিন নম্বর সিগারেটটা ধরাবে।
বিন্দি বলবে, এ ছাড়াও একটা কারণ আছে।
—কী কারণ? কী কারণ?
—শুট ইয়ার।
কেউ হয়তো বলল, এ তো রীতিমতো সোশ্যাল স্টাডিজের রিসার্চ পেপার হয়ে যাচ্ছে! এম. ফিল-এর ডিসার্টেশন। কুইক শেষ কর, লাইনে আরও টপিক আছে বাবা!
বিন্দি বলবে, ইফ য়ু ডোন্ট মাইন্ড, ফ্যামিলি স্টেটাসটা একটা বিগ ফ্যাক্টর। যার বাবা বিগ বস, সে জিনস্ কেন সুট-প্যান্ট, মিনি-স্কার্ট সবেতেই ‘ইয়েস’ পাবে। যার বাবা মাস্টার, তার কেস খারাপ। স্কার্টের ঝুল বাড়াও শাড়ি ধরো। আঠারো বছর বয়স হয়ে গেল… ইটস শোয়িং…
মনীষার বাবা অধ্যাপক। সে তুমুল অট্টরব অগ্রাহ্য করে বাঁকা হেসে বলবে, হ্যাঁ সেটা নামেও মালুম। স্টেটাসে আবার রুচিও বিদায় নেয়। ফেয়ার ওয়েল টু রুচি। আইডেন্টিটি তো আগেই ভোঁ ভাঁ! কী নাম! আ হা হা হা—বিন্দি, জুহি, পিঙ্কি… হ্যাভ নো রেফারেন্স টু ওয়ান’স অরিজিন, ল্যাঙ্গোয়েজ…
—আর রিলিজনটা বললি না? —বিন্দির মুখে হাসি, চোখে ঝাঁঝ।
—তুই-ই বল না। আমি আর কেন কথা খরচ করি! সব তো জানিস!
—ইন্ডিয়ানিজম ইন্টারন্যাশন্যালিজ্ম্ ইয়ার! বঙ্গভাষা বঙ্গসংস্কৃতি বঙ্গসন্তান করতে করতে শেষ পর্যন্ত নির্ভেজাল বং! ওহ। তোরা কবে বুঝবি? এখন ভাষা, সংস্কৃতি, অরিজিন এসব ম্যাটার করছে না। ভুলতে হবে। না ভুললে পৃথিবীর সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে পারবি না। না পারলে পিছোতে হবে, পিছোতে পিছোতে মনু-যুগ-টুগে ফিরে যেতে চাস? নাকি ট্রাইব্যাল বেল্টে ফুড গ্যাদারার হান্টার স্টেজে! অ্যান্ড দেন? অবলিভিয়ন— কেউ আর তোকে চিনবে না, জানতে চাইবে না। শেষ পর্যন্ত জিরো।
এ কথাগুলো বিন্দিরই, না রৌনকের? মনে পড়ছে না।
—ওই তো কতকগুলো কথা শিখেছিস! হিরো। জিরো! যে যা ব্রেনে ইনজেক্ট করে যাচ্ছে, কপচে যাচ্ছিস। বস্তাপচা হয়ে গেছে, বুঝছিস না। ভাবনা-চিন্তা করতে শেখ নিজে নিজে, ফ্রি-থিংকিং। নইলে আমি নাহয় জিরো, কিন্তু তোদের মতো আইডেন্টিটিলেসদের আন্তর্জাতিক বাজারে মর্কট বলে ডাকবে।
মনীষা লাফিয়ে উঠে দাঁড়াবে, কারণ রৌনক বলতে শুরু করেছে, নো পার্সন্যালিটিজ ইয়ার। দিস ইজ নট ডান।
মনীষা চলে যেতে যেতে বলে যাবে, এই যে ‘ইয়ার’টা ধরেছিস রৌনক, এটাও টুকলি। দিল্লি-বম্বে থেকে। নিজেদের ডাক-টাকগুলোও ভুলতে চেষ্টা করছিস পাছে কেউ বং বলে। তবে কী জানিস! যাদের হিরোটিরো বলিস, ‘দাদা’ ডাকটা তাদের সৌজন্যে বেশ মর্যাদালাভ করেছে। অশোককুমার, কিশোরকুমার, হেমন্ত মুখার্জি এঁদের সবাই ‘দাদা’ বলত। এখনকার সৌরভ গাঙ্গুলিকেও টিমের সব ক্রিকেটাররা অঞ্চল-নির্বিশেষে ‘দাদা’ই বলছে। কই বং তো বলছে না! ডিফারেন্সটা কোথা থেকে হচ্ছে, কেন হচ্ছে, নেক্সট সেশনটা এই নিয়েই চালা। কাজে দেবে!
হেভি রেগেছে— বিন্দি বলবে।
মনীষা চলে যাচ্ছে, রৌনকের ইচ্ছে করছে এক লাফে গিয়ে ওকে আটকায়, মনীষা চলে গেলে অর্ধেক চার্ম চলে যাবে আড্ডার। ওর জন্যে।
শুনেছি কলেজে ওরা সব ফার্স্ট বেঞ্চে বসত। ছেলেগুলো পাশের জনকে এইসা ঠেলবে যে তাসের বাড়ির মতো একজন আর একজনের ঘাড়ে পড়তে থাকবে। এবার ঠেলাটা আসবে উলটো দিক থেকে। একদিকে রৌনক আর এক দিকে রাজদীপ, কিংবা পৃথ্বীরাজ। এগুলোই সবচেয়ে বিচ্ছু। মাঝখানে বিন্দি, জুহি, সম্পদ, রীতা সব হি হি হো হো করবে। প্রোফেসর এলেও থামবে না। পাস কোর্সের ক্লাস আবার ক্লাস!
একদিন ওদের প্রোফেসর দত্ত বলেছিলেন, বুঝতে পারছি— এ যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে যে, সে এখনও মাতৃগর্ভে। তবে পরস্পরের স্পর্শজনিত পুলকটাকে একটু সামলে যদি এদিকে একটু মন দাও তো ‘হিটলার-বধ’টা শুরু করতে পারি।
গল্পটা আমার মনীষার কাছেই শোনা।
ইউনিভার্সিটিতে স্বভাবতই একটু ম্যাচিওরিটি এল। বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড বদলে গেল। এ ওকে ডিচ করল, সে তাকে, তারপরে হাত ঝেড়ে বলল, যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে ইয়ার, হাতে হাত মেলাও। এ সময়ে ঠেলাঠেলির জায়গা নিল স-ধূম, স-তরল আড্ডা।
মজা হচ্ছে মনীষার পাশ করার বছরেই এক আমেরিকা-প্রবাসী হাইফাই ভদ্রলোকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল। এক বছর পরে যখন আমাদের আড্ডায় এল, দেখা গেল জিনস্ তো বটেই, টপটাও চোলিকাট। কানে বিশাল বিশাল রিং। ভুঁড়িতেও একখানা রিং লাগিয়ে এসেছে। বিন্দিটা একেন্নম্বরের বিচ্ছু, জিজ্ঞেস করে, কী রে আইডেন্টিটি, বাড়িতে কিছু বলছে না?
—আ’ অ্যাম ওল্ড এনাফ টু থিংক ফর মাইসেলফ— গম্ভীর জবাব।
—আর তোর বঙ্গালি আই ডি কার্ড?
—ঠুনকো নয় যে ভেঙে যাবে। আই ক্যান টেক কেয়ার অব ইট।
প্রস্থান।
আরও মজা হল, বিন্দি প্রেম করে বিয়ে করল এক প্রচুর পয়সাঅলা ভদ্রলোককে। যাকে বলে ম্যান অব প্রপার্টি। বাড়িতে জাঁদরেল শাশুড়ি, দিদিশাশুড়ি। ভদ্র মেয়েরা শাড়ি ছাড়া অন্য কিছু পরে, পান ছাড়া অন্য কোনও নেশা করে— ভাবতেই পারেন না। বিন্দির সিগারেট ঘুচে গেল, জিন্স ঘুচে গেল, হাতের মেহেন্দি ঘুচে গেল। নাম পালটে হল বিনীতা। বিন্দি আবার কী? ফোর্ড আইকনে ফরসা ধবধবে, কালো ঢেউতোলা চুল, বনেদি হাজব্যান্ডের পাশে বসে বিন্দি যায়। হুশ করে চলে গেলেও ওর মাথার সিঁদুর, কপালের ভেলভেট টিপ, শাঁখাসমেত গোছা গোছা সোনার চুড়ি পরা হাত দেখা যায়।
এখন রৌনক, রাজদীপ, আকাশের সঙ্গে দেখা হলে ওরা হাসাহাসি করে। বলে, তোরা কী জানিস? জলের জাত। যখন যে পাত্রে রাখা যাবে তখন সেরকম। হিউম্যান বহুরূপী। পিয়ার-প্রেশারে পেন্টল ধরেছিলি, সিগারেট ধরেছিলি। আবার ম্যারিট্যাল প্রেশারে শাঁখা-সিঁদুর ধরেছিস।
আমি বলি—অ্যাডজাস্টমেন্ট। একে বলে অভিযোজন। সার্ভাইভ করতে গেলে কখনও রোঁয়া গজাতে হয়, কখনও ঝরিয়ে ফেলতে হয়। আসল কথাটা দাঁড়াচ্ছে—সারভাইভ্যাল।
কে কী রকম সারভাইভ্যাল চাইছিস সেটাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন— রৌনক দাঁতে নখ কাটে। ও কিছুতেই ভুলতে পারে না রুচি-পোশাক-কালচার এগুলোই মনীষার সঙ্গে ওর খেচাখেচির প্রধান কারণ ছিল।
আমি এসব ব্যাপারে দর্শক-শ্রোতার ভূমিকায়। ওদের সঙ্গে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে আলাপ। আমি শুনি বেশি, বলি কম। আমার টিউটর দীপকদা বলতেন— তোমার টেম্পারামেন্ট একেবারে আদর্শ। ঝড়-জঞ্ঝা চট করে কাটিয়ে উঠতে পারবে। লোকে তোমাকে বিশ্বাস করবে, ভরসা করবে। সত্যি বলতে, কতকগুলো কথা সত্যিই মিলে গেছে। কার কী অবসেশন যাচ্ছে, কে কার জন্য দৌড়োচ্ছে— এগুলো আমি চট করে বুঝতে পারি। যার যা প্রবলেম, মনের-প্রাণের কথা, বন্ধুরা বেছে বেছে আমাকেই বলে।
রৌনক মনীষার জন্য ফিদা। বিন্দি বহুদিন ধরে রৌনককে চেজ করে যাচ্ছে, নাথিং ডুয়িং। অর্পিতার মায়ের অ্যাফেয়ার। বুল্টু নিজের চেয়ে পাঁচ বছরের বড় পাড়ার দিদির জন্য দিওয়ানা— এসব আমাকে শুনতে হয়। শুনি। মতামত চাইলে দিই। সে হিসেবে মেলা কাউন্সেলিং করতে হয় আমায়। শুধু প্রেম নয়। পার্থর বহুবার পড়া জিনিস পরীক্ষার সময়ে গুলিয়ে যায়, রমিতা ওয়ান টু ওয়ান কথা বলতে অসুবিধে বোধ করে না, কিন্তু দল হলেই আড়ষ্ট; আত্মসচেতন হয়ে যায়। কৃষ্ণার ভেতর নিজের বোনের ওপর কেমন একটা ঘৃণা, বিদ্বেষ জন্মাচ্ছে। মলয়ের ধারণা ওর বাবা-মা ওকে দেখতে পারেন না। হাজারখানা। সব বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে।
তবে সব ঝড়ঝাপটা আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। মায়ের মৃত্যু ভেতরে ভেতরে কোথাও আমাকে অবশ করে রেখে দিয়েছে। এবং দীপকদার বিশ্বাসঘাতকতা আমি ক্ষমা করতে পারিনি। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলেন। যখন এম-এসসি পড়তেন তখন ম্যাথস-সায়েন্সের জন্য আমাদের বাড়ি ঢোকেন। ওঁর বাড়ির অবস্থা ভাল ছিল না। প্রচুর পড়তেন, জানতেন। শুধু অঙ্ক বা বিজ্ঞান নয়, সাহিত্য, ইতিহাস সবই। আমি যা শিখেছি তার অর্ধেকের বেশি শিখেছি ওঁর কাছে। এরকম একজন টিচারকে টিন-এজ ছাত্রী হিরো-ওয়রশিপ করবেই। এক ধরনের ভালবাসাই তো! আমিও বেসেছিলাম। মুখে কখনও বলিনি। আসলে বাবা কর্মসূত্রে জামনগরে থাকতেন। আমি আর মা এখানে। আমার বোধহয় একটা ফাদার-ফিগার দরকার ছিল। দীপকদা কিন্তু ঠারে-ঠোরে বলতেন অনেক কিছু— বুঝলে মিঠু, আমি অনেককে পড়িয়েছি, পড়াই। জানোই তো, নইলে আমার চলে না। কিন্তু তুমি আলাদা। তুমি আমার গ্যালেশিয়া। তোমার ওই কচি কলাপাতা রঙের আঙুল আর শুকতারা কুচির মতো চোখগুলো ছাড়া বাকি তোমাকে আমিই তৈরি করেছি। তোমার ওপর আমার অধিকার আগে। কতজনের সঙ্গে পরিচয় হবে, কতজন মানে ইয়ে… কিন্তু ভুলো না।
আমি ভুলিনি। কিন্তু দীপক সেনশর্মা কোনও এক বড়লোক শ্বশুরের টাকায় ইংল্যান্ড যাবার লোভ সামলাতে পারলেন না। আমাকে তো ছাড়লেনই, কিন্তু যে বউয়ের বাবার পয়সায় বিলেতে গেলেন তাকেও রাম ঠকান ঠকালেন। মার্কিনি মেমসাহেবের সঙ্গে লিভ-টুগেদার, বাঙালি বউকে তালাক, আর এক মেমসাহেবকে বিয়ে করে মার্কিন নাগরিক, হুজ হু-তে নাম লেখানো, বিখ্যাত গবেষক, অধ্যাপক, ও বিখ্যাত দুশ্চরিত্র হতে ওঁর বছর তিনেকের বেশি সময় লাগেনি।
বাড়ি ফিরতে দশটা। বাবা বারান্দায় বসে ঢুলছিল। ভি. আর. এস নিয়ে অবধি পিতৃদেবের মনমেজাজ ভাল নেই। টিভিটাও তো দেখলে পারে, সময় কেটে যায়। গল্পের গোরু কীরকম তাল গাছে উঠে যায়, ঝানু ব্যাবসাদার না দেখে দলিল সই করছে, প্লাস্টিক সার্জারি করে খালি মুখ নয়, দেহের কাঠামো, কণ্ঠস্বর অবধি বদলে যাচ্ছে, ক্যাসেট করা দুষ্কৃতীর শয়তানি গলা শুনেও নিজেদের বাড়ির মা-বউকে লোকে বিশ্বাস করছে না, একজনের জায়গায় অন্য একজন বাড়ির বউ হয়ে বসে গেছে বন্ধুর কথা রাখতে, প্লাস্টিক সার্জারির হরেক ব্যবহার। প্রচুর চিঠি লেখে বাবা ইংরেজি-বাংলা কাগজে। কোথাও একটা অঘটন ঘটল— অমনি চিঠি। কেন অমুক খুনের কিনারা আজও হল না। ফিল্মি হিরো গাড়ি চাপা দিয়ে মানুষ মেরেও কী করে এখনও বিজ্ঞাপনে মাস্ল্ ফোলায়, হাসপাতালে কুকুর কেন…। ‘মিসেলেনি’তে বাবা দিব্য একটা প্রবন্ধ লিখতে পারত— ‘দা ডিফরেন্ট ইউজেস অব প্লাস্টিক সার্জারি ইন হিন্দি সিরিয়্যাল্স্! হাউ দে এনটারটেন অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপ্ল্!’ তা করবে না। খালি আমার পথ চেয়ে আর কাল গুনেই কাটিয়ে দেবে।
এদিকে, আমার যে প্রেম চটকে গেল, আইডলকে ক্রমশ একটি বিশুদ্ধ লম্পট ধাপ্পাবাজে বদলাতে দেখে আমার মধ্যে যে কতকগুলো টেকটনিক প্লেট সরে গেছে, আমার ভেতরের ভূগোলই পালটে গেছে; যতই বাবাকে ভালবাসি, আমি যে এখন এন্টায়ারলি লিবারেটেড ফিমেল, তা বাবা বুঝবে না। স্যরি মি. সেনশর্মা। আপনার সব রিডিংগুলো মিলল না। নিজের বাবাকেই বুঝতে চাইছি না।
বাবা নীচে নেমে দরজা খুলে দিল।
কী রে? এরপর পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকিস। এত রাত অবধি জেগে থাকা আমার পোষায়?
এত রাত! মোটে তো দশটা! এগারো-বারো হলে কী করবে?
—সে ভদ্রমহিলা পৌঁছোলেন? —আর কথা বাড়ায় না বাবা। মেয়েকে বেশ ভয় পায়।
—হ্যাঁ, ওঁকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এলাম। ট্রেন খুব লেট।
—তা একটা ফোন করে দিতে কী হয়েছিল? ভাবছি!
—শুধু কি ট্রেন লেট! উনি আবার আদর্শবাদী টাইপ। কিউয়ে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি নিলেন। জ্যাম-ফ্যাম পেরিয়ে যখন ফার্ন রোডের বাড়িতে পৌঁছে দিলাম, বাড়িময় ঘুরে ঘুরে রোমন্থন করলেন, তারপর আমাদের গলদঘর্ম বসিয়ে রেখে নিজে আচ্ছা করে চান করলেন, তারপর আবার না খাইয়ে ছাড়লেন না।
—প্রথম দিন এসেই? বাড়িতে লোকজন মজুত, না কী?
—কেয়ার-টেকার, হিন্দুস্থানি। ডাল, রোটি, রসগুল্লা…
—বেশ করেছ, এখন খাবারদাবারগুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে শুয়ে পড়ো।
চানটান করে শুতে আমার একটু দেরি হল। জানলার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা আমার বহুদিনের প্রি-ঘুম অভ্যেস। লাল তারাটা জ্বলজ্বল করছে। মেঘের মতো ভেসে যাই আকাশপাতাল ভাবনায়। দীপক শর্মা সুট পরে এসে দাঁড়িয়েছে— এটা করালাম মিঠু, কেমন হয়েছে? মায়ের সঙ্গে ভোরে স্কুল যাচ্ছি। টিফিন বাক্সটা খুলে পড়ে গেল। যাঃ। কী মেয়ে রে তুই? মা পয়সা দিচ্ছে— আজকের দিনটা চালিয়ে দাও। আজেবাজে জিনিস খাবে না কিন্তু। হরেক রঙের একটা বিরাট তাঁবু, এত বড় যে গোটা পৃথিবীটাই বোধহয় তার ভেতরে ধরে যায়। একজন ক্লাউন নানা কসরত দেখাচ্ছে। আসল খেলোয়াড়রা পুরো জায়গাটা জুড়ে দেখাচ্ছে। ও দেখাচ্ছে এক পাশে। বাঁটুল, গালে হলদে, কপালে লাল, থুতনিতে নীল, আর নাকের ডগাটা কটকটে সাদা, বোধহয় নাকে একটা টুপিও পরেছে। এখন, জরির জামা গায়ে ওই খেলোয়াড়গুলোই আসল? নাকি ওই ক্লাউনটা? কাকে যেন জিজ্ঞেস করি, সে ঘাড় নেড়ে বলে, উঁহুঃ, বড় শক্ত প্রশ্ন। হালকা ঘুমের মধ্যে মেঘ ভেসে যায়, কে যেন বলে ওঠে— ছুটোবেলাই সব বেলা।
আমার অনেক কথা থাকে। কিন্তু আমি কাউকে বলি না। বাবাকে পর্যন্ত না। কেননা, সকলেই দেখি নিজের কথা বলতে ভালবাসে। আমি মৈত্রী, মিতু, অনেকেই মিঠু বলে। আমার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে আমার কতকগুলো গবেষণা আছে। সত্যি কথা বলতে কী, আমি যেন ওদের একটু আড়াল থেকে দেখি, চোখ রাখি। তাতে আমার একটা সুবিধে হয়। বলতে পারা যায়, এটা আমার হবি। যা দেখছি, তা থেকে যা ভাবছি, সেটা মনের মধ্যে রেকর্ড করা রইল। এবার ফলেন পরিচীয়তে। অদূর ভবিষ্যতে চরিত্র ও ঘটনা একটা নির্দিষ্ট দিকে বাঁক নিল, ধরুন। তখন আমার সিদ্ধান্তগুলো আমি যাচিয়ে নিতে পারি। কতকগুলো মেলে, কতকগুলো মেলে না। মনীষারটা যেমন একদম মেলেনি। ও কোনওদিন ভুঁড়িতে উলকি এঁকে, নাভি থেকে আংটা ঝুলিয়ে দেবে আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। রুচি, স্বদেশিয়ানা, একটু রক্ষণশীলতা, সীমাবোধ তো ওর ছিলই। আমি ওকে সোজাসুজি কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। রৌনকদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর ও-ই একদিন আমাকে ফোন করল। — মিঠু আসবি? আয় না রে। গেলাম। গিয়ে অবশ্য একটু কড়কানি দিলাম, নইলে মান থাকে না। —কী ভাবিস বল তো! আমার কাজ নেই?
বকিস না, বকিস না, দ্যাখ না তোকে কেমন পকোড়া আর আসলি বিন থেকে তৈরি কফি খাওয়াই!
হ্যাঁ, তোর কফি না খেলে তো আমার ঘুম হচ্ছে না!
রাগ করেছিস আমার ওপর? নারে?
তুই আমার কে, যে তোর ওপর রাগ করব?
মনীষা ওর পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লম্বা বডিটা আমার কোলের ওপর ফেলে দিল।
তুই বিশ্বাস করতে পারবি না এই ট্যাটু আর রিং ওখানে এখন কী রেটে চলছে! আমার বরের বন্ধুর বউরা, বান্ধবীরা সব কিছু-না-কিছু এসব করছেই।
খুব ভাল, এখানেও তো প্রেশার ছিল। তোকে তো কেউ কাত করতে পারেনি!
এখানে আমার পরিবেশ ছিল মিঠু। মা-বাবা ছিলেন, তাঁদের ভ্যালুজ ছিল। ওখানে কী আছে? কে আছে? আমার বর ছাড়া? সে বহুদিন ওখানে। এসব পছন্দ করে।
তা হলে তো আরও চমৎকার। নিজের ইচ্ছেয় কিছু করিস বুঝি। এতদিন নিরামিষ্যি খেয়েছিস এখন একটু কাঁকড়ার ঝাল খেতে সাধ গেছে। কিন্তু যাক গে আমাকে এত কৈফিয়ত দিচ্ছিস কেন?
একটু চুপ করে থেকে মনীষা বলল— হয়তো নিজেকেই দিচ্ছি। হয়তো নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করছি। মা-বাবার ইচ্ছে ছিল না এখানে বিয়ে দিতে। অমিত আমাকে প্রথম দেখেই কাত। —আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি, প্লিজ। তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না। আইল গিভ য়ু হোয়াটেভার য়ু ওয়ন্ট। ভুলে তো বিয়ে করলাম। তারপর নতুন দেশ দেখার আনন্দে মাতোয়ারা। তারপরে আস্তে আস্তে প্যান্ট, টপ— এখনও শাড়ি আর টিপ দেখলে ওখানে বাচ্চারা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। একদিন আমার আঁচল এসক্যালেটরে আটকে গিয়েছিল জানিস! কী আতঙ্ক! তো তক্ষুনি একজন সুইচ বন্ধ তো করে দিলই। আমাকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিল। শাড়ি খুলে কোথায় চলে গেছে। পা মচকে গেছে, দিশাহারা, লজ্জায় হতভম্ব, ইন মাই ব্লাউজ অ্যান্ড পেটিকোট। ওরা যখন আমার বরের নম্বর চাইল, দিতে বাধ্য হলাম, অত কিছু ভাবিওনি। কিন্তু সেই থেকে ও গম্ভীর হয়ে গেল। ড্রেস পালটালাম। দিবারাত্র আনস্মার্ট বলে আমাকে, যেটা চাইবে সেটা না করলেই মুখ গোমড়া। আর করলে কী আদর, কী ভালবাসা। আদারওয়াইজ, কোনও পার্টিতে ও আমাকে জাস্ট ডাম্প করে দিয়ে চলে যাবে। কী করি বল— ড্রেস বড়, না স্বামী বড়?
বলতে পারতাম, ড্রেসটা নয়। কিন্তু তোমার বর তোমাকে এক ড্রেসে ভালবাসবে আর এক ড্রেসে বাসবে না, এটা… এটা কী করে মেনে নেওয়া যায়?
শুধু বললাম— তোর যা ইচ্ছে হয় কর না, কে কী বলল তাতে কী আসে যায়! তবে ও রকম আউট অব ক্যারেকটার ড্রেস করে বন্ধুমহলে না গেলেই পারতিস। ব্রাভাডো! না কি!
হতে পারে। নিজেকে নিজেই সব সময়ে বুঝে উঠতে পারি না।
বিন্দির ব্যাপারে আমার তেমন কোনও বিস্ময় হয়নি। ও মেয়ে অত্যন্ত ধড়িবাজ। যা চায় তার জন্য ভোল বদল ওর কাছে কিছুই না। ও-ই আস্তে আস্তে ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেদের, বিশেষত বরের রুচি পালটে দেবে। ধীরে ধীরে। জানি না। আমার ধারণা এই। ভবিষ্যৎই বলবে আমি ঠিক কিনা।
আমাদের এই বাড়িটা খুব অসুবিধেজনক হয়ে উঠেছে। যখন এদিকে ধুধু সব খালি জমি বেশ কম দামে বিক্রি হচ্ছিল, দাদু কিনে রেখেছিলেন। বোধহয় ষাটের দশকের গোড়ায়। দাদু যখন তিন কাঠার ওপর দোতলা বাড়িটা করলেন আশেপাশে গাছগাছালির জন্যে কিছুটা ফাঁকা রেখে, তখনও চারপাশ ধুধু। নারকেল, অশ্বথ, জারুল, অমলতাস ছিল চতুর্দিকে। গ্রামের মেয়েদের মতো অনেক গাছপালা চিনি আমি। পাকুড়, পুটুস, ঢোলকলমি, ভাঁটফুল। এই বাড়িতে আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল, এখান থেকেই রামকৃষ্ণ মিশন সেবাসদনে গিয়ে মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন। যখন চোখ ফুটল, তখনও অনেক ফাঁকা দেখেছি, আশেপাশে বাড়ি উঠছিল, আমাদেরই মতো দোতলা, দেড়তলা। পাশের প্লটটা ছিল বিরাট। একটা আমলকী গাছে এত আমলকী ফলত যে আমরা কাছাকাছি বয়সের সব ছেলেমেয়েরা আমলকী কুড়োতাম— শম্পা, অত্রি, দুর্জয়, সায়ন্তনী…। আমলকী কুড়িয়ে দুর্জয়ের ঠাকুমাকে দিতাম। উনি সেগুলো জিরে জিরে করে কেটে রোদে শুকিয়ে ছোট ছোট শিশিতে ভরে আমাদের দিতেন। ফুরিয়ে গেলেই আবার। দাদু বলতেন— আমলকীকে কবিরাজিতে কী বলে জানিস তো?— অমৃতফল। খেলে নীরোগ, দীর্ঘজীবন লাভ হয়। আমাকে রোজ একটা করে কাঁচা আমলকী ভাতে দিয়ো তো বউমা! সারা শীতকাল দাদু আমলকী ভাতে খেতেন। দাদু বেশ ফরসা ছিলেন। আমাদের লোভ দেখাতে বলতেন, এই দ্যাখ আমলকী খাই বলেই না রক্ত পরিষ্কার, রং পরিষ্কার। তবে ফরসা হবার লোভ দেখিয়েও আমলকী ভাতে তিনি আমাকে খাওয়াতে পারেননি।
ওই প্লটটাতে একটা মাল্টি-স্টোরিড কমপ্লেক্স হয়েছে এখন। জি প্লাস ফোর। হয়তো রোদ হাওয়া ততটা আড়াল করেনি, কিন্তু আমাদের গাছ, মাঠ, ফুল, খেলা, ছোটবেলা সবই কাটা পড়েছে। ভীষণ বাঁধা-বন্দি লাগে নিজেদের। অতটা অবাধ ছিলাম বলেই হয়তো। বাড়িটার নাম ‘মহানন্দা’, আমরা বলি ‘নিরানন্দা’।
‘নিরানন্দা’তে থাকে শুভজিৎ। কলেজে একসঙ্গে পড়েছি। তখন থেকেই ওর বিদঘুটেমির জন্যে সবাই ওকে শুভ থেকে অশুভ বানিয়ে দিয়েছিল। লোকের পেছনে কাঠি দিতে ওস্তাদ। নধর গোলগাল ভুঁড়িয়াল চেহারা, কিন্তু বেশ করিতকর্মা। আমি চান করে মাথায় তোয়ালে জড়িয়ে বারান্দায় গাছে জল দিচ্ছিলাম, নীচ থেকে হাঁক মারল, এই মিতু কাতুকুতু।
আমিও বলি, কী রে অশুভ! এই সাতসক্কালে মুখখানা দেখালি তো?
—নীচে নেমে আয় না একবার!
—দেখছিস না জাস্ট চান করে বেরিয়েছি!
—তো কী! কবে থেকে আবার পরদানশীন হলি? না কী বলে তোদের ওই সমস্কৃতে অসূর্য… অসূর্যম্….
—চেষ্টা করিসনি— বরং শোয়ার্ৎজনেগার কিম্বা ব্রবডিংনাগ বল, পেরে যেতেও পারিস।
—কী আমার পণ্ডিত এলেন রে, মাথায় টিকি কই? নর নরৌ নরাঃ।
—এই অশুভ, ব্যাপারটা কী জানিস, টিকি ইজ নট নেসেসারি, বিজ্ঞানে পণ্ডিত হলেও তাকে পণ্ডিত বলে, এমনকী গানবাজনায় হলেও— পণ্ডিত রবিশঙ্কর, পণ্ডিত ভীমসেন যোশী…. শুনেছিস নিশ্চয়ই। আমার মাথায় টিকি নেই। কিন্তু তোর মাথায় শিং থাকতে পারে, পাতলুনে ল্যাজ, জুতোয় ক্ষুর… পরশুরাম কোট করছি। বুঝতে পারছিস তো?
—চিনি না আবার। সেই ব্যাটা রাজাগুলোকে দা দিয়ে কেটে ফিনিশ করে দিয়েছিল, বাবার কথায় মাকে সুদ্ধু কেটে ফেলে।
—বাঃ, অনেক জানিস দেখছি। তবে এ পরশুরাম সে পরশুরাম নয়। ইনি রাজশেখর বসু, পরশুরাম ছদ্মবেশে দারুণ দারুণ লিখতেন। আর দ্যাখ নর নরৌ নরাঃ-টা যখন জানিস তখন গর্দভঃ গর্দভৌ গর্দভাঃ-টাও শিখে রাখ। দেখিস আবার, দ ভ পরপর উচ্চারণ করতে পারবি তো?
—না পারলে? —শুভ এখনও খুশমেজাজ।
—না পারলে? ‘চুনে জল দিলে চুন তাজা হয়’ তাড়াতাড়ি উচ্চারণ করবি। চুন মানে লাইম, জলটা ফর্চুনেটলি জানিস। আর তাজা হল তা যা।
ক্লাস লেকচার দিয়ে দিলি যে রে! এস. এম-কে মনে পড়ে যাচ্ছে। হাউ বোরিং!
এস. এম.-এর সঙ্গে আরেকটা এস যোগ কর। পাঠাচ্ছি মেসেজটা। নিয়ে নে— শ্যালো মোরোনিক শিপ।
লম্বা চুলে পনিটেল, মোটকা শুভ বলল, ওরে বাবা রেগে আগুন তেলেবেগুন হয়ে আছিস যে রে!
—রেগে আগুন তেলেবেগুনটা জানিস তা হলে? কোথায় আছে বল তো?
—হে হে।
—বলতে পারবি না। সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’-এ ‘গোঁফ চুরি’-তে। বেগুন কী জানিস তো? ব্রিঞ্জাল? না বাইগন? গন উইথ দা উইন্ড! আমি আর দাঁড়াই না। সত্যিই রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।
শুভটাকে দেখলেই, বলা উচিত নয়, রাগে আমার গা জ্বলে যায়।
যেমন ফরসা, তেমন নাদুস, তার ওপর চুলে একটা পনিটেল। সব সময়ে আমাকে খোঁচাবে। অপরাধের মধ্যে বি.এ. পর্যন্ত আমার সংস্কৃত ছিল। কমপ্যারেটিভ লিটরেচারে এম.এ.-তে তার জন্যে এক্সট্রা সুবিধে তো কিছুই পেয়েছিই!
ওমা! শুভটা দেখি ভেতরে ঢুকে এসেছে। বললে, ভুলে গিয়েছিলাম বুঝলি, তুই হলি গিয়ে ‘নারী নারৌ নারঃ।’
—নারী, নার্যৌ নার্যঃ। আমি সংশোধন করে দিই। বলি, তুই কিন্তু জলম জলে জলানি।
—মানে আমি জল? আহ প্রাণটা ভরে গেল রে! জল দাও আমায় জল দাও।
—জলটা মিন করিনি। লিঙ্গটা মিন করেছি। নিউটার জেন্ডার। যাঃ যা দিকিনি।
—তুই আমাকে যা খুশি তাই বলবি তাই বলে, কালিন্দী? —শুভর গলায় ঝাঁজ।
—যা খুশিটুশি বলিস না। নিউটার জেন্ডারকে যা খুশি বলে দ্যাখ না ইন পাবলিক। তোকে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন পাঠিয়ে দেবে। দে আর অলসো হিউম্যান, রাইটস আছে আমাদের মতো।
—তা হলে আমাকে ‘নিউটার জেন্ডার’ বলে অপমান করলি কেন?
—স্যরি, এখন দেখছি ওদেরই অপমান করেছি। মানুষকে জানোয়ার বললে যেমন জানোয়ারদের অপমান করা হয়!
—তোর বড্ড বাড় বেড়েছে কালী। ভারী একটা চাকরি পেয়েছিস! এন. জি. ও-র চাকরি আবার চাকরি! ফরেন ফান্ডে ফুটানি। সমাজসেবার ছদ্মবেশে জোচ্চুরি!
—বাঃ বেশ ভাল বলে ফেলেছিস তো! না রে তোকে ক্ষমা করে দিলাম। এবার নিশ্চিন্ত মনে তোর সেলুনে যা, মানে ভ্যারেন্ডা ভাজ গে যা।
বাবা চৌকাঠের ওপর দাঁড়িয়েছিল। বলল, কী অসভ্যের মতন ঝগড়া করতে শিখেছ মিঠু! ছিঃ।
এইভাবে ঝগড়া করতে না শিখলে এদের সঙ্গে লড়ে বাঁচতে পারব না বাবা। প্লিজ, তোমার পুরনো ভদ্রতার কনসেপ্টগুলো আমার ওপর চাপিও না।
একটা জিনিস আমার অদ্ভুত লাগে। কত রকমের শ্রেণীবিভাগ আমাদের এই জেনারেশনের মধ্যেও! ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির তফাত তো হবেই। সেটা স্বাস্থ্যকর। যে মেয়েরা প্যান্ট পরে সিগারেট গাঁজা খায়। যারা অন্য কিছু পরে, ওসব খায় না। যাদের মায়েরা চাকরি করেন, যাদের মায়েরা করেন না। যারা সায়েন্স পড়ে, যারা আর্টস পড়ে, টেকনিক্যাল স্কুল, এঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি, ফ্যাশন ডিজাইনিং, হোটেল ম্যানেজমেন্ট, এম. বি. এ., আই টি— সব কিছুর একটা অদৃশ্য গোপন রেটিং আছে। জেনারল সায়েন্স ও আর্টসের ছাত্র-ছাত্রীরা অচ্ছুৎ হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক সময়ে এই সমস্ত রেটিং সত্ত্বেও দু’জন আলাদা বৃত্তের কারও সঙ্গে কারও প্রবল বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তবে সবচেয়ে আকচাআকচি বাংলা মিডিয়াম ইংলিশ মিডিয়ামে। ইংলিশ মিডিয়াম ‘বাংলা স্কুল’কে দীনহীন পারিয়া, নিম্নশ্রেণী, ন্যুইসেন্স ইত্যাদি মনে করে। বাংলা’রাও ইংলিশদের ভাবে নাক-উঁচু, ক্রীতদাস মনোভাবাপন্ন, আপস্টার্ট নকলনবিশ, মৌলিকতাহীন। সিংহচর্মধারী গর্দভ। একই প্রজন্ম, শিক্ষাপদ্ধতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে উভয়েই, উচ্চাকাঙক্ষার ধরনটা আলাদা হতে পারে কিন্তু উভয়েই ভালভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়। নিশ্চয়, এখনও পর্যন্ত সৎভাবেই এই বাঁচতে চাওয়া। অথচ এত এত দূরত্ব! বাবা বলেন— আমাদের সময়ে গুটিকয়েক মিশনারি স্কুল ছাড়া ইংলিশ মিডিয়াম তো কই ছিল না! কিন্তু আমরা গোড়ার থেকেই ইংরেজি পড়তাম। ইংরেজি ক্লাসে গ্রামার, ট্রানস্লেশনের মধ্যে দিয়ে প্রচুর শিখতাম, উচ্চারণ হয়তো ফিরিঙ্গিদের মতন হত না। কিন্তু তাতে কোনও অসুবিধে হত না। অনেকে চমৎকার অ্যাকসেন্ট রপ্ত করেও নিতেন।
ইউনিভার্সিটিতে শিখরিণী বলে একটি দারুণ সুন্দরী মেয়ে পড়ত। কোনও মফস্সলি রাজপরিবারের মেয়ে, সম্ভবত রানাঘাট। মফস্সলের শুনেই অনেকের নাক বেঁকে গেল। রানাঘাটে পড়াশোনা করেছে? এহ্, মেয়েটার ইহকাল পরকাল দুই-ই গেছে। ছেলেদের ক্ষেত্রে এটা অবশ্য ওপর ওপর। ভেতরে ভেতরে খুব উৎসাহ। চলাফেরা করে দুর্গাপ্রতিমার মতো। সরু কোমর, চমৎকার মসৃণ গলা, আর তার ওপরে একটা অপূর্ব মুখ, কোনওখানে কোনও খুঁত নেই। সে এদের একটু ঘা দিতে পেরেছিল। একদিন ক্যাম্পাস দিয়ে যাচ্ছে, আকাশ পেছনে থেকে ডাক দিল— শিখা, শিখা—
শিখরিণী যেমন চলছে চলতে লাগল। ধনেখালি শাড়ি পিন করে পরা। লম্বা চুলে মোটা বিনুনি। কপালে ছোট্ট টিপ, হাতে বালা, কানে কুণ্ডল, গলায় হার। একেবারে সালংকারা।
আকাশ ছুটে সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তখন থেকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছ না? শিখরিণী অবাক। কখন ডাকলে? কে যেন শিখাকে ডাকছিল!
—তুমিই তো শিখা? অত বড় নামে কাউকে ডাকা যায়!
—তাহলে ডেকো না!
—কী আশ্চর্য, আমরা তো সবাই সবাইকে শর্ট নামে ডাকি— রণজয়কে বলি রনি, রোহিতকে রোহু, আমাকে ওরা বলে আক।
—রোহু মানে রোহু ফিশ, রুই মাছ, আর আক কি আখ? না চন্দ্রবিন্দু দিয়ে চেঁচাবার?
প্রথমে বেচারি বুঝতে পারেনি, তারপরে বলল—কী আশ্চর্য! এইটুকু শর্টনিং অ্যালাও করবে না? ক্রিকেট টিমে তো সব টিমমেটের এরকম একটা শর্ট নেম থাকে। থাকত চিরদিনই। সুনীল গাভাসকরকে সানি। বীরেন্দ্র সহবাগকে বীরু। হরভজনকে ভাজ্জি, যুবরাজ সিংকে যুবি। শিখরিণী দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল, চোখে কোনও ভাবান্তর নেই।
—এইটেই এখন চলছে।
শিখরিণী বলল, আমার নামটার মানে জানো?
—শিখ শিখ শিখর—আই সি, পিক—ইট মিনস পাহাড়।
—রং। শিখরিণী মানে প্রথমত খুব সুন্দরী। দ্বিতীয়ত, আমার মনে হয় মানেটা শিখরচারিণী, ঝরনা। একটা ছন্দেরও নাম। সংস্কৃত ছন্দ অবশ্য। রোহিত রুই মাছ হয়ে আনন্দলাভ করতে পারে। তুমি আখ হয়ে সুমিষ্ট আহ্লাদ অনুভব করতে পার। রনি ডাকলে রণজয়ের মনে হতে পারে সে কোনও নীলচোখ সাহেবছানা। কিন্তু আমি শিখরিণী। শিখরিণী থাকতেই ভালবাসি। পিওর অ্যান্ড সিম্পল শুদ্ধ তৎসম— তার ছন্দত্ব ও ঝরনাত্ব নিয়ে। বড় নামে যদি ডাকতে না পারো ডাকবে না। আমি কি তোমাকে বলেছি ডাকতে?
শিখরিণী চতুর্দিকে চোখ ধাঁধানো রূপ ছড়িয়ে চলে গেল। আমি মনে মনে হাসি। বলি, জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী/অভয়াশক্তি বলপ্রদায়িণী, তুমি জাগো।
এইসব অসুরদের দলনের জন্য এইরকম দুর্গাই দরকার ছিল।
পরে শিখরিণীর সঙ্গে আমার বেশ আলাপ হয়ে যায়। শুনি ও নাকি মিস রানাঘাট, পরে একেবারে মিস নদিয়া হয়েছিল। আশ্চর্য নয়। এখন মিস ক্যালকাটা হয়ে যেতেই পারে। তবে নেংটি পরে স্টেজে দাঁড়িয়ে আগ-গলুই পাছ-গলুই দেখাতে বোধহয় ও রাজি হবে না। কিন্তু আসল কথাটা হল ও বাংলা আর সংস্কৃত দুটোই সাংঘাতিক ভাল জানে। ওর দাদু ছিলেন সংস্কৃতে স্কলার। রীতিমতো গবেষক। নাতনিকে পড়িয়েছেন ছোট থেকে। শব্দতত্ত্ব নিয়েই তাঁর কারবার। ভাষার ভিতটা নাতনির উনিই করে দিয়েছেন।
শিখরিণী বলছিল, সাধারণ বাংলা-মাধ্যম স্কুলে, বিশেষ করে সরকারি স্কুলে সত্যিই আজকাল কিচ্ছু হয় না। কিচ্ছু শেখানো হয় না, না ইংরেজি, না বাংলা, না সংস্কৃত, না ডিসিপ্লিন— বিশেষ করে ভাষা আর সাহিত্য জ্ঞান ভীষণ অশুদ্ধ। জার্মানিতে বলছে সংস্কৃত সবচেয়ে যুক্তিশীল ভাষা, কম্পিউটারের উপযুক্ত, এরা তাকে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছে। বাংলা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। এখন স্কুলে স্কুলে বাচ্চাদের শেখানো হচ্ছে বাংলা কোনও কাজে আসে না, ও না শিখলেও চলে এবং অন্যান্য প্রদেশের খুদে পড়ুয়ারা বাঙালি বাচ্চাদের বলে— এ বঙ্গালিবাবু রসগুল্লা খায়গা, চাবল বন জায়গা, মছলি খায়গা, বদবু নিকালেগা। বাচ্চাগুলো নিজেদের বাঙালি বলতে লজ্জা পায়। —এই হল আমাদের স্বাধীন ভারত।
আমি বলি, তুমি এত কী করে জানলে? রানাঘাটেও এরকম ঘটছে নাকি?
—ঘটেনি, ঘটবে। আমি এখানে আমার মামার বাড়ি আছি তো! লোক্যাল গার্জেন। ছোটমামার ছেলের মুখ থেকে শুনি। মামিমারাও তো ভীষণ বাংলাবিরোধী। বলেন— বাংলা চাকরি দেবে? স্মার্টনেস দেবে? লড়াই করবার প্রতিযোগিতা বাড়ার শক্তি দেবে? বাংলা পড়লে পিছিয়ে পড়তে হয়।
—যা ব্বাবা। একেবারে পড়লেই পিছিয়ে পড়তে হবে? তা তুই কী বলিস?
কী বলব? প্র্যাকটিক্যাল দিক থেকে দেখতে গেলে কথাগুলো তো সত্যি। যে সময়টা বাংলার পেছনে দেবে সে সময়টা বিদেশি ভাষার পেছনে দিচ্ছে। সাহিত্যে সময় না দিয়ে সায়েন্সে দিচ্ছে। তুমি লীলা মজুমদারের ‘পাকদণ্ডী’ পড়েছ?
আমি অপ্রতিভ। না রে, পড়া হয়ে ওঠেনি, তবে নামটা জানি।
—‘পাকদণ্ডী’তে লীলা মজুমদার লিখছেন— ইংরেজি নিয়ে কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন। সুবিখ্যাত অধ্যাপক পি. সি ঘোষের নাম শুনেছ তো? আমাদের দাদুরা পড়েছেন।
—হ্যাঁ হ্যাঁ ঈশানচন্দ্র ঘোষের ছেলে। ঈশান স্কলারশিপ যাঁর নামে। শুনেছি বলতে পেরে আমি হাঁফ ছাড়ি।
—সেই পি. সি. ঘোষের ক্লাসে গিয়ে লীলা মজুমদারের প্রথমটা নাকি খুব অশ্রদ্ধা হয়েছিল, কেননা তিনি শিলং পাহাড়ে খাস মেমসাহেবদের থেকে ইংরেজি শিখেছিলেন। পি. সি ঘোষের সেই উচ্চারণ ছিল না। উনি তো কনভেন্টে পড়েননি!
—তাতে কী? লীলা মজুমদার তো অদ্ভুত!
শোনো না, তারপর পি. সি. ঘোষের পাণ্ডিত্যে, তাঁর পড়ানোয় একেবারে মুগ্ধ হলে গেলেন ক্রমশ। ব্যাপারখানা এই। ওঁদের কোনও অসুবিধে হত না। আমাদের জেনারেশনের হচ্ছে। কেননা, ইংরেজিটা আর শেখানো হচ্ছে না। ইংরেজি পড়াবার টিচারও আর নেই। টেলিভিশনে ভাষাটাকে আরও বিকৃত করে দিচ্ছে। ‘এনিওয়েজ’ শুনেছ কখনও?
—যা বলেছিস। ‘এনিওয়ে’ই তো জানি ভাই। এখন হয়তো বহুবচন সিদ্ধ হয়ে গেছে।
—আর্ষ প্রয়োগ। বুঝলে না! টেলিভিশন যা বলবে তা-ই ঠিক, যা দেখাবে তা-ই ঠিক।
—স্ট্রিট-স্মার্ট আধুনিকরা বানিয়েছে কিনা দ্যাখ আবার! হয়তো খোদ আমেরিকা থেকেই আমদানি।
শিখরিণী এইরকম। দারুণ সিরিয়াস। অনেক পড়াশোনা করেছে। রোজ খবরের কাগজ পড়ে, কোনও সমালোচনা বা গায়ে-পড়াটড়া পাত্তা দেয় না। প্রয়োজন বুঝলে কথার চাবুক মারে। ও শেষ দিকটা ভীষণ আনপপুলার হয়ে গিয়েছিল। একা। ভাব দেখাত কিছুই এসে যায় না ওর। ওর কথা উঠলে তখন অনেকেই বলত ওরে বাবা তর্কবিশারদ, পণ্ডিত ভার্গব, জ্যোতিষার্ণব, শ্রীল-শ্রীযুক্তা মডার্ন খনা। বেশ কিছু অধ্যাপকও ওর কাছ থেকে চাবুক খেয়েছেন। ও বলে না, শুনেছি। বুড়ো ভাম জি. কে-কে বলেছিল— আপনার লজ্জা করে না, আমার বয়সি আপনার মেয়ে আছে! ছিঃ!!
জি. কে. হকচকিয়ে গিয়ে রেগে বলেন, এত বড় অপমান! কন্যার মতো দেখি বলেই, তোমার পিঠে হাত বুলিয়েছি? খারাপ অর্থ করলে! পরীক্ষার খাতায় টের পাবে।
দ্যাট ইজ জাস্ট লাইক য়ু, য়ু পিপল। আপনি যদি পারেন, কম নম্বর দেবেন, আমি রিভিউ করাব। আপনি আমাকে চেনেননি। কেস করব।
আর কোন স্যার যেন পূর্বরাগে ভুগছিলেন। চুল ঝামরে আছে। দাড়ি কামান না। তিনি সবসময়ে পেছনে পেছনে ঘুরতেন। তাঁকে বলেছিল, যা বলবার সোজাসুজি বলুন না স্যার। আপনি তো আর কলেজের খোকা নন! এনিওয়ে, আপনার কথা আমি বুঝতে পেরেছি। এইসব পেছন পেছন ঘোরা গুজগুজে প্রেমে আমার বিশ্বাস নেই। আপনার প্রতি কখনও আমার কোনও ফিলিং জন্মাবে না। স্যরি।
আরও নিশ্চয় অনেক গল্প আছে। ও তো বলে না, বলে অন্যরা। মেয়েরা অনেকেই বলে, যাই বলিস, প্রিন্সেস ডায়নারও এত চার্ম ছিল না।
হিংসা আর মুগ্ধতা কি একই অনুভূতির এপিঠ ওপিঠ?
আমি শিখরিণীতেও অভিভূত। যদিও সেটা কক্ষনও জানতে দিই না। জানলে ও বিরক্ত হবে। ও বলে থাকে, আমি জানি আমি দেখতে খুব সুন্দর। সেইজন্যে অনেকে খুব কদর দেখায়। কিন্তু আজ যদি আমার মুখটা পুড়ে যায়, কোনও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অসুখেবিসুখে নষ্ট হয়ে যায়, কোথায় থাকবে এই কদরদারেরা? চরিত্র, ভেতরের চেহারাটার প্রতি যদি কেউ আকৃষ্টও হয়, সেটা থাকে বাইরের চেহারার সঙ্গে জড়িয়ে। সুতরাং একা। কেউ আর তখন চারুপাঠ করবে না তোমার কানের কাছে। ফিরেও তাকাবে না। বড়জোর করুণা করবে।
—তাই বলে তুই বন্ধু-বান্ধবকে বিশ্বাস করবি না? প্রতি মুহূর্তে মাপতে থাকবি কে তোকে কিসের জন্য পছন্দ করছে? বাঁচবি কী করে? কী নিয়ে?
—কেন? বই নিয়ে, গান নিয়ে, আর সেই তাকে নিয়ে— যে আমারে দেখিবারে পায়/ অসীম ক্ষমায়/ ভালো মন্দ, মিলায়ে সকলি।
—তাই বল, তোর নোঙর তাহলে বাঁধা হয়ে গেছে!
—দুর, যদি ভাগ্যে থাকে পাব, নইলে পাব না। আর, না পেলেও সবার ওপরে তো একজন আছেনই যার কাছে সুন্দর-অসুন্দর ভালমন্দ বিচার নেই।
—কার কথা বলছিস? দাদু?
শিখরিণী হাসতে লাগল, বলল, তোমরা পারোও মৈত্রী। তোমাদের মতো নাস্তিক হয়ে বাঁচতে হলেই আমার হয়েছিল আর কী! কূল পেতাম না!
শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর! হায় কপাল! সে ভদ্রলোককে আমরা স্মরণ করি পরীক্ষার আগে, মাথার যন্ত্রণা হলে, কনস্টিপেশনে, চাকরির ইন্টারভিউয়ে। পুরোপুরি তৈরি থাকলেও ডেকে থাকি। ডাকটা আসে ভেতর থেকে। কেননা ডাকছি সেই অজানা অজ্ঞাতপরিচয় রহস্যময় এক্স-ফ্যাক্টরকে যা না কি সমান-সমানের মধ্যেও তফাত গড়ে দেয়। কিংবা নিচুকে উঁচু করে, উঁচুকে নিচু করে। তাই বলে, প্রাগৈতিহাসিক বুড়ো-ঠাকুরদাদের ঈশ্বর? কে বলছে? না গটগট চলে, কটকট বলে, চটপট নম্বর পায়, বেগুনি, নীল, মেরুন শাড়ি পরে রূপের বান ছোটায় সেই শিখরিণী পালচৌধুরী? ভাল।
বেশ গয়নাগাঁটিও পরে, বদলে বদলে। খায়দায়ও ভাল—ফুচকা, চাট, চটপটি কিছুতেই অভক্তি নেই। বিন্দির বিয়েতে গিয়ে তো মুরগি মাটন দুটোই সাঁটাল। কোনওটা বাদ দিল না। দহি-বড়া, ফিশ-তন্দুরি, আমিষ নিরামিষ…. এমনকী জিলিপি পর্যন্ত। ওরা সদ্য ভেজে ভেজে দিচ্ছিল।
একদিন বলেছিলাম, তোর ঈশ্বরের সঙ্গে কিন্তু এই গয়নাগাঁটি, মুরগি, মাট্ন, ফুচকা-চাট ঠিক যায় না। ঠিক যেন শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ ম্যাচ করেনি।
শুনে বেশ কিছুক্ষণ হাসল। সিরিয়াস হলেও রসিক বেশ, হাসতে ওস্তাদ। বলল, তুমি কি আমাকে মীরাবাইটাই ঠাওরালে নাকি? ম্যয়নে চাকর রাখ জি! তোমাকে হতাশ করতে হল। আসলে আমাদের পুরনো দিনের ঠাট-বাট সব গেছে। তবু তো বনেদি রক্ষণশীল বাড়ির মেয়ে। এইসব গয়নাটয়না পরার অভ্যাস ছাড়তে পারি না। আর, বাড়িতে আমাদের খাওয়া দাওয়ার কী তরিবৎ ধারণা করতে পারবে না। চলো, তোমাকে নিয়ে যাব একবার। তবে ধরনটা একটু আলাদা। গরমকালে আম-কাঁঠাল দিয়ে ঘন দুধ, শীতে ক্ষীর কমলা, ফলের পাহাড় বাড়িতে। মাংস মানে রেওয়াজি পাঁঠা। মাঝে মাঝে। মুরগির চল নেই। প্রচুর মাছ। কোনটা চাও বল না। তবে এই মুখরোচক কুপথ্যগুলো বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে নেই। সুযোগ পেয়ে তাই এগুলোর সদ্ব্যবহার করছি। বলতে বলতে ও বারোতম ফুচকাটা মুখের মধ্যে চালান করে দিল। ফুচকা-গদগদ গলায় বলল, দুর তুমিও যেমন। আমি সাধিকা-টাধিকা নই। বেশ রসেবশে আছি। একদম সাধারণ। প্লিজ মৈত্রী। আমার সম্পর্কে অনর্থক উচ্চ ধারণা কোরো না। পস্তাবে, মানে পছতাওগি।
তবে, ও যে ভীষণ ভাগ্যবাদী সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
আমি যত জনের সঙ্গে আজ অবধি মিশেছি তাদের মধ্যে শিখরিণী একেবারে আলাদা। যতই যা-ই বলুক ও আমাকে জীবন সম্পর্কে বদ্ধমূল ধারণাগুলোকে, কম্বিনেশনগুলোকে ভাঙতে শিখিয়েছে। মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ যাকে বলে। যেমন হাই-হিল, টপ-জিনসের সঙ্গে নোলক চলতে পারে, ধনেখালি শাড়ির সঙ্গে শালা। পাতাখোর দেখলেই মনে করার কারণ নেই—ছেলেটা/মেয়েটা বড় দুঃখী, জীবনে প্রচুর সমস্যা, পরীক্ষায় ফেল ইত্যাদি। পাতার সঙ্গে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্টও চলে, যদিও কতদিন চলবে বলা যায় না।
কাজলের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ‘ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল স্টাডিজ’-এ। রাধিকাদি অর্থাৎ রাধিকা কৃষ্ণানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। পরীক্ষা হয়ে গেছে। কেন যেন সাহিত্যটাহিত্য আর ভাল লাগছিল না। ফরাসি, জার্মান, সংস্কৃত, ইংরেজি, বাংলার পাথর টপকে টপকে চলমান সাহিত্যের সঙ্গে ঘর করেছি দু’ বছর। মনটা ‘হেথা নয়, হেথা নয়’ করছে। সেই সময়ে রাধিকাদির সঙ্গে আমার পরিচয় একটা সেমিনারে। প্রান্তিক মানুষের সংস্কৃতি নিয়ে একটা দারুণ পেপার পড়েছিলেন উনি। আমাদের কত পুজো, বারব্রত, উৎসব, শুভকাজের আনুষ্ঠানিকতা যে আসলে আদি-সংস্কৃতি থেকে এসেছে, তার কথা বলছিলেন উনি। আমার অনেক প্রশ্ন ছিল। যথাসম্ভব উত্তর দিলেন, তারপর দেখা করতে বললেন ইনস্টিটিউটে। ওঁর ঘরেই একটি ছেলে মানে যুবক বসেছিল কম্পিউটারের সামনে। খুব মন দিয়ে কাজ করছিল।
আমি ঢুকেই বলি, রাধিকাদি আমাকে আজ আসতে বলেছিলেন। আমি—
—বসুন।
দশ মিনিট হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম উনি কি আজ আসবেন?
—এসেছেন। একটা জরুরি কাজে গেছেন। এসে পড়বেন।
আরও দশ মিনিট পেরিয়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম এ কি হাসপাতাল না কর্পোরেট হাউস বাবা যে জরুরি কাজে চলে গেলেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট অগ্গেরাহ্যি করে?
একটু পরে নিঃশব্দে চলে আসছি। কম্পিউটারের দিক থেকে গলা ভেসে এল, আর দশ মিনিট।
পেছন ফেরেনি। মাথার পেছনে চুলে লুকোনো দুটো চোখ আছে না কি রে বাবা! না কি কম্পিউটার-স্ক্রিনে কোনওভাবে আমার ছায়া পড়েছে? জিজ্ঞেস করলাম, আর দশ মিনিটে এসে যাবেন?
—বোধহয়।
বলতে বলতেই রাধিকাদি ঢুকলেন। দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমার বায়োডেটা আনতে বলেছিলেন। কেন কে জানে! —হিসট্রির সঙ্গে তো কোনও সম্পর্ক নেই দেখছি। —বললেন।
আমি বলি—গ্র্যাজুয়েশন অবধি হিসট্রি ছিল। খুব ইনটারেস্ট ছিল জানেন। ওদিক থেকে যুবক বলল— এটা কী বললেন ম্যাডাম, হিসট্রির সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন মানুষ আছে?
উনি হাসলেন— ঠিকই। একরকম ঠিকই বলেছ— মৈত্রী, এ আমার রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট কাজল। তবে কে কার অ্যাসিস্ট্যান্ট সবসময়ে বোঝা যায় না।
খানিকটা মৃদু হাসি। কাজল চেয়ার ছেড়ে এদিকে এসে বসেছে। চা এল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, আর মুণ্ডাটা বললেন না ম্যাডাম? কাজল সিং মুণ্ডা।
পরে আমি বলেছিলাম, তুই এত কমপ্লেক্সে ভুগিস কেন রে? ও বলেছিল— ভুগি না। কিন্তু কমপ্লেক্স আছে। থাকবেই। নিজে ব্যানার্জি হয়ে মুণ্ডা অভিজ্ঞতা বোঝা যাবে না।
তা হলে অ্যাফিড্যাভিট করে পাল্টে নে পদবিটা।
তাহলে আর কী করলাম জীবনে?
এ-ই কাজল। কী যে করতে চায়— বোঝা যায় না পরিষ্কার।