ঈশান শঙ্খ
মিলি পুরনো একটা বাড়ি কিনেছে। খুব বেশি দিন নয়। বেশ মজবুত বাড়িটা। কিছুটা কম দামে পেয়ে গেল। সময় না নিয়ে রেজিস্ট্রি করে ফেলল। ও ভীষণ খুশি বাড়িটা কিনে।
মালপত্র এসেছে, প্যাকার্স অ্যান্ড মুভার্স সব জিনিসপত্র গুলো মিলির ইন্সট্রাকশন মতো ঘরে সাজিয়ে দিচ্ছে। মিলি ওর পছন্দ মত বাড়িটাকে সাজিয়ে নিতে চাইছে। হঠাৎ মিলির কোন গেল পুরনো বাড়ির ঈশান কোণে একটি রাখা শঙ্খের উপর। ভারী অদ্ভুত। জল সংখ্যাও নয় আবার বাজানোর সংখ্যাও নয়। ও খুব অবাক হলো। কাজের চাপে শঙ্খটা রেখে ঘরগুলোকে গুছিয়ে নিল।
বিকেলের পর ফ্রেস হয়ে হালকা টিফিন করে খাটে গা এলিয়ে দিল। ঋজু ওর স্বামী। সে দুহাতে দুকাপ কফি নিয়ে ঘরে ঢুকলো। দুজনেই বেশ উপভোগ করছিল কফিটা এবং বাড়িটা।
ঋজু বেসরকারি চাকরি করে। ভালো পোস্ট ভালো মাইনে। কিন্তু বসটা বড্ড বেমটকা। মাঝে মাঝেই ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তখন পুরো অফিস মাথায় তোলেন। আবার কেউ যদি ব্যক্তিগত কারণে ছুটিতে যায় তাহলে ওনার ইচ্ছা হলে ফোন করে উনি তাকে জয়েন করাতে পারেন। বেস্ট গোলমেলে। যেদিন ওনার ইচ্ছা হয় রাত্রি দশটা অব্দি অফিস খোলা রাখেন আবার ইচ্ছে হলে ওভারনাইটও কাজ করিয়ে নেন কর্মীদের। ঋজু অন্যত্র কাজ দেখছে। হয়ে গেলে বেঁচে যায়।
মিলু একটা বেসরকারি স্কুলে কর্মরতা। এখন ওদের বাচ্চা কাচ্চা হয়নি। হয়নি বলাটা ভুল চেষ্টা করছে কিন্তু হচ্ছে না। ওরা দুজনেই উত্তরবঙ্গের। দীর্ঘদিন একসাথে মেস লাইফ কাটিয়েছে। যদিও আলাদা আলাদা ভাবে। এক সময় ওরা ঘর বাধার স্বপ্ন দেখে। দুজনেই উচ্চশিক্ষিত, বয়সও কম। বিয়েও সেরে ফেলে চট জলদি। ভাড়াতেই ছিল কয়েক বছর। তারপর এই বাড়ি, অনেকটা তৃপ্তিদায়ক।
সন্ধ্যের সময় গল্প করতে করতে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ মিলির মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গে। আলো জ্বলছে। ঋজু ঠিকমতো শোয়নি। যাইহোক বাথরুম থেকে ঘরে ঢুকে ঋজুকে ঠিকভাবে শুতে বলে, তারপর আলো নিভিয়ে দেয়। শুতে যাবে এমন সময় দেখছে ঈশান কোণে একটা সবুজ আলো। মিলি দেখছে শঙ্খটা চারপাশে আলোটা। কাছে যায়। দেখছে শঙ্খটা যেন জীবন পেয়েছে। ও ভয় পেয়ে যায়। ঋজুকে ডাকে লাইট জ্বালায়। ঋজু কিছুই দেখতে পেল না। অতিরিক্ত পরিশ্রমে মিলিয়ে এমন করছে বলে ঠাট্টা করে। মিলিও লজ্জা পেয়ে যায়। দুজনে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে। ফ্রি মিলি ঋজুকে বলছে আমি যদি স্কুলের চাকরিটা পেয়ে যেতাম ভালো হতো। ইন্টারভিউ কাউন্সিলিং সবই তো হয়ে গেছে। কোথায় যে আটকে আছে বুঝতে পারছি না। চাকরিটা হলে আরেকটু ভালো থাকা যেত। ঋজু বলল এসব ভেবে এখন লাভ নেই, ঘুমিয়ে পড়ো।
পরদিন মিলি ঠাকুর দেওয়ার সময় ও শঙ্খটাকে একটা ফুল দিল। তারপর দুজন দুজনের কর্মস্থলে বেরিয়ে পড়ল। মিলি ক্লাস করাচ্ছে এমন সময় শিক্ষা দপ্তর থেকে ফোন। উনারা ওনাদের কথা মত রিক্রুটমেন্ট করতে চায়। তার আগে যাদের কাউন্সেলিং হয়ে গেছে তাদের সাথে একটু কথা বলে নিতে চায়। যদি দুটোর মধ্যে উনি শিক্ষা দপ্তরে আসেন। মিলি আশ্চর্য হয়ে গেল। এমনও হয়। সবাই বলল তোর বাড়িটা লাকি।
ও সরকারি চাকরি হলো। ওর মন বলছে ওই শঙ্খ তার কামাল। ওরস পুজোর সময় ফুল দেয়। তারপর বেরোয়। রোজ মাঝরাতে ওঠে। কিন্তু কোন আলো দেখতে পায় না। এরপর মাস ছয় সাত কেটে গেল। একদিন হঠাৎ মাঝ রাতে ও উঠেছে দেখছে ঈশান কোণে আলো। ও মনে মনে ভাবল এবার যদি ওর বরের একটা সরকারি চাকরি হয় তবে ভালো হতো। ও আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। পরদিন ঋজুর বাড়ি থেকে ফোন এলো ও যত তাড়াতাড়ি পারে যেন চলে আসে। ঋজুর বাবা ছিলেন সরকারি ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি রত অবস্থায় মারা যান। তারপর ওরা অনেক চেষ্টা করে যাতে চাকরিটা রিজুর হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোন সাড়াশব্দ করেনি। হঠাৎ অফিস থেকে ফোন রিজুর চাকরিটা হয়ে যাবে। ওকে অফিসে যোগাযোগ করতে বলা হলো। মিলি ভাবল তবে কি শঙ্খটার কোন গুন?
এরপর দীর্ঘ এক বছর ধরেই মিলি রোজ মাঝরাতে উঠে দেখে কিন্তু কোন আলো দেখতে পায় না ঈশান কোণে। একদিন মিলির খুব শরীর খারাপ সারাদিন শুয়ে। ঋজু ও পাশে শুয়ে। মাঝরাতে হঠাৎ মিলি দেখে আলো। ও কাঁদতে কাঁদতে বলে, হে ঈশ্বরী শক্তি, আমার মা হবার খুব ইচ্ছা। তুমি পূরণ করো।
ভোর বেলায় ঋজুও নিয়ে যাবে মিলিকে ডাক্তারের কাছে। প্রেগনেন্সি কিটে রিপোর্ট পজেটিভ। মিলি ও ঋজু খুব খুশি। কিন্তু মিলির অবস্থা ভালো না। শরীরটা তার খুব খারাপ। এর মধ্যেই শিশু বড় হচ্ছে তার শরীরে। যথাসময়ে বাচ্চাটা হল। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে মিলি মারা যায়। সদ্যোজাত শিশুটিকে নিয়ে ঋজু ভেঙে পড়ে। ঋজুর মা ই বাচ্চাটিকে দেখাশোনা করছে। মিলির শোকে ঋজু একা হয়ে গেছে। সেদিন মাঝরাতে ঋজু দেখে সেই সবুজ আলো। কাঁদতে কাঁদতে বলে মিলিকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু কোথায় মিলি! মৃত্যু লোকে একবার যে চায় সে তো আর ফিরে আসে না। সব বুঝ়রকি সব বুজরুকি চিৎকার করতে থাকে ঋজু। ছুটে এসে সে শঙ্খটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিল।