Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » উজান যাত্রা || Bani Basu » Page 13

উজান যাত্রা || Bani Basu

কতকাল পরে ঝাড়গ্রাম দেখলাম। গাছ ঝুঁকে আসা লাল কাঁকুরে রাস্তা, রাজবাড়ি, ওই পুব দিয়ে বয়ে গেছে ডুলুং নদী। নদীর ধার দিয়ে দিয়ে সরু আঁকাবাঁকা রাস্তা। এই বুনো রাস্তা দিয়ে চললে কনকদুর্গার মন্দির। আরও গেলে গিধনি। দলমা-পাহাড়ের কোলে। হঠাৎ যেন টুরিস্টের চোখ দিয়ে দেখতে পাই। কত অন্যরকম এবং কী সুন্দর আমার জন্মভূমি! এই সৌন্দর্য কখনও দেখতে পাইনি। গাছপালা ভাল লাগত, কিন্তু সে আমার পাড়া বলে, আড়াল বলেও কতকটা। পরিষ্কার পোশাক পরিচ্ছদ পরা লোকগুলোকে দেখে আমরা খরগোশের মতো পালাতাম। ডাকলেও পেছন ফিরতাম না। ওরা অন্য গ্রহের জীব, আমাদের সঙ্গে কোনও মিল নেই।

লোক্যাল গাইডরা বিরক্ত করতে লাগল— মন্দির দেখবেন? সাবিত্রী মন্দির! সবিতা, সূর্যের মানুষ-মেয়ে তিনি। মূর্তি নেই, খালি কেশগুচ্ছ আর খড়গ আছে। চতুমুর্খ শিব আছেন দিদি, লোকেশ্বর বিষ্ণু, মনসা দেবী? আচ্ছা তবে চিড়িয়াখানা, হর্টিকালচারাল গার্ডেন? দিদি চুপ, কেমন টেন্স হয়ে আছেন। শুনছেনই না। একটি হোটেলে খাওয়াদাওয়া সারা হল, ওঁরা অনেক কষ্টে একটা জিপ জোগাড় করে দিলেন। রাজবাড়ির চত্বর গাড়িতে গাড়ি। এখানে ধনী লোকেরা গাড়িতেই আসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে, এখানে অ্যামবাসাডর থেকে টাটা সুমো সবই আছে। এক একটা গাড়ি থেকে নামছেন সুসজ্জিত, ভুঁড়িঅলা, টি-শার্ট প্যান্ট, পায়জামা পাঞ্জাবি, শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, টাইট জিনস্‌, হাতে মোবাইল, হাই হিল। সব গটগট করে চলে গেল। আমরা খাওয়ার জন্য প্রথম ওখানেই গিয়েছিলাম। ওখানে নাকি ঘণ্টা দুই-তিন আগে অর্ডার না দিলে কিছু পাওয়া যায় না। এই প্রথম ঝাড়গ্রামের মল্ল রাজবাড়ির ভেতর ঢুকলাম। চৌকোনা চত্বরে ফোয়ারা, ফুলের কেয়ারি, সিঁড়ি বেয়ে এই প্রথম উঠলাম রাজবাড়ির ডাইনিং হলে। এটাই নাকি সবচেয়ে রাজকীয়। পুরনো রাজবাড়ির এই ঘরটি সম্ভবত দরবার ছিল। বহু ঝাড়। ধবধবে চাদর পাতা টেবিল। পুরনো আমলের রাজকীয় সাইডবোর্ড। তবে আমাদের ভাগ্যে রাজভোগ হল না। দিদি হঠাৎ বললেন, গিধানি যাব।

গিধানি নয়, গিধনি— ড্রাইভার সংশোধন করে দেয়।

আমি কিছু বলিনি। এবার দিদির ইচ্ছা আর আমার ভবিতব্য।

তবে তাড়াতাড়ি ফোন করি ঝাড়গ্রামের ফরেস্ট অফিসারকে। যদি একটা ইন্‌স্‌পেকশন বাংলো বুক করা যায়।

এইভাবে বলি— আমদাবাদের বিখ্যাত কটন কিং নরেন্দ্র মেহতার মেয়ে বিখ্যত সমাজসেবিকা কস্তুরী মেহতা এসেছেন। গিধনিতে হয়তো দু’-তিন দিন থাকবেন। ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল। বললেন, নিশ্চয়ই, আমি খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি।

এসব কথা কস্তুরীবেনকে বলা ঠিক বিবেচনা করলাম না। জেদি মানুষ, হয়তো বলবেন আমি গাছতলায় বসে থাকব।

ক্রমশই পথের পাশে লম্বা লম্বা শাল দেখা দেয়। শালমঞ্জরীর গন্ধে ভারী বাতাস। মিঠু আর শিখরিণী দেখি বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে। —আ-হ! শুধু এই হাওয়া খেয়েই থাকা যায়। বিশুদ্ধ অক্সিজেন! তবে কি এই বিশুদ্ধ অক্সিজেন খেয়েই বেঁচে থাকে এখানকার মানুষ। কতকগুলো ছাগলছানা উলটোপালটা লাফাতে লাফাতে পথ পার হয়ে গেল। রাস্তায় থেকে থেকেই মস্ত চারকোনা মাদুরের মতো ধান শুকোচ্ছে। খুব কৌতূহলে দেখি, স্থানীয় মেয়ে-বউরা ধানগুলো উলটেপালটে দিচ্ছে। একটা বাচ্চা ছেলে গোরুর গলা ধরে ঝুলছিল। একজন মহিলা এসে তাকে তাড়া দিলেন। সে গোরু ছেড়ে দৌড়ে কোথায় চলে গেল। কালো কালো ছেলেটা কিন্তু বেশ পুষ্ট। গা খালি, পরনে একটা নীল রঙের ইজের।

আমি বললাম, এখানে যদি গাড়িটা একটু থামাই দিদি, অসুবিধে হবে?

তুমার দোরকার তো যাও—

আমি রাস্তা ছেড়ে ভেতর দিকে নেমে গেলাম। যত যাচ্ছি খড়ের ঘর, তার গায়ে বিচিত্র ছবি। একটা টালির চালওয়ালা পাকা একতলা। দেখি লেখা আছে সাধন মুর্মু নিম্নবিদ্যালয়। নামটা আলাদা, চেহারাটা আলাদা, কিন্তু মনে হচ্ছে এইখানেই আমার সেই স্কুল ছিল, যেখানে ঘায়ের ওপর বেতের খোঁচানি খেয়েছিলাম। ছাতার বাঁট দিয়ে ছেঁড়া জামাটা দু’ফালা করে দিয়েছিলেন মাস্টার। ভেতরে মনে হল ছেলেরা পড়ছে। রাস্তায় একটি লোক দুটো গোরু নিয়ে যাচ্ছিল। একগাল হেসে বলল— ইটা ছেল্যাদের, মেয়্যাদেরও আছে।

কোথায়?

কিছু দূরে দেখিয়ে দিল, বলল— চলুন যাচ্ছি। আপনি টুরিস্ট? দেখতে এসেছ?

আশা করি মাস্টারদের চরিত্র পালটেছে। লোধা বা সাঁওতাল বলে আর ঘেন্না করে না।

হেসে বলি, হ্যাঁ।

সুন্দরী মল্লিক নিম্নবিদ্যালয় দেখি। ভেতরে পড়ার কলরোল। লোকটি বলল, ঝাড়গ্রাম আদিবাসী সংস্কৃতি পরিষদ আর এই সাধন মুর্মু, সুন্দরী মল্লিক মিলে কর‍্যাছেন। ল হইছে নতুন নতুন। ওঁদের ঠেকাতে পারবেক নাই। গুরু লোক। সব জানে। রিসিভার ঘেঁষতে পারবে নাই।

রিসিভার হল সেইসব লোক যারা লোধাদের দিয়ে চুরিটা করায়। চোরাই মাল বহু দামে বেচে। লোধারা ফুটো কড়ি পায়, আর পুলিশের মার খায়।

আমি বলি, আচ্ছা এখানে আপনারা এখন কেমন আছেন?

—মোটের ওপর ভালই। এই গোরু, ছাগল, মুরগি করছি। আমার ছেল্যা পোলট্রি করেছে মিতের সঙে। এরকম আরও সব নূতন নূতন কাজকাম হইছে। ওই ইস্কুলে আমাদেরই লোক শিক্ষক আছে গ’। শবর, সর্দার, সরেন…।

—আচ্ছা এখানে একটা মুণ্ডাপাড়া ছিল না? খুব গরিব। মোহন সিং, বাসন্তী মুণ্ডা, লক্ষ্মণ… লোধা পাড়ার পাশেই…

লোকটি ভুরু কুঁচকোল। ভাবছে। এর বয়স কত হবে? পঞ্চাশের কাছাকাছি। একটু পরে বলল।— মুখিয়ার কথা বলছ্যান? একটা মুখিয়া ছিল, টিবি হয়ে মরে গেল। অনেকগুলি ছেল্যামেয়া। উদের মা ছেলেগুলি নিয়্যা কুথায় চল্যা গেল একদিন। আমি শুন্যাছি। নিজে দেখ্যি নাই। উঃ ত্যাখন উয়ারা সবসময়ে টং থাকত। সাঁঝ হল্যাই বসে গ্যালো।

এখন?

বাপ রে। সব নিজের নিজের ছেল্যার মাথায় হাত রেখে, মাকে কথ্যা দিয়্যাছি ছুঁব না। পাপ জিনিস।

কোন মায়ের কথা বলছে? কালী? এখানে একটা ছোট কালীমন্দির ছিল বটে।

হর্নের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। ড্রাইভার, সঙ্গে সঙ্গে দিদি আর তাঁর স্যাঙাতরা— সকলেই অধৈর্য।

আমি দৌড়োই। ছোটখাটো ঢিবি, গোবরের স্তূপ টপকে টপকে দৌড়োই।

শিখরিণী বলল, কোথায় গিয়েছিলে? এতক্ষণ লাগল?

এটা আমার ছোটবেলার চেনা জায়গা। দেখতে গিয়েছিলাম। মিঠু দেখি একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে আছে। ও বোধহয় আন্দাজ করেছে।

কস্তুরীবেন বললেন, আসোল কোথা, বুঝলে কাজল, ছুটবেলাই সব বেলা।

আপনি কী বলতে চাইছেন? মর্নিং শোজ দা ডে?

নো, নো। তা টিক নয়। ছুটবেলাই আমাদের গোড়ে। সোব কিচুর রুটস ছুটবেলায়।

যদি ধরুন ছোটবেলায় কেউ খুব সাফার করে, শিক্ষা-সংস্কৃতির স্বাদ না পায়?

সে তখন জিদ করবে। তুমার মতুন হবে।

দিব্যি বসে নাচতে নাচতে চলেছেন। মুখ দেখে কিছু বুঝতে পারলাম না, বুঝে বললেন, না না-বুঝে বললেন।

আমি আমার মুখ বাইরের রুক্ষ হাওয়ার দিকে ফিরিয়ে বসি।

….গোলমতো আলপনা দেওয়া হয়েছে, তাকে বলে ঘঁড়। চালের গুঁড়ি মেথি সিঁদুর সব দেওয়া হয়েছে। কিছু আতপচাল, দুর্বা ঘাস দিয়ে দিহরি পুজো শুরু করলেন। ঘঁড়ের ওপর একটা ধপধপে সাদা ডিম। ধরিত্রী মাতার প্রতীক। রাখালরা সব গোরু দিয়ে আসছে পুজোর থানে। যে বলদ বা গাভী এই ডিম ছোঁবে সেই উৎসবের মধ্যমণি। তাকে তেল-সিঁদুর মাখানো হবে। তার মালিককে সবাই কাঁধে করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্মণ মাঝি সবাইকে হাঁড়িয়া খাওয়াচ্ছে। প্রথম পুজো মারাংবুরুর। তাঁর ভাগে একটি সাদা মোরগ। তারপরে সব যে-যার বংশের দেব্‌তার পুজো দিচ্ছে। পাঁচ দিন ধরে পুজো। সহরায় উৎসব। শরতের পরে হেমন্ত এসেছে। মাঠে মাঠে ধান। চাষি খেটেছে, তার সঙ্গে সঙ্গে ভগবতীও তো খেটেছে সমানে। তাই গো-মহিষদের পুজো, সারহাও মানে প্রশংসা। গো-মহিষরাই কেন্দ্র এই উৎসবের

ও হি রে—

জাগো মা লখিনি

জাগো ভগবতী

জাগোই তো অমাবইসার রাতরে-এ-এ।

আতপচালের গন্ধ, বলির রক্তের গন্ধ, এই দিনের বেলায় শেষবেলার রোদের মধ্যে সহরায়-এর গান ভেসে আসে। আকণ্ঠ উৎকর্ণ শুনি। সাদা মোরগটির জন্য বড় কষ্ট, আমার নিজের মোরগ কিনা! মারাংবুরুর কি মোরগ না হলে চলে না? এই মোরগটা কঁক কঁক করে দৌড়োত… আমি ওর পেছনে ছুটতাম।

কী শিখরিণী। কেমন বুঝছ? গাড়ি কেমন কত্থক নাচছে?— হেসে জিজ্ঞেস করি।

উত্তরে সে বলে, যতখানি আতুপুতু আমাকে মনে করো ততখানি আমি নই হে!

তখন তো কিছু বুঝতাম না— সাদা ডিমটি যে পৃথিবীর প্রতীক সে কথা জানতাম না। জানতাম না, মারাংবুরু পশুপতি জঙ্গলপতি, যাঁকে এরা শিব বলে, জানতাম না সিংবোঙা সূর্য। প্রতিদিনের আধপেটা জীবনে গো-মহিষের কাঁধে ভর করে একটা আনন্দের দিন এসেছে, শুধু এটুকু বোঝাই যথেষ্ট ছিল। খিচুড়ি রাঁধা হবে বলির শুয়োর ভেড়া মরগি দিয়ে। ভাগ পাব নিশ্চয়। অনেক দিনের পর পেটভরে খেতে পাব। সাঁওতাল, মুণ্ডা, কুর্মি, ভূমিজ, লোধা সবার উৎসব সহরায়। যদিও লোধাদের জমিজমা সামান্যই, ওরা কাঠকুটো পাতা কুড়োয়, ইঁদুর পেলে পুড়িয়ে খায়, গোসাপ খেতে তো ওস্তাদ। আমার বন্ধু ছিল সমীর কটাল। চৌধুরী মাস্টার খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে বলত, সমীর, সমীরণ— ভদ্দর নাম নিতে সাধ হয়েছে! মরি মরি! কী ভদ্দর! চান করিস? সাবাং মাখিস? তেল তো বোধহয় জীবনে মাখিসনি। জামাকাপড়? এই ছেঁড়া ত্যানাগুলো পরেই হাগিস, মুতিস, খাস, ঘুমোস, আবার পড়তে এসেছিস? সমীরের আর আমার অনেক কষ্ট করে জোগাড় করা বইখাতা অন্য ছেলেরা কুটিকুটি করে ছিঁড়ে রেখে দিত। শেষকালে সমীর একদিন মাস্টারের কাছে বেধড়ক মার খেয়ে, আবার ঘরে ফিরে গিয়ে বেধড়ক মার খেল বাপের কাছে।

লিখাপড়ার শক হঁইছে? ঘরে চাল নাই। মা, বুন শাক তুল্যা রাঁধছ্যে, তুমি বাবু হঁতে যাইছঁ? পরদিন গোঁজ মুখে আমাকে বলল— তুই যা, আমি আর যাবক নাই। লিখাপড়াতে মার, না লিখাপড়াতেও মার। আমি জঙ্গলে শিকার যাব। খরগোশ পেলে একা একা পুড়িয়ে খাবো। যাঃ।

কে জানে সমীর কী করছে এখন! এখন আমি ওই সমীর কটাল, লক্ষ্মণ মাঝি, বাসন্তী মুণ্ডাদের সঙ্গে একাত্ম বোধ করি না। দায়িত্বও বোধ করি না কি? আমার জগৎ উন্মুক্ত উদার, আমি সিংহবিক্রমে বিচরণ করি স্বনামে, স্বপরিচয়ে, গর্তের ইঁদুর বার করার কাজে উৎসর্গ করার জীবন আমার নয়। এইটুকু বুঝি। তরোয়াল দিয়ে ঘাস কাটার কাজ হয় না। ওই তো আদিবাসী সংস্কৃতি পরিষদ হয়েছে জায়গায় জায়গায়। স্কুল হয়েছে, ছেলেদের, মেয়েদের, ওখানে আমাদের সাঁওতাল, মুণ্ডা, মাস্টারমশাই। ওরা নিশ্চয় কারও ঘা খুঁচিয়ে দিয়ে মজা পায় না, ছেড়া জামা আরও ছিঁড়ে দেওয়ার নিষ্ঠুরতা নিশ্চয়ই ওদের নেই! আমি যে মুণ্ডা পরিচয়কে শিক্ষিত সমাজে সম্মানের যোগ্য করে তুলতে পারছি। এটাও তো অনেক।

হঠাৎ খেয়াল হল— কস্তুরীদি চুপ। আমিও চুপ। দু’টি মেয়ে, বিটি ছেল্যা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।

মিঠু বলছে, আমি মধুপুর এসেছি। গিরিডি যখন গেছি তখন উশ্রীর জল অমন শুকিয়ে যায়নি। তুই সাঁওতাল পরগনা একেবারে দেখিসনি? বাঙালির ছুটি মানেই তো হয় দিঘা, পুরী, দার্জিলিং আর নয়তো শিমুলতলা, মধুপুর, ঘাটশিলা।

শিখরিণী বলল, তা কেন? এখন যেখানে যাবে বাঙালি ট্যুরিস্টের ভিড়, একগাদা ট্রাভল এজেন্ট হয়েছে তারা তো অমরনাথ, কেদার, ছাঙ্গু লেক, সর্বত্র নিয়ে যাচ্ছে। জানো তো, গত বছর দক্ষিণ ভারত গিয়েছি। কন্যাকুমারীতে দেখি ছ’-সাতজন একেবারে গ্রাম্য বুড়ি হাত ধরাধরি করে ঘুরছে! হাত ধরাধরি কেন বলো তো? পাছে হারিয়ে যায়!— শিখরিণী হাসতে লাগল।

মিঠু বলল, ওরা কিন্তু তিন সমুদ্রের সঙ্গম দেখতে যায়নি। তীর্থযাত্রায় গেছে। যে কদিন থাকবে মন্দিরে দু’বেলা হাজিরা দেবে, আর ভারতীয় অন্তরীপের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে গুচ্ছের ফুলপাতা দিয়ে সমুদ্রপুজো করবে। উপরি পাওনা বিবেকানন্দ মন্দির। বিবেকানন্দ কে বলো তো? রামকৃষ্ণের শিষ্য, পরবর্তী গুরু। বাস।

অতটা আন্ডারএসটিমেট কোরো না। রামকৃষ্ণ লিটরেচার, বিবেকানন্দ রচনাবলী তো আজকাল অনেকেই পড়ে, অন্ততপক্ষে ধর্মগ্রন্থের মতো।

তা হলে বলো, এমন দশা কেন? কী রে কাজল! কিছু বলছিস না যে বড়!

আমার কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, তবু বললাম, গ্রেট মেন কাম অ্যান্ড গ্রেট মেন গো। বাট দা আমজনতা গোজ অন ফর এভার। সেই কবিতাটা মনে করতে পারো না, অনবরত পঠিত ও আবৃত্ত হয়ে চলেছে—ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে/ ক্ষমাহীন সংসারে।

মিঠু বলল, ক্লিশে হয়ে গেছে কাজল, ব্যবহৃত হতে হতে, ব্যবহৃত হতে হতে—ওর ভেতরের ম্যাজিক হারিয়ে গেছে। নতুন কবিকে নতুন বাণী দিতে হবে।

আমি হেসে বললাম, তুই এখনও বাণীতেই স্টিক করে আছিস তা হলে? গুড!

এটা কি উপহাস?— মিঠু জিজ্ঞেস করল।

যা বলিস!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress