পর্ব – ১
আম্মার হুঙ্কার – এ কেমন পোলা বিয়োলাম আমি, হে আল্লা । আব্বাকে বাবা বলে , পানি কে জল বলে । এর তো দোজখেও ঠাঁই হবে না । নামাজ পড়ে না , ফকির – দরবেশ মানে না । উরস্ -এ যায় না , হে আল্লা তুমি এর বিচার ক’র ।
মা যত না চেঁচায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত দাদি তার সাতগুণ বেশি চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে । আমি কাফের , আমি মোছলমান নই , মরে গেলে আমার জায়গা হবে নরকে , ইত্যাদি প্রভৃতি । ভাবি মনে মনে আমি তো আর কচি খোকা নই , ক্লাশ টেন হয়েছে , সামনের বছর মাধ্যমিক দে’ব । আমি বাঙালি , বাঙলা আমার মাতৃভাষা – কথ্যভাষা , সেখানে পানি – আব্বা – আম্মা – দাদি – নানি এদের ঠাঁই তো বিদেশি ভাষার ভেতর । ধর্মপ্রাণ মা বলে – এগুলোই না কি আসল বাঙলা , হিঁদু গুলো যে কথা বলে কোরানে সে কথা বলতে মানা । স্কুলে আব্দুল স্যার বাংলা পড়ান । পাঠ্য বইতে মাঝে মাঝে আম্মার এই ” কোরানের ” ভাষা থাকলেও স্যার ব্যাখ্যা করার সময় কাফেরদের ভাষাতেই বলেন ।
গ্রামের ছেলে , ধানক্ষেত -আনাজ ক্ষেত ,পুকুর , কুয়ো , আলপথ , হাঁসের জল ক্রীড়া , দোয়েল – ফিঙে – কাক – চড়াই – বুলবুলি -র ডাক শুনে বড় হচ্ছি ।
গ্রামটা মুসলমান প্রাধান । গ্রামের একমাত্র নাপিত হিঁদু , একমাত্র ডাক্তার হিঁদু , সদর থেকে চিঠি – মানি অর্ডার নিয়ে আসার পিওন হিঁদু এমনকি কামার যে সেও বিহারী হিঁদু। আম্মার শাঁড়াশি ঠিক করতে গেলে হিঁদুকে লাগে ,নানার চিঠি পেতে গেলে হিঁদুকে লাগে ,দাদির বাতের ব্যাথা কমাতে হিঁদু ডাক্তারের ওষুধ লাগে , তবে আমাদের মধ্যে ভাষায় এই ব্যবধান কেন ?
বুঝে উঠতে পারি না ।
আমাদের গ্রামে মহরমের বড় মেলা বসে । দূর দূর থেকে মানুষ জন আসে মেলাতে । কেউ জিনিষ বিক্রি করতে কেউ বা কিনতে । মেলাতে মুসলমানদের ভীড় বেশি থাকলেও হিন্দুদের সংখ্যাও কম থাকে না । ঘর – সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের সম্ভার যেমন থাকে তেমনই থাকে খাবারের দোকান । পাঁচদিন ধরে যাত্রা পালা হয়। তাতে হাসান – হোসেনের বিয়োগান্ত পালার পাশাপাশি বেহুলার দু:খের পালাও হয় । আম্মা সব পালাই দেখে আর কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ পোঁছে । পাশে বসা নাজনীন চাচী কে বলে – বুইলে বইন ম্যাইয়ারা সবসময়ই দু:কু কষ্ট পায় । আমি হাসি । বাড়ি ফিরে বলি – বেউলা তো হিঁদুর মেয়ে তার দু:খে তুমি কাঁদো কেন ? আম্মার উত্তর – ও তুই বুজবি না । মাইয়া লোগের কথা তোকে বলা আর ছাগলকে বলা এক । আমি মুচকি হেসে চলে যাই ।
সুন্দর লেখা। কয়েকটি ব্যাপার মন ছুঁয়ে যায় তবে আমার
মনে হয় যে যার ধর্মটিকে সম্যক দূরত্বে রেখে যদি শুধু
মানবিক মন নিয়ে সমাজটাকে দেখি, তাকে উপলব্ধি করি,
আরও বেশি স্বচ্ছ ও সুন্দর হয়। আরও বেশি পবিত্র ও
গ্রহণীয় হয়। ভালো লেখা শ্রদ্ধেয়। এভাবেই কলম এগিয়ে
যাক নিরপেক্ষ ও নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। শুভেচ্ছা তো থাকলই।
নম্রতায়-
” যাযাবর……. “
খুব সুন্দর বক্তব্য। প্রাণিত হলাম।
অসাধারণ মুগ্ধ সৃজন। বিভেদকামী ধর্মের চেয়ে মানবিক মূল্যবোধের ও এবং চেতনার গুরুত্ব অপরিসীম। মনুষ্যসৃষ্ট তথাকথিত ধর্মের সুড়সুড়ি কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের আখের গোছানোর অন্যতম কৌশল।
সুস্থ সামাজিক এবং সাম্যের গান ধ্বনিত হোক প্রতিটি মানুষের অন্তরে। চলুক কলম।
একদম ঠিক কথাই বলেছ। বিভেদকামী শক্তিদের চিহ্নিত করে নিজেরাই পারি তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সমাজে মৈত্রী ও সম্প্রীতির বাতাবরণ গড়ে তুলতে।