Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আমি কীরকমভাবে || Tarapada Roy

আমি কীরকমভাবে || Tarapada Roy

আমি কীরকমভাবে

কাণ্ডজ্ঞানের এই এক পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমার নিজের চেহারা, কণ্ঠস্বর, বিদ্যা-বুদ্ধি, আত্মীয়স্বজন নিয়ে এত কথা লিখেছি যে অতি বড় নির্লজ্জ ছাড়া বোধহয় আর কারও পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। কোনও পাঠক বা পাঠিকা আমাকে যদি ইগো-ম্যানিয়াক ভাবেন তা হলেও আমার কিছু করার নেই।

আমি অনুপায়। নিজেকে নিয়ে এমন সমস্ত দুঃখজনক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমাকে অনবরতই যেতে হয় যে তা হয়তো অনেক সময় অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। আমার তবু উপায় নেই, লিপিবদ্ধ করে আমার বেদনাভার যতটুকু লাঘব করা যায় তাই আমার চেষ্টা।

কেন যে লোকেরা আমাকে বারবার ভুল বোঝে সেটা আমি আজ অবধি কিছুতেই ধরে উঠতে পারিনি। এই তো গত রবিবার সন্ধ্যাবেলা রীতিমতো ধোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরে সেজেগুজে সস্ত্রীক একটি বিখ্যাত হলে নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। দুঃখের বিষয় মঞ্চের উপর স্বরপ্রক্ষেপণ যন্ত্রটি ঠিকমতো কাজ করছিল না। কখনও অতিশয় উচ্চগ্রাম, আবার কখনও অতি স্তিমিত; নাটকটির স্বরসাম্য বারবার বিঘ্নিত হচ্ছিল। অন্যান্য শ্রোতাদের মতো আমিও কিঞ্চিৎ বিব্রত বোধ করছিলাম। এমন সময় একজন কর্মকর্তা অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে বেড়ালের মতো চোখে খুঁজে খুঁজে আমার সিটের সামনে এসে দাঁড়ালেন, তারপর পিঠে মৃদু টোকা দিয়ে আমাকে উঠে আসতে বললেন, আমি কিছু অনুমান না করতে পেরে ভদ্রলোকের সঙ্গে পিছনের দরজা দিয়ে মঞ্চে উঠে গেলাম। একটু পরেই বুঝলাম ভদ্রলোক ভুল করেছেন; তিনি ভাবছেন যে আমি এই হলের ইলেকট্রিক মেকানিক এবং যদিও ধুতি-পাঞ্জাবি পরে থিয়েটার দেখছি, এই যন্ত্রপাতি আমাকে ঠিক করে দিতে হবে এখনই। না হলে আমার চাকরি উনি খেয়ে নেবেন।

আমার চাকরি অবশ্য শেষ পর্যন্ত ওই ভদ্রলোক খাননি কিন্তু কী অন্যায় নাজেহাল হলাম! বিনা প্রতিবাদে রীতিমতো অপমানিত হলাম। প্রতিবাদ করে লাভ নেই। কারণ আমি জানি যে চিরকাল যেখানে যে গাফিলতি হয়েছে, আমাকেই সেখানকার লোকেরা গাফিলতকারী হিসাবে শনাক্ত করেছে। আমার এক বান্ধবী তাঁর বাড়িতে তাঁর অসাক্ষাতে যখনই কোনও কাচের গেলাস বা পেয়ালা ভাঙে, তিনি বাড়ি এসে খোঁজ করেন, ‘নিশ্চয়ই তারাপদ এসেছিল?’ আমি স্বকর্ণে শুনেছি, মহিলা ভিতরের দিকে রান্নাঘরে কী করছেন, এদিকে বাইরের ঘরে আমাদের চায়ের আসরে কী করে একটা চিনেমাটির প্লেট কার হাত থেকে পড়ে ঝনাৎ করে ভেঙে গেল। মহিলা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ওই যাঃ, তারাপদ আবার যেন কী ভাঙল!’ কিন্তু প্রকৃত সত্য এই যে ওই বাড়িতে কিংবা নিজের বাড়িতে অথবা অন্য কোথাও আমি কদাচিৎ কোনও জিনিস ভেঙেছি।

কিন্তু শুধু চেনাশোনা বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন নয়, রাস্তাঘাটে অচেনা জায়গায় অপরিচিত লোক পর্যন্ত আমাকে সামান্য দেখেই কী একটা ভুল ধারণা তৈরি করে ফেলে।

কেউ বিশ্বাস করবেন না জানি। তবু ব্যাপারটা বলে রাখা ভাল। তখন আমি খুব একটা নাবালক নই। রীতিমতো অফিসে চাকরি করছি, প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা অফিস ছুটির পর কলেজ স্ট্রিটে যাই আড্ডা দিতে। ডালহৌসি স্কয়ার থেকে গোলদীঘি সামান্যই রাস্তা, হেঁটেই যেতাম। লালবাজারের পর বউবাজার-বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের মোড়ে ডানদিকে কয়েকটা চামড়ার জিনিসের দোকান পাশাপাশি। এই দোকানগুলোতে বাস কন্ডাক্টরের খুচরোর ব্যাগ, চাপরাশির কোমরবন্ধ, ঘোড়ার তকমা, ছাগলের বা গোরুর গলার ঘুঙুরের মালা ইত্যাদি আশ্চর্য সব দ্রব্যাদি বিক্রি হয়। এসব জিনিসের কিন্তু কোনও ক্রেতার অভাব নেই, সবগুলি দোকানই বেশ জমজমাট।

একদিন সন্ধ্যার দিকে ওই দোকানগুলির সামনের ফুটপাথ দিয়ে দ্রুত হেঁটে কলেজ স্ট্রিটের দিকে এগোচ্ছি। সেদিন কী কারণে যেন অফিস থেকে বেরতে একটু দেরি হয়ে গেছে। হঠাৎ একটা চামড়ার দোকানের সামনে বাধা পড়ল, দুই গ্রাম্য ভদ্রলোক চামড়ার সরঞ্জাম কিনছিলেন, তাদেরই একজন আমাকে আটকালেন, ‘দাদা, এক মিনিট দাঁড়িয়ে।’ তারপর দু’জনে মিলে আমার ঘাড় এবং গলার দিকে তাকিয়ে অস্ফুট কণ্ঠে কী আলোচনা করতে লাগলেন। একটু পরেই বুঝতে পারলাম বিষয়টি আমার পক্ষে মোটেই সম্মানজনক নয়। এঁদের গ্রামের বাড়িতে সদ্যোজাত গোবৎসটি কিঞ্চিৎ চঞ্চল, তার অবস্থান ও গতিবিধি নির্ণয়ের জন্যে তার গলার জন্যে একটি ঘুঙুর বসানো চামড়ার নেকলেস চাই। কিন্তু বাছুরটির গলার মাপ তাঁরা নিয়ে আসেননি। তবে আমাকে দিয়ে চলবে। আমার গলার চেহারা নাকি একেবারে তাদের বাছুরের গলার মতো। আমার যদি কোনও অসুবিধা না হয় তা হলে আমি যদি একটু দাঁড়াই তা হলে আমার গলার মাপে বাছুরের ঘুঙুরটা তাঁরা কিনতে পারেন।

এ অবস্থায় আমি কী করেছিলাম? কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল আমার? একটি গোবৎসকে গলায় ঘুঙুর বাঁধার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে মিথ্যা আত্মসম্মানে অন্ধ হয়ে হনহন করে হেঁটে গিয়েছিলাম, নাকি গলা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম মাপ দেবার জন্যে?

যাই করে থাকি, আমি কিন্তু এই গ্রাম্য ব্যক্তিদের সরলতাকে মনে মনে অনেকদিন আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু আমার সহপাঠী বন্ধু সিদ্ধিনাথকে কোনও কালে ক্ষমা করতে পারব না।

অনন্তকাল আগে আমি আর সিদ্ধিনাথ এক কলেজে একসঙ্গে পড়তাম। আজকাল তার সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা হয়। কী কারণে যেন সিদ্ধিনাথ চিরকালই আমাকে খুব তালেবর, শাহেনশা ব্যক্তি বলে মনে করে। হঠাৎ হঠাৎ এসে উলটোপালটা পরামর্শ বা সাহায্য চায়। নানারকম ফিকির সিদ্ধিনাথের। শহরতলিতে এক আত্মীয়ের সঙ্গে একটা কাঠ-চেরাইয়ের ব্যবসা করেছিল সিদ্ধিনাথ। ভালই চালাচ্ছিল, হঠাৎ একদিন এসে বলে আত্মীয়-অংশীদারের সঙ্গে কী গোলমাল হয়েছে, ও ব্যাটাকে ভাগাতে হবে। আমি তাকে বললাম কোনও উকিলের কাছে গিয়ে দেওয়ানি মামলা করতে। বলল, ‘তা নয়। ওকে আমি পুড়িয়ে মারতে চাই। তুমি আমার এই উপকারটুকু করো।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘মানে?’ সিদ্ধিনাথ যা বলল তাতে বুঝলাম ব্যাপারটা তেমন কিছু না, আজ রাত দুটো থেকে আড়াইটার মধ্যে সে তার শত্রুর বাড়ির পিছনের রাস্তায় আমাকে নামিয়ে দেবে। উদ্যোগ আয়োজন, সবরকম বন্দোবস্তই সে করেছে, যথা পেট্রলের টিন, তুলোর বল, মশাল। আমাকে শুধু নির্দিষ্ট বাড়িটিতে অগ্নিসংযোগ করে রাতের অন্ধকারের আড়ালে দৌড়ে তার জিপে এসে উঠতে হবে। পুরনো বন্ধু হিসেবে অন্তত এটুকু কি আমি তার জন্যে করব না?

সিদ্ধিনাথকে আমি জন্মজন্মান্তরেও ক্ষমা করব না, কিন্তু আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ, সে আমার অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিয়েছে।

উপনিষদের ঋষি বলেছিলেন, আত্মানং বিদ্ধি—নিজেকে জাননা। আমি এখন নিজেকে জানতে চাই। আমি কে? আমি কেমন? আমি কি অগ্নিসংযোগের নায়কের মতো, আমি কি গোরু বাছুরের বিকল্প, নাকি নিতান্তই সাদামাঠা কাচ কিংবা চিনেমাটির বাসন ভাঙার কারিগর?

আমার এই চিরায়ত প্রশ্নের চমৎকার জবাব দিয়েছিলেন আমার পূজনীয়া স্ত্রী। বিদেশ যাওয়ার জন্যে পাসপোর্টের ফটো তুলেছিলাম। যেমন হয়—অনেকটা আমার মতো, অনেকটা অস্পষ্ট, যেন আমি নই, তবে আমার ডবল, দু’ নম্বর তারাপদর দু’ নম্বরি ছবি।

পাঁচ সপ্তাহ বিদেশ ঘুরে ফিরে এলাম। ঘাটা-আঘাটায়, পথে-বিপথে। মাথায় একমাসের আতেলা চুল, চোখের নীচে কালি, ওজন সাত কেজি কম। দমদম বিমানবন্দরের লাউঞ্জে প্রাণাধিকা বললেন, ‘জানো, তোমাকে ঠিক তোমার পাসপোর্ট ফটোর মতো দেখাচ্ছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *