ইয়েস স্যার
আজ শনিবার।
হেডস্যার আজ ছুটির পর মিটিং ডেকেছেন। মিটিং-এর পর ইটিং-এর ব্যবস্থা আছে। ক্লাস নাইন। আর টেনের ছেলেরাই শুধু থাকবে। আমারে স্কুলের বিশিষ্ট দারোয়ান রামাধর দা তাঁর ছোট্ট ঘরে ডাব্বা, ডাব্বা ঝালমুড়ি তৈরি করছেন। গুড়ো মশলার গন্ধে জিভে জল আসছে। হেডস্যার
এলেন। আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালুম। মধ্যবয়সি মানুষ। বেশ মোটাসোটা। ফরসা চেহারা। সাদা পাঞ্জাবি। বোধহয় খদ্দর। মোটা ধুতি। পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। কদমছাঁট চুল। আমাদের প্রায়ই বলেন—এদেশে একজন মানুষই জন্মেছিলেন, তাঁর নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আমরা তাঁর পায়ের নখের যোগ্য নই। আমরা সব স্বার্থপর শয়তানের দল। আমাদের ধরে ধরে পেটানো উচিত। আমরা দেশের কলঙ্ক। রবীন্দ্রনাথ লাখ কথার এক কথা বলে গেছেন, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।
চেয়ারে বসতে বসতে স্যার বললেন বোসো, বোসো, আর সুব্রতটাকে কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসো।
সে কোথায় আছে স্যার?
পেটুকরা যেখানে থাকে। রামাধরের ঘরের সামনে ছোঁক ছোঁক করছে। আমাদের যেতে হল না। সুব্রতই এল হুসহাস করতে করতে।
হেডস্যার জিগ্যেস করলেন, আপনি কোথায় ছিলেন জানতে পারি? সুব্রতর চোখ দুটো ছানাবড়ার মতো হয়ে আছে। মুখে হুসহাস শব্দ। সুব্রত খুব সহজ, সরল। একটু বোকা বোকা। বাঁকা কথা। বোঝে না। কেরিয়ার-ফেরিয়ার ধার ধারে না। নিজের জীবনের মজার মজার ঘটনা বলে সারাক্ষণ আমাদের মাতিয়ে রাখে। স্যাররাও তাকে খুব ভালোবাসেন।
সুব্রত বললে—অ্যায়সা ঝাল ছেড়েছে কেউ খেতে পারবে না। জিভের তলায় বাটি ধরতে হবে। আপনার স্যার আলসার আছে, তাই একটু টেস্ট করতে গিয়েছিলুম। ঝাল কমাও, ঝাল কমাও, মুড়ি ঢালো। আমার হেডস্যার মুখে দিতে পারবেন না। এ সেই সরস্বতী পুজোর আলুরদম-কেস। আমাদের কথা শুনলেন না। খেয়ে অসুস্থ হলেন।
স্যার সুব্রতর মন জানেন। অবিশ্বাস করলেন না। বললেন—সামনে বোস, আমার চোখের সামনে। একটা কথা জেনে রাখ এখন সব বাঙালির পেটেই আলসার।
আমরা সবাই কোরাসে বললুম-ইয়েস স্যার।
হেডস্যার সভার কাজ শুরু করলেন। ছোট্ট একটা বক্তৃতা—বয়েজ! যে ভাবেই হোক আমাদের পরোপকার করতে হবে। নিঃস্বার্থ সেবা। ঘোর দুর্দিন আমাদের সামনে। ছেলেরা বাপ-মাকে। দেখে না। ভাই ভাইকে দেখে না। নেতারা দেশ দেখে না। ফি না দিলে ডাক্তার রোগী দেখে না। মাতালে দেশ ভরে গেছে। চতুর্দিকে সন্ত্রাসবাদী। এই অবস্থায় আমাদের জীবনের একমাত্র ব্রত হবে পরোপকার। পরের উপকার। তোমরা সব গ্রুপ করে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ো। সমাজের সর্বস্তরে ঢুকে যাও। আমাদের আদর্শ হবে উইপোকা। উইপোকা যেমন বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে, খাঁজে খাঁজে ঢুকে যায়, আমাদেরও সেই সব ভাঁজে ভাঁজে সমাজের খাঁজে খাঁজে। ঢুকে যেতে হবে। উইপোকা ধ্বংস করে, আমরা গঠন করব। আমরা চটাপট, চটচট হাততালি দিয়ে উঠলুম। খুব ভালো লেগেছে আমাদের।
হেডস্যার খুব অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন—এটা কি নাট্যশালা। পায়রা ওড়াচ্ছিস! ঠিক এই সময় ঘরে প্রবেশ করলেন আমাদের বাংলার স্যার নিমাইবাবু। প্রায় ছ’ফুট লম্বা। স্বাস্থ্যবান। এমন চেহারা, কেন যে বাংলায় পড়ে আছেন আমরা বুঝতে পারি না। আবার কবিতা লেখেন। সেই সব কবিতা আমাদের ক্লাসে শোনা। মানে বুঝি না, তবে শব্দের খেলা, বেশ ভালো লাগে। মেঘলা দিনে সাংঘাতিক কবিতা আসে। কাল সেইরকম একটা দিন ছিল। ক্লাসে বসে বসেই স্যার লিখে ফেললেন,
মেঘের ফানুস উড়ছে
মানুষ কি আর দেখছে।
কাজের কথাই বলছে
ময়ূর কেবল নাচছে।
আমরা টেবিল চাপড়ে চিৎকার করে উঠলুম, ফাটাফাটি, ফাটাফাটি। স্যার বললেন— আলুকাবলি, আলুকাবলি। তার মানে আমাদের আলুকাবলি খাওয়াবেন। তৈরি করবে রামাধর।
আমাদের রামাধরের কোনও তুলনা নেই। রোজ ভোরবেলা গঙ্গায় চান করে। মহাবীরের পুজো করে। আগে কুস্তি করত, এখন আর করে না। যোগাসন করে। স্যার বললেন—আলুকাবলি নিয়ে কবিতা হবে, এক-একজন এক-একটা লাইন লিখবে। চলে এসো বোর্ডে।
আমাদের মধ্যে স্বরাজ কবিতা লেখে। বোর্ডে গিয়ে লিখে এল, ফাটাফাটি আলুকালবি।
মধুকর পরের লাইন লিখলে, সুদ চায় না এই কাবলি।
সব লেখালিখির পর কবিতাটা যা দাঁড়াল, ফাটাফাটি আলুকাবলি,
সুদ চায় না এই কাবলি,
জিভে জল, টক, ঝাল, আর মিষ্টি,
কাবুল ফেলে বাঙলায় এল এই কাবলি।
নিমাই স্যার হেডস্যারের পাশের চেয়ারে বসে বললেন—পরোপকার খুব কঠিন কাজ। আমাদের এই জায়গাটা এত হতচ্ছাড়া, না হয় বিধ্বংসী বন্যা, না হয় দুর্ভিক্ষ। এই দুটো হলে পরোপকারের কাজটা সহজ হয়। হাণ্ডা হাণ্ডা খিচুড়ি বানাও, ঝপাঝপ দিয়ে যাও, কপাকপ খেয়ে যাও। হেডস্যার বললেন—সকলের ভাগ্য কি আর ভালো হয় নিমাইবাবু। আমাদের গভীরে ঢুকে কাজ করতে হবে। বেগুন গাছে ঝোলে। মারো টান। হাতে এসে গেল, আর আলু! মাটি খুঁড়ে তুলতে হয়। কারও বেগুনের বরাত কারও আলুর বরাত। আমাদের খুঁড়তে হবে। প্রথমে সারভে।
সুব্রত বলল—স্যার! আমার একটা প্রশ্ন আছে।
একটা কেন, তুমি হাজারটা প্রশ্ন করো।
স্যার! পরোপকার জিনিসটা ঠিক কী?
জিনিস বলছিস কী রে গাধা। বল কর্ম। পরের উপকার।
উপকার কাকে বলে স্যার?
অপকারের উলটোটাই হল উপকার। যেমন মানুষের উলটো হল অমানুষ। উদাহরণ শোন—
একটা মানুষকে ঠেলে ফেলে দিলি। এটা হল অপকার। হাত ধরে টেনে তুললি এটা উপকার। একজন মানুষ খেতে পায় না, তাকে খাওয়ালি, এটা উপকার।
নিমাইস্যার বললেন—এটা উপকার নয় সেবা।
আপনি আবার নতুন কথা এনে ব্যাপারটাকে গুলিয়ে দেবেন না।
ব্যাপার নয়, বলুন বিষয়।
ব্যাপার আর বিষয় এক। এটা ভাষা শিক্ষার ক্লাস নয়। উপকার হল এমন কাজ করা যাতে সমস্যার সমাধান হয়। তোমরা ঘুরবে। ঘুরে ঘুরে দেখবে। নোট নেবে। প্রথমেই কিছু করবে না। আমাদের জায়গায় অর্থাৎ কমিটিতে এসে জানাবে, তারপর অ্যাকশান।
ঝালমুড়ি এসে গেল। রামাধর বানায় বটে! দরজা দিয়ে ঢুকছে ঘরটা গন্ধে ভরে গেল। মার মার কাট কাট। ঠোঙায় ঠোঙায় ভাগ ভাগ করে এনেছে। সুব্রত টপাটপ সব দিয়ে দিল। একটা ভাগ বেশি হয়েছে।
হেডস্যার বললেন—ওটা রামাধরের।
সুব্রত বললে—আমি স্যার বাইরে গিয়ে খাব?
কেন?
গাছতলায় বসে খেতে ভালো লাগে।
নিমাইস্যার বললেন—ঠিক বলেছিস। চল আমিও যাই।
.
২.
একটু দূরে বারুইপাড়া। ওই পাড়ায় বড় বড় কারিগরদের বাস। তাঁরা সেতার, সরোদ, তানপুরা, হারমোনিয়াম, তবলা এইসব তৈরি করেন। বড়-ছোট অনেক দোকান আছে। আমরা ওই দিকটায় যাই লোভে লোভে। একটা বড় কুলবাগান আছে।
আমি আর সঞ্জয় গেছি। বিকেলবেলা। সরস্বতী পুজো আসছে। গাছে গাছে কেমন কুল ধরেছে দেখতে হবে তো। হঠাৎ দেখি একটা দোকানের সামনে এক বৃদ্ধ মইয়ের ওপর কোনওরকমে দাঁড়িয়ে বেশ বড় একটা সাইনবোর্ড লাগাবার চেষ্টা করছেন, পারছেন না। বয়েস হয়েছে। দুর্বল শরীর।
সঞ্জয় বললে—এই দেখেছিস?
কী দেখব?
পরোপকার।
কে করছে?
কেউ করেনি। আমরা করতে পারি। ওই দেখ, দাদু সাইনবোর্ড ঝোলাচ্ছে। একা। পারছেন না। যে-কোনও মুহূর্তে মই নিয়ে পড়ে যেতে পারে। চল সাহায্য করি।
সঞ্জয় বললে—অতবড় জিনিসটা একা পারবেন?
আর একজন পাচ্ছি কোথায়?
আপনার ছেলে নেই?
ছিল। বিয়ে করে বউ নিয়ে পালিয়েছে। ছেলেরা যা করে থাকে!
কই আমার দাদা তো তা করেনি।
তোমার দাদা একটি গাধা।
সঞ্জয় আমাকে বললে—দেখছিস, দাদাকে গাধা বলছে!
এ গাধা ভালো গাধা। তোর দাদার প্রশংসা।
সঞ্জয় বৃদ্ধকে বললেন—আমরা আপনাকে সাহায্য করব।
বৃদ্ধ বললেন—মতলব?
সঞ্জয় বললে—আমরা পরোপকার করে থাকি।
আমি মরলে এসো। কাঁধ দিয়ো। বাঙালি তো একটা পরোপকারই জানে বলো হরি হরিবোল।
কথা শেষ করেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক মই, সাইনবোর্ড, সবসুদ্ধ নিয়ে দাম করে পড়ে গেলেন। সাইনবোর্ডের তলায় বৃদ্ধ। চিৎকার করছেন হিন্দিতে জানে মারা, জানে মারা। চারপাশ থেকে লোকজন ছুটে আসছে। আমি আর সঞ্জয় ছুটছি। পেছনে চিৎকার—পালাচ্ছে, পালাচ্ছে। পাকাড়া, পাকাড়ো।
আমরা কুলবাগানের মধ্যে দিয়ে, পুকুর পাড় ধরে কোনওরকমে পালিয়ে এলুম। কুলকাঁটায় শরীর ক্ষতবিক্ষত। হাপরের মতো হাঁপাচ্ছি। হেডস্যার অনেক রাত পর্যন্ত স্কুলের অফিসে কাজ করেন।
আমাদের দেখে বললেন—কী ব্যাপার? এ কী চেহারা?
সব শুনে বললেন—আমি তোদের কী বলেছিলুম, আগে এসে রিপোর্ট করবি। কমিটি মিটিং-এ পাস হবে, তারপর অ্যাকশান। তোরা যেটা করতে গিয়েছিলিস, সেটা পরোপকার নয় সাহায্য। কালই আমি মিটিং ডাকছি!
সঞ্জয় বললে—ঝালমুড়ি হবে স্যার?
না, আলুকাবলি হবে।
সঞ্জয় উল্লাসে চিৎকার করে উঠল, ইয়া হু!
হেডস্যার ভুরু কুঁচকে বললেন—এটা কী হল?
এটা স্যার আনন্দের চিৎকার।
.
৩.
সেই নিউহলে মিটিং। বাংলার স্যার আর আমাদের ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাকটারও এসেছেন। আমাদের ব্যায়াম, আসন করান বটে, নিজের অম্বলের অসুখ। দশ মিনিটের মধ্যে তিনবার ভেঁকুর তুললেন ভেউ ভেউ করে। হেডস্যার বিরক্ত হয়ে বললেন—জোয়ানের আরক খেয়েছিলেন?
করুণ মুখে বললেন—ইলিশ মাছ!
এদিক নেই ওদিক আছে। যার জল সহ্য হয় না ইলিশ মাছ! ক’টা খেয়েছেন?
খাব না, খাব না করে তিন পিস মেরে দিয়েছি।
আপনি ইলিশ মেরেছেন এইবার ইলিশ আপনাকে মারবে। গঙ্গার ধারে গিয়ে এক ডেলা মাটি খেয়ে আসুন। মিনিটে, মিনিটে এইরকম সেঁকুর তুললে সভা তো সাসপেন্ড করে দিতে হবে।
বাংলার স্যার বললেন—সভা সাসপেন্ড না করে এই ব্যায়ামবীরকে সাসপেন্ড করে দিন। বাড়ি গিয়ে বারান্দায় বসে ভেঁকুর তুলে বাড়ির লোককে মোহিত করুন।
ব্যায়ামস্যার বললেন—আমাকে আলুকাবলিটা দিয়ে দিলে এখুনি চলে যেতে পারি।
হেডস্যার অবাক হয়ে বললেন—এর ওপর আলুকাবলি চাপাবেন?
ব্যায়ামস্যার বললেন, হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ধরতে গিয়ে দেখেননি। পোর্টারকে ডেকেছেন, ভারী ভারী মাল মাথায় তুলেছে। দু-কাঁধে দুলছে দুটোব্যাগ। আপনার হাতের হাতব্যাগটা দেখিয়ে বলছে, ওটাও আমার কাঁধে ঝুলিয়ে দিন। এ আপনার সেই কেস। যাহা বাহান্ন তাহা তিপান্ন।
আমাদের মধ্যে নিমাই খুব উশখুশ করছিল। উঠে দাঁড়িয়ে বললে—স্যার! আমাদের পাড়ায় একটা পরোপকার পাকছে।
হেড স্যার বললেন—ভাষাটা একবার শুনুন। পরোপকার কি ফল, যে পাকবে?
না স্যার, পরোপকারের একটা সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
শুনি কীরকম সুযোগ!
আমাদের বাড়ির পাশেই থাকেন পরেশ জেঠু। সকাল থেকেই খাবি খাচ্ছেন। একটু পরেই মারা যাবেন। খিটকেল টাইপের লোক। জ্যাঠাইমা কাঁদছেন আর বলছেন—কে কাঁধ দেবে।
হেডস্যার বললেন—আমাদের ছেলেরা একেবারে উচ্ছন্নে গেছে। কী সব ভাষা, খিটকেল, খিচাইন, ক্যাচাল!
ব্যায়ামস্যার বিশাল একটু ঢেঁকুর তুলে বললেন—সব ওই টিভি।
হেডস্যার করুণ গলায় বললেন,কথা বলছেন কেন! কথা বললেই ঢেঁকুর লিক করছে।
বাংলার স্যার বললেন—বড় বাজে দিকে আমাদের মন চলে যাচ্ছে। পরেশবাবুকে আমি চিনি। একটা মানুষ মারা গেলে তার যেমন প্রাণ থাকে না, সেইরকম গুণাগুণও থাকে না। আমাদের প্রত্যেকের একটা সামাজিক কর্তব্য আছে, সেই কর্তব্যবোধে ছেলেরা কাঁধ দেবে। একজন চলে যাও ওখানে। শেষ খাবিটা খাওয়া হয়ে গেলে খবর পাঠাও, আমাদের বিদ্যামন্দিরের টিম গিয়ে সল্কার করে আসবে।
হেডস্যার জনমত চাইলেন। কর্তব্য আর পরোপকার কি এক হল?
অবশ্যই হল। অত বড় একটা সমিতি তৈরি হয়ে গেল, হিন্দু সৎকার সমিতি। অসহায় মানুষ রাতবিরেতে মারা গেলে কী হবে? এ তো খালি প্যাকেট নয়, যে ডাস্টবিনে ফেলে দেবে। সেকালে কত হিতকারী সভা, সমিতি ছিল। জলে ডুবে গেলে, পাতকুয়ায় পড়ে গেলে, ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে ছাত থেকে গিরে গেলে, সঙ্গে সঙ্গে…।
হেডস্যার বললেন—হঠাৎ হিন্দি শব্দ ব্যবহার করলেন কেন? গিরে!
আমি যে বাতলা। সাহিত্য আমার বিষয়। তিনখানা উপন্যাস শেষ। চতুর্থটাও প্রায় শেষ। একবার পড়ে গেল বলেছি। একই ক্রিয়া আমি পর পর দুবার ব্যবহার করি না। আমার ছাত্ররা ব্যবহার করুক তাও আমি চাই না। হেডস্যার বললেন,—উপন্যাসগুলো যন্ত্রস্থ হবে কবে?
সে কি এক কথায় হয় স্যার! মেয়ের বিয়ের মতো! প্রকাশকরা সব পাত্রপক্ষ। নতুন লেখকের লেখা ছাপবে কে?
এ আবার কী? সব লেখকই তো একসময় নতুন ছিলেন। ছাপতে ছাপতে তবেই না পুরোনো হলেন।
সে কথা কে শুনছে স্যার!
যাক, আমাদের কথায় আসি। কতকগুলো জিনিস বোঝার আছে, যেমন পরোপকার, সেবা, সাহায্য কর্তব্য, পরহিত, কোনটা কী? আমাদের মধ্যে থেকে শ্যামল উঠে দাঁড়িয়ে বললে, স্যার! আমার ঠাকুমা একেবারে বুড়ি, কোমর ভাঙা। আমাকে ধরেছেন রোজ সকালে গঙ্গায় স্নান। করিয়ে আনতে হবে। এটা কি পরোপকারের মধ্যে পড়ে। যদি পড়ে, তা হলে আমাকে করতে। হবে। আর তাহলে সকালে আমার পড়া হবে না। আর পড়া না হলে আমি ফেল করব। আর ফেল করলে আমাকে বাড়ি থেকে দূর করে দেবে। আর দূর করে দিলে আমি কোথায় যাব, কী খাব!
শ্যামল বসে পড়ল।
হেডস্যার বললেন—ঠাকুমা পর নন, আপনজন। এ তোমার পরোপকারের মধ্যে পড়ছে না। আপনি কি বলেন?
বাংলাস্যার বললেন—আমার আমি ছাড়া বাকি সবাই তো পর। শ্যামলের পেট খারাপ হলে শ্যামলকেই বাথরুমে যেতে হবে। শ্যামলের ঠাকুমা গেলে হবে না। অতএব?
হেডস্যার বললেন—অতএব?
বাংলা স্যার বললেন—শ্যামলের কেসটা সেবার মধ্যে পড়ছে। আর স্বামীজি পরোপকার, দয়া এইসব কথা সহ্য করতে পারতেন না। তিনি বলতেন শিবজ্ঞানে জীব সেবা। তা হলে?
হেডস্যার বললেন—তা হলে!
তা হলে ব্যাপারটা একটা কথায় এসে দাঁড়াল—সেবা। সেবার মধ্যেই আছে।
ব্রজ উঠে দাঁড়িয়ে বললে—স্যার! আমার বোনের যখনই জ্বর হয় তখনই পা দুটো এগিয়ে দিয়ে বলে, পদসেবা কর।
ব্যায়ামস্যার বললেন—করবি! সঙ্গে সঙ্গে ভেউ করে ভেঁকুর।
নীলাঞ্জন উঠে দাঁড়িয়ে বললে—স্যার! আমার মনে হয় কামারপাড়ায় একটা প্রাইমারি স্কুল করা যেতে পারে। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা সারাদিন মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়ায়। খুব গরিব ওরা।
হেডস্যার বললেন—গুড আইডিয়া!
বাংলা স্যার বললেন—আইডিয়া গুড; কিন্তু করা যাবে না। রাজনীতি।
হেডস্যার ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন—আমরা তা হলে কী করব?
কিচ্ছু করব না, মিটিং করব।
বিষ্ণু হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে এসে ঢুকল।
কী রে! বাঘে তাড়া করেছে?
বিষ্ণু বললে—শিগগির, পরোপকারের মেশিন বের করুন।
সে আবার কী?
বাড়িওয়ালা গুন্ডা এনে আমাদের সব জিনিসপত্তর বাইরে ছুড়ে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। বাবাও হাসপাতালে। মাকে মেরেছে। দিদির চশমা ভেঙে দিয়েছে।
হেডস্যার বললেন—পুলিশ।
ব্যায়ামস্যার বললেন—পুলিশ কী করবে? এসব পেটি কেস।
তা হলে কে করবে?
কেউ করবে না। দেশ এখন আইনের হাতের বাইরে।
অপরেশ উঠে দাঁড়াল—চলুন না স্যার আমরা দল বেঁধে সবাই যাই।
হেডস্যার উঠে দাঁড়ালেন—নিশ্চয় যাব।
বাংলাস্যার সাবধান করলেন—আপনার বুকে পেসমেকার। আর আমি তো যেতে পারবই না, গলব্লাডার।
ব্যায়ামস্যার বললেন—আর আমারও অম্বল! আজ এক বছর হয়ে গেল একটা শিঙাড়া খাইনি, কড়াইশুটির কচুরি খাইনি।
আমাদের মধ্যে অপরেশ অন্য ধাতুতে তৈরি। যেমন চেহারা সেইরকম সাহস। ত্রিভুবনে। অপরেশের কেউ নেই। অনেক সময় মুটেগিরি করে পয়সা রোজগার করে। খুব ভোরে বাড়ি বাড়ি দুধ বিক্রি করে। লেখাপড়ায় ভীষণ ভালো। প্রাইভেট টিউটার রাখার ক্ষমতা নেই। রামকৃষ্ণ মিশনের এক সাধু অপরেশকে পড়ান। আমরা স্বামীজি স্বামীজি করি, অপরেশ স্বামীজিকে তার ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়েছে। অপরেশ বলে, ঠাকুর আমার সব কেড়ে নিয়ে খুব ভালো করেছেন। ঠাকুর, মা, স্বামীজি ছাড়া আমার আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে। আমরা এসব বুঝি না, তবে এটা বুঝি অপরেশ একেবারে অন্য রকমের। যেমন দেখতে সুন্দর, সেইরকম সুন্দর মন।
অপরেশ আমাদের দিকে তাকিয়ে বললে—কেউ আসবে? সাহস আছে? আমরা চারজন এগিয়ে গেলুম। হেডস্যার আসছিলেন, অপরেশ বললে—আপনাকে চিনেছি স্যার। কথা আর কাজ এক করতে পেরেছেন। আপনি পরে আসবেন।
.
৪.
অপরেশ যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে বিষ্ণুদের বাড়ি নয়।
ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করলুম,—যাচ্ছিস কোথায়?
ফোর্স আনতে। আর একটা কথাও বলবি না। শুধু দেখে যা। আমরা একটা অন্ধকার পাড়ায়। এলুম। খুব খারাপ জায়গা। মেয়েরা ঘুরছে। অপরেশ হনহন করে হেঁটে একটা সাবেক কালের বাড়িতে ঢুকল। গোটা বাড়িটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। পেছন দিকের একটা ঘরে আলো জ্বলছে।
ঘরে একটা ডিভান। ডিভানে বলিষ্ঠ চেহারার এক যুবক আড় হয়ে শুয়ে আছে। আর চারজন মেঝেতে বসে আছে বেশ আয়েস করে। পেছন দিকের দরজাটা খোলা। সেখানে একটা মাঠ। দরজার ধারেই পাঁচটা মোটর সাইকেল অন্ধকারে চকচক করছে। মাঠের ওপারে বড় রাস্তা। আলো জ্বলছে। রাস্তার ওপারে জমজমাট বাজার দোকানপাট, নতুন নতুন বাড়ি। সেটা পেরোলেই রেললাইন। আবার অন্ধকারের এলাকা। মেঝেতে যারা বসেছিল তাদের মধ্যে একজন খুব সুন্দর গলায় রবীন্দ্রনাথের গান গাইছে তোমার অসীমে।
অপরেশ ঘরে ঢুকেই বললে—নিবারণদা, উঠে পড়ো, অ্যাকশান। আবার কী হল? আজ যে আমার অফ ডে। ঠাকুরের জন্মদিন বুধবারে আমিও কোনও কাজ করি না।
ঠাকুরেরই কাজ। তপার দল আমাদের এক হেডমাস্টারের বাড়িতে ঢুকে অত্যাচার করছে। স্যার হাসপাতালে আই সি ইউতে পড়ে আছেন।
কেসটা কী?
মডার্ন ইলেকট্রনিকসের জগদা মণ্ডল বাড়িওয়ালা। ভাড়াটে উচ্ছেদ করে বাড়িটা প্রোমোটারকে দেবে। উৎপাত চলছে অনেক দিন ধরে। স্যার হাসপাতালে। এই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে।
তোর প্ল্যানটা বল? তোর মাথা আমার চেয়ে অনেক ভালো।
আমরা পাঁচটা বাইকে চড়ে সোজা জগদার ঠেকে যাব। কোথায় এই সময়ে থাকে তুমি জানো। আমিও জানি। এখন সে খুব দুর্বল। সঙ্গে মেশিন রাখে চালাতে জানে না। যদি ট্যান্ডাই ম্যান্ডাই করে সোজা তুলে নিয়ে যাব ওর গুরুর বাড়িতে। সেখান থেকে মোবাইলে তপাকে বলবে। যদি না বলতে চায় বারুইপুরে তোমার ডেরায় ডামপ।
মন্দ বলিসনি, তপা তো ওইটার কুত্তা। চল তাহলে।
যে গান গাইছিল, সে এবার গাইতে লাগল—কোন খেলা যে খেলবে কখন।
.
৫.
পাঁচখানা মোটর সাইকেল একসঙ্গে পাড়ায় ঢুকল। বিকট শব্দে। আমরা অবাক। জগদার ফুর্তির ডেরার সামনে আমাদের বিদ্যায়তনের অন্তত দুশো ছেলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ভেতরে ঢুকে আরও অবাক। জগদা কাঁদছে, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের হেডস্যার, বাংলার স্যার, আর ব্যায়াম স্যার। বেশ একটা নাটক। ব্যায়াম স্যার ঘন ঘন ভেঁকুর তুলছেন।
আমরা যখন ঢুকলুম তখন হেডস্যার বললেন—জগদা! তুমি আমাদের এক্স স্টুডেন্ট। তোমার বাবা ছিলেন অতি সম্মানিত, সাধক মানুষ। ভগবান তোমাকে কিছু কম দেননি, তোমার এই অধঃপতন! গুণ্ডারাজ একদিন শেষ হবে। তখন তুমি কী করবে? বাইরে তাকিয়ে দেখো আমার দুশো ছাত্র হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে আদেশের অপেক্ষায়। আর এই তো আমাদের নিবারণ এসে গেছে। নিবারণকে তুমি চেনো নিশ্চয়।
জগদা হাঁ-করে চেয়ে আছে। ফোলা ফোলা মুখ। কাতলা মাছের মতো চোখ। বাবু আবার মদ খাচ্ছিলেন। সামনের বার ইলেকশানে দাঁড়াবে। এইসব লোক সমাজের মাথা হবে!
হেডস্যার বললেন যে বাপের পরিচয় দিতে গিয়ে ছেলে-মেয়ের মাথা হেঁটে হয়, তারা তো অরফ্যান। তুমি যখন তোমার পিতার পরিচয় দেবে লোকে বলবে আম গাছে আমড়া হয়েছে। শোনো জগদা, আমার শরীরে বিপ্লবীর রক্ত বইছে। এখুনি তোমার সাজানো-গোজানো দোকানটা আমার ছেলেরা চুরমার করে দিতে পারে।
জগদা উঠে দাঁড়াল। টলছে। বললে—আর আমাকে কিছু বলবেন না স্যার। আমি নিজে যাচ্ছি ক্ষমা চাইতে।
একটা মিছিল। পাঁচখানা মোটর সাইকেল আগে। তারপর আমাদের তিনজন স্যার। তারপর আমরা। বিষ্ণুদের বাড়ির সামনের রাস্তায় মালপত্তর ডাঁই। বিষ্ণুর মা আর দিদি সামনের বাড়ির রকে চুপ করে বসে আছেন। আর বাঙালি ভদ্দরলোকের যা রীতি, সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল। আমাদের মিছিল দেখে সব পালাচ্ছে।
নিবারণ একটার হাত চেপে ধরে বললে—পালাচ্ছিস কোথায়! বাকি মজাটা দেখে যা। এই এর ফুলপ্যান্টটা হাফপ্যান্ট করে দে। প্রতিবাদ না করে এই পাড়ার যারা মজা দেখেছে তাদের সঙ্গে ক’টার বাড়ি আজ ভাঙচুর হবে। একসঙ্গে দুশো ছেলে চিৎকার করে উঠল—হবে।
পটাপট দরজা-জানালা বন্ধ হচ্ছে। রক-বারান্দা সব খালি।
তপা বেরিয়ে এসেছে। হেডস্যার বললেন—তুমি আমাদের স্কুলের ছাত্র ছিলে। পরিচয় দিতে লজ্জা করে। তোমার বাবা ছিলেন সেক্রেটারি। লেখাপড়ায় তুমি ভালোই ছিলে। অধ্যাপক না হয়ে গুণ্ডা হয়েছ। খুব গর্বের কথা!
তপা মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছে।
হেডস্যার বললেন তোমার কাছে তো রিভলভার আছে, যে রিভলভার দিয়ে স্বদেশিরা অত্যাচারী ইংরেজদের মারত, তুমি আমাকে মেরে ফেলল। এ লজ্জা আর সহ্য হচ্ছে না।
একে একে সব মাল ভেতরে উঠে গেল। জগদা বললে—কালই আমি বাড়িটা আপনাদের নামে রেজিষ্ট্রি করে দোব।
বিষ্ণুর মা ধীর শান্ত গলায় বললেন—দান আমরা নিই না। উনি অসুস্থ, বিপদে পড়েছি, সময় হলেই উঠে যাব।
জগদা বললে বাড়িটা তা হলে আমি সুন্দর করে সারিয়ে দোব। যতদিন ইচ্ছে আপনারা থাকবেন। আমার অপরাধ মার্জনা করবেন।
বাংলার স্যার—ইস করলেন।
ব্যায়ামস্যার বললেন—কী হল গোবর মাড়ালেন?
না, না, পরপর দুটো ক্রিয়া, আপনারা থাকবেন, মার্জনা করবেন।
দুটো নম্বর কেটে নিন।
সঞ্জয় আমার কানে কানে বললে—ইস আলুকাবলিটা।
হেডস্যার উঁচু রকে দাঁড়িয়েছিলেন। আমরা সব রাস্তায়। রাস্তার আলো তাঁর মুখে এসে পড়েছে। সুন্দর, সুপুরুষ চেহারা। হাসছেন আর বলছেন—আমি আমার পেসমেকারটা খুলে ফেলে দিতে পারি। তোমাদের সকলের হৃদয়ের শক্তিতে আমি আজ শক্তিমান। তোমরা আমার গর্ব।
আমরা সবাই চিৎকার করে বললুম—আপনাকে আমরা কোনওদিন ভুলব না স্যার। কোনওদিন। ভুলব না।