ঈদের নামাজ নিষিদ্ধ
আইসিসের কাণ্ড। তারাঈদের নামাজ নিষিদ্ধ করেছে ইরাকের মসুলে। বলেছে, ঈদের নামাজের সঙ্গে ইসলামের কোনও সম্পর্ক নেই। উপবাসের পর খাওয়া-দাওয়ার আর দল বেঁধে প্রার্থনার উৎসব এক কাফেররাই করতো। পুরোনো কালের মুসলিমরা ঈদের নামাজ পড়তো না। মসুলের কারও অধিকার নেই ঈদের নামাজ পড়ার। কেউ যদি নামাজ পড়তে যায়, তাদের নাকি মেরে ফেলা হবে। এই ইরাকে বসে বসে কী কাণ্ডই না করেছে আইসিসের সশস্ত্র লোকগুলো! বুলডোজার দিয়ে, ডিনামাইট দিয়ে, কুড়োল দিয়ে, শাবল দিয়ে ভেঙেছে মুসলমানের মাজারগুলো, শিয়াদের মসজিদগুলো, হাজার বছরের পুরোনো শিল্পকর্ম, মিউজিয়াম।
আইসিস কি একসময় নামাজ জিনিসটাকেই নিষিদ্ধ করবে? কারণ নামাজটা তো ইসলাম আসার আগে বিধর্মীরা পড়তো! ইহুদিদের আর কপ্টিক ক্রিশ্চানদের প্রার্থনা রুকু সেজদাসহ নামাজের মতোই। আইসিস তো মাজার, এমনকি কাবা শরিফ, রওজা শরিফ সব ভেঙে ফেলার কথাও বলছে। এগুলোও নাকি একধরনের মুর্তি পুজো। অনেকে মনে করে, ১৪০০ বছর আগের খাঁটি ইসলাম ধর্মকেই আইসিস অবিকৃত অবস্থায় পালন করছে। আইসিস সেনারা, অনেককে বলতে শুনেছি, পয়গম্বরের যোগ্য উত্তরসূরি।
বিধর্মীদের সংস্কৃতি যদি আইসিস ইসলাম থেকে বাদ দিতে শুরু করে, তাহলে শেষ অবধি কী থাকবে অবশিষ্ট ইসলামে? আইসিস তো এও বলতে পারে, এখন থেকে শুয়োর খাওয়া হালাল, কারণ আরবদেশে শুয়োর খাওয়া হারাম ছিল বিধর্মীদের মধ্যে। এখন থেকে খৎনা করা হারাম, কারণ বিধর্মীরা অর্থাৎ ইহুদিরা খনা করতো। কাফেরদের, বিধর্মীদের, অমুসলিমদের, অবিশ্বাসীদের গল্প আদম হাওয়ার গল্প। ইসলাম শুরু হওয়ার হাজার বছর আগেই এই গল্প লেখা হয়েছে। তাহলে এই গল্পটিকেও আনৈসলামিক বলে বাদ দেওয়া যায়? এভাবে নুহ নবীর গল্প, আবিল। কাবিলের গল্প, এবং আরও অনেক গল্পকে ইসলামের গল্প নয় বলে সরিয়ে রাখতে হয়। ওসব গল্প ইসলামের অনেক আগের, তাহলে ওসবও ডিলিট করে দিতে হয়। বাহাত্তর জন হুরি এবং হাতে গোনা কিছু গল্প ছাড়া সবই তো প্রায় হয় পেগানদের, নয় ইহুদি নাছারাদের গল্প। ইসলাম শুধু অন্য সংস্কৃতি থেকে নয়, ধর্ম গ্রহণ করেছে অন্য ধর্ম থেকে। সব ধারগুলো আজ ফেরত দিলে কি ইসলাম আর ইসলাম থাকবে? আইসিস যদি এভাবে চলতে থাকে যেভাবে চলছে, তাহলে খুব শীঘ্র ইসলাম বলে সম্ভবত কিছুরই আর অস্তিত্ব থাকবে না।
একবিংশ শতাব্দীতে সপ্তম শতাব্দীর সংস্কৃতি আনতে চাওয়া কি বৃদ্ধির কথা! মানুষ পেছনে যাবে নাকি সামনে এগোবে! মানুষ আর কতটা পেছোবে! পিছু হঠতে হঠতে দেয়ালে ঢুকে গেছে পিঠ। যখন নারীর স্বাধীনতা পাওয়ার কথা, মানবাধিকার লজ্বন না হওয়ার কথা, দারিদ্র ঘুচে যাওয়ার কথা, যখন সবারই বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার কথা, যখন মানুষের আরও মানবিক হওয়ার কথা, আলোকিত হওয়ার কথা, তখন লোক ধর্ম ধর্ম করে মাতম করছে, ফিরতে চাইছে অন্ধকার যুগে। আইসিস ছাড়াও অন্ধকারের উপাসনা করার লোক এই পৃথিবীতে আরও আছে।
ভাবছি মসুলের মানুষের কথা। ঈদের নামাজ পড়তে গেলে তাদের আজ খুন হয়ে যেতে হবে। ধর্মকর্ম করার অধিকারও মানবাধিকারের অংশ। আমি নিজে ধর্মে বিশ্বাস করি না, কিন্তু মানুষের ধর্মে বিশ্বাস করার অধিকারের জন্য আমি লড়ি। মসুলের মানুষ যদি ঈদের নামাজ পড়তে চায়, তবে সেই অধিকার তাদের থাকা উচিত। একই রকম কারও কারও যদি ধর্মে বিশ্বাস না করতে ইচ্ছে হয়, ধর্মের সমালোচনা করতে ইচ্ছে হয়, সেই অধিকারও তাদের থাকা উচিত। কিন্তু জোর করে ধর্মকর্ম করতে বাধা দেওয়া আর ধর্মের সমালোচনা করতে বাধা দেওয়া– দুটোরই বিরুদ্ধে আমি। স্বাধীনতায়। বিশ্বাস করলে বাক স্বাধীনতা আর ধর্ম বিশ্বাসের স্বাধীনতা দুটোতেই বিশ্বাস করতে হয়। স্বাধীনতায় আমি গভীরভাবে এবং বড় অকপটভাবে বিশ্বাস করি। স্বাধীনতাহীন জীবন বড় দুঃসহ।
মাঝে মাঝে ভাবি পৃথিবীর এত সহস্র কোটি মুসলিম আইসিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কেন করে না? কেন অনেকে সব জেনেশুনে আইসিসে যোগ দেয়? আইসিসের আদর্শে তবে কি তারা সত্যিই বিশ্বাস করে নাকি মানুষের মাথা লক্ষ্য করে গুলি করার আর ধারলো ছোরা দিয়ে মানুষের মুণ্ডু কাটার আনন্দ তারা উপভোগ করতে চায়, নাকি অল্প বয়সী মেয়েদের অবাধে ধর্ষণ করার আর অগুনতি যৌন দাসীকে ভোগ করার মজা পেতে চায়? এছাড়া যে আইসিস নামাজ নিষিদ্ধ করে, যে আইসিস মসজিদ গুঁড়ো করে, ইউনুস নবীর কবর ভাঙে, কাবা ভেঙে ফেলার স্বপ্ন দেখে, ইসলামের এতকালের পবিত্র সৌধ যারা উড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের প্রতি মুসলিম যুব সমাজের এত কেন আকর্ষণ?
আইসিসকে দমানোর চেষ্টা চলছে। মধ্যপ্রাচ্যের বড় শক্তি সৌদী আরব নিজেকে বাঁচানোর স্বার্থেই আইসিসকে নিশ্চিহ্ন করবে। আবার সৌদি আরবের ভেতরের অনেক খাঁটি ইসলামপন্থীদের টাকায় আইসিস শক্তশালী হতে থাকবে। আর আমরা দুর থেকে দেখতে থাকবো হত্যাযজ্ঞ। নিরীহ মানুষ বলি হতে থাকবে আর আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকবো আর অপেক্ষা করতে থাকবো মানুষের শুভবুদ্ধির। শুভবুদ্ধি সবার উদয় হয় না, হবেও না। কিন্তু আমাদের অপেক্ষা ফুরোবে না।
অপেক্ষা ছাড়া নিরীহ মানুষের আছেই বা কী।
তবে এই কথা জোর দিয়ে বলতে পারি, এক আইসিস গেলে আরও আইসিস আসবে। আইসিস তাদের নৃশংসতা দেখিয়েছে পৃথিবীকে। এই নৃশংসার চর্চা আরও বহুকাল চলবে, যতদিন না মানুষ ধর্মকে গৌণ করতে পারে আর মানবতাকে মুখ্য করতে পারে। মানবতাকে মুখ্য করার শিক্ষাটা ধর্মশিক্ষার বাইরের শিক্ষা, সভ্যতার, সমতার, সমানাধিকারের শিক্ষা। আইসিস তৈরি হওয়া সহজ, আইসিসের বিপরীত আদর্শে মানুষকে দিক্ষিত করা সহজ নয়। আইসিসের আদর্শে খুন ধর্ষণ লুটতরাজ আর ভায়োলেন্স। আইসিসের বিপরীত আদর্শে আছে শান্তি। শান্তি প্রতিষ্ঠা করা কোনওকালেই কোনও গোষ্ঠীতেই সহজ ছিল না, সহজ নয়।
এই কঠিন কাজটিই আমাদের করতে হবে।