আমার ছুটি
ছুটি এই শব্দটা আমার মনে রামধনুর সাত রং এর ছটা বিছিয়ে দেয়। ছুটি মানেই সাংসারিক দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি। মন বাউল এর ইচ্ছে ডানা মেলা। আমার ছুটির মানে এটাই। তাই যখনই সুযোগটা পাই সঙ্গে সঙ্গে তার সদ্ব্যবহার করি। আমার মন বাউলের পরিক্রমা শুরু হয় চেনা অচেনা পথে। পথে নামলেই তো পথ চেনা হয় এভাবেই ছুটি তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। এমনই এক ছুটির আনন্দ আমাকে প্রকৃতির রহস্যের আরো কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল— আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি কে এসেছিল আরো অমূল্য রত্ন রাজি! প্রায় চার দশক আগের কথা—– কজন জঙ্গল পাহাড় ভালোবাসা মানুষ বেরিয়ে পড়েছে ছুটির আনন্দে! নাগরিকতার যান্ত্রিকতায় আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা মন গুলো খোলা হাওয়ায় একটু প্রাণ খুলে শ্বাস নিতে চলেছে পুরুলিয়ার পথে! জল জঙ্গল পাহাড়ের সরজমিন পুরুলিয়া তখন ছিল আদিম অনাঘ্রাতা কিশোরীর মত। যোগাযোগ ব্যবস্থা ও তখন ভাল ছিলনা, রাস্তাঘাটও ভালো নয়। আমাদের নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য ছিল না। আদিম পুরুলিয়া কে আমরা আমাদের মতো করে আবিষ্কার করতে চলেছিলাম। অযোধ্যা পাহাড় তলীতে এক মাহাতো জোতদারের অতিথি হয়ে তার বাড়ি কে কেন্দ্র করে চলল আমাদের জঙ্গল ট্রেকিং অভিযান। আদিম অযোধ্যা তখন জঙ্গলের চাদরে ঢাকা। হাতি বাঘ নেকড়ে ভালুকের লীলাভূমি। আর রয়েছে সরল সাদাসিদে আদিবাসী জনগোষ্ঠী। এদের আতিথ্যের আন্তরিকতায় ভেসে গেলাম। এখানেই দেখা হয়েছিল এক অদ্ভুত প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষের সাথে— রামেশ্বর চালক– মানুষটির একমাথা কাঁচাপাকা চুল ,মায়াবী চোখে কি যে মায়া মাখানো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। উনি জঙ্গল পাহাড়ে, নদীর তীরে ,টাঁডভূমিতে গাছ লাগিয়ে বেড়ান !এটাই উনার নেশা। বাড়ির সবাই ওকে ক্ষ্যাপা বলে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম একটা সুন্দর মনকে। পরবর্তী প্রজন্মকে একটা সুন্দর সুস্থ প্রকৃতির উপহার দেওয়ার জন্য নিরলস একক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখানে সবাই ওকে “গাছ বুড়া “নামে ডাকে! উনার লাগানো জঙ্গল ঊষর টাঁড চাট্টান কে সবুজের মায়ায় ঢেকেছে। ন্যাড়া পাহাড়ে সবুজ কেশের বাহার হয়েছে। পলাশ শিমুল শালের বনের সাথে পাহাড় ও এখন সবুজের গানের দোহারকি করছে। আমার ছুটির আনন্দ আরো বেড়ে গেল গাছবুডার সাহচর্যে। উনাকে অনুসরণ করে সারা অযোধ্যা পাহাড় ঘুরেছি। কাসাই উৎস ঝাবরনালায় গেছি উনার সাথে।”” গাছকে ভালবাসলে গাছ তার প্রতিদানে ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয় গাছ বেইমানি জানেনা”— এই শিক্ষা পেয়েছি উনার কাছ থেকে যা আজও আমার কাছে বেদবাক্য হয়ে আছে! ছুটি শব্দটা তাই আমার কাছে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে গেছে! দুয়ারসিনি জঙ্গলের পথে সাতগুরুং এর সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে হারিয়ে গেলাম ছুটির আনন্দে। সাতগুরুং বড় সুন্দরী নদী– আদিবাসী কন্যার মত তার চলন! ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ পরিবর্তন মনকে আবিল করে দেয়। আর যখন বামনি ফলস এর পাকদন্ডী বেয়ে উতরাই এ নামছি অজানার আনন্দে মন ভরে উঠছে। মাঝে মাঝে মেঘের আঁচলে ঢেকে দিচ্ছে চরাচর। সূর্যের আলো পড়ে রামধনুর সাত রঙে ছটায় সেজে উঠছে সুন্দরী অযোধ্যা। জলকণার রামধনুর মুকুটে সে সুন্দরীর তাজে সেজেছে। আমার ছুটি সার্থকতায় ভরে গেছে। আজও তাই ছুটি মানেই প্রকৃতি সঙ্গ—- তা সে জঙ্গল –পাহাড়– নদী বা সমুদ্রের যাই হোক না কেন!