উজান যাত্রা (Ujan Jatra) : তৃতীয় পর্ব
বাংলোর চত্বরে বসে ছিল মৈত্রী আর তার বন্ধু শিখরিণী। প্লাস্টিকের মোল্ডেড চেয়ার পেয়েছে দুটো। কিন্তু মশা না পোকার বেশ উৎপাত। অন্ধকারে চড়-চাপড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না। মিঠু মিটিমিটি হেসে বলল, দেখিস আবার আমাকে মেরে বসিসনি।
শিখরিণী চিন্তিত স্বরে বলল, তুমি শিয়োর যে আমি ইতিমধ্যেই তোমাকে মেরে বসিনি?
—রতনদা— মিঠু হাঁকল।
—তোমার বেশ দা-টা বলা অভ্যেস আছে, না মিঠু? ইউ রিয়্যালি হ্যাভ চার্মিং ওয়েজ!
মিঠু আবার জোর গলায় হাঁকল, রতনদা!
অন্ধকারের মধ্যে রতন কিন্তু এসে দাঁড়িয়েছিল ঠিকই। বলল, বলুন দিদিমণি!
—একটা লণ্ঠন দিতে পারবে? আর এই পোকার কী করি বলো তো!
—পোকার একটা তেল আমরা লাগাই। আপনি নিবেন?
—হ্যাঁ হ্যাঁ— নিশ্চয়ই। কী সুন্দর ছমছমে রাত, জোছনা, শালফুলের গন্ধ— ভাল লাগছে বসে থাকতে। কিন্তু এই পোকাদের জ্বালায়।…
একটু পরে রতন থালায় বসিয়ে দুটো ঢিবি ঢিবি কাপে চা-ও নিয়ে এল।
—চা আনলে কেন? দিদিরা এলে খেতাম!
—তখন আবার আনব— এখন বিস্কুট নিন– উঁরা এলে চেঁড় ভেজে দোব।
—এ কীসের তেল রতনদা, বিচ্ছিরি গন্ধ!
—করঞ্জার তেলে সব মশলা ভরা হইছে। মশলার গন্ধ দিদি।
—এ মাখলে কিছু হবে না?
—কিচ্ছু হবে না, আপনি মেখেই দ্যাখো না!
—চায়ে চুমুক দিয়ে শিখরিণী বলল, আমার কী যে ভাল লাগছে! এরকম অভিজ্ঞতা আমার আগে কখনও হয়নি। বাড়িসুদ্ধু সবাই দক্ষিণ ভারত ঘুরেছি গাড়িতে। কোনও জায়গাটার চরিত্র বুঝতে পারিনি সত্যি কথা বলতে। মন্দির-ভাস্কর্য দেখেছি, আর আবার গাড়িতে…
—এ জায়গাটার মতো চরিত্রও তুই সাউথের শহর বাজারে পাবি না। ওখানে ওই মন্দির আর বড়জোর সমুদ্রই দেখবার, বোঝবার। আমি তোকে বলছিলাম না— আমি মধুপুর, গিরিডি গেছি। জায়গাগুলোই একেকটা মানুষের মতো ব্যক্তিত্বঅলা। ধর—মধুপুর যেন এক পুরাকালের রাখাল, প্রকৃতির শোভায় বুঁদ হয়ে মেঠো সুরে গান গাইতে গাইতে চলেছে। গিরিডি হল ধর— বেশ একজন গাইড, তোকে একথা সেকথা বলতে বলতে হঠাৎ একটা রেভিলেশনের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে, তারপর লুকিয়ে পড়বে। হি হ্যাজ হিজ ওন মাইন্ড। আর এই গিধনির শালবন, মহুয়া, কুসুম… সব মিলিয়ে আমার কী মনে হচ্ছে জানিস?
—কী?
—তির ধনুক নিয়ে ‘রাজকাহিনী’র কোনও ভিল যোদ্ধা রাতপাহারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তোর কিছু মনে হচ্ছে না?
—হচ্ছে, তোমারই মতো অনেকটা, তবে ভিল যোদ্ধা নয়, কালপুরুষ। আমার ভাগ্য নির্ধারণ করছে।
—তুই তা হলে এই জায়গাটাকে নিজের জীবনের দিঙনির্দেশক বলে মনে করছিস?
—হ্যাঁ। কিন্তু মিঠু তুমি আমার আগের প্রশ্নটার জবাব দিলে না!
—কী প্রশ্ন? আমি মনেই করতে পারছি না।
—আমি তোমাকে কোথাও আঘাত করেছি কিনা! আজ কিছুক্ষণ আগে তোমাকে আমার অনেক কথা বললাম। তুমি চুপ করে ছিলে। আঘাত পেয়েছ?
—নাঃ। শিখরিণী, আমার সত্যি কথা বলতে কী আঘাত পাওয়ার মনই নেই। আমার মায়ের, একমাত্র প্রিয়জনের ক্যান্সারে তিল-তিল করে যন্ত্রণাময় মৃত্যু দেখেছি কত বছর বয়সে! সতেরো-আঠারো, হায়ার-সেকেন্ডারি মিস হয়ে গেল। নিজের হাতে সেবা করেছি। মায়ের সঙ্গে তখন আমার আর কোনও আড়াল ছিল না। কে মা, কে মেয়ে— বোঝা যেত না। তারপর থেকে আমি…আমার ধাতটাই শক্ত হয়ে গেছে। জীবনে কিছুতেই আমি ভয় পাই না, দুঃখ পাই না!
—দুঃখ পাবার মতো কিছু ঘটলে, সেটাকে হজম করে নাও এই তো?
বললাম যে দুঃখ পাওয়ার মনটাই নেই। স্যরি। তুমি ঠিক বুঝবে না বোধহয়। তোমার জীবন আমার জীবনে বিশাল ফারাক।
—সেটা তো সব মানুষের ক্ষেত্রেই সত্যি, মিঠু। আমি তোমার কষ্ট বুঝতে পেরেছি। জীবনটা ঠিক আরম্ভ হবার সময়েই তুমি মস্ত বড় আঘাতটা পেলে। তাতে করে তোমায় খানিকটা অসাড় করে দিয়েছে। আমি তুলনা দিতে চাইছি না, তুলনা হয়ও না। আমিও কিন্তু মাতৃহীন। আমার জ্ঞানের আগেই। বাবা আবার বিয়ে করেছেন। দ্বিতীয় মা খারাপ কিছু না, কিন্তু আমি মানুষ হয়েছি দাদুর হাতে। কিছুটা মামার বাড়িতেও। তুমি পরিষ্কার করে বলো মিঠু, কাজলের ব্যাপারে তুমি আঘাত পাবে না?
—হঠাৎ তোমার এ কথা মনে হচ্ছে কেন?
—তোমরা খুব বন্ধু। লাইক-মাইন্ডেড। তোমার ভেতরে ওর মতো একটা মানুষের জন্যে…
—হ্যাঁ। কাজল আমার খুব বন্ধু, ভরসাও বলতে পারো। কিন্তু সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নয়। প্রফেশনে। আইডিয়ায়।
যাক, আমার মনের ভেতর থেকে একটা ভার নেমে গেল মিঠু। আমি গভীরভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। জানি আমাদের ভাগ্য নির্দিষ্ট। কিন্তু কী সেই ভাগ্য তা তো জানি না। ইতিমধ্যে কারও কষ্টের কারণ হওয়ার চেয়ে ত্যাগ করা অনেক ভাল। আমি এরকম করেই ভাবি। আমার মন থেকে সত্যিই একটা ভার নেমে গেল আজ।
মিঠুর মন থেকে কিন্তু ভার নামল না। তার সঙ্গে কাজলের বন্ধুত্ব। সত্যিই প্রেম-ট্রেমের কথা তার মাথাতেই আসেনি। কিন্তু যবে থেকে রাধিকা কৃষ্ণানের অফিসে কাজলের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে, তখন থেকেই কাজল খুব দ্রুত তার জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে। কেমন নিবিড় একটা সম্পর্ক, কোনও মান-অভিমান নেই, দু’জনে দু’জনের মেজাজ ও রসিকতা চট করে বুঝতে পারে, মোটামুটি ভাবনা-চিন্তার ধারাও একই রকম। কাজল যেন তারই পুরুষ-সংস্করণ, আরও অনেক পরিণত, আরও অনেক জ্ঞানী এবং কর্মী। কিন্তু দু’জনের চরিত্রের উপাদান একই। আশ্চর্য, তারা পরস্পরের অতীত নিয়ে কখনও কোনও খোলাখুলি আলোচনা করেনি অথচ, দু’জনেই জানে দু’জনের ভেতরে কোথাও একটা শূন্যতা আছে। একসঙ্গে কাজ করতে করতে পথ চলতে চলতে কী এক অদ্ভুত জাদুমন্ত্রে সেই শূন্যতা নিজেকে ভুলে যায়। সে জানে না এটা ভালবাসা কি না! তবে এর চেয়ে নিবিড় সম্পর্ক কি আর হয়! মিঠুর বুকের মধ্যে যেখানে সেই চিরস্থায়ী ক্ষতটা রয়ে গেছে, সেখানটা ব্যথা করতে লাগল। হঠাৎ তার মনে হল চিৎকার করে বলে ওঠে—মা, আজকে কিন্তু আমি টিফিন খাইনি, খাই নি-ই, খাব না …। কী অর্থহীন প্রতিক্রিয়া! কিন্তু তার ভেতরটা অজানা অচেনা, বা অনেক দিন আগেকার চেনা, এখন ভুলে যাওয়া অভিমানে থমথম করতে লাগল। এটা রৌনকের মনীষার জন্য ফিদা হওয়া নয়। বা বিন্দির রৌনকের জন্য দিওয়ানা হওয়া। এ অন্য কিছু। অন্যরকম। কিন্তু কাজল মুণ্ডা তার পাশে থাকবে না— এটা তার বুকের মধ্যে ক্রমশ লোহা পুরে দিচ্ছে। গৃহস্থ হয়ে গেলে কি আর মানুষ মানুষের বন্ধু থাকে?
দূরে টর্চের শক্তিশালী আলো দেখা দিল। আলোটা বাংলোর দিকে হেঁটে আসছে। শিখরিণী বলল, ওই যে বাবুদের এতক্ষণে আসা হচ্ছে।
মিঠু চেঁচিয়ে ডাকল, রতনদা!
—এই যে দিদিমণি।
—ওই ওঁরা আসছেন, চা নিয়ে এসো। সঙ্গে তোমার চেঁড় ভাজা।
হাওয়া দিচ্ছে না কোত্থাও। কিন্তু কেমন ঠান্ডা। গিধনির অন্ধকার আকাশে তারা ঝলমল করছে। দূরে গাছপালা ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তারা চুর শাল-মহুয়ার পাতায় পাতায় লেগে আছে।
লণ্ঠনটার দিকে এগোচ্ছে ওরা।
—তোরা এখানে?
—বাঃ অন্ধকারে কোথায় গেলি, বাঘ-ভালুকে খেল কিনা জানতে হবে না!
অল্পস্বল্প আলো পড়ে শিখরিণীকে কেমন অলৌকিক সৌন্দর্যসম্ভূত মনে হচ্ছে। কাজল আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইল। আগে তো তার এই মুগ্ধতা আসেনি। হ্যাঁ মেয়েটি খুব সুন্দর, কিন্তু তার মধ্যে এই বিস্ময়, আবেশ ছিল সে খেয়াল করেনি। কেন? দিকুদের মেয়ে। মুণ্ডাদের শত্রুপক্ষীয়। হয়তো তাই। কিন্তু মেয়েটি যে তাকে পছন্দ করছে সেটা হাবে-ভাবে প্রকাশ করতেই কী একটা বিপ্লব ঘটে গেল। অন্ধকারেও শিখরিণী তার দৃষ্টি বুঝতে পেরেছে। মোহ চোখে মেখে নিয়ে সেই দৃষ্টি সে ফিরিয়ে দিল।
—দিদি, এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?
—একানে ওকানে। কাজলের জায়গা খুব সুন্দোর। চোমৎকার। মানুষকে একদম ঢেকে নিচ্চে।
মানে কী এ কথার কেউই বুঝল না। কিন্তু এর মধ্যে যে দারুণ একটা প্রশংসা লুকিয়ে আছে সেটা বুঝতে কারওই অসুবিধে হল না।
এই সময়ে রতন আর চিঁড়েভাজা-চা এল।
—খুব খিদে পেয়েছে, না কাজল? —কস্তুরী বললেন, তারপরে ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে বললেন, চেঁড়ো? চেঁড়োভাজা কোতোদিন খাইনি। ইস্স তুমাদের খেপলা খাওয়ালে আর ভুলতে পাচ্ছো না। মেহতা বাড়ির রান্নাঘরে তৈরি খেপলা। চলো, তোমাদের সবাইকে কলকাতায় ফিরেই খাওয়াব।
কাজল বলল, আপনি কিন্তু বলেছিলেন দিদি, আমদাবাদ না গেলে কিছুই খাওয়াবেন না। তার মানে আমদাবাদের নিমন্ত্রণটা আপনি ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
—তুমাদের যা হেল্পফুল, তাতে তুমরা আমার রান্নাঘর, আমার অফিসঘর সোব তচনচ করে দিচ্চো। হেল্প, হেল্প! তোখন কাকে ডাকব তুমাদের হেল্প থেকে বাঁচতে!
অর্থাৎ ঝাড়গ্রাম এবং সেখান থেকে গিধনি আসা পর্যন্ত পুরো পথটা যে মেজাজ খারাপ ছিল, তা আবার ভাল হয়ে গেছে। কী রহস্য আছে কস্তুরীবেনের এই ভ্রমণে! কাকে খুঁজছেন? কী খুঁজছেন? আজ সন্ধ্যায় অন্ধকারে গিয়ে কি তার কোনও হদিশ পেলেন? কাজলকে একা পেলে মিঠু নিশ্চয়ই জেনে নিত। কিন্তু এখন, এখানে অনেক জন। জিজ্ঞেস করা যাবে না। যা-ই হোক, তা ওঁর ছোটবেলার সঙ্গে জড়িত, বারেবারে যেভাবে বলছেন ছুটবেলাই সোব বেলা।
এবং কলকাতা নাকি ওঁর মাতৃভূমি— মা-ল্যান্ড। কলকাতার মেয়ে ছিলেন নাকি ওঁর মা? কলকাতা-প্রবাসী গুজরাতি বা অন্য কিছু? নাকি বাঙালি? এই স্বতন্ত্র চরিত্রের কস্তুরীবেনের-অর্ধেকটা বাঙালি— ভাবতে তার খুব ভাল লাগল। তবে নিজের কাছে নিজেই সে লজ্জিত হল এ ভাবনায়। ওঁর যে অর্ধেক গুজরাতি, তা-ও খুব ভাল লাগছে। গোটা মানুষটার জন্যই তার এমন একটা শ্রদ্ধা, এমন একটা টান আসছে যে উনি কয়েকদিনের মধ্যেই চলে যাবেন ভাবতে তার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
শোবার আগে একটা বিদঘুটে ঘটনা ঘটল। রতন ওদের জন্য খিচুড়ি রেঁধেছিল, খিচুড়ির মধ্যে কিছু কিছু তরি-তরকারি দিয়েছে। কী তা বোঝা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে খেতে মন্দ লাগছে না। কাজল বলল, রতনদা এর মধ্যে আবার রাজ ব্যাং, কি মেঠো ইঁদুর দাওনি তো!
—কী বললে! ব্যাং? ইঁদুর? —শিখরিণী লাফিয়ে উঠে মুখ বিকৃত করে চলে গেল। ওয়াক তুলছে।
—ওয়াক, ওয়াক।
—রাজ বেং কী জিনিস? ইঁদুর বুঝলুম— কস্তুরী বললেন।
—কিছু না, ঠাট্টা করছিলুম। শিখরিণী-ই— গলা তুলে কাজল বলল— আমরা কিন্তু এরকমই খাই। ঢ্যামনা সাপ, বিষধর সাপও মাথা কেটে খাই, তারপরে গোসাপ। গোধিকা মনে আছে মিঠু, ফুল্লরা কালকেতুর উপাখ্যানে? সেই যে কিছু না পেয়ে অবশেষে গোধিকা পেল একটা—
—যেটা স্বর্ণগোধিকা হয়ে গেল?
—স্বর্ণগোধিকাই তো ছিল! আসলে দেবী চণ্ডী। কালকেতুর ঘরের দাওয়ায় নিজরূপ ধরে বসেছিলেন আর সেই সুন্দরী দেখে ফুল্লরা ভয়ে, হিংসায় একেবারে দিশেহারা হয়ে গেল। ভাবল— কালকেতু ওই সুন্দরীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে ঘরে নিয়ে এসেছে। ফুল্লরার লম্ফঝম্ফ কান্নাকাটি দেখে কালকেতু অবাক।
শাশুড়ি ননদী নাই, নাই তোর সতা
কার সঙ্গে দ্বন্দ্ব করি চক্ষু কইলি রতা!
—বলে কাজল হাসতে লাগল। আবার একবার হাঁক পাড়ল— শিখরিণী-ই। খিচুড়িতে আলু আর স্কোয়াশ ছাড়া কিচ্ছু নেই। খেয়ে নাও। রাতে খিদে পেলে কিছু জুটবে না কিন্তু।
কস্তুরী বললেন, আমার কাচে বিস্কুট আচে। লাড্ডু আচে। কুচি নিমকি আছে। তুমরা কবিতা করো, আমি প্যাকেট বার করি।
শিখরিণী এই সময়ে এসে বলল, দিদি, আমার এখন বমি পাচ্ছে, খেতে বলবেন না।।
সে রাগী চোখে কাজলের দিকে চেয়ে বলল, খাবার সময়ে বিশ্রী বিশ্রী কথা! ছিঃ!
কাজল বলল, বিশ্রী কথা কেন হবে? কলকাতার ভদ্রলোকেরা লালচে লালচে নরম মেঠো ইঁদুরের কাবাব দিব্যি খেতে ভালবাসেন। আর ব্যাং তো চিন, জাপান, কোরিয়া এসব জায়গায় ডেলিকেসি। ইউরোপীয়, আমেরিকানরাও দিব্যি খায়। হাঙর, কুড়কুড়ে করে ভাজা অক্টোপাস! কলকাতার হোটেলে মুরগির কাটলেট বলে তো ব্যাং কি পায়রাই দেয়। খাও তো!
—আচ্চা আচ্চা অনেক মেনু বলে ফেলেচ। একন একটু সামলাও। কস্তুরী হেঁকে উঠলেন।
—না, এরা সব সামন্তভূমিতে এসেছে। ট্রাইব্যাল-বেল্ট। আমরা কী খাই, কী পরি, কীভাবে বাঁচি—না-জেনে, না-দেখেই ফিরে যাবে?
—সামন্তভূমিটা কী?— মিঠু জিজ্ঞেস করল।
—আদিবাসীরা তো প্রাগৈতিহাসিক। তাদের নিয়ে অনেক রকম স্পেকুলেশন আছে। সামন্ত থেকে সাঁত। সাঁওতাল, সাঁওতাড়। এরকম একটা ধারণা আছে।
—তার মানে সাঁওতালরা সামন্ততন্ত্রে বাস করত? ফিউড্যাল সোসাইটি!
—হতে পারে ওরা সাদা মানুষদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় এসেছিল। সামন্ত হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখত। শেষ পর্যন্ত নিজেরাই নিজেদের পরিচয় ভুলে যায়। আবার উলটোটাও হতে পারে, সাঁওতাল থেকেই সামন্তভূমি, যেমন ধিরি থেকে ধৃ। তবে আদিবাসীরা সবাই নিজেদের ‘হড়’ বলে। ‘হড়’ মানে মানুষ।
—হড় কুথা থেকে এলো, তুমার শাস্ত্র কী বলে?
—সে এক গল্প। বাইবেলের জেনেসিসের সঙ্গে মিল আছে খানিকটা।
—কীকর্ম?
—দিদি, আমি যা পড়ে জেনেছি, তা হল, ঠাকুর আর ঠাকরান থাকতেন পুব দিকে। পৃথিবী তখন জলময়। মাটি অনেক নীচে। ঠাকুর জিউ কঁকড়া, হাঙর, কুমির, রাঘববোয়াল, কচ্ছপ সব সৃষ্টি করলেন। তারপর মাটি দিয়ে মানুষ গড়লেন কিন্তু আকাশ থেকে সূর্যের ঘোড়া সিঞ সাদম একটা রুপোলি সুতো— তড়ে সুগম দিয়ে নেমে এসে ভেঙে দিল। তখন নিজের বুকের ময়লা দিয়ে হাঁস আর হাঁসালি গড়লেন, ফুঁ দিলেন। তারা উড়ে বেড়াতে লাগল। তবে হাঁস হাঁসালি কিন্তু কণ্ঠার দু’দিকের দুটো হাড়েরও নাম। গড মেড ম্যান ইন হিজ ওন ইমেজ। আর আদমের পাঁজর থেকে ইভ তৈরির গল্পও তো আমরা সবাই জানি। বিয়ের সময়ে আমাদের কনেকে হাঁসুলি উপহার দেওয়া হয়, কণ্ঠার হাড়ের ওপর লেগে থাকে— তাই হাঁসুলি।
—আমাদের মঙ্গলসূত্রের মুতো! —কস্তুরী বললেন।
—তাই। এই হাঁস হাঁসালি থেকেই হাড়াম ও আয়ো বা পিলচু হাড়াম, আর পিলচু বুড়ি অর্থাৎ প্রথম মানব-মানবী জন্মাল। আদম-ইভের সঙ্গে সাদৃশ্যটা আরও স্পষ্ট হল— তাই নয়?
—সত্যিই তো! মিঠু অবাক হয়ে বলল।
শিখরিণী গুটিগুটি এসে বসেছিল তার ফেলে যাওয়া পাতে। ভীষণ খিদে পেয়েছে। এখানকার জল এত ভাল! সে এক গ্রাস মুখে দিল।
কস্তুরী বললেন, গুড গার্ল।
—আমাদের ব্রহ্মার বাহনও কিন্তু হাঁস। কোথাও একটা যোগাযোগ থাকতে পারে।— গুড গার্ল শিখরিণী বলল।
হতে পারে— কাজল বলল— হিহিরি পিপিড়ি দ্বীপে শ্যামা ঘাস আর সুন্তুবুকুচ ঘাসের বীজ ছড়িয়ে দিলেন ঠাকুরজিউ। ইতিমধ্যে লিটা তাদের বাখখর বা হাঁড়িয়া করতে শেখালেন। মারাং বুরুর নামে হাঁড়িয়া নিবেদন করে যে-ই না প্রসাদ খাওয়া অমনি হয়ে গেল বিপ্লব। হাড়াম আয়োর লজ্জা হল, বটপাতা পরলেন— কী দিদি, আদম ইভ আর শয়তানের গল্পের সঙ্গে মিলছে?
মিলছে তো বোটেই। এরকম কহানি তুমাদের মিশনারি শিখায়নি তো? সরল মানুষ নিজেদের মুতো করে নিজেদের ভাষায় তৈরি করে নিয়েছে?
—বোধহয় না। এগুলো ওর্যাল ট্র্যাডিশন, শ্রুতি, বহুকাল ধরে বংশপরম্পরায় চলে আসছে। তবে একটা বৈশিষ্ট্য বা তফাত— বাইবেলে শয়তান হল ভগবানের শত্রু, খারাপ লোক। কিন্তু এই লিটা বা মারাংবুরু আদিম জনগোষ্ঠীর একজন প্রধান দেবতা। মানে, জ্ঞানবৃক্ষের ফলকে সাদরে গ্রহণ করেছিল এরা। দুঃখের বিষয় জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে কিছু জাতি বিজ্ঞান, বিদ্যা, শাস্ত্র, সাহিত্য, ভাষাচর্চা করে কোথায় উঠে গেল! এদের জ্ঞান শুধু হাঁড়িয়ার ইনটকসিকেশনেই সীমাবদ্ধ রইল। হাঁড়িয়া উৎসবে, পূজায়— সর্বত্র ছড়িয়ে গেল।
শিখরিণী বলল, আমরা যে-সোমরসের কথা শুনি, তা-ও তো একরকম লতার নির্যাস। সুরা, ইনটকসিক্যান্ট। দেবতারা সোমরসের ভোগ খুব ভালবাসেন। কিন্তু সোমরসে তো তাঁদের বুদ্ধি লোপ হয়নি!
—মানে যোতো দিন মানুষ তোতো দিন নেশা— কস্তুরী বললেন। আসল কথাটা চাপা পড়ে গেল।
ওরা দেখেনি রতন কিসকু ওদের খেতে দিয়ে অন্ধকারে এক জায়গায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল। এই সময়ে বলে উঠল, দাদাবাবু, পারিশ ভাগের কতা তো কই বুললেন না।
কাজল চমকে উঠল। আর সবাইও তারই মতো চমকেছিল। ঠিক যেন কোন অতীতের সামন্তভূমি এই অতিথিদের কাছে তার ইতিহাস অসম্পূর্ণ রয়ে যায় দেখে কথা কয়ে উঠল।
—তুমিই বলো না। সে আস্তে করে বলল।
—রতন বলল, ইঁদের ছেল্যা মেয়্যা হঁল। সাঁত জুড়ার সাঁত কুঠরি হঁল বিয়্যা হঁল। তবে না হড়হপন জাতি। ঠিক হঁল ভাই-বুনে বিয়্যা হবে না। তাই পারিশ ভাগ হঁল। সাঁত পারিশ। মুর্মুগণ পূজারী, কিসকু রাজা, হাঁসদা মার্ন্ডি ধন লিয়ে লাড়েচড়ে। হাঁসদা বড় ছেল্যাটি, হেমব্রম জাগিরদার, সরেন সৈন্য, যুদ্ধ করে। টুডু-বাজনদার, কামার, আর মার্তি— কন কঁরত্যান স্মরণ নাই।
তাঁর পর সব লক খারাপ হঁইয়া গেল। ঠাকুর সাত দিন সাত রাত্রি আগুন জল বর্ষা করিলেন। সব মরিল। শুধু হারাতা পর্বতের গুহায় যাঁরা বসত ছিলেন, তাঁরা বাঁচল। তারপর বর্ষা থামিলে সব বার হয়্যাঁ অনেক পশু-পক্ষী পাইলেন, আবার সব বসাল। সাঢ়াংবেডায় বাস করিল। সিখানে সাবেক সাত খুঁট বাদে আরও পাঁচ খুঁট হঁল— বাস্কে, বেশরা, পাঁউরিয়া, চঁড়ে, আর এক খুঁট হারাঁয়্যা গেছে বডয়া। বাস্কেরা ব্যাবসা বাণিজ্য করত্যাঁ থাকেন—এইটুক জানি।
—হারাতার সঙ্গে আরারাতের মিল দেখেছেন দিদি? —কাজল বলল।
—ঠিক বুলেচো তো! আমার চিনা চিনা লাগচিল। ডেলুজ, ক্রিশ্চান ও হিন্দুদের। প্রথমে সোব জোল ছিল, না? পুরা কাহিনীই এর্কম। জোলে পৃথিবী ভাসল, প্রথমে মৎস্য অবতার হল, তারপর কূর্ম অবতার, স্থোলে জোলে বিচরণ কোরে। তারপর স্থোলের জীব বরাহ। তারপোর পশু মানুষ মিলিয়ে নৃসিংহ। তারপোর বামন। ডোয়ার্ফ। প্রথম এক্সপেরিমেন্ট কোরতে গিয়ে ভোগোবান প্রোপোৰ্শন ঠিক রাখতে পারেননি। সোব গোল্পেই আদি-বস্তু জোল। তা থেকে ইভলিউশন! তুমাদের মিথ খুব সুন্দর।
উষা এসেছে দিগ-বিদিক আলোয় বিদীর্ণ করে। সরে গেছে সামন্তভূমির ঘনীভূত অন্ধকার। কস্তুরী উঠে পড়েছেন খুব সকাল সকাল। ভোর দেখছিলেন। রাত্রি কালো, সব ঢেকে দেয়, তাই সে রহস্যময়ী, অথচ দিবারই নিজের উল্টো পিঠ সে। প্রকৃতির দুই দিক। কেমন করে এই অমানিশা দিবায় এসে মেশে, সন্ধিলগ্নটা দ্যাখবার তাঁর বড় ইচ্ছে ছিল। জীবনে বহুবার দেখেছেন। কিন্তু ঠিক এই পটভূমিতে নয়। গত রাতে খুব ভাল ঘুমিয়েছিলেন কিন্তু হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। দেখলেন চাঁদ অস্ত গেছে। কিন্তু তারার কী জোরালো পেনসিল টর্চের মতো আলো! আশ্চর্য! নিঃশব্দে মশারি তুলে উঠে পড়লেন, মুখটুখ ধুয়ে সোজা বাইরের চত্বরে এসে দাঁড়ালেন, তখনও মনে হচ্ছিল দূরে যেন গুঁড়ি মেরে কে বা কারা দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে গলে যাচ্ছে। সিঞ সাদাম। সূর্যের ঘোড়া সব ছিঁড়েখুঁড়ে দিচ্ছে। শাল গাছের ফাঁক দিয়ে একটা তির্যক আলোর রেখা এসে পৌঁছে গেল লাল মাটিতে। ‘তড়ে সুগম’, ‘তড়ে সুগম’। পবিত্র সুতা— এই রশ্মিরেখা ধরেই মনুষ্যলোকে পৌঁছোয় সূর্যের ঘোড়া। কাল যেন কাজল কথাগুলো ব্যবহার করেছিল। মনে থাকেনি। এখন দিনের আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে— ‘সিঞ সাদম’ ‘তড়ে সুগম’।
কস্তুরী যেন আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। এ যাত্রা এক তীর্থযাত্রার মতন। কেদার বা অমরনাথ যাত্রার চেয়েও দুর্গম। কিন্তু পথ ওই রকমই সুন্দর। যেমন পাহাড় তার ঐশ্বর্য— তুষার, ফুল, ঝরনা, রং ছড়িয়ে রাখে যাত্রাপথে, এই ভূমিও তেমনই উদার হাওয়ায়, শান্ত নীল সমুদ্রের মতো আকাশে, আশ্চর্য জ্যোতির্ময় সব জ্যোতিষ্কে এবং মানুষের মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গাছে গাছে সুন্দর করে রেখেছে পথ। কী তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে এই পথের শেষে!
মিঠু যে কখন এসে পাশে বসে আছে তিনি বুঝতেই পারেননি। কয়েক দিনের মধ্যেই এই মেয়েটির মধ্যে কী একটা পরিবর্তন এসেছে তিনি ধরতে পারছেন না। ওর চঞ্চল হরিণের মতো চোখে যেন এখানকার সমুদ্র-নীল আকাশের ছায়া পড়েছে। ও সাধারণত খুব উজ্জ্বল, স্মার্ট— মাউন্টেনিয়ারিং করেছে, হবে না? কিন্তু ও-ও যেন এই জায়গাটার সম্মোহনে পড়ে কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। অবশ্য এ-ও হতে পারে, এটাও ওর একটা রূপ। কাজের মধ্যে মেলামেশার মধ্যে একরকম। আবার কাজের বাইরে, শান্ত বনগন্ধঅলা ভোরবেলায় অন্য রকম। এর মধ্যে তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী ছেলেমেয়েদের দুর্বিনীত ডেভিল-মে-কেয়ার ধরনধারণ দ্যাখেননি ঠিকই। কিন্তু ইতিহাস নিয়ে কোনও মাথাব্যথাও দেখেননি।
দূর থেকে হঠাৎ চাপা পুরুষালি গলায় গান ভেসে এল।
হিহিড়ি পিপিড়ি রেবন জানামলেন,
খজ-খামান রেবন খজলেন
হারাতা রেবন হারালেন।
সাসাং বেডারবন জাতেনা হো।
হিহিড়ি পিপিড়ি … হিহিরি পিপিড়ি …
কেরোসিনের ঝাঁঝ পেলেন যেন। একটু পরেই রতন কিসকু, সামন্তভূমির পূর্বতন রাজবংশের সন্তান, মোটা মোটা কাচের গেলাসে চা অ্যালুমিনিয়মের থালায় বসিয়ে নিয়ে এল।
—আর দাদাবাবু দিদিমণি কখন আসবেন?
—একটু কাজ করবে রতন, আমাদের ঘরে কাপড়ের ব্যাগ আছে— একটু নিয়ে আসবে? কুচি নিমকি দিয়ে আমরা চা-টা খেতে পারি। —কস্তুরী বললেন।
—দিদিমুনি ঘুমাচ্ছেন— খুব সংকুচিত স্বরে রতন বলল।
—আমি নিয়ে আসছি দিদি— আবার সেই এন.সি.সি, ট্রেকার। টক করে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক লাফে বাংলোয় চলে গেল।
কয়েকটা লতাপাতার গোড়া, একদল ডেঁও পিঁপড়েকে পাশ কাটিয়ে লাফ দিয়ে পার হয়ে মিঠু উঠে গেল। ওর গায়ে এখনও কী রকম কাঁটা দিচ্ছে … ওই গানটা হিহিড়ি পিপিড়ি রেবন জানামলেন, হিহিড়ি পিপিড়ি। রতন কি ওদের জন্মের সময়কার গান গাইছিল? ‘জানামলেন’ কি জন্মালেন! হিহিড়ি পিপিড়িতে জন্মালেন! একটা শিশু জন্মালে যেমন তার জন্য নানা রকম আচার পালন হয়—আটকৌড়ে, ষষ্ঠীপুজো… ছড়া গান… একটা মানবগোষ্ঠীও তেমন তার জলের গান বেঁধেছে। হিহিরি গিগিড়ি…
ঘরের মুখে ঢুকতে গিয়ে সে একটা ধাক্কা খেল। শিখরিণীর বিছানা পরিপাটি করে গোছানো, অর্থাৎ সে উঠে পড়েছে। এবং পাশের ঘর অর্থাৎ কাজলের ঘর থেকে দু’জনের গলার আওয়াজ ভেসে আসছে।
শিখরিণী একটু উত্তেজিত— তোমার কাছ থেকে এটা আমি আশা করিনি কাজল, তোমার জানা উচিত আমার মতো একজন মেয়ে খাওয়ার সময়ে সাপ ব্যাঙের কথা বললেই রি-অ্যাক্ট করবে?
কাজল— কী করে জানব? বললামই তো আমার দেশে যখন এসেছ, আমাদের কথা তোমার জানা উচিত। বলিনি?
—কিন্তু তুমি তো এখান থেকে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে গেছ। নিশ্চয় আবার ফিরে আসতে চাও না?
—যদি চাই?
—শুধু শুধু আমাকে রাগাচ্ছ কাজল। ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে তোমার জন্য কত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে। ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল।
মিঠু আর শুনল না। দিদির পুঁতির কাজ করা গুজরাতি ঝোলাটা নিয়ে নিঃশব্দে চলে এল।
কুচো নিমকি দিয়ে রতনের কড়া চা মন্দ লাগছিল না।
কস্তুরী বললেন, দ্যাখো, রাজার জাত রাজার বংশ আজ চা করচে। টুরিস্টদের সেবা করচে।
—দিদি, আপনি কি সত্যিই মনে করেন চিরকালই যারা রাজা তারাই রাজা থাকবে? মিঠু চায়ের কাপটা পাশে নামিয়ে রেখে বলল, তাদের শিখতে হবে না, নিজের কাজ নিজের হাতে করে নেওয়া, অন্যের সেবা করা!
ফ্রেঞ্চ রেভলিউশন তো এই নিয়েই হয়েছিল! ড্রিঙ্কিং চকোলেটটা পর্যন্ত নফর জমিদারের মুখে ধরছে, তবে তিনি কোনওক্রমে খেয়ে নিচ্ছেন। খাওয়াটা তো আর অন্য কেউ করে দিতে পারবে না! জমিদারদের অত্যাচারে রাশিয়ার ভূমিদাসদের কী অবস্থা হয়েছিল মনে করুন। আজ সেই জমিদাররা কোথায়? ইংরেজ দুশো বছর ধরে আমাদের শাসন করে গেছে, মুঘল পাঠানরা তারও আগে ছশো বছর। কোথায় তারা? এরা তো তবু হালদার। দেশের মধ্যেই জাতির মধ্যেই কি ক্ষমতার হাতবদল হয় না? এটাই তো স্বাস্থ্যকর দিদি! এটাই তো ঠিক।
কেন যে মিঠুর গলায় একটু তার্কিক সুর— তিনি বুঝতে পারলেন না।
মিঠু বলল, বহু শতাব্দী ধরে বঞ্চিত— ঠিক কথাই। কিন্তু এখন যে নিজেদের রাজ্য হয়েছে, প্রাকৃতিক সম্পদে এত ধনী, ওই মার্ন্ডি, ওই হেমব্রম, সরেন, হাঁসদা যাদের কথা সাঁওতালি হিস্ট্রিতে শুনলেন— তারা কি পারছে সামলাতে! তারা কি ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের পেটমোটা করছে না! জাস্ট লাইক আদার্স? দিস ইজ ডিসগ্রেসফুল। আর ধরুন, যারা আধুনিক শিক্ষা পাচ্ছে, সুযোগ পাচ্ছে, তারা কি নিজের দেশের জন্য, নিজের মানুষদের জন্য কিছু করছে? করছে না। স্বার্থপরের স্বর্গে বাস করছে তারা।
কাদের কথা বলছিস রে মিঠু! পেছনে কাজল এসে দাঁড়িয়েছে, তারও পেছনে কালোর সঙ্গে চমকপ্রদ কনট্রাস্টে শিখরিণী।
হঠাৎ এক ঝলক হাসল মিঠু, রাগ ঝাল কিছু নেই। সে বলল, তোদের মতো লোকদের কথা ভাবছিলাম কাজল। আমি জানি না, কেন তুই তোর নিজের সমাজের জন্য কিছু করিস না!
—আগে কথাটা কখনও মনে হয়নি তোর?— কাজল একটু যেন উত্তেজিত।
—না হয়নি, কেননা তখন আমি এখানে আসিনি, রতনদাদের দেখিনি, হিস্ট্রিটা শুনিনি। কিছুই জানতাম না।
—তবু তো হিস্ট্রির কিছুই শুনিসনি। হড় জাতির এক্সোডাস শুরু হয়েছে সুদূর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে। সাসাংবেডা থেকে গোত্র ভাগ হয়ে জারপি দেশ, সেখানেও টিকতে পারা গেল না, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আসতে আসতে এক বিশাল পর্বত পথ আটকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মারাংবুরুর অর্থাৎ জঙ্গলের দেবতার পূজা করে সে পথ বা সিংদুয়ার খুলল। সেখান থেকে বাঁয়ে এসে ‘আয়রে’ দেশ, তারপর ‘কাঁয়ডে’ দেশ, তারপর ‘চাঁই’ দেশ — দুটো পথ ছিল চম্পাদুয়ার আর চাঁইদুয়ার। চাম্পাতে আমরা স্বাধীন ছিলাম, প্রত্যেক গোত্রের আলাদা গড় ছিল। তারপর সেই একই ইতিবৃত্ত। দিকুরা এসে সব কেড়ে নেয়। জঙ্গল পরিষ্কার করে বসত স্থাপন করলেই দিকুরা নিয়ে নেয়। চাম্পা পর্যন্ত আমাদের হড় জাতির এক ইতিহাস। তারপর মুণ্ডা, শবর, কুঁডবি ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে গেল। চাম্পা থেকে তড়েপুখুড়ি, আবার তাড়া তারপর বাড়িবারওয়া। তারপর শিরে দেশ বা শিকার দেশ। শিকার রাজার সমস্ত জঙ্গল পরিষ্কার করলাম কিন্তু দিকুরা সেখান থেকেও আমাদের তাড়াল। অজয় নদ পার হওয়া আমাদের পূর্বপুরুষের বারণ ছিল। কিন্তু পেটের দায়ে গুটিপোকার মতো এই সাঁওতাল পরগনায় চলে এসেছি। আর একদিন আর কোথাও চলে যাব। ঝাড়খণ্ড কি আর শেষ পর্যন্ত আমাদের আশ্রয় দিতে পারবে? মনে হয় না। ভারতের তাবৎ জাতি কাঙাল প্রকৃতির, বেসিক্যালি। কাঙালদের শাকের খেত দেখালে যা হয় আর কি!
কস্তুরী বললেন, তুমরা হিস্ট্রি নিয়ে এতো কী ঝগড়াচ্ছো! হিষ্ট্রি এক বিশাল আমাজন নদীর স্রোতের মুতো। সে তার নিজের ভেতরকার লুকুনো কারেন্টে বয়ে যায়। কেউ জানবে না কুথায় নিয়ে আমাদের ফেলবে!
—সবই যদি পূর্বনির্ধারিত দিদি, হিষ্ট্রি যদি তার নিজের দুর্বোধ্য পথেই চলে, তা হলে আর এত বিপ্লব, এত শিক্ষাসচেতনতা, এত লড়াই, সমাজসেবা কেন? —মিঠু দাঁতে নখ কাটছে।
—না দিদিমোণি, আমি বলতে চায়ছি কি এইসোব বিপ্লব, লোড়াই, সোব সেই ইতিহাসের ওঙ্গ, তার নিজের একটা গোতি আচে।
—তা হলে আপনি কেন, আপনারা কেন আপনাদের সময়ের স্বপ্ন পূর্ণ হল না বলে দুঃখ করেন? কেন গান্ধীজি অনশন করে পার্টিশন আটকালেন না, কেন সুভাষ রহস্যময়ভাবে মারা গেলেন, কেন জওহরলাল, বল্লভভাই, জিন্নাহ, মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে মাঝরাতের সমঝোতায় কেনা খণ্ডিত স্বাধীনতা অ্যাকসেপ্ট করলেন— এসব তো আজ ঘটে- যাওয়া ইতিহাস। সে নিয়ে দুঃখ করে তো লাভ নেই! ইতিহাসের নিজস্ব গতি!
আর দ্যাখ কাজল, হঠাৎ যে তুই এই দিকু-দিকু করে আমার সঙ্গে, শিখরিণীর সঙ্গে, হয়তো বা দিদির সঙ্গেও তাদের শত্রুদের ইকোয়েট করছিস— এটা কিন্তু ঠিক করছিস না। তুই হঠাৎ কেমন ক্যারেড অ্যাওয়ে হয়ে গেছিস। তোর আত্মপ্রত্যয়, সেলফ-পজেশন আমার শ্রদ্ধার জিনিস। তোর থেকে এটা আশা করিনি।
—তা হলে কী আশা করেছিলি? তোদের শ্রদ্ধার পাত্র হবার জন্যে যা যা ছকে দিচ্ছিস, তাই আমায় করতে হবে? হতে হবে? আ অ্যাম নট অ্যাফরেড টু লুজ ইয়োর রেসপেক্ট অ্যাজ লং অ্যাজ আ’অ্যাম মাইসেলফ।
কস্তুরীবেন বৃথাই ওদের কুচি নিমকি আর লাড্ডু নিয়ে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। কাজল দূরে গিয়ে বুকের ওপর হাত আড়াআড়ি করে দাঁড়িয়ে রইল। মিঠু চেয়ারে বসে রইল রাগত মুখে। আর শিখরিণী সমানে বলতে লাগল, এই মিঠু এত রেগে গেলে কেন? কী হল? দুর তুমি একেবারে ছেলেমানুষ। কবেকার কী হিস্ট্রি, সেটাকে এমন ব্যক্তিগতভাবে নিচ্ছ কেন? তুমিও আর সেই দিকু নেই, কাজলও আর সেই মুণ্ডা নেই।
কাজল পেছন ফিরে শান্ত গলায় বলল, য়ু আর রং শিখরিণী, আই’ল রিমেন আ মুণ্ডা অল মাই লাইফ। আমি কিছুর জন্যই আমার জাতি পরিচয় বিসর্জন দেব না। সে তাদের জন্য পলিটিকস বা পতিতোদ্ধার জাতীয় কিছু করি বা না করি।
কোথায় সুর কাটছে, কেন, কস্তুরী বুঝতে পারছেন না। এতদিন একটা পারস্পরিক ভাল লাগা, বিবেচনার, এমনকী বশংবদতার মধ্যে এদের পরিচয় পেয়েছেন। মিঠু ছেলেমানুষ, সবচেয়ে প্রাণোচ্ছল, সবকিছু করতে তৈরি, আপাতদৃষ্টিতে চঞ্চল, কিন্তু ওর ভেতরে লুকোনো সমুদ্র আছে। হয়তো বা দুর্বিনীত ভয়ংকর ঘূর্ণিপাক। মাঝেমাঝে, চকিত দর্শন দিয়েই তা আবার ঢেকে যায়। নীল আকাশে হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি। শিখরিণী মেয়েটিকে তিনি এখনও ঠিক বুঝতে পারেননি। ও মিঠুর বন্ধু। কিন্তু কোনওভাবেই মিঠুর মতো নয়। অনেক শান্ত, মিঠুর মতো চটপটে নয়, চটপটে হতে ওর ইচ্ছেও যে আছে তা মনে হচ্ছে না। ওর ব্যক্তিত্বটা একেবারে তৈরি হয়ে গেছে। বেশ সমৃদ্ধ ব্যক্তিত্ব, কিন্তু সেটা আর পালটাবে না। ও জীবনকে যেভাবে বুঝেছে সেভাবেই বুঝবে, বুঝতে ইচ্ছুক। ওর নিজের পটভূমি কলকাতায় ও অনেক স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক, কিন্তু এই যাত্রাটাতে যেন ওর মহিমা ফুটছে না। ও প্রকৃতি উপভোগ করছে ঠিকই, কিন্তু কেমন বাইরে থেকে। ও অভিভূত হয় না। একটা দার্শনিক প্রকৃতিস্থতা আছে ওর মধ্যে। যেন কোনও লুকোনো অভিপ্রায়। সেই অভিপ্রায়ে ও অচল অটল।
কাজলকে তাঁর সবচেয়ে পছন্দ। কাজল সত্যি সত্যি এ যাত্রায় তাঁর যথার্থ যাত্রাসঙ্গী। কেননা দু’জনেই এক ধরনের অন্বেষণ-সূত্রে বাঁধা। তিনি খুঁজছেন তাঁর হারানো দিন, তাঁর মাকে। কাজল অবশ্য তার দেশ ও ইতিহাসকে খাতায়কলমে খুঁজছে, তবু জন্মস্থানে এসে হারানো শৈশব, হারানো আপনজনের প্রতি ওর কেমন একটা নৈর্ব্যক্তিক আগ্রহ। সেটাকে টান বলা যাবে না, তাঁরটা যেমন টান। কিন্তু … কিন্তু কী এক মমতা ছেলেটাকে এই মুহূর্তে অধিকার করে রেখেছে একটা মায়ার মতো সেটা তিনি টের পাচ্ছেন। ও বলছে ও পলিটিকসে জয়েন করবে না, এটাতে কিন্তু নিজের লোকেদের উন্নয়নের কিছু সুযোগ ছিল। ও সমাজসেবাও করতে চাইছে না। ও কী চায়? ও কি বিশুদ্ধ অ্যাকাডেমিক! ধাতটাই বিজ্ঞান-গবেষক, পণ্ডিতের?
—আমি ভিতরে গিয়ে চান করে নিচ্চি। আজ আমি ওই জঙ্গলের ইনটিরিয়রে যাব। তুমাদের যদি ঝোগড়া থাকে তো তাই করবে। আমি একা যাবো। ইন ফ্যাক্ট একা যেতেই আমার পোছন্দ হচ্ছে।
তিনি আর অপেক্ষা না করে পুঁতির কাজ করা লাল থলিটা চেয়ারের ওপর ফেলে রেখেই চলে গেলেন। ইয়াং পিপল মানেই ঝোগড়া আর ঝোগড়া, আর ওল্ডার পিপল মানেই সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি—তবে কোথায় যাবেন তিনি? কাউকে নিবেন না, ডাকা তো দুরের কথা। তিনি তাড়াতাড়ি করে নিজের ঘরের দিকে চলতে লাগলেন।
এখানকার জল কীরকম ঠান্ডা। কিন্তু ছ্যাঁক করে ওঠে না শরীর। রতন বলছিল কুয়ার জল কখনও বেশি ঠান্ডা, বেশি গরম হয় না। শীতল যাকে বলে। চান করে মনে হয় একটা নতুন জীবন পেলেন। পোশাক পরে একেবারে নীচে নেমে গেলেন। মনে মনে আবার বললেন—কাউকে নিব না। একা একা যাব। কারো তুমরা ইয়াং জেনারেশন তুমাদের ঝগড়া।
রোতন, আর একটু চা হোবে? —চা-টা প্রায় শেষ করে এনেছেন, হঠাৎ পেছন থেকে লাফ মেরে সামনে চলে এল মিঠু— দিদি পিলচু বুড়ি এসে গেছে। সে এখন রীতিমতো ট্রেকার, টাইটস আর টিশার্ট পরা, কোমরে বেল্ট, যেখানে টাকা পয়সার থলিটা থাকে সেখানটা দেখিয়ে বলল, কুকরি। পিঠেও একটা ছোটখাটো রুকস্যাক। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাজির কাজল— সে শুনতে পেয়েছে মিঠুর কথা। হাসছে, বলল, হাড়াম আয়ো সব হাজির দিদি।
পেছনে পেছনে শিখরিণীও হাজির। সে আজকে সবুজ পাতার রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পরেছে। দেখাচ্ছে খুব সজীব। বলল, আমরা কি এবার যাব, দিদি?
—হাড়াম আয়ো হড় হপন সোব যুদি রেডি তো ঠাকরান আর কী কোরে! মৃদু হেসে কস্তুরী বললেন।— সৃষ্টির আদি ওগাধ জোলে ভেসে পোড়া যাক। তুমরা চান করলে না?
—তা হলে ঠাকরান জিউকে ধরা যেত না। যেরকম মেলট্রেনের মতো ছুটছিলেন!—কাজল বলল— তা ছাড়া, কোথায় যাব, কত ময়লা, ধুলো, মাটি, ঘাম— এসে চান করাই ভাল।
তারও কাঁধে একটা ঝোলা। বলল, আপনার নিমকি লাড্ডুর থলিটা নিয়ে নিন দিদি। কাজে লেগে যেতে পারে।
শিখরিণীর কাঁধে একটা বড় চামড়ার ভ্যানিটি ব্যাগ।
চতুর্দিকে পুটুস ঝাড়। সাদা-হলুদ কুটিকুটি ফুল ফুটে আছে। বনতুলসীর ঝোপ এত দুর্ভেদ্য যে তার মধ্যে দিয়ে পথ বার করাই দুষ্কর। ঝাড়ের পর ঝাড় এড়িয়ে পথ বার করে কাজল। সার বেঁধে সবাই ঢোকে।— শিখরিণী, তোমার জুতো কিন্তু এই যাত্রার উপযুক্ত নয়, পোকামাকড় পিঁপড়ে … মিঠু ওকে বলে দিসনি স্নিকার কি কেডস পরে আসতে!
মিঠু বলল, আমার একদম খেয়াল ছিল না।
ক্রমে শালের চারা বড় হতে থাকে, মহুয়া আরও গাঢ় সবুজ। কেঁদ গাছ দেখিয়ে দিল কাজল— মহুয়ার সঙ্গে খুব একটা তফাত বুঝতে পারল না কেউই।
এর কাঠ দিয়ে তোদের ফার্নিচার হয়। শাল দিয়ে তো হয়ই জানিস নিশ্চয়। শালপাতায় করে হিঙের কচুরি— আহ স্বাদই আলাদা।
শিখরিণী আর মিঠু চোখাচোখি করে হাসল। এই খুনসুটিটা বোধহয় কাজল আজ সারাদিনই করে যাবে।
অনেকক্ষণ চলবার পর ওরা দু’-একজন মেয়ের দেখা পেল, তারা, শালপাতা ছিঁড়ে বোঝা করছে। ক্রমশই এরকম মেয়ে সংখ্যায় বাড়তে থাকে।
—কী করছ গ—কাজল একজনকে শুধোয়!
—তাতে তুমার কী? —মেয়েটি নিজের কাজে মগ্ন, উত্তর দেবার সময় নেই।
—এখানে কাঁচা শালপাতাও খুব চলে বুঝলেন দিদি! কাঁচা শালপাতায় করে যদি স্রেফ ভাত আর ডাল কিংবা শাক খান, আপনার আর কিচ্ছু লাগবে না, শালপাতার এমনই চমৎকার গন্ধ। তবে এই আমিষাশী শহুরে মেয়েদের কী লাগবে বলতে পারছি না!
—শালের গোন্ধও চোমৎকার, তা তুমার পিছনে কাটিও চোমৎকার। উত্তর এল দিদির কাছ থেকে।
আস্তে আস্তে ছাগলছানা, ছানাপোনা সমেত ছাগলি, একাবোকা রামছাগল একটু উঁচুতে দাঁড়িয়ে শিং বাঁকিয়ে দিগন্ত দেখছে। একটা-দুটো বাছুর হামলাচ্ছে। কচি গলা, শুনলেই বোঝা যায়। গোরু চলে গেল কয়েকটা, পেছনে পাচনবাড়ি হাতে একটি বয়স্ক লোক।
—ছুট ছেল্যা নাই, বাগালি কঁরছো? —কাজল আবার শুধোয়।
ছোট ছেলেমেয়েরা পড়তে গেছে ইস্কুলে— সোজা সরল বাংলায় বলল লোকটি।
একটু অবাক হয়ে মিঠু আবার শিখরিণীর দিকে তাকাল।
আর খানিকটা গিয়ে শস্যখেত। —জুনুর— মানে ভুট্টা— কাজল বলল। মনসাপুজো না হওয়া পর্যন্ত জুনুর খাওয়া বারণ। বুঝলেন দিদি?
শিখরিণী বলল, আমরা যেমন সরস্বতী পুজোর আগে কুল খাই না।
বাজরার খেত পড়ল। আলু, অড়হর ডাল। তারপর আস্তে আস্তে দুটো-একটা করে কুটির। একটি কুটিরের দাওয়ায় এক মা তার বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছিল, কৌতূহলী চোখে তাদের দিকে চেয়ে রইল, তারপর বুকের কাপড় টেনে, বলল—টুরিস্ট? আসেন না, বসেন না গ, —মহিলার বিস্মিত দৃষ্টি শিখরিণীর দিকে।
এক পা দু’পা করে এগিয়ে ওরা দাওয়ার বসছিল। মেয়েটি ভেতর থেকে পাতার মাদুর এনে দিল।— এই ঠেঁ বসেন। বাচ্চাটিকে বোধহয় ভেতরে শুইয়ে এল।
—এ কার ঘর?— কাজল জিজ্ঞেস করল।
—ইটা হারান মল্লিকের ঘর।
—লোধা হও?
—লোধা বলেন লোধা, মুণ্ডা বলেন মুণ্ডা। আমরা তো আর বনের জংলি নাই। আমারদের খেতিবাড়ি আছে। ছাগল পালি৷ মোরগ আছে।
—ছেলেপুলেরা সব কই?
—উরা সব ইস্কুলে পড়তে যাঁইছে।
—স-ব?
—স-ব! এ-লোধা, মুণ্ডা, কিসকু, হাঁসদা— স-ব ছেলেমেয়ে পড়ছেঁ।
—বাড়ির বড়রা?
—কাজ কঁরছে।— খেতি আছে, পশু-পক্ষী আছেন তাঁদের তো খাওয়া-চরা চাই! ওঁরা কজন পড়ছে। বয়স্ক বিদ্যালয় হঁইছে না?
—কোন দিকে স্কুল? ওই সাধন মুর্মু নিম্ন বিদ্যালয়?
—না না, সি তো উই দিকে। ওই আমাদের কুলি থে’ বরাবর, সিধা।
—আচ্ছা দেখি গে যাই, হ্যাঁ— আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
হঠাৎ শিখরিণী নিজের ব্যাগ খুলে এক মুঠো লজেন্স দিল মহিলার হাতে।— বাচ্চারা এলে দেবেন।
হাত পেতে নিল বউটি, তারপর বলল, উদের বলব অম্বিকা দেবীর প্রসাদ আছে!
—না, না, সেকী! সেকী! স্টেশনারি দোকান থেকে কেনা, কোনও প্রসাদ নয়।
বউটি মৃদু মৃদু হাসতে লাগল, কিছু বলল না।
কস্তুরী রাস্তায় উঠতে উঠতে বললেন, দেকো কাজল, আমি যেখান প্রথম শিখরিণীকে দেকি তোখন আমারও মনে হোয়— অম্বা, আমাদের ওকানে অম্বার পূজা হয় তো! ব্যাঘ্রবাহিনী দেবী। তুমাদের দুর্গারই মুতো। তবে এতো ছেলেমেয়ে নাই।— তিনি কাজলকেই বললেন কথাগুলো।
আপনাদের তো দুর্গাপুজো নেই, না দিদি!
—না, কিন্তু ও সোময় শুক্লা প্রতিপদ থেকে নওরাত্রি হয়, সে নয়দিন ধরে চণ্ডীপাঠ, ঘটপূজা, উপবাস। ডাণ্ডিয়া নাচ, দশেরার দিন পর্যন্ত। সেদিন রাবণও বধ হল। আমরাও মুক্তি পাচ্ছি।
বউটি যেমন বলেছিল— একটু দূরেই ব্যারাকবাড়ির মতো বিদ্যালয়। সুধীন্দ্রনাথ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। রাস্তা থেকেই দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকটি ঘরে ক্লাস হচ্ছে। একটা কোণের ঘর থেকে একজন বেরিয়ে এলেন। শার্ট প্যান্ট পরা। কিন্তু কাজলেরই মতো।
আপনারা দেখতে এসেছেন?
—হ্যাঁ। ভাল লাগছে। আপনি? …
—আমি বালিরাম ভুক্তা। হেড মাস্টার এ স্কুলের।
—বাঃ, চলুন আপনার অফিস ঘরে বসি।
—নিশ্চয়! আসুন। আসুন মা, দিদিরা।
হেডমাস্টারমশাইয়ের ঘরে একটি কাঠের বেঞ্চি, একটি টেবিল, দু’টি চেয়ার। চেয়ারগুলো প্লাস্টিকের। একটি আলমারিতে পরপর ফাইল রাখা।
দেখতে দেখতে মিঠু বলল— এরা মাধ্যমিক পড়ে কোথায়?
—এখানেই প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক সব।।
—অ্যাফিলিয়েশন আছে?
—নিশ্চয়ই। অনেক সংগ্রাম করে জোগাড় করেছি দিদি। কলেজটি এখনও করতে পারিনি। জিলায় জিলায় যেখানে পায় পড়তে পাঠিয়ে দিই। বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, কৃষ্ণনগর, হুগলি, বর্ধমান। যে যে-বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারে পায়। এ পর্যন্ত ওরাই আমাদের স্কুলের টিচার। অনেকে কারিগরি শিখেছে। এখানে ডোম কমিউনিটি আজকাল দারুণ বাঁশ-বেতের কাজ করছে, কার্পেন্ট্রি আছে, আমাদের লোক্যাল চাহিদা সবই মিটে যায়। বেত-বাঁশ বিদেশে যাচ্ছে।
—মেয়েদের স্কুল নেই?
—ওই তো। এই স্কুলের পেছনে খানিকটা রাস্তা গেলেই, অনেকটা বাগান আছে। হঠাৎ একটু ইতস্তত করেন বালিরাম ভুক্তা—মা, একটি কথা সবিনয়ে নিবেদন করি।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ বলুন।
—মা, দিদি, দাদা আপনাদেরও কাছে প্রার্থনা— যা দেখে গেলেন কাগজে ছাপবেন না।
—আমরা কাগজ টাগজের লোক নই— কিন্তু কেন? শিখরিণী আশ্চর্য হয়ে বলল।
—কাগজে হইচই হবে। রিপোর্টার আসবে, শতেক ইন্টারভিউ নেবে, সরকারি লোক আসবে, সে খুব ঝামেলা। শান্তি নষ্ট হয়ে যাবে আমাদের। ছেলেমেয়েদের মন উচাটন হবে। লেখাপড়ার সময়টা খুব শান্তিতে অভিনিবেশে কাজ করতে হয়। এ শুধু আমার কথা নয়। আমাদের বাবার কথা!
—কার বাবা? কাজল শুধোয়।
—আমাদের সবার বাবা। প্রাণপাত করে যিনি এই গ্রাম গড়ে গেছেন। আমাদের পচুই ছাড়িয়েছেন, আলসে-কুঁড়েমি ছাড়িয়েছেন। নানান কাজে-কামে উৎসাহ দিয়েছেন। আমরা এ দেশের মানুষ, আর সবার মতো আমাদের সব অধিকার আছে, কর্তব্যও আছে, যিনি শিখিয়েছেন … দিকুরা আর আমরা আলাদা নই— একই দেশের …
—কে তিনি?
—সে অনেক দিন হবে। পঁচিশ তিরিশ বছর। শুনলাম কে আসছেন। দূর পাহাড় থেকে। ওঁরা নেমে এলেন আমাদের এখানে—এক হাঁটু কাদা মেখে, হাতে দু’টি বাক্স। কাঁধে ঝোলা, বললেন আশ্রয় দেবে? তা মা, আমরা আশ্রয় দেব কী? তাঁরাই আমাদের আশ্রয় হয়ে উঠলেন। সে সময়ে আমাদের বাবা-মা’রা বলতেন স্বয়ং ঠাকুর আর ঠাকরান আমাদের কষ্ট দেখে, কান্না শুনে, মানুষের বেশে নেমে এসেছেন। আস্তে আস্তে পাহাড় থেকে সব ট্রেনার নেমে আসতে লাগলেন, কত কিছু শিখলাম। মা যখন এখান থেকে পাহাড়ে চলে যাবেন বললেন, কেঁদে কেঁদে সব পথ আটকিয়ে ছিলুম। উনি বললেন— তোরা কি শেষ পর্যন্ত আমার মারাংবুরু হলি? সিংদুয়ার দিবি না? আমার কিরে কেটে বল— আর কোনওদিন হাঁড়িয়া খাবি না। আমি চলে যাচ্ছি আমার আরও অনেক সন্তান আছে, কাজ আছে। তোদের বাবা তো রইল।
কস্তুরী জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর নামেই এই বিদ্যাভোবোন?
—আজ্ঞে হ্যাঁ মা। কোথায় না কোথায় গেছেন তিনি আমাদের শিক্ষা, চাষবাস, আমাদের হাসপাতালের জন্যে। এই ভূমি এরকম ছিল না মা। রুক্ষ, পাথুরে, তিনি আমাদের দিয়ে এইসব পথ বাড়ি ঘর দুয়ার কুয়া সব করালেন। আমার বাল বয়সে আমি ছোট ছোট হাতে এই স্কুলবাড়ির নতুন শাখা গড়ার জন্য কড়াইয়ে সিমেন্ট-বালি মেখেছি। আমি তাঁর ছায়ে ছায়ে বড় হয়ে উঠেছি। কলেজে পড়েছি, টিচার্স ট্রেনিং নিয়েছি মেদিনীপুরে, তারপর এখানে।
—তিনি কোথায়?
—তিনি তো আর নেই মা। স্বদেহে নেই। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি তিনি সবসময়ে আমাদের দিকে চেয়ে আছেন। আমরা বাবার থান গড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু মা লিখে পাঠালেন। না। ভীষণ ক্রুদ্ধ। আর কত বোঙ্গা চাস তোরা? খবরদার বাবার থান গড়বি না। তাঁর আসল থান হল এই গ্রাম, এই রাস্তা, এই স্কুল, চিকিৎসালয়। সব পবিত্র। সব থানে তিনি। এই পবিত্রতা রক্ষা করবি।
কাজল বলল, তা আপনাদের কি আর এখন কোনও দেবতা নেই?
—তা কেন থাকবে না? এখনও মায়েবা তুলসী তলায় মড়লি দ্যান। মড়লি জানেন তো? গোবরের দু’টি গোলাকৃতি মণ্ডল। ভূমণ্ডল কল্পনা করে নেন। এখনও সহরায় পরবে মা ভগবতীর গুণ গাই, সারারাত নাচগান করি। গড়াম-থান তো আছেই। পাঁচ বৎসর বাদ বাদ সিং-বোঙার পূজা করি। আপনারাও যেমন দুর্গা, সরস্বতী, নারায়ণ পুজো করেন। কত দিনের আচার উৎসব চলে আসচে কিনা! কিন্তু নিজেদের কাজটুকু কোনও দেবতা করে দেবেন এ বুদ্ধি তো নাই? কী? আছে?
বালিরাম ভুক্তার মাথার কাছে বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র ও গাঁধীজির ছবি। উনি নমস্কার করে বললেন—এঁরা আমাদের সবার জন্য কত ভেবেছেন, খেটেছেন, নতুন-নতুন ভাবনা, প্রাণ দিয়ে গেছেন সবার জন্যে— আমরা জানি।
আরও কিছুক্ষণ কথা হল। তারপর মেয়েদের স্কুল হাসপাতাল দেখতে যাবেন বলে সবাই উঠলেন। পেছন ফিরে দাঁড়াতেই দরজার ওপরের দেওয়ালে কস্তুরী দেখলেন— স্থানীয় শিল্পীর হাতে আঁকা, কাঠকয়লার স্কেচ। তলায় লেখা—প্রতিষ্ঠাতা সুধীন্দ্রনাথ। আর কিছু না, পদবি না, কোনও ভক্তির কথা না, এঁরা যে তাঁকে ঠাকুর বা বাবা বলে মানেন, সে কথা পর্যন্ত না। শুধু প্রতিষ্ঠাতা— সুধীন্দ্রনাথ।
কীরকম আচ্ছন্নের মতো বেরিয়ে এলেন কস্তুরী। ভাল করে পথ দেখতে পাচ্ছিলেন না। হোঁচট খেলেন। কাজল এক দিক থেকে মিঠু এক দিক থেকে না ধরলে একেবারেই পড়ে যেতেন। মাঝখানে কস্তুরী। চোখ ঝাপসা, দু’পাশে কাজল আর মিঠু চোখাচোখি করল। কাজল জিজ্ঞেস করল, দিদি, আর কি আজ যাবেন? আজ এই পর্যন্ত থাক না! একটা বেজে গেছে। আবার কাল আসা যাবে!
কস্তুরী হ্যাঁ না কিছুই বললেন না। দু’জনেই বুঝতে পারল সরল গাছের মতো সোজা এই মহিলার মধ্যে ঢেউ উঠছে। তিনি প্রাণপণে সে তরঙ্গ রোধ করতে চেষ্টা করছেন। তাঁকে আর একটা কথা বললেই হয়তো ভেঙে পড়বেন। সেটা তাঁর লজ্জার কারণ হবে। ব্যবসায়ী কন্যা ব্যবসায়িনী সমাজসেবিকাদের তো আবেগ থাকতে নেই! আমরা প্রত্যাশা করি তাঁরা সবসময়ে খুব ধীর স্থির আত্মস্থ হবেন। তাঁদের সমস্ত কাজের পেছনে একটা নৈর্ব্যক্তিক দর্শন থাকবে, যান্ত্রিক অনুভবশূন্য বাস্তববুদ্ধি দিয়ে তাঁরা কাজ করে যাবেন।
শিখরিণী তাকাল মিঠুর দিকে, মিঠু তাকাল কাজলের দিকে, চোখে চোখে ইশারা হয়ে গেল। কাজল বলে উঠল আমরা এগোচ্ছি দিদি, আপনি আস্তে আস্তে আসুন। আজকের এপিসোড এইখানেই শেষ কিন্তু। পেটের মধ্যে রাজব্যাং ঢুঁ মারছে। তিনজনে তাঁর অনুমতির অপেক্ষা না করে এগিয়ে যায়।
—কী সুন্দর গ্রাম রে তোদের! মিঠু বলল।
—আমি এরকম দেখিনি, কাজল সংক্ষেপে বলল।
শিখরিণী বলল, আমি বিশ্বাস করি না এরা ইঁদুর খায়। সাপ খায়…
কাজল হেসে বলল, দ্যাখো গোরু-শুয়োর খেতেও তো তোমাদের একদিন খুব আপত্তি ছিল। এখন খাচ্ছ। তো! সাপের মাংস অনেকেরই খুব প্রিয়। আর মেঠো ইঁদুর সত্যিই ফার্স্ট ক্লাস, তুলতুলে নরম।
—আঃ—
—তুমিই তো টপিকটা শুরু করলে বাবা।
—আমি জাস্ট বলেছি এদের ফুড-হ্যাবিট বদলে গেছে।
—আরে বাবা, তোমরা চাওমিন, হ্যামবার্গার খাও বলে তো আর চিংড়ি মাছের মালাইকারি খাওয়া ছাড়োনি, ছেড়েছ?
মিঠু বলল, ফিরে গিয়ে তো আবার রতনের শ্রীহস্তের খিচুড়ি খেতে হবে, মালাইকারি-টারি বলে আর মন খারাপ করে দিসনি।
—দ্যাখো আজকে তো দ্বিতীয় দিন। রতন হয়তো নতুন কিছু সারপ্রাইজ দেবে। বনমোরগের কালিয়া আর…
শিখরিণী ঝেঁঝে উঠে বলল, আমি এখানে নিরামিষ ছাড়া আর কিছু খাচ্ছি না।
সুধীকাকা! সুধীকাকা যিনি কল্যাণী মেহতার সঙ্গে ইলোপ করেছিলেন বলে তিনের এক ফার্ন রোডের আসর ভেঙে গেল, যার জন্য মেয়েকে নিয়ে নরেন্দ্র মেহতা আমদাবাদ ফিরে গেলেন, যার জন্য দাদা-দাদি কোনওদিন মাতৃপ্রসঙ্গ উঠতে দেননি, সেই সুধীকাকা! এদের বাবা। তাঁর জন্য এরা থান গড়তে চেয়েছিল।
গলার জোরে সবাইকে ছাপিয়ে সুধীকাকা গাইছেন— বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/ তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী। —মা বলছেন সুধা, তুমি অত চড়ায় ধরলে আমরা গাইব কী করে?
ছোট্ট কিকির মনে হচ্ছে— গাক না। সুধীকাকা একলাই গাক। চোখ বুজিয়ে বুজিয়ে সে বাংলাদেশের হৃদয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। বাংলাদেশ জানা আছে, হৃদয়ও মোটামুটি জানা, কিন্তু বাংলাদেশের হৃদয় একটা অদ্ভুত মমতাময় স্বপ্ন-দোলনা, সেই দোলনার গভীর আরামে বুঁদ হয়ে একটা অপরূপ ঘুম!
ছ’বছর বয়সে শেষ দেখা। তবু আজ চারকোল স্কেচটা দেখার পর হুবহু মনে পড়ে যাচ্ছে সুধাকাকাকে। স্কেচটা স্বভাবতই আরও অনেক বেশি বয়সের। কিন্তু সুধাকাকার মুখের কাঠামো একই রকম আছে। লম্বাটে। গালের হাড় সামান্য উঁচু, উজ্জ্বল শ্যাম, চোখ দুটো কেমন ঘোর-লাগা, নাকটা বেশ স্পষ্ট, সব মনে পড়ে যাচ্ছে। ধুতির ওপর শার্ট পরতেন সুধীকাকা। গোঁফদাড়ি কিছুই ছিল না। পরেও রাখেননি দেখা যাচ্ছে। একেবারে এক মুখ, শুধু তার ওপর বয়সের বদল। কতদিন মারা গেছেন সুধীকাকা! এদের মনে জীবন্ত আছেন এখনও। কতদিন থাকবেন? আমরা কি কেউ মনে রেখেছি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিকদের? তাঁরা কি ইতিহাসের পাতায়, কি সরকারি অফিসে, কি পুরনোপন্থী বাড়ির দেওয়ালে ছবি হয়ে নেই? শুধু ছবি। আর কিছু নয়। ওঁরা প্রাণপাত করেছেন, আমরা এ. সি. রুমে থাকব বলে, বিদেশি গাড়িতে করে শপিং মলে বিলিতি ফতুয়া কিনতে যাব বলে। ডবল দামে। উপার্জন বাড়লেই আস্তে আস্তে বাড়িতে ঢুকবে জিনিস, আরও জিনিস! ফিরে তাকিয়েও দেখব না রাস্তায় কুকুরের মতো ঘুরে বেড়ানো শিশুদের দিকে। কিশোর বয়স থেকে সংগ্রাম করতে করতে তাঁর বড় হওয়া বিবেকানন্দকে আদর্শ হিসেবে সামনে রেখে সারা জীবন ব্রিটিশের কারাগারে। অসুখ, অসুখের পরে আরও অসুখ, তারই মধ্যে লিখে যাচ্ছেন দেশবাসীর উদ্দেশে অমিত চিঠি, লিখছেন ‘ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ —দেশ, দেশ ছাড়া অন্য কোনও চিন্তা নেই। বিদেশে ইতালি থেকে অস্ট্রিয়া, সেখান থেকে জার্মানি, জাপান, রাশিয়া নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মানুষটি। প্রত্যেকটি সুধীজন, প্রত্যেকটি শক্তিমানের সঙ্গে দেখা করছেন বৈদেশিক সহানুভূতি ও সাহায্যের আশায়। কী মৃত্যু, কী অবসান ওই মহান জীবনসাধনার! এয়ার-ক্র্যাশ। যদি সত্যিই হয়ে থাকে! তাঁকে আমরা মনে রেখেছি? ২৩ জানুয়ারি কোনওক্রমে ছবিতে আর মূর্তিতে মাল্যদান, জাতীয় পতাকা উত্তোলন। কে চেয়েছে তাঁর কাজের ভার কাঁধে তুলে নিতে? তিনি হিন্দু মুসলমান, হিন্দিভাষী উর্দুভাষী, বাংলাভাষী, ধনী-দরিদ্র, বনেদি ঘর, সাধারণ ঘরে কোনও তফাত করেননি। আপামর ভারতবাসীর উন্নয়ন ছিল তাঁর লক্ষ্য। কোথায় এঁদের স্বপ্নের ভারত! যাঁরা সুযোগ পেয়েছিলেন, তাঁরাও কি প্রকৃত সমস্যা দেখতে পেয়েছিলেন? চেয়েছিলেন দেখতে? না নিজের মনগড়া কল্পমূর্তিকে রূপ দেওয়ার অহংয়ে সমস্ত বাস্তবতা বোধ বিসর্জন দিয়েছিলেন! যার ফলে আজ চতুর্দিকে ঘুষরাজ, কলঙ্করাজ, দুর্নীতিরাজ, ইঁদুরের গতিতে মানুষের বংশবৃদ্ধি হয়। ইঁদুরের মতোই খুঁটে খায়, মরে, মানুষের এ চরম অপমান কি কোনও দেশ-প্রেমিকদের গড়া দেশে হতে পারে? না, এখন দেশ-প্রেমিকরা গদিতে বসেন না, বসে রাজনীতি-ব্যবসায়ীরা— নরেন্দ্র বলতেন। কেননা তিনি রবীন্দ্র-সুভাষ-বিবেকানন্দ-অরবিন্দ এই জাদু চতুষ্কোণে চলে এসেছিলেন। তাঁর কাজ আরও সহজ হবে ভেবেছিলেন, এখানকার হাওয়ায় তাঁদের প্রতিভা, কল্পনা, দর্শন ও প্রেমের চূর্ণ হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসছে কিনা!
কী নিয়ে কল্যাণীর সঙ্গে নরেন্দ্রর মতভেদ এত সাংঘাতিক হয়ে উঠল? বাবা যখন নতুন স্টুডিবেকারটা কিনলেন, তখনই, বোধহয় তখন থেকেই। মা বললেন— এটার কি খুব দরকার ছিল?
বাবা— বিজনেসের ব্যাপার, বুঝবে না!
মা— পুরনো গাড়িটা কি খারাপ ছিল? আমাদের তো উদ্বৃত্ত দিয়ে ফান্ড গড়ার কথা ছিল?
—আমার একার উপার্জনে দেশ গড়বে? বাবার গলায় বিদ্রুপের সুর, হাসি।
—তোমার একার নয়, তোমার মতো অনেকের। এক একটা গ্রাম বা অঞ্চল ধরে যদি আমরা কাজ করতে যাই— এ টাকা তো কিছুই নয়! আর অন্য ব্যবসায়ীদের এতে শামিল করার দায়িত্বটাও তোমার আর শরদের। কস্তুরী বুঝতে পারলেন না এই সংলাপ তিনি নিজে এখন বানাচ্ছেন কিনা! অবিকল না হলেও ভাবটা যেন ছিল এই রকমই। নতুন গাড়ি নিয়ে কথা কাটাকাটি তাঁর মনে আছে। সোনার ভারী ভারী গয়নার একটা সেট মা বাবার হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছেন স্পষ্ট মনে আছে। হিরের নাকছাবি, কানের দুল ঝকঝক করছে, গলার মস্ত বড় চাঁদের মতো লকেট। মা’র ভুরু কুঁচকে উঠছে— এ তুমি কী করছ? এসব কী হবে? —কিকির মনে হচ্ছে এই হিরেগুলো তো মা তার জন্যেও রেখে দিতে পারতেন! সে বড় হয়ে পরত বেশ!
—ব্যক্তিগত কিছু থাকা দরকার, কল্যাণী, দুঃসময়ে কাজে লাগে।
—দুঃসময়ে? এর চেয়েও দুঃসময়? দেশ স্বাধীন হয়েছে, অথচ নির্দোষ মানুষের রক্ত চারদিকে, কার দেশ নরেন্দ্র? যে নিজের দেশ থেকে, জমি বসত থেকে উৎখাত হল, দেশটা তা হলে তার নয়! তোমাকে লোভ পেয়ে বসছে, লোভ আর স্বার্থচিন্তা, এখনও শোনো, এখনও ফেরো। চারদিকে মানুষের হাহাকার শুনতে পাচ্ছ? মেয়ে, বাচ্চা, পুরুষ সবার! শুনতে পাচ্ছ না, চতুর হাসি ধুরন্ধর সুযোগসন্ধানীদের? ঘোলা জলে যে ওরাই মাছ ধরবে এবার।
—দেশের লিডার, যাঁদের হাতে আসল ক্ষমতা, তাঁরাই যদি দুর্নীতি দেখতে না পান, চোখ বুজিয়ে থাকেন, আমি একা কী করব?
—একা কেন? তোমার মতো আদর্শবাদী ব্যবসায়ী কি আর কেউ নেই? আমরা, আমি, সুধী, অজিতবাবু, স্নেহদি, নিবেদিতা আমরা কি নেই?
—তোমরা? শুধু মনোবল নিয়ে কিছু করা যায় না কল্যাণী, স্রোতের মুখে কুটোর মতো ভেসে যাবে। সুধী? অজিতবাবু? কী করবে ওরা? টাকার দাম বোঝে? পাঁচ হাজার টাকা একসঙ্গে চোখে দেখেছে?
প্রশান্ত মহাসাগরীয় নীরবতা। ধুধু করছে গভীর জল। বিষ পান করে নীলকণ্ঠ।
না, তিনি বানাচ্ছেন না— গাড়ি, সোনা, হিরে এবং মায়ের বিরক্তি তাঁর মনে আছে। বাবার আক্ষেপ— লিডাররা কিছু করছেন না, তা-ও। আর ওই কথাটা খুব মনে আছে— পাঁচ হাজার টাকা একসঙ্গে চোখে দেখেছে?
পাঁ-চ হাজার! অত টাকা কেউ চোখে দেখে? একসঙ্গে? বাপ রে?
কিন্তু কস্তুরী কখনও হিরে ছোঁননি। তাঁর দাদির গহনা সব তোলা আছে। সোনার চুড়ি কিংবা বালা আর সামান্য মুক্তো শোভা পায় তাঁর অঙ্গে। এর চেয়ে বেশি কিছু হাজার চেষ্টা করেও তাঁকে পরাতে পারেননি দাদি। নাকছাবিতে ছিল রীতিমতো ঘৃণা। এখন দেখেন, ছোট ছোট মেয়েরাও নাকছাবি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কানে রাজস্থানিদের মতো দুটো-তিনটে ফুটো করে হাজারও গয়না পরছে। ভারী ভারী সোনার গহনা, কুন্দন অনন্ত হাঁসুলি পরছেন এমনকী প্রৌঢ়ারাও। চতুর্দিকে গয়নার দোকানের বিজ্ঞাপন। সুন্দরী মেয়েরা মাথা থেকে পা পর্যন্ত গহনা পরে স্বর্ণহাসি হাসছে। দেখলে তাঁর বড় বিতৃষ্ণা হয়, কেমন একটা বিরাগ, যা কল্যাণী মেহতা মাত্র ছ’বছরের মেয়ের মনে গেঁথে দিয়েছিলেন।
বাবা, তুমি এই সুধাকাকার ওপর তোমার নীরব ঘৃণা, আর কল্যাণী মেহতার ওপর তোমার আহত অভিমান কোনওদিন মেয়ের কাছ থেকে লুকোতে পারোনি। আজ স্পষ্ট দেখছি, এদের সুধীন্দ্র আর তোমার ঘেন্নার সুধী এক নয়। তুমি যেমন মাকে বুঝতে পারোনি, তেমনই আরও সুধীকাকাকেও পারোনি। সুধীকাকাই ছিলেন মায়ের আদর্শের সবচেয়ে কাছাকাছি। একসঙ্গে পড়াশোনা করেছিলেন, সুধীকাকা সবচেয়ে সুপুরুষ এবং গুণীও বটে, প্রবল উৎসাহ। একাই দশজনের মনে আলো জ্বালিয়ে দিতে পারেন, সেই চারণকবি মুকুন্দদাসদের মতো।
বাবা, তা হলে অনেকদিন থেকেই তুমি সুধীন্দ্র সম্পর্কে ঈর্ষা পোষণ করেছ? সেই ঈর্ষা-বিদ্বেষের ছোঁয়া লেগেছে রবি জ্যাঠাদের মনেও, নিবেদিতা মাসি! একই ধারণা। বাবা, আমি জানি না মা ও সুধীকাকার ইলোপমেন্টের মধ্যে বিবাহবহির্ভূত প্রেম ছিল কিনা। কিন্তু সৃষ্টিছাড়া দেশপ্রেম মানবপ্রেম যে ছিল সেটুকু জানাই তোমার মেয়ের পক্ষে যথেষ্ট।
অন্ধকার বাংলো চত্বরে ঝমঝম করে গান বাজতে লাগল। বহু মানুষের সম্মিলিত গান। স্পষ্ট করে মুখগুলো বোঝা যায় না, কিন্তু তারা আজকের নয়। অনেকদিন আগেকার, যখন ভারত নবীন ছিল, অসহ গর্ভযাতনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। স্নেহলতা ঘোষ এলো করে শাড়ি পরে আসতেন, রমা সরকারও, নিবেদিতা মাসি ঘুরিয়ে পরতেন, মা যখন বাড়িতে সভা হত, এলো করে, বাইরে যেতে হলে কুঁচি দিয়ে ঘুরিয়ে।
‘ব্যক্তিগত বা দলগত আত্মপরতা, অপরকে দাবিয়ে রাখার প্রবৃত্তি আর সাম্রাজ্যবাদে চরিত্রগত কোনও ফারাক নেই।’ সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন। কথাটা স্বাধীন ভারতবর্ষে বড্ড খেটে গিয়েছিল, গেছে। ব্যক্তিগত, দলগত আত্মপরতা—এই নিয়েই আমরা ঘর করছি। দেশপ্রেম আর নেই। দলপ্রেম। কমিটমেন্ট আর দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি নেই। কমিটমেন্ট দলের প্রতি। সবসময়ে ঘুরে-ফিরে আসত এই আক্ষেপ, বাবা কথাটা বলতেন— কারণে, অকারণে। কল্যাণীর থেকে দূরে গেলেও আকস্মিক আঘাতে তিনি বোধহয় স্থৈর্য ফিরে পেয়েছিলেন। তাই কটন-কিং-এর সাম্রাজ্য নানাবিধ সমাজ-সেবার সঙ্গে যুক্ত ছিল। মেয়েকে নিয়ে তিনি যথাসাধ্য অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন।
সমাজতন্ত্র একশ’বার। কিন্তু রাশিয়ার থেকে আলাদা। বাদ যাবে জড়বাদ, ঢুকবে জাতীয়তাবাদ’ সুভাষচন্দ্রের কথা— বাবা মন্ত্রের মতো জপ করতেন। গুজরাত-কাণ্ডের পর বাবার এক বন্ধু রমেশকাকা বললেন— জাতীয়তাবাদের পরিণাম তো এই নরেন্দ্র। স্বাধীনতার পর কতগুলো দাঙ্গা হল, কতগুলো রাজ্য বিচ্ছিন্ন হতে চাইল, দ্যাখো। সারা ভারত কোনওদিন এক জাতি হবে না, জাতীয়তাবাদ প্রচার করলে এইরকম উগ্র রূপই নেবে।
বাবা বলেছিলেন, ভারতকে সেভাবে এক জাতি হতে কে বলেছে? ইউরোপকে দূর থেকে আমরা এক জাতি বলে ভাবি, তুমি তো জানো, তা নয়। ইংরেজ চরিত্রে আর ফরাসি চরিত্রে আকাশপাতাল ফারাক। আমরা তেমনই আলাদা হয়েও পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুভাবে থাকব। আর দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি আমাদের ভালবাসা দায়িত্ববোধ আমাদের চালিত করবে।
অ্যাবস্ট্রাকশন, ভাবের কথা নরেন্দ্র। ভালবাসা? এক পরিবারে দম্পতির মধ্যে, বন্ধুতে ভালবাসা নেই, আনুগত্য নেই, তার এত বড় বিচিত্র দেশ!
ব্যক্তিগত সমস্যা সব দেশেই আছে রমেশ। কিন্তু নিজের দেশের শিশুদের ফুডে, রোগীদের ওষুধে ভেজাল মিশিয়ে দিচ্ছে, সদ্য সদ্য স্বাধীন হয়ে— এ আর কোথাও পাবে না। নিজের রাস্তা নোংরা করছে, ট্রাম-বাস পোড়াচ্ছে যা নাকি নিজেদের টাকা দিয়েই কেনা—এ-ও তুমি আর কোথাও পাবে না। কোটি কোটি টাকা তছরুপ করছে সরকারি দফতর, নেতাদের কথা তো বলাই বাহুল্য, এ-ও তুমি কোথাও পাবে না। সততা দেখাতে গেলে অবধারিত মৃত্যু… স্বাধীন চিন্তা প্রকাশ করলে কণ্ঠ চেপে ধরবে… এ জিনিসও অচিন্তনীয়।
বুশ— পিতা-পুত্র তো বাকি পৃথিবীর কাছে শয়তান— কস্তুরীর মনে হল—কিন্তু নিজের দেশের ছেলেদের আফগানিস্তানে ইরাকে পাঠাতে তাদের বুক কেঁপে যায়, জবাবদিহি করতে হয় পাবলিকের কাছে— আমাদের ছেলেরা কেন এত মরবে? আর আমাদের এখানে কী হল? কারগিল। জয় এবং চিরদিনের জন্য কারগিল থামাবার জন্য যখন সেনাধ্যক্ষরা অনুমতি চাইলেন, রাজনীতি সে অনুমতি দিল না। একটার পর একটা জাতীয় পতাকা-মোড়া কফিন আসছে। মিলিটারি স্যালুট পাচ্ছে, দূরদর্শনে প্রচারিত হচ্ছে—বীরের এই সম্মান। কেন প্রাণটা দিল ওরা জানে না, প্রাণ দিয়ে যদি কিছু পাওয়া যেত, তার মানে থাকত। কিন্তু অর্থহীন এই প্রাণদান। জয়ের দোরগোড়া থেকে পিছু হঠে যারা, তাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিরর্থক প্রাণদান। মানে এই নীতিকাররা জনসাধারণকে আসলে মানুষ বলে গণ্যই করেন না। শহিদ মৃত্যু গ্ল্যামারাইজ করে আরও কিছু হতাশ বেকার সংগ্রহ করা, তারপর তাদের উদ্দেশ্যহীন মৃত্যুর মুখে পাঠানো। একটা প্রতিবাদ উঠেছে এত বড় দেশের কোনও কোণে! বিধবা মা, পত্নীদের দিয়ে বলানো হয়েছে— তাঁরা নাকি দেশের জন্য তাঁদের প্রিয় মানুষটির আত্মত্যাগে গর্বিত। কোন দেশের জন্য? যে-দেশ তাদের বন্দুকের খাদ্য ছাড়া আর কিছু মনে করে না? নগণ্য? আর রাজনীতিকরা? তাঁরা এত দামি যে একটার পর একটা লজ্জাকর অপরাধ-চুরি-জোচ্চুরি ধরা পড়লেও বুক ফলিয়ে জেলের মধ্যে দরবার বসান। যদি অ্যাট অল জেলে যেতে হয়! সাধারণ চোর জোচ্চোরদের যখন জেলে পোরে ওদের মুখে তোয়ালে টোয়ালে চাপা থাকে, অর্থাৎ এতর পরেও তাদের মুখ দেখাতে লজ্জা করছে। কিন্তু মহান রাজনীতিকরা, নেতারা? তাঁদের সহাস্য, সদম্ভ, পারিষদবেষ্টিত মুখের ছবি কাগজে বেরোয়। ছিঃ!!
কস্তুরীর শরীরে তিরতির করে ছড়িয়ে যাচ্ছে উত্তেজনা। লাল হয়ে যাচ্ছেন, অন্ধকারে। কী করেছেন? কতটুকু করেছেন— এতদিনে? কিচ্ছু না। কাউকে স্বাবলম্বী করতে পারেননি। কোনও গোষ্ঠীকে সপ্তদশ শতক থেকে বিংশ শতকে এনে ফেলতে পারেননি। ব্লাইন্ডদের জন্য, অসহায়দের জন্য সামান্য কিছু চেষ্টা, কুটিরশিল্পকে বাজারজাত করবার প্রচেষ্টা। আর উন্মত্ত গুন্ডাদের থেকে কিছু অসহায় মানুষকে রক্ষা করা। বাস। এতেই তাঁর এমন ভারতজোড়া নাম যে চুপিচুপি, খুব চুপিচুপি পশ্চিমবঙ্গে আসতে হয়েছে। জানতে পারলেই সাংবাদিকরা ছেঁকে ধরবে। বাণী দিন কিছু। বাইট, জাস্ট ওয়ান, ম্যাডাম। নিতাই নস্কর তাঁর জন্য এই গুণী ছেলেমেয়েগুলিকে তাদের কাজকর্ম ফেলে আসতে আদেশ দিয়েছে। তারাও এই অকিঞ্চিৎকর মানুষটির সঙ্গলাভ করে নিজেদের ধন্য মনে করছে।
দিদি, শুতে যাবেন না? —খুব মৃদুস্বরে কে বলল। ফিরে দেখেন মিঠু।
অনেক রাত হল।
চলো, যাচ্ছি—খুব নরম গলায় মেয়েটিকে বললেন তিনি। তুমি ঘুমিয়ে পড়োনি?
না, আপনি আসছেন না দেখছি, যদি বাইরে ঘুমিয়ে পড়েন, ভাবনা হচ্ছিল।
কস্তুরী জানেন না, ওরা তিনজনেই যে যার বিছানায় শুয়ে মিনিট গুনছিল। কতক্ষণে দিদি হুঁশে আসেন, কতক্ষণে তাঁর এই বাহ্যজ্ঞানহীন দশা শেষ হয়। ওঁকে যে একলা থাকতে দেওয়া উচিত— সেটা তো ওরা বুঝছিলই। খাবার সময়ে কী খাচ্ছেন, কতটা খাচ্ছেন ওঁর কোনও হুঁশ ছিল না। অথচ আজকে রতন বেশ ভাল ব্যবস্থা করেছিল। আলুভাতে মাখন, মটর ডাল, আর হলুদ জিরে দেওয়া পোস্তর ঝোল। শিখরিণী তার সেই অদ্ভুত ব্যাগের ভেতর থেকে আচারের শিশিও বার করেছিল।
রাত দশটা এখানে অনেক রাত। শেয়াল টেয়াল বেরোতে পারে। বুনো শুয়োর। কাজল বলল, তোরা যা! ডেকে নিয়ে আয়!
শিখরিণী বলল, তুমিই যাও, উনি তোমাকেই সবচেয়ে মানেন।
মিঠু উঠে দাঁড়াল। আর কোনও অনুরোধ-উপরোধ তর্ক-বিতর্কের মধ্যে গেল না।
সারা সন্ধে ওদের মধ্যে নানান জল্পনা হয়েছে। কাজল সাধারণত কারও গোপন কথা বলে না, হয়তো মিঠুকে বলত, শিখরিণী না থাকলে। কিন্তু কস্তুরীবেন-এর ব্যাপারে শিখরিণী একেবারেই বাইরের লোক।
শিখরিণী বলেছিল, এত অভিভূত হবার কী আছে? আজকাল আদিবাসী উন্নয়নের জন্য সরকার কতরকম প্রকল্প নিচ্ছে। তার সুফল তো কেউ কেউ পাচ্ছেই। এই ভদ্রলোক সুধীন্দ্র খুবই করিতকর্মা লোক, সমস্ত সুবিধাগুলো আদায় করেছেন ওদের জন্য। এইভাবেই সেনসিবল মানুষ কাজ করে থাকে।
মিঠু ভাবছিল, এই কি সেই প্রিয়জন যাঁকে কস্তুরীবেন খুঁজছেন? তিনি আর নেই। মারা গেছেন। তাই মৃত্যুশোকটা ভয়ানক লেগেছে! কত দশকের ব্যবধান কে জানে? এই সুধীন্দ্র ওঁর বাবা নয়, তবে কে? ইনি গুজরাতি নন, বাঙালি মনে হচ্ছে। ওঁর খুব আপনজন কী? কাকাটাকা? ভাই? নাকি কোনও বাঙালি বিপ্লবীই যাঁকে উনি সেই ছোট্টবেলাতেই ‘গুরু’ বলে মেনেছিলেন? একজন ছোট্ট মেয়ে যাঁকে হারিয়েছিল, একজন প্রৌঢ়া কি তাঁর শোকে মূহ্যমান হতে পারেন? সময় চলে যায়, সময়ের ও জীবনের বহু স্তর যা পার হতে গেলে অনেক কিছুই ধুলোর তলায় চাপা পড়ে যায়। তবু মনে থাকে। মনে রাখে মানুষ।
উঠতে গিয়ে কস্তুরী দেখলেন— তাঁর পায়ে প্রচণ্ড ঝিঁঝি ধরে গেছে, নাড়াতে পারছেন না। এক একটা পা ফেলেন আর ঝনঝন করে ওঠে পা দুটো। উঠে দাঁড়িয়ে রইলেন আর পায়ের ভেতর দিয়ে যেন বিদ্যুতের কারেন্ট বইতে লাগল।—কী হল দিদি?
কিকি বলল, ভীষণ ঝিনঝিন ভূত ধরেছে।
ঝিনঝিন ভূত? সে আবার কী? মা চোখ বড়বড় করে বললেন, মাসি পাশ থেকে বললেন—কে তোকে বললে রে ঝিনঝিন একটা ভূত?
দীপ্তি বলেছে, আমার বন্ধু। ও সব জানে!
খুব জানে! মা হেসে ফেলেছেন— ঠিক আছে, বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা চেপে ধর তো!
—ঝিঁঝি ধরেছে? দিদি? হঠাৎ মিঠু নিচু হয়ে তাঁর দুই পায়ের বুড়ো আঙুল চেপে ধরল। তবু একটু সময় লাগল ঠিক হতে।
দু’হাত জুড়ে নমস্কার করলেন কস্তুরী। প্রণাম করাই উচিত ছিল। মা পায়ে হাত দিয়েছেন। কিন্তু বড্ডই ছোট হয়ে এসেছেন যে মা!
আস্তে আস্তে শুয়ে পড়লেন। মিঠু চারপাশ থেকে মশারি গুঁজে দিল। তখন দক্ষিণ কলকাতায় বেশ মশা ছিল। সন্ধে হলে ধুনো দেওয়া তো হতই। মশারি টাঙাতে হত। কিকিকে শুইয়ে দিয়ে মা বলতেন— আমি মশারি গুঁজে দিচ্ছি কিকি, ঘুমিয়ে পড়ো। —তাই তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন।
সে এক হইহই কাণ্ড। কল্যাণী মেহতা মিঠু ব্যানার্জিকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন—দেখছিস কিকি! এই আমার মেয়ে।
অজিতবাবু ভারী গলায় বললেন—ও কেন তোমার মেয়ে হতে যাবে— এক টিপ নস্য নিলেন অজিতবাবু— মেয়েটি আমার, তোমার ছেলে কালো বলে তাকে ডিজওন করছ নাকি?
যে ঢুকল সে সুধীন্দ্র, কিন্তু কিকি দেখলেন সে কাজল মুণ্ডা। সুধীকাকা এইরকম পালটে গেছেন! বুড়ো হলে কি লোকে পালটে যায়? কিন্তু বুড়োবুড়ো তো লাগছে না!
রবি জ্যাঠা বললেন— হয়েছে ভাল। তোমরা কি আমাকে কাউন্ট করছ না!
নিবেদিতা মাসি বললেন— তেলেভাজা আরও আনতে গেছে। আপনি খান না। খেতে খেতেই আরও এসে যাবে।
চা-টি দিব্যি—সিরাজ চাচু বললেন। কাকে ফুল আনতে দিলে? রমা সরকার বললেন—আনতে তো দিইনি। ওরাই পাঠিয়ে দেবে। ধুতি চার বান্ডিল, শাড়ি পাঁচ, ছোট বড় দু’সাইজের ফ্রক আছে। জাঙিয়াও। দু’সাইজের শার্ট প্যান্ট। আপাতত এই তো বলেছে।
যদি কম পড়ে?
আরও এসে যাবে— কে দেবে? আকাশ থেকে পড়বে— সিলিঙের দিকে তাকিয়ে বসে থাকব, পড়বে।
থপ থপ করে শব্দ করে বাণ্ডিল পড়তে লাগল। কী বোঝা যায় না। খালি বোঝা যায় ওগুলো ব্যাঙ। কুনো ব্যাঙ, সোনা ব্যাঙ। রাজ ব্যাঙ?
শরদ তোমার কাজটা ভুলো না।
না ভাবী— শরদ শাহ সাইকেলের চাকার মতো ঘুরতে ঘুরতে চলে যাচ্ছেন। সিঁড়ি দিয়ে গড়াচ্ছেন, শাঁ শাঁ করে আকাশে চলে গেলেন। বাঁইবাঁই করে ঘুরছে আগুনের চাকা।
কল্যাণী, ও যে একেবারে আকাশে চলে গেল। উপায় কী! কাউকে না কাউকে তো যেতেই হবে!
এইসময় খুব ম্লান মুখে ঘরে ঢুকে শিখরিণী বলল— মা আমি যাব? আমার তো কোনও কাজ নেই।
কল্যাণী মেহতার মুখ ক্রমে মিলিয়ে যাচ্ছে। আবছা হতে হতে টুকরো টুকরো কাচের মতো এর মুখ ওর হাত তার পা সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। তখন একটা ক্যালাইডোস্কোপ হাতে নিয়ে কাজল বলল— দেখুন দিদি, কী সুন্দর নকশা সব। কী চমৎকার।
এখনও ভোর হয়নি। কাক ডাকেনি। চরাচর স্তব্ধ। কস্তুরী মশারি গুটিয়ে আস্তে আস্তে নামলেন। পা টিপে টিপে পাশের ঘরে গেলেন— কাজল! কাজল!
—কে? তুই ভাবিস না। সব ঠিক করে দেব। ও কিছু নয়।
—কাজল, আমি দিদি।
—ওহ্ হো, বলুন দিদি, এত রাতে! ঘুমোননি?
—রাত আর কই? কাজল, কাল ওঁদের কাছ থেকে আমার মায়ের হোয়্যারঅ্যাবাউটস তোমায় আনতে হবে।