উজান যাত্রা (Ujan Jatra) : তিনি ও পিসি
রাতটা আজকে যেন একটু বেশি আঁধার। ভেতরের অন্ধকার বাইরের অন্ধকার। কোনটা বেশি তিনি বুঝতে পারছেন না। কেমন একটা স্নায়বিক বিস্রস্ততা তাঁর শরীরে। গরম হওয়া সত্ত্বেও কেমন একটা তিরতির কাঁপুনি। কস্তুরী চান সেরে অন্ধকার বারান্দায় বসে রইলেন অনেকক্ষণ। বেশ গুমোট। তবে মাঝেমাঝে গুমোট ভেঙে হাওয়া দিচ্ছে। গন্ধরাজের দিন বোধহয় শেষ হয়ে গেল। আর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো গন্ধ পাওয়া গেলেও তিনি সইতে পারতেন না। প্রথম সন্তান-সম্ভাবনার সময়ে যেমন হয়েছিল! অনেকক্ষণ তাঁর মাথাটা অসাড় হয়ে রইল। কীরকম একটা ক্রোধ হতে লাগল প্রয়াত নরেন্দ্র মেহতার ওপর। সত্য, সত্য থেকে কাউকে কখনও দূরে রাখতে নেই। কেন? কেন বাবা এমন করলেন? কত দুঃখ পেতেন তিনি? মায়ের চলে যাওয়ায় ছোট্ট মেয়েটির যে মৃত্যুশোক হয়েছিল তার বেশি কি? ওই যে মেয়েটি মিঠু, ভারী চমৎকার মেয়ে, ওর মায়ের মৃত্যু কবে ঘটেছে জানেন না, কিন্তু এখনও সে কথা তুললে ওর বাহ্যজ্ঞান লোপ পায়, ওর চেয়ে বেশি কি? কী এসে যায় সৎমায়, তিনি যদি সত্যি মায়ের মতো হন! কিচ্ছু না। তিনি তো এখন এই উত্তর-পঞ্চাশেও সেই হাতের স্পর্শ, বুকের গন্ধ, চুড়ির টুংটাং, সব টের পান। দুঁদে ব্যাবসাদার, হাজার কাজের কাজি তিনি যে এখনও ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে তাঁকে দেখেই কেঁদে ওঠেন! নাঃ। তিনি পালিকা-মা হলেও কিছু এসে যায় না। আসলে ভয়ংকর ওই মন্তব্য— নিজের মেয়ে নয় বলেই বোধহয় চলে যেতে পারল! ওভাবে কেউ যায়! তা হলে তাঁর কাছে মা যতখানি, মায়ের কাছে তিনি কি কোনওদিনই ততখানি ছিলেন না? মাতৃহীন একটি শিশুকে মানুষ করছিলেন এই মাত্র! এবার ক্রোধ হতে লাগল রবিপ্রসাদ বর্মন নামে ওই বৃদ্ধের ওপর। ঠিক আছে বলুন না সত্য কথা, মন্তব্য করার দরকার কী! ওঁর কি একবারও মনে হল না মা-মেয়ে সম্পর্কের এমন বিচার শুনে ছোট্ট কিকির কেমন লাগতে পারে! নাঃ, তিনি তো আর সেই ছোট্ট কিকি নন। এক প্রৌঢ়া। অভিজ্ঞতা যাঁর মুখে নিজের ছাপ মেরে দিয়েছে। বৃদ্ধ বোধহয় মনে করলেন এ তো প্রায় বুড়ো হয়ে এল। এর আবার মা-সংক্রান্ত ফিলিং কী! উনি বোঝেননি। সম্ভবত কেউ বোঝে না একটা বড় বয়স্ক মানুষের মধ্যেও একটা শিশু বেঁচে থাকে, যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে পারে, যে … নিবেদিতামাসি তাঁকে পেয়ে কাঁদেননি! এই রবিজেঠু … রবিপ্রসাদও যে তাঁকে পেয়ে দেড় ঘণ্টা-দু’ঘণ্টা পুরনো দিনের কথা বকবকবকবক করে গেলেন সে-ও তো শিশুমিই। শিশু যেমন আপন মনে তার নিজের জগতের কথা নিজেই বলে।
আরও রাত্তিরে রামলাখন রুটি আর আলুভর্তা নিয়ে এল।
কস্তুরী বললেন, দুধ মিলেগা রামলাখন?
হাঁ জি!
তো দুধ লাও থোড়া।
কঠিন কিছু আজ তাঁর গলা দিয়ে নামবে না। বেচারি রামলাখন। ওকে তাঁর আগেই বলা উচিত ছিল। এত রাত্তিরে কোথা থেকে দুধ জোগাড় করবে? তাঁর বাড়িতে তো আর ফ্রিজ নেই! হয়তো নিজের জন্য রেখেছিল। সেটাই তাঁকে দেবে।
মাঝরাত্তিরে কস্তুরীর কোলাপসিবলে দমাদ্দম আওয়াজ। প্রচণ্ড শব্দে একটা গ্রেনেড ফাটল। ধোঁয়াধোঁয়া। একটু পরিষ্কার হতে তিনি দেখলেন তাঁর মা, হালকা নীল রঙের কালো দাঁতপাড় শাড়ি পরা ছিন্নভিন্ন হয়ে লুটিয়ে রয়েছেন। হাতে জাতীয় পতাকা, এক ভাঁজ হয়ে শুয়ে আছে। অশোকচক্রের আধখানা দেখা যাচ্ছে। কোলাপসিবল্ খুলে তিনি উন্মত্ত জনতার মধ্যে, বোমা বন্দুকের মধ্যে ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইছেন, কারা পিছন থেকে তাঁকে বাধা দিচ্ছে। এখনও আশা আছে। অ্যাম্বুলেন্স, অ্যাম্বুলেন্স, কোথায় জনতা? নির্জন রাস্তা দিয়ে তিনি তাঁর মায়ের দেহ নিয়ে কোন অদৃশ্য অনস্তিত্ব হাসপাতালের দিকে চলেছেন। অনেক দূর থেকে আবছা মুখ কারা যেন তাঁকে অনুসরণ করছে। জাতীয় পতাকাটা মা’র হাত থেকে খসে পড়ে গেল। কিকি আর কেয়ার করে না। মাতৃমুখ ছাড়া ওই পতাকা একটা কাপড়ের টুকরোর বেশি কী!
শেষ রাত্তিরের হালকা ছায়া। কস্তুরী ঘর্মাক্ত জেগে উঠে সদ্য দ্যাখা স্বপ্নের প্রতিটি পুঙ্খানুপুঙ্খ খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। সন্দেহ নেই, ২০০২ ফেব্রুয়ারির শাহপুরের সেই বিভীষিকা তাঁকে ছাড়ছে না। কিন্তু মা কেন ছিন্নভিন্ন? এ কি সেই দেশ যাকে তাঁদের বাবার জেনারেশনের লোকেরা মা বলত, মা বললেই কি সবচেয়ে বেশি ভক্তি, ভালবাসা, দায়বদ্ধতা আসত! তা হলে এই মা কেন তাঁর মায়ের বেশে! একটা প্রসঙ্গের সঙ্গে আর একটা প্রসঙ্গ কি জুড়ে গেছে? তবে কি তাঁর অসাবধানতা, তাঁর অবিচারই ছিন্নভিন্ন করছে মাকে?
সকালবেলা উঠে চানটান সেরে, নিয়মিত ব্যায়াম ও প্রাণায়ামের পর তিনি মুখে একটি হরিতকী আমলকির বড়ি ফেললেন। দুটো মর্তমান কলা ছাড়িয়ে খেয়ে ফেললেন এক বাটি মুড়ি গরম চায়ের সঙ্গে। এবং সংকল্প করলেন— না, এখানেই ছেদ টানা নয়। তাঁকে যেতে হবে সিরাজচাচুর কাছে। সম্ভব হলে রমা পিসিমার কাছেও। ক্রস-চেক করো কস্তুরী। সবসময়ে ক্রস-চেক করবে। দলিলপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়বে। অডিট দেখবে। স্টেটমেন্ট অব অ্যাকাউন্টস ঠিকঠাক ফাইলে আছে তো? সেক্রেটারির ওপর পুরো নির্ভর কোরো না। যতই যোগ্য হোক, মানুষই তো! ভুলভ্রান্তি হতে পারে। ক্রস-চেক করো, ভেরিফাই করো কস্তুরী।
তিনি ঘড়ি দেখলেন, রামলাখনকে বললেন— ঠিক দশটার সময়ে তিনি বেরোবেন। ভাড়ার গাড়ি চাই। সুখের বিষয়, কোনওটাই খুব দূরে নয়।
সার্কাস রোয়ে গিয়ে দেখলেন একটা জি-প্লাস ফোর নতুন বাড়ি। তার লেটার বক্সে কোনও আলির নাম দেখলেন না। তিনি এ-ও জানেন না সিরাজচাচুর এটা নিজের বাড়ি ছিল কিনা। কো-অপারেটিভের অফিস রয়েছে না? ভেতরে এক ভদ্রলোক ঢুকছেন তালা খুলে। কস্তুরী গিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ালেন— এক্সকিউজ মি। ভদ্রলোক ফিরে তাকালেন— আই ওয়ান্টেড সাম ইনফর্মেশন।
—ইয়েস! ভদ্রলোক শুনতে প্রস্তুত।
—আই ওয়জ লুকিং ফর আ সিরাজ আলি, হু ইউজড টু লিভ হিয়ার।
—ওয়াজ হি বাই এনি চান্স দা ওনার অব দা ল্যান্ড?
—আই হ্যাভ নো আইডিয়া।
—স্যরি ম্যাডাম, অ্যাজ ফার অ্যাজ আই নো, দিস প্রপার্টি ওয়জ বট বাই আস ফ্রম মহম্মদ আখতার। হি হ্যাজ এ ফ্ল্যাট হিয়ার, ইউ ক্যান আসক্ হিম!
মহম্মদ আখতার! আলিরা তো নিজেদের আলিই বলবে! মহম্মদ আখতার! ঠিক আছে, তিনি দেখবেন। সবচেয়ে ওপরের তলার দক্ষিণ কোণের ফ্ল্যাটটা। বেল টিপলেন। দরজা খুললেন এক ভদ্রমহিলা। সালোয়ার-কামিজ পরা। বয়স্ক।
কাকে চান?
সিরাজ আলি বলে কুনও বৃদ্ধ মানুষ একানে থাকেন?
সিরাজ আলি? এ তো আমাদের বাড়ি। প্রোমোটার বাড়ি ভেঙে করেছে।
আগে, কে থাকত একানে?
ভাড়া ছিল অনেকগুলো।
তাঁদের মধ্যে কেউ? সিরাজ আলি?
আমি মোটামুটি এঁদের সবাইকে চিনতাম। সিরাজ আলি বলে কেউ… ওহো রিয়াজদের কেউ হতে পারেন। তবে কোনও বুড়ো মানুষ আমি দেখিনি।
তার মানে সিরাজচাচু এই রিয়াজদের কেউ হলেও এই ভদ্রমহিলা তাঁর বিয়ের পর তাঁকে দ্যাখেননি, মানে তিনি নিশ্চয়ই গত হয়েছিলেন।
মানুষ কেন এত তাড়াতাড়ি মারা যায়! আরও আয়ু দরকার। চল্লিশ বছর থেকে মানুষ সত্যি সত্যি সচেতনভাবে বাঁচতে আরম্ভ করে। করে না? সিঁড়ি দিয়ে তিনি মন্থর পদক্ষেপে নেমে যাচ্ছিলেন, পিছনে দরজা আধখোলা, ভদ্রমহিলা কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখছেন। সাদা শাড়ি পরা এই মহিলাটি খুব হতাশ হয়েছেন, তিনি বুঝতে পারছেন।
দুরুদুরু বুকে গর্চা ফার্স্ট লেনে ঢুকলেন কস্তুরী। বেশ খানিকটা ঘুরেছেন। দোনামোনা করেছেন। সইবে তো? আরও আঘাত? তিনি কি এখানেই থামবেন? একটা ছন্ন গল্প নিয়ে ফিরে যাবেন? না, তা হয় না। সত্যের মুখোমুখি হবার সাহস তোমার আছে কস্তুরী, না হলে… পুরনো ধরনের বাড়ি তো রয়েছে, সভয়ে দেখতে লাগলেন কোনও বহুতল আছে কিনা।
এই বাড়ি ম্যাডাম— ড্রাইভার বলল। বেল বাজালেন। দরজা খুলল।
রমা সরকার এই বাড়িতে থাকেন?
মেয়েটি বোধহয় কাজের লোক। দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল, ওপরে যান। সিঁড়ির মাঝ থেকেই চটি দেখতে পেলেন কস্তুরী। চটি, নানা রকমের। ছেঁড়া, ধুলোমাখা। ওপরে দালান। একটি ঘরের পরদা হাওয়ায় দুলছে। ভেতর থেকে সুর করে নামতা পড়ার আওয়াজ আসছে শিশুকণ্ঠে।
দালানে দাঁড়িয়ে কস্তুরী একটু চেঁচিয়ে ডাকলেন, রমাপিসিমা! রমাপিসিমা!
পাশের ঘরের পরদা সরিয়ে দু’-তিনটি বালক-বালিকা এসে দাঁড়াল।— দিদু চান করতে গেছে, তুমি বসো।
—কোথায় বসব বাবা!
—এইখানে।
কস্তুরী ঘরের একমাত্র চেয়ারটিতে বসে অনন্তকাল অপেক্ষা করতে লাগলেন। নামতার পরে ওরা এখন স্লেট-পেনসিল বার করে লিখছে। নেহাতই বাচ্চা, কিন্তু মনে হল বেশ অখণ্ড মনোযোগে লিখছে। প্রথমে স্কেল দিয়ে স্লেটের ওপর পরপর দাগ কেটে নিল। একটি বাচ্চা তাঁকে জিজ্ঞেস করল— ধান্য বানান দন্ত্য নয়ে নয়ে হবে না য-ফলা হবে। তিনি উত্তর দিলেন। তারপর কৌতূহল হল, ছেলেটির কাছ থেকে স্লেট টেনে নিয়ে দেখলেন লিখেছে: ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা/ তাহার মাঝে আছে সে দেশ সকল দেশের সেরা।/ সে যে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
বাচ্চাটি বলল, এই গানটা আমরা রোজ গাই। তপু গাইতে পারে না, ওর গলায় সুর নেই। আমার পাশে দাঁড়িয়ে গায় তো! আমারও সুর ভুল হয়ে যায়।
তখন বেশ একটা গোলমাল পড়ে গেল। একজন বলল, তুইও গাইতে পারিস না, লিখতেও পারিস না, খালি নালিশ করতে পারিস।
একজন বলল, তপুর গলায় সুর নেই তো কী হবে! ভগবান দেননি। কিন্তু ও তো সবার আগে যোগবিয়োগ কষে ফেলে।
কী হচ্ছে তোমাদের? এত গোলমাল কেন? এক বৃদ্ধা এসে দাঁড়িয়েছেন। লাল পাড় শাড়ি পরা, মাথার চুলগুলি কাঁচাপাকা। মুখটি প্রশান্ত।
কস্তুরী উঠে দাঁড়ালেন। প্রণাম করলেন। তারপর উঠে বললেন, চিনো? দেখো তো!
হাঁ করে চেয়ে রইলেন রমাপিসিমা, তারপর বললেন, কিকি, না?
তিনি কস্তুরীকে একেবারে জড়িয়ে ধরলেন। বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বললেন— তোমরা বসে বসে লেখা করো। আমি আসছি।
পাশের ঘরটি রমাপিসিমার শোবারঘর।
—বসো কিকি, পা মুড়ে বিছানায় ভাল করে বসো।
—তুমি কেমুন আছো পিসিমা!
—খুব ভাল। এই তো এদের নিয়ে চমৎকার কেটে যাচ্ছে। তুমি?
—অতটা ভাল বুলতে পারছি না।
কেন? নরেন্দ্রদাদা ভাল আছেন তো!
বাবা এই কো মাস আগে, ফেব্রুয়ারিতে চলে গেছেন।
রমাপিসিমা হাত জোড় করে নমস্কার করলেন, বললেন, দুঃখ কোরো কিকি। ওঁর যা বয়স হয়েছিল তাতে… একসময়ে প্রিয়জনদের ছেড়ে দিতে হয়।
—পিসিমা, আমার মা-ও কি…
—না না, কিছু হলে শুনতুম…
—কোথা থেকে শুনতে পিসিমা…
বৃদ্ধা ওঁর মুখের দিকে তাকালেন, বললেন, কল্যাণী তো অনেক দিন চলে গেছে, এত দিন তো কেউ খোঁজ করেনি কিকি? আজ এই অবেলায় কেন?
আমি এখন আর ছুট্ট কিকি নেই। আর আমি যে-কেউ নই, তাঁর মেয়ে। আমার কি জানবার অধিকার নেই?
—তোমার বাবা তোমাকে কিচ্ছু বলেননি?
—না।
—তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে?
—মায়ের প্রসোঙ্গ উঠলেই উনি চুপ করে যেতেন, মনে হত খুব কোষ্ট পাচ্ছেন তাই… আমার তো আর কেউ ছিল না।
—কেন তোমার ঠাকুরদা-ঠাকুমা?
—ওঁরা তো কোবেই চলে গেলেন।
—যাই হোক, ওই কদিনের জন্যও ছেলেকে নাতনিকে কাছে তো পেয়েছিলেন!
—তা তো পান। কিন্তু আমার মা কোথায় গেলেন, কেন গেলেন, যদি গেলেন তো আমায় নিয়ে গেলেন না কেনো? বোলে গেলেন না কেনো?
—এতদিন পরে এসব কথা তোমার মনে জাগছে কেন? কেউ কি তোমাকে বুঝিয়ে বলেননি?— দাঁড়াও তোমার জন্যে চা করে আনি।
—আমার চা হয়েছে। পিসিমা।
—আমার জন্যে। একটু বারবার চা না খেলে আমার চলে না কিকি।
কস্তুরীর মনে হল, চায়ের নাম করে রমাপিসিমা একটু সময় নিচ্ছেন। কিছুক্ষণ পরে উনি দু’কাপ চা আর গাঁঠিয়া নিয়ে ঢুকলেন, বললেন, আমাদের সেই বাঙালি খুকি তো আর নেই দেখছি। একেবারে গুজরাতি কিকি-ই হয়ে গেছে।
—বাঙালি, গুজরাতি, মারাঠি, পঞ্জাবিতে কী তফাত পিসিমা, সোবাই তো একই ভারতের!
—তুমি কি সত্যিই এখনও তাই মনে করো কিকি? তুমি কি এখনও আমাদের অতীতের মতো স্বপ্নে বাস করো? তাহার মাঝে আছে সে দেশ সকল দেশের সেরা!—রমাপিসিমা হাসলেন।
—একটু বুঝিয়ে বলুন কী বলছেন!
—তুমি অনুভব করো না এখন ভারত এক নয়, অনেক। গুজরাতি ভারত, মারাঠি ভারত, পঞ্জাবি, হরিয়ানি, বিহারি, অসমিয়া,… অজস্র ভারত। এক একটা রাজ্যেও আবার বহু ভারত, যাদব ভারত, জাঠ ভারত, ব্রাহ্মণ ভারত, আদিবাসী ভারত, জোতদার ভারত, মজুর ভারত। কোটিপতি ভারত, দারিদ্র্যসীমার নীচের ভারত, মুসলিম ভারত, হিন্দু ভারত এবং সবকিছু ছাপিয়ে ক্রমশ মাথা তুলছে মার্কিন ভারত। চারিদিকে মৃত্যু দেখতে পাই, দেহের মৃত্যু, মনের মৃত্যু, বুদ্ধি, যুক্তি, সততা, ভালবাসা, দেশপ্রেম… সবকিছুর মৃত্যু। তুমি পাও না? …পাবে না, কেননা কিকি তোমরা আমাদের বংশধর, কিন্তু সেই কথা আছে না?— এক পুরুষ খাটে, পরের পুরুষ গড়ে, তার পরের পুরুষ ভোগ করে, আর তার পরের জন নষ্ট করে সব। সমস্ত। তোমরা… তোমাদের গড়ার জেনারেশন ছিল, পারোনি, তারপরে ভোগীরা এসে গেল, আর তারপরে সব ছন্ন করা নষ্ট করার জেনারেশন উঠছে।
—এতটা হোতাশার কারণ নেই পিসিমা। বড় জটিল দেশ, জটিল। ফুল অফ ভ্যারাইটিজ। ভুল হোবে, শুধরাবে, ধীরে ধীরে হোবে।
—কীসের জটিল? ধর্মবিশ্বাস তো ব্যক্তির ঘরের ব্যাপার, তাকে লাউডস্পিকার দিয়ে সর্বজনীন করার কী দরকার? কীসের জটিল?— খাদ্য, পোশাক, রুচি, ভাষা আলাদা তো থাক না যে যার সম্মান নিয়ে আলাদা, একজন কেন বহুজনকে গ্রাস করে? এক ভাষা কেন অন্য সব ভাষাকে গ্রাস করে দাবিয়ে পুষ্ট হচ্ছে। যারা বনেজঙ্গলে বাস করে ফুড গ্যাদারার আর হান্টার থেকে ধীরে ধীরে কৃষিকে তাদের জীবিকায় স্থান দিয়েছিল, তাদের রুজি-রোজগারের উপায়গুলোও কেন তোমাদের স্বাধীন ভারত কেড়ে নিচ্ছে। আর তাদের নামে যেখানে আলাদা রাজ্য হচ্ছে, সেখানে আরণ্যক মানুষ এক নষ্ট সংস্কৃতির ছোঁয়াচে কোটি কোটি টাকার গাড়ি চড়ে বেড়াচ্ছে কেন? পাবলিক মানি লুঠ হয়ে যাচ্ছে, কেউ যদি তা থামাতে যাচ্ছে তো খুন হয়ে যাচ্ছে। যেখানে যে সৎ মানুষ আছে হয় তার বদনাম, নয় সাইড লাইনড আর নয় সরাসরি খুন— সে ডাক্তার হোক, আই এ এস অফিসার হোক, দলনেতা হোক, সাধারণ গৃহস্থ হোক, গরিব কৃষক মজুর হোক, কেরানি হোক। একটা স্বাধীন দেশের তরুণদের কেন ডাকাত হতে হয়! দাঙ্গাবাজ গুন্ডা না হয়ে বাঁচবার অন্য উপায় থাকে না কেন? …শোনো শোনো… বড় বড় অর্থনীতিবিদ আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের থিয়োরি আউড়িয়ো না। দে হ্যাভ নো ইম্যাজিনেশন। ধর্মনিরপেক্ষ? ওরা জানে ধর্মের মানে? ধর্ম হল মানুষের মানবধর্ম, তার বেসিক মনুষ্যত্ব। মুণ্ডারিতে ‘ধিরি’ মানে পাহাড় বা পাথর। ‘ধিরি’ থেকে স্যানসক্রিটাইজড হয়ে হল ‘ধৃ’। তার থেকে ‘ধর্ম’, যা পর্বতের মতো অচল অটল মূল প্রপার্টি মনুষ্যত্বের। সেই ধর্মই যদি না থাকল তা হলে কী রইল? হ্যাঁ, ধর্মমতনিরপেক্ষ বলা যেতে পারে বটে। শব্দগুলো সাবধানে চয়ন করা চাই।
দু’জনেই চুপ করে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর রমা ধীর গলায় বললেন, কল্যাণী চলে গেছে সেইখানে যেখানে তাকে প্রয়োজন। কেউ কেউ আসে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে, তারা দেশকে সর্বাগ্রে স্থান দেয়। টাকা-পয়সা-বিলাস-ব্যসন— এমনকী নিশ্চিন্ত ঘরসংসারের বাঁধনও তাদের বেঁধে রাখতে পারে না। তোমার হয়তো দুর্ভাগ্যই। কিন্তু এ দেশের সৌভাগ্য কল্যাণী মেহতা সেইরকমের একজন মা। আগে মানুষ, পরে মা। বলছি না সবাইকেই তার মতো হতে হবে। কিন্তু দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি সবাইকার মিনিমাম কমিটমেন্ট থাকলে একজনকে এত আত্মত্যাগ করতে হয় না। কিকি ফিরে যাও, তার খোঁজ কোরো না। এতদিন যখন কেটে গেছে, বাকি দিনগুলোও যাবে। এখন এই বয়সে তোমাকে দেখলে ও বড় ব্যক্তিগত কষ্ট পাবে, তুমিই তো ওর একমাত্র বাঁধন। ছিঁড়তে যে কত দুঃখ পেয়েছে আমি জানি!
—রমাপিসিমা, মায়ের এখন বোধহয় আটাত্তর বছর পার হয়ে গেছে। দেশকে যা দেবার এতদিনে দেওয়া হয়ে গেছে। এখনও যা পারেননি তা আর কাউকে পারতে হবে। আমার মাকে আমি অন্তত দেখতে চাই। মিলতে চাই মা’র সঙ্গে। কুনোও ওজর আপত্তি আমি শুনবো না। সোবই যদি নোষ্ট মিথ্যা তো বাচ্চাগুলোকে স্বোপ্নো দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা শিখাচ্ছেন কেন? ইলিউশন নিয়ে বড় হলে, ওদের কী দোশা হবে? স্বোপ্নো মানেই তো স্বোপ্নোভঙ্গো। —কস্তুরীর গলায় এখন জেদ, তিনি তর্কের জন্য প্রস্তুত।
রমাপিসিমার মুখটা হঠাৎ হাসিতে ভরে গেল। উনি বললেন, বুঝতে পারলে না? আমাদের মতো আর একটা জেনারেশন তৈরি করতে চাইছি। যারা ভালবাসবে। স্বপ্নটা বড় নয়, ভালবাসাটা বড়। কিকি, ওরা স্ট্রিট চিলড্রেন, অনেকে আছে যাদের মায়েরা এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে। এদের জন্য ভাববার কেউ নেই। নাম-কা-ওয়াস্তে কর্পোরেশন স্কুল হয়। চক-ডাস্টার, বসবার জায়গার অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। স্নেহের অভাবে উপস্থিতি থাকে না। ওদের ভালবাসা দিচ্ছি। আর শেখাচ্ছি, শুধু অক্ষর পরিচয় নয়। —ভাল-মন্দের তফাত, ন্যায়-অন্যায়ের বিচার যেন ওরা করতে পারে। দ্যাখো কিকি, সবাই ভাবে লেখাপড়া শিখলেই একটা চাকরি করব আর একটা টিভি. কিনব। গ্রামে-গঞ্জে কিষানের ছেলে লেখাপড়া শিখে শহরে পিয়োন হয়। মাঠ পড়ে থাকে, মাটি কাঁদে। আমার লক্ষ্য পিয়োন বেয়ারা গড়া নয়। সেই মানুষ গড়া যে এদেশকে নিজের বলে জানবে, মায়ের মতো ভালবাসবে। আর স্বপ্নভঙ্গ বলে ওদের কিছু নেই। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। বাজে ধূপ, শ্মশান-সমাধির ফুল এইসব ওদের হাতে ধরিয়ে দেয় ওদের মালিকেরা, করুণ বাচ্চা মুখগুলো—তা-ও বিজ্ঞাপন। আর বাড়িতে সাত বাড়ি কাজ করা মা গালি দেবে, মারবে, এতে আর আশ্চর্য কী! এরাই আমার কুমোরের মাটি, ভদ্দরলোকরা নয়। স্বপ্ন কিছু নেই। স্বপ্ন মানে ইলিউশন নয় কিকি। স্বপ্ন মানে আশা। দুর্জয় আশা, আর দুর্মর ভালবাসা। যে কাজ ওরা করুক, আশা করি পথশিশু হয়ে ওদের আর থাকতে হবে না। আমার এখানকার অনেকেই অনেক কিছু করছে। এরাও করবে। আমি যত দূর পারি ওদের সাহায্য করব। এইভাবেই নিজের ক্ষুদ্র চেষ্টায় যত দূর পারি কল্যাণীর কাজ করছি। দেশের, ঈশ্বরের কাজ করছি। আমাদের মধ্যে যাঁরা ধনী তাঁরা তো মুখ ফেরালেন। একটু পরে উনি বললেন, কিকি, ভেবো না। আমি কস্তুরীবেনের কাজকর্মের কোনও খবর রাখি না। যে যেখানে আছে, নিজের সাধ্যমতো কাজ করে গেলে একদিন সমস্ত ভুলের সংশোধন হবে। হয়তো হাজার বছর পরে। হয়তো বা তারও পর। কোনও সময়সীমা নেই। আমাদের জীবনকালটাই আমাদের সময়সীমা। কিকি, তোমার মা অনেকদিন মেদিনীপুরে ছিলেন। এই মুহূর্তে কোথায় আমি বলতে পারছি না। পুরুলিয়ায় খুঁজে দেখতে পারো। গোড়ায় ঝাড়গ্রামে যাও।