Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ইঁদুর ও মদিরা || Tarapada Roy

ইঁদুর ও মদিরা || Tarapada Roy

ইঁদুর ও মদিরা

চঞ্চলা পাঠিকা, এই বিদ্যাবুদ্ধির এ রকম অপ্রাকৃত এবং খটমটে শিরোনাম দেখে চট করে পাতা উলটিয়ে দিয়ো না। আসলে এই রচনার নাম অনায়াসেই দেওয়া যেত সুরা ও রমণী অথবা নারী ও মদিরা। কিন্তু অনিবার্য কারণে এবং একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে ইঁদুর বাদ দিয়ে নামকরণ করা গেল না।

তবু ইঁদুরের রহস্যে প্রবেশ করার আগে ভদ্রতাবশত দু’-একটা মদিরার গল্প বলে নিই।

প্রথম গল্পটি শুনেছিলাম শ্রীযুক্ত হিমানীশ গোস্বামীর কাছে, পরে অবশ্য সেটা আমি অন্যত্র পাঠ করেছি। নার্সিংহোমে হাত পা ভেঙে এক ভদ্রলোক শয্যায় শায়িত। আগের দিন রাতে কী এক অজ্ঞাত কারণে ভদ্রলোক দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়েছিলেন এবং তারই ফলে এই অবস্থা। বিকালের দিকে এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেখা করতে এলেন আহত ব্যক্তির সঙ্গে। ‘কাল আমার কী হয়েছিল বল তো ?’ আহত ব্যক্তি বন্ধুকে প্রশ্ন করলেন। বন্ধুটি বললেন, ‘আর বলিস না, সাংঘাতিক ব্যাপার। সেই যে আমরা তোর জন্মদিন উপলক্ষে তোদের গাড়িবারান্দার ছাদে বসে সন্ধ্যারাত থেকে কয়েকজন মিলে কয়েক বোতল মদ খেলাম।’ আহত ব্যক্তি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আরে, সে পর্যন্ত আমার মনে আছে। কিন্তু তারপর পড়লাম কী করে ? কোথায় পড়লাম ?’

বন্ধুটি বললেন, ‘তুই তো নিজে থেকে নিজের দোষে পড়লি। রাত বারোটার সময় তুই বললি যে আমি এবার পাখির মতো উড়তে পারব। এই জন্মদিন থেকে ভগবান আমাকে একটা নতুন ক্ষমতা দিয়েছেন, আজ থেকে আমি ইচ্ছে করলেই পাখির মতো উড়তে পারব।’ আহত ব্যক্তির কিছুই মনে নেই, সে চোখ গোল গোল করে বলল, ‘সর্বনাশ ! তারপর ?’

‘তারপর আর কী ?’ বন্ধুটি বললেন, ‘তুই উড়তে পারবি শোনামাত্র মানিক আর বলাই বাজি রাখল যে, তুই কিছুতেই উড়তে পারবি না, কোনও মানুষ কখনও উড়তে পারে না। এই শুনে তুই ক্ষেপে গেলি। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িবারান্দার কার্নিশে উঠে দুই দিকে দুই হাত ছড়িয়ে পাখির মতো উড়তে গিয়ে নীচে ধপাস করে পড়ে গেলি।’

আহত ব্যক্তি অনেকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, ‘কিন্তু তুই তো ছিলি সেখানে। তুই তো আমাকে বাধা দিতে পারতিস ?’ বন্ধুটি অধোবদনে স্বীকারোক্তি করলেন, ‘কী আর বলব, আমি তো নিজেও ভেবেছিলাম যে তুই নিশ্চয় উড়তে পারবি। তোর ওড়ার উপরে আমিও তো পঞ্চাশ টাকা বাজি রেখেছিলাম।’

দ্বিতীয় গল্পটি আমাকে বলেছিলেন এক পুলিশের দারোগা। দারোগা সাহেব একদিন রাত বারোটার সময় থানায় ফোন পেলেন, এক খ্যাতনামা অভিনেতা (নাম বলা উচিত হবে না) তাঁকে ফোন করছেন, ‘আমার গাড়ি রাস্তায় রেখে আমি একটি অমুক হোটেলে গিয়েছিলাম। এখন সেই হোটেলের থেকেই ফোন করছি। ভীষণ ব্যাপার হয়েছে।’

দারোগা সাহেব ভাবলেন, গাড়ি নিশ্চয় চুরি হয়েছে। হামেশাই হয়। সুতরাং জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার গাড়িটা রাস্তায় নেই ?’ অভিনেতা বললেন, ‘আরে গাড়ি না থাকলে তবু অন্য কথা ছিল। গাড়িটা আছে কিন্তু স্টিয়ারিং-হুইল, ড্যাশবোর্ড, ব্রেক পেডাল এমনকী সামনের কাচটা পর্যন্ত নেই।’

দারোগা সাহেব তাঁর চাকুরি-জীবনে অনেক রকম চুরির কথা শুনেছেন, এটা একটু বেশি অভিনব বলে মনে হল তাঁর, তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনি ওখানে থাকুন আমি আসছি।’ কিন্তু দারোগা সাহেবকে যেতে হল না, তিনি বেরতে যাচ্ছেন এমন সময় বিখ্যাত অভিনেতা টলতে টলতে থানার মধ্যে ঢুকলেন, ‘দারোগাবাবু কিছু মনে করবেন না। আপনাকে অযথা বিরক্ত করেছি। আমার গাড়ির সবকিছু ঠিকঠাক আছে, কিছুই চুরি যায়নি। ভুল করে পিছনের সিটে গিয়ে বসেছিলাম, তাই ও রকম মনে হয়েছিল। ফোন করে ফিরে এসে সামনের সিটে বসতেই সব ঠিকঠাক হয়ে গেল।’

মদের এই প্রভাব এ কি শুধু মানুষদের ওপর ? অন্য জীবজন্তুর সঙ্গে মদের কী সম্পর্ক ? ঘোড়াকে রাম খাওয়ালে বেশি ছোটে এ তো পুরনো কথা। মদ খেলে কুকুরও মাতাল হয় এ আমার স্বচক্ষে দেখা। একবার আমার একটা কুকুর রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে যায়, বিশেষ চোট লাগেনি কিন্তু মৃত্যুভয়ে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল। সামনের বাড়ির এক ভদ্রলোক দয়াপরবশ হয়ে তাকে নিজের বরাদ্দ থেকে দু’ আউন্স হুইস্কি চামচে করে খাইয়ে দিয়েছিলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কুকুরটি চাঙ্গা হয়ে উঠল এবং রাস্তায় ছুটে গিয়ে সমস্ত গাড়িকে তাড়া করতে লাগল। সেদিন বহু কষ্টে তাকে দ্বিতীয়বার চাপা পড়ার হাত থেকে আমরা রক্ষা করতে পেরেছিলাম।

কুকুর বা ঘোড়া নয়, সামান্য ইঁদুরের ওপর মদ নিয়ে গবেষণা করেছেন এক মার্কিন মনস্তত্ববিদ, প্রোফেসর গেলর্ড এলিসন। এলিসন সাহেবের গবেষণা কোনও ভুয়ো বা ফাঁকা ব্যাপার নয়। এই গবেষণার ফলশ্রুতি নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো সংবাদপত্রে বিশদভাবে বেরিয়েছে।

এলিসন সায়েব দেখতে পেয়েছেন যে যদি মদ ঠিকমতো সরবরাহ করা হয় তবুও ইঁদুরের মধ্যে কিছু সংখ্যক কখনওই মদ খাবে না। বাকি কিছু সংখ্যক অল্পস্বল্প মদ খাবে। আর অল্প কিছু ইঁদুর যাকে বলে অ্যালকোহলিক অর্থাৎ পুরোপুরি মদ্যপ তৈরি হবে। এর একটা হিসেবও দিয়েছেন অধ্যাপক এলিসন, শতকরা দশ ভাগ মদ্যপ, শতকরা পঁচিশ ভাগ মদ স্পর্শ করে না, বাকিরা সময়-সুবিধামতো পরিমিত পান করে। সবচেয়ে মজার কথা, মানুষের সমাজেও মদ্যাসক্তির ভাগাভাগিটা প্রায় একই রকম।

পরিমিত মদ্যপায়ী ইঁদুরেরা সাধারণত পান আরম্ভ করে নৈশাহারের দু’ ঘণ্টা আগে। নৈশাহারের পরে তারা জল ছাড়া কোনও পানীয় খায় না। অবশ্য ঠিক ঘুমুতে যাওয়ার আগে আর কেউ কেউ আরেকটু মদ খায়।

সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার মদ্যপ ইঁদুরদের নিয়ে। তাদের স্বভাব চরিত্র আচার আচরণ ঠিক মদ্যপ মানুষদের মতোই। এই অ্যালকোহলিক ইঁদুরেরা সকাল থেকেই মদ্যপান শুরু করে, যত দিন গড়াতে থাকে, তারাও মদ খেয়ে যায়। এরা অধিকাংশই খুব আলসে, এদের ঘুম ভাল হয় না। তার চেয়ে বড় কথা অন্য ইঁদুরেরা এদের মোটেই সম্মান বা গ্রাহ্য করে না। যেসব ইঁদুর মদ খায় না বা পরিমিত মদ্যপান করে ইঁদুর সমাজে তাদের বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গে দেখা হয়।

ইঁদুরের কথা আর নয়, মানুষের কথায় আসি। আরম্ভে সুরা ও রমণীর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, সেখানেই আসছি।

ওমর খৈয়াম এক স্বপ্নসম্ভব পুষ্পকুঞ্জের কথা বলেছিলেন সেখানে খাদ্য ও কাজ, সাকী ও সুরা সবই ছিল। দুঃখের বিষয় এ নিতান্তই পদ্যের পৃথিবী, মানুষের জীবনে এসব একসঙ্গে জোটে না।

এক বিদেশি পানশালার কথা মনে পড়ছে। সেখানে এক বেআক্কেলে মদ্যপের সঙ্গে আমার ক্ষীণ পরিচয় হয়েছিল। একদিন দেখি সে শুকনো মুখে বসে আছে। আমি সহানুভুতি দেখাতে তার পাশে গিয়ে বসলাম, ‘কী হল, কী হয়েছে’ জানতে চাইলাম। সে বলল সাংঘাতিক, আগের রাতে একজনের কাছে এক বোতল হুইস্কির জন্য তার বউকে বেচে দিয়েছে। আমি তখন বললাম, ‘তা হলে এখন বউয়ের জন্য অনুশোচনা হচ্ছে।’ সে বলল, ‘তা হচ্ছে। বউ না থাকায় আজ খুব কষ্ট হবে, আজ মদ খাব কী বেচে ?’

দ্বিতীয় গল্পের নায়কের দেখা পেয়েছিলাম এই শহরেরই এক ক্লাবে। সেও শুকনো মুখে বসে ছিল। জিজ্ঞাসা করাতে বলল, বউয়ের সঙ্গে গোলমাল চলছে। আমি বললাম, ‘তা, ব্যাপারটা কী ?’ সে বলল, ‘বউ বলেছে তিরিশ দিন আমার সঙ্গে কথা বলবে না।’ ‘আমি বললাম, ‘তা হলে তোমার ভালই তো হল।’ ‘ভালই তো হয়েছিল’, সে গেলাসে একটা দীর্ঘ চুমুক দিয়ে দীর্ঘতর নিশ্বাস ছাড়ল, ‘আজকেই মাস শেষ হয়ে গেল, আজকেই তিরিশ দিনের শেষ দিন।’

মদিরা কথামালার আপাতত শেষ গল্পটি অবশ্যই ইঁদুরকে নিয়ে। একটি ইদুঁর একটি বিড়ালকে নিয়ে একটি হোটেলে গেছে। সেখানে ইঁদুরটি পরিমিত এবং বিড়ালটি আকণ্ঠ মদ্যপান করেছে। যখন নেশাগ্রস্ত বিড়ালটি এলিয়ে পড়েছে, তখন ইঁদুরটি বেয়ারাকে ডেকে নিজের জন্য এক প্লেট কড়াইশুঁটির অর্ডার দিল। বেয়ারাটি ভদ্রতা করে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার বন্ধু মিস্টার ক্যাট কিছু খাবেন না, ওঁর খিদে পায়নি ?’ ইঁদুরটি বেয়ারাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ওঁকে নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না, মিস্টার ক্যাটের খিদে পেলে আমি কি আর এখানে থাকব ?’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *