আয়নামহল (Aynamahal) : 04
পাঁচতলার এই ঘরটায় সকালবেলা জানলাগুলো সব খোলাই থাকে। শুধু সকালটুকুই। এই সময়টায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বন্ধ রাখতে বলে দিব্যজ্যোতি। সাগরসবুজ মোটা মোটা পরদাও সরিয়ে দেওয়া হয় দুপাশে। দিব্যি টাটকা আলো বাতাস খেলে ঘরে।
আজও, দিব্যজ্যোতির বাসনামতোই, ঘরে এখন এক টুকরো রোদ্দুর। দক্ষিণের জানলা গলে খব বেশি এগোয়নি, কোনওমতে গুটিগুটি এসে দাঁড়িয়েছে অন্দরে। মেঝেতেই থাকবে কিছুক্ষণ, তারপর কাঁচা হলুদ রং পিছু হটবে ক্রমশ।
রোদ্দুরটা দিব্যজ্যোতিকে চুম্বকের মতো টানছিল। নাকি রংটা? কারও ছবির কথা মনে পড়ছে কি? টার্নার? কনস্টেবল? সোরা? রংটাকে ছুঁয়ে দেখতে বড় সাধ জাগছিল দিব্যজ্যোতির। কিন্তু ওই রোদ তার বিছানা পর্যন্ত আসে কই, খানিক তফাতে থমকে যায় যে রোজ। যেন দিব্যজ্যোতিকে দেখতে পেয়েই তার গতি রুদ্ধ হল, এবার সে এক পা এক পা করে পিছোবে। দিব্যজ্যোতিকে একবার স্পর্শ করতেও কেন যে তার এত অনীহা?
রাতের নার্স মীনা সামনে এসেছে। শ্যামলা রং, ছোটখাটো রোগাসোগা চেহারা, খয়াটে মুখ, সিঁথিতে সিঁদুর জবজব করছে। সাদা ধবধবে পোশাক আর শুভ্র মস্তকাবরণীর সঙ্গে সিঁদুরটা বড্ড বেমানান। চোখে লাগে।
দিব্যজ্যোতির ভুরুতে ভাঁজ পড়ল। কেন যে এত সিঁদুর মাখে মেয়েটা? মনে হয় যেন ওই লালের পরিমাণের ওপরই নির্ভর করে আছে তার জীবনের সব সুখ শান্তি নিরাপত্তা! কী যে হাস্যকর সংস্কার! দিব্যজ্যোতির ভাল না-লাগায় অবশ্য মীনার কিছু যায় আসে না। অবলীলায় রোদটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে সে। কেজো সুরে বলল, কী হল, ব্রেকফাস্ট হবে না আজ?
ভুরুর ভাঁজ বাড়ল দিব্যজ্যোতির। তীব্র স্নায়বিক ঝাঁকুনিতে সাময়িকভাবে হারানো বাক্শক্তি ফিরে এলেও তার মুখ এখনও অল্প বেঁকে আছে, শব্দ উচ্চারণ পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। ঈষৎ স্খলিত স্বরে বলল, সরো তো, সামনে থেকে সরো।
কেন স্যার? কী হল?
আহা, সরো না। চলে যাবে যে।
থতমত খেয়ে দু’পা হটে গেল মীনা। ঘাড় ঘুরিয়ে জানলা দেখতে দেখতে বলল, কে চলে যাবে? কী চলে যাবে?
রোদ্দুর।
ও, তাই বলুন। আমি ভাবলাম, কী না কী!
মীনা হেসে ফেলল। টানা সাত দিন রাতডিউটি করে দিব্যজ্যোতিকে মোটামুটি চিনে ফেলেছে সে। লোকটা খুব একটা হেঁজিপেজি নয়, রীতিমতো সমীহ করে কথা বলে ডাক্তারবাবুরা। পেশেন্ট হিসেবে নির্ঝঞ্ঝাট, খাওয়াদাওয়া নিয়ে তেমন ঝামেলা নেই, অকারণে ডাকাডাকি করে না, তবু একটু খ্যাপাটে ধরনের। কড়া সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়ানো সত্ত্বেও ঠিক জেগে যায় কাকভোরে, কখন জানলার পরদা আর কাচ সরবে তার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। বেড থেকে বাড়িঘর ছাড়া কিছুই দেখা যায় না, তবু তাকিয়ে থাকা চাই। জিজ্ঞেস করলে বলে, অন্ধকারের পাতলা হওয়াটা দেখতে নাকি বেশ লাগে। আপন মনে গান গেয়েও ওঠে হঠাৎ হঠাৎ, জড়ানো গলায়। গানের তালে তালে অদ্ভুতভাবে দোলায় বাঁ হাতখানা। মনের জোর আছে খুব। বাঁ কাত ফিরে একা একাই উঠে বসতে চেষ্টা করে বিছানায়, ধরতে দেয় না, মানা করে। এক-এক সময়ে ভীষণ উদাস, কী যেন ভাবছে। দু’-চার হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মীনাকেও যেন দেখতে পায় না তখন। আবার কখনও বা যেচে রঙ্গরসিকতা করছে টুকটাক। কিংবা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানছে মীনার পরিবারের কথা। এমন পেশেন্টের সঙ্গে তো হালকা সুরে কথা বলাই যায়।
ভুরু নাচিয়ে মীনা জিজ্ঞেস করল, কী আছে বলুন তো ওই রোদ্দুরটায়?
নাথিং। এভিরিথিং।… তুমি বুঝবে না।
কী করে বুঝব? আমি তো আপনার মতো আর্টিস্ট নই। মীনা প্রেশার মাপার যন্ত্রখানা বিছানায় রাখল, একবার হাতটা দিন তো। ব্রেকফাস্টের আগে পালস প্রেশারটা একবার দেখে নিই।
মূর্তিমান রসভঙ্গ! দিব্যজ্যোতি বেজার মুখে বলল, বারেবারে এত মাপামাপির কী দরকার?
বা রে, দেখতে হবে না প্রেশার স্টেডি হল কি না! নইলে বাড়ি যেতে পারবেন না যে।
তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়েই বা হবেটা কী? এখানে কী এমন খারাপ আছি?
আহা, বাড়ি না গেলে ছবি আঁকবেন কী করে?
এবার দিব্যজ্যোতি হেসে ফেলেছে। হাসতে হাসতে সচল বাঁ হাতখানা বাড়িয়ে দিল, দ্যাখো।
কবজি টিপে নাড়ির গতি মাপছে মীনা। তিরিশ সেকেন্ড হতে না- হতেই ছেড়ে দিল হাত, পেশাদারি ক্ষিপ্রতায় ফেট্টি জড়াচ্ছে দিব্যজ্যোতির বাহুতে। কানে স্টেথো গুঁজল, ফসফস পাম্প করছে রবার বাল্ব।
দিব্যজ্যোতির আবার একবার মনে হল, মীনার সিঁথির লালটা বড্ড বেশি চড়া। ক্যাটক্যাট করছে। চোখ বুজে ফেলল দ্যিবজ্যোতি। বোজা চোখেই টের পেল মীনার কাজ শেষ, যন্ত্র গোছাচ্ছে।
চোখের পাতা অল্প ফাঁক করে দিব্যজ্যোতি প্রশ্ন করল, কেমন দেখলে?
মন্দ কী।
কত? প্রেশার?
বলার নিয়ম নেই। ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করবেন।
দিব্যজ্যোতি অবহেলাভরে বলল, দুর, ডাক্তার কী বলবে? আমি জানি কেমন আছি।
কেমন?
ডান সাইডের বখেড়াটা বাদ দিলে একদম ফিট। শরীর ফরির কিস্যু নয়, মনটাই আসল, বুঝলে। মন চাঙা, তো শরীর ভি চাঙা।… তুমি স্টিফেন হকিংয়ের নাম শুনেছ?
না।
তোমার জি কে খুব পুওর। হকিং একজন সায়েন্টিস্ট। ভেরি ভেরি ফেমাস। তার গোটা শরীরটাই অসুখে পঙ্গু হয়ে গেছে। ঘাড় হেলেই থাকে, লোয়ার পোরশন গন, স্পিচ নেই… কিন্তু তার মধ্যেই বিয়ে করেছে। বাচ্চাও হয়েছে। দিব্যজ্যোতি বাঁ চোখ টিপল, কী বুঝলে?
এই ধরনের রসিকতাও লোকটার মুখে আটকায় না। মীনা অতি কষ্টে হাসি চেপে বলল, আপনি কিন্তু আজকে একটু বেশি কথা বলছেন স্যার।
আমার কি কথা বলা বারণ?
তা নয়। স্ট্রেন তো হচ্ছে।
হোক। মুখের মাসলের এক্সারসাইজটা এখন খুব দরকার।… দাও, ব্রেকফাস্টটাও দাও। পরের এক্সারসাইজটাও শুরু করি।
মীনা উঠে খাবারের ট্রলি ঠেলে নিয়ে এল বিছানার পাশে। চাবি ঘুরিয়ে উঁচু করল খাটের মাথার দিকটা। বাঁ হাতের চেটোয় ভর দিয়ে দিব্যজ্যোতিও উঠল একটু ঘষটে ঘষটে। বুকের কাছে টেনে আনা টেবিল থেকে নিজেই চামচ দিয়ে খাবার তুলছে মুখে। অনভ্যস্ত হাত কাঁপছে মৃদু মৃদু, বেঁকে থাকা মুখে চামচ ঢোকাতে গিয়ে খানিকটা পরিজ গড়িয়ে পড়ল কষ বেয়ে। মীনা তাড়াতাড়ি মুছে দিতে যাচ্ছিল, চামচ নেড়ে তাকে বারণ করল দিব্যজ্যোতি। নিজেই ন্যাপকিনে মুছছে সযত্নে। আয়াস করে টোস্ট খেল, ধীরে ধীরে নুনবিহীন ডিমসেদ্ধও। চিবোতে এখনও বেশ কষ্ট, তবু দিব্যজ্যোতি ছাড়ার পাত্র নয়। আহার পর্ব যখন শেষ হল, দিব্যজ্যোতি কুলকুল ঘামছে।
খাবারের ট্রে সরিয়ে নিয়ে মীনা জিজ্ঞেস করল, এবার এ.সি-টা একটু চালিয়ে দিই?
শ্রান্তিতে চোখ জড়িয়ে আসছিল দিব্যজ্যোতির। বালিশে মাথা রেখে বলল, হুঁ।
.
প্রাতরাশের পর ঘণ্টাখানেক ঘুম, তারপর ডাক্তার। শারীর চিকিৎসা। স্নান। তারপর খবরের কাগজটা একটু উলটেপালটে দেখা। দ্বিপ্রাহরিক আহারের আগে পর্যন্ত মোটামুটি এই রুটিনেই চলে দিব্যজ্যোতি।
আজ খবরের কাগজে চোখ রেখে একটু ঢুলুনি মতন এসে গিয়েছিল, ঘোর ছিঁড়ল চেনা গলার ডাকে। কল্পনা।
আধশোওয়া দিব্যজ্যোতি অবাক হয়ে বলল, তুই!
প্লাস্টিক ব্যাগ থেকে একখানা টিফিন কেরিয়ার বার করে টেবিলে রাখল কল্পনা। শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে বলল, কাল রাতে এসেছি।
ফের সব ছেড়েছুড়ে চলে এলি?
সোনামাটিতে একদম মন টিকছে না গো, মামা। সারাক্ষণ বুকটা কেমন উথালপাথাল করে। তুমি হাসপাতালে পড়ে আছ ভাবলে আমার দেহটা কেমন ঠান্ডা হয়ে আসে গো।
দিব্যজ্যোতি অপ্রসন্ন মুখে বলল, যত্ত সব ঢঙের কথা। আমি কি ফুটপাথে আছি? নাকি এখানে আমার দেখাশোনার লোকের অভাব পড়েছে?
জানি, জানি। এখন আমার সেবা তোমার না-হলেও চলবে। ভ্রূকুটি হেনে টুল টেনে বসল কল্পনা। একই রকম খরখরে গলায় বলল, কিন্তু
আমার যে মন মানে না, মামা।
ফিরছিস কবে?
যাব গো, যাব। তুমি আগে বাড়ি এসো, খানিক থিতু হও…. আমিও দিদাকে হাতে হাতে একটু সামলে দিই…
দিনের নার্স ববিতা বাইরে গেছিল, এইমাত্র ফিরেছে ঘরে। টিফিন কেরিয়ারে চোখ যেতেই হাঁ হাঁ করে উঠল, এ কী, বাইরের খাবার এনেছেন কেন?
সমবয়সি রোগা, লম্বা, ফ্যাকাশে মুখ মেয়েটাকে সরু চোখে একবার জরিপ করল কল্পনা। গলায় আলাদা গাম্ভীর্য এনে বলল, বাইরের খাবার কেন হবে? মামার জন্য আমি নিজের হাতে বানিয়েছি।
কিন্তু আমাদের কিচেনের ফুড ছাড়া আমরা অ্যালাও করি না। নিউট্রিশনের একটা মাপ আছে… তা ছাড়া ওঁকে সল্টফ্রি ডায়েট খেতে হয়….
জানি। নুন কম দিয়েই রেঁধেছি। রোগীর পথ্যে এত এত মশলাও ঢালিনি।
তবু… আমাদের নিয়ম নেই। সামান্যতম নুন থাকলেও সে রান্না আমি ওঁকে দিতে পারব না। আমার চাকরি চলে যাবে।
এ কী অন্যায় কথা! তোমাদের ওই ট্যালটেলে রান্নাই মামাকে গিলতে হবে?
উনি তো আর হোটেল রেস্টুরেন্টে আসেননি, হাসপাতাল নার্সিংহোমের খাবার এরকমই হয়।
একেবারে কাঠে কাঠে পড়েছে। ববিতাও কল্পনার চেয়ে কিছু কম খরখরি নয়। কাজকর্মে দিব্যি দড়, তবে মাধুর্যের বড় অভাব। ভিজিটিং আওয়ারে দিব্যজ্যোতির ঘরে ভিড়ভাট্টা একটু হয়ই, কিন্তু গুঞ্জন সামান্য মাত্রা ছাড়ালেই মেয়েটা এসে যা রুক্ষ গলায় শাসন করে সবাইকে। রীতিমতো রাগী দিদিমণি রাগী দিদিমণি ভাব।
কল্পনা-ববিতা কোন্দল চরমে ওঠার আগেই দিব্যজ্যোতি হাল ধরল। গলা ঈষৎ উচ্চগ্রামে উঠিয়ে বলল, বেশ তো, আইনে যদি বাধা থাকে তো দিয়ো না। ও খাবার ফেরত নিয়ে যাবে।
কল্পনা ফোঁস করে উঠল, এটা কিন্তু এদের বাড়াবাড়ি, মামা। আমরা কি আমাদের আপনজনদের ভালমন্দ বুঝি না?
চুপ কর। বাচাল কোথাকার।
বাঁকা চোখে কল্পনাকে একবার দেখে নিয়ে বিজয়িনীর দর্পে ফের বেরিয়ে গেল ববিতা। কল্পনাও কিন্তু মিয়োয়নি, নাকের পাটা ফুলিয়ে ফোঁস ফোঁস করছে। গোমড়া মুখে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটা বিধবা, তাই না মামা?
উঁহুঁ। বিয়ে হয়নি।
তাই বলো। কল্পনার মুখ হাসিতে ভরে গেল, হবেও না। যা চোপা দিব্যজ্যোতি হেসে ফেলল, তা হলে তো তোরও বিয়ে হওয়া উচিত ছিল না।
আচমকাই দু’চোখের মণি স্থির হয়ে গেল কল্পনার। বুঝি বা জ্বলেও উঠল সামান্য। এক দৃষ্টিতে দেখছে দিব্যজ্যোতিকে।
দৃষ্টিটাকে দিব্যজ্যোতি আমলই দিল না। ভাবলেশহীন স্বরে বলল, ড্যাবড্যাব করে দেখছিস কী? ঠিকই বলেছি। সুখেনের মতো ঠান্ডা ছেলে পেয়েছিস বলে বর্তে গেলি, অন্য কেউ হলে ঘেঁটি ধরে তোকে বের করে দিত।
কল্পনা আস্তে আস্তে চোখ নামিয়ে নিল। নখ খুঁটছে।
দিব্যজ্যোতি আবার বলল, যাক গে। সুবর্ণলতার কী খবর!
কল্পনা মৃদু স্বরে বলল, চলছে। তোমার জামাইকে সব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি।
ঠিক কাজ করিসনি। ও বেচারা নরমসরম মানুষ… মেয়েগুলোকে দিয়ে কাজকর্ম কি তোলাতে পারবে?
কল্পনা জবাব দিল না। চুপ করে আছে।
আমিনা কাজে আসছে?
তিন দিন এসেছিল। তুলে দিয়ে গেছে কাজ।
পেমেন্ট ক্লিয়ার করে দিয়েছিস?
হুঁ।
মালগুলো তো এবার ডেসপ্যাচ করতে হয়। আগের ফিনিশড প্রোডাক্টগুলোও তো পড়ে আছে।
কীভাবে কী করতে হবে বলে দাও।
থাক। তোর বিদ্যের দৌড় আমি জানি। নিজের নামের বানান লিখতে গিয়ে কলম ভেঙে ফেলিস। দিব্যজ্যোতি বাঁ চোখ কুঁচকে ভাবল কী যেন। তারপর বলল, এবার ফেরার সময়ে আমার গাড়িটা নিয়ে যাস। ড্রাইভারের বন্দোবস্ত করে দেব। সমস্ত মাল গাড়িতে তুলে, সুখেনকে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিবি। দেখি আমি ফিরে কত দূর কী করতে পারি।
তুমি কী করে করবে?
অক্ষম হয়ে গেলাম ভাবছিস? ওরে মেয়ে, ইচ্ছে থাকলে বিছানায় শুয়ে শুয়েও অনেক কিছু করা যায়। তা ছাড়া চিরকাল আমি এরকম পঙ্গু থাকব নাকি? এই তো, দ্যাখ না, ডান হাতটা আগে নাড়াতেই পারছিলাম না, এখন একটু একটু মুঠো হচ্ছে। পায়েও জোর আসছে। কথাও কত পরিষ্কার হয়ে গেছে বল। বুঝতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে?
কল্পনা দু’দিকে মাথা নাড়ল। কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, তোমার জন্য আমি ডাকাতে কালীবাড়িতে মানত করেছি, মামা।
পাঁঠা টাটা মানত করিস না। ওটা আমাকে খাওয়াস। সতীলক্ষ্মীর পুণ্য হবে।
নিজের রসিকতায় নিজেই জোরে হেসে উঠল দিব্যজ্যোতি। সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিরি রকম বিকৃত হয়ে গেছে তার মুখমণ্ডল। এত বীভৎস, যে কল্পনাও শিউরে উঠেছে। তাড়াতাড়ি দিব্যজ্যোতির কাঁধে হাত রেখে বলল, হাসতে হবে না। থামো। থামো।
দিব্যজ্যোতি কি তার ক্ষণিকের অসুন্দরতাটাকে টের পেল? প্ৰত্যক্ষ করল কি কল্পনার চোখে? ম্রিয়মাণ যেন হঠাৎ। আবার বুঝি ঝিমুনি নামছে মস্তিষ্কে। মিনিট খানেক পর বিড়বিড় করে বলল, সুবর্ণলতার কাজে আমি কোনও ঢিলেমি পড়তে দেব না।
কিছু বলছ!
হ্যাঁ। সুবর্ণলতাকে চলতেই হবে।
থামবে কেন? আমি তো আছি।
হুম। চোখের কোণ দিয়ে কল্পনাকে দেখল দিব্যজ্যোতি, একটা কথা ভাবছিলাম। ফোনটা এবার নিয়েই ফ্যাল।
কল্পনা এক পল থেমে থেকে বলল, তাড়া কীসের? তুমি আগে সুস্থ হও।
না। নিয়েই ফ্যাল। কোথায় কী দরখাস্ত জমা করতে হবে জানিস তো?
তোমার জামাই জানে।
শ্যামলবাবু আর এসেছিল সুবর্ণলতায়?
হ্যাঁ। তোমার শরীরের কথা জানতে। ওখানে অনেকেই তোমার খোঁজখবর করে যাচ্ছে। সুবর্ণলতার মেয়েরাও তো তোমার নাম করছে সারাক্ষণ।
দিব্যজ্যোতির হাসি এবার অনেক প্রশান্ত। আবার বিড়বিড় করে বলল, ওরা সবাই চাইছে বলেই বোধহয় বেঁচে গেলাম এ যাত্রা।
ববিতা ফের ঢুকেছে ঘরে। কল্পনাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ঘড়ি দেখছে বারবার। লক্ষ করে দিব্যজ্যোতি বলল, সময় হয়ে গেছে, এবার তুই রওনা দে।
কল্পনা উঠল। টিফিন কেরিয়ার প্লাস্টিক ব্যাগে পুরছে।
দিব্যজ্যোতি জিজ্ঞেস করল, কী এনেছিলি রে?
মাগুরমাছের পাতলা ঝোল, চিকেন স্টু, আর একটুখানি আলুপোস্ত। ববিতার দিকে তাকিয়ে মুখভঙ্গি করল কল্পনা, তোমার তো কপালে নেই, দিদাই খাক।
সেই ভাল। মাকেই একটু যত্নআত্তি কর। দু’সপ্তাহ ধরে বেচারার যা টেনশন যাচ্ছে।
যেতে গিয়েও ঘুরে এসেছে কল্পনা। বলল, তোমায় একটা খবর দিতে ভুলে যাচ্ছিলাম। রুনিমাসি আসছে কলকাতায়।
হঠাৎ!
হঠাৎ কেন হবে, তোমায় দেখতে আসছে। তার বোন বোধহয় খবর দিয়েছে। দিদাও বলে থাকতে পারে। দিদাকে তো কাল রাতেও টেলিফোন করেছিল।
কবে?
বোধহয় সামনের হপ্তায়।
ও। … তুই যা।
কল্পনা বেরিয়ে যেতেই ববিতার প্রশ্ন ধেয়ে এল, মহিলা কি আপনার নিজের ভাগনি?
দিব্যজ্যোতির দৃষ্টি তেরচা হল, কেন বলো তো?
দেখে কিন্তু মনে হয় না।
দিব্যজ্যোতি ছোট একটা শ্বাস ফেলল, দেখে যাকে যা মনে হয়, তার সবটাই কি ঠিক?
.
ভিজিটিং আওয়ারে দিব্যজ্যোতির ঘরে লোক সমাগম আজ কিছুটা কম মরণাপন্ন রোগী ক্রমশ আরোগ্যের দিকে গেলে দর্শনার্থীর সংখ্যা তো কমেই আসে। তবু নয় নয় করেও এল বেশ কয়েকজন। সাগ্নিক, পূরবী, দীপাঞ্জন, দিব্যজ্যোতির খুড়তুতো ভাই, ভাইয়ের বউ…। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ দু’জন পুরনো রাজনৈতিক সঙ্গীও এসে হাজির। দু’জনেই পার্টির বেশ হোমরাচোমরা। বেশ কিছুদিন ধরেই তাদের নাকি আসি আসি করেও আসা হচ্ছিল না। ইদানীং রাজনীতির সঙ্গে দিব্যজ্যোতির তেমন প্রত্যক্ষ সংস্রব নেই বটে, তবে এককালে এদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বহু মিটিং-মিছিলে থেকেছে সে। পুরনো সেইসব দিনের কথাই আসছিল ঘুরেফিরে। স্মৃতি রোমন্থন। আধ ঘণ্টা বকর বকর করে বিদায় নিল দুই কমরেড। সঙ্গে ভাই ভ্রাতৃবধূ। সাগ্নিকরাও উঠব উঠব করছে।
দীপাঞ্জন জিজ্ঞেস করল, আপনাকে ঠিক কবে ছাড়ছে দিব্যদা?
ডাক্তার তো বলছে, পরশু। নইলে তার পরের দিন।
পূরবী বলল, তাড়াতাড়ি ফিট হয়ে যান, দিব্যদা। আপনাকে এভাবে বিছানায় দেখতে একটুও ভাল লাগছে না।
দিব্যজ্যোতি হেসে বলল, দ্যাখো না, বড়জোর এক-দু’ মাস। তার পরই রাস্তায় বেরিয়ে পড়ব।
এত সোজা নয়, দিব্যদা। সাগ্নিকের স্বর হালকা, বাড়ি গিয়ে নো বেগড়বাই। দু’বেলা ফিজিওথেরাপিতে যেন কামাই না পড়ে।
জ্ঞান দিস না। জানি কী করতে হবে। ফিজিওথেরাপি যেমন চলার চলবে, তবে আমি একটু খাড়া হতে পারলেই… ডিসেম্বরে আমার এগজিবিশন, ছবি আঁকার আগে একটা মেন্টাল প্রিপারেশন লাগবে তো। নিজেকে সারাক্ষণ ক্রিপল ভাবলে চলবে?
কিন্তু এখনও তো আপনার… রাইট সাইড…
সে তো এখন। আজ। এই মুহূর্তে। দ্যাখ না তোরা, এসে যাবে… জোর এসে যাবে।
দীপাঞ্জন আর পূরবীর মুখে শ্রদ্ধামিশ্রিত বিস্ময়। দীপাঞ্জন অস্ফুটে বলল, এই জন্যই আপনি গ্রেট, দিব্যদা। আপনার সামনে এলে আমাদের কনফিডেন্স লেভেলটাও কত বেড়ে যায়।
গ্যাসট্যাস দেওয়া থামা তো। নিজের ওপর আস্থা হারালে বেঁচে থাকা যায় নাকি? বলেই দিব্যজ্যোতি সাগ্নিককে ধরেছে, তা হ্যাঁরে, গোলে হরিবোল হয়ে সুবর্ণলতার ওয়ার্কশপটা তো ভোগে গেল। কিছু করবি? নাকি করবি না?
না না, অবশ্যই হবে। আপনি সুবর্ণলতায় যাওয়ার মতো অবস্থায় এলেই…
আমার সঙ্গে কী সম্পর্ক? ডেট ফিক্স করে বল, সোনামাটিতে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি, গাড়ি তো আছেই, নিয়ে চলে যা।
যাব। অনুপল ব্যাটা হায়দরাবাদ গেছে, ফিরুক।
সময় নষ্ট করিস না। প্লিজ। ওখানকার কুমোরদের তোরা একটু গাইড করলে…
দিব্যজ্যোতি থেমে গেল সহসা। চোখ পড়েছে দরজায়। পৃথা। পরনে তুঁতে রং সিল্কের শাড়ি, কাঁধে বাদামি ভ্যানিটি ব্যাগ, কপালে ছোট্ট লাল টিপ। একটু যেন ভারী হয়েছে পৃথা, চেহারায় গিন্নি গিন্নি গোছের ভরভরন্ত ভাব।
পলকের জন্য থমকেছিল দিব্যজ্যোতি, ক্ষণপরেই বাঁ হাত তুলে ডাকছে, দাঁড়িয়ে রইলে কেন? এসো।
পৃথা পায়ে পায়ে ভেতরে এল। খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে আড়ষ্ট গলায় বলল, কেমন আছ এখন?
যা ছিলাম তার তুলনায় ফার্স্ট ক্লাস। কণাদ এল না?
ওর তো অফিস… আসবে… পরে…
তুমি কি স্কুল থেকে? ডাইরেক্ট?
পৃথা হ্যাঁ-না কিছুই বলল না, অস্পষ্টভাবে হাসল।
দিব্যজ্যোতি সাগ্নিকদের বলল, একে তোরা নিশ্চয়ই চিনতে পারছিস না?
পূরবী ইতস্তত করে বলল, বোধহয় পারছি। আপনার ক্যাবিনেটে ওঁর একটা…
হ্যাঁ, ওরই ছবি। আমার প্রাক্তন স্ত্রী। পৃথা। পৃথা বসু। ওর বরকে বোধহয় তোরা চিনবি না… নাকি চিনিস… কণাদ, আমার একেবারে প্রথম দিকের ছাত্র। নিউজপেপারে আছে এখন। বলেই দিব্যজ্যোতির চোখ পৃথায়, আমাদের যেন কতদিন ডিভোর্স হয়েছে? এগারো বছর? নাকি আর একটু বেশি?
উত্তরের জন্য অবশ্য অপেক্ষায় নেই দিব্যজ্যোতি। প্রায় একই রকম অনায়াস স্বরে সাগ্নিকদের নাম পরিচয় জানাল পৃথাকে। বলল, সোনামাটিতে আমার সেরিব্রাল ইনফার্কশনটার সময়ে এই সাগ্নিক ছিল সঙ্গে। আর অনুপল। ওরাই যা করার ঝটপট করেছে, বুঝলে।
পৃথার মুখ দিয়ে একটাই শুধু ধ্বনি বেরোল, ও।
দিব্যজ্যোতি সাগ্নিকদের বলল, অ্যাই, তোরা এবার কাট তো। পৃথার সঙ্গে কত যুগ পর দেখা হল, একটু শান্তিতে গল্প করতে দে। তোরা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলে ও তো কথাই বলতে পারবে না।
দীপাঞ্জন, সাগ্নিক আর পূরবী প্রায় দুদ্দাড়িয়ে দৌড় মারল। ওরা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথা তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠেছে, আশ্চর্য, তোমার নেচার একটুও বদলাল না!
নেচার তো মানুষের বদলায় না পৃথা। যা বদলায়, সেটা হল অভ্যেস।
সেই একই রকম কথার প্যাঁচ। পৃথা গুমগুম স্বরে বলল, জানি এরকম সিচুয়েশনে পড়তে হবে। তাই আসতে চাইনি।
তবু এসেছ তো! দিব্যজ্যোতি হাসল, মুখটা বেঁকেই রইল হাসিতে। বলল, তোমার সমস্যা কী জানো পৃথা? তুমি যেটা চাও, সেটা করো না। আর যেটা করো…
থাক। আমায় নিয়ে গবেষণা না-করলেও চলবে।… হঠাৎ ডাকাডাকি কেন?
দিব্যজ্যোতি হাসিটা মুখে ধরেই আছে, জীবনের প্রায় প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছিলাম তো… হঠাৎ ইচ্ছে হচ্ছিল তোমায় একবার দেখি। জানি, তুমি আছ কেমন!
পৃথা কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক। তারপর বলল, দেখা তো হয়েছে, এবার যাই?
কিন্তু জানা যে হল না। দিব্যজ্যোতির হাসি আর একটু চওড়া হল, তুমি সুখী হয়েছ তো পৃথা?
পৃথা গম্ভীর গলায় বলল, ঠিকই আছি।
সে তো থাকবেই। আমি জিজ্ঞেস করছি তুমি সুখী হয়েছ, কি না?
কেন হব না? আমার এখন কীসের অভাব? আমার কণাদ আছে, টুকুস আছে… তারা আমায় ভালবাসে, চোখে হারায়… দিব্যি সংসার করছি…
আমি কিন্তু এত কিছু জানতে চাইনি, পৃথা। আমি শুধু…
তোমাকে বলব কেন? পৃথা দুম করে রেগে গেল, তুমি জানতে চাওয়ার কে? কী রাইট আছে? বলেই হঠাৎ চড়ে যাওয়া মেজাজটা দ্রুত সামলে নিয়েছে, থাক না ওসব কথা। তুমি তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে ওঠো। হাত বাড়িয়ে দিব্যজ্যোতিকে একবার ছুঁল পৃথা। তারপর ধীর পায়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
দিব্যজ্যোতি সেদিকে তাকালই না। চোখ বুজল।