Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ইয়েতির আত্মীয় (১৯৯৯) || Samaresh Majumdar » Page 5

ইয়েতির আত্মীয় (১৯৯৯) || Samaresh Majumdar

সারারাত জেগে দিনের আলো ফুটলে ঝুলন্ত বিছানায় গিয়েছিল অর্জুন। ঘুম যখন ভাঙল, তখন দুপুর। ক্যাম্প ফাঁকা। অভিযাত্রীরা বেরিয়ে গেছে অনুসন্ধানে। তৈরি হয়ে এক মগ চা নিয়ে চুমুক দিতে দিতে সে গেল জুডির তাঁবুতে। দুবার ডেকেও যখন সাড়া পাওয়া গেল না তখন বুঝল মেয়েটা এখনও গভীর ঘুমে

এখানে স্নান করার বালাই নেই। প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারতে বেশ কষ্ট হয়। আজ ব্রেকফাস্ট খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অর্জুন দুপুরের খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়ল। ওই ভারী জুতো, মোজা থেকে টুপি পর্যন্ত সমস্ত শরীর ভারী শীতবস্ত্রে মুড়ে বরফের ওপর দিয়ে হাঁটতে মোটেই স্বচ্ছন্দ নয় সে। তবে গতকালের চেয়ে আজ একটু জোরে পা ফেলতে পারছে। অভিযাত্রীরা এদিকে যায়নি! কিন্তু গতকাল সে আর জুড়ি যে আসা-যাওয়া করেছিল তার কোনও চিহ্ন বরফের ওপর নেই। গত রাত্রে বয়ে যাওয়া তুষারঝড় এবং শেষে পড়া মিহি তুষার সেসবের ওপর যেন সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। ফলে যে জায়গা থেকে সেই অজানা প্রাণীর পায়ের চিহ্ন শুরু হয়েছিল তার হদিস পাওয়ার কোনও উপায় নেই।

গতকালের মতো আজও গ্রামবাসীরা তাকে দেখে উল্লসিত হল। অর্জুন দেখল, দোভাষী হাসিমুখে এগিয়ে আসছে, আমি তোমার ওখানে যাব বলে ভাবছিলাম।

কেন? অর্জুন অবাক হল।

আমাদের পুরোহিত উঠে বসেছে, কথা বলেছে। শুনলাম গতকাল তোমার সঙ্গে একজন মহিলা এসেছিলেন, তিনি ভাল ওষুধ দিয়েছিলেন। আমি ছিলাম না বলে নিশ্চয়ই খুব অসুবিধে হয়েছিল, তাই না?

না, তেমন কোনও অসুবিধে হয়নি। তবু লোকটাকে হতাশ করল না অর্জুন।

সে সোজা চলে গেল পুরোহিতের বাড়িতে। পেছনের ভিড়টাকে বাইরে রেখে দোভাষীর সঙ্গে ভেতরে ঢুকল অর্জুন। তাদের দেখে পুরোহিত উঠে বসে একগাল হাসল। কিন্তু সেই মহিলা চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন রাগত ভঙ্গিতে। অর্জুন কারণ জানতে চাইলে দোভাষী বলল, সুস্থ হতেই পুরোহিত নাকি আর সুপ খেতে চাইছে না। অথচ ওই খেয়েই তো সুস্থ হয়েছে। তাই ওর বউ রাগারাগি করছে।

অর্জুন পুরোহিতের শরীর ছুঁয়ে দেখল, একদম স্বাভাবিক উত্তাপ। আপাতচোখে মনে হচ্ছে সুস্থ। কিন্তু জুডি বলেছে অবিলম্বে ওকে হাসপাতালে ভর্তি না করলে ফল খারাপ হবে। এই সুস্থতা খুবই সাময়িক।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তুমি কথা বলতে পারবে?

দোভাষী তর্জমা করতেই লোকটা চটপট জবাব দিল। কথাবার্তা বলতে লাগল তর্জমার মাধ্যমে, কথা বলা কী, আমি এখন দৌড়তে পারি। কিন্তু আমার বউ কিছুতেই এই ঘরের বাইরে যেতে দিচ্ছে না।

উনি ভালই করছেন। তুমি তো পুরোহিত?

হ্যাঁ। আমার বাবাও এই কাজ করত।

তোমার ছেলেমেয়েরা কোথায়?

কেউ নেই। আমার ছেলেমেয়ে নেই।

যে রাত্রে মন্দির থেকে চুরি হল সে রাতে তুমি ওখানে ছিলে? লোকটি চট করে মাথা নামিয়ে নিল।

অর্জুন বলল, সবাই বলছে তুমি ছিলে। ভোরবেলায় তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তারপরই জ্বর আসে ঠিক তো?

লোকটা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

তুমি কি রোজ মন্দিরে থাকতে?

না।

তা হলে সেদিন ছিলে কেন?

আমি একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বপ্নটা কী মনে নেই। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর খুব খারাপ লাগছিল। বউকে বললাম মন্দির থেকে ঘুরে আসি। তাতে মন ভাল হয়ে যাবে। তাই মন্দিরে গিয়েছিলাম।

তখন কটা বাজে?

এখানে সময় কেউ বলতে পারবে না। তবে রাত শেষ হতে বেশি দেরি ছিল না। চাঁদ আকাশের অনেক নীচে নেমে গিয়েছিল।

তখন মন্দিরে কেউ ছিল?

না।

মন্দিরের দরজা বন্ধ ছিল?

হ্যাঁ। আমি গিয়ে খুলি।

তারপর?

মন্দিরে প্রদীপ জ্বলছিল। আমি চুপচাপ বসে ছিলাম। হঠাৎ মনে হল। বাইরে কিছু নড়ছে। তাকিয়ে দেখি ওই শয়তানের পাথরটার ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একটা ভয়ংকর ভূত আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে আমার শরীর কাঁপতে লাগল। মাথা ঘুরতে লাগল, পেটে যন্ত্রণা শুরু হল। আমি চিৎকার করতে গেলাম কিন্তু কোনও শব্দ বের হল না। এইসময় ভূতটা আমার দিকে এগিয়ে এল। আমি আর কিছু মনে করতে পারছি না। ওঃ! লোকটার শরীর আবার কেঁপে উঠল।

তুমি কি জানো মন্দির থেকে পবিত্র মাথা আর চামড়া চুরি গিয়েছে?

আমাকে বউ বলেছে।

কে চুরি করেছে জানো?

আমি জানি না। সত্যি বলছি জানি না।

ভয়ংকর ভূতটাকে দেখতে কেমন?

লোকটা চোখ বন্ধ করল, লম্বা, বিশাল চেহারা, মুখটা বীভৎস। গায়ে লম্বা লোম ছিল। হেঁটে আসছিল পাহাড়টাকে আড়াল করে।

কোনও কথা বলেছে?

না। বললেও আমি শুনিনি। আমার কোনও হুঁশ ছিল না।

বাইরে বেরিয়ে এসে অর্জুন দোভাষীকে বলল, ওকে যদি বাঁচাতে চাও তা হলে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাও।

কেন? ও তো ভাল হয়ে গেছে! দোভাষী অবাক!

এটা খুব সাময়িক। সেই রাত্রে ও মনে ধাক্কা খেয়েছিল। হয়তো সেই কারণে বুকের রোগ হতে পারে। ওর পেটে যে ব্যথা আছে তা এতদিন চাপা ছিল বলে নিজেই টের পায়নি। এখন এইসব বড় হয়ে উঠবে।

কিন্তু হাসপাতাল তো অনেকদূরে।

নিয়ে যাওয়া যাবে না?

ওখানে নিয়ে যেতে বাহকদের যে টাকা দিতে হবে তা পুরোহিতের নেই। যদি সত্যি হয় তোমার কথা তা হলে ওর এখানেই মরে যাওয়া উচিত, তাতে ও শাস্তি পাবে।

বুঝতে পারছি। যদি আমাদের হেলিকপটার এর মধ্যে আমাদের ক্যাম্পে আসে তা হলে ওকে কাঠমপুর হাসপাতালে পাঠাতে পারি। এতে নিশ্চয়ই তোমরা আপত্তি করবে না?

ওখানে একা গেলে ও মরে যাবে। কথা বলার লোকই পাবে না।

পাবে। তোমাদের গ্রামের একটা ছেলে ওখানকার ডাক্তার। অর্জুন বলল, সে ওর দেখাশোনা করবে।

দোভাষীর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে প্রস্তাবটা পছন্দ করছে না। বলল, এই ব্যাপারটা নিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলে তোমাকে জানাব।

মন্দিরের কাছে পৌঁছে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তোমরা তো এখানে জন্মেছ। যে-কোনও কাজে কোথাও যেতে হলে বরফের ওপর দিয়ে যেতে হয়। তুমি কখনও তুষার-ভালুক দেখেছ?

অনেকবার দেখেছি। কতবার দেখেছি মনে নেই।

ওরা এখানে আসে?

একসময় ওরা খুব জ্বালাত। ফসল নষ্ট করে দিত। ওপরের পাহাড়ে ভুট্টা যখন পাকত তখন হামলা করত। আমরা ওদের সঙ্গে পেরে উঠতাম না।

তারপর?

আমরা লক্ষ করেছিলাম ওরা মানুষকে খুব নকল করে। দূর থেকে কোনও মানুষকে হাঁটতে দেখলেই ওরা পেছনের দুই পায়ের ওপর ভর রেখে হেঁটে চলে। ওই যে ডানদিকের বরফের পাহাড়ের ওপাশে ওদের ডেরা। ভুলেও কেউ ওদিকে যাই না। একবার আমরা বিকেলের দিকে ওই পাহাড়ের নীচে গেলাম দল বেঁধে। একটা বড় পাত্রে জল রেখে দুটো দলে আলাদা হয়ে নিজেদের মধ্যে মারপিট করতে লাগলাম। পুরোটাই ছিল অভিনয়। মার খেয়ে যে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল সে-ও সেটা অভিনয় করেই করছিল। তারপর সবাই ওই পাত্রে মুখ লাগিয়ে চুমুক দিয়ে জল খেয়ে নিল। আমরা জানতাম ওরা নিশ্চয়ই আড়াল থেকে আমাদের লক্ষ করছে। চলে আসার আগে ওই জলের সঙ্গে খুব কড়া মদ মিশিয়ে দিলাম। ওরকম মদ একপাত্র খেলে মানুষ একদিনরাত ঘুমিয়ে থাকবে। ওখান থেকে সরে এসে আড়ালে দাঁড়িয়ে আমরা লক্ষ করছিলাম। সেদিন ছিল চাঁদের রাত। তাই অন্ধকার নামল না। জ্যোৎস্নায় ওপর থেকে নেমে এল গোটাচারেক ভালুক। আমরা যেখানে যুদ্ধ করেছিলাম সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে মারপিট শুরু করে দিল ওরা। একেবারে হুবহু নকল করছিল ওরা। তারপর ক্লান্ত হলে আমাদের মতো পাত্রে মুখ ড়ুবিয়ে পান করতে লাগল একের পর এক। কিছুক্ষণ বাদে দেখলাম ওরা টলছে এবং শেষ পর্যন্ত মাটিতে পড়ে গেল। আমরা তখন ছুটে গিয়ে নেশায় অজ্ঞান হওয়া ভালুকদের মেরে ফেললাম। ওদের চামড়া খুব কাজে লেগেছিল। দুদিন ধরে মাংস খেয়েছিল গোটা গ্রাম। তারপর থেকে ওরা আর ঝামেলা করেনি।

ঘটনাটাকে অবিশ্বাস্য মনে হলেও অর্জুন কিছু বলল না। দোভাষী যে পাহাড়টাকে তুষার-ভালুকের এলাকা বলে দেখিয়েছিল সেদিকটা ভালভাবে দেখে রাখল।

সন্ধের আগেই ক্যাম্পে ফিরে এল অর্জুন।

ক্যাম্পের খবর ভাল। অভিযাত্রীদের একটা দল পায়ের চিহ্ন দেখে অন্তত আধ মাইল দূরে তুষার-ভালুকদের একটা দলকে দেখতে পেয়েছে। ডানা টেলিফোটোতে তার ছবি তুলেছে। কিন্তু মুভি ক্যামেরায় সেই ছবি ওঠেনি, ওঠার কথাও নয়। স্টিল ছবি কাঠমণ্ডতে না পাঠালে প্রিন্ট হবে না। দ্বিতীয় দিনেই এই সাফল্যে সকলে খুব খুশি। সকলে এই নিয়ে কথা বলছিল। অর্জুন

তাঁবুতে ফিরে চেয়ারে বসতেই জুডি এল, লোকটার কাছে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ। এখন কথা বলছে, উঠে বসেছে।

কিন্তু…।

আমি বলেছি আজও, ওরা হসপিটালে নিয়ে যেতে চাইছে না। আচ্ছা, এমন হতে পারে না, কোনও কিছু দেখে শক পেয়েছে লোকটা। আর তা থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, জ্বর এসেছিল। অর্জুন জানতে চাইল।

হতে পারে। কিন্তু ওর পেটে যে ব্যথা আছে সেটার পরীক্ষা হওয়া উচিত। জুড়ি বেরিয়ে গেল।

একটু বাদে জন এলে অর্জুন আজকের ঘটনাটা জানাল। জন বললেন, হেলিকপটারে লোকটাকে কাঠমণ্ডর হাসপাতালে পাঠাতে তাঁর আপত্তি নেই। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, পুরোহিত লোকটার কথা কি বিশ্বাস করছ?

না করার তো কিছু নেই।

ও যা বর্ণনা দিয়েছে বলছ, সেরকম প্রাণী তো গোরিলা জাতীয় কিছুর সঙ্গে মিলছে। ঠাণ্ডার ধারেকাছে গোরিলা থাকে না বলে শুনেছি। এই অঞ্চলে তো নয়ই। মনে হচ্ছে লোকটা ভুল দেখেছে।

আমারও তাই মনে হয়েছে। তবে যাই দেখুক, লোকটা খুব ভয় পেয়েছে। আর সেই রাতের আগন্তুকই জিনিসগুলো চুরি করেছে।

তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু ওর পরিচয় কী?

আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। অর্জুন বলল, আচ্ছা, বলুন তো, আপনার এই দুদিন কোনদিকে গিয়েছিলেন?

জন একটা ম্যাপ দেখালেন। এটা কোনও ছাপা ম্যাপ নয়। এখানে আসার পর জন নিজেই ম্যাপটা তৈরি করেছেন।

অর্জুন ম্যাপটা দেখল। তারপর উলটোদিকের একটা অংশ দেখাল, আমার মনে হয় এই অঞ্চলে গেলে ওদের দেখা পেয়ে যাবেন।

কেউ তোমাকে বলেছে?

হ্যাঁ। গ্রামে যে লোকটা দোভাষীর কাজ করছে সে বলছিল।

হুম। ঠিক আছে।

গতরাত্রে পাহারা দেওয়ার সময় আমরা কয়েকটা শেয়ালকে দেখেছি। আর একটা বড় প্রাণীর গর্জন শোনামাত্র তারা পালিয়েছিল। আওয়াজটা এসেছিল ওইদিক থেকে। তাই বলছিলাম, শেরপাদের রাজি করিয়ে রাত্রে ওদিকে যাওয়া যায় না?

দেখলে তো, শেরপারা রাজি হয়নি। জন গম্ভীর গলায় বললেন।

মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে গেল অর্জুনের। কী কাণ্ড, শেয়াল ডাকছে। এই বরফের রাজ্যে কয়েকটা শেয়াল পরিত্রাহি চিৎকার করে চলেছে। গতরাত্রে ঠাণ্ডা কী তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল। এখন এই স্লিপিং ব্যাগের আরাম থেকে বেরোতে মোটেই ইচ্ছে করছিল না। তাঁবুর ভেতর কোনও আলো নেই। কিন্তু অর্জুনের মনে হল শেয়ালরা মিছিমিছি ডাকবে কেন? ওদের তো গলা সাধার কোনও দায় নেই।

অন্ধকারে পাশের ঘুমন্ত বিছানা থেকে জনের গলা ভেসে এল, তুমি কি শেয়ালের ভাষা বুঝতে পারো?

না। অর্জুন হাসল।

তা হলে চলো, বাইরে বেরিয়ে দেখা যাক।

কৌতূহল যে হচ্ছিল না তা নয়, কিন্তু শীতের কথা ভেবে উদ্যোগ নেয়নি অর্জুন। এবার স্লিপিং ব্যাগ থেকে বের হয়ে যাবতীয় পোশাক এবং জুতো-মোজা পরে নিল অন্ধকারেই জনের গলা শুনতে পেল, রেডি?

হ্যাঁ।

তাঁবুর বাইরে অদ্ভুত দৃশ্য। আজকের জ্যোৎস্না গতরাতের চেয়েও জোরালো। কী চকচকে দেখাচ্ছে পৃথিবীটাকে। বরফের ওপর জ্যোৎস্না পড়ায় একটা হলদে আলো ছিটকে উঠেছে। আজ রাত্রে যারা পাহারায় ছিল তারা এগিয়ে এল।

জন জিজ্ঞেস করলেন, কিছু দেখেছ?

ফ্রেমিং বললেন, তেমন কিছু নয়। কয়েকটা শেয়াল অনেকক্ষণ থেকে ঘুরঘুর করছিল আশপাশে। হঠাৎই ওরা দূরে চলে গিয়ে এইভাবে ডাকাডাকি করছে। জন অর্জুনকে বললেন, ডানাকে ঘুম থেকে তোলা যায় কিনা দ্যাখো তো।

মেয়েটা যে এমন ঘুমকাতুরে, তা জানতে পারল অর্জুন। ক্যাম্পের সবাই যখন জেগে গিয়েছে তখনও ওর সাড়া নেই। শেষপর্যন্ত জুড়ি ওর ঘুম ভাঙাল। পোশাক পরে বাইরে এসে অর্জুনকে দেখে ডানা হাসল, কী ব্যাপার? যুদ্ধ হচ্ছে নাকি?

জন জিজ্ঞেস করলেন, ডানা, তাকিয়ে দ্যাখো তো, এই আলোয় ছবি তুলতে পারবে?

ডানা চারপাশে ঘুরে দেখল। তারপর বলল, বেটাতে তুলতে পারব। অবশ্য কতটা ভাল হবে তা বলতে পারছি না।

ফিল্ম উঠবে না?

না। ভিডিওতেই তুলতে হবে।

গো। গেট রেডি। কুইক।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ওরা তৈরি হয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। শেরপাদের নিয়ে পুরো দলটা। শুধু জুডি আর অর্জুনকে কেউ কিছু বলল না। অর্জুনের খারাপ লাগছিল। জনসাহেব তাকে সঙ্গে যাওয়ার কথা বলতে পারতেন।

প্রায় জনশূন্য ক্যাম্পে জুড়ি অর্জুনের পাশে এসে বলল, এইসময় আমার খুব খারাপ লাগে। আমার যেন কোনও প্রয়োজনই নেই।

তুমি তো অভিযাত্রী নও, তাদের ডাক্তার। কিন্তু আমি ভাবছি ওরা ওইদিকে গেল কেন? অর্জুন হাত তুলল।

কারণ ওইদিক থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছিল।

অর্জুন মাথা নাড়ল। তারপর বলল, চলো, একটু হেঁটে আসি।

সানন্দে। জুডি খুশি হল।

হাঁটতে-হাঁটতে জুড়ি বলল, এখানে খুব ভাল স্কেটিং করা যায়। কীরকম স্বপ্ন-স্বপ্ন মনে হচ্ছে, তাই না?

অর্জুনের হাতে স্টিক ছিল। প্রতিটি পা বাড়াবার আগে সে সামনের বরফ পরীক্ষা করে নিচ্ছিল। সে কিছু বলল না।

জুডি জিজ্ঞেস করল, আমরা উলটোদিকে যাচ্ছি, না?

হ্যাঁ। দোভাষী বলেছিল ওই বরফের পাহাড়ের দিকে তুষার-ভালুকদের দেখতে পাওয়া যাবে। আমি জনকে বলেছি, কিন্তু তিনি…।

আমার মনে হয়, এবার ফেরা উচিত। জুডি বাধা দিল। কেন?

আমাদের সঙ্গে কোনও অস্ত্র নেই। আর শেয়ালগুলো হঠাৎ চুপ করে গিয়েছে। গতরাত্রে ওদের একটার দাঁত দেখেছি আমি। ভালুকের বদলে

শেয়ালও যদি আমাদের আক্রমণ করে তা হলে, বুঝতেই পারছ।

অর্জুন বলল, আমার মনে হয় তুমি একাই ফিরে যেতে পারবে।

তুমি?

আমি আর একটু দেখতে চাই।

অগত্যা জুড়ি কাঁধ নাচাল, তোমাকে একা ছাড়তে খারাপ লাগছে, বেশ, চলো।

সূর্যকে মাথায় রেখে দিন চেনা যায়। কিন্তু চাঁদের বেলায় হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছিল। অর্জুন দেখল গুঁড়ি গুঁড়ি তুষার গতকালের মতো নীচে নেমে আসছে না। অর্থাৎ আজ রাত্রে যদি প্রকৃতির মেজাজ পালটায় তা হলে পায়ের চিহ্ন থাকবে।

গ্রামের কাছাকাছি এসে অর্জুন ডানদিকে ঘুরল। এখানে উঁচু-নিচু হয়ে বরফের ঢেউ চলে গিয়েছে পাহাড়ের বুক পর্যন্ত। এই পথেই সেই অজানা জন্তুটা হেঁটে গিয়েছিল। বারংবার পরীক্ষা করতে হচ্ছে বরফ। দু-দুবার ঘুরে যেতে হয়েছে আলগা বরফ সামনে থাকায়। দুই ঢিপির মাঝখানে দাঁড়িয়ে ওরা আকাশ ছাড়া কিছু দেখতে পেল না। কী মসৃণভাবে বরফের ঢিপি তৈরি হয়েছে। একমাত্র পায়ের চিহ্ন ছাড়া পৃথিবীর চেনা পরিবেশে ফিরে যাওয়ার কোনও উপায় নেই।

অর্জুন বুঝতে পারছিল একটু বেশি ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফিরে যেতেও ইচ্ছে করছিল না। ঠিক তখনই গর্জন কানে এল। ভয়ংকর ক্রুদ্ধ না হলে এরকম গর্জন করা সম্ভব নয়। এবং ওই গর্জন ছোটখাটো জন্তুর পক্ষে করাও সম্ভব নয়। ওরা চারপাশের উঁচু বরফের দিকে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না। তা হলে নিশ্চয়ই যে গর্জন করছে সে তাদের দেখে করেনি। এবার গর্জনটার আওয়াজ আরও বেড়ে গেল। একটি নয়, একাধিক জন্তু রাগ দেখাচ্ছে। অর্জুন ধীরে-ধীরে ওপরে উঠছিল। হঠাৎ তার ডান পা বরফের মধ্যে ঢুকে গেল। উত্তেজনায় পরীক্ষা করতে ভুলে গিয়েছিল। অনেক চেষ্টা করে নিজেকে মুক্ত করতে পারল সে। জুড়ি চাপা গলায় বলল, লেটস গো ব্যাক। অর্জুন ওই স্বরে বলল, জাস্ট ওপরে উঠে চারপাশে নজর বুলিয়ে ফিরে যাব।

ধীরে ধীরে ওরা উঁচু টিলার ওপর যেতেই অর্জুন বসে পড়ল এবং জুড়িকে জোর করে টেনে বসাল। চোখের সামনে অদ্ভুত দৃশ্য। টিলা থেকে নেমে যাওয়া বরফের উপত্যকায় দুটি বিশাল চেহারার ভালুক পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গর্জন করছে। কিছুটা দূরে একটি ভালুক নিরীহ মনে বসে আছে। একেবারে মানুষের ভঙ্গিতে দুজন এগিয়ে গেল পরস্পরের দিকে। তারপর ফ্রিস্টাইল কুস্তি শুরু হয়ে গেল। যে বসে আছে সে ওসব লক্ষ না করে পাশ থেকে কিছু একটা টেনে নিল। লড়াই থেকে চোখ সরিয়ে অর্জুন দেখল জটির হাতে বলের চেয়ে বড় একটা জিনিস।

কিছুক্ষণ লড়াই করার পর একটা জন্তু যে আহত হয়েছে বোঝা গেল তার কানফাটানো চিৎকারে। তারপর সে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে দৌড়ে গেল ওপাশের পাহাড়ের দিকে। বিজয়ী ভালুক আনন্দে বরফের ওপর একবার গড়াগড়ি দিয়ে নিতেই দর্শক উঠে দাঁড়াল। তারপর হাতের বস্তুটি ছুড়ে দিল বিজয়ীর দিকে। সেটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পাশে পড়ল। এবার বিজয়ী এসে আলিঙ্গন করল দর্শককে। তারপর দুজনে চারপায়ে হেঁটে চলে গেল ওপাশে।

মিনিটপাঁচেক চুপচাপ বসে রইল ওরা। চারপাশে কোনও শব্দ নেই। অর্জুন দেখল দর্শক ভালুকের ছুড়ে দেওয়া বস্তুটি পড়ে আছে তখনও। ওটা পাথর বা কাঠ নয়। তা হলে কী? জুডিকে সেখানে বসেই লক্ষ রাখতে বলে সে নামতে লাগল। সে যখন নীচে নেমে এসেছে তখন ওপর থেকে জুভি চেঁচিয়ে সাবধান করল। অর্জুন দেখল সেই আহত ভালুকটা আবার ফিরে এসেছে। তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। তাকে দেখেও কিছু না বলে ভালুকটা এগিয়ে যাচ্ছিল বস্তুটির দিকে।

অর্জুন দ্রুত একটা বরফের চাঙড় তুলে ছুড়ে মারল ভালুকটার দিকে। সেটা গিয়ে লাগল ঠিক মাথায়। অন্য সময় হলে নিশ্চয়ই সে ছুটে আসত, ছিঁড়ে ফেলত অর্জুনকে। কিন্তু এখন কাতর চোখে তাকাল। অর্জুন দ্বিতীয়বার আঘাত করতেই সে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর ধীরে ধীরে ফিরে গেল যেদিক থেকে এসেছিল সেইদিকে। অর্জুন দৌড়ে গিয়ে বস্তুটি তুলে নিল। তারপর যতটা সম্ভব জোরে উঠে এল ওপরে। এসে বলল, লেটুস গো।

জুডি জিজ্ঞেস করল, ওটা কী?

বুঝতে পারছি না। এটা কোনও কিছুর মাথা। তারপরেই খেয়াল হল। হতেই সে হুররে বলে চিৎকার করে উঠল।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress