Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আসামী হাজির || Bimal Mitra

আসামী হাজির || Bimal Mitra

“আমি অতি সাধারণ মানুষ। এই সাধারণ মানুষের কথা আজকালকার ক্ষমতালোভী মানুষেরা শুনিবে কিনা জানি না। ক্ষমতা পাইবার লোভে মানুষ যখন আজকাল যে-কোনও অন্যায় আচরণ করিতে প্রস্তুত সেই সময় আমার মত সাধারণ মানুষের কাহিনী শুনিবার মত লোক নাই জানিয়াও আমি আমার এই জীবন লিখিতে বসিয়াছি। এই অবিশ্বাসের যুগেও আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর কোথাও-না-কোথাও একজন বিশ্বাসী-প্রাণ মানুষ আছে। সে মানুষ এখনও সততা এবং সত্যবাদিতাকে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করে ধর্মকে, বিশ্বাস করে ভালবাসাকে এবং বিশ্বাস করে ঈশ্বরকে। এই তিন শক্তিকে যে বিশ্বাস করে না তাহার জন্য আমার একাহিনী নয়। তাহারা আমার এই কাহিনী না পড়িলেও আমি দুঃখ করিব না। ঈশ্বর যদি একজন যিশুখৃষ্টের জন্য হাজার-হাজার বছর অপেক্ষা করিতে পারেন, তাহা হইলে আমার মত নগণ্য লোক একজন সৎ পাঠকের জন্য লক্ষ-লক্ষ বছর অনায়াসেই অপেক্ষা করিতে পারিব। আমার বয়স এখন..”

এই পর্যন্ত লিখেই সদানন্দবাবু থামলেন। বয়েসটা হিসেব করতে হবে। বয়েস কত হলো তাঁর? ভাবতে ভাবতে সদানন্দবাবু ভাবনার তলায় তলিয়ে গেলেন। কম দিন তো হলো না। অত দিনের সব কথা মনে রাখা কি সহজ! অথচ মনে করতেই হবে। মনে না করতে পারলে জীবনী লেখা ব্যর্থ হবে। সব কথাই তাঁকে খুলে লিখতে হবে। কোথাও কথা গোপন করা চলবে না তাঁর। যে-জীবন থেকে সরে এসে তিনি এখানে এই চৌবেড়িয়াতে নির্বাসনদণ্ড ভোগ করছেন সেই ফেলে আসা জীবনের কথা তাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে আবার মনে করতেই হবে। আবার তাঁর ফেলে আসা জীবনটাকে আগাগোড়া পরিক্রমা করতে হবে।

তাঁর সেই ছোটবেলার কথাটাও তিনি মনে করতে চেষ্টা করলেন।

তিনি লিখতে লাগলেন—“আপাতদৃষ্টিতে সেই ছোট বেলা হইতেই আমার কোনও অভাব ছিল না। যাহাকে সংসারী লোক অভাব বলে তাহা আমার ছিল না। আমি নবাবগঞ্জের প্রবল-প্রতাপ জমিদার নরনারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র পৌত্র, আর হরনারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র পুত্র সদানন্দ চৌধুরী, যাহা চাহিতাম তাহাই পাইতাম। চাহিয়া না পাওয়ার দুঃখ যে কী ভীষণ অসহনীয় তাহা আমাকে কখনও বুঝিতে হয় নাই। অথচ সেই আমার কপালেই না-চাহিয়া সব পাওয়ার বিপর্যয় যে এমন মর্মান্তিক ট্রাজেডি হইয়া দাঁড়াইবে তাহা আমি সেই অল্প বয়সে উপলব্ধি করিতে পারি নাই।”

লিখতে লিখতে সদানন্দবাবুর ভাবতে বড় ভালো লাগলো। নবাবগঞ্জের সেই বাড়িটা, সেই গাছ-পালা-পুকুর, সেই বারোয়ারি-তলা, আর সেই চণ্ডীমণ্ডপ। কথাগুলো যেন ভোলা যায় না। অথচ ভুলতেই তো চেয়েছিলেন তিনি। ভোলবার জন্যেই তো এই চৌবেড়িয়া গ্রামে এসেছিলেন।

ঘরের মধ্যে একটা ছোট তক্তপোষ। তের টাকায় কিনে এনেছিলেন চৌবেড়িয়ার বাজার থেকে। তার ওপর একটা মাদুর। যখন এখানে এসেছিলেন তখন কিছুই সঙ্গে আনেন নি। তাঁর কিছু থাকলে তবে তো সঙ্গে আনবেন। নবাবগঞ্জ থেকে ট্রেনে উঠে একবার শুধু তিনি সুলতানপুরে গিয়েছিলেন। তারপর সেখান থেকে কেষ্টনগর। কেষ্টনগর থেকে নৈহাটি। আর তারপর ভাসতে ভাসতে কলকাতা হয়ে একেবারে এই এখানে। এখানে তখন কে-ই বা ছিল! একেবারে যেন পৃথিবীর ওপিঠ। না আছে একটা হাট, আর না আছে একটা স্কুল।

প্রথম আশ্রয় পেলেন পালেদের আড়তে। রসিক পাল ধার্মিক মানুষ। তিনি আপাদমস্তক ভালো করে নজর দিয়ে দেখলেন। বললেন–আপনার নাম?

সদানন্দ চৌধুরী!

ব্রাহ্মণ না কায়স্থ?

ব্রাহ্মণ।

ব্রাহ্মণ শুনে খুব খাতির করে বসতে বললেন। তারপর নানা খবরাখবর নিলেন। কোথায় বাড়ি, পিতার নাম কী, কী উদ্দেশ্যে চৌবেড়িয়ায় আগমন, বিদ্যা কতদূর। সব শুনে বললেন–ঠিক আছে, আপনি যখন এসে পড়েছে তখন আর কোনও ভাবনা নেই, আপনি এখানে থাকুন–

রসিক পাল মশাই চৌবেড়িয়ার বনেদী কারবারী। পাট, তিসি, তিল মেস্তার কারবার করে তিনি বড়লোক হয়েছেন। বিরাট আড়ত ছিল তাঁর। সেই আড়তে বসে তিনি কারবার করতেন আর মহাজনী কারবারের নামে নানা লোককে সাহায্যও করতেন। চৌবেড়িয়া গ্রামের সাধারণ মানুষ পাল মশাইকে ছাড়া তাদের জীবনযাপনের কথা কল্পনাও করতে পারত না। বাড়িতে উৎসবে-অনুষ্ঠানে বিবাহে, শ্রাদ্ধে, অন্নপ্রাশনে, পৌষ-সংক্রান্তিতে সব ব্যাপারেই রসিক পাল মশাই-এর কাছে এসে হাজির হতো। বলতো– যাবেন পাল মশাই, আপনি গিয়ে একবার পায়ের ধুলো দেবেন–

সেই রসিক পালের বড় ইচ্ছে হয়েছিল চৌবেড়িয়াতে একটা স্কুল হোক। গ্রামের ছেলেদের বাইরের গ্রামে গিয়ে লেখাপড়া করতে হয়, এটা তাঁর ভালো লাগতো না। নিজে তিনি লেখাপড়ার ধার ধারতেন না। কিন্তু তার জন্যে তাঁর দুঃখ ছিল। ছেলেদের কলকাতার হোস্টেলে রেখে লেখাপড়া শিখিয়েছে বরাবর। কিন্তু গ্রামে স্কুল করতে গেলে মাস্টার দরকার। এমন মাস্টার চাই যার সময় আছে ছাত্র পড়াবার। কিন্তু তেমন বেকার লোক কোথায় পাবেন? কে মাস্টারি করতে রাজি হবে?

তা শেষ পর্যন্ত এই সদানন্দ চৌধুরীকে পেয়ে গেলেন। রসিক পালের আড়তে অনেক লোক খাওয়া-দাওয়া করে। ব্যাপারীরা কাজে কর্মে আড়তে এলে তাদেরও খাওয়া-শোওয়ার বন্দোবস্ত রাখতে হয়। সদানন্দ সেখানেই থাকুক।

কিন্তু সদানন্দ হাত-জোড় করলে। বললে–তার চেয়ে পাল মশাই আমি বরং স্বপাক আহারের ব্যবস্থা করি। আমার চাল-ডাল-নুন-তেলের ব্যবস্থাটা শুধু আপনি করে দিন। আমি বরং মাইনেই নেব না–

রসিক পাল তাজ্জব হয়ে গেলেন কথা শুনে। বললেন–মাইনে নেবে না?

সদানন্দ বললে—না–

–তাহলে তোমার খরচ চলবে কেমন করে?

সদানন্দ বললে–আমার তো খরচের কিছু দরকার নেই। আমি নেশা-ভাঙ করি না, চা খাই না, পান-তামাক-বিড়ি কিছুরই দরকার হয় না আমার। মাছ-মাংস খাওয়া আমার নিষেধ। দু’বেলা দু’মুঠো ভাত আর আলুভাতে পেলেই আমার চলে যাবে–

রসিক পাল অনেক কাল ধরে অনেক লোক চরিয়ে বুড়ো হয়েছে। এমন কথা কারো মুখে কখনও শোনেননি। আবার ভালো করে আপাদ-মস্তক দেখে নিলেন সদানন্দর। তাঁর মনে হলো এখনও যেন তাঁর অনেক দেখতে আর অনেক শিখতে বাকি।

বললেন–আচ্ছা, আজ রাত্তিরটা তো আড়ত-বাড়িতে থাকো, তারপর কাল যা-হয় করা যাবে–

বলে তিনি সেরাত্রের মত বাড়িতে বিশ্রাম করতে চলে গেলেন। আড়তের ক্যাশবাক্সে চাবি পড়লো। চাবি নেবার আগে হরি মুহুরিকে বললেন–ওই লোকটাকে একটু যত্ন-আত্তি কোরো হরি, লোকটা ভালো মনে হচ্ছে–

হরি মুহুরিই সদানন্দের সব বন্দোবস্ত করে দিলে। পরের দিন রসিক পাল হরি মুহুরিকে জিজ্ঞেস করলেন–কালকে রাত্তিরে ওই ছোকরার কোনও অসুবিধে হয়নি তো?

হরি মুহুরি রসিক পালের আড়তের পুরোন লোক। আড়তে বহু লোকের আনাগোনা দেখেছে, বহু লোকের তদবির তদারক করেছে।

বললে–আজ্ঞে অসুবিধে হবে কেন? অসুবিধে হবার কথা তো নয়।

–কী খেতে দিয়েছিলে?

–আজ্ঞে ভদ্দরলোক কিছুই খান না। বলতে গেলে উপোস। উপোসই এক রকম।

–কী রকম?

–আজ্ঞে, একখানা রুটি আর সিকি বাটি ডাল। আর কিছু নিলেন না।

–মাছ হয়নি কাল?

–আজ্ঞে হয়েছিল, কিন্তু উনি মাছ-মাংস-ডিম কিছুই ছোঁন না।

–শোওয়ার কোনও অসুবিধে হয়নি? নতুন জায়গা তো!

–অসুবিধে হলে কি আর গান গাইতেন?

–গান?

রসিক পাল অবাক হয়ে গেলেন। আবার জিজ্ঞেস করলেন–গান? কী গান?

হরি মুহুরি বললে–ঘুমোতে ঘুমোতে অনেকের গান গাওয়া যেমন অভ্যেস থাকে তেমনি আর কি।

–কী, গানটা কী?

হরি মুহুরি বলল কবির গান আজ্ঞে–ছোটবেলায় হরু ঠাকুরের কবির গান শুনেছিলুম, সেই গান

–হরু ঠাকুরের কোন্ গান?

হরি মুহুরি গানটা বললে–

আগে যদি প্রাণসখি জানিতাম।
শ্যামের পীরিতি গরল মিশ্রিত,
কারো মুখে যদি শুনিতাম ॥
কুলবতী বালা হইয়া সরলা
তবে কি ও বিষ ভখিতাম ॥

রসিক পাল সাদাসিধে মানুষ। কবি নয়, কিছু নয়, সহজ সাধারণ মানুষের গানের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন তিনি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গান গায়, পাগল নাকি হে?

হরি মুহুরি বললে–গানও করতে লাগলেন আবার কথাও বলতে লাগলেন। সারা রাত গান আর কথার জ্বালায় আমাদের কারো ঘুম হয়নি কর্তামশাই–

–গান তো হলো, কিন্তু কথা? কথা কিসের আবার?

হরি মুহুরি বললে–সে সব অনেক কথা, সব কথার মানে বুঝতে পারিনি। কখনও আবার একজন মেয়েমানুষের নাম ধরে ডাকে, আবার কখনও…

–মেয়েমানুষ? মেয়েমানুষ মানে? চরিত্র খারাপ নাকি লোকটার?

হরি মুহুরি বললে–আজ্ঞে তা বলতে পারবো না, তবে যে-মেয়েটার নাম ধরে ডাকছিলেন তার নামটা ভারি নতুন–

–কী রকম?

হরি মুহুরি বললে–নয়ন। কখনও নয়ন বলছিলেন, কখনও আবার নয়নতারা–মনে হলো নিশ্চয়ই কোনও মেয়েমানুষের নাম হবে। রাত্তির বেলা ঘুমোতে ঘুমোতে মেয়েমানুষের নাম ধরে কথা বলে, পীরিতের গান গায়, এ তো ভালো লক্ষণ নয় কর্তামশাই, আপনি কেন অমন লোককে আড়তে ঠাঁই দিলেন বুঝতে পারছি নে, কাজটা কি ভালো হলো?

রসিক পাল তখন আর কিছু বললেন না। মনে মনে ভাবতে লাগলেন। এতদিন সংসারে বাস করে এসে এত লোক চরিয়ে তিনি কি শেষকালে ভুল করলেন নাকি! হরি মুহরির কথার কোনও সোজা উত্তর দিলেন না। শুধু বললেন–ঠিক আছে, তুমি একবার ওঁকে আমার গদিতে পাঠিয়ে দিও তো–

গদিবাড়িতে রসিক পাল রোজ সকালে এসে কয়েক ঘণ্টা বসেন। সেই সময়ে খাতক পাওনাদার পাড়া-প্রতিবেশী নানা রকম লোক নানা আর্জি নিয়ে তাঁর কাছে আসে। কেউ টাকা খয়রাতি চায়, কেউ শুধু মুখটা দেখাতে আসে। তারপর আসে ব্যাপারীরা। কারবারের লেনদেন নিয়ে কথাবার্তা হয় সেই সময়। রসিক পাল মশাই তখন কুঁড়োজালির মধ্যে হাত পুরে মালা জপ্ করেন আর মুখে কথা চলে। রসিক পালের সব কাজই ঘড়ি ধরা। সকাল বেলা উঠেই গঙ্গাস্নান। তখন ঘড়িতে ভোর ছ’টা! পাল মশাইকে দেখেই সবাই বুঝতো তখন ঘড়িতে ছটা বেজেছে। কী গ্রীষ্ম, কী বর্ষা তার কোনও ব্যতিক্রম হতো না। তারপর গদিবাড়িতে এসে যখন বসতেন তখন ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় আটটা। তারপর যখন ঘড়িতে সকাল নটা তখন একবার হাঁচবেন।

এরকম ঘড়ি মিলিয়ে কাজ বড় একটা দেখা যায় না। কিন্তু সেই লোকেরই একদিন সকাল ন’টার সময় হাঁচি পড়লো না।

সে এক বিস্ময়কর কাণ্ড! ঘটনাটা দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো। এ কী হলো! এমন তো হয় না! সকলেই বুঝলো এবার একটা কিছু সর্বনাশ ঘটবে।

রসিক পাল হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন–হরি–

এক ডাকেই আড়ত থেকে হরি মুহুরি এসে হাজির। হরি মুহুরি আসতে পাল মশাই বললেন–হরি, একবার বলাই ডাক্তারকে ডাকো দিকিনি। বলবে আমার শরীর খারাপ, আমি এখুনি বাড়ির ভেতরে যাচ্ছি–

তারপর ডাক্তার এলো। পাল মশাইকে পরীক্ষা করলো। হয়ত ওষুধ-বিষুধও দিলে। কী ওষুধ দিলে ডাক্তার তা কারো জানবার কথা নয়। কেন ঘড়িতে ঠিক ন’টা বাজবার সঙ্গে সঙ্গে তার হাঁচি সেদিন পড়লো না, ডাক্তারি-শাস্ত্রে তার নিদান আছে কিনা তাও কেউ জিজ্ঞেস করলে না। কিন্তু দু’দিন পরে আবার সবাই দেখলে ঠিক ঘড়িতে যখন কাঁটায়-কাঁটায় ছ’টা তখন তিনি গঙ্গাস্নানে চলেছেন। তারপর ঠিক আটটার সময় গদিবাড়িতে এসে বসলেন। আর ঠিক তারপর যখন ন’টার ঘরে ঘড়ির বড় কাঁটাটা ছুঁয়েছে তখন ‘হ্যাচ-চো’ শব্দে তাঁর হাঁচি পড়লো। তখন সবাই নিশ্চিন্ত।

সদানন্দর ঠাকুরদাদা নরনারায়ণ চৌধুরীরও ঠিক এমনি ঘড়ির কাঁটা ধরা কাজ ছিল। নদীতে স্নান করে এসে বসতেন কাছারি-ঘরে। তখন কৃষাণ, খাতক, পাওনাদার, গ্রামের আরো পাঁচ-দশজন গণ্যমান্য লোক এসে বসতো। বিরাট কাছারি-ঘর। কাছারি-ঘরের পেছনে ঢাকা বারান্দা। সেই বারান্দার লাগোয়া সিঁড়ি দিয়ে নরনারায়ণ চৌধুরী দোতলায় উঠতেন। দোতলায় ছিল তাঁর শোবার ঘর। সেই শোবার ঘরের মধ্যেই ছিল তাঁর লোহার সিন্দুক।

সদানন্দ একদিন বলেছিল–দাদু, তোমার কত টাকা!

টাকা! শুধু টাকা নয়, থাক্ থাক্ নোট। তার পাশে হীরে পান্না চুনি মুক্তো! আরো কত দামী-দামী জিনিস।

নরনারায়ণ যখন সিন্দুক খুলেছিলেন তখন দেখতে পাননি যে তাঁর নাতি কখন নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তখন সদানন্দর বয়েস পাঁচ কি ছয়। পাঁচ ছ’ বছর বয়েস থেকেই নাতি যেন কেমন সব লক্ষ্য করতো। সব জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে, সব জিনিস সম্বন্ধে কৌতূহল দেখাবে। বলবে–তোমার দাড়ি সাদা কেন দাদু?।

কর্তাবাবু বলতেন–একে নিয়ে তো মহা মুশকিল হলো দেখছি–ওরে কে আছিস, কোথায় গেলি সব–

দীনু চৌধুরী বাড়ীর পুরনো ভৃত্য দীননাথ। দীননাথ এসে তখন নাতিকে টানতে টানতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেত।

কর্তাবাবু বলতেন–যা দীনু, ওকে নিয়ে পুকুরের হাঁস দেখা গে যা–

সত্যিই তখন অনেক কাজ নরনারায়ণ চৌধুরীর। একগাদা লোক কাছারি বাড়িতে। টাকাকড়ির কথা হচ্ছে তখন খাতকদের সঙ্গে। সুদের কড়াক্রান্তির চুলচেরা হিসেব। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেই লোকসান হয়ে যাবে দাদুর। টাকার ব্যাপারে নরনারায়ণ চৌধুরীর কাছে সব কিছু তুচ্ছ। অন্য সময়ে দাদুর খুব ভালোবাসা। অন্য সময়ে নাতি না হলে দাদুর চলে না। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেন–সদা কোথায় গেল, সদাকে দেখছি নে যে–

রসিক পাল মশাইকে দেখে সদানন্দর সেই কর্তাবাবুকেই মনে পড়তো কেবল। ঠিক তেমনি কারবার, ঠিক তেমনি ব্যবহার।

পরের দিন হরি মুহুরি এল।

বললে–কেমন আছেন বাবু, ঘুম হয়েছিল তো?

সদানন্দ বললে—হ্যাঁ–

–আপনাকে কর্তামশাই একবার ডেকেছেন গদিবাড়িতে—

কথাটা শুনেই সদানন্দ সোজা গদি বাড়িতে যাচ্ছিল। হরি মুহুরি বললে–না না, এখন যাবেন না। এখন নয়–

সদানন্দ বললে–কেন, এখন নয় কেন? এখন ঘুম ভাঙেনি বুঝি তাঁর?

হরি মুহুরি বললে–ঘুম? ঘুম কর্তামশাই-এর ভোর চারটেয় ভেঙেছে, তারপর ছটার সময় গঙ্গাস্নান করেছেন, তারপর আহ্নিক সেরে আটটায় গদিবাড়িতে এসে বসেছেন–

সদানন্দ বললে–তা এখন তো সাড়ে আটটা, এখন যাই–

না, এখন না। ন’টা বাজুক, নটার সময় কর্তামশাই হাঁচবেন—

–হাঁচবেন?

–হ্যাঁ।

–হাঁচবেন মানে?

হরি মুহুরি এই বেকুফকে নিয়ে মহা মুশকিলে পড়লো। বললে–আরে আপনি কি বাংলা কথাও বোঝেন না? হাঁচি মশাই হাঁচি। সর্দি হলে যে-হাঁচি মানুষ হাঁচে সেই হাঁচি। আপনি কখনও হাঁচেন না?

সদানন্দ বললে–হাঁচবো না কেন?

–সেই রকম কর্তামশাইও হাঁচেন। ঠিক ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় ন’টার সময় ঘড়ি মিলিয়ে হাঁচেন।

সদানন্দ তখন চৌবেড়িয়াতে নতুন। তাই অবাক হয়ে গিয়েছিল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল–একেবারে ঘড়ি ধরে ন’টার সময়?

হরি মুহুরির তখন হাতে অনেক কাজ। সে কথার উত্তর দেবার সময় ছিল না তার। সে নিজের কাজে চলে গিয়েছিল আড়তঘর ছেড়ে। তারপর আড়তঘরের ঘড়িতে যখন ন’টা বাজলো ঢং ঢং করে তখন সদানন্দ সবে উঠতে যাচ্ছে এমন সময় পাশের গদিবাড়ি থেকে একটা বিকট হাঁচির শব্দ এলো। একেবারে ঘর-কাঁপানো কান-ফাটানো হাঁচি। ঘড়ির সঙ্গে সদানন্দ আর একবার মিলিয়ে দেখে নিলে হাঁচির টাইমটা। তারপর গদিবাড়ির দিকে পা বাড়ালো।

পাল মশাই-এর ডান হাত তখন কুঁড়োজালির ভেতরে মালা জপতে ব্যস্ত আর বাঁ হাত দিয়ে কাগজপত্র দেখছেন আর সামনে বসা লোকদের সঙ্গে কথা বলছেন। এমন সময় সদানন্দকে দেখেই বাঁ হাতের খাতাটা সরিয়ে পাশে রাখলেন।

বললেন–এই যে, এসো এসো, বোস

সদানন্দ তক্তপোশের ওপর পাতা মাদুরের ওপর পা গুটিয়ে বসলো। যারা এতক্ষণ সামনে ছিল তার একটু নড়ে-চড়ে সরে বসলো।

বলি, তুমি যে সঙ্গীত-সাধনা করো তা তো আমাকে আগে বলোনি, তোমার দেশ কোথায়, দেশে কে কোথায় আছেন, কে নেই সব বলেছ আর আসল কথাটাই বলো নি তো। তুমি গানের চর্চাও করো নাকি আবার?

গান! সদানন্দ কথা বলতে গিয়ে একটু থমকে গেল। বললে–গান?

–হ্যাঁ হ্যাঁ গান। হরি মুহুরি সব বলেছে আমাকে। আড়তঘরে ঘুমোতে ঘুমোতে তুমি গান গেয়েছ, নয়নতারার সঙ্গে কথা বলেছ, আরো কী কী সব করেছ, ও সব বলেছে আমাকে। তুমি কি কবির দলে ছিলে নাকি?

সদানন্দ লজ্জায় পড়ে গেল। কী বলবে বুঝতে পারলে না।

পাল মশাই আবার বললেন–তোমার চেহারা দেখে কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি তুমি গান গাইতে পারো। আমি ভেবেঝিলুম অভাবে পড়ে এখানে এসেছ, আমার কাছে আশ্রয় চাও, তাই তোমাকে ইস্কুলের কথা বলেছিলুম। গাঁয়ের ছেলেরা লেখা-পড়া করতে পারে না…তা নয়নতারা তোমার কে?

সদানন্দ বললে–নয়নতারা? আমি বলেছি?

–হ্যাঁ, গান গেয়েছ, নয়নতারার নাম ধরে কথা বলেছ। ঘুমোতে ঘুমোতে তোমার গান গাওয়ার অভ্যেস আছে বুঝি?

সদানন্দ কোনও উত্তর দিলে না। আর উত্তর দেবেই বা কী? উত্তর দেবার কিছু থাকলে তবে তো উত্তর দেবে?

–কী গানটা যেন বললে–হরি মুহুরি। দাঁড়াও মনে করি। ছোটবেলায় আমিও গানটা—শুনেছি–

আগে যদি প্রাণসখি জানিতাম।
শ্যামের পীরিত গরল মিশ্রিত
কারো মুখে যদি শুনিতাম ॥
কুলবতী বালা হইয়া সরলা
তবে কি ও বিষ ভখিতাম ॥

লজ্জায় মাথা কাটা গেল সদানন্দর। পাল মশাই গানের কলিগুলো বলছেন আর আশেপাশের সবাই শুনছে।

রসিক পাল মশাই আবার বলতে লাগলেন–কিন্তু বাপু, তোমায় বলে রাখছি গান-টান করলে তো আমার চলবে না। গান গাইতে ইচ্ছে করে অন্য জায়গায় চেষ্টা দেখ। আমি গান-টান বিশেষ পছন্দ করি নে। আর গান যদি ভক্তিমূলক গান হয় তাও বুঝি। এসব গান তো চাপল্যের গান হে কী বলল, তোমরা কী বলে?

রসিক পাল সকলের দিকে চেয়ে তাদের মতামত চাইতে তারাও সবাই একবাক্যে বললে–হ্যাঁ কর্তামশাই, আপনি তো হক কথাই বলেছেন–

–ওই দেখ, সবাই আমার কথায় সায় দিলে। আমি অন্যায্য কথা কখনও বলিনে, তা জানো?

তারপর বাঁ হাত দিয়ে আবার হিসেবের খাতাটা কাছে টেনে নিলেন। খাতকরা যে প্রাণের দায়ে তাঁর অন্যায্য কথাতেও সায় দিতে বাধ্য এ-কথা সদানন্দর পক্ষে মুখ ফুটে বলা অন্যায়। তাই আর সে কোনও কথা বললে না। চুপ করে রইল।

রসিক পাল মশাই খাতার হিসেবে মনোযোগ দিতে দিতে এতবার বললেন–যাও, তুমি এবার যাও–

সদানন্দ আর সেখানে বসলো না। তক্তপোশ থেকে উঠে সোজা গদিবাড়ির বাহিরে চলে গেল। রসিক পালের তখন আর ও-সব কথা ভাববার সময় ছিল না। মুহূর্তে হিসেবের গোলকধাঁধার মধ্যে জড়িয়ে পড়লেন। রসিক পাল আর নরনারায়ণ চৌধুরীদের কাছে হিসেবটাই ছিল সব। হিসেবই ধর্ম, হিসেবই অর্থ, হিসেবই ছিল মোক্ষ কাম এবং সব কিছু হিসেব করতে করতেই নরনারায়ণ চৌধুরী একদিন পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে পড়লেন। তখন আর উঠতে পারেন না তিনি।

মনে আছে তখনও পাল্কী করে কালীগঞ্জের বৌ আসতো দাদুর কাছে। সদানন্দ দেখতে পেলেই পাল্কীর কাছে দৌড়ে আসতো। বেশ ফরসা মোটাসোটা মানুষ, সাদা থান পরা। অমন ফরসা মেয়েমানুষ সদানন্দ আর জীবনে দেখেনি। নয়নতারাও ফরসা। সদানন্দর মা, হরনারায়ণ চৌধুরীর স্ত্রী, তিনিও ফরসা। কিন্তু কালীগঞ্জের বৌ শুধু ফরসা নয়, দুধে-আলতায় মেশানো ফরসা। গায়ের রং-এর দিকে একবার চাইলে কেবল চেয়েই দেখতে ইচ্ছে করে। পাল্কীটা উঠোনে থামতেই কালীগঞ্জের বৌ নামতো। মুখের ওপর একগলা ঘোমটা দিয়ে বাড়ির ভেতরে বারান্দায় ঢুকতো। সঙ্গে থাকতো একজন ঝি। ঝি আগে আগে চলতো আর পেছনে কালীগঞ্জের বৌ। চলতে চলতে একেবারে সিঁড়ি দিয়ে সোজা দোতলায় দাদুর ঘরে চলে যেত।

নরনারায়ণ তখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে হিসেবের খাতা দেখছেন। আর মাথার কাছে সেই সিন্দুকটা। ওটা তিনি কাছছাড়া করতে পারতেন না।

–কে?

তারপর ঠাহর করে দেখেই যেন বিচলিত হয়ে উঠতেন।

–আমি নায়েব মশাই, আমি। কালীগঞ্জের বৌ।

–ও!

বলে যেন হঠাৎ বিব্রত হয়ে পড়তেন। একটু নড়ে-চড়ে সরে শুতে চেষ্টা করতেন।

বলতেন–তা আপনি আবার কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন বৌ-মণি! আমি তো বলেই ছিলুম আপনাকে আর আসতে হবে না–

কালীগঞ্জের বৌ বলতো–কিন্তু আর তো আমি অপেক্ষা করতে পারছি না নায়েবমশাই। আর কত দিন অপেক্ষা করবো? এই দশ বছর ধরে আপনি বলে আসছেন আমাকে আসতে হবে না, আমাকে আসতে হবে না। শেষকালে আমি মারা গেলে কি আমার টাকাগুলো দেবেন? তখন সে-টাকা আমার কে খাবে? সে টাকায় কি আমার পিণ্ডি দেওয়া হবে?

–আঃ, বৌ মণি আপনি বড় রেগে যাচ্ছেন! আমি যখন বলেছি আপনার টাকা দেব তখন দেবই।

–কিন্তু কবে দেবেন তাই বলুন! আজই টাকা দিতে হবে আমাকে। এই আমি এখানে বসলুম। এখান থেকে আমি নড়ছি না আর যতক্ষণ না আমার দশ হাজার টাকা পচ্ছি–

বলে কালীগঞ্জের বৌ সেইখানে সেই মেঝের ওপরেই বসে পড়লো।

হঠাৎ দাদুর নজরে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠেছে–ওরে, খোকা এখানে কেন? ওরে কে আছিস, খোকাকে এখান থেকে নিয়ে যা, ও দীনু–

দীননাথ কোথা থেকে দৌড়তে দৌড়তে এসে সদানন্দর হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যেত। সদানন্দ আর দেখতে পেত না কালীগঞ্জের বৌকে। কিন্তু মন থেকে দূর করতে পারতো না দৃশ্যটা। থেকে থেকে কেবল কালীগঞ্জের বৌ-এর চেহারাটা চোখের ওপর ভেসে উঠতো। ঘুমের ঘোরেও মনে হতো ওই বুঝি কালীগঞ্জের বৌ এল!

একদিন দীনুকে জিজ্ঞেস করেছিল–ও বউটা কে দীনুমামা?

দীনুমামা বলেছিল–চুপ, ওকথা জিজ্ঞেস করতে নেই–

তবু ছাড়েনি সদানন্দ। জিজ্ঞেস করেছিল–ও দাদুর কাছে টাকা চায় কেন? কীসের টাকা? দাদু ওকে টাকা দেয় না কেন? ও কে?

দীনু বলেছিল–ও-সব কথা তোমার জানতে-নেই। ও কালীগঞ্জের বৌ–

এর বেশী আর কিছু বলতো না দীনু। শুধু দীনু নয়, ওই কালীগঞ্জের বউ বাড়ীতে এলেই বাড়িসুদ্ধ সবাই যেন কেমন গম্ভীর হয়ে যেত। দাদু থেকে শুরু করে বাবা মা সবাই কেমন চুপ করে থাকতো। কারোর মুখে আর কোনও কথা বেরোত না তখন। ও যেন কালীগঞ্জের বৌ নয়, যম। যেন নবাবগঞ্জের চৌধুরী বাড়িতে সাক্ষাৎ যম এসেছে চৌধুরীবাড়ীর সর্বনাশ করতে। যেন সে চলে গেলেই সবাই বাঁচে।

কিন্তু রসিক পাল মশাই-এর এখানে অন্য রকম। রসিক পাল মশাই চৌবেড়িয়ার সুখী মানুষ। ধর্মভীরু। সবাইকে দয়া-দাক্ষিণ্য করেন। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। আড়তে যেমন বহু লোক থাকে খায় শোয়, তেমনি আবার সুদের একটা পয়সা পর্যন্ত ছাড়েন না। বলেন– না হে, ওটি পারবো না। দাতব্য করতে বলো করছি কিন্তু সুদের হিসেবে গরমিল করতে পরবো না–ওটা পাপ–

রসিক পাল মশাই সত্যিই রসিক পুরুষ।

হঠাৎ হঠাৎ তাঁর অনেক কিছু মনে পড়ে যায়। সেদিনও তেমনি। কাজ করতে করতে আবার হঠাৎ ডেকে উঠলেন–হরি–

পাশের আড়তঘর থেকে হরি মুহুরি দৌড়ে এল। বললে–আজ্ঞে ডাকছেন, আমাকে?

রসিক পাল বললেন–দেখ হরি, ওই যে লোকটা, ওর নামটা কী যেন…

–আজ্ঞে কার কথা বলছেন?

–ওই যে, কাল বিকেলবেলা আমার গদিবাড়িতে এসেছিল। রাত্তিরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গান গাইছিল? আমি তাকে ডেকে সব জিজ্ঞেস করেছি। তা আমি ভাবছি কি জানো, আসলে ছেলেটা খারাপ নয়, বুঝলে? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গান গাইলে ওর কী দোষ বলো? ঘুমোলে তো আর কারো জ্ঞান থাকে না! ঘুম না মড়া।

হরি মুহুরি বললে–আজ্ঞে, তা তো বটেই–

–তবে যে তুমি বললে–ছেলেটা ভালো নয়, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পীরিতের গান গায়, মেয়েমানুষদের নাম ধরে ডাকে!

হরি মুহুরি বললে–আজ্ঞে যা ঘটেছে আমি তাই-ই আপনাকে বলেছি–

না হে, আমি ভেবে দেখলাম ওর কিছু দোষ নেই। ওর জন্যে তোমাদের যদি ঘুমের ব্যাঘাত হয় তো ওর বিছানাটা না-হয় তোমরা অন্য ঘরে করে দাও–

হরি মুহুরি বললে–কিন্তু কর্তামশাই, তিনি তো চলে গেছেন–

–চলে গেছেন মানে?

–আজ্ঞে তিনি যে বললেন আপনি তাকে চলে যেতে বলেছেন।

–আমি? তাঁকে চলে যেতে বলেছি?

–আজ্ঞে তিনি তো তাই বললেন। বলে আড়তঘর ছেড়ে চলে গেলেন।

রসিক পাল রেগে গেলেন। বললেন–তোমাদের কি কোনও আক্কেল বলে কিছু নেই? তিনি বললেন আর তোমরাও তাঁকে যেতে দিলে? কোথায় যাবেন তিনি? তোমরা জানো তাঁর কোনও যাবার জায়গা নেই? তাঁকে জিজ্ঞেস করেছ তিনি যাবেন কোথায়? তার কোনও চুলোয় কি কেউ আছে যে সেখানে তিনি যাবেন?

হরি মুহুরি আর সেখানে দাঁড়াল না। সোজা একেবারে দৌড়তে লাগলো রাস্তার দিকে। সামনের বড় রাস্তাটা একেবারে গিয়ে পড়েছে গঙ্গার কাছে। তখনও সদানন্দ কোথায় যাবে ঠিক করতে পারেনি। গঞ্জের মুখে খানকয়েক দোকান। সেখানে গিয়েই ভাবছিল কোথায় যাওয়া যায়। সেই কোথায় নবাবগঞ্জ আর কোথায় সেই নৈহাটি আর কোথায় সেই সুলতানপুর। সব জায়গা থেকে ভাসতে ভাসতে একেবারে এই অজ গ্রামে চৌবেড়িয়াতে এসে হাজির হয়েছিল। এবার এখান থেকেও চলে যেতে হলো।

হঠাৎ পেছনে হরি মুহুরির গলা শোনা গেল।

–ও মশাই, ও মশাই—

ডাকতে ডাকতে সামনে এসে হাঁফাতে লাগলো বুড়ো মানুষটা।

বলল–আপনি তো খুব ভদ্রলোক মশাই, কর্তামশাইকে কিছু না বলে কয়ে চলে এলেন, এদিকে আমার হয়রানি, চলুন–

তখনও সদানন্দ ব্যাপারটা স্পষ্ট বুঝতে পারেনি।

হরি মুহুরি সদানন্দর হাতটা খপ করে ধরে ফেললে। ধরে টানতে লাগলো। বললে– আর বোঝবার কিছু নেই, চলুন কর্তামশাই আপনাকে ডাকছেন–

বলে টানতে টানতে একেবারে গদিবাড়িতে কর্তামশাই-এর সামনে হাজির করলো।

রসিক পাল বললেন–তুমি চলে যাচ্ছিলে যে?

সদানন্দ বললে–আজ্ঞে আপনি যে চলে যেতে বললেন–

–তুমি বলছো কী? আমি তোমাকে চলে যেতে বলেছি? এই যে এতগুলো লোক এখানে রয়েছে, এরাও তো শুনেছে, এরা কেউ বলুক তো আমি তোমাকে কখন চলে যেতে বললাম? বলুক এরা

তা তার দরকার হলো না। সদানন্দ আবার রয়ে গেল চৌবেড়িয়াতে। তার জন্যে অন্য একটা ঘরের বন্দোবস্ত হলো। ইস্কুল প্রতিষ্ঠা হলো। গভর্নমেন্ট থেকে প্রাইমারি স্কুলের টাকাও ধার্য হলো শেষ পর্যন্ত। সবই করে দিয়েছিলেন সেই রসিক পাল মশাই।

হায়, কিন্তু কোথায় গেলেন সেই রসিক পাল, আর কোথায় রইল তাঁর সেই স্কুল। সে-সব চলে গেছে এখন। সেই নরনারায়ণ চৌধুরী, সেই হরনারয়ণ চৌধুরী, সেই নয়নতারা, সেই নিখিলেশ, সেই কালিগঞ্জের বৌ, সবাই কে কোথায় চলে গেল তা জানবার প্রয়োজন তাঁর ফুরিয়ে গেছে আজ। সেই রসিক পালের দেওয়া ঘরখানাতেই তাঁর দিন কাটে এখন, এই চৌবেড়িয়ার রসিক পালের এস্টেট থেকেই তাঁর ভরণ-পোষণটা এসে যায়। আর সকাল থেকে রাত, রাত থেকে সকাল পর্যন্ত কোথা দিয়ে কেটে যায় কী করে কাটে তারও খেয়াল থাকে না সদানন্দবাবুর! রসিক পালের এস্টেটের টাকায় জীবন চলছে তাঁর। শুধু তাঁর নয়, অনেকেরই জীবন চলে। এ যেন ধর্মশালার মত অনেকটা। এককালের মাস্টার মশাই এখানকার অনেকেরই মাস্টার মশাই, তাঁকে মানে সবাই। ভাত আসে অতিথিশালা থেকে, আর তিনি রুটিন বেঁধে জীবন-যাপন করেন। বেশ শান্তিতেই আছেন তিনি। এই জীবনটার কথাই তিনি লিখে যাবেন। অনেক পাতা লেখা হয়ে গেছে। সেদিন আবার তিনি খাতাটা নিয়ে লিখতে বসেছেন।

তিনি লিখতে লাগলেন—“আমি এখন ঘরেও নাই, ঘরের বাইরেও নাই। ঘরই আমার নিকট পর, আবার পরই আমার নিকট ঘর। আমার চাওয়ারও কিছু নাই, তাই পাওয়ার পর্বও আমার চুকিয়া গিয়াছে চিরকালের মত। আজ এত দূর হইতে বাল্যকালের দিনগুলির দিকে চাহিয়া কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আমার আর কিছু করিবারও নাই। যাহা কিছু ইহ-জীবনে করিয়াছি তাহা ভাল করিবার উদ্দেশ্যেই করিয়াছি। পরের ভালো ব্যতীত আর কিছু ভাবি নাই, তবে…..”

হঠাৎ ঘরের দরজায় একটা টোকা পড়লো।

লিখতে লিখতে থেমে গেলেন সদানন্দবাবু। জিজ্ঞেস করলেন–কে?

বাইরে থেকে কেউ উত্তর দিলে না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন–কে?

তবু উত্তর নেই।

সদানন্দবাবু এবার উঠলেন। উঠে দরজাটা খুলতেই দেখলেন একজন বৃদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে আছেন। প্রায় তাঁরই বয়েসী। হাতে একটা পুঁটুলি।

সদানন্দবাবু জিজ্ঞেস করলেন–কাকে চাই?

–আপনার নাম কি সদানন্দ চৌধুরী?

সদানন্দবাবু বললেন—হ্যাঁ–

–আপনার পিতার নাম কি হরনারায়ণ চৌধুরী?

সদানন্দবাবু আবার বললেন–হ্যাঁ—

–আপনার নিবাস কি নবাবগঞ্জে?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

বলতেই ভদ্রলোক আর কোনও কথা না বলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লো। বললে– আরে মশাই, আপনাকে আজ পনেরো বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি, আর আপনি এখানে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছেন–

বলে তক্তপোশের ওপর বসে রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে লাগলো।

সদানন্দবাবু তখনও বুঝতে পারছেন না কিছু। বললেন–আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না আপনার কথা–

–আরে মশাই, আমার নাম হাজারি বেলিফ, আমি ফৌজদারি-আদালত থেকে আসছি। আপনার নামে হুলিয়া আছে। আপনি খুন করে এখানে লুকিয়ে আছেন, ভেবেছেন কেউ টের পাবে না—

সদানন্দবাবু অবাক হয়ে গেলেন। বললেন–আমি খুন করেছি? বলছেন কী আপনি? কাকে?

ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠলো। যেন বেশ একটা মজার বিষয়বস্তু পেয়েছে সদানন্দবাবুর কথার মধ্যে।

বললে–দাঁড়ান মশাই, আজ এত বছর ধরে আপনার পেছনে লেগে পড়ে আছি, আপনার জন্যে আমার চাকরি যায়-যায় অবস্থা–

সদানন্দবাবু ভদ্রলোকের হাল-চাল দেখে কেমন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। বললেন–দেখুন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি কী বলছেন

ভদ্রলোক বললে–কেন, আমি তো সোজা বাংলা ভাষাতেই কথা বলছি, আপনি নিজেও তো বাঙালী মশাই। আপনার নিবাস নদীয়া জেলার নবাবগঞ্জ গ্রামে, আপনার পিতামহের নাম নরনারায়ণ চৌধুরী, আপনার পিতার নাম হরনারায়ণ চৌধুরী, আপনারা নবাবগঞ্জের জমিদার, আমি কি কিছু জানি না বলতে চান?

সদানন্দবাবু তখনও অবাক হয়ে দেখছিলেন ভদ্রলোকের মুখখানা। মনে হলো কোথায় যেন আগে দেখেছিলেন লোকটাকে। ভদ্রলোক তখন একটা মোটা ঝাড়নের মত রুমাল দিয়ে ঘাম মুছছে ঘষে ঘষে। অনেক দূর থেকে হেঁটে এসেছে লোকটা মনে হলো।

ভদ্রলোকের যেন হঠাৎ নজরে পড়লো। বললে–আরে, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন না, আপনার তো এখন কোনও কাজকর্ম নেই, কেবল খাচ্ছেন-দাচ্ছেন আর নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন–রসিক পালের পুষ্যিপুত্তুর হয়ে পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে বসে আছেন

কথাগুলো সদানন্দবাবুর ভালো লাগলো না। কিন্তু সে কথা চেপে গিয়ে বললেন আপনাকে যেন কোথায় দেখেছি বলুন তো

–আমাকে কোথায় আর দেখবেন। কোর্টেই দেখেছেন।

–কোর্টে? কোর্টে তো আমি কখনও যাইনি।

–তাহলে কালেক্টরি অফিসে দেখেছেন। আমি কোর্টে যাই, কালেক্টরিতে যাই, দুনিয়ার সব জায়গাতেই যে আমায় যেতে হয় মশাই। দুনিয়াতে যে-যে কিছু সম্পত্তি করেছে তার কাছেই আমাকে যেতে হয়। আমার কাজই তো আসামীকে কোর্টে নিয়ে গিয়ে হাজির করা। যেমন আপনি! আপনি একজন আসামী বলেই আপনার কাছে এসেছি

তারপর একটু থেমে বললে–এক গ্লাস জল দিতে পারেন, বড্ড তেষ্টা পেয়েছে–

সদানন্দবাবু বললেন–আপনি বসুন, আমি জল আনি—

রসিক পালের এস্টেটে বন্দোবস্ত সব পাকা। আগে আরো পাকা ছিল। তখন রসিক পাল বেঁচে ছিলেন। কাছারি বাড়িতে পাকা খাতায় সকলের নাম লেখা থাকতো। কে আজ খাবে, কী তার নাম, ক’জন খাবে, কী কাজে তারা চৌবেড়িয়ায় এসেছে, হরি মুহুরির লোক সব কিছু খাতায় লিখে রাখতো। রসিক পালের টাকাও যেমন ছিল, তেমনি আবার সে-টাকার সদ্ব্যবহারও ছিল। যেদিন স্কুল উঠে গেল, সেদিন রসিক পাল বড় কষ্ট পেয়েছিলেন মনে মনে। কিন্তু উঠে যাবার কারণও ছিল। রসিক পাল সুদখোর মানুষ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু মানুষটাকে যে ভালো ভাবে না চিনেছে সে রসিক পালকে বুঝতে ভুল করবে। রসিক পাল কথায় কথায় বলতেন–আমি কি টাকা নিয়ে দান-ছত্তোর করতে বসেছি হে যে সুদের টাকা ছেড়ে দেব?

কিন্তু হরি মুহুরি যখন এসে খরচের কথা বলতো তখন রেগে যেতেন। বলতেন–খরচ হবে তো খরচ হবে, আমি কি টাকা নিয়ে স্বগ্যে যাবো? আমি সঙ্গে করে টাকা নিয়েও আসিনি, সঙ্গে করে নিয়ে যাবোও না। যা খরচ হবে তা হবে। চালের দাম বাড়ছে বলে কি আমি অতিথিশালা তুলে দেব ভেবেছ?

লোক বলতো–পাগল, পাল মশাই একজন আস্ত পাগল।

সদানন্দবাবু সব ভালো করে দেখতেন। এমন লোক আগে কখনও দেখেননি তিনি। দেখলে তাঁর জীবনটা অন্য রকম করে গড়ে উঠত। হয়ত এমন করে এভাবে জীবনটা শেষ করতে হতো না।

আত্মজীবনীটা লেখবার সময় ওই রসিক পাল সম্বন্ধে অনেকগুলো পাতা লিখতে হবে। যে-পৃথিবী ঘেন্নায় ছেড়ে এসে এখানে এমন করে আশ্রয় পেয়েছেন এখানকার সেই আশ্রয়দাতার কথা না লিখলে তাঁর লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

স্কুল যেদিন উঠে গেল সেদিন রসিক পাল বড় দুঃখ করে বলেছিলেন–মাস্টার, আমি পারলুম না

সদানন্দবাবু বলেছিলেন–আপনি যে পারবেন না পাল মশাই তা আমি জানতুম।

–কী করে জেনেছিলে?

সদানন্দবাবু বলেছিলেন–কারণ কেউ-ই পারেনি। কেউ পারেনি বলেই আপনি পারলেন না।

–তার মানে? রসিক পাল অবাক হয়ে চেয়ে দেখেছিলেন মাস্টারের দিকে।

সদানন্দবাবু বলেছিলেন–মানে হুঁকোর খোল-নলচে খারাপ হয়ে গেলে কি তামাক ধরে, না ধোঁয়া বেরোয়!

রসিক পাল কথাগুলো তবু বুঝতে পারেননি সেদিন। রসিক পাল দেদার টাকাই উপায় করেছিলেন, কিন্তু টাকার ওপর আসক্তি তাঁর কমেনি। টাকার আসক্তি যার আছে তার দ্বারা টাকার সদ্ব্যয় কেমন করে হবে? তাই ছেলেরা স্কুলে আসতো না, সদানন্দবাবু বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের ডেকে আনবার চেষ্টা করতেন।

শেষকালে সদানন্দবাবু একদিন হাল ছেড়ে দিলেন।

বললেন–এবার স্কুল তুলে দিন পাল মশাই, আর আমাকেও মুক্তি দিন–

–কেন? কী বলছো তুমি?

সদানন্দবাবু বললেন–আমি গোড়াতেই আপনাকে বলেছিলুম এসব কাণ্ড আরম্ভ না করতে, কিন্তু আপনি কিছুতেই শুনলেন না। এখন কেউ লেখাপড়া করবে না। এখন লেখাপড়া না করেই ছেলেরা হাজার টাকা মাইনের চাকরি চাইবে–

–ওটা তোমার রাগের কথা মাস্টার, তুমি আর একটু চেষ্টা করে দেখ না। মাসে মাসে আমি এতগুলো টাকা দিচ্ছি, গভর্মেন্টের ঘর থেকেও টাকা আনবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, দেখবে, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে–

কিন্তু ঠিক শেষ পর্যন্ত হলো না। যত দিন যেতে লাগলো ততই যেন কারা সব গ্রামে আসতে লাগলো লুকিয়ে লুকিয়ে। অচেনা সব মুখ তাদের। রাতের অন্ধকারে তারা গঙ্গার ধারে গঞ্জের হোটেলে এসে ব্যাপারী সেজে রইল। তারপর একদিন কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ রসিক পাল মশাই-এর বসত বাড়ির ভেতর থেকে একসঙ্গে একটা আর্তনাদ উঠলো।

সে অনেক রাত তখন!

তারপর পুলিস এল, এনকোয়ারি হলো। কয়েকদিন ধরে চৌবেড়িয়াতে খুব হইচই হলো। লোকজনকে ধরে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ চললো। কয়েকজন গ্রেফতারও হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুরই ফয়সালা হল না। যে মানুষ একদিন সামান্য অবস্থা থেকে নিজের আর্থিক অবস্থা ফিরিয়ে দশজনের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁকে থতম করে দেশকে পাপমুক্ত করা হলো।

তারপরও কিছুদিন স্কুল চলেছিল। কিন্তু পাশের গ্রামে আর একটা স্কুল হলো। একদিন তারা এখানকার সব ছেলে ভাঙিয়ে নিয়ে চলে গেল।

রসিক পাল মশাই-এর ছেলে ফকির পাল বললে–মাস্টার মশাই, এবার কী করবো তা হলে?

সদানন্দবাবু বললেন–আর কী করবে? এবার স্কুল বন্ধ করে দাও, আর আমাকেও এবার মুক্তি দাও–

ফকির বললে–কিন্তু আপনি কোথায় যাবেন?

সদানন্দবাবু বললেন–আমি আর কোথায় যাবো বাবা, যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকেই চলে যাবো। তোমাদের ঘাড়ে কতদিন বসে বসে খাবো, বলো?

ফকির বললে–তা হবে না মাস্টার মশাই, আমি জানি আপনার কোথাও যাবার জায়গা নেই–

সদানন্দবাবু বললেন–ওকথা বোল না ফকির; মানুষের সমাজে জায়গা না হোক, বনে জঙ্গলে জানোয়ারের সমাজে তো জায়গা হবেই—

তবু ফকির পাল ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। রসিক পালের সব ক্রিয়াকর্মই ফকির চালিয়ে যাচ্ছে। বার বাড়ির উল্টোদিকে অতিথিশালা ছিলই আগে থেকে। কখনও সেখানে কেউ থাকতো, আবার কখনও কেউ থাকতো না। তীর্থের গুরুমহারাজ কিম্বা পাণ্ডাঠাকুর কেউ এলে তাঁদের অতিথিশালার একটা মহলেই আশ্রয় দেওয়া হতো। তাঁদের জন্যে যেমন ব্যবস্থা ছিল, মাস্টার মশাই-এর জন্যেও ঠিক সেই তেমন ব্যবস্থাই হলো।

সদানন্দবাবুর সেই দিন থেকে আর কোথাও যেতে পারলেন না। এই চৌবেড়িয়াতেই রয়ে গেলেন।

হরি মুহুরি প্রথম দিনেই বুঝতে পেরেছিল।

বলেছিল–আচ্ছা মাস্টার মশাই, নয়নতারা কে?

সদানন্দবাবু একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলেন প্রথমে। বললেন–কেন মুহুরি মশাই? নয়নতারার কথা তুমি জানলে কেমন করে?

–আপনি নিজেই বলেছেন।

বলে হরি মুহুরি হাসতে লাগলো।

সদানন্দবাবু বললেন–ও বুঝতে পেরেছি, আমার ওই এক বদ অভ্যেস, ঘুমোতে ঘুমোতে কথা বলি। আজকে পাল মশাইও তাই বলছিলেন আমাকে। আমি নাকি গান গেয়েছিলুম–

–আমিই তো বলেছি কর্তামশাইকে। আমি তো আপনার পাশের ঘরে শুয়েছিলুম, তাই মাঝরাত্তিরে আপনার হরুঠাকুরের কবিগান শুনে চমকে উঠেছিলুম। ভাবলুম সেকালের গান একালে এত রাত্তিরে কে গায়! তা আপনি কবিগানের দলে ছিলেন নাকি?

সদানন্দবাবুর হাসি পেল। মুখে বললেন–না না, কবির দলে ছিলুম না। কবির দলে থাকতে যাবো কোন্ দুঃখে! গানটা শুনেছি তাই মনে আছে–

–আপনার দেশ কোথায় মাস্টার মশাই? আপনার বাড়ি?

এই চৌবেড়িয়াতে আসর পর থেকে এই প্রশ্ন তাঁকে অনেকবারই শুনতে হয়েছে। আরো যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিনই হয়তো শুনতে হবে। রসিক পালও জিজ্ঞেস করতেন প্রথম প্রথম। অজ্ঞাতকুলশীল মানুষকে নিজের আস্তানায় আশ্রয় দিতে গেলে তার কুলুজি জানতে হয়। কোথায় নিবাস, পিতার নাম, সব কিছু।

রসিক পাল বলতেন–ঠিক আছে বাবা, তোমার কিছু বলতে হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি কোথাও তোমার একটা ঘা আছে

–ঘা?

–হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ, এতদিন মহাজনী কারবার করছি আর লোক চিনতে পারবো না? তোমায় কিছু বলতে হবে না। কবিগানের কথাও বলতে হবে না, নয়নতারা কে তা–ও বলতে হবে না। আমি সব বুঝতে পেরেছি–

বলেই একটা লম্বা হাঁচি হাঁচলেন। আর সদানন্দবাবু ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখলেন ঠিক কাঁটায় কাঁটায় বেলা নটা।

হাঁচির পরেই মনটা বেশ প্রসন্ন হয়ে উঠলো রসিক পালের। হাঁচির সঙ্গে ঘড়ির কাঁটা মিলে গেছে এমন ঘটনায় রসিক পাল বরাবরই প্রসন্ন হয়ে উঠতেন।

সদানন্দবাবু চৌবেড়িয়াতে যাবার পর থেকেই রসিক পাল মশাই-এর মেজাজ যেন কেমন মিষ্টি হয়ে গেল। তিনি দু’হাতে দানছত্র করতে লাগলেন। ফকির পাল বাবার কাণ্ড দেখে একদিন বাপকে বললে–এখন দিনকাল বদলে গেছে, এখন কি আর এত খরচ বাড়ানো উচিত বাবা?

রসিক পাল আশেপাশের লোকজনদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন–দেখ দেখ, ফকিরের কথা শুনলে তোমরা! আজকালকার ছেলে তো, কেবল কোট-প্যান্ট পরতেই শিখেছে। আরে, আমি আমার নিজের টাকা খরচ করবো তাতে তোর কী? তুই কথা বলবার কে? আমার রোজগার করা টাকা আমি খরচ করবো তাতে তোর অত মাথাব্যথা কেন শুনি?

তা এদিকে তখন ঘরের মধ্যে বসে হাজারি বেলিফ অপেক্ষা করছিল। আসামী কি পালালো নাকি? জল আনতে গেল তো গেলই। এতক্ষণ লাগে এক গেলাস জল আনতে! ভদ্রলোক হাতের পোঁটলাটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ঘরের বাইরে একবার উঁকি মেরে দেখবার চেষ্টা করলে। কে যেন যাচ্ছিল উঠোন পেরিয়ে।

ডাকলেও গো, কে তুমি? একবার ইদিকে এসো তো ভাই–

অতিথিশালার লোক। ডাক শুনে কাছে এল। ভদ্রলোক বললে–তুমি এ বাড়ির লোক তো?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

–কী নাম তোমার?

–গণেশ।

–গণেশ! বেশ নাম। ভাই গণেশ, তুমি বলতে পারো এই ঘরের সদানন্দবাবু কোথায় গেলেন?

–আমাদের মাস্টার মশাই-এর কথা বলছেন?

ভদ্রলোক বললে–সদানন্দবাবু বুঝি তোমাদের মাস্টার মশাই?

–আজ্ঞে, এখন আর মাস্টারি করেন না, আগে করতেন। তাঁকে দরকার?

–হ্যাঁ ভাই, এক গ্লাস জল চেয়েছিলুম তাঁর কাছে। অনেক দূর থেকে আসছি কিনা আমি। বড্ড জল-তেষ্টা পেয়েছিল

গণেশ বললে–আপনি মাস্টার মশাই-এর কাছে জল চেয়েছিলেন? তবেই হয়েছে! আজকে তাহলে আর জল পেয়েছেন!

–সে কী? কেন? তিনি যে আমাকে বসতে বলে চলে গেলেন?

গণেশ বললে–তাঁকে নিজেকেই কে জল দেয় তার ঠিক নেই, তিনি আনবেন জল! তিনি নিজের হাতে কখনও জল গড়িয়ে খেয়েছেন? তাঁর নিজের জল-তেষ্টা পেয়েছে কি না তাই-ই বলে তিনি বুঝতে পারেন না কখনও।

কথাগুলো শুনে হাজারির বেশ মজা লাগলো। বললে–তাহলে মাস্টারি করতেন কী করে এখানে?

গণেশ বললে–ওই জন্যেই তো কর্তামশাই-এর ইস্কুলটা উঠে গেল।

–পড়াতে পারতেন না বুঝি?

–পড়াতে পারবেন না কেন? বড্ড ভালো মানুষ যে, তাই কেউ তাঁকে মানুষ বলেই মানতো না। একটু ভয়-ভক্তি না করলে কি ইস্কুল চালানো চলে? অত ভালো মানুষ বলেই তো বুড়ো কর্তামশাই ওঁকে অত ভালবাসতেন।

ভদ্রলোক বললে–তাহলে তো দেখছি মুশকিলে পড়া গেল–

গণেশ বললে–-মুশকিলে আর কেন পড়বেন, আমি জল এনে দিচ্ছি—

বলে গণেশ ভেতর দিকে কোথায় চলে গেল। দুপুর বেলা। সাধারণত এমন সময় সকলেরই একটু বিশ্রাম। সকাল থেকে কাজ চলতে চলতে দুপুর বেলাতে এসেই কাজের চাকা যা একটু থামে। তারপর বিকেল বেলা সেই যে শুরু হবে, তার শেষ হবে অনেক রাত্রে পৌঁছিয়ে। নবাবগঞ্জের বাড়িতেও ঠিক এমনি হতো। অথচ সংসার বলতে তো ওই তিনটে প্রাণী। নরনারায়ণ চৌধুরী, বাবা, মা আর ওই সদানন্দ। অনেকে নামটা ছোট করে দিয়ে ডাকতো–সদা।

চৌধুরী বাড়িতে নতুন বউ এসেছে। পালকী আসছে রেলবাজার থেকে। ট্রেন থেকে বর আর বউকে নামিয়ে তোলা হয়েছে পালকীতে। ছ’ ক্রোশ রাস্তা উঁচু-নিচু এবড়ো খেবড়ো মেঠো পথ।

চৌধুরী মশাই-এর শ্যালক ছিল সঙ্গে। সে-ই বর-বৌকে সঙ্গে করে আনছিল। তার সঙ্গে আসছিল নরনারায়ণ চৌধুরীর গোমস্তা, একেবারে সামনের পালকীতে। আর একেবারে সকলের সামনে-সামনে দীনু গোমস্তা আগে আগে চলেছে। কৈলাশ গোমস্তাকে লোকে দূর থেকে নমস্কার করছে। এক-একটা গ্রামে ঢোকে তারা আর গাঁয়ের বৌ-ঝি-ছেলে বুড়ো সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বলে–গোমস্তা মশাই, বউরাণীকে একবার দেখবো

কৈলাস গোমস্তা বলে–আরে না না, এখন না, কাল চৌধুরী বাড়িতে বউরাণীকে সাজিয়ে-গুজিয়ে দেখাবো তোদের

–ওমা, তা এখন কি সাজগোজ নেই?

–তা থাকবে না কেন? এখন সেই কেষ্টনগর থেকে রেলে চড়ে বৌ ঘেমে-নেয়ে আসছে, এখন কি কেউ দ্যাখে রে? কালকে সাজিয়ে-গুজিয়ে রাখবো বউমাকে তখন দেখিস–

এমনি সারা রাস্তা। সকলকে ঠাণ্ডা করতে করতেই কৈলাস গোমস্তা অস্থির।

পেছনের পালকীতে প্রকাশমামা মুখ বাড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো–একটু পা চালিয়ে পা চালিয়ে দীনু—

যেন প্রকাশ মামারই বিয়ে। তার সাজগোজের বাহার বরকে পর্যন্ত হার মানিয়েছে। বিয়ের উৎসবের ক’দিন ধরে তার খাটুনিরও যেমন শেষ নেই, আবার উৎসাহেরও তেমনি কামাই নেই।

হইচই করতে করতে বর-বৌ নবাবগঞ্জের চৌধুরীবাড়ির উঠোনে এসে ঢুকলো। গ্রাম ঝেটিয়ে লোকজন এসে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে।

কৈলাস গোমস্তা মার মার করে উঠলো-সরো গো, সরো সবাই, সরো। বৌ-এর দম আটকে আসবে সরো, ভেতরে হাওয়া ঢুকতে দাও–

প্রকাশ মামাও কম যায় না। কোঁচানো ধুতি আর ঢিলে পাঞ্জাবি নিয়ে হিমশিম্ খেয়ে যাচ্ছে। সে–ও বলে উঠলো–যাও, যাও, যাও, ওদিকে যাও ভাই সব, এদিকে ভিড় নয়, এদিকে ভিড় নয়–

গৌরী পিসীর আর তর সইলো না। সে কারো মানা শুনবে না। একেবারে দৌড়ে এসে পালকীর দরজার সামনে নিচু হয়ে বৌ-এর ঘোমটা তুলে মুখখানা দেখলে।

নয়নতারাও চমকে গেছে। এ আবার কে? শাশুড়ী নাকি?

বউ দেখে গৌরী পিসীর খুশীর আর শেষ নেই। গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো– ওলো, জোরে জোরে উলু দে, জোরে জোরে উলু দে তোরা

সত্যিই নয়নতারার রূপের বাহার দেখে গাঁ-সুদ্ধ লোক অবাক। এমন রূপও হয় নাকি! দোতলার ঘরে নরনারায়ণ চৌধুরী তখন পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর প্রথম নাত বৌ বাড়িতে এসেছে। তাঁকেই প্রথমে প্রণাম করতে হবে।

–চলো বৌমা, তোমার কর্তাবাবুকে আগে পেন্নাম করবে চলো—

নরনারায়ণ চৌধুরীর বহুদিনের সাধ পূর্ণ হতে চলেছে তখন। অনেক অভিশাপ তিনি কুড়িয়েছেন! এবার যাবার সময় নাত-বৌ-এর মুখ দেখতে পেলেন। এবার তাঁর বংশের ধারা আবহমান কাল ধরে চলুক। বংশপরম্পরায় নবাবগঞ্জের চৌধুরী বংশের গৌরব আরো বৃদ্ধি হোক। অনাগত কালের মানুষ বলুক–এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা নরনারায়ণ চৌধুরী মানুষের সমাজে সত্যিই ছিলেন এক নরনারায়ণ। তিনি ছিলেন দানবীর, কর্মবীর, দেবদ্বিজে ভক্তিপরায়ণ, মহাপুরুষ! এই তাঁর পৌত্র, এই সদানন্দ চৌধুরীরই একদিন সন্তান হবে, সেই সন্তানেরও আবার একদিন সন্তান হবে। এমনি করে সন্তানের পর সন্তানের জন্ম হয়ে শাখা প্রশাখা বিস্তার করে পুরুষানুক্রমে তাদের বংশাবলীর মধ্যে দিয়েই তিনি চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন। এ বয়সে এই পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় এই-ই তাঁর একমাত্র কামনা, এই-ই তাঁর একমাত্র সান্ত্বনা–এই-ই তাঁর একমাত্র সুখ!

হঠাৎ কৈলাস গোমস্তা এসে খবর দিলে কর্তাবাবু,–কালীগঞ্জের বৌ এসেছে–

–কে?

–আজ্ঞে কালীগঞ্জের বৌ!

–তা কালীগঞ্জের বৌ হঠাৎ আজকে এল কেন? তাকে কি তোমরা নেমন্তন্ন করেছিলে?

–আজ্ঞে, সে কী কথা! তাকে নেমন্তন্ন করতে যাবো কেন? আপনি তো তাকে নেমন্তন্ন করতে বারণ করেছিলেন?

–তাহলে খবর পেলে কী করে যে আজকে আমার নাতির বিয়ে?

–তা জানি নে, তবে নতুন বউয়ের মুখ দেখবার জন্যে একখানা শাড়ি আর এক হাঁড়ি মিষ্টিও এনেছে। নতুন বউ-এর মুখ দেখতে চাইছে–

সমস্ত বাড়িময় খন উৎসবের আবহাওয়া। খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের লুচি ভাজার গন্ধে বাড়ি তখন একেবারে ম-ম করছে। আত্মীয়-কুটুম এসে গেছে দূর দূর থেকে। এমন সময় কি না কালীগঞ্জের বউকে এ বাড়িতে আসতে হয়!

নরনারায়ণ চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন–বংশী ঢালী কোথায়?

–ডেকে দেব?

–ডেকে দাও, আর দেখো যেন আমার ঘরের কাছে এখন কেউ না আসে, দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকবে। যাও–

তা বংশী ঢালী এল। কর্তাবাবুর বাড়ির বিয়েতে সে পরনের কাপড়খানা রঙীন করে ছাপিয়েছে। মাথার চুলগুলো তেল-চকচকে করে আঁচড়ে নিয়ে বাহার করেছে।

সামনে এসে দাঁড়াতেই কর্তাবাবু কৈলাস গোমস্তার দিকে চেয়ে বললেন কালীগঞ্জের বৌ যা-কিছু এনেছে, সন্দেশ শাড়ি সব নেবে, খুব খাতির করে নেবে। বুঝলে?

–বৌ দেখাবো?

–হ্যাঁ। আর দেখ, খাতিরের যেন কমতি না হয়, যেমন করে বাড়ির আত্মীয়-কুটুমদের খাতির করা নিয়ম, কালীগঞ্জের বৌকেও ঠিক তেমনি করে খাতির-যত্ন করবে। যেন কোথাও কোনও ত্রুটি না থাকে। বুঝলে?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

–তাহলে তুমি এখন যাও, গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকো, দেখবে যেন এদিকে কেউ না আসে–

কৈলাস গোমস্তা চলে যেতেই কর্তাবাবু চাইলেন বংশী ঢালীর দিকে। বললেন– বংশী, আগে তুই তো আমার ইজ্জত অনেকবার বাঁচিয়েছি। আর একবার বাঁচাতে পারবি?

–হ্যাঁ হুজুর, আপনি যখন যা বলবেন তাই করবো। বলুন, কার ঘাড় থেকে কটা মাথা নিতে হবে–

কর্তাবাবু বললেন–তাহলে ঘরে ঢোকবার দরজাটা বন্ধ করে দে, তোকে আজ একটা কাজের ভার দেব–

বংশী ঢালী দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে হুড়কো লাগিয়ে দিলে। আর সঙ্গে সঙ্গে নবাবগঞ্জের চৌধুরী বংশের ঝাড়-লণ্ঠনের সব বাতি যেন এক ফুৎকারে নিবে গিয়ে দিকবিদিক একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল। কর্তা নরনারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র পৌত্র, ছেলে হরনারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র পুত্র সদানন্দ চৌধুরী তখন উৎসব-অনুষ্ঠানের জাঁকজমকের ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে একেবারে দূরে সরে এসেছে। একদিন আগে কেষ্টনগরের একটা বাড়িতে একটা অচেনা মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ের সম্প্রদান হয়েছে, নিমন্ত্রিত অতিথি-অভ্যাগতরা ভুরিভোজে পরিতৃপ্তির উদ্গার তুলতে তুলতে যে যার বাড়িতে চলে গেছে। বাসরঘরের চার-দেয়ালের মধ্যে সে নববধূর মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখেছে। ভেবেছে এ কাকে সে বধূ করে নিয়ে চলেছে তার বাড়িতে! এ–ও কি সংসারের আর পাঁচজন মানুষের মত যান্ত্রিক মানসিকতার একটা অতি সাধারণ প্রতীক! এ–ও কি কলের পুতুলের মত সুতো টানলে হাত পা নাথা নাড়াবে, কল টিপলে খাবে ঘুমোবে আর যান্ত্রিক নিয়মে কেবল সন্তানের জন্ম দিয়ে চৌধুরী বংশের লোকসংখা বাড়িয়ে যাবে!

সেদিন কালরাত্রি। গ্রামের লোক সবাই বৌ দেখে দলে দলে যে যার বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে। সদানন্দ অন্ধকার বারবাড়ির উঠানের পাশ দিয়ে চণ্ডীমণ্ডপের দিকে যচ্ছিল। জায়গাটা বড় নিরিবিলি নির্জন। হঠাৎ মনে হলো সামনের চণ্ডীমণ্ডপের পেছনে চোর-কুঠুরির ভেতর থেকে কে যেন হঠাৎ একটা আর্তনাদ করে উঠলো—আঃ–

একটা মেয়েলী গলার চাপা আর্তনাদ। কিন্তু আর্তনাদটা একবার গলা ছিঁড়ে বার হবার পরেই যেন আবার হঠাৎ মাঝখানে বন্ধ হয়ে গেল। মনে হলো কে যেন কার গলা টিপে ধরেছে।

সদানন্দ খানিকক্ষণ হতবাক হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর চোর কুঠুরিটা থেকে একটা ধস্তাধস্তির আওয়াজ আসতেই তার যেন কেমন সন্দেহ হলো। সদানন্দ চোর কুঠুরির দিকে দৌড়ে যেতেই দেখলে সামনে অন্ধকারের মধ্যে থেকে কে একজন বেরিয়ে আসছে।

সদানন্দ চিনতে পারলে না লোকটাকে। বললে–কে? কে তুই? কে? কে কেঁদে উঠলো চোরকুঠুরির ভেতরে?

প্রথমে কেউই উত্তর দিলে না। চারদিকে অন্ধকার। ওদিকে বিয়েবাড়ির আলোয় পশ্চিম দিকটা ঝলমল করছে। পূর্ব-উত্তর কোণাকুণি দিকটাতেই অন্ধকার বেশি। চণ্ডীমণ্ডপটা পূবদিক-ঘেঁষা। নরনারায়ণ চৌধুরী যখন নবাবগঞ্জে জমিদারি পত্তন করেছিলেন তখন হাতে অনেক কাঁচা টাকা আসতে লাগলো। কিন্তু টাকা এলে কী হবে, মানুষটার ব্যবহার সেই আগেকার মতই রয়ে গেল। এককালে যখন কালীগঞ্জে গোমস্তার কাজ করেছেন, তখনও যেমন, আবার জমিদারি পত্তনের পরও তেমনি। এই নবাবগঞ্জ একদিন কালীগঞ্জের পত্তনির মধ্যেই ছিলো। তখন নরনারায়ণ চৌধুরী এইখানে বসে একটা একতলা বাড়ির বৈঠকখানার মধ্যে গোমস্তাগিরি করতেন। কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে নবাবগঞ্জের সেই একতলা বাড়িটার সামনে একটা বিরাট দুমহলা দোতলা বাড়ি উঠলো। তখন আগেকার সেই একতলা বাড়িটা হয়ে গেল চণ্ডীমণ্ডপ। আর তার আধখানায় কাজ চলতে লাগলো চণ্ডীমণ্ডপের। আর বাকিখানায় হলো চোর কুঠুরি। সে সিকিখানা প্রায়ই ব্যবহার হতো না। বছরের বেশির ভাগ সময় তার দরজায় তালা-চাবি দেওয়া পড়ে থাকতো। একটা ঝাঁকড়া-মাথা গাব গাছ সে ঘরখানাকে দিনের বেলায় অন্ধকার করে রাখতো। আর রাত্তিরে তার চেহারা অন্ধকারের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যেত।

লোকটা তখন সামনে এসে পড়েছে একবারে।

সদানন্দ মুখখানা একবার লোকটার মুখের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।

বললে–কে? কে রে তুই? কথা বলছিস না কেন?

–আজ্ঞে আমি!

এবার গলার আওয়াজে চিনতে পারলে সদানন্দ। বংশী ঢালী।

–বংশী ঢালী?

–আজ্ঞে হ্যাঁ খোকাবাবু।

–তা তুই এই অন্ধকারে এখানে একলা কী করছিস? খেয়েছিস?

বংশী ঢালী বললে–কাঁচা-ফলার খেইচি, একটু পরে পাকা-ফলার খাবো।

তা বটে। কর্তাবাবুর বাড়ির কাজ, সবাই তিন-চারদিন ধরে চারবার পেটভরে খাবে। এটাই রেওয়াজ। জমি-জমার দখল নিয়ে যখন কোথাও কোনও গণ্ডগোল বাধে তখন বংশী ঢালীরই ডিউটি পড়ে। বদমাইশ প্রজাকে ঢিট করতেও বংশী ঢালীর ডিউটি পড়ে।

–তা পাকা-ফলারের পাতা তো পড়েছে, খেতে যা–

সে কথার উত্তর না দিয়ে বংশী ঢালী অন্য কথায় চলে গেল। এক গাল হাসি হেসে বলল–আপনার বৌ খুব সোন্দর হয়েছে খোকাবাবু, একেবারে মা-দুর্গার মত–

কিন্তু বংশী ঢালীর হাসিতে সদানন্দর মন ভুললো না। বললে–তা হবে, তুই আগে খেয়ে নিগে যা—

বংশী ঢালী চলে গেল বটে, কিন্তু সদানন্দর মনের সন্দেহ গেল না। বংশী ঢালী যেতেই সদানন্দ চোর কুঠুরিটার দিকে আরো এগিয়ে গেল। বাইরে থেকে এ দরজায় তালা ঝুলছে তখনও। তাহলে আর্তনাদটা কোন্ দিক থেকে এলো? কে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো?

মানুষের ইতিহাসে এই রকম করে কতবার কত বংশী ঢালী নিঃশব্দে কত জমিদারের চোর কুঠুরিতে ঢুকেছে, আর নিষ্কলুষ মুখোশ নিয়ে কতবার চোর-কুঠুরির বাইরে বেরিয়ে এসেছে তা কোনও ভাষার ইতিহাসে লেখা থাকতে নেই। কিন্তু হিসেবের কড়ি বাঘে খেয়েছে। এমন কথা যেমন কোথাও লেখা থাকে না, আসল আসামী ধরা পড়েছে এমন নজিরও কোনও আদালতের নথিপত্রে নেই। কারণ আসল আসামীরা ধরা পড়ে না। নকল আসামীদের সামনে এগিয়ে দিয়ে আসল আসামীরা বরাবরই আড়ালে লুকিয়ে থাকে। তাদের কোনও শাস্তি হতে নেই। তারা রায় বাহাদুর হয়, রায়সাহেব হয়, তারা পদ্মশ্রী পদ্মভূষণ হয়, তারা শ্বেতপাথরের মূর্তি হয়ে বাস্তার মোড়ে মোড়ে শহরের শোভা বাড়ায়। কবে একদিন হয়ত নবাবগঞ্জের নরনারায়ণ চৌধুরীও এমনি শোভা হয়ে উঠতো, রায় বাহাদুর হতো, রায়সাহেব হতো, পদ্মভূষণ হতো, পদ্মশ্রী হতো। এ-যুগে জন্মালে তা হবার চেষ্টাও হয়ত করতো। কিন্তু অদৃষ্ট-দেবতার কোন্ এক দুর্লঙ্ঘ্য আইনে আসামী একদিন হঠাৎ ধরা পড়লো। আর ধরা পড়লো বলেই রাত জেগে জেগে তার বংশধরকে নিয়ে এই উপন্যাস লেখবার প্রয়োজন আজকে আমার পক্ষে অনিবার্য হয়ে উঠলো।

কিন্তু সন্দেহটা দৃঢ় হলো আরো অনেক পরে। উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে ঘুরে আবার পূর্বদিকে ভেতর-বাড়িতে আসবার কথা। কাল এই সারা বাড়ি অতিথি-অভ্যাগতে ভরে উঠবে। গতকাল থেকেই ভিড় শুরু হয়েছে। মাঝখানে একটা দিন শুধু কালরাত্রি। তারপরেই ফুলশয্যা।

গৌরী পিসী হঠাৎ সদানন্দকে দেখতে পেয়েছে। বললে—হ্যাঁ রে, তুই এখানে, আর ওদিকে যে সবাই তোকে খুঁজছে বাবা! রাত-বিরেতে অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন? গাব গাছের তলায় কী করছিলি?

ওদিকে দোতলায় ছেলে হরনারায়ণ কর্তাবাবুর কাছে দাঁড়িয়ে ছিল।

বাবাকে জিজ্ঞেস করলে–বৌমা কেমন দেখলেন?

কর্তাবাবু বললেন–ওসব কথা এখন থাক, তোমার নতুন বেয়াই-বেয়ানকে আনতে যাবে কে?

ছেলে বললে–প্রকাশকে বলেছি।

–প্রকাশ? প্রকাশ কে?

–আমার সম্বন্ধী।

–তোমার সম্বন্ধী! তোমার সম্বন্ধী আবার কবে হলো? তোমার তো সম্বন্ধী ছিল না, বৌমা তো বেয়াই-এর একই সন্তান!

–-আজ্ঞে, আমার আপন সম্বন্ধী নয়, আপনার বৌমার মামার ছেলে। আপনার বৌমার মামাতো ভাই—

–ও–

যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন কর্তাবাবু। ছেলের সম্বন্ধীর কথা শুনেই চমকে উঠেছিলেন। তা চমকে ওঠবারই কথা। এত ভেবে-চিন্তে তিনি ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন, মাত্র একটা উদ্দেশ্য নিয়েই। উদ্দেশ্যটা হলো বাড়িতে শুধু যেন বউই না আসে। তার সঙ্গে যেন রাজত্বও আসে। না, অর্ধেক রাজত্ব কথাটা ভুল। কর্তাবাবু যখন ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন, তখন এটা জেনেশুনেই দিয়েছিলেন যে ছেলে একদিন শ্বশুরের সমস্ত সম্পত্তি পাবে।

–চক্রবর্তী মশাই কখন আসছে?

–কাল সকালে আসবার কথা। রজব আলীকে বলেছি রেলবাজারে গাড়ি নিয়ে হাজির থাকতে–

ভাগলপুরে বউমার বাপের যে সম্পত্তি আছে তা কুড়িয়ে বাড়িয়ে পাঁচ-ছ’ লাখ টাকার মতন। তার ওপর কর্তাবাবুর নবাবগঞ্জের নিজের সম্পত্তি। একুনে সব মিলিয়ে আরো কয়েক লাখ। তিনি যখন এ সংসার থেকে বিদায় নেবেন তখন এই ভেবেই নিশ্চিন্ত হয়ে যাবেন যে তার বংশধারা আর তার বংশের ঐশ্বর্য যাবচ্চন্দ্রদিবাকরৌ অক্ষয় অব্যয় অম্লান হয়ে বিরাজ করবে। তারপর যখন তার ছেলেও আর থাকবে না, তখন নাতি থাকবে। সেই নাতিই নরনারায়ণ চৌধুরীর বংশের জয়ধ্বজা চিরকাল আকাশে উঁচু করে তুলে রাখবে।

তা দোতলার একটা ঘরের মধ্যে পঙ্গু হয়ে পড়ে থাকলে কী হবে, তার নজর কিন্তু সব দিকে। একদিন এক জমিদার বাড়িতে সামান্য গোমস্তার কাজ করে প্রথম জীবন কাটিয়েছেন। তখন থেকেই বুঝেছেন কাকে বলে পয়সা। পয়সার যে কী মূল্য তা তখন থেকেই চিনতে শিখেছিলেন তিনি। তখনই বুঝেছিলেন যে প্রচুর পয়সার মালিক না হলে আর বেঁচে থেকে কোনও সুখ নেই। তাই তখন থেকেই পয়সার সাধনাতেই মন দিলেন তিনি। এমন করে মন দিলেন যে লোকে বুঝতে পারলো যে হ্যাঁ সাধক বটে। শেষে একদিন যখন সিদ্ধিলাভ করলেন তখনই পেছনে লাগলো শনি। অত পয়সা করেও তার শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। যখন পয়সার পাহাড়ের ওপর বসে আছেন, যখন আত্মীয়-স্বজন, পাইক লাঠিয়াল বরকন্দাজ নিয়ে নবাবগঞ্জের সকলের মাথায় উঠেছেন তখনও মনে শান্তি নেই। হঠাৎ বলা-নেই কওয়া-নেই, একদিন দীনু কাছে এসে দাঁড়ায়। তার মুখের চেহারা দেখেই কর্তাবাবু বুঝতে পারেন কী হয়েছে।

তবু জিজ্ঞেস করেন–কী রে, কী হয়েছে?

দীনু মুখ নিচু করে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলে–আজ্ঞে আবার কালীগঞ্জের বৌ এসেছে–

রেগে যেতেন কর্তাবাবু। গলা চড়িয়ে বলতেন–তা বলা-নেই কওয়া-নেই ওমনি হুট করে এলেই হলো? হঠাৎ আবার এলো কেন? আমি টাকা কোথায় পাবো? আমার কি টাকার গাছ আছে? আমি টাকার চাষ করি? আমি এখন কী করব? তুই গিয়ে কালীগঞ্জের বউকে বল এখন দেখা হবে না–আমার শরীর ভালো নেই–

দীনু বলতো–আজ্ঞে আমি যে বলেছি আপনি ভালো আছেন!

–কেন বললি ভালো আছি? আমি ভালো আছি না খারাপ আছি তুই জানলি কী করে? তুই কি আমায় জিজ্ঞেস করেছিলি?

বুড়ো মানুষ দীনু লোকটা। ফাইফরমাশ খাটাই তার কাজ। সে এত মতলব-ধান্দা ফন্দি ফিকির কিছু বোঝে না।

বললে–না আজ্ঞে, আপনাকে তা জিজ্ঞেস করিনি–

–তাহলে! তাহলে কী করে বুঝলি যে আমার শরীর ভালো আছে?

–আজ্ঞে আমার ভুল হয়েছিল। আমি সেই কথা গিয়ে বলে আসি যে আমার ভুল হয়েছিল। কর্তাবাবুর শরীর ভালো নেই। তার সঙ্গে এখন দেখা হবে না–

–হ্যাঁ, তাই বলে আয়।

দীনু চলে যাচ্ছিল। কর্তাবাবুর আবার কী মনে হলো। ডাকলেন। বললেন–দীনু, শোন্‌, ওকথা বলতে হবে না, তুই বরং তাকে ডেকেই নিয়ে আয়–

এমনি কতবার। কোথায় সেই ইছামতী পেরিয়ে কালীগঞ্জ। আর কোথায় এই নবাবগঞ্জ। পাকা প্রায় পঁচিশ ক্রোশ রাস্তা। তা মধ্যে আবার ইছামতী। কথায় বলে একা নদী বিশ ক্রোশ। এই এতখানি রাস্তা ঠেঙিয়ে আসতো সেই কালীগঞ্জের বৌ। আর এসেই সেই টাকা! টাকার তাগাদা। যেন কর্তাবাবুর কানে স্মরণ করিয়ে দিতে আসতো যে তুমি জমিদারই হও আর যে-ই হও আসলে তুমি আমার অনুগত কর্মচারী। আমার ভৃত্য।

আর সদা এসে ঠিক তখনই দাঁড়াত সেখানে। তখন খুব ছোট সে। পাশের সিন্দুকটা খুলতেই সে দেখতে পেতো ভেতরে কত সোনা, কত মোহর, কত টাকা, কত নোট! দেখতে দেখতে সেই ছোটবেলাতেই সদানন্দর চোখ দুটো পাথর হয়ে যেতো। যত লোক আসে দাদুর কাছে, তাদের সকলের যথাসর্বস্ব এনে ওইখানে ঢেলে দিত। সে সব জমা হয়ে ক্রমে ক্রমে দাদুর সিন্দুকের ভেতরে পাহাড় হয়ে যেত। আর দাদু তত বলতো আমার টাকা কোথায়? টাকা কোথায় আমার? আমার কি টাকার গাছ আছে? আমি কি টাকার চাষ করি?

কালীগঞ্জের বৌ বলতো কিন্তু আমার যে পাওনা টাকা নারায়ণ!

–তা পাওনা টাকা বললেই কি হুট বলতে টাকা দিতে হবে?

–কিন্তু তুমি যে আমাকে আসতে বলেছিলে আজ?

–তখন আসতে বলেছিলুম, ভেবেছিলুম টাকা থাকবে আমার কাছে। কিন্তু এখন দেখছি টাকা নেই আমার।

হঠাৎ পাশ থেকে সদানন্দ বলে উঠলো–না দাদু, তোমার টাকা আছে, আমি দেখেছি তোমার সিন্দুকের ভেতর যে অনেক টাকা আছে–

কর্তাবাবু হঠাৎ পাশের দিকে নজর দিয়ে দেখেন নাতিটা কোন ফাঁকে সেখানে এসে বসে বসে এতক্ষণ তাদের কথা শুনছিল।

বললেন–ওরে, ও দীনু, কোথায় গেলি তুই, ও দীনু, একে এখানে আসতে দিলি কেন? ও দীনু,–

দীনু তাড়াতাড়ি ভেতরে এসে সদাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেত। কিন্তু সদা যেতে চাইত না, দীনুর টানাটানিতে ঘর থেকে যেতে যেতেও চীৎকার করে বলতো তুমি মিথ্যে কথা বলছো দাদু, তুমি মিথ্যেবাদী–তুমি মিথ্যেবাদী–তোমার অনেক টাকা আছে–

তারপর একসময় কালীগঞ্জের বৌ আবার যেমন এসেছিল তেমনি চলে যেত।

সদানন্দ পালকীটার পেছন পেছন ছুটতো–ও কালীগঞ্জের বৌ, কালীগঞ্জের বৌ, আমার দাদু মিথ্যেবাদী, দাদু তোমায় মিথ্যে কথা বলেছে, দাদুর অনেক টাকা আছে, সিন্দুকের ভেতর দাদুর অনেক টাকা আছে–আমি দেখেছি।

কিন্তু ছুটতে ছুটতে বেশি দূর এগোতে পারতো না। দীনু এসে সদাকে ধরে নিয়ে অন্দরমহলে চলে যেত। আর পালকীটা রাস্তায় নেমে খেয়াঘাটের দিকে এগিয়ে চলতো। তারপর খেয়া পেরিয়ে পঁচিশ ক্রোশ দূরে একেবারে সোজা কালীগঞ্জ—

এসব অনেক দিন আগেকার কথা। তারপর মাইনর ইস্কুল থেকে পাশ করে সদানন্দ কেষ্টগঞ্জের রেলবাজারের ইস্কুলে পড়তে গেছে। সে ইস্কুল থেকে পাসও করেছে। তারপর কলেজ। কলেজ থেকে বিএ পাস করেছে। তারপরে তার বিয়ে। এ সেই বিয়ের পরের দিনেরই কাণ্ড।

গৌরী পিসী বললে–সবাই ওদিকে আনন্দ করছে, বাড়িতে নতুন বৌ এসেছে, আর তুই কি না এখানে অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছিস–আয় আয় এদিকে আয়–

বলে সদানন্দকে টানতে টানতে ভেতর বাড়ির উঠোনের দিকে নিয়ে চললো। তখন সত্যিই সেখানে যজ্ঞি বাড়ির ধুম চলেছে। আলোয় আলো হয়ে গেছে জায়গাটা। পাকা ফলার খেতে বসেছে এ-গ্রাম সে-গ্রামের মুনিষরা। তাদেরই তো আসল আনন্দ। কর্তাবাবুর একমাত্র নাতির বিয়ে তো তাদেরই উৎসব। তারা ক’দিন ধরেই খাবে। তাদের নিজেদের বাড়িতে রান্না-খাওয়ার পাট আজ কদিন ধরে বন্ধ থাকবে। সকাল বেলা খাবে আবার রাত্তিরেও খাবে। প্রকাশমামা নিজে দই-এর হাঁড়ি নিয়ে সবাইকে দই দিচ্ছে। কাঁধে তোয়ালে কোমরে গামছা। মুখে খই ফুটছে। বলছে–খা খা খা, পেটভরে খা সবাই–

হঠাৎ সদানন্দর দিকে নজর পড়তেই বলে উঠলো–আরে, এ কী হয়েছে? রক্ত কীসের? রক্ত কেন তোর গেঞ্জিতে?

–রক্ত!

আরো সবাই চেয়ে দেখলে সেদিকে। বললে–সত্যিই তো, রক্ত এল কোত্থেকে? এত রক্ত?

সদানন্দও চেয়ে দেখলে তার গেঞ্জিতে সত্যিই রক্ত লেগে রয়েছে। এত রক্ত এল কোত্থেকে? তার হাতেও রক্ত।

গৌরী পিসীও এতক্ষণে নজর করে দেখলে–এ কী রে, কীসের রক্ত?

হঠাৎ যেন চারদিক থেকে প্রশ্ন উঠলো রক্ত! এ কীসের রক্ত! আকাশ-বাতাস-অন্তরীক্ষ সব জায়গা থেকে একসঙ্গে ঝড়ের মত প্রশ্ন আসতে লাগলো রক্ত, রক্ত! দোতলা থেকে নরনারায়ণ চৌধুরী প্রশ্ন করলেন–রক্ত! রক্ত! হরনারায়ণ চৌধুরীও পাশে এসে দাঁড়িয়ে দেখলেন। বললেন–আরে, এত রক্ত এল কোত্থেকে? দীনু দৌড়ে এল–এ কী খোকাবাবু, এ কীসের রক্ত? কৈলাস গোমস্তাও ভাল করে নজর করে দেখলে–তাই তো, রক্ত কীসের? রজব আলী পাকা-ফলার খাচ্ছিল একমনে। সেও বলে উঠলো–রক্ত! সদানন্দর অতীত জিজ্ঞেস করলে–রক্ত! সদানন্দর বর্তমান জিজ্ঞেস করলে–রক্ত! সদানন্দর ভবিষ্যৎ জিজ্ঞেস করলে রক্ত! সদানন্দর শিক্ষা-দীক্ষা-অস্তিত্বও প্রশ্ন করলে রক্ত! ইতিহাস ভূগোল সমাজ–সমস্ত ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ, অধস্তন উত্তরপুরুষ একযোগে সবাই প্রশ্নের ঝড় বইয়ে দিলে–রক্ত রক্ত রক্ত!!!

গণেশ হঠাৎ মাস্টার মশাইকে দেখতে পেয়েছে।

–আরে মাস্টার মশাই, আপনি এখেনে? আর ইনি আপনার জন্যে ভেবে ভেবে অস্থির! আপনি এঁকে ঘরে বসিয়ে রেখে এসেছেন–

সদানন্দ হাজারি বেলিফের দিকে চাইলেন। এতক্ষণে যেন সব মনে পড়লো আবার।

বললেন–আমি আপনার জন্যে জল আনতে এসেছিলুম, কিন্তু গেলাস খুঁজে পাচ্ছিলুম না–

গণেশ বললে–আপনি গেলাস খুঁজে পাবেন কী করে? আপনি কি কখনও নিজের হাতে জল গড়িয়ে খেয়েছেন? যান, আপনি ঘরে যান, আমি জল এনে দিচ্ছি–

যে-গেলাস খুঁজতে সদানন্দবাবুর রাত পুইয়ে গিয়েছিল, সেই গেলাস খুঁজে জল এনে দিতে গণেশের এক মিনিটও লাগলো না।

জল খেয়ে হাজারি যেন একটু ঠাণ্ডা হলো। বললে–যাক্ গে, এবার আর দেরি নয়। মশাই, চলুন। এখন পাঁচ ক্রোশ রাস্তা হাঁটতে হবে, বেলাবেলি বেরিয়ে পড়ুন–

সদানন্দবাবু বললেন–আজকেই যেতে হবে?

হাজারি বেলিফ বললে–তা যেতে হবে না? আপনার নামে হুলিয়া রয়েছে আমার কাছে আজ পনেরো বছর ধরে আর আপনি বলছেন আজকেই যেতে হবে কিনা? শেষকালে হাকিমকে খবর দিলে যে আপনার হাতে হাতকড়া লাগিয়ে নিয়ে যাবে তারা। তখন কি ভালো দেখাবে? তার চেয়ে ভালোয়-ভালোয় আমার সঙ্গে চলুন, বেশী ঝামেলা হবে না। আমি বাজে ঝামেলা পছন্দ করি না–

সদানন্দবাবু বললেন–কিন্তু আমি কী অপরাধ করেছি যে আমার নামে হুলিয়া বেরিয়েছে? বাদী কে?

হাজারি বললে–বাদী কে আবার, পুলিস।

–আর আমার অপরাধ?

হাজারি বললে–অপরাধ? অপরাধের কথা বলছেন? হরনারায়ণ চৌধুরীর নাম শুনেছেন?

–হ্যাঁ, তিনি তো আমার বাবা!

–আপনি তাকে খুন করেন নি?

–খুন? আমি? আমি আমার বাবাকে খুন করেছি?

–হ্যাঁ মশাই, হ্যাঁ, আর শুধু কি তাই? আপনি আট লাখ টাকা তহবিল তছরূপ করেছেন, তারও প্রমাণ আছে কোর্টের কাছে–

–আট লাখ টাকার তহবিল তছরূপ? বলছেন কী আপনি?

–আর নয়নতারা? নয়নতারাকে চেনেন?

–হ্যাঁ।

হাজারি বেলিফ বললে–তার সব্বোনাশ কে করেছে?

–তার সব্বোনাশ হয়েছে! কে সব্বোনাশ করেছে তার? কী সব্বোনাশ হয়েছে?

হাজারি বললে–আপনি ভালো মানুষ সেজে থাকলে কী হবে, এক গেলাস জল পর্যন্ত নিজে গড়িয়ে খেতে পারেন না, কিন্তু আপনার শয়তানি জানতে কোর্টের বাকি নেই মশাই। আজ পনেরো বছর ধরে আপনার নামে হুলিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আপনি এখানে সাধু সেজে লুকিয়ে বসে আছেন। কী কাণ্ড বলুন দিকিনি!

সদানন্দবাবু হতবাক হয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তার মুখ দিয়ে যেন আর কোনও কথা বেরোতে নেই।

বললেন–তাহলে আমি আসামী?

হাজারি বললে, আসামী না হলে আপনার নামে হুলিয়া বেরোল কেন? কই, আর কারো নামে তো হুলিয়া বেরোচ্ছে না! আপনি ভেবেছেন লুকিয়ে লুকিয়ে জল খাবেন আর কেউ তা জানতে পারবে না? তাহলে মশাই আর কোর্ট-কাছারির সৃষ্টি হয়েছে কেন? আর তা ছাড়া এখন হয়েছে কী! এখন তো সবে ‘মহড়া’–

–‘মহড়া’ মানে?

হাজারি বললে–কবির গান শোনেন নি? প্রথমে ‘মহড়া’ দিয়ে শুরু হবে, তারপরেই ‘চিতেন’। ওই ‘চিতেনে’ই তো যত মজা। তারপর ‘পর-চিতেন’, তাতে আরো মজা। তারপরে সকলের শেষে আছে ‘অন্তরা’। এখন নিচের ছোট কোর্টে শুরু হবে মামলা, তারপরে যখন সেই মামলা বড়-আদালতে যাবে তখনই তো মজা।

সদানন্দবাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন–একটা কথা রাখবেন আমার?

–কী কথা!

–আমাকে দু-চারদিন সময় দেবেন?

–দু’চারদিন?

–হ্যাঁ, আমি দেখে আসবো একবার সুলতানপুরে গিয়ে যে সত্যিই আমি হরনারায়ণ চৌধুরীকে খুন করেছি কি না। দেখে আসবো আমি আট লাখ টাকা তছরূপ করেছি কি না। তারপর একবার যাবো নবাবগঞ্জে। আর নয়নতারার কথা বললেন? কিন্তু আমি তো তার কোনও সর্বনাশ করিনি। আমি তো বরাবর তার ভালো করবারই চেষ্টা করেছি। তাকেও আমি একবার দেখতে যাবো নৈহাটিতে।

–আর আমি? আমি কি এখানে বসে ভ্যারেণ্ডা ভাজবো নাকি? আপনি যদি মশাই পালিয়ে যান? আপনাকে আর আমার বিশ্বাস নেই–

সদানন্দবাবু বললেন–পালালে তো আগেই পালাতে পারতুম হাজারিবাবু। আর এই তো আমি সংসার ছেড়ে চৌবেড়িয়াতে পালিয়ে এসেছি, কিন্তু জীবনের যন্ত্রণা থেকে কি রেহাই পেয়েছি? এও তো এক জেলখানা। এই জীবনই তো আমার কাছে জেলখানা। এই জেলখানা থেকে না-হয় আর একটা জেলখানাতে গিয়ে ঢুকবো। জেলখানাকে আমি ভয় করি না। কিন্তু আমি জানতে চাই আমি কী অন্যায় করেছি। বুঝতে চাই আমি কী পাপ করেছি। দেখতে চাই আমি কার কী ক্ষতি করেছি, কার কী সর্বনাশ করেছি! নিজের চোখে ভালো করে পরীক্ষা করতে চাই আমার এত চেষ্টা, এত অধ্যবসায়, এত ত্যাগ কেন এমন করে মিথ্যে হয়ে গেল, কে আমার সব ইচ্ছেকে এমন করে পণ্ড করে দিলে? এর কারণটা কী?

–আর আমি?

–আপনিও চলুন আমার সঙ্গে। আজ পনেরো বছর আমার পেছনে নষ্ট করেছেন, এবার আর দুটো দিন নষ্ট করতে পারবেন না?

সঙ্গে নেবার মত কিছুই ছিল না। তবু টুকিটাকি কিছু নিতে হলো। সদানন্দবাবু বেরোলেন। পেছনে ভদ্রলোকও সঙ্গে চলতে লাগলো। বললে–দুগ্যা, দুগ্যা, এ কী এক ঝামেলায় ফেললেন মশাই আমাকে, চলুন চলুন, পা চালিয়ে চলুন–

গণেশ দেখতে পেয়ে দৌড়ে এল।

বললে–কোথায় যাচ্ছেন মাস্টার মশাই? যাচ্ছেন কোথায়?

সদানন্দবাবু বললেন–হরি মুহুরি মশাইকে বলে দিও গণেশ যে দু’দিনের জন্যে আমি একটু বাইরে যাচ্ছি–

–দু’দিন পরে আবার আসছেন তো?

সদানন্দবাবু বললেন–তা কি বলা যায় কিছু! সারা জীবন এত হিসেব করে চলেও যখন একদিন সব হিসেব বেহিসেব হয়ে গেল তখন ঠিক করে কিছুই আর বলতে ভরসা হয় না। তবে এলে তো তোমরা দেখতেই পাবে–

বলে গঙ্গার ঘাটের দিকে পা বাড়িয়ে দিলেন। চলতে চলতে তার মনে হতে লাগলো যেন আকাশ বাতাস অন্তরীক্ষ সব একসঙ্গে ঝড়ের মত প্রশ্ন করে চলেছে–এ কীসের রক্ত! দোতলা থেকে নরনারায়ণ চৌধুরী প্রশ্ন করছেন, প্রশ্ন করছেন হরনারায়ণ চৌধুরী। প্রশ্ন করছে দীনু, কৈলাস গোমস্তা, গৌরী পিসী, রজব আলী, সবাই। সদানন্দবাবুর অতীত বর্তমান ভবিষ্যও যেন একই প্রশ্ন করে চলেছে। একই প্রশ্ন করে চলেছে সদানন্দবাবুর শিক্ষা-দীক্ষা অস্তিত্ব। প্রশ্ন করে চলেছে সদানন্দবাবুর ইতিহাস-ভূগোল-সমাজ। প্রশ্ন করে চলেছে। সদানন্দবাবুর ঊধ্বর্তন পূর্বপুরুষ, প্রশ্ন করে চলেছে সদানন্দবাবুর অধস্তন উত্তরপুরুষ। একযোগে সকলের প্রশ্ন সদানন্দবাবুর মনে ঝড় বইয়ে দিচ্ছে–এ কীসের রক্ত!

আর তাদের সকলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে যেন নয়নতারাও সদানন্দবাবুকে জিজ্ঞেস করে চলেছে–এ কীসের রক্ত!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18
Pages ( 1 of 18 ): 1 23 ... 18পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress