নোবেল বিজেতা আমেরিকান কবি লুইস গ্লুক
১৯৪৩ সালের ২২ এপ্রিল নিউইয়র্কে লুইস গ্লুকের জন্ম। তবে তিনি বেড়ে উঠেছেন লং আইল্যান্ডে। বাবা ড্যানিয়েল গ্লুক আর মা বিয়েট্রেস গ্লুকের দুই মেয়ের মধ্যে তিনি বড়। শৈশবে অ্যানারেক্সিয়া নার্ভালসা রোগে ভুগেছিলেন অনেক দিন। এ জন্য বছর সাতেক থেরাপি নিতে হয়েছে তাঁকে।
তিনি ১৯৬১ সালে জর্জ ডব্লিউ হাই স্কুল, হিউলেট, নিউ ইয়র্ক থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। পরবর্তীতে তিনি সারাহ লরেন্সে কলেজ ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। গর্ডার্ড কলেজে কিছুদিন কবিতা বিষয়ে শিক্ষকতা করার পর, বর্তমানে তিনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।
মাত্র আঠেরো বছর বয়সে তাঁর কবিতা লেখায় হাতে খড়ি। পঁচিশ বছর বয়সে প্রথম কবিতার বই ‘ফার্স্টবর্ন’। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ (প্রথম সন্তান) সাড়া ফেলে দিয়েছিল সাহিত্যের জগতে। তারপর আস্তে আস্তে বেড়েছে পরিধি। মেলভিন কানে, পুলিৎজার পুরস্কার জুটেছে আগেই। তাঁর মুকুটে জুড়ল নোবেলের পালক ২০২০ সালে। যে কবিতা তাঁকে ফিরিয়ে এনেছিল মৃত্যুর থেকে, সেই কবিতায় এবার তাঁকে পাইয়ে দিল শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান।
এই কবি তাঁর কবিতার সাবলীল আর ব্যতিক্রমী ভাষাশৈলী দিয়ে নিজেকে এমনভাবে প্রকাশ করেন, যা একাধারে হয়ে ওঠে স্থানিক ও বৈশ্বিক।
১৭৮৬ সালে একটি স্বাধীন সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দ্য সুইডিশ একাডেমির সৃষ্টি হয়েছিল। এই একাডেমি ১৯০১ সাল থেকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দিয়ে আসছে। এ পর্যন্ত ১১২ বার এ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। বিজয়ী হয়েছেন ১১৬ জন কবি ও সাহিত্যিক।
লুইস গ্লাক তাঁর ‘ওয়াইল্ড আইরিস’ কবিতা-গ্রন্থের জন্য ১৯৯৩ সালে পুলিৎজার প্রাইজ পান। তিনি পুলিৎজার প্রাইজ’র পাশাপাশি ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল অ্যাওয়ার্ড, দ্য একাডেমি অব অ্যামেরিকান পোয়েট’স প্রাইজসহ বেশ কিছু পুরস্কারে ভূষিত হন। অবশেষ ২০২০ সালে সাহিত্য নোবেল পুরস্কার পান তিনি। নোবেল-কমিটি তাদের বক্তব্যে বলেন, ‘”Her unmistakable poetic voice that with austere beauty makes individual existence universal”।
( ” তাঁর অদম্য কাব্যিক কণ্ঠস্বর যে কঠোর সৌন্দর্যের সাথে ব্যক্তি অস্তিত্বকে সর্বজনীন করে তোলে”।)
লুইস গ্লাকের কবিতা মূলত আত্মজৈবনিক। ব্যক্তিগত হতাশা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, সাফল্য-ব্যর্থতা, নিঃসঙ্গতা ধ্রুপদী মিথের সাথে মাখামাখি হয়ে ধরা দিয়েছে তাঁর কবিতায়। লুইস গ্লুকের কবিতার বইয়ের সংখ্যা মোট এগারটি। তন্মধ্যে ’দ্য সেভেন এইজ’ , ’ভিটা নোভা’ ও ‘এভেরনো’ উল্লেখযোগ্য। কবিতার পাশাপাশি ‘প্রুফস এন্ড থিওরিস’, ‘এসেস অন পোয়েট্রি’ তাঁর বহুল আলোচিত গদ্যসংগ্রহ।
মৃত্যু, পরা-জগত, নীরবতা, নৈঃশব্দ্য, নির্জনতা ও অন্য পৃথিবী যার কবিতায় ভর করে তিনি হলেন লুইস গ্লুক। লুইস গ্লুকের কাব্যভাষা নির্মাণ খুব সহজ-সরস ও প্রাঞ্জল কিন্তু তার কবিতার এ সরলরেখা একই বিন্দু থেকে উৎসারিত হলেও দুটো জগতকে একত্র করেছে। ফলতঃ মৃত্যু, নৈঃশব্দ, নির্জনতায়ও তার কবিতার চরিত্রের দ্বৈততা বা দ্বৈত সত্তা লক্ষ্য করা যায়। লুইস গ্লুক এমন এক নির্জনতার কবি, যিনি লোকান্তরিত হয়েও এ পৃথিবীর মানুষের সাথে কথা বলেন- মৃত্যু,দূর্যোগ,দুঃখ-বিলাপ, আর্তি-বেদনা, হাহাকার যেমন তাঁর কন্ঠ থেকে ঝরে পড়ে এ পৃথিবীর মানুষের কাছে তেমনি আবার কখনো এ চরিত্রটি তার সঙ্গীকে খুঁজে নেন অনায়াসে কখনও বন্ধুবেশে,কখনও পাখি বা প্রেমিক হয়ে বা ঝর্ণা হয়ে বয়ে যায় স্বর্গ থেকে মর্ত্যে। সুতরাং,তার কবিতায় দুঃখ, বিলাপ, নিঃসঙ্গতা যতই থাকুক, সবশেষে তিনি নিঃসঙ্গ নন। নির্জনতা বা দুঃখবাদীদের সাথে এই স্বাতন্ত্রতার দিকটি অনন্য হয়ে ধরা দিয়েছে তাঁর কবিতায়।
লুইস গ্লুক তাঁর রচনায় যন্ত্রণা, আকাঙ্ক্ষা আর প্রকৃতি নিয়ে লিখেছেন। বিশেষ করে বিষণ্নতা আর একাকিত্ব নিয়ে প্রচুর কবিতা লিখেছেন তিনি। নাইন-ইলেভেনের মর্মান্তিক ঘটনা গ্লুককে খুবই প্রভাবিত করেছিল। এই মর্মান্তিক ঘটনা তাঁকে জীবন গুটিয়ে ফেলার পরিবর্তে জীবনকে উদযাপন করতেই বেশি উৎসাহী করেছে। তাঁর রচনা ও ভাবনায় অনেক সময় পৌরাণিক ঘটনা আর ইতিহাসের ছোঁয়া পাওয়া যায়।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন পোয়েট লরিয়েট, Faithful and Virtuous Night কবিতার জন্য ন্যাশনাল বুক এ্যাওয়ার্ড বিজয়ী এবং তাঁর সাম্প্রতিক কল্পবিজ্ঞান, কবিতা: ১৯৬২-২০২১২ সহ এক ডজনেরও বেশি কাব্য গ্রন্থের লেখক। পুলিৎজার পুরষ্কার বিজয়ী রবার্ট হেস তাকে “সাম্প্রতিক লেখার সবচেয়ে শুদ্ধ ও সর্বাধিক দক্ষ গীতি কবি” বলে অভিহিত করেছেন। গ্লুক কুড়ি বছর ধরে উইলিয়ামস কলেজে অধ্যাপনা করেছেন এবং বর্তমানে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের রোজনক্র্যাঞ্জ আবাসিক লেখক। তিনি আমেরিকান আর্টস অ্যান্ড লেটার্স একাডেমির সদস্য এবং ১৯৯৯ সালে আমেরিকান কবিদের একাডেমির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর অসংখ্য কবিতার বইয়ের মধ্যে রয়েছে অ্যা ভিলেজ লাইফ (২০০৯), দ্য সেভেন এজ (২০০১) এবং দ্য ওয়াইল্ড আইরিস (১৯৯২), যার জন্য তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন।
লুইস গ্লুকের প্রাপ্তির ঝুলিতে আছে ন্যাশনাল হিউম্যানিটিজ মেডেল, পুলিৎজার পুরস্কার, ন্যাশনাল বুক পুরস্কার। ২০০৩-০৪ সালে লুইস গ্লুক ছিলেন আমেরিকার রাষ্ট্রীয় কবি।
নোবেল কমিটির সংবাদমাধ্যম প্রতিনিধির সাক্ষাৎকারে লুইস গ্লুককে জিজ্ঞেস করা হয়, নোবেল বিজয়ী হয়ে তার কী অনুভূতি।
কবির উত্তর—
“একটি বাড়ি কিনতে চাইছিলাম বেশ কিছুদিন… এবার কিনতে পারব…”
এরকমি প্রাত্যহিক চিন্তা, অবস্থান এবং প্রসঙ্গ লুইস গ্লুকের লেখা ও মননকে আকার দেয়।
বাড়ি কিনতে পারাটা একজন কবির চিন্তাভাবনার বিষয় হতে পারে, সেটা ভাবতে গেলেই ধাক্কা লাগে। কবি তো তিনি যাকে প্লেটো বলেছেন সমাজবহির্ভূত। সমাজে থাকলে তিনি ক্ষতিই করেন, কারণ কবির যা চিন্তাশক্তি তা সমাজের প্রাত্যহিক কাজেকর্মে লাগে না। অথবা কবি হবেন এমন, যিনি ভবিষ্যতদ্রষ্টা— কবি আবার বাড়ি কেনাকাটি করার কথা ভাববেন কেন?
“I’m concerned with the preservation of daily life”— একই সাক্ষাৎকারে উনি বলেছেন। লুইস গ্লুককে নোবেল স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্যে আমাদের প্রাত্যহিক বৈষয়িক আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তাই সেই পুরস্কার বাবদ পাওয়া টাকা দিয়ে বাড়ি কিনতে চাওয়াটা আমাদেরই স্বপ্ন পূরণ যেন।
রোজকার নিউজপেপার পড়ার মতোই সহজ, ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট, অথচ প্রব্লেম্যাটিক ওঁর কবিতা লেখার আঙ্গিক –
We were leaving to deliver
Christmas presents when the tire blew
Last year. Above the dead valves pines pared
Down by a storm stood, limbs bared . . .
I want you.
(আমরা বিতরণ করতে যাচ্ছি
যখন ক্রিসমাস উপহার
গত বছর. মৃত পাইন কান্ড দিয়ে ঘেরা
ঝড়ের নিচে দাড়িয়ে, হাত-পা খালি। . .
আমি তোমাকে চাই।)
প্রথম দিকের কাব্যিক জীবন থেকে এই লাইনগুলো উঠে আসে ওঁর লেখা ‘Early December in Croton-on Huson’ (1968) কবিতায়। ক্রিসমাসের উপহার, টায়ার পাঙ্কচার, ঝড়ে ধসে যাওয়া পাইন গাছ অনায়াসে মিশে গেল poetic voice-এর সঙ্গে— I want you— ভালবাসার উদ্বেগ যেন বাকি জিনিসগুলোর মতোই বাস্তব এবং সর্বস্ব।
অথবা দেখা যাক “The Untrustworthy Speaker” (1990) থেকে এই পঙক্তিগুলো:
Don’t listen to me; my heart’s been broken.
I don’t see anything objectively.
I know myself; I’ve learned to hear like a psychiatrist.
When I speak passionately,
that’s when I’m least to be trusted.
( আমার কথা শুনো না; আমার হৃদয় ভেঙে গেছে।
আমি বস্তুনিষ্ঠভাবে কিছু দেখি না।
আমি নিজেকে জানি; আমি মনোরোগী বিশেষজ্ঞের মতো শুনতে শিখেছি।
আমি যখন আবেগের সাথে কথা বলি,
তখনই আমি অন্তত বিশ্বাস করি।
সত্যটা কীভাবে কার উদ্দেশ্যে বোঝা দায়।)
কবি নিজেই নিজের কাব্যিক কণ্ঠ ও ভাষার নির্ভরযোগ্যতাকে প্রশ্ন করছেন। কারণ? সেই প্রাত্যহিক ব্যথা-বেদনা, ভালবাসার ছন্দপতন, পার্থিব জীবনের বৈষম্য। ভাষা এখানে এতটাই আড়ম্বরহীন, অ-কাব্যিক, যেন নিশানা মেপে তীরন্দাজের তীর। গ্লুকের লেখার বিশেষত্ব বোধহয় এখানেই— ডাক্তার প্রয়োজন বুঝে যেমন প্রেসক্রিপশন লেখেন, গ্লুক তেমন অপ্রয়োজনীয় কোনও শব্দ অপচয় করেন না।
ওঁর বহুচর্চিত কবিতা Averno (2006) থেকে কিছু লাইন দেখি:
You die when your spirit dies.
Otherwise, you live.
You may not do a good job of it, but you go on—
Something you have no choice about.
( আপনার আত্মা মারা গেলে আপনি মারা যান।
নইলে আপনি বেঁচে থাকেন।
আপনি এটির একটি ভাল কাজ নাও করতে পারেন, তবে আপনি চালিয়ে যান-
এমন কিছু যা সম্পর্কে আপনার কোন বিকল্প নেই।)
ভাষার politics এবং তার aesthetics মিলে মিশে একাকার— কবি যেমন বলছেন সত্যি তেমনি, অথবা নাও হতে পারে— স্রষ্টা এবং পাঠকের “choice” নেই— কবিতা, ভাষা, জীবন— নিজের মতোই বয়ে চলে— আমাদের এজেন্সি আদৌ আছে কি? Averno কবিতা সঙ্কলনে গ্রিক মাইথলজি-র পেরসেফনের ক্যারেক্টারটিকে device হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন— কিন্তু বক্তব্য সেই দৈনন্দিন জীবনাবস্থান, মা ও মেয়ের টানাপড়েন, বয়ঃসন্ধির উদ্বেগ। পুরাণকথা ও মাইথলজি আধুনিক মানুষের অ-নায়কোচিত গাথা হয়ে রয়ে যায়।
আত্মজৈবনিক অনেক কিছুই ছায়ার মতো ঘনিয়ে আসে ওঁর লেখায়। কৈশোরে ওঁর আনরেক্সিয়া নারভাস রোগ হয়েছিল। বহুদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। নিজের এই রোগ নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে, গ্লুক লিখেছেন রোগের কারণ তাঁর স্বাধীন সত্তার খোঁজ এবং মায়ের বিরুদ্ধাচারণ। আরেক জায়গায় লিখেছেন, যে বড় দিদির আকস্মিক মৃত্যু তাকে অসম্ভব ধাক্কা দেয়। স্কুলে থাকতেই ওঁর psychoanalytic treatment শুরু হয়।
একাকিত্ব, দুঃখ, সম্পর্কের ওঠাপড়া, রোজনামচা অকথিত উদ্বেগ— আতঙ্ক (trauma) হয়ে ভাষায় ও কবিতায় রূপ নেয়।
This is the barrenness
of harvest or pestilence.
And the wife leaning out the window
with her hand extended, as in payment,
and the seeds
distinct, gold, calling
Come here
Come here, little one
And the soul creeps out of the tree.
( এই বন্ধ্যাত্ব
ফসল বা মড়ক।
আর স্ত্রী জানালার বাইরে হেলান দিয়ে
তার হাত প্রসারিত করে, অর্থপ্রদানের মতো,
এবং বীজ
স্বতন্ত্র, স্বর্ণময়, আহ্বান
এখানে আসুন
এখানে এসো, ছোট একটি
এবং আত্মা গাছ থেকে বেরিয়ে আসে।)
‘All Hallows’ (1968) কবিতা থেকে নেওয়া এই পঙক্তিগুলি বারে বারে মনে করিয়ে দেয় রোজকার মানসিক barenness, pestilence— অনুর্বর দশা। গাছে ঝুলে থাকা প্রেতাত্মার মতো, কবির আত্মাও পালিয়ে যেতে চায়।
মানসিক এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে কলেজের পোশাকি ডিগ্রি নেওয়া হয়নি ওঁর—
…my emotional condition, my extreme rigidity of behavior and frantic dependence on ritual made other forms of education impossible.
( আমার মানসিক অবস্থা, আমার আচরণের চরম অনমনীয়তা এবং আচার-অনুষ্ঠানের উপর উন্মত্ত নির্ভরতা অন্যান্য ধরণের শিক্ষাকে অসম্ভব করে তুলেছে।)
কবিতা ভাবা এবং কবিতা লেখাই হয়ে উঠল লুইস গ্লাকের পঠন-পাঠন। বিচ্ছেদ, মৃত্যু, জরা একদিকে আঁচড় কেটেছে তাঁর মননে, অন্যদিকে জীবনশক্তি, আশা, পুনর্জন্ম ভাষা পেয়েছে তাঁর চেতনায়। নিজের নানান সঙ্কলনে উনি কখনও বা গ্রীক দেবদেবী, আবার কখনও বাগানের ফুল হয়ে কথা বলেছেন (The Wild Iris, 1992)।
‘Archaic Fragment’ (2006) কবিতায় লিখেছেন:
I was trying to love matter.
I taped a sign over the mirror:
You cannot hate matter and love form.
It was a beautiful day, though cold.
This was, for me, an extravagantly emotional gesture.
( আমি ব্যাপারটা ভালবাসার চেষ্টা করছিলাম।
আমি আয়নার উপর একটি চিহ্ন এঁকেছি:
আপনি ব্যাপারটা এবং প্রেমের আকারকে ঘৃণা করতে পারেন না.
ঠান্ডা হলেও এটি একটি সুন্দর দিন ছিল।
এটা ছিল, আমার জন্য, একটি অসাধারণ আবেগপূর্ণ অঙ্গভঙ্গী।)
পাশ্চাত্যের অস্তিত্ববাদী চিন্তায় পদার্থ আগে, মর্ম তার পরে। Existence আর essence, matter আর form নিয়ে চিরাচরিত কাব্যিক দ্বন্দ্ব ওঁর লেখার হৃদযন্ত্রের মতো। মনের বেগ আর ভাষার বেগ একসঙ্গেই যেন ওঠাপড়া।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চেকোস্লোভাকিয়ায় কবিরা নানান ছদ্মবেশি কায়দায় কবিতা লিখতেন স্তালিনীয় আইডিওলজি থেকে তাঁদের সৃষ্টিকে আগলে রাখতে। ‘Poetry of the Everyday’ এরমই এক ছদ্ধবেশী পন্থা। প্রাত্যহিক ভাষা ও বৈষয়িক বস্তুর মধ্যে লুকিয়ে থাকত ক্ষমতা, শাসন, স্বাধীনতা, আত্মচেতনা, রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন। সেগুলোর বাইরের রূপ হত পাহাড়, নদী, লেক, শিশু, বৃদ্ধ-ভেতরে থাকত কবিতার সামাজিক ভূমিকা ও কর্তব্য নিয়ে টানাপোড়েন। গ্লুকের লেখা একইভাবে অহরহ বস্তুসর্বস্ব জীবনকে দত্তক নেয় কবিতার matter এবং form-এর জন্য।
লুইস গ্লাকের লেখাকে কোনও শ্রেণীবদ্ধ বিভাগ বা লেবেল দিয়ে মাপা যাবে না। নানান দৃষ্টিকোণ ও পন্থা দিয়ে ওঁর লেখার প্রতি অগ্রসর করা যায়। উনবিংশ শতকে ওঁর ইহুদি পূর্বপুরুষরা রাশিয়া এবং হাঙ্গারি থেকে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রে চলে আসেন। নিউ ইয়র্ক শহরে ব্যবসা শুরু করেন। এমন বহিরাগত অবস্থান থেকে লুইস গ্লুক জীবনকে চিনতে শিখেছেন। ওঁর লেখনী-জীবনের সমান্তরাল চলেছে বিশ্বায়নের জীবনী। যার মূল কর্তা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রোজনামচা জীবনে বিশ্বায়নের তালে তালে, মানুষের ভাবাবেগের যুদ্ধে লুইস গ্লুক-ই কর্তা।
You know, he said, our work is difficult: we confront
much sorrow and disappointment.
He gazed at me with increasing frankness.
I was like you once, he added, in love with turbulence.
( আপনি জানেন, তিনি বলেছেন, আমাদের কাজ কঠিন: আমরা মুখোমুখি হয়েছি
অনেক দুঃখ এবং হতাশার।
তিনি আমার দিকে ক্রমবর্ধমান খোলামেলা দৃষ্টিতে তাকালেন।
আমি একবার তোমার মত ছিলাম, তিনি যোগ করেছেন, অশান্তির প্রেমে।)
-‘অ্যাবোরিজিনাল ল্যান্ডস্কেপ’ (2013)
–‘Aboriginal Landscape’(2013)
‘প্রেসিডেন্টস ডে’
লুইস গ্লুক-এর কবিতা ও কাব্যব্যক্তিত্বের স্বরূপ আলোচনা করতে গিয়ে, বিপাশা বিনতে হক বলেছেন, (20 OCT , 2020).
” ২০২০-এ সাহিত্যে নোবেলবিজয়ী মার্কিন কবি লুইস গ্লুকের (১৯৪৩- ) কবিতা তর্জমা করতে গিয়ে আমার যে অনুভূতি হলো তা আলোচনা করছি। আমি গ্লুকের লেখার ধাঁচ, ভাষার ব্যবহার ও সর্বোপরি তার কাব্যদর্শন বিষয়ে আলোকপাত করব। গ্লুকের লেখনী ছুঁয়ে আলোচ্য বিষয়গুলোই তুলনা করবো বাংলা কবিতার দুই দিকপাল সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে। প্রায় স্বগোতোক্তিচ্ছলে বলে যাওয়া গ্লুকের কবিতায় আমরা যাপিত জীবনের গ্লানি ও ক্লেদ, আর এ থেকে উত্তরায়ণের ইঙ্গিত খোঁজার চেষ্টা করবো।
তর্জমাকালে প্রথম যে বিষয়টি লক্ষ্য করি তা এই, কবিতায় তিনি মিতভাষী; কোথাও কোনো বাড়াবাড়ি নেই, আর বিশেষণ ব্যবহার করার ব্যাপারে তাঁর বিশেষ অনীহা। যেমন ‘নিশীথ পরিযাণ’ কবিতায় তিনি বলছেন ‘রেড বেরিস/ লাল জাম’ তর্জমার সময় আমি ভাবছিলাম লাল জামের সাথে ‘টকটকে’ জুড়ে দিল বেশ দেখাতো। এবং এজাতীয় সোজাসাপ্টা কথা তার প্রায় প্রতিটি কবিতাতে রয়েছে। তিনি রূপকগুলোকে এমনভাবে এনেছেন যেন এরা সরাসরি কবিতায় অংশগ্রহণ করছে। শুধু বিশেষণ কেন, শব্দ খরচ করার ক্ষেত্রে তাকে আমার ভীষণ সংযমী মনে হয়েছে। এই যেমন ‘খেয়াল’ কবিতার তৃতীয় স্তবকে “তারপর ওরা সন্তাপগৃহে ফিরে যায়” এই ‘ওরা’ টা কারা? ‘নিশীথ পরিযাণ’ কবিতার দ্বিতীয় স্তবকে “আমরা নির্ভর করি এসবে/এরা মিলিয়ে যায়” আমরা কিসে নির্ভর করি আর কেনইবা এদের মিলিয়ে যেতে হয়? মাঝে মাঝে আমার মনে হয়েছে প্রনাউন রেফারেন্সে আমি খেই হারিয়ে ফেলছি। লিখতে বসে প্রগলভতা না আনা, অলংকারকে ‘না’ বলা কঠিন, আর এই না ভাবটা তিনি তার লেখনীতে শক্ত করে ধরে রেখেছে। একদম ‘চাপা হাসি মাপা কান্না’ জাতীয় অমিত সংযমে তার কবিতা এগিয়ে চলতে দেখেছি।
এসব ভাবতে গিয়ে মনে হলো বাঙালি কাব্যরসিকের কাছে শব্দের এই মেপে মেপে ব্যবহার কিছুটা অস্বস্তিকর ঠেকতে পারে। তার লেখনীর তুলনাটা চলে আসে বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গোডোট’-এর সাথে; যেখানে অপ্রতুল শব্দের কারণে চরিত্রের মুখে কথা ফোটে না, জন্ম হচ্ছে আয়রনির, স্যাটায়ারের। বিপরীতে বলা যায় বাঙালি পাঠক হিসেবে আমরা জীবনানন্দ দাস পড়ছি, রবীন্দ্র-নজরুল পড়ছি, যাদের কবিতা সবসময়ে ছাপিয়ে যায়, রূপকের ও ইমেজারির এক্সসেসে আমরা এত অভ্যস্ত যে গ্লুকের কবিতার চাঁচাছোলা, সরাসরি ভাবটা আমাদের কাছে বেশ সাদামাটা, আসবাববিহীন খালি ঘরের মতো মনে হতে পারে। এখানে বাংলার প্রথমদিকের আধুনিক সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কথা অবধারিতভাবে চলে আসে, বিশেষ করে তার লেখার এই চাঁচাছোলা স্টাইল। শক্তি চট্টপাধ্যায় বলেছেন, তার, মানে সুধীনের কাজ ছিল ভাস্করের কাজ, লিখতে বসে যেন তিনি ছেনী বাটালি নিয়ে বসতেন। কম কথায় কাজ সারতেন বাঁধুনি শক্ত করে। শক্তি আরো যোগ করেছেন সুধীনের ‘কবিত্ব ছিল কিন্তু excess ছিল না। সংযমের মধ্যে রাখতে পারতেন।’ উত্তরাধুনিক কবি গ্লুকের কাব্যশৈলীতে আবেগের এই শমিত প্রকাশ চোখে না পড়ে যায় না।
গ্লুকের কবিতার দ্বিতীয় বিষয়টি হলো শব্দ বাছাই করা। তিনি জটিল-কুটিল শব্দ লেখায় তেমনভাবে আনেননি, যেটা তার মিতভাষিতার আরেকটি দৃষ্টান্ত হতে পারে। এই বিষয়টি কিন্তু প্রথমে আলোচনা করা বিষয়ের পরিপূরক। বোধ হয় লিখতে বসে এই ছিমছাম, সোজা ভাব ধরে লিখে যাওয়া বাংলা কবিতার জগতে খানিকটা বিরল ঘটনা। গ্লুকের কবিতায় মিনিমালিস্ট আন্ডারটোনে বলা একধরণের চাপা উত্তেজনা থেকে যায়, যে কোনা ব্যাপারে প্রতিহত হবার স্বভাব এমন বলা যায়। এ বিষয়ে বলবো, মানুষের ব্যক্তিত্বের মতো লেখার স্টাইলটাও খুব ব্যক্তিগত একটা প্রকাশ মাধ্যম; এত বছরের সাহিত্যের ক্যারিয়ারে তিনি সেটা হোমোজেনিয়াসলি সেটা ধরে রেখেছেন।
তৃতীয়ত, তার কবিতায় বিশেষ লক্ষ্যনীয় যে, তিনি, খানিকটা জীবনানন্দ দাশের মতোই, মৃত্যুকে গ্রহণ করেছেন জটিলতাপূর্ণভাবে। হয়তো জীবনানন্দের মতো সেটা এত মারাত্মক রকমের জটিল না, কিন্তু বেশ খানিকটা। জীবনানন্দের মতোই গ্লুকের অধিকাংশ কবিতা জীবনের অর্থে গুরুগম্ভীর প্রকষ্ঠে আবদ্ধ। জীবন-মৃত্যু তাঁদের কাছে বিশৃঙ্খল কিংবা অমীমাংসিত এক ধাঁধা। মৃত্যু যে শূন্যতার সম্ভাবনা নিয়ে আসে, সেই প্রকাশটা গ্লুকের লেখার পরিমিতিবোধের কারণে আরও ফাঁকা, আরও নিঃসঙ্গ। বিপরীতে বলা যায় জীবনানন্দের কাছে মৃত্য আত্মঘাতিক, সহিংস এবং জমজমাট আয়োজনে ঠাঁসা।
জীবন-মৃত্যুর ধারণার সাথে এ পর্যায়ে আমরা জুড়ে দিতে পারি গ্লুকের সময়ের ধারণা, যেখানে তিনি অনেকটা জীবনানন্দের মতো। দুজনের কবিতায় বর্তমান-অতীত-ভবিষৎ সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে না; সময় তার স্বাতন্ত্রহীন রূপ নিয়ে তার বিচিত্রতায় আবর্তন ঘটিয়ে চলে মাত্র।
নোবেল পাবার পর এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান যে দশ বছর বয়স থেকেই তিনি নাকি মৃত্যু নিয়ে লিখছেন! পাঠক হিসেবে ধারণা করি, এত অল্প বয়স থেকে যিনি মৃত্যু ভাবনায় কাতর, তার লেখায় মৃত্যু বর্ণ অথবা বর্ণহীন, গন্ধ অথবা গন্ধহীন ভাবে মিশে না থেকে যায় না।
পঞ্চমত, এ বিষয়টা খুব স্পষ্ট তার কবিতায় যে আধুনিক ও উত্তরাধুনিক কবিদের মতো গ্লুকও মানুষের মনের ছায়াময় দিকগুলো তুলে ধরেন। শব্দ আর বাক্যের অন্তরালে তিনি হৃদয়ের স্পর্শকাতরতা, একাকীত্ব, পারিবারিক বন্ধন, বিবাহবিচ্ছেদ, মৃত্যু, কাম, ক্রোধ, বেদনা, হতাশা– এসবের অভ্যন্তরীন কথোপকথন মেলে ধরেন। আমরা জানতে পারি রোজানা ওয়ারেনের ভাষ্যে (যিনি একজন বিশিষ্ট মার্কিন কবি) যে, লুইসের প্রাথমিক পর্যায়ের কাব্যে স্থান পেয়েছে ব্যর্থ প্রেম, অপূর্ণ ভালোবাসা, ভেঙে যাওয়া পরিবার, শোক, সন্তাপ, বিরহ, ইত্যাদি। আর শেষের দিকে এসে তিনি খুঁজে পেয়েছেন আত্মিক একাকীত্ব। এই একাকীত্বের সঙ্গে মিশেল দিয়েছেন চিরায়ত মিথ ও উত্তরাধুনিক বিচ্ছিন্নতা।
পরিশেষে, সেই চিরায়ত মিথ ও পৌরাণিক কেচ্ছা প্রচ্ছন্নভাবে ফিরে আসে তার লেখায়; সেটা শুধু ফিরেই আসে না, তারা পাকাপোক্তভাবে জায়গা করে নেয়। আর এসব বিষয়ের মিথস্ক্রিয়া ঘটেছে ‘আভের্নো’য় যেটা তিনি গ্রীক মিথ চরিত্র দেবী পারসেফনের ভাবনাকে ধারণ করে লিখেছেন। আমি ‘ভক্তি পুরাণ’ কবিতাটি ‘আভের্নো’ থেকে নিয়েছি। সেই একই সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, শৈশবে পড়া পুরাণ বারে বারে তার কবিতার রসদ জুগিয়েছে ও পুষ্ট করেছে।
আলোচনার রাশ টানছি গ্লুক প্রসঙ্গে একথা বলে যে তার কবিতা নির্মেদ, নির্বহুল ও খানিকটা নৈর্ব্যক্তিক। এখানে কিন্তু না বললেই না যে গ্লুক এই উত্তরাধুনিক সময়কালে ইংরেজি কবিতায় ‘মিতভাষ’ ধরে রেখে, তথা যথেষ্ট বেসিক ফর্মে রেখে, প্রায় স্বগতোক্তির ছলে শ্লোকের আকারে তিনি কবিতা বলে যান। এই স্বগতোক্তির বিষয়টি চোখ এড়িয়ে যায়নি ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ এর সাহিত্য সমালোচক উইলিয়াম লগানেরও। আমি গ্লুকের কাব্যাদর্শে দেখতে পাই প্রতীকী কবিদের স্বল্পভাষ, ব্যঞ্জনাধর্মী সংহতি, ইন্দ্রিয়ঘনত্ব, নৈর্ব্যক্তিকতা, এবং সর্বোপরি জীবনজারিত অভিজ্ঞতা।
কবি লুইস গ্লুক, আপনাকে অভিনন্দন।
লুইস গ্লুক – এর কবিতা (অনুবাদ – বিপাশা বিনতে হক)
খেয়াল
একটা কথা বলি: প্রতিদিন
মানুষ মারা যাচ্ছে। আর সেটা সবে শুরু।
প্রতিদিন, সন্তাপগৃহে, নতুন বিধবার জন্ম হচ্ছে,
নতুন অনাথের সাথে। ওরা হাত ভাঁজ করে বসে থাকে,
নতুন জীবনটাকে বুঝে নেবার চেষ্টা করে।
তারপর ওরা গোরস্তানে যায়, সেখানে অনেকের
ওটা প্রথমবারের মতো যাওয়া। ওরা কাঁদতে ভয় পায়,
কখনো বা না কাঁদতে। কেউ একজন ঝুঁকে পড়ে
ওদের বলে দেয় এরপর কি কর্তব্য। হতে পারে সেট একটা সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেয়া, ক্ষেত্র বিশেষে খোলা কবরে একমুঠো মাটি ছুঁড়ে দেয়া।
তারপর ওরা সন্তাপগৃহে ফিরে যায়।
হঠাৎ করে দর্শনার্থীতে ফুলে ফেঁপে ওঠে ঘর।
বিধবা ভদ্রমহিলা সোফায় আসন গ্রহণ করেন; একদম রাজকীয় কায়দায়,
আর দর্শনার্থীরা সারিবদ্ধভাবে তার দিকে এগোতে থাকে,
কেউ তার হাত স্পর্শ করে, কেউ তাকে আলিঙ্গন করে,
সকলের জন্য তার কিছু না কিছু বলার থাকে;
তিনি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন, তাকে দেখতে আসার জন্য শুকরিয়া আদায় করেন।
মনে মনে তিনি চান সবাই চলে যাক।
তিনি ফিরে যেতে চান কবরস্থানে;
ফিরে যেতে চান হাসপাতালে, যে ঘরে তার সেবা শুশ্রুষা হতো, সে ঘরে।
তিনি ভালোই জানেন, এসব সম্ভব না। কিন্তু এটাই যে তার একমাত্র আশা,
আশা এই যে আবার যদি পুরোনো সময়ে ফিরে যাওয়া যায়। খুব বেশি পিছনে না,
বিবাহ পর্যন্ত দূরে না, প্রথম চুম্বনের মতো দূরেও না।
ভক্তি পুরাণ (A Myth of Devotion)
হেডিস্ যখন ঠিক করলেন যে তিনি এই মেয়েটির প্রেমে মজেছেন
তিনি তার জন্য একটি বৈকল্পিক পৃথিবী রচনা করলেন,
সবই একরকম রইলো, হুবহু রইলো এর তৃণভূমি,
তাতে শুধু একটি বিছানা সংযোগ করে দিলেন।
সবই এক রইলো, সূর্যালোক সহ, ভাবা কঠিন যে একজন তরুণী
কড়া সূর্যালোক থেকে সহসা ঘুটঘুটে অন্ধকার সহ্য করে নেবে।
ক্রমশ তিনি ভাবলেন যে রাতের সূচনা করবেন,
তাতে অন্ধকারটা উড়ে বেড়ানো পত্রপল্লবের ছায়ার মতো করে দেখাবে শুরুতে।
তারপর আসবে চাঁদ, তারা। তারপর চাঁদহীন, তারাহীন আকাশ।
পার্সিফোন এসবে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হোক।
শেষে তিনি ভাবলেন, এই পরিস্থিতিগুলো সে স্বাভাবিক বলে মেনে নেবে।
একটি বিকল্প পৃথিবী
শুধু ব্যতিক্রম এই যে এখানে প্রেম রয়েছে।
সকলে কি প্রেম কামনা করে না?
বহু বছর তিনি প্রতীক্ষা করলেন,
দুনিয়া সৃষ্টি করা, তার তৃণদলে পার্সেফোনকে নজরে রাখা।
পার্সেফোন গন্ধ শোঁকে, চেখে দেখে স্বাদ।
তোমার যে কোনো এক ধরণের ক্ষুধা থাকা মানেই
সব ধরণের ক্ষুধা থাকা, তিনি মনে করলেন।
প্রতি রাতে সবাই কি চায় না প্রিয় শরীর, কম্পাস, ধ্রুবতারা,
শান্ত নিঃস্বাশ, বলে দেয় আমি বেঁচে আছি,
তার মানে এখনো তুমি বেঁচে আছো,
তুমি আমাকে শুনতে পাচ্ছ, তুমি আমার সাথে আছো।
আর যখন একজন পাশ ফিরে শোয়, অন্যজনও পাশ ফিরে শোয়–
অন্ধকারের দেবতা এসবই ভাবছিলেন,
পার্সেফোনের জন্য সৃজন করা দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে।
এ কথা একবারও তার মনে আসেনি যে
এর মানে এখানে আর কোনো ঘ্রাণ রইলো না,
এখানে আর খানাপিনার তো প্রশ্নই ওঠে না।
অপরাধবোধ? আতঙ্ক? ভালোবাসার ভয়?
তিনি এসব কল্পনাও করতে পারেন না,
কোনো প্রেমিকই এগুলো ভাবে না।
তিনি স্বপ্নে বিভোর থাকেন, ভাবতে বসেন এই দুনিয়াকে কি নামে ডাকবেন।
প্রথমে ভাবেন: নতুন নরক। তারপর: উদ্যান।
পরিশেষে এর নাম রাখেন পার্সেফোনের মেয়েবেলা।
নরম আলো জেগে ওঠে শয্যার পেছনে, ঘাসের সমান করে ছাটা মাথায়।
তিনি তাকে বাহুতে জড়িয়ে নেন।
তিনি বলতে চান আমি তোমাকে ভালোবাসি,
তোমার ক্ষতি করার সাধ্য কারও নেই।
তারপর তিনি ভাবেন
এটি একটি ডাহা মিথ্যে কথা, তাই তিনি বলে ওঠেন
তুমি এখন মৃত, কেউ তোমাকে কষ্ট দেবে না আর
তার কাছে বিষয়টা আরও নতুন, সম্ভাবনাময় ঠেকলো,
আরও সত্য দেখালো।
নিশীথ পরিযান
এখনই সেই মুহূর্ত যখন তুমি আবারও দেখতে পাও
পাহাড়ের ছাইয়ে জন্মানো লাল জাম
আর অন্ধকার আকাশে
পাখিদের নৈশকালীন পরিযাণ।
আমি মুষড়ে পড়ি, ভাবি
মৃতেরা এই দৃশ্য আর দেখতে পাবে না ;
আমরা নির্ভর করি এসবে,
এরা মিলিয়ে যায়।
কি করলে তবে প্রাণে সান্ত্বনা পাবো?
নিজেকে বলি হয়তো ওদের এসব বিলাসিতা লাগে না;
হয়তো কিছু না হয়ে থাকাটাই যথেষ্ট,
যদিও তা কল্পনায় আনা কঠিন।
রোদ্দুরের এমন ঝিলিক
বরফগুলোও হিরের মতো জ্বলছে,
জীবন আলো-হাসি হাসছে আর
উষ্ণতায় ভরে আছে আমার সর্বস্ব।
কার ইঙ্গিতে এত আলো, এত হাসি
কে এই আনন্দের কারিগর!
কাঁধের ওপর দিয়ে বরফ ছুড়ে দিলাম
এরা সব আমারই থাকুক।
তবু মেঘ জমেছে কার্বনের মতো
ফিরে আসছে ভয়ংকর কালো
কোথায় হারাল আনন্দ আর আলো!
সূর্যের কাছে হাত পেতেছিলাম, শান্তির কাছেও
এই তো ছিল; এই নেই।
আনন্দ শব্দটা ধুলোজমা শব্দের মতো অতীতে হারালো…
অনেক দিন তাকে খুঁজে পাই না।
সুখ
দুজন শুয়ে আছে রাত্রির কোলে
সাদা বিছানার চাদরে শুয়ে আছে দুজন মানুষ।
ভোর খুব কাছে,
এইবার ওদের ঘুম ভাঙবে
মাথার কাছে লিলি জাগছে ফুলদানিতে
সূর্যের আলো ওদের পানপাত্রে তৈরি—
এখনই চুমুক দেবে।
পুরুষটি পাশ ফিরল, কোমল স্বরে ডাকল সঙ্গীকে
পর্দাটা দুলে উঠল, গেয়ে উঠল পাখিরদল
নারীটি এবার পাশ ফিরল, আর তার সর্বাঙ্গ
তপ্ত হলো সঙ্গীর নিঃশ্বাসে।
চোখ খুললাম আমি…
সূর্যেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরময়
আমি তোমার মুখের দিকে তাকালাম,
আয়নায় দেখতে পেলাম আমাকেই।
আমরা স্থির; শুধু সূর্যটা আমাদের
যেতে থাকল পেরিয়ে, আলো ছড়াতে ছড়াতে।
লুইস গ্লাকের আরও একগুচ্ছ কবিতা
ভাষান্তর: পান্থজন জাহাঙ্গীর
সতর্কবার্তা
প্রেমে পড়ে আমি অপরাধী হয়েছি।
তার আগে ছিলাম একজন পরিচারিকা ।
আমি তোমার সাথে শিকাগো যেতে চাইনি।
আমি তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম,
আমি চেয়েছিলাম তোমার স্ত্রীকে কষ্ট দিতে।
আমি চেয়েছিলাম তার জীবন যেন নাটকের মতো হয়
যার সমস্ত অংশ ট্রাজেডিতে ভরা।
একজন ভাল ব্যক্তি এভাবে ভাববেন?
আমি ভেবেছিলাম
এটা আমার সাহসের কৃতিত্ব –
আমি তোমার সামনের বারান্দায় অন্ধকারে বসে ছিলাম।
আমার কাছে সবকিছু পরিষ্কার ছিল:
যদি তোমার স্ত্রী তোমাকে যেতে না দেয়
সেটি প্রমাণ করে যে সে তোমাকে ভালোবাসেনি।
যদি সে তোমাকে ভালবাসতো
সে কি তোমাকে খুশি করতে চাইবে না?
আমি এখন ভাবি
আমি যদি সামান্য চিন্তা করলেও তবে ভাল ব্যক্তি হতাম।
তবে আমি ছিলাম একজন ভাল পরিচারিকা।
আমি একসঙ্গে আট রকম পানীয় বহন করতে পারি।
আমি তোমাকে আমার স্বপ্নগুলি বলতাম।
গতরাতে আমি দেখলাম একজন মহিলা
একটি অন্ধকার বাসে বসে আছে –
স্বপ্নে, সে কাঁদছে,যে বাসটিতে রয়েছে সেটি
দূরে সরে যাচ্ছে । এক হাত
সে দোলাচ্ছে; অন্যটাতে
বাচ্চাভর্তি একটি ডিমের বাক্স।
স্বপ্ন মেয়েটিকে উদ্ধার করে না।
স্বর্গীয় সংগীত
আমরা দেখতে পেলাম একটি শুঁয়োপোকা ময়লার মধ্যে মরছে,
লোভী পিঁপড়াগুলি তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
আমি দুর্যোগ কখনো আমার পিছু ছাড়েনি,
প্রাণশক্তির বিরোধিতা করতে আমি সর্বদা আগ্রহী
তবে ভীরুও, দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেলি
আমার বন্ধুটি ইভেন্টগুলি চালিয়ে যেতো,
স্বভাবতই দেখতে দেখতে সক্ষম হয়েছিল ।
আমার জন্য সে হস্তক্ষেপ করেছিল
ছেঁড়া জিনিসটি থেকে কয়েকটি পিঁপড়া ব্রাশ করে
সাজিয়ে রেখেছিল রাস্তা বরাবর.
আমার বন্ধু বলে যে,
আমি নাকি ঈশ্বরের দিকে চোখ বন্ধ করে রেখেছি,
যা অন্য কোনও কিছুই ব্যাখ্যা করে না
বাস্তবে আমার বিরক্তি।
সে বলে, আমি যেন শিশুদের মতো
বালিশে মাথাটা পুড়িয়ে রাখি
যাতে দেখা যায় না যায়,যে শিশুটি নিজেকে বলে
সেই সামান্য দুঃখ নিয়ে আসছিল-
আমার বন্ধুটি মায়ের মতো।
ধৈর্য, আমাকে অনুরোধ করেছিল
নিজের মতো একজন প্রাপ্তবয়স্কের মতো জেগে ওঠতে,
সাহসী ব্যক্তির মতো-
আমার স্বপ্নে,আমার বন্ধু আমাকে তিরস্কার করে।
আমরা একই রাস্তায় হাঁটছিলাম, শুধু শীতকাল ব্যতীত;
সে আমাকে বলছে যে যখন তুমি বিশ্বকে ভালোবাসো
তখন তুমি স্বর্গীয় সঙ্গীত শুনতে পাও
তাকাও,সে বলে।
আমি যখন তাকাই, কিছুই দেখি না।
কেবল মেঘ,তুষার, গাছে একটি সাদা আচল
নববধূগুলি একটি দুর্দান্ত উচ্চতায় লাফিয়ে পড়ার মতো-
তারপরে আমি তার জন্য ভয় পাই; আমি তাকে দেখেছি
ইচ্ছাকৃতভাবে পৃথিবীর উপর ফেলে দেওয়া জালে ধরা পড়ে যায়-
বাস্তবে আমরা রাস্তার পাশে বসে সূর্যাস্ত দেখছি;
মাঝেমাঝে একটি পাখির কাকলিতে মৌনতার ব্যবচ্ছেদ হয়।
এই মুহুর্তে আমরা সত্যটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি
যে আমরা নির্জনে মৃত্যুর সাথে স্বাচ্ছন্দ্যে আছি।
আমার বন্ধু ময়লার মধ্যে একটি বৃত্ত আঁকে;
ভিতরে,শুঁয়োপোকা নড়াচড়া করে না।
তিনি সর্বদা কিছু সুন্দর,একটি চিত্র তৈরির চেষ্টা করছে
তার থেকে পৃথক জীবনের সক্ষম।
আমরা খুব শান্ত ।
এটি শান্ত এখানে নৈঃশব্দ বিরাজ করে,শুরের মূর্চনাটি স্থির,
রাস্তা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে যায়, বাতাস শীতল হচ্ছে,
এখানে সেখানে শিলাগুলি চকচকে এবং ঝকঝক করছে-
এই নৈঃশব্দকে আমরা উভয়েই ভালবাসি।
রূপের ভালবাসাই সমাপ্তির ভালবাসা।
শীতের শেষে
স্থির বিশ্ব জুড়ে,একটি পাখি ডেকে যায়
কালো ডালের মধ্যে একাকী জেগে।
তুমি জন্ম নিতে চেয়েছিলে;
আমি তোমাকে জন্ম দিতে দেই
তোমার আনন্দের পথে?
আমার দুঃখ কবে থেকে গেছে?
আলো-আধারিতে সামনে ডুবে গিয়ে
একই সময় সংবেদনের ইচ্ছারা জাগে
যেমন ছিলে নতুন কিছু তুমি
চেছেয়েছিলে সমস্ত উচ্ছ্বলতা ও উজ্জ্বলতায়
নিজেকে জানান দিতে
কখনই ভাবছি না
এটি তোমার জন্য কিছুর মূল্য হবে,
কখনই কল্পনা করছি না আমার কণ্ঠের শব্দটি
কোন কিছুর মতো তোমার অংশ হবে-
অন্য পৃথিবীতে তুমি শুনতে পাবে না,
স্পষ্টও নয় আবার,
পাখির ডাকে বা মানুষের বিলাপে,
কেবল পরিষ্কার শব্দ নয়
অবিরাম প্রতিধ্বনি
সমস্ত রব যার অর্থ হল বিদায়, বিদায়
একটি অবিরাম মিছিল
আমাদের একে অপরকে বেঁধে ফেলে।
উপত্যকাটি
বহু বছর ধরে,তাদের দেহ থেকে
ধীরে ধীরে পশম, অদৃশ্য হয়ে গেল
উজ্জ্বল আলোতে তারা না দাঁড়ানো পর্যন্ত
পরস্পরের কাছে ছিল তারা আগুন্তক।
আগের মতো কিছুই ছিল না।
তাদের হাত কাঁপছিল পরিচিত হওয়ার জন্য।
সফেদ মাংস থেকে
তারাও চোখ রাখতে পারেনি
যেটি স্পষ্টভাবে আহত করেছিল
একটি পৃষ্ঠায় শব্দের মতো।
এবং অর্থহীন বাদামী সবুজ থেকে
অবশেষে ঈশ্বর জেগে উঠলেন,
তাঁর মহান ছায়া তাঁর সন্তানদের নিদ্রিত দেহগুলি
অন্ধকার করে দিয়ে, তারপর স্বর্গে লাফ দিলেন।
কী সুন্দর! মর্ত্য প্রথমবারের মতো
আকাশ থেকে দেখেছে,
দ্য ওয়াইল্ড আইরিস
আমার কষ্টের শেষে
একটি দরজা ছিল।
আমার কথা শোনে: যাকে তুমি মৃত্যু বলেছো
আমার মনে পড়ে ।
মাথার উপর,স্থানান্তরিত পাইনের ডালপালাগুলির আলোড়ন।
তারপর কিছুই নেই।
মৃদু সূর্য শুকনো পৃষ্ঠের উপরে ঝাঁকুনি দিয়ে যায়।
বেঁচে থাকা ভয়ঙ্কর
মনে হয় অন্ধকার পৃথিবীতে সমাহিত হলাম।
তারপর এর শেষ হলো: যা তোমরা ভয় করছো
একটি অক্ষম আত্মা হতে, কথা বলতে,
হঠাৎ শেষ হয়ে,কঠিন পৃথিবীকে
একটু বাঁকাতে।
আর আমি পাখি হয়ে
নীচু ঝোপঝাড়ে ছুটাছুটি করছি।
তোমরা যারা অন্য পৃথিবী থেকে
উৎসারিত পথ মনে রেখ না
আমি তেমাদেরকে বলি
আমি আবার কথা বলতে পারব:যাই হোক না কেন
বিস্মৃতি থেকে ফিরে আসে
একটি শব্দকে খুঁজে নিতে:
আমার জীবনের কেন্দ্র থেকে
একটি দুর্দান্ত ঝর্ণা প্রবাহিত হল
নীচে সমুদ্র জলের, গাঢ় নীল ছায়া।
লুইস গ্লুক’এর আরও কিছু কবিতা ::
ভাষান্তর : লায়লা ফারজানা
শুরুতে একটি ভূমিকা—
আর তারপর অব্যবহৃত, কবর।
দূরের দ্বীপে,আমার মায়ের হাতে
ছোট্ট কেকের প্লেট—
যতদূর মনে পড়ে, সেই অবিকল—
বদলায়নি একটুও,
উজ্জ্বল আর অক্ষত সেই মুহূর্ত—
রোদে ঝলসে যায়নি একটুও,
তাই আমি জেগে উঠেছি, সুখে,
এ বয়সেও জীবনের প্রতি ক্ষুধা
আর পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে—
টেবিলের পাশে নতুন ঘাসের ফালি,
ফ্যাকাশে সবুজের টুকরা হয়ে
গাঢ় মাটির রঙে মিশে যায়।
আমি নিশ্চিত বসন্ত আবার ফিরে এসেছে
আমার কাছে,
এবার প্রেমিক হয়ে নয়, মৃত্যুর বার্তাবাহক হয়ে,
তবুও যে বসন্ত
তাই বুঝি কোমল।
ইচ্ছাটি (The Wish)
মনে আছে সেই সময়টা? যখন তুমি কিছু ইচ্ছা করেছিলে?
আমারও অনেক কিছু চাওয়ার আছে।
সেই সময় আমি তোমাকে যে প্রজাপতিটার কথা বলেছিলাম
সেটা মিথ্যা ছিল। আমি সব সময় ভাবতাম
তুমি কী চাও? তুমি কী চেয়েছিলে সেদিন?
তুমি কী মনে কর? আমি কী চেয়েছিলাম?
আমি জানি না।
যে আমি ফিরে আসব কিনা,
যে আমরা শেষ পর্যন্ত একসাথে থাকব কিনা।
আমি তাই চাই—যা সব সময় চেয়েছি ।
আমি চেয়েছিলাম
অন্য একটি কবিতা।
রূপালি পদ্ম (The Silver Lily)
আবারও রাতগুলো শীতল,
প্রথম বসন্তের রাতের মতো, আবারও শান্ত।
কথা বললে কি বিরক্ত হবে?
আমরা এখন একা;
আমাদের চুপ থাকার কোনও কারণ নেই।
তুমি কি দেখতে পাচ্ছ, বাগানে পূর্ণিমার চাঁদ।
পরের পূর্ণিমা আমার আর দেখা হবে না।
বসন্তে, যখন চাঁদ উঠেছিল,
তখন সময় ছিল অফুরন্ত।
সাদা জলপ্রপাতের মতো ঝরছিল
তুষারের ফুলকুঁড়ি আর মেপলবীজের গুচ্ছ।
সাদার ওপর সাদা, বার্চ গাছের উপরে সাদা চাঁদ।
আর সে বৃত্তাকার চক্রে, যেখানে গাছটি,
চাঁদের নরম সবুজ-রূপালি আলোয়,
খণ্ডিত ছিল প্রথম ড্যাফোডিলের পাতা।
অনেক দূরে চলে এসেছি আমরা একসাথে—
জীবনের একদম শেষ প্রান্তে—শেষের ভয় করেছে গ্রাস।
এমনকি এই রাতগুলিতে, আমি এখনও নিশ্চিত নই সমাপ্তির অর্থ কী।
আর তুমি, যে ছিলে একজন পুরুষের সাথে—
প্রথম কান্নার পর,
আনন্দও কি ভয়ের মতো
নিশ্চুপ হয়ে যায় না?
সান্ধ্যকালীন প্রার্থনাগুলো (Vespers)
তোমার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে, তুমি আমাকে দিয়েছ
পৃথিবীকে ব্যবহারের অনুমতি, প্রত্যাশিত বিনিয়োগে কিছু ফেরৎ।
অবশ্যই আমাকে বিবৃত করতে হবে আমার ব্যর্থতা,
মুখ্যতঃ টমেটো গাছগুলো সম্পর্কে।
আমি মনে করি আমাকে টমেটো-চাষাবাদে
উৎসাহিত করা উচিত নয়।
আর যদিও বা করি,
তোমাকে প্রতিরোধ করতে হবে প্রবল বৃষ্টি,
শীতল রাত—যা এখানে প্রচলিত—প্রায়ই আসে
অন্য অঞ্চলে যখন গ্রীষ্মের বারো সপ্তাহ।
এই সবই তোমার;
অথচ বীজ রোপণ করেছি আমি,
মাটি ছিঁড়ে ডানা মেলার মত প্রথম অঙ্কুর দেখেছি আমি,
এবং ওটা ছিল আমার হৃদয়—ব্লাইটের আঘাতে ভাঙা,
গুণিতক হারে বাড়ছিল কালো দাগগুলি—কাতারে কাতারে।
আমি জানি, সে বোধকে বোঝার মতো হৃদয় তোমার নেই।
আমি জানি, তোমার মতো যারা—
মৃত আর জীবিতের মধ্যে কোনও তফাৎ করো না
পূর্বাভাসে তারা দায়মুক্ত, নিরাপদ।
অথচ তুমিই জান না কতটা ত্রাস আমরা বুক পেতে নিই,
কতটা সন্ত্রাস সহ্য করি,
কতটা আতঙ্কিত হই পাতায় একটি সামান্য ক্ষতে,
এমনকি হেমন্তের প্রথম অন্ধকারে;
যখন মেপলের লাল পাতা ঝরে; আমি দায়বদ্ধ—
সেই ঝরা লতাগুলোর কাছে।
বুনো আইরিস (The Wild Iris)
আমার তীব্র কষ্টের শেষে ছিল একটি খোলা দরজা।
আমার কথা শুনুন: আমি মনে করি সেটিই ছিল যাকে আপনারা বলেন— মৃত্যু।
ঊর্ধাকাশে, আওয়াজ, স্থানান্তরিত পাইনের শাখা। তারপরে কেবল শূন্যতা।
খরখরে ভূ-পৃষ্ঠে দুর্বল সূর্যের ঝাপসা আলোর আভা।
তাই ভয়াবহ এই বেঁচে থাকা
অন্ধকার পৃথিবীতে সমাহিত যখন চেতনা ।
তারপরে সমাপ্তি : যা আপনাদের ভয়,
একটি আত্মা এবং অক্ষম কথা বলার চেষ্টা,
হঠাৎ ফুরিয়ে যাওয়া, দুর্ভেদ্য পৃথিবীর একটু শিথিলতা ।
আর আমি হতে চেয়েছি বুনোলতার নীচু ঝোপে
তীরবিদ্ধ পাখিদের মতো।
আমি বলছি, আপনারা ভুলে গেছেন সেই পথ,
ছিন্ন করেছেন এই পৃথিবীর সাথে সেই পৃথিবীর যোগাযোগ।
তবুও
আমি আবারও বলতে চাই:
বিস্মৃতি থেকে ফিরে আসা একটি কণ্ঠস্বর,
একটি আওয়াজকে খুঁজে পেতে:
আমার জীবনের কেন্দ্র থেকে
উৎসারিত একটি অদম্য ঝর্ণা,
গভীর নীল সমুদ্রে গভীর নীল ছায়া।
* লুইস গ্লুক এর আরও কিছু কবিতা
অনুবাদঃ অনিমিখ পাত্র
১).
নকটার্ন
মা মারা গেছে গত রাতে,
মা যে কখনও মরে না।
শীতকাল ছিল বাতাসে
এখনও অনেক দূর
কিন্তু তবুও শীতকাল ছিল বাতাসে।
মে মাসের দশ তারিখ ছিল
হায়াসিন্থ আর আপেল ফুল
ফুটেছিল পেছনের বাগানে।
আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম
মারিয়া গান গাইছে চেকোশ্লোভাকিয়া থেকে –
আমি কত একা –
এই ধরণের গান।
আমি কত একা
মা নেই, বাবা নেই –
আমার মাথা যেন কী ফাঁকা তাদের ছাড়া
সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে মাটি থেকে;
থলাবাসনগুলো সিঙ্কে,
ধোওয়া কিন্তু এখনও গুছিয়ে রাখা হয়নি।
পূর্ণ চাঁদের নিচে
মারিয়া কাচা জামাকাপড় ভাঁজ করছিল
শক্ত কাপড়গুলো হয়ে গেল
শুকনো সাদা জ্যোৎস্নার আয়তক্ষেত্র।
আমি কী একা, কিন্তু সঙ্গীতে
আমার একাকীত্বই আমার আনন্দ।
সেটা ছিল মে মাসের দশ তারিখ
ঠিক যেমনটা ছিল ন’তারিখ, আট তারিখ।
মা তার বিছানায় ঘুমোচ্ছিল
তার হাতগুলো ছড়ানো, তার মাথা
তার মাঝখানে ভারসাম্যে রাখা।
২).
মা ও শিশু
আমরা সবাই স্বপ্নদ্রষ্টা, আমরা জানি না আমরা কারা
কোনো মেশিন আমাদের তৈরি করেছিল, এই দুনিয়ার মেশিন, বেঁধে রাখা পরিবার।
নরম চাবুকে ঘষামাজা হয়ে, তারপর দুনিয়ায় ফেরৎ যাওয়া।
আমরা স্বপ্ন দেখি; আমরা মনে রাখি না।
পরিবারের মেশিনঃ অন্ধকার লোমশ ফার, মাতৃদেহের অরণ্য
মায়ের মেশিন মায়ের ভেতরে সাদা শহর।
এবং তার আগে মাটি আর জল।
পাথরের মাঝে মস, পাতা আর ঘাসের টুকরো।
আরও আগে বিরাট অন্ধকারের মধ্যে কোষগুচ্ছ
এবং তারও আগে পর্দাঢাকা পৃথিবী।
এই কারণেই তোমার জন্মঃ আমাকে চুপ করিয়ে দেবার জন্য।
আমার মায়ের আর বাবার কোষ, এখন তোমার পালা
মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠার, মাস্টারপিস হয়ে ওঠার।
আমি সহসা উদ্ভূত, আমি কক্ষনও মনে রাখিনি।
এখন তোমার চালিত হওয়ার পালা;
তুমিই সে যার জানবার দাবি আছে
আমি কেন কষ্ট পাই? আমি কেন কিছু জানি না?
বিরাট অন্ধকারে স্থিত কোষগুচ্ছ। কোনো মেশিন আমাদের তৈরি করেছিল।
এবার তোমার ডাক দেবার পালা, জিজ্ঞেস করার পালা
কীসের জন্য আমি? কীসের জন্য আমি?
৩).
শীতের শেষে
স্থির এই পৃথিবীতে, কালো বৃক্ষশাখার মধ্যে
একা জেগে উঠে ডাকে পাখি।
জন্ম নিতে চেয়েছিলে তুমি, আমি তোমাকে জন্ম নিতে দেব।
তোমার খুশির পথে কখনই বা
আমার শোক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলো?
একইসঙ্গে ডুবে গিয়ে অন্ধকার আর আলোয়
সংবেদনের জন্য উন্মুখ
যেন তুমি নতুন একটা জিনিস, নিজেকে
প্রকাশ করতে চাইছ
সব চমৎকারিত্ব, সব প্রাণবন্ততা
কখনও ভাবনি
যে তোমাকে কিছু মূল্য চোকাতে হতে পারে,
তুমি কখনও কল্পনা করোনি আমার কন্ঠস্বর
তোমার অংশ ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে –
অপর জগতে তুমি তাকে শুনতে পাবে না
আর কক্ষনও পরিষ্কারভাবে পাবে না,
কোনো পাখির ডাকে বা মানুষের কান্নায়।
কোনো পরিষ্কার আওয়াজ নয়, কেবল
সমস্ত শব্দের
নাছোড় প্রতিধ্বনি
যার মানে বিদায়, বিদায় –
এক অবিচ্ছিন্ন রেখা
যা আমাদেরকে একে অপরের সঙ্গে বেঁধে রাখে।
অনুবাদ : খোরশেদ আলম
কৃতজ্ঞতা
আমার প্রতি তোমার এতটুকু করুণার জন্য
মনে করো না যে আমি কৃতজ্ঞ নই।
আমি খর্বাকৃতির করুণা পছন্দই করি,
বরং বৃহৎ আকারের চেয়েও
এইসব করুণা আমার বেশিই প্রিয়,
যা তোমাকে চোখে চোখে রাখে,
নেকড়ের জ্বলজ্বলে দৃষ্টির মতো,
অপেক্ষায় জাগিয়ে রাখে
দিনের পর দিন
নিঃশেষ হবার আগ পর্যন্ত।
বিদায়
চোখ ভরা জল নিয়ে
বাবা দাঁড়িয়ে আছেন প্ল্যাটফর্মে
জানালার দৃষ্টি গলে তাঁর মুখমণ্ডলে
নিবুনিবু আলো— যেন অতীতের
ভুলে যাওয়া অন্য একজন।
তার ছায়া মুখে মেখে নিয়ে
সহসাই তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন
আর মন দিলেন পাঠে।
জীবনের অভ্যস্ত রুটিনে অপেক্ষার
ট্রেন সেখানে ধোঁয়াটে নিঃশ্বাস ছাড়ে।
অনুবাদ: সুজিত মান্না
শিকারি
অন্ধকার রাত – রাস্তাগুলি ঘিরে ধরে আছে কতকগুলি বিড়াল
বিড়াল এবং তাদের শিকারসামগ্রী –
বিড়ালগুলি তার পাহাড়ি পূর্বপুরুষের মতই দ্রুত দৌড়োতে পারে
ঠিক তাদের মতই ক্ষুধার্ত।
কোথাও কোনো চাঁদ নেই। রাত্রিটা ঠান্ডা হয়ে আছে–
এই রাতকে উত্তাপ দেওয়ার জন্য কোনো চাঁদ জেগে নেই। গ্রীষ্ম বেরিয়ে গেছে পথে অনেক দূর
অনেক শিকার-ই বাকি পড়ে আছে
ইঁদুরগুলি বসে আছে শান্ত হয়ে, বিনিদ্র ঠিক বিড়ালগুলির মতো।
এই বাতাসের গন্ধ নাও – এই নিশ্চল রাত এক ভালোবাসার রাত
ক্ষণে ক্ষণে রাস্তার ভেতর চিৎকার উঠে আসছে
যেখানে বিড়ালগুলি তাদের দাঁত বসিয়ে দিচ্ছে ইঁদুরগুলির পায়ে
যখনই ইঁদুরগুলি চিৎকার তুলছে, তাদের মৃত্যু হচ্ছে। এই চিৎকার যেন একটি নকশা
এমন একটি নকশা যেটা বিড়ালগুলিকে বলে দিচ্ছে কোথায় বসাতে হবে থাবা।
তারপর সেই সব চিৎকার জুড়ে উঠে আসছে মৃত্যু
এমনই এক রাতের ভেতর তুমি ভালোবাসা পাচ্ছো – এ বড়ো সৌভাগ্যের
তোমার শরীর বিছানায় বিবস্ত্র হয়ে শুয়ে থাকার মতো উত্তাপ নিয়ে বসে আছে
ঘামছে – এসব কিছু তো পরিশ্রম, ভালোবাসার ফল, ভুলে যাও মানুষ কী কী বলে ফিসফাস করে
মৃত ইঁদুরগুলি পড়ে আছে রাস্তার ওপর – বিড়ালগুলি তাদের দেহ রেখে গেছে এখানেই
খুশি হও তোমাকে আজ এই রাস্তার ওপর থাকতে হয়নি
এখনই রাস্তাপরিষ্কারকরা এসে তাদের সরিয়ে দেবে। সূর্য উঠলেই কেউ আর এইসব দেখে হতাশ হবে না
সূর্য উঠলেই পরবর্তী দিন ও রাতের জন্য আবার সুন্দর হয়ে উঠবে রাস্তাগুলি
শুধু খুশি হও তুমি বিছানায় আছো
যেখানে ভালোবাসার চিৎকারগুলো ডুবিয়ে রাখছে সমস্ত মৃত্যুর শব্দগুলিকে
সূর্যাস্ত
সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথেই একজন খামার-শ্রমিক মৃত পাতাদের পুড়িয়ে ফেলছে
এটি এমন কোনো বড়ো ঘটনাই নয়, একটুকু আগুনই তো শুধু
স্বৈরাচারী শাসকের হাতে লালিত একটি পরিবারের মতো নিয়ন্ত্রিত ছোট একটি জিনিস মাত্র,
তবুও, যখনই এটা জ্বলে উঠছে, শ্রমিকটি উধাও হয়ে যাচ্ছে
রাস্তার ওপর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সে
সূর্যের তুলনায় এইসব আগুন নেহাতই ক্ষণজন্মের এবং কোনোদিনই তারা পেশাদার হতে পারবে না –
যোগান শেষ হয়ে এলে তাদের মৃত্যু দাঁড়িয়ে দেখি।
তারপর লোকটি আবার ফিরে আসে – ছাইগুলিকে একজোট করে।
এইসব কিছুর পরেও মৃত্যুই একমাত্ৰ সত্য।
যেন মনে হয় – সূর্য যে জন্য এসেছিল, সব কাজ শেষ করে ফেলেছে
জমিতে শস্যদের বাড়তে দিয়েছে – তারপর তাদের পুড়ে যেতে
উদ্বুদ্ধ করে গেছে
তাই সূর্যের এখনই চলে যাওয়ার সময় এসেছে।
জ্বলে থাকা পাতা
শুকনো পাতারা দ্রুত আগুনে জ্বলে যায়।
তারা পুড়ে যায় দ্রুত, ক্ষণিকের মধ্যেই
কোনো একটি অবস্থা থেকে শূন্যতে এসে থামে
এখন মধ্যদুপুর। নীল আকাশটা ঠান্ডা হয়ে আছে
আগুনের নীচে ধূসর হয়ে আছে পৃথিবী
যত দ্রুত এগুলো হারিয়ে যাবে, পৃথিবীর ধোঁয়া ততটাই তাড়াতাড়ি পরিস্কার হয়ে আসবে
পাতার স্তুপ করা জায়গাটিতে
হঠাৎ এই শূন্যতাটিকেই বিশাল আকারের মনে হবে
রাস্তা বরাবর দাঁড়িয়ে একটি ছেলে এইসব দেখছে
দীর্ঘ সময় ধরে সে এই পাতাদের পুড়ে যাওয়া দেখে চলেছে
হয়তো এভাবেই তুমিও পৃথিবীটাকে মরে যেতে দেখবে–
দেখবে এটা এভাবেই জ্বলে যাচ্ছে।
অনুবাদ: অমিতাভ পাল
অনুভূতি থাকা
লাল পপি মন না থাকলেও হয়, বড় কথা হলো- অনুভূতি থাকা; আমার সেগুলি আছে এবং ওরাই আমাকে চালায়। স্বর্গে আমার প্রভুর নাম সূর্য, আমি আমার হৃদয়ের আগুন তাকে দেখাই- এই আগুনই আমার ভিতরে তার উপস্থিতির কথা বলে। কিন্তু যদি হৃদয় না থাকে তাহলে? ভাই বোনেরা- মানুষ হবার বহু আগে আমাকে কি পছন্দ করেছিলে তোমরা? তোমরা কি নিজেকে খোলার অনুমতি দিয়েছিলে এবং তারপর আর কখনো খোলোনি? এটা এজন্যই বলছি, কারণ এখন তোমাদের মতোই আমি কথা বলি। আমি কথা বলি কারণ আমি ছিন্নভিন্ন।
অনুবাদ: নন্দিনী সেনগুপ্ত ইচ্ছে
(‘দ্য উইশ’ কবিতা অবলম্বনে লেখা)
মনে আছে তোমার, সেবারে তুমি ঠিক কি কামনা করেছিলে? আমি গুচ্ছের জিনিসের জন্য মানত করি, মনে মনে সংকল্প করি। সেবারে ঐ প্রজাপতির ব্যাপারে আমি তোমাকে মিছে কথা বলেছিলাম। আমি সবসময় আশ্চর্য হয়ে ভাবি যে তুমি ঠিক কী কারণে মানত করো! আমি কী চেয়েছি তুমি জানো? কী ভেবেছ? নাহ, আসলে আমিও ঠিক জানিনা। ভাবি ফিরে আসবো। ভাবি শেষমেষ যেভাবেই হোক, আমাদের মিলন হবে। অবশ্য আমি সেটাই চেয়েছিলাম, যেটার জন্য আমি সবসময় মানত করে থাকি। আমি আরেকটা কবিতা চেয়েছিলাম।
অনুবাদ: ফারহানা আনন্দময়ী
সুখ
দুজন শুয়ে আছে রাত্রির কোলে সাদা বিছানার চাদরে শুয়ে আছে দুজন মানুষ। ভোর খুব কাছে, এইবার ওদের ঘুম ভাঙবে মাথার কাছে লিলি জাগছে ফুলদানিতে সূর্যের আলো ওদের পানপাত্রে তৈরি— এখনই চুমুক দেবে। পুরুষটি পাশ ফিরল, কোমল স্বরে ডাকল সঙ্গীকে পর্দাটা দুলে উঠল, গেয়ে উঠল পাখিদল নারীটি এবার পাশ ফিরল, আর তার সর্বাঙ্গ তপ্ত হলো সঙ্গীর নিশ্বাসে। চোখ খুললাম আমি… সূর্যেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরময় আমি তোমার মুখের দিকে তাকালাম, আয়নায় দেখতে পেলাম আমাকেই। আমরা স্থির; শুধু সূর্যটা আমাদের যেতে থাকল পেরিয়ে, আলো ছড়াতে ছড়াতে।
অনুবাদ: অহ নওরোজ
অল হ্যালোজ
এমনকি এখন দৃশ্যগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে
অন্ধকার হয়ে আসছে পাহাড়,
ষাঁড়গুলো তাদের নীল জোয়ালে নুয়ে পড়ছে।
মাঠগুলো যেন গুছিয়ে রাখা।
নতুন চাঁদ উঠছে বলে
চারপাশে ফুটেছে হলুদ সিঙ্কফয়েল—
তার ভেতর পথের সীমানায়
গাদা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভেড়াগুলো।
ফসলের বিরানকাল আসে এভাবে,
যেনবা মড়ক লেগেছে।
মহিলারা জানালায় ঝুঁকে এসে বাড়াচ্ছে হাত
কিছু পাওয়ার আশায়—
আর শস্য ও মুদ্রাগুলো ডাকছে তাদের
এদিকে এসো, এদিকে এসো
গাছ থেকে আত্মা বেরিয়ে আসে শিরশির করে।
ডিসেম্বরের শুরুতে ক্রোটন-অন-হাডসনে*
ম্লান রোদে হাডসনের
বরফ জমে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।
হাড়ের ভেতর শুনছি ঠনঠন শব্দ—
মাত্রই ঝরে যাওয়া ধূসর বরফগুলো
নদীর পশম হয়ে গেছে, স্থির।
গত বছর যেদিন গাড়ির চাকা অচল হয়েছিলো
আজ ঠিক সেদিনই ছুটছি আমরা
ক্রিসমাসের উপহার বিলাতে।
প্রবল ঝড়ে তারের উপর
ভেঙে পড়েছে পাইনের ডালপালা…
আমি তোমাকে চাই।
*ক্রোটন-অন-হাডসন একটি স্থানের নাম।
(এ ছাড়াও আরও কিছু অনুবাদ কবিতা লুইস গ্লৃক-এর)
১).
সুখ
একটি সফেদ শয্যায় একজন মানব ও মানবী শুয়ে আছে।
এটা ভোর,আমি মনে করি
শীঘ্রই তারা জেগে উঠবে,
শয্যার পাশে টেবিলের উপর একটি ফুলদানি।
শালুকের সূর্যালোকে
তাদের গলায় ঝর্ণা বয়ে যায়,
তার দিকে ঘুরে আমি তাকে দেখি
যেন তার নাম ধরে ডাকি।
কিন্তু নৈঃশব্দের গভীরে তার মুখ-
জানালার শার্শীতে
একসাথে একবার, দুবার,
একটি পাখি ডাকছে,
এবং তারপর সে আড়মোড়া দিয়ে জাগে
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে ভরে নেয় দেহ,
আমি চোখ খুলছি, তুমি আমাকে দেখছো।
প্রায় পুরো কক্ষে
রোদ ঝলমলে।
তোমার মুখের দিকে তাকাতে বললে,
তোমাকে ছুঁয়ে নিজেকে আয়না বানাতে
আরও কাছে এনে রেখেছি,
তুমি কত শান্ত!
এবং বামিং হুইল রোডটি আলতো করে আমাদের উপর দিয়ে চলে যায়।
২)
.তুষারপাত
তুমি কি জানো আমি কী ছিলাম, কেমন ছিলাম?
তুমি জানো হতাশা কি? তারপর তোমার জন্য
শীতের অর্থ থাকা উচিত।
আমি বেঁচে থাকার আশা করিনি,
পৃথিবী আমাকে দমন করছে। আমি আশা করিনি.
আবার জেগে ওঠার, অনুভব করার,
স্যাঁতসেঁতে পৃথিবীতে আমার দেহ
স্মরণ করে আবার সাড়া দিতে সক্ষম হবে।
এতদিন পর আবার কীভাবে খুলবো
শীতল আলোতে
নব বসন্ত,
ভয় করছো,এখনও,কিন্তু আবার তোমার মধ্যে
বিলাপ, হ্যাঁ,বিপদের মধ্যে আনন্দও আছে
নতুন বিশ্বের দুর্মর বাতাসে।
৩).
আদিম অন্ধকার
তোমরা কিভাবে বলতে পারো
পৃথিবী আমাকে আনন্দ দেবে?
প্রতিটি জিনিসই আমার বোঝা
আমি তোমাদের সবার সাথে সফল হতে পারি না।
এবং তোমরা আমাকে থামিয়ে দিতে চাও,
তোমরা আমাকে বলতে চাও
তোমাদের মধ্যে কে সবচেয়ে মূল্যবান,
কে আমার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
এবং তোমরা একটি উদাহরণ হিসাবে তুলছো
বিশুদ্ধ জীবন বিচ্ছিন্নতা অর্জনের তোমরা সংগ্রাম করছো।
তোমরা আমাকে কীভাবে বুঝতে পার
নিজেরাই যখন বুঝতে পার না?
তোমাদের স্মৃতিশক্তি যথেষ্ট প্রখর নয়-
তোমরা কখনই ভুলো না তোমরা আমার সন্তান,
একে অপরকে ছুয়েঁ আছো বলে কষ্ট পাচ্ছ না।
তবে তোমরা জন্মগ্রহণ করেছো বলে
কারণ তোমাদের আব্যশক জীবন
আমার থেকে পৃথক।
৪).
প্রেমের কবিতা
সবসময় ব্যথা থেকে কিছু তৈরি করা যায়।
তোমার মা বুনে যায়,
সে লাল রঙের প্রতিটি ছায়ায় স্কার্ফ বের করে।
তারা ক্রিসমাসের জন্য ছিল এবং তারা তোমাকে আদরে রেখেছিল
যখন তোমাকে সাথে নিয়ে সে একের পর এক বিয়ে করে যাচ্ছিল,
এটা কিভাবে পারছিল?
যখন সমস্ত বছরগুলো সে তার বৈধব্য হৃদয়ে জমা রেখেছিল
যখন মৃত্যুর প্রত্যাবর্তন হয়েছিল,
অবাক হওয়ার কিছু নেই, তুমিও সেই পথের পথিক।
রক্ত হিম হয়ে আসে, তোমার মা
একের পর এক ইটের দেয়ালের মতো।
৫).
ডুবে যাওয়া শিশুরা
তোমরা দেখো,তাদের কোন বিবেচনাবোধ নেই।
সুতরাং তাদের ডুবে যাওয়া স্বাভাবিক,
প্রথমে তুষার তাদের ভিতরে নিয়ে যাবে
এবং তারপরে, সমস্ত শীতকালে,
তাদের পশমের স্কার্ফ ডুবে যাওয়ার সাথে সাথে
তাদের পিছনে ভেসে বেড়াচ্ছে,
তারা নি:সাড় হওয়া পর্যন্ত ।
এবং পুকুরটি তার অজস্র তমস বাহু দিয়ে তাদের তুলে দেয়।
কিন্তু মৃত্যু অবশ্যই তাদের কাছে ভিন্নভাবে আসবে,
শুরুতে এত কাছে,
যেন তারা সর্বদা ছিল অন্ধ এবং ওজনহীন।
অতএব বাকিরা স্বপ্ন দেখে, লন্ঠন সফেদ কাপড়,
টেবিলটিকে ঢেকে দেয়,ঢেকে দেয় তাদের দেহগুলো,
এবং এখনো তারা তাদের ডাকা নামগুলি শুনে
লোরের মতো পুকুরে পিছলে পড়ে যায়;
তুমি কিসের জন্য অপেক্ষা করছো
ঘরে এসো, ঘরে এসো,
নীল আর স্থায়ী জলে,বিলীন হয়ে গেলো তারা।
৬).
মশকরা কমলা
তোমাকে বলছি, এটি চাঁদ নয়।
এইগুলি সেই ফুল
যেগুলো উঠোনকে আলোকিত করছে।
আমি তাদের ঘেন্না করি।
আমি তাদের ঘেন্না করি,যেমন ঘেন্না করি যৌনতাকে,
লোকটির ঠোঁটকে,
নিজের মুখটিকে সেলাই করে দিয়ে,নি:সাড় করি লোকটির দেহ
এবং সর্বদা বলাৎকারের উঠোন
থেকে দল বেধেঁ নিচু হয়ে
চিৎকার পালিয়ে যায়,
আজ রাতে মনের মধ্যে একটি প্রশ্নটি শুনেছি
এবং উত্তরটির পেছনে ধাবিত হচ্ছি,
এক শব্দে মিশ্রিত জবাবটি
আরোহণ করছে আর করছে এবং তারপর
বার্ধক্য নিজেদের মধ্যে গড়িয়ে পড়ছে।
ক্লান্ত বৈরিতা। তুমি কি দেখছো?
আমরা বোকা হয়ে গেছি।
এবং মশকরা কমলার সুঘ্রাণ চড়িয়ে যাচ্ছে
জানালা দিয়ে।
আমি কীভাবে বিশ্রাম নিতে পারি?
আমি কীভাবে খুশি থাকতে পারি?
যখন এখনও পৃথিবীর মধ্যে
সেই গন্ধ চড়িয়ে যাচ্ছে।
৭).
পুকুর
রাত্রি তার ডানা দিয়ে ঢেকে রাখে পুকুরটিকে।
বৃত্তাকার চাঁদের নীচে আমি তোমার চেহারা বানাতে পারি
তোমার মুখ ছোট এবং ক্ষুদ্র প্রতিধ্বনিত নক্ষত্রের মধ্যে সাঁতার কাটছে।
রাত্রির হাওয়ায় পুকুরের পৃষ্ঠটি ধাতু হয়ে যায়।
তোমার খোলা লোচনে আমি তাদের একটি স্মৃতি চিহ্নিত করতে পারি,
যেমন আমরা একসাথে শিশু ছিলাম।
আমাদের ঘোড়াগুলো পাহাড়ে চরছিল,
ধূসর রঙের ওপর তাদের শাদা দাগ ছিল ।
তারা এখন মৃতের মতো ঘাস খাচ্ছে,
তাদের গ্রানাইট স্তনের প্লেটগুলির নীচে,
সুন্দর এবং অসহায় বাচ্চাদের মতো
যারা অপেক্ষা করছিল:
পাহাড়গলো অনেক দূরে। তারা উঠে যায়
শৈশবের চেয়ে অধিকতর কালো
জলের মধ্যে নিরবে শুয়ে থেকে,কি ভাবছো?
যখন তুমি চেয়ে থাকো ঐ পথের দিকে,
অন্য এক জীবনে আমরা একই রক্তের ছিলাম দেখে,
আমি তোমাকে ছুঁতে চাই,
কিন্তু পারিনা।
৮).
জ্ঞান
তারা দুজনেই ছিলেন নিরব-নিস্তব্দ,
মহিলাটি শোকগ্রস্ত, পুরুষটি
তার দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।
কিন্তু ঈশ্বর দেখছিলেন।
তারা তাঁর অভ্রলোচন অনুভব করেছিল
প্রাকৃতিক দৃশ্যে পুষ্প উন্নয়ন দেখে।
কে জানতো তিনি কি চেয়েছিলেন
তিনি ছিলেন ঈশ্বর এবং প্রকান্ড
তাই তারা অপেক্ষা করেছিল
এবং এই পৃথিবী তিনি প্রজ্ঞা দিয়ে পরিপূর্ণ করেছিলেন
যেমন করে তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন।
অনেক দূরে, তিনি যে শূন্যতা রচনা করেছিলেন
সেখানে তিনি তাঁর ফেরেশতাদের দিকে ফিরে গেলেন।
৯).
নিশাচর
একটি বন পৃথিবী থেকে উত্থিত।
হে করুণাময়, তাই প্রয়োজন ’ঈশ্বরের উষ্ণ ভালবাসা
তারা একসাথে জন্তু ছিল।
তাঁর অবহেলার সন্ধ্যায় একসাথে শুইয়ে থাকে;
তাদের আতঙ্ক
পাহাড় থেকে যান্ত্রিকভাবে নেকড়ে এসেছিল
তাদের মানবিক উষ্ণতায় আকৃষ্ট হয়ে,
তখন ফেরেশতারা দেখলো
তিনি কিভাবে তাদের ভাগ করেছেন:
পুরুষ, মহিলা এবং মহিলার দেহকে।
মন্থিত শিলার উপরে, একটি ধীরে গলে যাওয়া
রূপার মধ্যে পাতাগুলো ছেড়ে দাও।
…………………………………….
[ সংগৃহীত ও সম্পাদিত।
কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ও ঋণস্বীকার –
১).বিপাশা বিনতে হক
২).পান্থজন জাহাঙ্গীর
৩).কবি লায়লা ফারজানা
৪).অনিমিখ পাত্র
৫).সুজিত মান্না
৬).খোরশেদ আলম
৭).সুপর্ণা সেনগুপ্ত
৮).অমিতাভ পাল
৯).ফারহানা আনন্দময়ী
১০).নন্দিনী সেনগুপ্ত
১১).অন্যআলো ডটকম