Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আতসী || Ashutosh Mukhopadhyay

আতসী || Ashutosh Mukhopadhyay

অতসী একটি ফুলের নাম। স্বর্ণাভ। দেখতেও মিষ্টি।

অতসী গাঙ্গুলির বন্ধুরা এই ফুলের সঙ্গে নামের মালিকের তেমন মিষ্টি গোছের। মিল দেখতে পায়। বন্ধু বলতে য়ুনিভার্সিটির ছেলে-মেয়েরা। এই মিলটা তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বা ধরিয়ে দিয়েছে অতসী গাঙ্গুলির ছেলেবেলার বন্ধু শোভনা বিশ্বাস। সে-ও তারই সঙ্গে কলেজ ডিঙিয়ে ইকনমিক্স পড়তে ঢুকেছে। এই মিল দেখানোর পিছনে একটু বাস্তব রসের যোগ আছে।…যে কলেজ থেকে তারা পাশ করে বেরিয়ে এসেছে, সেখানকার দুজন তরুণ শিক্ষক ওই ফুলের সঙ্গে এই মিল। আর মিতালিটুকু প্রথম আবিষ্কার করেছিল। তাদের একজন সেটুকু সামনা-সামনি ঘোষণা করার মতো সাহস দেখিয়েছিল। অতসী গাঙ্গুলি খুব খুশি হয়ে তাকে চপ কাটলেট খাইয়ে বিদায় করেছিল। তারপর ওই মন-পসন্দ নামের মালিকের কাছ থেকে আশানুকুল সাড়া না পেয়ে ভদ্রলোক আর একদিন বাড়িতেও এসেছিল। দূর থেকে অতসীকে সে দোতলার ঘরের জানলার কাছে কয়েক পলকের জন্য দেখেও ছিল। আর অতসীও তাকে দেখেই সরে এসেছিল।

বাড়ির কাজের লোকটি এসে খবর দিতেই অতসীর সাফ জবাব, বলে দাও বাড়ি নেই, কখন ফিরব তারও ঠিক নেই।

এই অতসী-স্তুতি সেখানেই শেষ। শুনে শোভনা বিশ্বাস বলেছিল, এত অকরুণ। হতে পারলি কি করে–গোলাপে কাটা থাকে জানি, অতসীতেও থাকে।

দ্বিতীয় মিল-আবিষ্কারক ওই কলেজের বাংলার তরুণ কবি-শিক্ষক। উঠতি কবি হিসেবে ভদ্রলোকের বেশ সুনাম তখন। অতসী নামের মূল তার হৃদয়ে গেঁথে আছে দুবছর ধরে ক্লাস করেও সেটা বোঝা যায়নি। এম, এ ক্লাসে ভর্তি হবার পর ডাকে একদিন অতসী গাঙ্গুলির নামে আধুনিক কবিতার মাসিক-পত্র এলো। কে পাঠালো ভেবে না পেয়ে পাতা উল্টেই দেখে ছাপা অক্ষরে প্রথম কবিতার নামই অতসী। নিচে কবির নাম। বলাবাহুল্য কলেজের সেই অতি চেনা নাম।

বার কয়েক মনোযোগ নিয়ে পড়ে কবিতার মর্মোদ্ধার করা গেছে। চৌ লাইনের মধ্যে পুষ্পবাহার অতসীর বিশেষ একটি মানবী রূপের কল্পনা এবং স্তুতি।

যা করণীয় অতসীর তা ঝটপট করে ফেলা অভ্যাস। তারপর চার লাইনের একটা চিঠির নকলসহ কবিতাটা শেভনাকে দেখিয়েছে। প্রথমে কবিতা এবং পরে চিঠিটা পড়ে শোভনার দুচোখ কপালে।–এই চিঠি সত্যি তুই ভদ্রলোককে পাঠাবি নাকি?

–পাঠাবো না, পাঠিয়ে দিয়েছি।

রুদ্ধশ্বাসে শোভনা চিঠিটা আবার পড়েছে।

কবিতা-পত্র পেলাম। ধন্যবাদ। আপনার অতসী পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। পরের সংখ্যায় কৌটিল্য-ব্যঞ্জনাসহ অর্থশাস্ত্রের ওপর একটি নিটোল সনেট দেখতে পেলে আরো মগ্ধ হব।

–চিঠিতে তোর নাম দিসনি? শোভনার ব্যগ্র প্রশ্ন।

–দেব কেন, কবিতার ওই মাসিক-পত্র যে পাঠিয়েছে সে তার নাম দিয়েছে?

দুজনেই ইকনমিক্স-এর ছাত্রী, অবশ্য বি-এর রেজাল্ট দেখলে শোভনার থেকে অতসী ঢের বেশি এগিয়ে। সেকেন্ড ক্লাস সেকেন্ড হয়েছিল। আত্মীয় পরিজনেরা তাইতেই বেশ খুশি। কেবল অতসীর বুকের ভিতরটা চিনচিন জ্বলছে। মার্কশীটে দেখা গেছে ফার্স্ট ক্লাস ফাস্ট-এর থেকে আট নম্বর মাত্র পিছিয়ে। তার মধ্যে দুদুজন ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে, তারা ছেলে। একজন সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে, সে মেয়ে। অতসী ওদের থেকে নিজেকে কোনো অংশে খাটো ভাবে না। কিন্তু দুদুটো টিউশনি চালিয়ে এর বেশি আর কত হবে। এম. এ-তে ওই তিনজনকেই মনে মনে দেখে নেবার ইচ্ছে। কিন্তু ভিতরের এই জ্বলুনি বা অভিলাষ কাউকেই বুঝতে দেবার মেয়ে নয় সে।

.

যাক। এবারে বন্ধুর উৎসুক প্রশ্ন, কৌটিল্য-ব্যঞ্জনা সহ অর্থশাস্ত্রের ওপর একটি নিটোল সনেট দেখা আর মুগ্ধ হওয়ার অর্থ কি–কলেজের বাংলা মাস্টারের আর্থিক সংগতির খোঁচা দিলি?

অতসীর হাসি এবং জবাব, যা খুশি বুঝে নে বাপু, মনে এলো লিখে দিলাম।

সাদা-মাটা দেখতে শোভনা বিশ্বাস অরসিক বা অনুদার নয়। য়ুনিভার্সিটিতে ঢুকে প্রশংসার ছলে দুই একটি উৎসুক ছেলের কানে অতসী-নামের মহিমা আর মাধুর্য তুলে দিতেই সেটা দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে। দুদুটি তরুণ মাস্টারের মুখে ঝামা ঘষে দেবার ঘটনা শোভনা বিশ্বাস অবশ্যই অনুক্ত রেখেছে। সেটা বলা মানেই প্রকারান্তরে তাদের সতর্ক করা আর সমঝে দেওয়া। এই বোকামো করলে ভবিষ্যতের মজার আশায় জলাঞ্জলি। কলেজের কবি-শিক্ষকের লেখা পুষ্পবাহার অতসীর বর্ণনা আর উপমা কটা কেবল সানুরাগে বন্ধুর ওপর চালিয়ে দিয়ে মন্তব্য করেছে, নামের সঙ্গে এমন মিষ্টি মিল কমই দেখা যায়।

অতসী-ফুল বা গাছ কত ছেলে দেখেছে আর দেখলেও কত জনে মনে রেখেছে। তাতে দুই বন্ধুরই সন্দেহ আছে। দুজনেরই ধারণা এই মিলটুকু ধরিয়ে দেবার পর ছেলেগুলোর কেউ-কেউ আলিপুরের হর্টিকালচারাল গার্ডেনে হানা দিয়েছে। তা না হলে ওই ফুলের গুণগান ছেলে-মেয়েদের (বিশেষ করে ছেলেদের) মুখে মুখে এতটা প্রগলভ হয়ে ওঠে কি করে? ফুলের গুণ-গান বলতে নামের মিলের প্রশস্তি।

এই প্রশস্তির ধারে কাছে না ঘেঁষেও ওই নামের ওপর ছোট্ট একটু কটাক্ষপাত করে ছাত্রবন্ধুদের মজার খোরাক যুগিয়েছিল যে ছেলে তাকে য়ুনিভার্সিটির মধ্যমণি। বললেও অত্যুক্তি হবে না। সমর ঘোষাল। কিন্তু এ প্রসঙ্গ একটু পরে। ছেলেরা সমর ঘোষালকে কেবল ভালবাসে না, অনেক উঁচু পর্যায়ের আত্মজন ভাবে। অতসীর থেকে বছর খানেকের বড় হবে, পড়েও এক ক্লাস ওপরে। সিক্সথ ইয়ারের ছাত্র, সাবজেক্ট ইংরেজি। গত তিন বছরের মধ্যে তার আগে বি, এ-তে ওই বিষয়ে ফার্স্ট ক্লাস অনার্স কেউ পায়নি। সমর ঘোষাল বেশ দাপটের সঙ্গে এই কলঙ্ক মোচন করেছে। এম. এ-তেও ফাস্ট ক্লাস পাবে, এ-ও যেন ধরা-বাঁধা ব্যাপার। ভালো ক্রিকেটার, নামা ক্লাবের এডিভিশনে খেলে, গত বছর থেকে বাংলা দলের বাছাই বারো জনের মধ্যেও জায়গা করে নিতে পেরেছে। মুরুব্বি জনেরা উৎসাহ দেয়, লেগে থেকে সেভাবে চেষ্টা করলে ভারতীয় বাছাই দলেরও সে নিশ্চয় একজন হতে পারবে। এমনিতে চোখের আড়ালেই সরে থাকতে চায়, কিন্তু টেনে এনে সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে অন্য মানুষ। ইংরেজি বাংলা দুই-ই কান পেতে শোনার মতোই বলে। ছাত্র মহলের ইউনিয়নবাজী তথা রেষারেষি অনেকটা এই একজনের জন্যেই অনেক শান্ত এখন। মধ্যস্থতায় নামলে মিটমাট হয়ই। এ হেন গুণের ছেলের সব থেকে বড় গুণ কথা-বার্তায় চাল-চলনে এতটুকু দম্ভ নেই। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, ঠিক সেই রকমই থাকে। যে-যা বলুক মন দিয়ে শোনে, যেন সকলের কাছ থেকেই তার কিছু শেখার আছে। এমনি সব কিছুর ভিতর দিয়ে তার শান্ত সহজ ব্যক্তিত্বটুকুই সকলকে আকর্ষণ করে।

শোভনা বিশ্বাসের একটা বড় দোষ বা বড় গুণ, সে সক্কলের সঙ্গে যেচে আলাপ করতে ওস্তাদ। কোনো নামী ছেলে বা মেয়ের কথা শুনলে কতক্ষণে তাকে একটু নাড়াচাড়া করে দেখবে সেই ফাঁক খোঁজে। কলেজে পড়তে সায়েন্স গ্রুপ পড়াতেন এক প্রৌঢ় নাম-করা প্রফেসার। তার ছাত্ররা তাকে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করত। কথায় কথায় শোভনা কার মুখে শুনল ভদ্রলোক ম্যাট্রিক থেকে এম. এস-সি পর্যন্ত ফার্স্ট ছাড়া কখনও সেকেন্ড হননি। কলেজ আঙিনায় ভদ্রলোককে সামনা-সামনি দেখেই এগিয়ে গিয়ে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম সেরে মুখোমুখি দাঁড়ালো।–আপনার হাতখানা একবার আমার মাথায় রাখুন তো সার।

ভদ্রলোক অপ্রস্তুত।-কেন বলো তো, তুমি কী পড়ো–কোন ইয়ারের ছাত্রী?

-বলছি! বিনীত নিবেদন, আগে আপনার হাতখানা একবার আমার মাথায় রাখুন না…।

কি আর করেন? রাখলেন।

-আমি বি, এ ফাইনাল ইয়ারের ইকনমিক্স-এর খুব সাধারণ ছাত্রী…ম্যাট্রিক থেকে এম. এস-সি পর্যন্ত একজন ফাস্ট হওয়া মানুষ জীবনে এই প্রথম দেখলাম সার, দোষ নেবেন না।

অতসী একটু পিছনে দাঁড়িয়ে দেখছিল আর শুনছিল। কলেজ গেট পেরিয়ে হাসতে হাসতে বলল, হায়ার সেকেন্ডারি থেকে এম. এ, এম-এসসি পর্যন্ত ফাস্ট আজকাল অনেকেই হয়, এই ভদ্রলোকের অর্ধেক বয়সের সে-রকম কাউকে যদি সামনে দেখতিস?

-তাহলে মাথায় হাত রাখতে বলতে পারতাম না, আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে একবার জড়িয়ে উড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করত, ফার্স্ট বা ফার্স্ট ক্লাস ছেড়ে মোটামুটি সেকেন্ড ক্লাস যদি একটা হয়।

সেদিন লাইব্রেরি হলে দূরের টেবিলে একজনকে দেখা গেল। বিকেলে ওই টেবিলে তাকে প্রায়ই দেখা যায়। অতসীকে ক্লাসের পর নিয়মিত লাইব্রেরিতে এসে পড়াশুনা সেরে নিতে হয়। ফিরে গিয়ে দুদুটো টিউশনি আছে, সপ্তাহে তিন দিন করে পড়ায়, বাড়ি গেলে নিজের পড়ার সময় মেলে না। তাছাড়া বেশ অবস্থাপন্নর পক্ষেও এম. এ ক্লাসের সব বই কিনে পড়া সম্ভব হয় না, অতসীর তো নিজস্ব খুব কম বই-ই আছে। ছুটির দিনে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে পড়তে যায়। সেখানেও ওই ছেলেকে এক-আধ দিন দেখেছে। সামনা-সামনি পড়ে গেলে বা চোখাচোখি হয়ে গেলে পরিচিতের মতোই সামান্য হেসে পাশ কাটিয়েছে। অতসীও তাই করেছে। য়ুনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে আজ ওই দূরের টেবিলে মুখোমুখি একজন মাত্র সহপাঠী বসে। পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক কথা-বার্তা চলছে।

আঙুল তুলে অতসী ওই টেবিলটা দেখিয়ে বলল, ওই দ্যাখ, ম্যাট্রিক থেকে এম এতে ফার্স্ট না হলেও এখানকার একটি অলরাউন্ড রত্ন বিশেষ–তোর জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করার মতোই একজন সমর ঘোষাল।

শোভনা বেশ নিবিষ্ট চোখে দেখে নিল। দূরে হলেও এই দিকে মুখ করেই বসেছে। অস্ফুট মন্তব্য করল, আমার নয়, মনে হচ্ছে তোর ইচ্ছে করার মতোই একজন। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালো–চলি…। হাত

-ওকি! এই শোন–

কর্ণপাত না করে এগিয়ে চলল। সোজা ওই টেবিলে। দুদিকের দুজনেই এক সঙ্গে মুখ তুলল। শোভনা সহপাঠীর দিকে তাকালোও না, সমর ঘোষালকে বলল, আমাদের ওই টেবিলে একবারটি অনুগ্রহ করে আসার সময় হবে?

আঙুল তুলে টেবিল দেখালো। সমর ঘোষাল পঞ্চাশ গজ দূরের টেবিলে তাকালো। এবং অতখানি দূর থেকেই অতসী গাঙ্গুলীর সঙ্গে চোখাচোখি।

উঠল। ঠোঁটে মৃদু হাসির আভাস। আসছে। আগে আগে শোভনা। একটা বড় কাজ সমাধা করার মতো মুখ। এই টেবিলে এসে দুই ভুরু সামান্য কুঁচকে একটু ঘটা করেই আর এক দফা রত্নটিকে দেখে নিল। অতসীর মনে হল, যে এলো সে এই দৃষ্টিবাণে আহত বা বিড়ম্বিত হবার মতো একজন নয়।

গম্ভীর মুখে শোভনা বলল, সদ্য কলেজ উৎরানো দুটো কচিকাঁচা আমরা। সেখানে। ছেলে-মেয়ে সক্কলের সঙ্গে সকলের তুই তোকারির সম্পর্ক ছিল, এখানকার হাল কেমন, তুমি চলে না আপনি-আজ্ঞে?

তুমিটাই ভালো চলে।

-বেশ। অতসীর মুখোমুখি চেয়ারটা দেখিয়ে বলল, ওই চেয়ারে পাঁচটা মিনিট বোসো তাহলে, একটু আলাপ পরিচয় সেরে নিই–

সমর ঘোষাল হুকুম তামিল করল, অর্থাৎ বসল।

–আমি শোভনা বিশ্বাস, খুব সম্ভব সেকেন্ডক্লাস লাস্ট হয়ে ইকনমিক্স পড়তে ঢুকেছি, এ হল…(থেমে গিয়ে একটু ভ্রূকুটির ঘটা) কেন, এর নামের সৌরভ এখনো। তোমার নাকে-কানে পৌঁছয়নি?

কানে পৌঁছেছে, অতসী গাঙ্গুলি, তোমার পাবলিসিটির গুণে ছেলেরা এই নাম নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে, পরিচিত হয়ে ধন্য হলাম, আমার নাম

–থাক, থাক, য়ুনিভার্সিটির আকাশে তুমি দীপ্ত সূর্য, তোমার আলোর গরিমায় চার দিকের নক্ষত্ররা টিপ টিপ জ্বলছে, এটুকু আমাদের জানা আছে। আমরাও গুণের কদর জানি

আর সেই কারণেই এ হেন গুণীকে জবরদস্তি ধরে আমরা একটু টানাটানি করে থাকি

খোঁটা দেবার সুরে অতসী বলল, আমরা বলে আবার আমাকে জড়াচ্ছিস কেন, নিজের কথা বল

সঙ্গে সঙ্গে শোভনার ভ্রূকুটি এবং ঝঝ। বেশি দেমাক দেখাস না, তোর মতো চেহারা আর বিদ্যের জোর থাকলে তোকে জড়াতে যাব, এতই বোকা ভাবিস আমাকে?

এবারে সমর ঘোষালের দুচোখ শোভনার দিকেই মনোযোগী একটু। তারপর হাল্কা-গম্ভীর মন্তব্য–নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, তোমার মতো চেহারা আর বিদ্যের জোরের। রসিকতার টানাটানিও ভালো না লাগার মতো উঁচু স্তরের কেউ নই আমি।

খুশিতে বিগলিত ভাব শোভনা বন্ধুর দিকে ফিরে ঠেস দিল, কি রে, শুনলি? খুব যে নাক সিটকোস

চেয়ার ঠেলে সমর ঘোষাল উঠে দাঁড়ালো। ঠোঁটের ফাঁকে একই রকমের মৃদু হাসি, শোভনার দিকে চোখ।–অনুমতি হলে আমি স্বস্থানে ফিরি-এর (অতসীর) ক্ষতি হচ্ছে, পড়াশুনার ব্যাপারে খুব সীরিয়াস এখানেও দেখেছি, ন্যাশনাল লাইব্রেরিতেও লক্ষ্য করেছি।

তেমনি মৃদু হেসে অতসী জবাব দিল, কপাল গুণে আমার গোপাল ঠাকুরের পূজা আর্চা সবই লাইব্রেরিতে…বাড়িতে সময় হয় না।

দাঁড়িয়ে শুনল, দেখলও একটু, কিছু জিগেস না করে ফিরে গেল।

–যা! শোভনার গলায় হতাশা, ভেবেছিলাম যত জমাটি মগজই হোক, আগুনের আঁচে এনে ফেলতে পারলে একটু গলগলা ভাব দেখব, কিছুই তো দেখা গেল না!

–আর জ্বালাসনে বাপু, পড়তে হয় পড়। নয়তো পালা, এ চ্যাপ্টারটা আজ শেষ করতেই হবে।

শোভনার অত ধৈর্য নেই, তাছাড়া বাড়ির গাড়ি অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। উঠে পড়ে বলল, এখন চ্যাপ্টারের চাপে বসে বসে চ্যাপ্টা হ, তারপর ট্রাম-বাসের। ভিড়ে চ্যাপ্টা হওয়া আছেই–আমি বাপু সত্যি আর বসে থাকতে পারছি না।

এর পরেও অতসী আর সমর ঘোষালের দেখাসাক্ষাৎ যেটুকু এই লাইব্রেরিতে বা ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। য়ুনিভার্সিটিতে কথাবার্তা বলতে গেলে হয়ই না। মুখোমুখি বা সামনাসামনি পড়ে গেলে সমর ঘোষাল হেসে মাথা নাড়ে। অতসীও একই জবাব দেয়। কথা টুকটাক ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে দেখা হলে হয়। ফেরার সময় কিছু পথ হেঁটে দুজনেরই ট্রাম বা বাস ধরতে হয়। তারপর দুজনের পথ দুদিকে। সমর ঘোষাল থাকে, মধ্য কলকাতায়, অতসী দক্ষিণে। অতসী প্রায় প্রত্যেক ছুটির দিনেই ন্যাশনাল লাইব্রেরি আসে, সমর ঘোষাল মাঝেমধ্যে। এইটুকু দেখাসাক্ষাৎ বা কথা-বার্তার ফাঁকে বাড়তি আগ্রহের ছিটেফোঁটাও কেউ দেখেনি। দশ মিনিটের হাঁটা। পথ ট্রাম-বাস পর্যন্ত পাশাপাশি আসার মধ্যেও সহজ ব্যক্তিত্বের ফারাক একটু থেকেই যায়। অতসীর এটুকুই খুব পছন্দ। গরীব ঘরের সুরূপা মেয়ে এযাবত পুরুষের হ্যাংলামো অনেক দেখেছে।

তবে ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে ফেরার সময় এটুকু পথ এক সঙ্গে আসে দুজনে। সমর ঘোষালের আগে হয়ে গেলে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়, হাসিমুখে জিগেস করে, কত দেরি? অতসীর প্রায়শঃ একই জবাব, আর দুমিনিট অপেক্ষা করো। বা, আর পাঁচ মিনিট। আবার ওর আগে হয়ে গেলে ঝোলা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে হাসি-হাসি মুখে তার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায় কেবল, কিছুই জিগেস করে না। সমর ঘোষাল চটপট উঠে পড়ে। স্বাভাবিক সৌজন্যে আগে ওকে ট্রামে তুলে দিয়ে (চাপাচাপির ভয়ে অতসী পারতপক্ষে বাসে ওঠে না) নিজের ট্রাম বা বাস ধরে।

এটুকুর মধ্যে দুই একটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের টুকটাক কথাও হয়। এর মধ্যে সমর ঘোষাল একদিন জিগেস করেছিল, আচ্ছা, তোমার সব পড়াশুনা লাইব্রেরিতে, বাড়িতে একদম সময় পাও না বলেছিলে…কেন, অন্য কিছু শেখটেখ নাকি?

অতসী হেসেই জবাব দিয়েছিল, শিখি না, শেখাই। সপ্তাহে তিন দিন করে সন্ধ্যার পর দুটো মাড়োয়ারি বাড়িতে টিউশনি করি। তারা লোক ভালো, কেবল কামাই পছন্দ করে না। রাত্রিতে তারপরেও নোট-টোট বা লেখা-টেখা নিয়ে বসি-ফলে ঘুমোতে দেরি, সকালে উঠতেও দেরি–আর তার ফলে স্নান-টান সেরে নাকে-মুখে কিছু গুঁজে যুনিভার্সিটিতে ছোটার তাড়া–কম করে এক ঘণ্টার পথ তো।

শোনার পর একটু শ্ৰদ্ধার ভাবই লক্ষ্য করেছে অতসী। চেহারা বা ছিমছাম বেশ বাস দেখে গরীব ঘরের মেয়ে কেউ ভাবে না। চলতে চলতেই সমর ঘোষাল মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়েছে।–দুদুটো টিউশনি কত দিন ধরে করছ?

–বি, এ পড়তে ঢোকার সময় থেকেই।

পরের বিস্ময়টুকুও নির্ভেজাল মনে হয়েছে অতসীর।–এই করে বি. এ-তে ইকনমিক্স-এর মতো সাবজেক্ট নিয়ে সেকেন্ড ক্লাস সেকেন্ড–দারুণ তো!

শুনে মনে মনে সত্যিই খুশি অতসী, কারণ সেকেন্ড ক্লাস সেকেন্ডের খবরটা ও নিজে কখনো দেয়নি। মুখ টিপে হেসে বলল, তোমার ইংরেজিতে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার থেকেও কঠিন মনে হচ্ছে?

হেসে উঠল, ও একটা হয়ে গেছে…এবারে যে কি হবে ভাবতে গেলে ভয়। করে বলে ভাবি না।

এমন শুনলে উৎসুক হবারই কথা।-কেন?

-আর বলো কেন, আমার বাইরেটাও খেলার মাঠ, বাড়িতেও খেলার মাঠ…গেল বার বেঙ্গল টিমে চান্স পেয়ে কি যে ক্ষতি হয়ে গেল সে-কেবল আমিই বুঝছি।

খেলার সমঝদার অতসী আদৌ নয়। তবু মুখে বলল, নামী খেলোয়াড় হওয়াও কম কথা নয়।

আবার হাসি। আমার দৌড় আমি তো জানি। হাজার খেলি, কোনদিন গাভাসকার বা কপিলদেব হতে পারব না। এর থেকে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়াটা অনেক সহজ ছিল, কিন্তু বাড়িতে খেলার মাঠের শুভার্থীদের হামলায় দুদিকই ফসকাবার দাখিল। সব নয়, এর মধ্যে একটা কথাই কুট করে কানে লাগল অতসীর।…খুব অনায়াসে বলতে পারল, এর থেকে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া অনেক সহজ ছিল। তা-ও এম, এ-তে আর ইংরেজি সাবজেক্ট নিয়ে। অতসীরও আত্মবিশ্বাস সব থেকে বড় পুঁজি। সে-ও অনেক সময়। ভেবেছে, ওই দুদুটো টিউশনি করতে না হলে সে-ও ইকনমিক্স-এ ফার্স্ট ক্লাস পেতে পারত।..সবে ফিফথ ইয়ার, ফাইনালের এখনো ঢের দেরি, এখনো অতসীকে যদি কেউ টিউশনি থেকে অব্যাহতি দেয়, সে কখনও এমন অনায়াস জোরের সঙ্গে বলতে পারবে না, এবারে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়াটা সহজ ব্যাপার।…ইকনমিক্স-এ ফার্স্ট ক্লাস ফি বছর একজন ছেড়ে দুতিন জনও পায়, কিন্তু ইংরেজিতে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়াটা তার বিবেচনায় ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ার ব্যাপার, অনন্য প্রতিভাধরও ওই বিষয়ে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া সহজ বলতে পারবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু যে বলল, সে একবার ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে দেখিয়ে দিয়েই বলল, এটা বৃথা আস্ফালনের পর্যায়ে ফেলার অজুহাত ভাবা যায় না।

.

এবারে অতসী নাম বাহারের প্রসঙ্গে বন্ধুদের কাছে সমর ঘোষালের সেই কটাক্ষপাতের প্রসঙ্গ–যা যুগপৎ আনন্দের সঙ্গে একটু তরল বিস্ময়েরও খোরাক যুগিয়েছিল। সমর ঘোষাল টিপ্পনির সুরে বলেছিল, নামের মধ্যে তোমরা কেবল নৈসর্গিক রসের বাস্তব রূপ দেখছো, কিন্তু ওই নামের সঙ্গে অদৃশ্য ছোট্ট একটু আকার যোগ করলে কি দাঁড়ায় তা কখনো ভেবেছ?

বলা-মাত্র কেউই বুঝে উঠল না। সমস্বরে প্রশ্ন, তার মানে?

–তার মানে অতসীর অ-এর সঙ্গে ছোট্ট একটু আ-কার জুড়ে দিলে কি দাঁড়ায়?

দুই একজনে তক্ষুণি বলেছে, কেন আতসী!

–ঠিক। তাহলে মানেটা কি দাঁড়ায়?

–ভেবে একজন বলেছে, আতসবাজি শুনেছি, আতসী সেই গোছের কিছু হবে।

-খুব ঠিক। আতসী মানে আগ্নেয়, যার জ্বলে ওঠার জন্য সামান্য একটু তাপই যথেষ্ট।…তা তোমাদের অতসীর সঙ্গে অদৃশ্য একটু আ-কার যুক্ত আছে কিনা ভেবে দেখেছ?

কথাটা স-পল্লবে অতসীর কানে উঠতে সময় লাগেনি। শোভনাই বলেছে। তারপর উৎসুক প্রশ্ন, কি রে, সমর ঘোষালের তোর মেজাজের আঁচ পাওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেছে নাকি?

না, অতসীর রাগ একটুও হয়নি, ভিতরে ভিতরে কেবল অবাক হয়েছে। অতসীর অ-এর সঙ্গে একটা আ-কার যুক্ত করলে কি হয়, তা কখনো ভাবেনি। কিন্তু যা হয় সেটা কত বড় সত্য তা ওই ছেলে কি বুঝে এমন টিপ্পনী কেটেছে, না নিছক ঠাট্টার ছলে? রাগ হলে বা আঘাত পেলে অতসীর ভিতরটা কি যে জ্বলে জ্বলে ওঠে, সব ভস্ম করে ফেলার মতো আক্রোশে ফুঁসতে থাকে সেটা ও নিজে ভিন্ন আর কে জানে? এমন হলে যন্না আরো বেশি, কারণ ভিতরে যতই জ্বলুক ফুসুক, বাইরে তার প্রকাশ কম। বাইরেটা সর্বদাই দাহ নিবারক শান্ত ব্যক্তিত্বে ঢাকা। ভিতরে বাইরে অতসী গাঙ্গুলী একজন নয়, প্রায় বিপরীত দুজন।

রাগের বদলে ওই একজনের প্রতি কৌতূহল দ্বিগুণ বেড়েছে। য়ুনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে দেখা হলে বা চোখাচোখি হলে মিটিমিটি হেসেছে। তারপর সেদিন এক ফাঁকে জিগ্যেস করেছে, সামনের রোববারে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে আসছ?

সমর ঘোষালও কদিন ধরে একটু যেন ব্যতিক্রম লক্ষ্য করছিল।-কেন বলো তো? ৩৪৮

-তোমাকে একটু কমপ্লিমেন্ট দেবার ছিল।

সত্যি অবাক।–কেন, কী করলাম?

কী করেছে মাথায়ও নেই বোঝা গেল। হেসেই জবাব দিল, তেমন কিছু না, দেখা হলে বলব।

লাইব্রেরিতে এসেছে। দুজনে দু জায়গায় বসে পড়াশুনা যেমন হয়–হয়েছে। তবে এইদিনে সমর ঘোষাল বেশ আগেই উঠে এসেছে। দেরি আছে?

অতসী নিজের হাতঘড়ি দেখল। এরই মধ্যে হয়ে গেল?

হয়ে গেল না, কমপ্লিমেন্ট পাওয়ার আশায় আর মন বসছিল না।

অতসীও হাসি মুখেই খাতাপত্র গুছিয়ে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে উঠে পড়ল। রাস্তায় নেমেই সমর ঘোষাল তাড়া দিল, কিসের কমপ্লিমেন্ট বলে ফেলো, সবুর সইছে না।

-তুমি খুব লোভী তো?

সমর ঘোষাল একবার থমকে তাকালো। তারপর হেসেই বলল, এমনিতে আমি খুব লোভী ছিলাম না, তবে মানুষের চরিত্র বদলাতে কতক্ষণ।…তা বলো, কমপ্লিমেন্ট কী কারণে?

অতসী কটাক্ষে একবার দেখে নিল। আগের মন্তব্য একেবারে তাৎপর্যশূন্য মনে। হল না। বলল, কমপ্লিমেন্ট অতসীর অ-এর সঙ্গে ছোট্ট একটা আ-কার জুড়লে কী দাঁড়ায় ছেলেদের সেটা বুঝিয়ে দেবার জন্যে।

শুনে সমর ঘোষাল প্রথমে জোরেই হেসে উঠল। ব্যাপারটা ভুলেই গেছল। হাসি থামাতে দুচোখ আবার পাশের দিকে ঘুরল। কমপ্লিমেন্ট তো দিলে…কিন্তু আসলে রেগে যাওনি তো?

–রেগে যাব কেন, তুমি তো অনেকটাই সত্যের কাছাকাছি গেছ…তবে আমার কেবল কৌতূহল, গেলে কি করে, নাকি এটা কেবল বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে নিছক রঙ্গরসের ব্যাপার?

সমর ঘোষাল মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।–সত্যি জবাব দিলে রেগে যাবে না তো?

-কেউ রেগে যাবে মনে হলেও তুমি সত্যের অপলাপ করো নাকি?

–তাহলে বলি।…তুমি আয়নায় নিজেকে দেখো?

–এ আবার কি কথা, রোজই তো দেখি!

বন্ধুদের যা বলেছি তার ষোল আনাই রঙ্গরসের কথা নয়, তার সঙ্গে তোমাকে নিয়ে আমার কিছু ধারণাও মেশানো ছিল।…তোমার চেহারাপ বা রুচির ছিমছাম বেশবাস চাল-চলন দেখলে কারো মনে হবে না দুদুটো টিউশানি আর নিজের হিম্মতের ওপর নির্ভর করে বি এ ইকনমিক্সে সেকেন্ড ক্লাস সেকেন্ড হয়ে এম. এ পড়তে এসেছ। বাসের আ-দেখলে চাপাচাপির ভয়ে তুমি সর্বদা ট্রামে যাতায়াত করো, সংগতি থাকলে ট্রামও এড়াতে। চরিত্রগতভাবে তুমি কেবল অতসী ফুলখানা হয়ে বসে থাকলে এত কষ্ট করে এভাবে এগোতে চেষ্টাই করতে না, অনেক আগেই যাচাই বাছাই করে কারো ঘরের শোভা বর্ধন করতে চলে যেতে। তাই আমার মনে হয়েছে যতই ওরা তোমার মধ্যে ফুলবাহার অতসীর মিষ্টি মিল টেনে বার করুক, দরকার হলে অতসী। থেকে তুমি আতসীও হয়ে উঠতে পারো।

অতসী কান পেতে শুনছিল। বলে উঠল, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ।

.

এরপর অনেক পাঠকের হয়তো প্রত্যাশা আর অনেক পাঠকের হতাশা, কাহিনা এবার চিরাচরিত প্রেমের রাস্তায় গড়াবে। …হা প্রেমের রাস্তায় এগনো একটু আছেই, তবে সকালের ঘাসের ডগায় মুক্তা-বিন্দুর মতোই স্বল্প পরমায়ু তার।

পড়াশুনার চাপ যথাসম্ভব বাড়িয়েও সমর ঘোষাল এম এতে ফার্স্ট ক্লাস পায়নি। কেউই পায়নি। সমর ঘোষাল সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে।

রেজাল্ট খুব প্রত্যাশিত হল না বলে অনেকে সহানুভূতি আর সান্ত্বনার কথা বলেছে। কেবল অতসী গাঙ্গুলী এ নিয়ে একটি কথাও বলল না বলে সমর ঘোষাল প্রথমে একটু অবাক হয়েছিল। পরে কিছু না বলাটাই তার ভালো লেগেছে-কথায় চিড়ে ভেজে না এই প্র্যাকটিকাল মেয়ে তা খুব ভালো করেই জানে।

অতসী ভেবেছিল দেখা-সাক্ষাতে এবারে একটু ছেদ পড়বে, আবার মনে মনে বিপরীত আশাও ছিল। বিপরীতটাই হয়েছে। য়ুনিভার্সিটির দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ হয়েছে। তার বদলে প্রত্যেক ছুটির দিনে সমর ঘোষাল ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে আসা শুরু করেছে। তার সাবজেক্ট ইংরেজি, বি. এ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, এম. এ-তে সেকেন্ড ক্লাস ফাস্ট-বে-সরকারী কলেজে চটপট একটা মাস্টারি জুটিয়ে নিতে কিছুমাত্র অসুবিধে হয়নি। অতসীকে বলেছে, এটা খুব সাময়িক, এবারে খেলার মাঠ ভুলে সে আই এ এস পরীক্ষা দেবার জন্য তৈরি হচ্ছে। সেই প্রস্তুতির তাগিদেই ছুটির দিনে এখন ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে আসা। এই উচ্চাশার কথা শুনে অতসী একটা উৎসাহের কথাও বলেনি। এ-টুকুও সমর ঘোষাল লক্ষ্য করেছে, কিন্তু আদৌ অখুশি হয়নি। এই ব্যক্তিত্বের মেয়ের মুখের কথায় নেচে না ওঠারই কথা। অন্য দিকে অতসী জানেও না আই এ এস হওয়ার জন্য ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে এসে কাজ করার কতটা দরকার।…সীরিয়াস ছেলে, এম, এ-তে ঘা খেয়েছে, দরকার থাকতেও পারে। কিন্তু এ-ছাড়া এখানে আসার আর কোনো আকর্ষণই নেই এটা সে ভাবেও না, বিশ্বাসও করে না।

দিন গড়িয়েছে। সমর ঘোষালের আই এ এস পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। কারণ পরীক্ষার মাত্র কদিন আগে তার বাবা মারা গেছে। সামনের বারে দেবে বলেছে। অতসী বাবার মৃত্যুর জন্য সহানুভূতি এবং সান্ত্বনার কথা বলেছে। আই এ এস-এ বসা হল না বলে কোনো পরিতাপের কথা বলেনি। এই না বলার মধ্যে তার শান্ত ব্যক্তিত্ব অর্থাৎ পারসোনালিটির দিকটাই বড় হয়ে উঠেছে সমর ঘোষালের কাছে। বনের পাখির আশায় কথা তারাই বেশি খরচ করে যাদের নিজের ওপর বা অন্যের ওপর আস্থা কম।

ততদিনে অতসীরও এম. এ পরীক্ষা শেষ। যথাসময়ে রেজাল্ট বেরিয়েছে। এবারে সেকেন্ড ক্লাস ফাস্ট। ফার্স্ট ক্লাস তিনজন। শোভনা তাকে কংগ্রাচুলেট করতে বাড়িতে ছুটে এসেছিল। তার এম, এ পরীক্ষা দেওয়াই হয়নি। সিক্সথ ইয়ারে পৌঁছুবার আগেই তার বিয়ে হয়ে গেছল। বড়লোকের মেয়ের রূপের ঘাটতি পূরণ করা কঠিন কিছু নয়। আপাদ-মস্তকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে মনে মনে অতসী তাকে খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছে। শীগগিরই ছেলেপুলে হবে বোঝা যায়।

সমর ঘোষালও সেই প্রথম বাড়িতে এসেছে। তার কথায় উচ্ছ্বাস বা আতিশয্য নেই এটুকু ভালো লেগেছে। কিন্তু কথাগুলো খুব পছন্দ হয়নি। বলেছিল, ফার্স্ট ক্লাস পেলে আরো কত যে ভালো লাগত…মনে মনে আশাও করেছিলাম।

শুনে অতসী হেসেছে, কিন্তু ভেতরটা চিনচিন জ্বলেছে।…কারণ, এই লোক এম. এ-তে ফার্স্ট ক্লাস পায়নি বলেই তার নিজের ফার্স্ট ক্লাস পাবার উদ্দীপনাটা দ্বিগুণ। বেড়ে গেছল। খেটেছিল খুব।

এরপর দুমাসের মধ্যে সমর ঘোষালের আর দেখা নেই। কেউ লক্ষ্য করছে না, অতসীর দুই ভুরুর মাঝে একটু কোঁচকানো ভাজ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সমর ঘোষালের বাড়িতে টেলিফোন আছে। নম্বরও জানা। বাইরে বেরিয়ে একটা ফোন করলেই হয়। তাতেও ভিতর থেকে বাধা।

না করে ভালই করেছে। আরো দিন দুই যেতে নিজেই এসে হাজির। বেলা। তখন এগারোটা বেজে গেছে। অতসীর কেন যেন মনে হল, তার এখানে বসার ঘর বলতে একটাই, এবং সেটা বাবা মা ভাই বোন সক্কলের অধিকারে, আর কারো হানাদারি অভিপ্রেত নয় বলেই অসময়ে আসা। এটা কোনো ছুটির দিন নয়, এক বাবা-মা ভিন্ন আর কারো বাড়িতে থাকার সম্ভাবনাও কম।

বসতে দিয়ে এবং নিজে মুখোমুখি বসে নিরীহ প্রশ্ন করল, এ সময়ে যে…আজ কলেজ ছিল না?

–ছিল, কাল রাতে হঠাৎ ছোট্ট একটা গল্প মনে পড়ে যেতে একটু বাড়তি উৎসাহ নিয়ে কলেজ বাতিল করে তোমার এখানে চলে এলাম।

-তাই নাকি, কি এমন গল্প?

দ্বিধা-ভরে অন্দরের খোলা দরজার দিকে একবার তাকালো।-ইয়ে…কেউ নেই তো?

-তোমার গল্প শোনার জন্য কান পেতে বসে থাকার মতো কেউ নেই।

শুনে বেশ একটু জোরের সঙ্গেই সমর ঘোষাল বলল, তাহলে আজ আর আমাকে ঠেকায় কে? গল্পটা ছোট্ট, সাদা-সাপটা ব্যাপার।…কোনো ছেলের এক মেয়েকে বিয়ে করার ইচ্ছে, কিন্তু অনেক পাঁয়তারা কষেও মেয়েকে কথাটা বলে উঠতে পারছে না। শেষে কি বলবে, অনেক গুছিয়ে রিহার্সাল দিয়ে বলবেই পণ করে সেই মেয়ের কাছে। হাজির। কিন্তু এত বারের রিহার্সাল দেওয়া ভালো-ভালো সব কথাগুলোই ভুল হয়ে গেল। ফলে নিজের ওপরেই বিষম রেগে গিয়ে ঠাস-ঠাস করে কেবল তিনটে কথা বলে উঠল, আমি তোমাকে চাই! শুনে মেয়েটি একবার শুধু তাকালো বলল, নিয়ে নাও….ছেলেটা হাঁ। ভাবছে ডারল্ড ইজি! সো ইজি!

দুই ঠোঁট চেপে অতসী হাসছে, চোখেও হাসি উছলে উঠেছে।

এবারে সমর ঘোষাল চেষ্টা করে গম্ভীর।ভাবলাম ঝপ করে বলে ফেলতে পারলে কপাল জোরে আমার কেসটাও তো ডারল্ড ইজি অ্যান্ড সো ইজি হয়ে যেতে পারে। –হাসি নয়, পারে কি পারে না বলো?

দুই ঠোঁটে আর চোখে হাসিটুকু তেমনি আগলে রেখে অতসী মাথা নাড়ল। পারে।

সঙ্গে সঙ্গে সমর ঘোষাল চোখ পাকালো, তাহলে দুদুটো মাস আমাকে যন্নার। মধ্যে না রেখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ফোন করলেই তো হত–করোনি কেন?

বসার ঢংটা একটু শিথিল করে নিয়ে অতসী বলল, এবার তাহলে আমার একটা ছোট্ট গল্প শোনো..এক ছেলের আর এক মেয়ের ভাব-সাব, দুজনে দুজনকে পছন্দও করে, তাই থেকে মেয়েটার ধারণা ছেলেটাকে তার ষোল আনা জানা হয়ে গেছে। মেয়েটি একদিন প্রস্তাব করল, এবারে আমরা বিয়ে করে ফেললে কেমন হয়। মুখে চিন্তার ছায়া ফেলে ছেলেটা জবাব দিল, হয় তো ভালই কিন্তু কে আর আমাদের বিয়ে করতে এগিয়ে আসছে বলো…। তাই আমি ষোল আনা বোঝার জন্য তোমার গল্পটা আগে শোনার অপেক্ষায় ছিলাম।

এবারে সমর ঘোষাল এত জোরে হেসে উঠল যে নিজের ঘরে বসেও অতসী সচকিত একটু।

-তাহলে চলো উঠে পড়া যাক, এই দিনে ঘরে বসে আর ডাল ভাত-মাছ। ভালো লাগবে না।

স্নান সারাই ছিল, খুশি হয়ে অতসী দশ মিনিটের মধ্যে তৈরী হয়ে এলো। তার এই অনাড়ম্বর ছিমছাম ভাবটা শুরু থেকেই সমর ঘোষালের পছন্দ। আর কেউ হলে কম করে আধ-ঘণ্টা সময় নিত।

পার্কস্ট্রীটে এসে একটা ভালো রেস্তোরাঁ বেছে নিল। খাওয়ার ফাঁকে টুকটাক ভবিষ্যতের কথা শুরু হল। সমর ঘোষাল প্রস্তাব করল, তাহলে মা-কে বলি, পুরুত ডেকে যত তাড়াতাড়ি হয় দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলুক?

অতসী বলল, পুরুত ডেকে পিঁড়িতে বসে বিয়ে আমার পছন্দ নয়, তার থেকে রেজিষ্ট্রি বিয়ে হোক।

-সে কি! কেন?

অতসী খুব অনায়াসে বলে গেল, কেন বুঝতেরছ না? বড় বোনের বিয়ে দিতে গিয়েই বাবা প্রায় নিঃসম্বল, ছোট বোন দুটো এখন কলেজে আর ভাইটা স্কুলে পড়ছে। ঘটার বিয়ে হলে লোকজনের ভিড় হয়ই, আর কনের সঙ্গে তারা আর কি ঘরে আসছে তা-ও লক্ষ্য করে। তুমি যখন বড়লোকের সালঙ্কারা কন্যা ঘরে এনে তুলছ না, আমার দিকের দৈন্য সকলের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর দরকার কি? এর থেকে নিঝঞ্ঝাটে রেজিষ্ট্রি বিয়ে অনেক স্বস্তির হবে।

সমর ঘোষাল খাওয়া থামিয়ে শুনল। আরো মুগ্ধ হল। মাথা নেড়ে আন্তরিক সায় দিল।খুব যুক্তির কথা, মা একটু খুঁত খুঁত করবে, কিন্তু কি আর করা যাবে! ঠিক আছে, রেজিষ্ট্রি বিয়েই হবে।

এবারে অতসীর সোজা-সরল প্রশ্ন, এ-তো হল, তারপর?

-তারপর কি?

বিয়ের পরের প্রোগ্রামটা কি?

–আই এ এস পরীক্ষায় ওপরের দিকে ঠাই পাওয়ার জন্য এবারে আরে আদা জল খেয়ে লাগব…মনে হয় ভালোই করব।

নিরুত্তাপ গলায় অতসী বলল, মনে হয় কেন, পরীক্ষা দিলে ভালো করবেই। …কিন্তু আমার দিকটা তাহলে ভাবছ না–

সমর ঘোষাল শশব্যস্ত, কেন কেন–তোমার কথা ভেবেই তো আমার আরো বেশি পছন্দ–কিন্তু তুমি কি ভাবার কথা বলছ?

অতসী মুখের দিকে চেয়ে টিপটিপ হাসছে।–তুমি আই এ এস অফিসার হয়ে জায়গায়-জায়গায় ঘুরে বেড়াবে আর আমি তাহলে সেই অতসী ফুলটি হয়েই কেবল তোমার ঘরের শোভা বাড়াবো?

এ দিকটা ভাবা হয়নি বটে, সমর ঘোষাল মনে মনে একটু হোঁচট খেয়ে উঠল। তারপর ব্যস্ত মুখেই বলল, তোমারও তো কোয়ালিফিকেশন কম নয়, তুমিও ভালো চাকরি পেয়ে যেতে পারো, আর গভর্নমেন্টের চাকরি হলে দুজনের এক-জায়গায় থাকতেও অসুবিধে হবে না।

মুখে হাসির আভাস লেগেই আছে। দুচামচ ফ্রায়েড-রাইস চালান দিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, পাঁচ বছর ধরে ছেলে-মেয়ে পড়াচ্ছি, এই এক চাকরি ছাড়া আমার আর কিছু ভালো লাগবে না। বি. এ এম. এ-র একটাতেও ফার্স্ট ক্লাস পেলাম না, গভর্নমেন্ট কলেজে চাকরি পাওয়ার কোনো আশা নেই, এ তুমি খুব ভালোই জানো। গভমেন্ট স্কুলে চাকরি পেতে পারি হয়তো, কিন্তু আই এ এস অফিসারের বউ স্কুল। মাস্টার এটা তোমার খুব ভালো লাগার কথা নয়, আর এখানকার প্রাইভেট কলেজের চাকরি যদি জোটেও তোমার বদলীর চাকরির সঙ্গে খাপ খাওয়ার কোনো আশাই নেই, তখন তুমি এক জায়গায় আমি এক জায়গায়। গা-ঝাড়া দিয়ে হেসে নিল একটু, মোটকথা তোমার ওই আই এ এস চাকরি আমার একটুও পছন্দ নয়।

বলার সুরটুকু এমনি সহজ অথচ স্পষ্ট যে সমস্যাটা সমর ঘোষালের কাছে। আন্তরিক হয়ে উঠল। একই সঙ্গে চিন্তার কারণও। বলল, তাহলে এ-রকম একটা বাজে কলেজেই পড়ে থাকব?

-তা কেন, আগাগোড়া ভালো কেরিয়ার তোমার, ইংরেজির মতো সাবজেক্ট একটাতে ফার্স্ট ক্লাস আর একটাতেও অদ্বিতীয় সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট, এই প্রভিন্সের এতগুলো য়ুনিভার্সিটির কোথাও না কোথাও অনায়াসে ঢুকে পড়তে পারো–পারো না?

সমর ঘোষাল সায় দিল, তা পারি।

উৎসাহে অতসীর মুখখানা আরো সুন্দর লাগছে।–টিচিং লাইনে এলে কত ছুটি ভেবে দেখেছ, আর কত সুবিধে? নিজেদের মধ্যে আমরা কত সময় পাক-ইচ্ছে করলে, তুমি ডক্টরেটের থিসিস সাবমিট করতে পারো, পয়সা করার ইচ্ছে থাকলে ছাত্রদের জন্য দরকারি বই লেখারও অঢেল সময় পেতে পারো–আই এ এসএর পিছনে ছুটে কেবল প্রতিপত্তি ছাড়া খুব বেশি আর কি পাবে?

কান জুড়নোর মতোই কথা আর যুক্তি। সোৎসাহে বলল, বেশ বেশ। আমি কোনো যুনিভার্সিটির চাকরিতেই ঢুকে গেছি ধরে নাও কিন্তু তখন তুমি কি করবে?

অতসীর হালছাড়া হাসি আর জবাব, তখন আমার আর কি সমস্যা! যেখানে তুমি, আমিও সেখানেই। কলেজের মোহ আমার নেই, স্কুলের চাকরি তো একটা জোটাতে পরিবই! প্রোফেসর হলে তখন আমার স্কুলের চাকরি নিয়ে কারোই কোনো কমপ্লেকস থাকবে না–দুজনের রোজগারে দিব্যি চলে যাবে–তার বেশি আমাদের। দরকার কি?

সমর ঘোষাল মুগ্ধ চোখে খানিক চেয়ে রইলো। তারপর আধাভরাট খাবারের ডিশ ফেলে কেবিনের পর্দা ঠেলে বেরিয়ে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে এলো। ফিরে এসে অতসীর গলা জড়িয়ে ধরে ফ্রায়েড রাইস আর চিলি-চিকেন খাওয়া মুখে গভীর একটা চুমু খেল।

অতসীর হাঁসফাস দশা। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, তুমি একটি অসভ্য!

সমর ঘোষাল বলল, তোমার থেকে আমি যত ভালো রেজাল্টই করি, প্র্যাকটিকাল বিচারবুদ্ধিতে আমি তোমার নখের যোগ্যও নই।

অতসর হাসিমুখ, সেই সঙ্গে ধমকের গলা, তাবলে ভক্তিশ্রদ্ধার ঠেলায় এরকম। হামলা! আরো সুযোগ সুবিধে থাকলে কি করতে?

শোনার পর সমর ঘোষালের দুচোখে সত্যিই তিমির তৃষ্ণা।

.

বিয়ে হয়ে গেল। অতসী গাঙ্গুলি অতসী ঘোষাল হল।

এর পরের সবকিছুই যেন তাদের ইচ্ছার অনুকূলে সাজানো। তাদের বলা ঠিক হল না, অতসীর। সমর ঘোষাল যুগপৎ খুশি এবং অবাক হয়ে দেখছে পরের সব পদক্ষেপ অতসীর হিসেব মতোই দুজনকে বাস্তবের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে।

…ভালো মতো একটু নড়া-চড়া করতে দেখা গেল অতসীর কথা মিথ্যে নয়, কলেজ-যুনিভার্সিটির চাকরি যেন তার জন্য হাঁ করেই ছিল। মফঃস্বল কলেজের সরকারী চাকরি পছন্দ হল না, নর্থবেঙ্গল যুনিভার্সিটিতে লেকচারারের পোস্টটাই পছন্দ। এখানকার শ্রদ্ধেয় ইংরেজির প্রোফেসারও এই চাকরিই নিতে পরামর্শ দিলেন। আর বললেন, এ-লাইনেই এলে যখন যত তাড়াতাড়ি পার ডক্টরেটটা করে নাও, নইলে এগোতে অসুবিধে হবে।

সমর ঘোষাল তারই আন্ডারে রিসার্চ করবে স্থির করেই রেখেছিল। ভদ্রলোকের খবই স্নেহের পাত্র সে, খুশি হয়েই রাজি হয়ে গেলেন। কয়েক দিনের আলোচনায়। রিসার্চের বিষয়ও স্থির করে অতসীকে নিয়ে সে শিলিগুড়ি রওনা হয়ে গেল। প্রোফেসার দূরে থাকলেও অসুবিধে কিছু হবার কথা নয়। মাঝে মধ্যে কলকাতায় আসতে হবে, ভেকেশনগুলো আছে, এটা কোনো বাধাই নয়।

য়ুনিভার্সিটি ক্যামপাস কলেজ থেকে অনেকটাই দূরে। এই এলাকায় ঘর আগেই ঠিক করে রেখে গেছল। দোতলা বাড়ির একতলায় দুখানা বড় ঘর, কিচেন বাথ ইত্যাদির আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাও অপছন্দের নয়। কলকাতার ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে এ রকম ফাঁকা জায়গায় এসে অতসী খুশি। শিলিগুড়ি শহরেও শুনেছে লোকের মাথা লোকে খায়, শহরের ভিতর দিয়ে আসার সময় যেটুকু দেখেছে তাতেই হাঁপ ধরার দাখিল। এখানে এসে ওঠার পর একটু কেবল খুঁতখুঁতুনি থেকেই গেল। বড় হলেও ঘর মাত্র দুখানা। এরপর লোকজন আসা শুরু হলে তাদের কোথায় বসাবে কি করবে? যাক, অতসী কোন কিছুতে ঘাবড়াবার মেয়ে নয়, পুরুষের বুদ্ধিতে যেটুকু হয়েছে তাই যথেষ্ট, পরে দেখা যাবে।

নতুন একটা সংসার পেতে বসার ঝামেলা যে কত, দেখে প্রায় অসহায় অবস্থা সমর ঘোষালের। ব্যবস্থা করা আর গোছগাছের ঠেলায় অতসীর ফুরসৎ তো নেই-ই, নতুন কর্তাটিরও নাজেহাল দশা। তার ওপরেও ফরমাশ বর্ষণ হয়েই চলেছে, এটা আনো ওটা আনো, এটা করো ওটা করো। অতসীরও তো নতুন সংসারই, সব একেবারে মনে পড়ে না। ফলে যা একবারে হয়ে যায় তার জন্য তিন বার করে। ছোটাছুটি। আবার ফরমাশ অনুযায়ী যা আনে তার বেশিরভাগই পছন্দ হয় না, নাক-মুখ কুঁচকে বলে ওঠে, এ-রকম আনলে কেন–ও-রকম পেলে না? এ মা, প্লাস্টিকের এত বড় বালতি আনতে বলেছি তোমাকে! দেখ কাণ্ড, কিচেন বাথরুম টয়লেটের জন্য তিনটেই লাল মগ–কোনো বুদ্ধি যদি থাকত, বদলাবদলি হয়ে গেলে টের পাবে!

ঘাম ঝরা নাক-মুখ কোঁচকানো মূর্তিখানা চোখে মিষ্টিই লাগে সমর ঘোষালের, তাই বিরক্তির বদলে হাল ছেড়ে বসে পড়ে।আমার দ্বারা আর কিসসু হবে না, আমার বদলে ওই ছেলেটার ওপর তোমার সর্দারি চালাও।

ছেলে বলতে ওপরতলার ভদ্রলোকের ঠিক-করা কাজের লোকটা। জোয়ান, গাঁটা-গোট্টা চেহারা, ভাবলেশশূন্য পালিশ করা মুখ, নাম শেরিং। এই তিন দিন ধরে তার নীরব দর্শক আর কলের পুতুলের মতো হুকুম তামিলের ভূমিকা। বাংলা বলতে পারে না, ভাঙা-ভাঙা হিন্দি বলতে পারে এবং বোঝে। গত তিন দিন যাবত এই বংগালী মেমসাবটি তার মনোযোগী দ্রষ্টব্যের একজন। অতসী চাপা গলায় গজগজ করে উঠল, একটু গুছিয়ে নিয়েই ওকে আমি তাড়াব, সব টানা-হেঁচড়া করতে করতে কতবার করে বুকের কাপড় কাঁধের কাপড় সরে যাচ্ছে, ওর হাঁ-চোখ দৃষ্টি তখনো নড়ে না–

একটা সিগারেট ধরাবার ফাঁকে সমর ঘোষাল আড়চোখে লোকটাকে দেখে নিয়ে বলল, বুক-কাঁধের কাপড় তাহলে আর একটু বেশি-বেশি সরাও, দেখবে ও খুশি হয়ে আমার থেকে ঢের বেশি পছন্দ মতো তোমার সব কাজ করে কম্মে দেবে।

কিছু একটা উদ্দেশ্য নিয়ে অতসী বড় স্টিল ট্রাঙ্কটার ও-ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঠাট্টার জবাবে গম্ভীর মুখে দেখে নিল একবার তারপর লোকটার দিকে ফিরল।-শেরিং!

দুচোখ তার মুখের ওপরেই ছিল। গলা দিয়ে বিড়বিড় শব্দ বার হল, জি মেমসাব

পাঁচ-পাঁচটা বছর মাড়োয়ারী বাড়িতে মাস্টারী করার ফলে অতসী হিন্দিটা মোটামুটি রপ্ত করেছে। আঙুল দিয়ে ট্রাঙ্কটার উল্টো দিক দেখিয়ে হুকুম করল, ইধার আও।

সমর ঘোষাল বুঝল ট্রাঙ্কটা যেখানে ছিল সেখানে রাখা আর পছন্দ নয়, অন্যত্র সরাবে। এ-রকুম ওলট-পালট করেই চলেছে। শেরিং এগিয়ে এসে যথাস্থানে দাঁড়ালো। ভাবলেশশূন্য দুচোখ তখনো কর্রীর মুখের ওপর।

-আপনা দো আঁখো জমিন পর রাখো।

এবারের হুকুম শুনে সমুর ঘোষাল এস্ত একটু। লোকটা তাই করল। দুচোখ নিজের পায়ের দিকে নামালো।

–আব উধার পাকড়ো–আঁখো মাৎ উঁচানা

ঝুঁকে অতসী নিজে ট্রাঙ্কের এ-দিকের আংটা ধরল।–লে আও।

ধরাধরি করে ঢাউস ট্রাঙ্ক পছন্দের জায়গায় রেখে অতসী সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কাজ সেরে লোকটাও মুখ তুলেছিল, কিন্তু সমর ঘোষাল আশ্চর্য হয়ে দেখল, কীর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই দুচোখ আবার মাটির দিকে।

আব তুমি বাহার যা কে ঠায়রো, হম বোলায়গা।

ঘর ছেড়ে বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। দৃষ্টি তার পরেও পায়ের দিকে।

সমর ঘোষাল এবার চাপা গলায় বলে উঠল, এ-রকম করলে লোকটা পালাবে যে!

অতসীর গম্ভীর মুখের দুই ঠোঁটে এবারে একটু হাসির ফাটল। বলল, বেশি বাড়লে তোমারও ওই দশা হবে।

সমর ঘোষালের মনে হয়েছে এই ব্যক্তিত্বের মাধুর্যটুকুই দুচোখ ভরে দেখার মতো।

.

দিন সাতেকের চেষ্টায় সব-কিছু চলনসই। মনে হল অতসীর। বড় সমস্যা ছিল রান্না নিয়ে। কারণ কলকাতায় যেভাবে দিন কেটেছে, অতসীর কখনো রান্নাঘরে ঢোকার সময় হয়নি। এ-ব্যাপারে তার সহজাত ঝোঁকও নেই। ওপরতলার ভদ্রলোক বলে দিয়েছিলেন, বাঙালি বাড়িতে কাজ করে করে শেরিং মোটামুটি রান্নাও শিখেছে। দুতিন দিন য়ুনিভার্সিটি-ক্যান্টিন থেকে খাবার আনিয়ে লাঞ্চ ডিনার সারা হয়েছে। কিন্তু এ-ব্যবস্থা কদিন আর চলতে পারে, তাছাড়া ক্যানটিন খুব কাছেও নয়। শেরিং কলের মানুষ, তাই কর্তীর কোনো হুকুমে তার মুখে বিরক্তির ছায়া নেই। আর তার দুচোখও এখন সর্বদা মাটির দিকে। অতসী লক্ষ্য করেছে সকালের ব্রেকফাস্ট চা টোস্ট ডিমসেদ্ধ বা ওমলেট তার আয়ত্তের মধ্যে, বিকেলেরটা এপর্যন্ত পরখ করা হয়নি, কারণ ক্যানটিনে সে-সময় লুচি-পুরি তরকারি আলুর দম ভালোই মেলে। অতসী হুকুম করা মাত্র কলের মানুষটা আশ্চর্যরকম তৎপর হয়ে তড়িঘড়ি নিয়ে আসে। অতসী এরপর তাকে রান্না ঘরে ঠেলেছে। জিগেস করা মাত্র সে বলেছে বাঙালী রান্না সে সবই জানে। কিন্তু তার জানার বহর দেখে প্রথম দিনই সমর ঘোষালের দুচোখ কপালে। ভাতে খুব ত্রুটি নেই, কেবল সেদ্ধ একটু কম, ডালের সঙ্গে ভাজাও ঠিকই আছে, কিন্তু ডালটাকে ফ্রায়েড ডাল বলা যেতে পারে। তরকারি যা পাতে পড়ল সেটা একটা স্বাদশূন্য রকমারি আনাজের ঘাট, মাছের ঝোল একদিকে আর কড়া ভাজা মাছের খণ্ড আর একদিকে। তা-ও ছনছনে ঝাল।

প্রথম দিনের রান্না কিছুটা চালান দিয়েই হতাশ গলায় সমর ঘোষাল বলে উঠেছিল, এবারেই হয়ে গেল, দুজনেরই আলসার অনিবার্য।

অতসী কিন্তু মোটামুটি খেতে পেরেছে। ধমকের সুরে বলেছে, একটু ধৈর্য ধরো তো, বলে দিলে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু সাহেবের খাওয়া দেখে শেরিঙের নিজেরই খটকা লেগেছে। চার ভাগের তিন ভাগ তার পাতে পড়ে। নিজের পায়ের দিকে চোখ নামিয়ে মেমসাহেবের কাছে নিবেদন করেছে, মিট-কারি, এগ কারি সুপ-এ-সব হলে সে ভালো খানা পাকাতে পারে।

দেখা গেল এ-গুলো সত্যিই চলনসই। কিন্তু দুবেলা এই একই জিনিস কাহাতক চলে। দুদিন না যেতে বিরক্ত হয়ে সমর ঘোষাল বলে উঠেছে, শোনো, আমার জন্য সব কেবল সেদ্ধ করে রাখতে বোলো, আমি সেদ্ধ-ভাত খাব! ডাল তরকারি সুক্তোর স্বাদ তো ভুলতেই বসেছি।

শোনামাত্র অতসীর তপ্ত মুখ।-আমি যা পারি না তা নিয়ে খোঁচা দিয়ে লাভ কি, তোমার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, দেখেশুনে একজন রাঁধুনি বিয়ে করলেই ভালো। করতে। রোসো দুদিন, সব ঠিক হয়ে যাবে।

দুদিন যেতে দেখা গেল সত্যি অনেকটাই ঠিক হয়ে এসেছে। ডাল তরকারী মাছ সবই মুখে দিতে পারছে। কি ব্যাপার? না, অতসী সোজা গিয়ে ওপরতলার গৃহিণীর শরণাপন্ন হয়েছিল। সমস্যার কথা শুনে তিনি নেমে এসে হাতে ধরে শেরিংকে এই তিনটি জিনিস রাঁধতে শিখিয়েছেন। এখন নাকি সুলে রাঁধতে শেখাচ্ছেন। অতসী হেসে সারা, মহিলা যা দেখান যা শেখান শেরিঙের মাটির দিকে চোখ, শেষে ধমক খেয়ে বুঝেছে রান্না শেখার জন্য তার দিকে তাকানো যেতে পারে।

সাত আটদিন যেতে অতসী নিজের ভাবনা ভাবতে বসল। স্কুলের চাকরি একটা জোটাতে হবে। কেবল এখানে কেন, কালিম্পং কারসিয়াং দার্জিলিং-এ যেতে হলেও তার আপত্তি নেই। মেয়েদের হস্টেলে থাকবে, শনি রোববারে বা অন্যান্য ছুটির দিনে চলে আসবে। এ কটা দিন যেতে সমর ঘোষালও মোটামুটি সুস্থির। ঘর গোছানো আর সংসার পাতা নিয়ে অতসীর ফরমাশের পর ফরমাশ, অন্যদিকে ছাত্র পড়ানোর প্রস্তুতি–কোনো দিকে তাকানোর অবকাশ ছিল না। পরামর্শের জন্য অতসী তাকে টেনে এনে সামনে বসালো–ইংরেজিটা তুমি আমার থেকে ভালো জানো যখন নিজে আর কষ্ট করি কেন, আমার বায়োডাটা দিয়ে দরখাস্তের জেনারেল একটা খসড়া করে দাও, তারপর চেষ্টা শুরু হোক, এ কটা দিন তো নিজের তালেই কাটালে—

মুখের দিকে চেয়ে এই প্রথম কি একটু ব্যতিক্রম চোখে পড়ল সমর ঘোষালের। উঠে এসে সামনে দাঁড়ালো। –দেখি দেখি! দুহাতে মাথাটা ধরে সামনে টেনে নিবিষ্ট চোখে কিছু দেখার চেষ্টা, সঙ্গে মন্তব্য, একটা মাইক্রোসকোপ থাকলে ঠাওর করা যেত

অতসীর গলা দিয়ে প্রায় আর্তনাদের মতো বেরুলো, কি–পাকা চুলটুল নাকি?

সমর ঘোষাল হাসতে লাগল, বলল, না, লাল আঁচড়ের মতো একটু কিছু চোখে পড়েছে, এ কদিন খেয়ালই করিনি, কপালে এমন সুন্দর টকটকে সিঁদুরের টিপ পরতে, সিঁথির সিঁদুরও আগুনের শিখার মতো জ্বলজ্বল করত–সে-সব এরই মধ্যে বাতিল!

যাও! অতসী দুহাতে তাকে ঠেলে সরালো। কলকাতায় তোমার মায়ের পছন্দে ও-রকম পরতে হত, এখানে আমি ও-রকম গেঁয়ো সেজে বেড়াবো?

-সঙ কেন, তোমার ফর্সা কপালে অমন টকটকে সিঁদূর টিপ আমার তো খুব ভাল লাগত, আর মনে হত একমাত্র আমি ছাড়া আর সক্কলের বেশি কাছে আসা নিষেধ।

অতসীর মুখে রাগত হাসি।আর এখন কি মনে হচ্ছে, দুহাত বাড়িয়ে সকলকে আমি কাছে ডাকছি?

সমর ঘোষাল মাথা নেড়ে সায় দিল, অর্থাৎ সে-রকমই লাগছে। তারপর নিরীহ প্রশ্ন, শেরিংকে ডেকে যাচাই করে নেব?

–যা বললাম, বসে করবে না এইসব করবে?

জবাবে আগে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলল।–তা করতেই বা হাত উঠছে কই, এখন ধরো তোমার যদি কারসিয়ঙ বা দার্জিলিং-এ চাকরি হয়, আমার ভালো লাগবে? এখন তো ভাবনা আরো বাড়ল, তোমাকে কুমারী ভেবে ভালো লোকও যদি বেশি কাছে আসতে চায় তাকে দোষ দেওয়া যাবে না।

সমর ঘোষাল আশা করেছিল এতটা বলার পর ওই ফর্সা কপালে ছোট হলেও একটা সিঁদুর টিপ আর সিঁথির লাল আঁচড় আর একটু উজ্জ্বল দেখবে। এ কদিনে ওটুকু ভারী পছন্দের হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু দেখা গেল না।

তিন দিনের মধ্যে এই একই প্রসঙ্গে আবার একটু মজার যোগাযোগ। অতসী এখানকার সব থেকে নামকরা মেয়ে স্কুলে এসে হাজির। ব্যাগে দরখাস্ত। নারভাস হবার মেয়েই নয় সে। অফিসের কেরানীর কাছে আগে প্রিন্সিপালের নাম জেনে নিল, মিসেস হৈমন্তী খাসনবিশ। তারপর বেরিয়ে এসে স্লিপে নিজের নাম লিখতে গিয়েই ভুল। লিখেছে শ্রীমতী অতসী গাঙ্গুলি। বিরক্তির একশেষ। দ্বিতীয় স্লিপে শ্রীমতী অতসী ঘোষাল লিখে বেয়ারার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিল। দুতিন মিনিটের মধ্যেই ডাক এলো।

বরাতটাই বোধহয় খারাপ আজ। ঘরে পা দিয়ে নিজের অগোচরেই একটু অভব্যতা করে ফেলল। কারণ স্কুলের কোনো প্রিন্সিপালের এমন দশাসই চেহারা তার কল্পনার। বাইরে। পোশাক পরিচ্ছদও একটু বিচিত্র ধরনের। বিশাল টেবিলের ওধারে মস্ত একটা রিভলভিং চেয়ার জুড়ে বসে অল্প অল্প দোল খাচ্ছেন। পরনে সাদা সিল্কের শাড়ি, গায়ে কাজ করা সিল্কের সাদা ব্লাউস, তার ওপর সাদা কাজ করা খয়েরি রঙের ঢাউস একটা দুক-খোলা এপ্রনগোছের হাফ-হাতা লং কোট। মাথায় অবিন্যস্ত সাদা-কালো চুলের বোঝা। নাকের নিচে ঘন লোম, দুই গালেরও অনেকটা আর হাতের কনুই থেকে যেটুকু চোখে পড়ে তা-ও ঘন লোমে বোঝাই। মুখের ছাদ পুরুষালি। শাড়ি পরা না থাকলে বা খোলা এপ্রনের মাঝখানে বক্ষের বিপুল স্তন-ভারের আভাস না দেখা গেলে মেয়ে কি পুরুষ ভেবে দুচোখ আরো বেশি বিভ্রান্ত হত।

.

ইয়েস? আই অ্যাম মিসেস খাসনবিশ, সীট ডাউন প্লীজ! হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?

অতসী ধরেই নিল সে ফেল। মানে মানে এখন সরে পড়লেই হয়। সেটা করা আরো বিসদৃশ। দুহাত জুড়ে একটু বেশি আনত হয়ে শ্রদ্ধা জানালো। মহিলার দিক থেকে তার কোনো জবাব মিলল না। বিশাল টেবিলের এ-ধারের চেয়ারে মুখোমুখি বসল। কিন্তু তার চোখে চোখ রাখতে মনে হল, উনি যেন প্রথম দর্শনে ওর ভেবা চ্যাকা খাওয়া মূর্তি দেখে বেশ মজা পাচ্ছেন।

অতসী সবিনয়ে জানালো, সে একটা চাকরির চেষ্টায় এসে তাকে বিরক্ত করতে বাধ্য হয়েছে, এই এই কোয়ালিফিকেশন, যদি কোনো সুবিধে হয়।

মিসেস খাসনবিশ ঝুঁকে আর একবার স্লিপের নামটা দেখলেন। গলার স্বর এমনিতেই ফ্যাসফেসে, প্রশ্ন আরো রুক্ষ। এম, এ অ্যান্ড বি, এ ফ্রম হোয়াট য়ুনিভার্সিটি?

–ক্যালকাটা য়ুনিভার্সিটি?

–দেন হোয়াই হিয়ার?

অতসী সবিনয়েই জানালো, হাসব্যান্ড এখানকার য়ুনিভার্সিটিতে জয়েন করেছেন তাই সে এখানে। মাত্র আট দশদিন হল তারা এখানে এসেছে।

তখুনি সেই সিঁদুর প্রসঙ্গের পরোক্ষ যোগাযোগ। হাসব্যান্ড শুনে প্রিন্সিপাল লোমশ দুই হাত টেবিলের ওপর রেখে সামনে ঝুঁকলেন, থলথলে মুখের দুচোখ তার দিকে নিবিষ্ট হল। তারপর মন্তব্য, ইউ আর ম্যারেড দেন…! ক্রিশ্চিয়ান?

–না হিন্দু।

শুনে কৌতূহল বাড়লো যেন।–কতদিন বিয়ে হয়েছে?

–মাস দুই আগে…।

থলথলে মুখে হাসির আভাস একটু। আবারও তেমনি ঝুঁকে বসেই নিরীক্ষণ করলেন একটু। তারপর সোজা হয়ে বসে বললেন, আই অ্যাম সরি, ক্লাস ইলেভেন টুয়েলভ-এর জন্য আমার একজনই ইকনমিকস-এর টিচার আছে। তার রিটায়ারমেন্টের এখনো বছর দুই বাকি

ফ্যাসফেসে গলার স্বর একটু সদয় মনে হল অতসীর। দ্রুত ভেবে নিল, দুটো বছর সে যে কোনো নিচু ক্লাসেও পড়াতে প্রস্তুত, বলবে কি বলবে না। কিন্তু তার আগেই মিসেস খাসনবিশ বললেন, বাট আই মে ট্রাই টু হেল্প ইউ..জলপাইগুড়ির গার্লস স্কুলের হেডমিসট্রেস আমার বন্ধু, শী রিগারডস মি, তার স্কুলে ইকনমিক্স-এর একটা লিভ ভেকেন্সির পোস্ট খালি আছে শুনেছি, তাঁর ইকনমিক্স টিচারের টিউবারকিউলোসিস ধরা পড়তে সে লং লিভ এ আছে, তিন চার দিন আগে হেডমিসট্রেস আমাকে ফোনে জিগেস করেছিলেন, আমার চেনা-জানা কেউ আছে কিনা, আপনি

অতসী তক্ষুনি বলে উঠল, আমাকে আপনি বলে লজ্জা দেবেন না

খুশি।–অলরাইট, গো অ্যান্ড সি হার, এর মধ্যে কাউকে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিনা জানি না, যদি না নেওয়া হয়ে থাকে, ইউ হ্যাভ ফেয়ার চান্স…ইউ মে রেফার মি।

মহিলা এতটা সদয় হতে পারে আশাতীত। জলপাইগুড়িতে চাকরি হলে এখান থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করা জল-ভাত ব্যাপার। অতসী আর একটু ঝুঁকে কৃতজ্ঞতায় টুপুটুপু সুরে বলল, ইউ আর সো কাইন্ড ম্যাডাম, যেখানেই চাকরি করি দু বছর বাদে হলেও আমি এখানে আপনার আশ্রয়ে আসব এই আশা নিয়ে যাচ্ছি, আমার সঙ্গে অ্যাপ্লিকেশন আছে, যদি অনুমতি করেন তো এখনই সেটা রেখে যেতে পারি…।

থলথলে মুখের খাঁজে খাঁজে হাসি উছলে উঠল।–্যু ইয়ার..এ লং টাইম মাই ডিয়ার, হাউ এভার ইউ রিয়েলি দিস বিজনেস…অ্যান্ড দ্যাটস গুড। লোমশ হাত বাড়িয়ে দিলেন, লেট মি হ্যাভ ইট।

ব্যাগ খুলে তৎপর হাতে অতসী অ্যাপ্লিকেশনটা বার করে খসখস করে নিজের নাম সই করল। তারপর একটু থমকে জিগেস করল, ডেট দেব?

-ও সিওর…আই অলওয়েজ ওয়ান্ট টু বি ফেয়ার-ডেট, উইল ক্লেইম প্রায়রিটি, হু নোজ দ্যাট দি প্রেজেন্ট ইকনমিক্স টিচার উইল নট কুইট, আরলিয়ার…আই ডোন্ট লাইক হার, নাইদার সি ডাজ মি, নাও আই হ্যাভ ওয়ার্কস, টু ডু উইশ ইউ গুড লাক।

বলবে না বলবে না করেও হেসে গড়িয়ে কর্তাটির কাছে প্রিন্সিপাল মিসেস। খাসনবিশের তাকে কুমারী ভাবার কথাটা না বলে পারল না। আগে ইন্টারভিউর আদ্যোপান্ত বলে পরে এটুকু শুনিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে হতাশায় যেন ভেঙে পড়ে সমর ঘোষাল অতসীর গা-ঘেঁষে শুয়ে পড়ল।–তাহলে বোঝ, ঝানু মহিলারাই তোমাকে কুমারী ভাবছে, পুরুষেরা হামলে পড়বে না কেন?

তাকে ঠেলে সরাতে চেষ্টা করে অতসী হাসতে হাসতে বলল, কিন্তু আমার তো মনে হয়, আমাকে কুমারী ভেবে ঠকেছেন বলেই উনি পরে বেশি সদয়।

সমর ঘোষাল তড়াক করে উঠে বসেছে, মিসেস খাসনবিশ সধবা না বিধবা?

জব্দ করার জন্যেই অতসী জবাব দিল, সবাই শুনেছি, কিন্তু কপালে সিঁথিতে সিঁদুরের বংশও নেই (শেষেরটুকু সত্যি)।

সমর ঘোষাল চোখ পাকালো তুমি আর ওই স্কুলের ত্রিসীমানায় ঘেঁষবে না।

দেখা গেল চাকরির ভাগ্য অতসীরও খারাপ নয়। জলপাইগুড়ি স্কুলের চাকরিটা পেল। হেড মিসট্রেস তাকে পরের সপ্তাহ থেকেই জয়েন করতে বলেছেন। সমর ঘোষালও আপাতত নিশ্চিন্ত। এখান থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করা কঠিন কিছু নয়। সমূহ বিচ্ছেদের সম্ভাবনা থাকল না।

কৃতজ্ঞতা আর ধন্যবাদ জানাতে অতসী তার পরদিনই এখানকার মেয়ে স্কুলের প্রিন্সিপাল মিসেস হৈমন্তী খাসনবিশের সঙ্গে দেখা করতে ছুটল। এবার দিনের সাক্ষাৎকারের মিয়াদ মিনিট দুই তিন। বললেন, দ্যাটস ইয়োর লাক, আই অ্যাম গ্ল্যান্ড। ওঠার আগে একবার শুধু জিগেস করলেন, যে পোস্ট-এই যাও হোল-টাইম সীনিয়র টিচারের ইলেভেন টুয়েলভ ছেড়ে ক্লাস নাইন টেন-এও পড়াতে হয়…হোয়াট এলস। ইউ ক্যান্ টিচ?

–বি. এ পাএ ম্যাথস্ ছিল..ইংরেজিও পড়াতে পারি।

অতসী পিছু হটার মেয়েই নয়।

–থিংক, দ্যাট উইল ডু, ও, কেউইশ ইউ গুড লাক এগেন।

উঠে আসার আগে অতসী সবিনয়ে বলল, আমাকে যদি আপনি একটু মনে রাখেন…

জবাবে জাঁদরেল মহিলার দুচোখ ওর মুখের ওপরে উঠে এলো।–ডোন্ট ওয়ারি, আই উইল গেট রিপোর্টস ফ্রম মাই কাউন্টার-পার্ট দেয়ার।

সাদা কথায় তার ছাত্রী পড়ানোর কেরামতির খবর এখানে বসেই তিনি পাবেন, মনে রাখা না রাখা এর ওপর নির্ভর করবে। অতসী আর কথা বাড়ানো নিরাপদ বোধ করল না।

.

যে সহজ এবং সরল ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ প্রায় সম-বয়সী একটি ছেলে আর একটি মেয়েকে এত কাছাকাছি টেনে এনেছিল, সেই ব্যক্তিত্বের সংঘাতেই দুজনের দুদিকে ছিটকে যেতে দুবছরও সময় লাগল না। অবশ্য এই ব্যক্তিত্ব তখন আর পরস্পরের কারো কাছেই সহজ বা সরল মনে হয়নি। ভুল দুজনেরই। স্বভাব বা ব্যক্তিত্ব কারোই বদলায়নি, কিন্তু গোড়ায় সেটা বুঝতে ভুল হয়েছে। প্রাথমিক মোহ কেটে যেতে এই ভুল দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

অতসীর ভুল, বিদ্যায় বুদ্ধিতে চাল-চলন আচার-আচরণে পাঁচজনের চোখে পড়ার মতো একজন জোরালো পুরুষকে জীবনের দোসর হিসেবে পেতে চেয়েছিল। সমর ঘোষালের মধ্যে এই গুণগুলোই সে পুরোমাত্রায় দেখেছিল। নিজের ওপর এমনি প্রবল আস্থা যে, বিয়ের পর ধরেই নিয়েছিল এই জোরালো পুরুষটি এর পর ষোল আনা তার। ধরে না নেওয়ার কারণও নেই, একে একে তার সমস্ত ইচ্ছে মেনে নেবার পরেই এই বিয়ে। এর পরেও এই জোরালো পুরুষের সত্তসুষ্ঠু নিজের দখলে টেনে আনতে পারবে তাই বা ভাবতে যাবে কেন? এটুকু পারার মধ্যেই আনন্দ, পরিতৃপ্তি। নিজের জগতে বরাবরই সে একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী। সম্রাজ্ঞীর জগতে গুণধর শক্তিধর পাত্রমিত্র থাকবে বই কি। কিন্তু তার ইচ্ছের বোল আনা অধীনে থাকবে। সম্রাজ্ঞীর জগতের সে সম্রাট হলেও একই কথা। তারও ইচ্ছের অধীনে না থাকাটা বিদ্রোহের সামিল।

এখানেই ভুল অতসীর। তার ঘরের পুরুষের প্রবলতর সত্তার হদিশ সে পায়নি।

সমর ঘোষালের ভুল, অতসীর সব-কিছুর মধ্যে সে অনাড়ম্বর চরিত্রগত দৃঢ়তা। দেখত, সহজ ব্যক্তিত্বের মহিমা আবিষ্কার করত। মোহগ্রস্ত না হলে তার মতো মানুষের অনাপোস প্রবল ইচ্ছা আর ব্যক্তিত্বের মধ্যে তফাৎটা চোখে পড়ার কথা। চোখে পড়ার মতো অনেক নজিরই তো তার সামনে ছিল, যা তখন পড়েনি। আর তার ফলে। সমর ঘোষাল নিজেও মোহগ্রস্ত হয়ে ছিল না তো কি?

খিটির মিটির বাধতে লাগল অতি তুচ্ছ সব ব্যাপার নিয়ে। দোষের মধ্যে সমর ঘোষালের সবেতে উৎসাহ, সবেতে আগ্রহ। বাড়িতে লোক-জন আসা শুরু হয়েছে, ঘরে ভালো এক প্রস্থ টি-সেট ডিনার সেট এনে রাখা দরকার। শুনেছে ফ্যান্সি মারকেটে এ-সব খুব ভালো পাওয়া যায়। কিন্তু সবকিছু সেখানে সাদা পথে আসে না বলে পুলিশের হানাদারিও হয় শুনেছে। ছোট বড় হাঙ্গামাও বাধে। তাই অতসীকেও সঙ্গে নিতে ভয়। কিন্তু একলা গেলে সমর ঘোষালের আর ভয়ের কি আছে, চোরাই মাল। তো আর কিছু কিনতে যাচ্ছে না। স্কুল করে ট্রেনে ফিরে বাড়ি পৌঁছুতে অতসীর প্রায় রাতই হয়ে যায়। এই ফাঁকে তাকে খুশি এবং অবাক করে দেওয়ার জন্য সমর ঘোষাল একাই ফ্যান্সি মার্কেটে চলে গেছে। তার বিশ্বাস অনেক দেখে আর যাচাই বাছাই করে চোখ-জুড়ানো জিনিসই এনেছে। কিন্তু দেখে শুনে অতসীর ঠাণ্ডা মুখে চাপা বিরক্তি, তোমাকে এমন সর্দারি করতে কে বলেছিল, আর দুটো চারটে দিন। সবুর সইলো না?

সমর ঘোষালের ভেবা-চ্যাকা খাওয়া মুখ।-কেন, তোমার পছন্দ হল না?

-না হলে কি করব, টি সেটের এত হালকা রং কদিন চকচকে থাকবে? ডিনার সেটের ডিজাইন আবার তেমনি জবরজং-এ বাপু চলবে না, বদলে নিয়ে এসো।

তিন বার করে ছোটাছুটি করে সমর ঘোষালের হাঁপ ধরার দাখিল, আর দোকানদারও বিরক্ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অতসীর ষোল আনা পছন্দের জিনিস আনাই গেল না।

অতসীর সময় কম, এটা ওটা আনার হুকুম হয়ই। নতুন আর এক সেট জানলা দরজার পর্দার কাপড় আনতে বলে গেছে। একটু বেশি দাম দিয়ে যতটা সম্ভব পছন্দের জিনিসই আনতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু দেখামাত্র মুখ গম্ভীর এবং বিরূপ মন্তব্য। তোমাকে আনতে বলাই আমার ভুল হয়েছে, কি যে টেস্ট না তোমার–এত দাম। দিয়ে এই জিনিস নিয়ে এলে! থান থেকে কেটে এনেছ আর তো বদলানোও যাবে না—

টেস্ট-এর কথা শুনেই সমর ঘোষাল খাপ্পা।–এগুলো তাহলে রাস্তায় ফেলে দাও, টাকা দিচ্ছি নিজের পছন্দের জিনিস নিয়ে এসো, আর কোনদিন আমাকে কিছু আনতেও বোলো না।

অতসীর কানের দিকটা লাল হয়ে উঠছে।–তোমার পছন্দের সঙ্গে আমার পছন্দ যদি না মেলে তাতে রাগের কি ভুল?

সঙ্গে সঙ্গে তির্যক জাব, আমার পছন্দের সঙ্গে তোমার পছন্দ মেলে বলেই তুমি আমার কাছে এসেছ।

-তার মানে? তুমি দয়া করে আমাকে এনেছ?

–না, তুমি দয়া করে এসেছ।

চায়ের টেবিলে এমনি তুফান লেগেই আছে।

অতসীর নিজের পছন্দের কিছু কিনতে হলেও চলনদার হিসেবে সমর ঘোষালকে সঙ্গে থাকতেই হয়। দুটো বেড-শিট আর পছন্দসই একটা বেড-কভার কেনা হবে। প্রথমটা নিয়ে যাচাই বাছাইয়ের প্রশ্ন নেই। অনেক দেখে যে দুটো বেড-কভার নিয়ে বিবেচনা, সমর ঘোষালের চোখে তার একটা তো ভারী সুন্দর লাগল। কিন্তু মতামত জিগেস না করা পর্যন্ত সে চুপ।

-বলো, এ দুটোর কোনটা নেব?

সমর ঘোষাল সঙ্গে সঙ্গে, আঙুল তুলে দেখালো, ওইটা অনেক বেশি সুন্দর।

ধারণা, অতসীরও ওটাই বেশি পছন্দ। কিন্তু বলার সঙ্গে সঙ্গে তার খুঁতখুঁতুনি বাড়তে থাকল। দুটোই আবার পাশাপাশি খুলে দেখা হল। তারপর মন্তব্য, ভালো তো…কিন্তু একটু বেশি গরজাস। আরো একটু বিবেচনার পর অন্যটাই দোকানদারের দিকে এগিয়ে দিল, নাঃ, এটাই দিন।

সমর ঘোষাল নিঃসংশয়, সে কিছু না বললে আগের পছন্দের জিনিসটাই ঘরে আসত।

কাউকে চায়ে বা ডিনারে ডাকলেও এমনি তুচ্ছ কারণে মতবিরোধ। ঘরে কেবল চা-কফি ভিন্ন আর কিছু হয় না। সবই, সবই কোনো ভালো রেস্তোরাঁ থেকে আসে। সমর ঘোষাল যদি বলে, কাজু খাস্তা কচুরি চিকেন-কাটলেট আর ভালো কিছু সন্দেশ আনাও তো অতসী ভুরু কুঁচকেই প্রথমে সব বাতিল বুঝিয়ে দেবে, তারপর বলবে, কাজুর যা দাম তার বদলে চিপস করলেই হয়। আজকাল ওসব কচুরি মিষ্টি-টিষ্টি অচল। তার থেকে চীজ পকোড়া ফিশ-ফিংগার চিকেন প্যাটিস আর মিষ্টির বদলে পেস্ট্রি অনেক ভদ্রস্থ হবে। ডিনারে একজন যদি বলে বিরিয়ানি ফিশফ্রাই কোর্মা চাটনি। মিষ্টি হোক, অন্যজন অবধারিত বলবে, অত তেল মশলার হেভি মেনুর দরকার কি, তার থেকে ফ্রায়েড রাইস ফ্রায়েড প্রন চিলি-চিকেন আইসক্রিম হলে খারাপ হবে কিছু?

ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে এসে ঘরে ফিরে অতসী কিছুটা ক্লান্ত থাকে ঠিকই। মুখ হাতে জল দিয়ে বেশ খানিকক্ষণ শুয়ে থাকে। কিন্তু সে-সময় সমর ঘোষালের কাছে। যুনিভার্সিটির কেউ এলে আর গৃহিণীর খোঁজ করলে তাকে ডাকতেই হয়। অতসীর ফর্সা মুখ থমথমে হয়ে ওঠে। গলা দিয়ে চাপা ঝঝ বেরিয়ে আসেই।–তোমার কি দয়ামায়া বলে কিছু নেই? আমি কি তোমার শো-কেসের পুতুল, যে আসবে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে দেখাতে হবে!

বাইরের লোক চলে যেতে তার পরেও তপতপে মুখ দেখে সমর ঘোষালও রেগে গিয়ে একদিন কেবল বলেছিল, কে তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়ে ওই চাকরি করতে বলেছিল, ছেড়ে দিয়ে দেখো না আমি চালাতে পারি কি না?

সঙ্গে সঙ্গে অগ্ন্যুৎপাত।–কি বললে? আর আমি যদি বলি তোমার চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেখো। আমি চালাতে পারি কিনা–ছাড়বে? তোমার চাকরিটা চাকরি আর আমারটা নয়?

কিন্তু সমর ঘোষাল রিসার্চের কাজে আর পড়াশুনায় মন ঢেলে দিতে, দেখা গেল অতসী সব দিন আর অত ক্লান্ত থাকে না।

খানিক বাদে শয্যা ছেড়ে উঠে আসে, কাছাকাছির মধ্যে ঘুর ঘুর করে, এটা ওটা টুকটাক পরামর্শের দরকার হয়, কিছু কেনার কথা মনে পড়ে, নয়তো কারো বাড়িতে বা কোথাও যেতে ইচ্ছে করে।

সমর ঘোষাল বিরক্ত হয়, আমাকে রিসার্চের কাজটা ভালোভাবে করতে দেবে না কি?

খুব গায়ে মাখে না, ঠোঁটে হাসির আভাস দেখা দেয়। সেদিন বলল, ডক্টরেট হয়ে তোমার বিদ্যেবুদ্ধি আর এমন কি বাড়বে?

–বিদ্যেবুদ্ধি একটুও বাড়বে না, সামনে এগোবার রাস্তাটা পরিষ্কার হবে।

–সেটা কত এগোবার রাস্তা-রিডার প্রোফেসার ভাইস চ্যান্সেলার পর্যন্ত? কথার সুরে শ্লেষ, তখন তোমার স্কুল মাস্টার বউ মনে ধরবে তো?

সমর ঘোষালের আগে যা মনে হয়নি এখন তা হয়।

…সে এম. এ তে ফার্স্ট ক্লাস না পাওয়ার দরুন এই একজনেরই কোনো আক্ষেপ দেখেনি, প্রস্তুতি সত্ত্বেও তার আই এ এস পরীক্ষা দেওয়া বন্ধ করেছে, আর আজও তার নাগালের বাইরে যোগ্যতা আর প্রতিপত্তি অর্জন করুক এটা চায় না।

গত দেড় বছরের মধ্যে সমর ঘোষাল বার তিনেক কলকাতায় গেছে। অতসী দুটো ভেকেশনে সঙ্গে এসেছে, কর্তব্যের দায়ে দুতিন দিনের বেশি শাশুড়ীর কাছে থাকেনি, বাপের বাড়িতে থেকেছে। সমর ঘোষালের কাছে এ-ও কম দৃষ্টিকটু ঠেকেনি, কারণ বয়স্কা বিধবা মা তাদের অপেক্ষায় দিন গোনে, বউকে বুকে আগলে রাখতে চায়। কিন্তু এ নিয়ে কিছু বললে অতসী তেতে ওঠে। বলে, এখানে এসে তো বেশির ভাগ সময় তুমি তোমার রিসার্চের প্রোফেসার আর বই-পত্র নিয়ে কাটাও, আমার কাহাতক ভালো লাগে–নিজের মা-বাবা ভাই বোনের কাছে কটা দিন থাকবো। তা-ও দোষের?

সমর ঘোষাল খুব ভালো করেই জানে ভদের অনটনের সংসারে অতসীর বন্ধনের। শিকড়টা কোনদিনই খুব গভীরে পৌঁছয়নি। এখনো মাঝে মাঝে মা-কে টাকা পাঠাতে হয় বলে তার বিরক্তি লক্ষ্য করেছে। পরের বোন দুটো অকর্মা বলে রাগ করে।

তৃতীয় বারে অতসী সঙ্গে আসেইনি। তার সাফ কথা, তোমার তো এখন ডক্টরেট হওয়ার স্বপ্ন, আর আমার লিভ ভেকেন্সির চাকরি কবে আছে কবে নেই ঠিক নেই, আমার তো চেষ্টা কিছু করতে হবে না এভাবেই চলবে?

–ছুটির মধ্যে কোথায় কি চেষ্টা করবে?

–আমার যেটুকু চেষ্টা ছুটির মধ্যেই করতে হবে, স্কুল কামাই করে চেষ্টা করতে গেলে যা আছে তা-ও যাবে–তাছাড়া এই ডেলি প্যাসেঞ্জারির চাকরি আর কতকাল। করব?

তর্ক না বাড়িয়ে সমর ঘোষাল তাকে রেখে একলাই চলে গেছে। আর অতসী দুর্জয় রাগে ফুঁসেছে।…ডেলি প্যাসেঞ্জারের চাকরি আর ভালো লাগে না এটা ঠিক, তা বলে চাকরি যাবার ভয় আর তেমন নেই বললেই চলে। যার জায়গায় আছে সেই মহিলা বিনে মাইনেয় আরো এক বছরের ছুটিতে। এলেও এই দেড় বছরে পড়ানোয় তার যা সুখ্যাতি হয়েছে, আর মেয়েদের কাছে সে এত পপুলার এখন। যে হেডমিসট্রেস তাকে এক-রকম আশ্বাসই দিয়ে রেখেছেন ওখানে থেকে গেলে ভবিষ্যতের ব্যবস্থা তিনিই করতে পারবেন। এদিকে এখানকার বড় স্কুলে চাকরির আশার দিনও এগিয়ে আসছে। এই দেড় বছরের মধ্যে অতসীর প্রিন্সিপাল মিসেস খাসনবিশের সঙ্গে দুবার দেখা হয়েছে। দুবারই পুজোর পর গিয়ে দেখা করাটা শ্রদ্ধানিবেদনের সাক্ষাৎকারই বলা চলে। মিসেস খাসনবিশ অখুশি হননি। বলেছেন, ইওর হেডমিস্ট্রেস স্পিক্স হাইলি অফ ইউ, রোসো আরো কিছু দিন দেখি কি করতে পারি।

একটা তুচ্ছ উপলক্ষ্য ধরেই অতসী ঠাণ্ডা মাথায় শেষ ফয়সালা করে ফেলল। এই লোকের কাছে তার সম্রাজ্ঞীর আসন টলে গেছে, এটা স্পষ্টই বুঝেছে। কিন্তু সম্রাজ্ঞী নিজে এ আসনচ্যুত হতে রাজি নয়, এই এক ব্যাপারে তার কোনো আপোস নেই। অতএব শেষ ফয়সালার কিছু একটা উপলক্ষ্য কেবল দরকার ছিল।

ইদানীং সমর ঘোষালের কাছে তিনটি মেয়ে পড়তে আসছিল। ছুটির দিনে সকালে বা সন্ধ্যায়। অতসী তাদের ধারে কাছে যেত না, ফরমাশ মতো শেরিং চা দিয়ে যেত। মেয়েরা মাস্টারমশায়ের স্ত্রীকে দেখার জন্য বা একটু আলাপ করার জন্য উৎসুক বুঝেও সমর ঘোষাল এটা-ওটা বলে কাটিয়ে দিয়ে গম্ভীর মুখে কাজ সারার জন্য ব্যস্ত হয়।

দিন কয়েক এটা দেখে অতসী সোজাসুজি জিগেস করেছে, এরা টাকা দিয়ে বাড়তি বিদ্যার্জন করতে আসে না এমনি?

-এমনি।

–ছেলেরা বুঝি আজকাল আর পড়াশুনা নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না, যত চাড় মেয়েগুলোরই?

বক্রোক্তির জবাবে ভ্রূকুটি।

–ছুটি-টুটির দিনে এ-রকমই তাহলে চলবে এখন?

–কেন, তোমার অসুবিধে হচ্ছে?

-খুব বেশি রকম অসুবিধে হচ্ছে! দুখানা মাত্র ঘর, উঠতে বসতে চলতে ফিরতে অসুবিধে হয় কিনা তুমি বোঝো না?

সমর ঘোষালের উষ্ণ জবাব, এরা খেলা করতে আসে না, দুখানা ছেড়ে দশখানা ঘর হলেও তোমার অসুবিধেই হত…মনটাকে আর একটু উঁচুতে তুলতে চেষ্টা করো অতসী।

-কি? কি বললে তুমি? তোমার নিজের মন এত উঁচুতে এখন যে ওই মেয়েগুলোকে আমি হিংসে করি এ-ও ভাবতে পারলে তুমি? ওরা আমার ঈর্ষার পাত্রী?

অতসীর গলা খুব চড়ছে না কিন্তু দুচোখ দিয়ে গলগল করে বিদ্বেষ ঠিকরোচ্ছে।–চুপ করে না থেকে জবাব দাও!

-আমি কিছুই ভাবি না, ভাবতে চাই না–তুমিই ভাবিয়ে ছাড়ছ।

দেহের রক্ত-কণা মুখে আগেই জমছিল। মুখ থেকে চোখের দিকে ছুটেছে।

অন্য ঘরে চলে গেল। রাতে দুজনে মুখোমুখি বসে খাওয়া সারল, কেউ একটি কথাও বলল না। রাতে সমর ঘোষালের ঘুম আসতে দেরি হল। অতসী তখনো শয্যায় আসেনি। সকালে ঘুম ভাঙতে শয্যার দিকে তাকিয়েই বুঝল রাতে সে এ-ঘরে আসেনি।

সকালের প্রক্ষালন সেরে টেবিলে এসে বসল। মুখোমুখি চেয়ারে অতসীও। শেরিং পেয়ালা চায়ের পট টোস্ট-এর ট্রে টেবিলে রাখতে অতসী দুজনের পেয়ালাতেই চা ঢালতে ঢালতে শেরিংকে বলল, ঠিক হ্যায়

শেরিং টেবিল ছেড়ে সরে গেল। দুজনে দু-জনের পেয়ালা শুধু তুলে নিল, টোস্ট পড়ে থাকল। নিঃশব্দে দুটো চুমুক দেবার পর খুব ঠাণ্ডা গলায় অতসী বলল, শোনো, আমি ভেবে দেখলাম এ-ভাবে আর বাইরের ঠাট বজায় রেখে চলতে চেষ্টা না করাই ভালো, তাতে দিনে দিনে অশান্তি আরো বাড়বে।

পেয়ালা মুখের কাছেই ধরা, সমর ঘোষালেরও ঠাণ্ডা প্রশ্ন, কি করতে চাও?

–করার একটাই আছে, আমার মনে হয় যত ঠাণ্ডা আর শোভনভাবে সেটা করা যায় দুজনের পক্ষেই ততো ভালো।

–ডিভোর্স…?

অতসীর ভুরুর মাঝে ভাজ পড়ল একটু। এইটুকুই জবাব। চায়ের পেয়ালা খালি করে সামনে রাখল।

পেয়ালায় বার দুই চুমুক দিয়ে সমর ঘোষাল জিগ্যেস করল, তোমার এ ডিসিশন ফাইনাল তাহলে?

–হ্যাঁ, ভাঙা পেয়ালা জুড়তে চেষ্টা না করাই ভালো…আমার যতদূর ধারণা, বনিবনা হল না আর চিন্তাধারায় খাপ খেল না বলে মিউঁচুয়াল কনসেন্টে ডিভোর্স চাইলে ব্যাপারটা সহজেই ফয়সালা হয়ে যায়…যায় না?

-তা যায়।

-তাহলে তাই করো, সামনের বড় দিনের ছুটিতে আমরা কলকাতা চলে যাই…কিন্তু আমার দিকের কোনো উকিল জানাশোনা নেই…তোমার আছে?

সমর ঘোষাল সন্তর্পণে এক বড় নিঃশ্বাস তল করে নিল।–বাবার এক বিশেষ বন্ধুই এ সবের বড় উকিল, তোমার ব্যবস্থাও তিনি করে দিতে পারবেন। ব্যাপারটা তাতে সহজ হবে।

-খুব ভালো।…তাহলে এই কথাই রইলো, এই বড় দিনের ছুটিতেই আমরা কলকাতা যাচ্ছি, আমি আজ থেকেই আর ফিরছি না, সেখানে মেয়েদের হস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে নেব, স্কুলের টেলিফোন নাম্বার রেখে যাব, তেমন দরকার হলে ইউনিভার্সিটি থেকে তুমি ফোন করতে পারো।

-হ্যাঁ, এতবড় ব্যাপারেও অতসী ধীর স্থির সম্রাজ্ঞীর ভূমিকা নিতে পেরেছে। সমর ঘোষাল সে তুলনায় কেবল স্তব্ধ, এবং তাজ্জব।

অতসীর এটুকুই সান্ত্বনা।

.

ঘোষাল নয়, অতসী গাঙ্গুলী স্কুলে বসে সমর ঘোষালের ফোন পেয়েছে সাড়ে তিন মাস বাদে। ও-দিকের গলার স্বর ঠাণ্ডা–তোমার একটা চিঠি এসেছে, মনে হয়। দরকারি…।

-কোত্থেকে?

–খামে এখানকার মেয়ে স্কুলের ছাপ দেখলাম।

-ও…! অতসীর গলায় আগ্রহ স্পষ্ট।-কি করা যায় বলো তো, রিডাইরেক্ট করলে তো আবার পেতে দেরি হয়ে যেতে পারে।

সমর ঘোষালের গলায় গম্ভীর শ্লেষ, আমাকে হাতে হাতে পৌঁছে দিতে বলছ?

ভিতরে যতই জ্বলুক, অতসীর গলায় সম্রাজ্ঞীর হাসি।খুব ইচ্ছে করলে নিয়ে : আসতে পারো…কেন, তোমার সেই ছাত্রীরা বাড়িতে পড়তে আসা বন্ধ করে দিয়েছে?

রাগে থমথমে গলা সমর ঘোষালের। ফোন ছেড়ে দেব?

-না, চিঠি এই রাতটা তোমার কাছেই থাক, আমি কাল ভোরের ট্রেনে গিয়ে নিয়ে নেব, মনে হয় ওখানকার স্কুলের চাকরিটা হল।…থ্যাংক ইউ।– ইচ্ছে করেই সমর ঘোষাল সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। অতসী আসতে শেরিং তার হাতে চিঠি তুলে দিয়েছে। অতসীর ফর্সা মুখ লাল। সম্রাজ্ঞীর ভূমিকায় দাঁড়িয়েই সে এখানে এসেছিল।

প্রিন্সিপাল মিসেস খাসনবিশের টাইপ করা দুলাইনের চিঠি। যত শীগগির সম্ভব দেখা করার নির্দেশ।

.

সীট ডাউন প্লীজ! লোমশ হাত দুটো টেবিলে রেখে মিসেস খাসনবিশ সামনে ঝুঁকলেন, এনিথিং সীরিয়াসলি রং উইথ ইউ?

অতসী হঠাৎ ভেবাচ্যাকাই খেয়ে গেল। মনে মনে এই স্কুলে চাকরিতে জয়েন। করার নিশ্চিত আশা নিয়েই এসেছে। শুকনো গলায় বলল, বেগ ইওর পারডন। ম্যাডাম?

মিসেস খাসনবিশ এটুকুতেই অসহিষ্ণু।তোমার জলপাইগুড়ির হেড-মিসট্রেস জানালেন, হাসব্যান্ডের সঙ্গে তোমার ডিভোর্স হয়ে গেছে, তবু আমি তোমার দরখাস্ত থেকে এখানকার ঠিকানা বার করেই চিঠি দিলাম, জাস্ট টু অ্যাভয়েড সাসপিশন অফ মাই কাউন্টার পার্ট দেয়ার, সি লাইকস ইউ ভেরি মাচ, এই স্কুলের খাম দেখলে তার প্রথমেই সন্দেহ হত, আমি তোমাকে ভাঙিয়ে নেবার মতলবে খাম দেখলে তার প্রথমেই সন্দেহ হত, আমি তোমাকে ভাঙিয়ে নেবার মতলবে আছি, অ্যান্ড থট এ য়ুনিভার্সিটি প্রোফেসার শুড আফটার অল বি এ জেন্টলম্যান। –দ্য লেটার শুড রিচ ইউ! নাও টেল মি হোয়াটস দি ম্যাটার-হোয়াট আই হার্ড…এ ফ্যাক্ট?

নানান অসুবিধে এড়ানোর জন্য জলপাইগুড়ির হেডমিসট্রেসকে বলতে হয়েছিল, চাকরি হলে এখানেও গোপন করা যাবে না। অতসীর মনে ভয়ই ধরে গেল, এর জন্যে মিসেস খাসনবিশ কি তাকে বাতিল করে দেবেন?

জবাব দিল, ঠিকই শুনেছেন…।

–বাট হোয়াই…মে আই নো?

–বনিবনা হচ্ছিল না…ঠিক অ্যাডজাস্ট করা যাচ্ছিল না।

–দ্যাট সিম্পল? সেটলড ইট মিউঁচুয়ালি?

অতসী মাথা নেড়ে সায় দিল। মহিলার দিকে চেয়ে কেন যেন একটুও ক্ষুব্ধ। মনে হল না তাঁকে। প্রশ্ন শুনে আরও আশান্বিত।আর ইউ হ্যাপি ইন জলপাইগুড়ি অর স্টিল ওয়ান্ট টু কাম হিয়ার?

–আজ বললে আজই জয়েন করতে পারি।

থলথলে মুখখানা হাসি হাসি।–ইউ হ্যাভ সাম লাক অ্যাট লিস্ট, যাঁর জায়গায়। তোমাকে নেবার কথা বলেছিলাম প্রিপারেটরি টু রিটায়ারমেন্ট লিভ-এ যাচ্ছেন, ইউ মে জয়েন নেক্সট মানডে-ইউ আর অতসী হোয়াট নাও?

গাঙ্গুলি…।

–ওকে–কাম্ উইথ এ ফ্রেশ অ্যাপলিকেশন।

এই শিলিগুড়িতেই আবার জীবন শুরু অতসীর। অতসী গাঙ্গুলির। মনে হয়েছে, এই ডিভোর্সের ফলেই প্রিন্সিপাল মিসেস খাসনবিশের তাকে নিয়ে নেবার আগ্রহ আরো বেড়েছে। কিছু দিন যেতে ধারণাটা আরো মনে বসে গেছে।…মহিলা তার কোয়াটারস এ একা থাকেন, স্কুলেরই দুটো ক্লাস ফোর কর্মচারী তাঁর বাবুর্চি এবং পরিচারক। টিচাররা সকলেই জানে তার স্বামী বর্তমান, কিন্তু চর্মচক্ষে কেউ সে ভদ্রলোককে কখনো দেখেনি। ভদ্রমহিলার যেমন মেজাজ তেমনি যাকে বলে হুইমজিকাল। আর খেতেও খুব ভালবাসেন। দুতিন জন পেয়ারের টিচারকে মাঝে মাঝে বাড়িতে ডেকে এনে খাওয়ান। স্কুল কম্পাউন্ডের মধ্যেই মেয়েদের বোর্ডিং, আলাদা আলাদা ঘর নিয়ে। একপাশে জনাকয়েক টিচারও থাকে। অতসীরও এখানেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আধ বয়সী বোর্ডার টিচার তিনজনেই অবিবাহিত এবং অনেকটা নিঃসঙ্গ বলেই প্রিন্সিপালের স্নেহের পাত্রী হয়তো, কেবল তাদেরই নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো হয়। বরাত জোরে অতসীও এদের সঙ্গে যুক্ত এখন। স্বচক্ষে মিসেস খাসনবিশের খাওয়ার বহর দেখে মনে হয়েছে, গতরখানা এমন হবে সে আর দোষের কি। মহিলার নতুন বয়সের চেহারাখানা কল্পনা করতে চেষ্টা করেছে।…পুরুষ অতসীর দুচোখের বিষ এখন, তবু কারো সঙ্গে এই মহিলার সুখের সংসার-জীবন ভাবতে গিয়ে হাসিই পেয়েছে।

জলপাইগুড়ি ছেড়ে এখানে আসতে পেরে অতসী ভেবেছিল তার অতীত নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না, সকলে তাকে কেবল অতসী গাঙ্গুলী বলেই জানবে।…কিন্তু এসব ব্যাপার বোধহয় গোপন থাকেই না। টিচাররা তো জেনেইছে, মেয়েদেরও জানতে। খুব সময় লাগেনি। হতে পারে এদের কারো-কারো সঙ্গে যুনিভার্সিটির কারো ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। হতে পারে ওই জাঁদরেল প্রিন্সিপালই পেয়ারের তিন বোর্ডার শিক্ষয়িত্রীকে বলে দিয়েছেন। না, মুখে তাকে কোনো টিচার এ নিয়ে একটি কথাও বলেনি। কিন্তু তাকে নিয়ে কথা আর কানাকানি যে হয় এটা খুব ভালোই বুঝতে পারে।…ঘুরিয়ে। ফিরিয়ে সে সম্বন্ধে কিছু আভাস দেবার লৌকও একজন এই কটা মাসের মধ্যে জুটেছে। স্কুলে মোট পাঁচজন পুরুষ টিচার আছে। তিনজনই সায়েন্স গ্রুপের, একজন জিওগ্রাফি টিচার, আর একজন অপেক্ষাকৃত কম বয়সের আর্ট বা ড্রইং টিচার অমরেশ ঘোষ। বোর্ডার টিচারদের মুখে অতসী জেনেছে স্কুল কমিটির একটি বিশিষ্ট মুরুব্বির জোরে বছর তিনেক আগে অমরেশ ঘোষের এখানে চাকরি হয়েছে। বছর পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ হবে বয়েস। অবিবাহিত।

অতসীর এখন সাতাশ চলছে, সতের বছর বয়েস থেকে পুরুষের চোখের স্তুতি দেখে অভ্যস্ত, চিনে অভ্যস্ত। অতসী হলপ করে বলতে পারে সে এই স্কুলে আসার পনেরো দিনের মধ্যে ওই ভদ্রলোক তার প্রেমে পড়ে গেছে। আর মাস তিনেকের মধ্যে তো আপনারজনের মতো আচরণ তার। এখন স্কুলেই দুচারটে কথাবার্তা বলার ফাঁক খোঁজে। মাঝে-সাজে অতসী বিকেলের দিকে একটু হাঁটতে বা বেড়াতে বেরোয়। কিছুটা নিরিবিলিতে বেড়ানোর একটাই জায়গা। মহানন্দার দিকে গেলে তার সঙ্গে দেখা আর কথা হবেই। না গেলে অনুযোগ, যে একঘেয়ে জীবন আমাদের, হাঁটা চলার অভ্যাসটুকু ছাড়বেন না, শরীর মন দুই-ই ভালো থাকে, কিন্তু আপনি একদিন আসেন তো পাঁচ দিন আসেন না।

অতসী হাসে, যতটুকু সম্ভব সদ্ভাব রেখেই চলে। তাকে নিয়ে টিচারস রুমে আলোচনা হয় বলে ভদ্রলোক বিরক্তি প্রকাশ করে এবং বেশির ভাগ কি নিয়ে আলোচনা হয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তা-ও প্রকাশ করে দেয়।

অস্বস্তি গিয়ে অতসীর বরং সুবিধেই হয়েছে। বাইরে বোঝা যায় না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে বেপরোয়া হয়ে উঠতে পেরেছে। এর ওপর বোর্ডার টিচার তিনজনের মুখে প্রিন্সিপাল তার পড়ানোর প্রশংসা শুনে আর স্বচক্ষে ছাত্রীদের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ মেলামেশার ফল দেখে আরো প্রসন্ন। ওই তিন টিচারের একজনকে বলেছিল, দ্য গার্ল হ্যাঁজ আ চার্মিং পারসোনালিটি অফ হার ওউন-ভেরি ডিফারেন্ট ফ্রম আদার।

এরপর আর পরোয়া কাকে করে?

.

একে একে চার বছরে চার-চারটে ব্যাচ অতসী গাঙ্গুলির হাত দিয়ে হায়ার সেকেণ্ডারি পাশ করে বেরিয়ে গেল। প্রত্যেক ব্যাচের থেকে প্রত্যেক ব্যাচের ওপর অতসী গাঙ্গুলির হিসেবী আধিপত্য বিস্তার বেড়েই চলেছে। ব্যাচ বলতে সকলে নয়, অতসীর নিজস্ব বাছাই ব্যাচ, অন্য টিচারদের বিবেচনায় ওই দেমাকী টিচারের বিদ্রোহী ব্যাচ। তাদের চাপা আক্রোশ অতসী গাঙ্গুলি মেয়েগুলোর মগজ ধোলাই করে ছেড়ে দিচ্ছে। যে মেয়েরা মুখের দিকে চেয়ে কথা বলত না, তার সেই বাছাই মেয়েগুলো দেখতে দেখতে সেয়ানা হয়ে উঠছে, হেসে-হেসে তর্ক করে ভেবা-চ্যাকা খাওয়ার মতো মুখ করে প্রশ্ন করে, বুদ্ধিমতীর মতো তির্যক মন্তব্য করে, টিকা-টিপ্পনী কাটে।

যেমন, সোস্যাল সায়েন্সের বয়স্ক টিচার কি আলোচনা প্রসঙ্গে একজনের স্মরণীয় উক্তি কোট করেছিলেন, ম্যারেজ ইজ এ গ্রেট ইনস্টিটিউশন–অতসী গাঙ্গুলির এক সুশ্রী পেয়ারের ছাত্রীর আলতো মন্তব্য, মে বি, বাট হু ওয়ান্টস টু লিভ ইন অ্যান ইনস্টিটিউশান?

…ইংরেজি টেক্সটের এক গল্পে বর-কনের বিয়ের বর্ণনা ছিল। দেখতে সুশ্রী একটি ভালো ছাত্রীর হঠাৎ প্রশ্ন, বিয়ের সময় কনের ধপধপে সাদা পোশাক কেন?

শিক্ষয়িত্রীর সাদাসিধে জবাব, সাদাটা শান্তি আর আনন্দের প্রতীক, মেয়েদের সেটা সব থেকে আনন্দের দিন।

তক্ষুণি প্রশ্ন, বরের গায়ে তাহলে কালো পোশাক কেন, তার কি তাহলে সেটা সব থেকে অশান্তি আর নিরানন্দের দিন?

নিজের বিয়ে-ভাঙা কপাল নিয়ে ওই রূপসী টিচার মেয়েগুলোর মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে না তো কি? কিছু বলারও উপায় নেই, খামখেয়ালি প্রিন্সিপালের দিনে-দিনে চোখের মণিটি হয়ে বসছে। খুশি হয়ে তার উঁচু ক্লাসের ইংরেজিরও অর্ধেক দিন এই একজনকেই পাঠিয়ে দিয়ে নিজে বসে বসে লজেন্স চকোলেট খায়। আবার অবাকও হয়, অতসী গাঙ্গুলির বাছাই মেয়েগুলোর একটারও যদি পরীক্ষার ফল খারাপ হত, ইকনমিক্স-এ তো সক্কলের ভালো নম্বর। অবাক কেবল ড্রইং মাস্টার অমরেশ ঘোষ হয় না, বলে আপনার হাতে পড়ে মেয়েগুলো সব সোনার টুকরো হয়ে উঠছে সেটা যদি এঁরা দেখতেন, কেবল হিংসের কথা–

অতসী গাঙ্গুলির ঠোঁটের ফাঁকে একটু মজা-ছোঁয়া হাসি লেগেই থাকে। প্রশ্রয়ের সুরে জিজ্ঞেস করে, কেন, কি বলেন…?

ও-টুকুতেই উৎসাহে টুপটুপু ভদ্রলোক, আর বলেন কেন, ভালো কারো সহ্য হয়, আপনি নাকি নিজেকে এডুকেশন ফ্যাক্টরি ভাবেন একটা, সিলেবাস বা নিয়ম টিয়মের ধার ধারেন না, কেবল পড়ানোর চমক দেখান, মেয়েগুলোকে আস্কারা দিয়ে আদরে বাদর করে তুলছেন।

এই চার বছরে ভদ্রলোকের দুর্বলতা মেয়েরাও টের পেয়ে গেছে, বিশেষ করে অতসী গাঙ্গুলির বাছাই ব্যাচের মেয়েরা। নিজেদের মধ্যে তারা হাসাহাসি কানাকানি করে, বলে, কেন বামন কি চাঁদের দিকে হাত বাড়ায় না–নইলে কথাটা এলো। কোত্থেকে?

…অতসী গাঙ্গুলির আত্মবিশ্বাস ওই কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়োর মতো ঊর্ধ্বমুখী এখন। কাঁচা তাজা একটি মেয়েকে তার হাতে ছেড়ে দাও, তার দখলে থাকতে দাও, দেখবে বরাবরকার মতো সে তার হয়ে গেল। অতসী গাঙ্গুলি কল্পনায় তাই দেখছে, তাই বিশ্বাস করছে, অদূর ভবিষ্যতে তারা তার প্রতিশোধের এক-একখানা হাতিয়ার হয়ে উঠছে। আপন-আপন জগতে তারাও এক-একটি সম্রাজ্ঞী হয়ে উঠছে। কেবল যে মেয়েদের তার চাই তাদের মোটামুটি সুশ্রী হতে হবে, পুরুষের চোখ টানার মতো কিছু প্রসাদ গুণ (অতসী গাঙ্গুলির ভাষায় ন্যাচারাল ভাইটালিটি উইথ প্রসপেকটিভ ফেমিনাইন কারুভস) তাদের থাকতে হবে। এটুকু থাকলে রুচি-বোধ, প্রখর বিচার বিবেচনা-যুক্তিবোধ, সব থেকে বেশি স্বাধীনচেতা আত্মবোধের স্বাদ আফিম গিলিয়ে আপন আপন জগতে তাদের এক-একটি সম্রাজ্ঞী করে তোলা এখন কঠিন ভাবে না অতসী গাঙ্গুলি। এরাই তার প্রতিশোধের ভবিষ্যৎ হাতিয়ার।

তার বাছাই প্রথম ব্যাচের পাঁচটি মেয়ের মধ্যে বি. এ আর এম, এ পড়ার ফাঁকে চারটির বিয়ে হয়ে গেছল। তাদের মধ্যে দুজনের ডিভোর্স হয়ে গেছে, একজনের ডিভোর্স কেস কোর্টে ঝুলছে। চতুর্থজন তার স্বামীকে ভেড়া বানিয়ে রেখেছে। পঞ্চমজন একের পর এক প্রত্যাশীদের বাতিল করে চলেছে। অতসীকে সে বলেছে তারও স্কুল টিচার হবার ইচ্ছে। হলে তো সোনায় সোহাগা। একবার যারা তার কেনা হয়ে গেছে, সময় আর সুযোগ হলেই তারা তাদের গুরুদেবীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। অতএব অতসী সকলের সব খবর পায়।..দ্বিতীয় ব্যাচের চারজনের মধ্যে বিয়ে হয়েছে দুজনের, একজনের ডিভোর্স কেস কোর্টে ঝুলছে, অন্যজন কোন এক বড় কোম্পানির রিসেপশনিস্ট-এর চাকরি জুটিয়ে স্বামীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে গেছে। বাকি দুজন প্রার্থীর আশায় ছাই ঢেলে চলেছে। তৃতীয় আর চতুর্থ ব্যাচের সাত আর ছয় তেরো জন এখনো অপেক্ষাকৃত নতুন। পুলকিত হবার মতো ঘটনা এখনো ঘটেনি বটে। কিন্তু যোগাযোগ কারো না কারো সঙ্গে হয়ই। যাকে দেখে, কথা-বার্তা শুনে হাসি-খুশির আত্মপ্রত্যয় লক্ষ্য করে অতসীর মনে হয় প্রত্যেকে তার নিজস্ব জগতের সম্রাজ্ঞটি হয়েই বসে আছে। তারা তাদের দিনের অপেক্ষায় আছে।

এবারের বাছাই আটটি মেয়ের ব্যাচের যে-মেয়েটি লিডার, তার ওপর অতসী গাঙ্গুলির চোখ আরো চার বছর আগে থেকে। ও মেয়ে যখন তার ছাত্রীই নয়, তখন থেকে। এখন বদ্ধ বিশ্বাস তার এতদিনের সব বাছাই মেয়েদের ওপর দিয়ে এই মেয়ে টেক্কা দেবে। দেবার মতো সমস্ত গুণই তার মধ্যে দেখেছে। মনে মনে অতসী গাঙ্গুলি তাকে বুকে আগলে রেখেছে।

…চার বছর আগের সেই কৌতুক প্রহসনটুকু ভোলার নয়। কোন টিচার অ্যাবসেন্ট থাকলে প্রিন্সিপালের হুকুম-মতো লিজার-আওয়ারের টিচার তার ক্লাস নিতে যায়। ক্লাস এইটের ম্যাথস টিচার অনুপস্থিত। অতসী গাঙ্গুলি তার ক্লাস নিতে ঢুকেছিল। ছাত্রী না হলেও সব ক্লাসের মেয়েরাই তাকে দেখলে খুশি হয়।

মেয়েদের ফ্র্যাকশন জ্ঞান দেখার জন্য অতসী ছোট্ট একটু বুদ্ধির অঙ্ক দিয়েছিল। একটা ফেন্স মানে বেড়ার মধ্যে পনেরোটা ভেড়া আছে, আর তাদের জন্য তিরিশ দিনের খাবার মজুত আছে। কিন্তু একটা ভেড়া ফেন্স টপকে পালিয়ে গেল। তাহলে বাকি চৌদ্দটা ভেড়ার ওই মোট খাবারে আরো কতদিন চলবে?

প্রশ্ন শুনে অনেক মেয়েরই ধাঁধা লেগে গেল। অনেকেই কলম নিয়ে খাতার ওপর ঝুকল। কোণের বেঞ্চের একটি মেয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। ভারী সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে, মুখে আর চোখে দুষ্টু-দুষ্টু মিষ্টি-মিষ্টি হাসে, এখনই বেশ লম্বা আর। সুডৌল স্বাস্থ্য, এক মাথা ঝাকড়া কোকড়া চুল। ছাই রংয়ের ওপর টকটকে লাল বর্ডার দেওয়া স্কুল ড্রেসে চমৎকার মানিয়েছে।

অতুসী গাঙ্গুলি জিজ্ঞেস করল, হয়েছে?

মাথা নাড়ল, হয়নি। তার পরেই প্রশ্ন শুনে অবাক।-ম্যাডাম, যে-ভেড়াটা ফেন্স টপকে পালালো সেটা কি পালের গোদা ভেড়া?

অতসী গাঙ্গুলি হাঁ কয়েক পলক।–তার সঙ্গে অঙ্কের কি সম্পর্ক?

–গোদা ভেড়া হলে তিরিশ দিনের খাবারই পড়ে থাকবে, বাকি চৌদ্দটা ভেড়াই ওটার পেছু পেছু ফেন্স টপকে পালাবে।

অতসী গাঙ্গুলি হেসে সারা, মেয়েরা আরো বেশি। হাসি থামতে বলল, আচ্ছা। গোদা ভেড়া নয় ধরে নিয়েই করো।

মেয়ে জবাব দিল-এর আর করার কি আছে, একটা ভেড়ার দুদিনের খাবার চৌদ্দটা ভেড়া খাবে–এর একটার ভাগে ওয়ান-সেভেনথ পড়বে, তাহলে টু ওয়ান সেভেনথ ডে চলবে।

বসে পড়ল। অতসী গাঙ্গুলির চোখে মুখে ঠোঁটে হাসি। হুকুম করল, দাঁড়াও।

তক্ষুনি উঠে দাঁড়ালো।

তোমার নাম কি?

–নূপুর সরকার।

-কংগ্রাচুলেশনস্, তোমাকে আমার মনে থাকবে। অন্য কয়েকটি মেয়ে বলে উঠল, ও ব্রাবর আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল ম্যাডাম।

অতসী গাঙ্গুলি মনে রেখেছে। পর পর দুবছর তাকে ফার্স্ট প্রাইজ নিতে দেখেছে। সঙ্গে ইংরেজির আরো অনেক প্রাইজ নিতে দেখেছে। ক্লাস টেনে উঠে তার ছাত্রী হয়েছে। অতসী গাঙ্গুলি ইংরেজি এস এ-কম্পোজিশন ক্লাস নেয়, প্রিন্সিপাল না এলে ইংরেজি টেক্সটও পড়াতে হয়। প্রিন্সিপালের থেকে মেয়েরা তার ক্লাসেই। বেশি মজা পায়। নূপুর সরকার তখনো অতসী গাঙ্গুলির বাছাই ব্যাচের কেউ নয়, বাছাই ব্যাচ সে ঘেঁকে তোলে এগারো আর বারো ক্লাসের মেয়েদের থেকে। কিন্তু এই একটি মেয়ের প্রতি আগে থাকতেই ষোল আনা মনোযোগ তার। শুধু চেহারাপ দেখার মতো হয়ে উঠেছে তা-ই নয়, দুষ্টুমিও বাড়ছে। এর ওপর তার সুন্দর ইংরেজি লেখা।

গেল সপ্তাহে এসএ লিখতে দিয়েছিল, এ পুওর গার্লস কনস্ট্রাকটিভ ফিউচার প্ল্যান। এ-রকম উদ্ভট বিষয় নিয়ে লিখতে মেয়েরা মজা পায়। যে যতটা পারে বুদ্ধি ফলাতে চেষ্টা করে। অতসী গাঙ্গুলি এতদিনে জানে নূপুর সরকার এখানকার একজন নামী ডাক্তারের মেয়ে, তার দাদাও ডাক্তার। কিন্তু গরীব মেয়ের ফিউচার প্ল্যান রচনায় কোনো মেয়েই তার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারল না। সুন্দর লিখেছে।

.

পরের সপ্তাহে এর উল্টো রচনা লিখতে দিল সকলকে। ধরো তোমাদের প্রত্যেকের কাছে দশ লক্ষ করে টাকা আছে, এবারে যার যার কনস্ট্রাকটিভ ফিউচার প্ল্যান লেখ।

সবাই দ্বিগুণ মজা পেয়ে লিখতে বসে গেল। একটু বাদে অতসী গাঙ্গুলির চোখ গেল, নুপূর সরকারের দিকে। সে লিখছে না, চুপচাপ বসে আছে।

–কি হল, ভাবছ?

নূপুর মাথা নাড়ল, ভাবছে না।

–তাহলে লিখছ না কেন?

জবাবে সেই দুষ্টু-দুষ্টু মিষ্টি-মিষ্টি হাসি। বলল, দশ লক্ষ টাকা থাকলে আমি কিছুই করব না। এমনি চুপচাপ বসে থাকব।

এই মেয়েকে নিয়ে অতসী গাঙ্গুলি কি করে, কোথায় রাখে? হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ে সব মেয়েকেই বলল, থাক বাপু থাক, আমার ঘাট হয়েছে, কাউকেই আর এই এস্এ লিখতে হবে না।

সেকেন্ডারি পরীক্ষায় আরো দশ পনেরোটা নম্বর বেশি পেলে নূপুর সরকার স্কলারশিপ পেতে পারত। ক্লাস ইলেভেনে এসে নূপুর আর আরো সাতজন তার হাতের মুঠোয়। এদের সকলকে উদ্যোগী হয়ে সে ইকনমিক্সএ টেনে এনেছে। তাতে বাছাই ব্যাচের অবধারিত লিডার নূপুর সরকার। লিডার কাউকে করতে হয় না, ব্যাচের সব থেকে চৌকস মেয়েটি লিডার আপনি হয়ে বসে। এই লিডার বলতে যার পরামর্শ আর বুদ্ধি নিয়ে ব্যাচের অন্যরা চলে ফেরে ওঠে বসে, গুরুদেবীর ভাব-ভাবনা আয়নার মতো দেখতে পায়।

ক্লাস ইলেভেনে নূপুর ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেছে। দেখা-মাত্র অতসী গাঙ্গুলির মনে হয়েছে কিশোরীর সমস্ত চিহ্ন মুছে দিয়ে চট করে মেয়েটা যৌবনের সিংহাসনে দিব্যাঙ্গনার মতো বসে গেল।

তার দিকে চেয়ে হাসিমুখে অভিনন্দন জানালো কংগ্রাচুলেশন!

-থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম।

পড়াশুনার মেজাজ আনতে গিয়ে সকলের উদ্দেশে অতসীর প্রশ্ন, আচ্ছা, ইকনমি বলতে তোমরা কে কি বোঝো বলো তো? নূপুর আগে বলো–

উঠে দাঁড়ালো। অতসী গাঙ্গুলি পুরুষের চোখ দিয়ে দেখছে ওকে, আর ভিতরটা ততো খুশি হয়ে উঠছে। এখন তো ছেনিখোন্তা মাল-মশলা সব তার হাতে, যাবে কোথায়!

নূপুর একটু ভেবে জবাব দিল, ইকনমি হল খরচ করার এমন একটা আর্ট, যাতে কোনো মজা নেই।

অতসী গাঙ্গুলি জোরেই হেসে উঠল।–আমার কাছে ফার্স্ট ক্লাস নম্বর পেলে, পরীক্ষার খাতায় গোল্লা।

নূপুর হাসতে হাসতে বসে পড়ল।

..দু বছরের মগজ ধোলাইয়ের ফাঁকে এই মেয়ে এমনি হাসির জবাব অনেক দিয়েছে।

প্রশ্ন : কমিউনিস্ট আর ক্যাপিটালিস্টের মধ্যে তফাৎটা কি চার-চারে আট লাইনের মধ্যে লেখ।

নূপুর সরকার দুলাইনের মধ্যে লিখেছে। কমিউনিস্ট বলবে এত কারো থাকা উচিত নয়। ক্যাপিটালিস্ট বলবে এতটা অন্তত সকলেরই থাকা উচিত।

প্রশ্ন : এ-দেশে প্রোটেকটিভ ফরেন হেল্প-এর চেহারাটা কেমন?

নূপুরের উত্তর : লাইক এ ফিমেল ড্রেস উইদাউট অবস্ট্রাকটিং দি ভিউ।

আর একটা তৎপর জবাব মনে পড়লে অতসী গাঙ্গুলি হেসে বাঁচে না। প্রঃ ছিল, ডাইরেক্ট ট্যাক্সেশন আর ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেশনের কিছু ভালো উদাহরণ দাও।

মেয়েরা লিখতে শুরু করে দিয়েছে। কোণের বেঞ্চ থেকে নূপুর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। দেহের ছাঁদ বদলেছে, কিন্তু চোখে আর ঠোঁটে সেই দুষ্টু-মিষ্টি হাসি লেগেই আছে।–একটা খুব রিয়েল আর ওরিজিন্যাল এগজাম্পল দেব ম্যাডাম?

–ও শিওর?

–আমার বউদি খরচের সতেরো ফিরিস্তি দিয়ে যে-টাকাটা আদায় করে নেয়, সেটা হল ডাইরেক্ট ট্যাক্সেশন। আর দাদা ঘুমিয়ে পড়লে যে টাকাটা তার পকেট থেকে হাতিয়ে নেয়, সেটা ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেশন।

এই উদাহরণ অতসী গাঙ্গুলির চিরদিন মনে থাকবে।

এ-ব্যাচেরও বারো ক্লাসের পরীক্ষা এসে গেল। মেয়েরা পড়াশুনায় ব্যস্ত। অতসী গাঙ্গুলিও তার বাছাই ব্যাচকে যতটা পারে এগিয়ে দেবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এ-বছরের মত তার মগজ ধোলাইয়ের পর্ব শেষ। সে পরিতুষ্ট, পরিতৃপ্ত। কেবল খেদ, নূপুর সরকারের মতো আবার একটি গড়ে তোলার মতো লিডার কবে পাবে।

এর মধ্যে আর্ট টিচার অমরেশ ঘোষ মুখখানা বেজার করে বলল, আপনার এবারের ব্যাচের ওই নূপুর সরকার মেয়েটি এত মিষ্টি এত ভালো, কিন্তু বেজায় ফাজিল। আমি তো হঠাৎ বুঝতেই পারিনি কি বলছে!

অতসী গাঙ্গুলি নূপুরের নাম শুনেই সচকিত একটু।–কেন, কি বলেছে?

–স্কুল থেকে কাল বাড়ি যাবার পথে রাস্তায় দেখা হতে আমাকে বলল, একটু নতুন কিছু আঁকুন না সার? কি-রকম জিজ্ঞেস করতে বলল, যেমন ধরুন, উমা নয়, শিব উমার জন্য তপস্যায় বসেছে গোছের…।

অতসী গাঙ্গুলি মনে মনে হেসে অস্থির। এ-রকম কথা নূপুর বলবে না তো কে বলবে। পরে ওর সঙ্গে দেখা হতে ছদ্ম কোপে চোখ পাকিয়েছে, এই মেয়ে আর্ট টিচার অমরেশবাবুকে কি বলেছিস?

ক্লাসের বাইরে নূপুর সরকারের এই ব্যাচটাকে তুমি ছেড়ে তুই বলা শুরু করেছিল। আর এই ব্যাচের মেয়েরাও বাইরে তাকে ম্যাডামের বদলে দিদি বলে। অতসীদি।

পরীক্ষা হয়ে গেল। বিদায়ের দিন এলো। অতসী গাঙ্গুলি প্রত্যেক ব্যাচকে বলে, নূপুর সরকারের হাত ধরে এই ব্যাচকেও তাই বলল।–মনে রেখো, ভালো যদি কিছু করে থাকি তোমাদের লয়েলটিটুকুই কেবল আমার প্রাপ্য, আর কিছু চাই না।

.

অতসী গাঙ্গুলির বাছাই ব্যাচের সব মেয়েরাই য়ুনিভার্সিটিতে ঢুকে ইকনমিক্স অনার্স পড়ে। এই ব্যাচে ব্যতিক্রম হল, নূপুর সরকার, ইংরেজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হল। অতসী গাঙ্গুলি এই মেয়ের বেলায় সেটাই স্বাভাবিক ভেবেছে। এটাই ওর সব থেকে প্রিয় সাবজেক্ট।

মনে মনে ভাবল, এটা মন্দ হল না, একজনের সম্পর্কে টাটকা খবর কিছু কিছু পাওয়া যাবে।

এখন ওই প্রিয় ছাত্রীর বাড়িতে যাতায়াতও সহজ হয়ে গেছে অতসী গাঙ্গুলির। ফাঁক পেলে নূপুরও বোর্ডিং-এ এসে তার সঙ্গে গল্প করে, চা-চপ-কাটলেট রসগোল্লা সন্দেশ খেয়ে যায়।

ঠোঁট টিপে হেসে অতসী গাঙ্গুলি জিজ্ঞেস করে, তোদের ডক্টর ঘোষাল কেমন পড়াচ্ছে?

প্রায় দুবছর আগে সমর ঘোষালের ডক্টরেট হবার খবর অতসী ঠিকই রাখে।

–খুব ভালো, তবে বেজায় গম্ভীর আর সীরিয়াস। তার প্রসঙ্গ কেন নূপুরও জানে।

–সেটা বরদাস্ত করছিস নাকি তুইও! চোখে মুখে মজার হাসি।–এতদিন আমার কাছে কি শিখলি তাহলে?…এক কাজ করতে পারিস, মেয়েরা স্পেশাল সাহায্যের জন্য ছুটির দিনে তার বাড়িতে পড়তে আসত, গাম্ভীর্য আর সীরিয়াসনেস খাঁটি কি নকল বোঝার জন্য তুইও এ-সুযোগটা নিতে পারিস। ৩৭৪

নূপুর হেসেছে কেবল, জবাব দেয়নি।

বি এ ফাইনালের ছমাস আগে একদিন এসে খবর দিয়েছে, কি-যে মুশকিল হল, পরীক্ষাটার মুখে ডক্টর ঘোষাল এই য়ুনিভার্সিটি ছেড়ে কলকাতার না কোন যুনিভার্সিটির রিডার হয়ে চলে গেলেন।

অতসী গাঙ্গুলির মুখখানা তেতে উঠল।–যাবে না তো কি, নিজের স্বার্থ ছেড়ে কে আর আমার মতো তোদের জন্য প্রাণটা দিয়ে পড়ে থাকে।

ফাইনাল পরীক্ষার খবর বেরুতে নূপুর এসে জানালো জার্নালিজম নিয়ে এম-এ পড়ার জন্য সে কলকাতায় চলল। অতসী গাঙ্গুলি প্রথমে ভাবল, ওর মাথায় আসে। পরে মনে হল, এই সাবজেক্টই ওর পক্ষে ভালো, এ-লাইনে থাকলে গর্তের অনেক সাপ টেনে বার করতে পারবে, অনেকের মুখোশ ছিঁড়ে-খুঁড়ে দিতে পারবে।

.

আরো বছর আড়াই কেটে গেছে। অতসী স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হয়েছে। বেয়ারা তার হাতে একটা ডাকের খাম দিয়ে গেল। খামের লেখাটা চেনা-চেনা মনে হল। খাম খুলে দেখল তাই। নিচে নূপুরের নাম।

শ্রীচরণেষু,

অতসীদি, আশা করি আমাকে ভুলে যাননি। গত আড়াইটা বছর দ্রুত তালে কেটে গেল। জেনে খুশি হবেন, এম এ জার্নালিজম এ ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি। তার আগে থেকে একটা কাগজে শিক্ষানবিসি করছিলাম, এখন সেই কাগজের সঙ্গেই যুক্ত হয়েছি।

আমাদের ব্যাচকে বিদায় দেবার কালে আপনি বলেছিলেন লয়েলটিটুকুই আপনার প্রাপ্য, আর কিছু চান না। অন্যদের কথা জানি না, আমি ভূলিনি। এখানে পড়ার সময় ইনভেসটিগেটিভ জার্নালিজম, বিষয়টির ওপর আমি বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলাম। আপনার প্রতি লয়েলটির কথা ভেবে আমার প্রথম অনুসন্ধানের বিষয় ছিল বিবাহ বিচ্ছেদ। অন্য দেশ বা রাজ্যের নয়, কেবল এই বাংলার। ভেবেছিলাম কাজটা কঠিন হবে না, কিন্তু শুরু করে দেখি আমি অথৈ জলে। হাজার-হাজার কেস-এর ফয়সালা হয়ে গেছে, হাজার-হাজার পেনডিং কেস লাখের দিকে গড়াতে চলেছে। দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিদেশের মতো অদূর ভবিষ্যতে এখানেও ডিভোর্স কোর্ট গজাবে। কাগজের সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে কেস স্টাডি করার কিছু সুবিধে হয়েছে। ডিভোর্স ছাড়া গতি নেই এমন বেদনাকরুণ ঘটনা অবশ্যই অনেক পেয়েছি। কিন্তু সামগ্রিক সংখ্যার তুলনায় নগণ্য। শতেকে নব্বইটির কাছাকাছি দেখলাম বিচ্ছেদের মূলে ব্যক্তিত্বের সংঘাত পারসোনালিটি ক্ল্যাশ। কত তুচ্ছ কারণে এই সংঘাত স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে বিচ্ছেদের প্রাচীর তুলে দিতে পারে দেখে আমি তাজ্জব। পরস্পরের সদয় বোঝা-পড়ার চেষ্টা, একটু অ্যাডজাস্টমেন্টের চেষ্টা এমন নির্দয়ভাবে অনুপস্থিত হয় কি করে? এর নাম ব্যক্তিত্ব না সুপারইগো?–আত্মকেন্দ্রিক অহংকার? যাক, এর পরে বেছে-বেছে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে নেমেছিলাম। প্রথমেই কার কাছে গেছি আপনি নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন–ডক্টর সমর ঘোষালের কাছে। কলকাতায় এসে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। তার সাহায্য সর্বদাই পেয়েছি। এব্যাপারে দেখলাম একমাত্র তিনিই অকপট হতে পেরেছেন, নিজের দোষ-ত্রুটি স্বীকার করেছেন। অন্য স্ত্রী পুরুষদের বেশিরভাগ ডিভোর্সের পরেও আক্রোশ নিয়ে বসে আছেন, পরস্পরের বিরুদ্ধে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করছেন।

…এরপর আরো একটু সমাচার আছে। আসছে সপ্তাহে ডক্টর ঘোষালের সঙ্গে আমার বিয়ে। পারস্পরিক বোঝাপড়া বা অ্যাডজাস্টমেন্ট সম্ভব কিনা সেটা ষোল আনা যাচাই করে দেখার জন্য একজন ভুক্তভোগীকেই জীবনে টেনে নিলাম। লয়েলটির এর থেকে বড় প্রমাণ আপনার সামনে আর কি রাখতে পারি? অবশ্য আপনার তুলনায় আমার একটু সুবিধেও আছে। বয়সে তিনি আমার থেকে দশ-এগারো বছরের বড়, আর স্নেহ নিম্নগামী, চেষ্টা সত্ত্বেও আমার দিক থেকে বোঝাপড়ার ত্রুটি দেখলে স্নেহের দায়ে তিনি উপেক্ষা করবেন বা শুধরে দেবেন এই বিশ্বাস আর জোরও আমার মনে আছে।…এর মধ্যেও আপনার কথা আমি ভেবেছি। আপনার মানসিকতার অনাপোস জয় যদি এখনো চান, মনে হয় সে-সময়ও একেবারে ফুরিয়ে যায়নি, এখনো আপনি আমাদের আর্ট টিচার অমরেশ ঘোষের দিকে ফিরে তাকাতে পারেন। প্রণতা, আপনার। স্নেহের নূপুর।

ক্রোধে আর আক্রোশে অতসী গাঙ্গুলি কাঁপছে থরথর করে। সেই ক্রোধ আর আক্রোশ চোখ দিয়ে ভেঙে পড়তে শয্যায় আছড়ে পড়ল। অনেক-অনেকক্ষণ একভাবে পড়ে রইলো।…প্রথম ঘণ্টার ক্লাস মিস হয়ে গেছে। উঠল। মুখ-হাত ধুয়ে এসে সামান্য কুঁচকে যাওয়া শাড়িটা বদলে আরো একটু চকচকে শাড়ি পরল। অভ্যস্ত তৎপরতায়। আবার প্রসাধন সেরে নিল। আয়নায় দাঁড়িয়ে রক্তিম দুই কানে, নাকের ডগায়, দুচোখের কোণে আর একটু পাউডার বোলালো। ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে করিডোর। ধরে দ্রুত সিঁড়ির দিকে চলল। দ্বিতীয় ঘণ্টার ক্লাস না, মিস্ হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress